কোলকাতা কেন্দ্রিক ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ আসলে ছিল ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’
নীল দর্পণ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করায় যে সমাজ সংস্কারক রেভারেন্ড জেলং এর জেল ও জরিমানা হয়েছিল, তিনি ১৮৬৯ সালের ২১ শে জানুয়ারী বেঙ্গল স্যোশাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের অধিবেশনে তৎকালে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করলেন। তিনি মন্তব্য করলেন; জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তুপ এবং শোচনীয় সামজিক দুরবস্থার দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এদেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এক সময় যারা এত বড় একটা রাজ্য শাসন করেছেন, আজ তাদের বংশধররা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। ….. বাংলাদেশের কোনও গভর্ণমেন্ট অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু মুসলমান দফতরী পিওন সব অফিসে ভরে গেছে …..।
তাই অবস্থাদৃষ্টে একথা প্রমানিত হয়েছে যে, আলোচ্য শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ বাঙালি হিন্দুরা যেভাবে সানন্দে গ্রহণ করেছিল, বাঙালি মুসলমানরা সেভাবে করেনি। পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট মার্কসিস্ট গবেষক ও সমালোচক বিনয় ঘোষের মতে, ক্ষমতাচ্যুত মুসলমান সমাজের ইংরেজ বিদ্বেষ এবং নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গর্ববোধ ও রক্ষণশীলতা এবং স্বাভাবিক ইংরেজ বিদ্বেষের জন্য সে সময় ইংরেজের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তাদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। প্রথম যুগে ইংরেজদের সমস্ত কার্যকলাপ তারা সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনও তারা সুনজরে দেখেননি। এই অসহযোগিতার ও গোড়ামির জন্যই তারা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পেছনে পড়ে গেছেন। …… মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাব থাকার জন্য ইংরেজ শাসকরাও হিন্দুদের মতন শিক্ষার সুযোগ মুসলমানদের দেয়নি।
এ সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, প্রথম যুগে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের নীতি মুসলমান বিদ্বেষ এবং হিন্দু পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের সরকারি চাকরিও পেয়েছেন। মুসলমানরা সেরকম সুযোগ বা উৎসাহ পাননি। নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে গর্ববোধ তাদের ছিল।….
ইংরেজদের নতুন জমিদারি ব্যবস্থার ফলে শুধু যে মুসলমান জমিদার জায়গিরদারেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন তা নয়, বাংলার যে কৃষক প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হলো তাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। বাংলার প্রায় প্রত্যেক জেলায় এই উৎখাত নি:স্ব প্রজাদের ধুমায়িত বিক্ষোভ ও কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করল। সেই সময় এল ওয়াহাবী আন্দোলনের ঢেউ। ধর্মান্দোলনের ঢেউ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর ইংরেজ বিদ্বেষের এই সম্মিলিত প্রকাশকে ব্রিটিশ শাসকরা ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদ বলে প্রচার করলেন। বাঙালি মুসলমানদের এই মনমানসিকতা সম্পর্কে লর্ড এলেনব্যুরোর মন্তব্য হচ্ছে, ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের একটা জন্মগত বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস (প্রবলেম্স অব ইন্ডিয়া : সেলভনকর : পৃ: ২২)।
১৮৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী কোলকাতায় অনুষ্ঠিত বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন এর দ্বিতীয় অধিবেশনে জনাব এ লতিফ বাংলাদেশে মুসলমানদের শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে যে নিবন্ধ পাঠ করেন, সে সম্পর্কে আলোচনাকালে ইংরেজ বিচারপতি জ্রে বি ফিয়ার এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তিনি বলেন, ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে এদেশের মুসলমান ভদ্রশ্রেণী লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মান লাভে তারা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রশ্রেণী থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে রযেছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।
তাই এ সময়কালের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একদিকে ক্ষমতা হস্তচ্যুত হওয়ায় মুসলমান বিত্তশালীরা কিছুটা আক্রোশ ও কিছু অভিমানে ইংরেজ রাজশক্তি থেকে নিরাপদ দুরত্বে চলে গেছে এবং পাশ্চাত্য ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আচার ব্যবহার, রীতিনীতি সব কিছুকেই বর্জন করেছে। অন্যদিকে অভিভাবকহীন বাংলার মুসলিম গণমানুষের নেতৃত্ব সবার অলক্ষ্যে এক শ্রেণীর মোল্লা মৌলভীর (অনেকেই উত্তর ভারতীয় অঞ্চল থেকে আগত) কুক্ষিগত হয়েছে। এরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি এবং কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করল। সর্বোপরি এরা বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ধরনের জগা খিচুড়ি ভাষা ও তমুদ্দুন এর প্রবর্তন করল।
এতসব ঘটনা প্রবাহের আলোকে একথা নি:সন্দেহে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজ জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে এবং ইংরেজ পৃষ্টপোষকতায় কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হলো, বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত ও বিত্তশালীরা অন্তত তার অন্তর্ভূক্ত হলো না। এজন্য কারা দায়ী সে কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ না করেও শুধু এটুকু মন্তব্য করা যথার্থ হবে যে, এটাই হচ্ছে বাস্তব ও ঐতিহাসিক সত্য। সে আমলের বাংলার এই নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছুতেই ধর্ম নিরপেক্ষ ছিল না। অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মুল ভিত্তি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার চৌহদ্দিতেই গড়ে উঠে নির্ভেজাল প্রকৃত জাতীয়তাবাদ।
বাংলার ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে পুরো ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, তাদের কর্ণধারেরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবিদার হিসেবে যত কথাই বলে থাকুক না কেন, তা আসলে বাঙালি হিন্দু জাতিয়তাবাদের কথাবার্তা। এজন্যই তো ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দপাঠ’ এর মুল সুরই হচ্ছে যবন বিরোধী। সে আমলে এদের রচিত বাংলা সাহিত্যের সর্বত্রই হিন্দুয়ানীর ঢক্কানিনাদ, বন্দেমাতরম স্লোগানের আড়ালে সামগ্রিকভাবে বাঙ্গালি সমাজের দেশপ্রেমের বহি:প্রকাশ দেখতে পেত। (পরবর্তী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ সহ জনাকয়েক ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। মানব প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী।)
সুষ্ঠু ও একটা পরিচ্ছন্ন আলোচনার সুবিধার্থেই বঙ্গীয় এলাকায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টির গোড়ার কথা এবং এদের বিকাশের ধারাবাহিতা দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকায় কোলকাতার বাসিন্দাদের ব্যাপক বিকাশের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এক শ্রেণীর বাঙালি শিক্ষিত হিন্দু বিদেশী রাজশক্তির সহযোগির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্বল্প দিনের ব্যবধানে অত্যন্ত দ্রুত এরই ধারাবাহিকতার জের হিসেবে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী (এটাকেই জাতীয়তাবাদী বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা করা হয়।) পূর্ণতা লাভ করে।
(চলবে)
কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি (পৃষ্ঠা ২৯-৩১) থেকে সম্পাদিত।
No comments:
Post a Comment