পর্ব দুই।
রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ।
রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ : সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এদেশের ক্ষমতা দখলের পর তাদের সহায়তাকারী হিন্দুদেরকে বলল, পূর্বে তোমাদের সব ছিল। যথাÑ তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি ছিলে, তোমাদের ইতিহাস ছিল, বিজ্ঞান ছিল, আভিজাত্য ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলমানরা এদেশ দখল করে তোমাদের ইতিহাস, বিজ্ঞান, জাত্যাভিমানসহ সবকিছু বরবাদ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা পুনরায় তোমাদেরকে সবকিছু দেব। এভাবে ইংরেজ চাটুকারগণই μমে μমে বর্ণ হিন্দুতে ও বাঙ্গালীতে পরিণত হলো এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে ভীত হয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হলো। ইংরেজদের পরামর্শ মোতাবেক অনেক খোঁ জাখুিঁ জ করেও যখন এদেশের বর্ণ হিন্দুরা নিজেদের কোন গৌরবময় ইতিহাস খুেঁ জ পেল না তখন তারা হতাশ হয়ে নিজেদেরকে অপাংক্তেয় মনে করল এবং রাজপুত, মারাঠা ও শিখ জাতির বীরত্বগাথা দিয়ে কবিতা, কাব্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও ইতিহাস রচনা শুরু করল। এরূপ করতে গিয়ে এ সকল হতাশ বর্ণহিন্দুরা বাঙালী জাতীয়তাবোধকে হারিয়ে ফেলল এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ অভিমুখে ধাবিত হয়ে নিজেদের ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতিসত্তাকে সর্বভারতীয় জাতিসত্তার বেদীমূলে বিসর্জন দিয়ে আত্মহত্যা করল। মূলত: সমগ্র ভারত জয় করার পূর্বে বাংলাভাষীদেরকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করার জন্য হিন্দুদেরকে ইংরেজরাই প্রমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। সমগ্র ভারত কুক্ষিগত করা শেষ হলে ব্রিটিশ রাজশক্তি উক্ত বাঙালীদেরকে পর্যায়μমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করে। ব্রিটিশের এ সকল কূটবুদ্ধি বুঝতে না পেরে তৎকালীন বাঙালী জাতীয়তার কর্ণধারগণ নিজ জাতি সম্পর্কে হতাশ প্রতিμিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠকবৃন্দ অনুধাবনে সক্ষম হবেন আশা করি।
১. বাঙালীর বল নাই, বিμম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই, সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল। বাংলায় যে কেহ কিছু করিয়াছেন সকলেই তৈলের জোরে। (হরপ্রসাদ রচনা সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯২)
২. “বাঙলার ইতিহাস নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙলার বিদেশী, বিধর্মী, পরপীড়কদিগের জীবন চরিত মাত্র। বাঙলার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙলার ভরসা নাই। কে লিখিবে?” [একটু খেয়াল করলে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন বঙ্কিমবাবু ইতিহাস বলতে কাদের ইতিহাস বুঝিয়েছেন। আবার বিদেশী ও বিধর্মী বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? জীবন চরিত বলতে কাদের ইতিহাসকে বুঝাচ্ছেন?]
৩. রবীন্দ্রনাথও পূর্বোক্তদের ন্যায় বাঙালী জাতি সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তিনিসহ তৎকালীন বাঙালী জাতীয়তার কর্ণধারগণ বাংলাদেশে কোন বীর পুরুষ, মহান পুরুষ খুঁজে না পেয়ে দস্যু শিবাজীকে হিন্দু পুনরুত্থানের নায়ক বানিয়েছেন এবং বাংলাভাষী হিন্দু জাতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে সর্বভারতীয় জাতীয়তায় নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
১.
সাত কোটি বাঙালীরে- হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালী করে- মানুষ করনি।
(রবীন্দ্রনাথ)
২.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় বাঙালী হওয়া অপেক্ষা আরব বেদুইন হওয়াকে সম্মানজনক বলেছেন। মর্মে যবে মত্ত আশা সর্প সম ফোঁসে
অদৃষ্টের বন্দনেতে দাপিয়া বৃ া রোষে,
তখনও ভাল মানুষ সেজে
বাঁধানো হুকা যতনে মেজে,
মলিন তাস সজোরে ভেজে
খেলিতে হবে কষে।
অনড়বপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব
জনাদশেক জটলা করি’ তক্তপোষে বসে।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি
মুখের ভাব শিষ্ট অতি
অলস দেহ ক্লিষ্ট গতি
গৃহের প্রতি টান,
তৈলঢালা সিড়বগ্ধ তনু নিদ্রা রসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালী সন্তান।
বাঙালী মোরা ভদ্র অতি পোষমানা এ প্রাণ,
বোতাম আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান।
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন,
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি
জীবন স্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয় তলে বহ্নি জ্বালি’
চলেছি নিশিদিন,
বরশা হাতে ভরসা প্রাণে সদাই নিরুদ্দেশ।
মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন।
পাদুকা তলে পড়িয়া লুটি।
ঘৃণায় মাথা অনড়ব খুঁটি
যেতেছ ফিরি ঘর
ঘরেতে বসে গর্ব কর পূর্ব পুরুষের
আর্য তেজ দর্পভরে পৃথিবী থর থর।
হেলায় মাথা দাঁতের আগে মিষ্ট হাসি টানি’
বলিতে আমি পারিবনাতো ভদ্রতার বাণী।
উচ্ছ্বসিত রক্ত আসি বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি,
প্রকাশহীন চিন্তা রাশি করিছে হানাহানি,
কোথাও যদি ছুটিতে পাই বাঁচিয়া যাই তবে
ভব্যতার গণ্ডি মাঝে শান্তি নাহি মানি।
৩. দুরন্ত আশার শেষ দুইটি লাইনে তিনি যা বলেছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে বাঙালীত্বে তিনি খুশী নন। বাঙালীত্ব থেকে বেরিয়ে তিনি কোথায় যেতে চান তাও তিনি অব্যক্ত রাখেননি। মারাঠা দস্যু শিবাজীর জন্য তিনি লিখলেনÑ
সেদিন শুনিনি কথা, আজি মোরা তোমার
আদেশ শির পাতি লব,
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে
সর্বশেষ ধ্যানমন্ত্র তব,
এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে এ মহাবচন
করিব সম্বল।
৪. শিবাজী এবং রবীন্দ্রনাথের রুচিবোধ :
বাঙালী জাতীয়তাবাদের কর্ণধারগণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দরুন বাংলা মুলুকে কোন বীর পুরুষের খোঁজ না পেয়ে মারাঠা দস্যু সর্দার শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে বরণ করে নেয়। তাই শিবাজী সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ করলে রবীন্দ্র জাতীয়তাবোধ ও রবীন্দ্র রুচির বিশেষত্ব সম্যক উপলব্ধি করা সহজ হবে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন জাতির উত্থান হয়। এর নাম মারাঠা জাতি। শিবাজীরা ছিলেন ভোঁসলে পরিবারের সদস্য। এই পরিবার ছিল কৃষিজীবী। শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে প্রমে নিজাম শাহী সুলতানের পরে আদিল শাহী সুলতানের অধীনে চাকুরি করে প্রতিপত্তি ও জমিদারী লাভ করেন। হঠাৎ উনড়বতির আতিশয্যে অনেক সুন্দরীর সহজ প্রাপ্তিতে তিনি তাঁর প্র মা স্ত্রী জীজাবাঈকে উপেক্ষা করেন। জীজাবাঈ স্বামী সংসার ত্যাগ করে অশিক্ষিত এক ব্রাহ্মণ কোন্দদেবের আশ্রিতা হন। কোন্দদেব নিরক্ষর শিবাজীকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে গড়ে তোলেন।
শিবাজী বয়ঃপ্রাপ্তির পর কোন্দদেবের শিক্ষা কাজে পরিণত করতে ‘মাওয়ালী’ নামে দুর্ধর্ষ অসভ্য পার্বত্য জাতির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। মিত্রতার প্রধান শর্ত হলো মারাঠা ও মাওয়ালীরা একতাবদ্ধ হয়ে লুটতরাজ করবে এবং প্রত্যেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের যথাযথ হিস্যা পাবে। শিবাজীর নেতৃত্বে গঠিত ডাকাত দল সারা ভারতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লুটতরাজ করতো। রাতের আঁধারে অতর্কিত আμমণ করতো নিরীহ গ্রাম ও নগরবাসীর উপর। সোনাদানা-অর্থ লুট করতো, নারীশিশুদেরকে μীতদাস করে দাসবাজারে বিμয় করতো। তাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে এদেশের মানুষ এতো আতঙ্কগ্রস্ত ছিল যে, ছোট শিশুদের কানড়বা থামানোর জন্য বাংলার মায়েরা মারাঠা বর্গীদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো! এরূপ একটি বহুল প্রচলিত ছড়া হলো :
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল।
বর্গী এল দেশে।।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে বার বার পরাজিত হয়ে শিবাজী গোপনে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৬৭৪ সালের ১২ জুন কোম্পানীর দূত হেনরী ওকসিন্ডেন গোপনে শিবাজীর পার্বত্য দুর্গে এসে মোগল শক্তি ধ্বংসে চুক্তিবদ্ধ হন। ইংরেজদের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করে শিবাজীর লুটতরাজ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিক শ্রী অজয় কর তাঁর ‘ঐতিহাসিক প্রশেড়বাত্তর’ বইতে মারাঠা বর্গীদের ভূমিকাকে নিমেড়বাক্তভাবে চিত্রিত করেছেন।
ক. “ইংরেজ বণিকেরা বর্গী হাঙ্গামার সুযোগে নবাবের কোন অনুমতি গ্রহণ না করিয়া কলিকাতার দুর্গ নতুন করিয়া গড়িতে আরম্ভ করিল।”
খ. “এইরূপে রঘুজী (মারাঠা) পুনঃ পুনঃ বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করিতে লাগিল। আলীবর্দ্দী কিছুতেই তাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা নিহত করাইল।”
গ. “মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্যরা এদেশে বর্গী নামে পরিচিত। আলীবর্দ্দী খাঁর সিংহাসনারোহণের পূর্ব হইতে তাহারা সময়ে অসময়ে মোগল সাম্রাজ্য আμমণ করিয়া লুটপাট করিত। আলীবর্দ্দী খাঁর আমলে এদেশে যে আμমণ ও লুণ্ঠন চলিতে থাকে তাহাই ‘বর্গীর হাঙ্গামা’ নামে পরিচিত।”
ঘ. “বর্গীরা তখনকার শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎ শেঠের বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া প্রায় আড়াই কোটি টাকা লইয়া প্রস্থান করে।”
দস্যু সর্দার শিবাজীর মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল ১৬৮০ সালে। এই সংবাদ শুনে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মন্তব্য ছিল : “আমার দয়া, ক্ষমা, উদারতা, সহনশীলতা এবং দাক্ষিণাত্যে আমার অনুপস্থিতির সুযোগেই শিবাজী ক্ষণিকের ‘ইঁদুর রাজা’ হয়ে মরল।” (উল্লেখ্য, সম্রাট আওরঙ্গজেব দীর্ঘ ২৪ বছর দাক্ষিণাত্যে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রতিনিধিরাই দাক্ষিণাত্য শাসন করতেন)।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথসহ সকল বর্ণহিন্দু বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ মারাঠা, রাজপুত ও শিখদের সে সকল ব্যক্তিদের বন্দনা করেছেন, যাদের সাথে মুসলমানদের সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু যেসব মারাঠা, শিখ ও রাজপুত ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ গং তাদের বীরত্বের পক্ষে কিছুই লিখেননি। এর থেকে কি একথাই প্রমাণ হয় না যে, তৎকালীন বাঙালী বাবুরা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মসীযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন?
৫. ডাকাত সর্দার শিবাজীর জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যুবলি’ করে পরিহাস অট্টহাস্য রবে,
তব পুণ্যচেষ্টা যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস এই জানে সবে।
...... ...... ...... ......
অশরীরি হে তাপস, শুধু তব তপমূর্তি লয়ে আসিয়াছ আজ,
তবু তব পুরাতন সেই শক্তি আনিয়াছ ব’য়ে, সে তব কাজ।
মারাঠীর সাথে আজি হে বাঙালী এক কণ্ঠে বল জয়তু শিবাজী,
মারাঠীর সাথে আজি হে বাঙালী, একসঙ্গে চল মহোৎসবে সাজি।
(কবির উপরোক্ত আহ্বানে সাড়া দিতে হলে মারাঠার সাথে বাঙালীরা এক সাথে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হতে হবে, বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। সবকিছু করতে রাজী হলেও যবনগণ কবির স্বদেশবাসীর অন্তর্ভুক্ত নয়।) নিমেড়বর উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন:
৬. ঠাকুরবাড়িতে আর একটি সভা সৃষ্টি হয়েছিল বিষবৃক্ষের মত, সেটি হল সঞ্জীবনী সভা। কবির মতে সেটা স্বাদেশিকের সভা। সভ্যদের দীক্ষা দেওয়া হত ঋক বেদের মন্ত্র পড়িয়েÑ ঋক বেদের পঁিু থ, মরার মাথার খুিল ইত্যাদি নিয়ে এখানে যে সভা হতো তা বাস্তবিক সত্য। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১৬৭)।
উপরোক্ত অবস্থায় বিশ্ব কবির স্বজাতি কারা, বিজাতি কারা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোপরি বিশ্বকবির স্বজাতিদেরকে তৎকালে বলা হতো বাঙালী আর বিজাতিদেরকে বলা হতো মুসলমান।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা, যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। উক্ত দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু ছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন। রামমোহন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ইংরেজদের খুশী করার জন্য খ্রীস্টান ধর্মের অনুকরণে এক নতুন ধর্ম তৈরি করেন। উক্ত নতুন ধর্মে ঈশ্বর এক, সাকার পূজা নিষিদ্ধ, হিন্দু দেব-দেবী পূজা-অর্চনা ও পৈতে ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বারকানাথও তাঁর গুরু রামমোহনের শিষ্যত্বের মাধ্যমে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তবে এ ঘোষণা ছিল বাহ্যিক। দ্বারকানাথ নিজের ছেলে ও নাতিদের নামের সাথে হিন্দুদের বড় দেবতা ইন্দ্রের নাম সংযুক্ত করেন এবং তাঁর বংশের সব মেয়ের নামের সাথে যুক্ত হয় দেবী উপাধি। শুধু তাই নয়, ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ঘোষণা দিলেও পরিবারের মেয়েদেরকে বিয়ে দেন ব্রাহ্ম পাত্রদের পরিবর্তে হিন্দু পাত্রদের নিকট।
রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথও প্রকাশ্যে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন কিন্তু বাস্তবে ছিলেন ঘোরতর ব্রাহ্মণ্যবাদী। কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণিত হবে।
১. “দেবেন্দ্রনাথকেও দেখা যাচ্ছে, দুর্গো পূজার সময় পূজোর সব ব্যবস্থা করে দিয়ে পূজোর কটা দিন সরে পড়তেন অন্য কোথাও।” (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, . ৩৬)।
২. দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হিন্দু পদ্ধতিতেই করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, “মাতা, পিতা, স্ত্রী, পুত্রকে দুঃখ দিয়ে স্বজাতি হইতে পৃ ক হওয়া কর্তব্য নহে।” (দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী, পৃ. ৫০)।
৩. ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের পৈতে ত্যাগ করা জরুরী ছিল। দেবেন্দ্রনাথ নিজে পৈতে ত্যাগ করলেও পুত্র রবীন্দ্রনাথের যথারীতি উপনয়ন অনুষ্ঠান করে পৈতে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। (রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত, পৃ. ১৯৯)।
৪. ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতিভেদ প্র া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতদ্সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠান থেকে রাজনারায়ণ বসুকে শূদ্র বলে অপমান করে বহিষ্কার করা হয়েছিল। (ঐ, পৃ. ১৯৯)।
৫. রবীন্দ্রনাথ যখন পিতা হলেন তখন পুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়নের ব্যবস্থা করা হয়। উপনয়নের সময় রথীন্দ্রনাথকে হিন্দু নিয়মে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল এবং তিনদিন যাবত শুদ্র বা ছোটলোকের মুখদর্শন থেকে বিরত রাখার জন্য ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। (ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃ. ১৩০)
৬. বাংলা ১৩১১ সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলে নোবেল পাওয়া কবি, ব্রাহ্ম ধর্মের গুরু রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে গেলেন এবং হিন্দু ধর্মের নিয়মে স্বীয় সযতড়ব লালিত কেশ, দাড়ি, গোঁফ মুণ্ডন করলেন। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, ঐ, পৃ. ১৬৭)।
৭. ব্রাহ্ম ধর্মের কবি রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে লিখলেন, “ভারতবর্ষে যথার্থ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজের অভাব হইয়াছেÑ দুর্গতিতে আμান্ত হইয়া আমরা সকলে মিলিয়াই শুদ্র হইয়াছি।” আরও লিখলেন, আমি ব্রাহ্মণ আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্প হৃদয়ে লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। (এপ্রিলÑ১৯০২, ‘প্রবাসী’, পৃ. ৬৫৭)
৮. রবীন্দ্রনাথ সাধারণ কোন ব্রাহ্ম ছিলেন না। তিনি ছিলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক। মুখে ব্রাহ্ম হলেও তিনি ছিলেন কর্মে ব্রাহ্মণ। তাই তিনি লিখতে পারলেনÑ
“বেদ, ব্রাহ্মণ, রাজা ছাড়া আর
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার।” (পূজারিনী দেখুন)
উপরোক্ত অবস্থায় কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে ভণ্ড-প্রতারক বলে অথবা কট্টর বর্ণবাদী বলে তবে তাঁর মুখ বন্ধ করার যুক্তি কী?
রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ
রবীন্দ্র যুগে এদেশ পরাধীন ছিল। তখন এদেশে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামে এদেশ আলোড়িত হয়েছিল। যথাÑ স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। উক্ত আন্দোলনসমূহে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কি ছিল তার নিরিখেই আমরা বিচার করব রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ কি ছিল? লক্ষ্য- উদ্দেশ্য কি ছিল?
স্বাধীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ
১. রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা বা ফ্রীডমকে ভাল চোখে দেখেননি। পশ্চিমী রাষ্ট্রদর্শনে যাকে ফ্রীডম বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাকে চঞ্চল, ভীরু, স্পর্ধিত ও নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়েছেন। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ভারতবর্ষ ও স্বদেশ, খণ্ড ১২, পৃ. ১০২৫)।
২. সমাজ বিরোধীরা অন্যায়, খুন, জখম করে যেমন অপরাধী হয়, রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতার নামে হত্যা, লুটপাটকেও রবীন্দ্রনাথ ঐরকম সমান অপরাধ মনে করতেন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দণ্ডনীতি, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪৪)।
৩. ইংরেজ শাসনের পক্ষে তিনি লিখেনÑ “রাগ করিয়া যদি বলি, ‘না আমরা চাই না’ তবুও আমাদিগকে চাহিতেই হইবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এক হইয়া মহাজাতি বাঁধিয়া উঠিতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের যে প্রয়োজন তাহা কখনোই সম্পূর্ণ হইবে না” (ড. অরবিন্দ পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৩৩)।
৪. কবি আরও লিখেন, ইংরেজদের আহবান আমরা যে পর্যন্ত গ্রহণ না করিব, তাহাদের সঙ্গে মিলন যে পর্যন্ত না সার্থক হইবে, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে বলপূর্বক বিদায় করিব, এমন শক্তি আমাদের নাই। যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কুরিত হইয়া ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিনড়ব হইয়া উঠিতেছে, ইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই ভারতবর্ষ সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষ আমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে দূর করিব, আমাদের এমন কী অধিকার আছে, বৃহৎ ভারত বর্ষের আমরা কে? (ড. পোদ্দার, ঐ, পৃ.১৩৫)।
ইংরেজদের বশংবদ গোলাম রবীন্দ্রনাথের উক্তরূপ আরও বহু স্বাধীনতাবিরোধী মন্তব্য ও উক্তি রহিয়াছে। পাঠক মহলই বিবেচনা করে দেখবেন এই স্বাধীনতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের গোলাম রবিবাবু স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের আদর্শ হতে পারে কিনা? ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পিত বাঙালীদের জন্যই রবীন্দ্রনাথ আদর্শস্থানীয় হতে পারে, তার সাহিত্য প্রেরণার উৎস হতে পারে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ
প্রশাসনিক সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার যখন বৃহত্তর বঙ্গকে দুই ভাগ করে পূর্ব বাংলা ও আসামকে একটি প্রদেশের মর্যাদা দিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে তখন বাঙালী বাবু সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা পর্যন্ত বাঙালী হিন্দু সমাজ কখনো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও করেনি। অথচ উক্ত ১৪৮ বছর বাংলার ও ভারতের মুসলমানগণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, অগণিত মানুষ আহত, নিহত, পঙ্গু, দীপান্তর ও কারান্তরালে গিয়েছিলেন। মুসলমানদের এ সকল আন্দোলনে বাঙালী হিন্দুরা বরাবরই প্রকাশ্যে ব্রিটিশের পক্ষে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বঙ্গভঙ্গে বাঙালী হিন্দুদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল এবং মুসলমানদের উনড়বতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বিধায় তথাকথিত মানবতাবাদী কবি ব্রিটিশের গোলামীর পরিবর্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯০৫ সালের ২৪ ও ২৭ সেপ্টেম্বরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দু’টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলিকাতাতে। রবিবাবু উভয় সভার সভাপতি ছিলেন।
কলিকাতার হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গ বিভাগ দিবস ১৬ অক্টোবরকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করে। কংগ্রেস শোক দিবস উপলক্ষে নিুোক্ত কর্মসূচি পালন করে।
১. রাখী বন্ধন উৎসবÑ রবিঠাকুর এর প্রবক্তা। হিন্দুদের ‘মঙ্গল সুতা’ বন্ধনের আদলে ঐদিন বাহুতে রঙিন ফিতা বাঁধার ব্যবস্থা করা হয়।
২. উপবাস ব্রত পালন- খুব সকালে উপবাস অবস্থায় খালি পায়ে হেঁটে আত্মশুদ্ধির জন্য গঙ্গাসড়বানে যেতে হবে। এই শোক দিবসের গঙ্গাসড়বান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রার্থনা সঙ্গীত গাইলেন। সমবেত বাঙালী বাবুরা উক্ত গানটি উচ্চস্বরে গাইলেন।
বাংলার মাটি, বাংলার জল
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,পুণ্য হউক
হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট
বাংলার বন, বাংলার মাঠ
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর পণ, বাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজ, বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক এক হউক এক হউক
হে ভগবান।
ভগবানের নিকট প্রার্থনা শেষে রাখীবন্ধন অনুষ্ঠান করা হয়।
একই দিন বিকেলে রবি ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গ ভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ফেডারেশন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য ছিল-
“যেহেতু বাঙালী জাতির সর্বাঙ্গীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গ ছেদন করিয়াছেন, সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গছেদের কুফল নাশ করিতে, বাঙালী জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব।” (আহসানুল্লাহ, অখণ্ড বাংলার স্বপড়ব, পৃ. ৮২০-৮৩)।
রবিঠাকুরের অন্য রূপ
বাংলায় এবং ভারতে ব্রিটিশবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে রবি ঠাকুর সকল আন্দোলনে ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। ১৭৫৭ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ইঙ্গ-হিন্দু শাসন-শোষণে ভিক্ষুকে পরিণত হওয়া মুসলমানদের পক্ষে তার কলম থেকে একটি শব্দও বের হয়নি। কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম করেও যখন বঙ্গভঙ্গকে ঠেকানো গেল না তখন তিনি মুসলমানদের সহানুভূতি লাভে কিছু কিছু ভালো ভালো কথা লিখার চেষ্টা করেছেন।
গরজ বড় বালাই। রবিবাবুর জমিদারীর এলাকা ছিল খণ্ডিত পূর্ব বাংলায়। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা বন্ধ করে কবি তাঁর লেখনীকে অসাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শত হলেও তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণদের চেয়েও গোঁড়া। তাই শব্দ চয়নে অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলেও ভাবের দিক থেকে কবির লেখনী আগের মতই থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ এরূপ দু’টি জনপ্রিয় কবিতার বিষয় পাঠকদের অবগতির জন্য পেশ করছি। একটি পূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে : যথাÑ
বাংলার মাটি বাংলার জল ... .... ....
বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
অসাম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ‘জল’কে পানি বলতে পারেননি, হিন্দু কালচারের ‘তিন সত্যি’কে আঁকড়ে ধরেছেন এবং ভগবান শব্দের পরিবর্তে স্রষ্টা বা অন্যকিছু বলতে পারেননি।
অপর গানটি বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজীবন ফ্রীডম বা স্বাধীনতা বিরোধী লেখকের কবিতা ও গান স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু শাণিত করে তা আমি জানি না। তবে উক্ত গানটিও যে কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের আদলে রচিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ‘বন্দে মাতরম’ কবিতাটিতে মায়ের বন্দনা করা হয়েছে। এই মা বলতে বঙ্কিম কি বুঝাতে চেয়েছেন পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন : পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক ড. অরবিন্দু পোদ্দারের মতে,
“... বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদকে একটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আলোকে মণ্ডিত করেন। ভারতবর্ষ নামক যে একটি ভৌগোলিক সত্তা, তাকে তিনি মাতৃরূপে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, এই মাতৃ ভাবনা স্বর্গীয় দেবী ভাবনার সমতুল্য। ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতে তিনি দেশ জননীকে দুর্গা, লক্ষ্মী ও স্বরস্বতীর সঙ্গে একাত্ম বলে বর্ণনা করেছেন।... অন্য কথায়, হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং তারই অনুপ্রেরণায় ভবিষ্যত ভারতকে নির্মাণ করার আদর্শ তিনি (শ্রী অরবিন্দু) প্রচার করেছিলেন।... হিন্দু ঐতিহ্য আশ্রিত সমস্ত লেখকের দৃষ্টিতেই... সৃজনধর্মী ও বুদ্ধিমার্গীয় উভয়ত:... শ্রীকৃষ্ণই হলেন একমাত্র পুরুষ যিনি বর্তমানের পরাধীন ও শত লাঞ্ছনায় ছিনড়বভিনড়ব ভারতবর্ষকে এক শক্তিশালী প্রগতিশীল দুর্জয় সত্তায় রূপান্তরিত করতে পারেন।... তাঁদের সুদূর বিশ্বাস কেবলমাত্র হিন্দু দার্শনিক চিন্তা, জীবদর্শন এবং এর সংশেষবাদী ধর্ম দ্বারাই অতীতে এই বিরাট ভূখণ্ড ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্য অর্জিত ও সুরক্ষিত হয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় সেই আদর্শের শক্তিতেই নবভারতের আবির্ভাব ঘটবে।” (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : ১৯৮২ ‘উচ্চারণ’ কলিকাতা)
হিন্দু ঐতিহ্য ‘মা’ বলতে কাকে বুঝায়, মায়ের কষ্টে সন্তানদের কি করা উচিত তা ১৯০৮ সালের ৩০ মে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় লেখা হয়েছিল:
“মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে, একমাত্র কোন বস্তু তাঁর পিপাসা নিবারণ করতে পারে? মানুষের রক্ত এবং ছিনড়বমস্তক ব্যতীত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না। অতএব জননীর সন্তানদের উচিত মায়ের পূজা করা এবং তার ইপ্সিত বস্তু দিয়ে সন্তুষ্টি বিধান করা। এসব হাসিল করতে যদি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়, তবুও পশ্চাদপদ হওয়া উচিত হবে না। যেদিন গ্রামে গ্রামে এমনিভাবে মায়ের পূজা করা হবে, সেদিনই ভারতবাসী স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদে অভিষিক্ত হবে” (ইবনে রায়হান : বংগভংগের ইতিহাস, পৃ. ৬-৭)।
* ‘বন্দে মাতরম’-এর খণ্ডিত ‘মা’কে অখণ্ড করার জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসারকে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। (বাংলার বিপ্লববাদ, শ্রী নলিনী কিশোর গুহ, পৃ. ৭৭, ৭৮)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে হিন্দু ঐতিহ্যের ‘মা’ কিন্তু ভক্তের রক্ত ও ছিনড়ব মস্তকে খুশী নন। তিনি ভক্তদেরকে মানুষ (মুসলমান নয় কি?) হত্যা করে উক্ত মানুষের রক্ত ও মস্তকের বিনিময়ে স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদের ওয়াদা করেছেন। এমতাবস্থায় বঙ্কিমের মা, রবি ঠাকুরের মা এবং হিন্দু দেবী কি এক ও অভিনড়ব নয়? মনে রাখা প্রয়োজন, উক্ত সময়ে উপমহাদেশে, বিশেষত: বাংলায় হিন্দুরা মা কালীর নিকট শপথ নিয়ে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছিল। বাংলায় অসংখ্য গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল।
উক্ত সময়ে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত হয়েছিল মাতৃবন্দনার গান :
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি
... .... ....
‘মা’ তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন
ও ‘মা’ আমি নয়ন জলে ভাসি।
লক্ষণীয়, ১৯০৫-০৬ সালে হিন্দু বাংলা ছিল সোনার বাংলা কিন্তু মুসলিম বাংলা বা পূর্ব বাংলা ছিল ভিক্ষুকের বাংলা, অবহেলিত, লাঞ্ছিত নিপীড়িত, ম্লেচ্ছ, যবন ও অস্পৃশ্যদের বাংলা। এমতাবস্থায় কবি কোন বাংলাকে উদ্দেশ্য করে গানটি রচনা করেছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
অপরদিকে যুগান্তরে প্রকাশিত ‘মা’ ছিল পিপাসায় কাতর আর রবীন্দ্রনাথের ‘মা’- এর বদনখানি মলিন। মায়ের মলিন বদন দেখে কবির চোখ অশ্র“সজল। বঙ্গভঙ্গ না হলে নিশ্চয়ই কবির চোখ অশ্র“সজল হতো না, কবি এত সুন্দর গান রচনা করতেন না। এ জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য ব্রিটিশ রাজশক্তির, তাই পাঠকবৃন্দ সমস্বরে গেয়ে উঠুনÑ
‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা...”।
‘স্বরাজ’ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ‘
স্বরাজ’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উগ্র হিন্দুবাদী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক। তিনি উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরকে মুসলমান ও নিমড়ববর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। কুখ্যাত দস্যু সর্দার শিবাজীকে ভারতের জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসব প্রচলন করেন। তার প্ররোচনায় ভারতের দিকে দিকে প্রধানত বাংলায় প্রচণ্ড হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত হয়। তিলক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মাধ্যমে হিন্দুদেরকে সংগঠিত করে ভারতবর্ষে রামরাজত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শুরু থেকেই স্বরাজ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শ্রী অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, “তাতে দেখতে পাচ্ছি তিলক তার দূত হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপে পাঠাতে চেয়েছিলেন এবং সে বাবদ রবীন্দ্রনাথকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে কবি এ প্রস্তাবে রাজী হননি। মি. চৌধুরী আরও লিখেছেন, “আগেই বলেছি তিলকের লক্ষ্য ছিল হিন্দু স্বরাজ। প্রশড়ব উঠতে পারে রবীন্দ্রনাথ কি করে এরূপ লক্ষ্যধারী রজনৈতিক নেতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিলকের সহিংস আন্দোলনে দেশে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ সালে তিলককে গ্রেফতার করে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্যোগী হয়ে ‘তিলক’ মুক্তির জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে পুনেতে পাঠান। (দ্র: ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ : শ্রী অমিতাভ চৌধুরী, ১৪০০ সাল, পৃ. ৬)
রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশ সরকার নাখোশ হলে তিনি স্বরাজ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং লিখেনÑ “স্বরাজতো আকাশ কুসুম নয়, একটা কার্য পরম্পরার মধ্য দিয়াতো তাহাকে লাভ করিতে হইবে। নতুন বা পুরাতন যে দলই হোন তাঁহাদের সেই কাজের তালিকা কোথায়? তাহাদের প্লান কি? তাহাদের আয়োজন কি? কর্মশূন্য উত্তেজনায় এবং অক্ষম আস্ফালনে একদিন একান্ত ক্লান্তি ও অবসাদ আসিবেইÑ ইহা মনুষ্য স্বভাবের ধর্মÑ কেবল মদ যোগাইয়া আমাদিগকে সেই বিপদে যেন লইয়া যাওয়া না হয়।” (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৪৬, ‘উচ্চারণ’ কলিকাতা)।
No comments:
Post a Comment