Thursday 30 March 2017

পর্ব এক। রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ?


পর্ব এক।
রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ??

রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ সন্ধানে।

ইতিহাসের রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুরবাড়ি

ভূমিকা
শ্রদ্ধা ও ভক্তি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত প্রায় সমার্থক দুটি শব্দ। ব্যক্তি বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ পর্যবেক্ষণের পর আকৃষ্ট হয়ে মানুষ প্রমত কোন ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করে বা কোন বস্তুকে গুণের আধার মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি জন্ম নেয়। এ অবস্থায় শ্রদ্ধার পরবর্তী স্তর হচ্ছে ভক্তি।

অন্যদিকে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে দেখা মাত্র অথবা উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর বিভিনড়ব বর্ণনা শুনে কোন প্রকার বিচার বিবেচনা ব্যতীত যখন মানুষ উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়, উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুকে গুণের আধার মনে করে এবং অন্ধভাবে শ্রদ্ধাবনত হয় তখন আমরা একে এক প্রকারের ভক্তি বলে থাকি। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি প্রম প্রকারের ভক্তির চোখ রয়েছে, আর দ্বিতীয় প্রকার ভক্তি চক্ষুহীন, বিবেকহীন বা অন্ধ।

আমাদের ভারতবর্ষে অনেক পীর/পুরোহিত রয়েছেন যারা নিজেদের সততায় ও যোগ্যতায় ভক্তের দল সৃষ্টি করেন আবার অনেক পীর/পুরোহিত রয়েছেন যারা সৎ ও যোগ্য নয় কিন্তু কূটকৌশলে অতি দক্ষ। এসব কূটকৌশলী পীর/ পুরোহিতগণ ধুরন্ধর মুরীদ/ পাণ্ডার মাধ্যমে ভক্তের দল সৃষ্টি করে বৈষয়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

 আবার এমন অনেক পীর/পুরোহিত ও বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালীকে পেশা হিসেবে পছন্দ করেছেন। শেষোক্ত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠায় নিজেদের প্রচেষ্টার চেয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বৈষয়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। শেষোক্ত ব্যক্তিদেরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’তে পরিণত করে স্বীয় স্বার্থ হাছিল করে। সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হলে অথবা সাম্রাজ্যবাদের পতনে উক্ত ‘হিরো’দের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পর্যায়μমে ‘জিরো’তে পরিণত হয়।

বিভিনড়বমুখী তথ্যপ্রবাহের ফলে বর্তমানে পৌরাণিক চরিত্র গুরুত্বহীন। আধুনিক যুগের মানুষ ধর্মীয় কারণ ব্যতীত পৌরাণিক হিরোকে সম্মান করে না। আধুনিক যুগের মানুষ যুক্তিবাদী বিধায় ঐতিহাসিক কষ্টিপাথরে যাচাই করে হিরোর হিরোত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন শোষণকে স্থায়ী এবং যুক্তিপূর্ণ করতে এদেশের অনেক নীতিহীন, সুবিধাবাদী ব্যক্তিকে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছে এবং তাদের রচিত ইতিহাস উক্ত দালালদের মুখোশ হিসেবে অদ্যাবধি ব্যবহৃত হচ্ছে এবং জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এদেশের স্বাধীনতাকামী ও আপোসহীন ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসে ভেজাল মিশ্রণ করে হিরো থেকে জিরোতে পরিণত করেছে অথবা তাদের রচিত কলঙ্কিত ইতিহাসের পাতা থেকে উক্ত বীর পুরুষদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।

 ব্রিটিশ রচিত ইতিহাস আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে ও স্বাধীনতার বীর সেনাপতিদেরকে ভিলেনে পরিণত করেছে পক্ষান্তরে দেশদ্রোহী ও খলনায়কদেরকে নায়কে পরিণত করেছে। অদ্যাবধি ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ রচিত ইতিহাস পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে বিধায় উপমহাদেশের অধিবাসীগণ সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র জাল ছিনড়ব করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের পরও ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত ডিভাইড এন্ড রোল পলিসির তেজস্ক্রিয়তায় লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী প্রতিনিয়ত হত্যানির্যাতনের শিকার হচ্ছে, নিজ দেশে পরবাসীর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।

প্রত্যেক বিখ্যাত ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে ২টি দল থাকা স্বাভাবিক। আমরা উভয় দলের এবং মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তৃতীয় পক্ষ বা নিরপেক্ষ হয়ে আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের ঐতিহাসিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
রবীন্দ্র ভক্তদের যুক্তি
প্রচারিত ও প্রচলিত ইতিহাসে আছে তিনি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, কলিকাতার ঠাকুর পরিবারে জন্ম, পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষি, দাদা ছিলেন প্রিন্স, বিশ্ববিখ্যাত নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ‘গীতাঞ্জলি’ লিখে, পেয়েছিলেন নাইট উপাধি।

 বাল্যকাল থেকে কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন, নৃত্যকলায় ছিলেন সফল ও সার্থক। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়, বিশ্বভারতী ও শ্রীনিকেতন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালী জাতির ও ভারতীয়দের উনড়বয়নে আমৃত্যু সাধনা করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন জমিদার, কবি ও প্রতিভাবান শিল্পী। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এতো গেল ভক্তদের কথা। সমকালে, পরবর্তীতে এবং বর্তমানের তথ্য প্রবাহের যুগে সবাইকে যে প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাসকে বিশ্বাস করতে হবে তাতো নয়। প্রচারিত ইতিহাস ও ভক্তদের দাবিসমূহকে ইতিহাসের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করার নিমিত্তে অত্র প্রবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে। প্রবন্ধের লেখক একজন মুসলমান নামধারী ব্যক্তি হওয়ায় প্রবন্ধকারের মূল্যায়নকে যাতে ফুৎকারে কেউ উড়িয়ে না দেয় এবং প্রবন্ধকারের সততাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে গালি না দেয় তজ্জন্য খাঁটি ব্রাহ্মণের/ক্ষত্রিয়ের হস্তলিখিত তথ্যাদি এবং গঙ্গাজলে পবিত্র হওয়া বাঙালী জাতীয়তাবাদী দু-একজন মুসলমানের উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন, “সত্য প্রিয় হউক, অপ্রিয় হউক, সাধারণের গ্রহণযোগ্য হোক কি না হোক তাকে খজুঁতে হবে, বুঝতে হবে, প্রচার করতে হবে।”

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বংশ পরিচয়
 􀁑 কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন কুশারী খুলনা জেলা ত্যাগ করিয়া কালিঘাটের নিকট গোবিন্দপুরে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। রবিবাবু যে খুলনা জেলার পিঠাভোগের কুশারী বংশ সম্ভূত উহারই সমর্থনে কয়েক বৎসর পূর্বে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল। (পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫, সুন্দরবনের ইতিহাস, এ.এফ.এম আবদুল জলিল, ৩য় খণ্ড)
􀁑 প্রখ্যাত গীতিকার, কবি ও অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী তাঁর রচিত ‘বাংলার মূল’ বইয়ে দাবি করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ প্রাচীন আরবের পৌত্তলিক ‘কুশাইরী’ বংশ সম্ভূত ছিলেন। উক্ত কুশাইরীগণ কাবা মন্দিরের তাকুত দেবতার পূজো করত। উক্ত তাকুত দেবতার পূজারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বংশের লোকেরা পরবর্তীতে (তাকুত>টাকুট>টাকুর>) ঠাকুর পদবী গ্রহণ করে (পৃ. ১৫২-১৫৩)।

􀁑 কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথের দাদা নীলমণি ঠাকুর। তিনি প্রমে ইংরেজদের অধীনে চাকুরী করে সাহেবদের সুনজরে পড়েন এবং উন্নতির দরজা খুলতে থাকে μমে μমে। এঁরা কিন্তু বরাবরই ঠাকুর পদবীধারী নন, পূর্বে এঁরা ছিলেন কুশারী। পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী যখন শ্রমিকের কাজ করতেন তখন তাকে নিমড়বশ্রেণীর লোকেরা ঠাকুর মশাই বলতেন। ঐ ঠাকুর মশাই থেকে ঠাকুর পদবীর সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র রামলোচন এর দত্তক পুত্র (এ-এক অন্য ইতিহাস, গোলাম আহমাদ মোর্তজা, পৃ. ১৪২)।

দ্বারকানাথ
দ্বারকানাথের পিতা ইংরেজদের সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। তবুও ইতিহাসে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ। আর একজন ইংরেজ দালাল রামমোহন ছিল দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু। উভয় গুরু-শিষ্য মিলে এদেশে ইংরেজদের শাসন-শোষণে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন ও প্রিন্স দ্বারকানাথ। সংক্ষেপে দ্বারকানাথের বিত্তশালী হওয়ার তথ্য ও উৎসসমূহ নিমড়বরূপ :
১. নীতি ও বুদ্ধি বিচারের দিক দিয়ে রামমোহন ছিলেন তাঁর গুরু। গরীবের রক্ত শোষণ করা অর্থে প্রিন্সের এই প্রাচুর্যের পূর্বে তিনি ছিলেন মাত্র দেড়শ’ টাকা বেতনের সাহেব ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর মাত্র (তথ্যÑ ড. কুমুদ ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন : বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, পৃ. ৮২)।

২. এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগমনের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সৌভাগ্যের সূত্রপাত। শুরু থেকেই তা যুক্ত হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তির আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে (কৃষ্ণ কৃপালিনী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিস্মৃত পথিকৃৎ, পৃ. ১৭)।
৩. রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলিকাতাতেই।” এছাড়া ছিল মদের ব্যবসা, আফিমের ব্যবসা, ঘোড়ার রেস খেলা, বিপদগ্রস্ত লোকের বন্ধু সেজে মামলার তদ্বির করা এবং ২৪ পরগনার সল্ট এজেন্ট ও সেরেস্তাদার (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ কার্তিক, ১৪০৬)।

৪. ১৮২৪ সালে লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশদের যেখানে ২৭১টি নীল কারখানা ছিল সেখানে প্রিন্স ও তার দোসরদের নীল কারখানা ছিল ১৪০টি (প্রমোদ সেনগুপ্ত, নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৬)।
এভাবেই ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর দ্বারকানাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ হলেন এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অবদান রাখলেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
ইনি রবীন্দ্রনাথের পিতা। বাংলার শ্রেষ্ঠ জমিদার। জন্মসূত্রে পিতার চরিত্র, ব্যবসাবাণিজ ্য, ইংরেজ দালালী ও জমিদারী প্রাপ্ত হয়ে মহান ঋষি বা মহর্ষি হলেন। তাহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজাকূল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তিনি নির্মম হাতে উক্ত প্রজা বিদ্রোহ দমন করে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা তথাকথিত বাঙালী হিন্দু রেনেসাঁর মধ্যমণি ছিলেন। তাঁর জমিদারীর দু-একটি নমুনা উলে-খ করা হলো :
১. ঠাকুর পরিবারের এই মহর্ষি-জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্ম মন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার একথা আর গোপন করিতে পারি না।” (অশোক চট্টোপাধ্যায়, প্রাক-বৃটিশ-ভারতীয় সমাজ, পৃ. ১২৭)।

২. “ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিণী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা-বাপ নাই, পশুপক্ষী ও মানুষ, যে জন্তু যে প্রকারে পারে মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করে, তদ্রƒপ প্রজার স্বত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক, যাহারা যোগী-ঋষি ও মহাবৈষ্ণব বলিয়া সংবাদপত্র ও সভা-সমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর।” (কাঙাল হরিনাথের ‘অপ্রকাশিত ডায়েরী’, চতুষ্কোণ, আষাঢ়, ১৩৭১)।

৩. প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে ব্রিটিশ সরকারকে জানানো হলো যে, একদল শিখ বা পাঞ্জাবী প্রহরী পাঠাবার ব্যবস্থা করা হোক। মঞ্জুর হলো সঙ্গে সঙ্গে। সশস্ত্র শিখ প্রহরী দিয়ে ঠাকুরবাড়ি রক্ষা করা হলো আর কঠিন হাতে নির্মম পদ্ধতিতে বর্ধিত কর আদায় করাও সম্ভব হলো। ঠাকুরবাড়ির জন্য শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “অথচ এরাও কৃষকদের উপর থার্ড ডিগ্রী (প্রচণ্ড প্রহার) প্রয়োগ করতে পিছপা হননি, কর ভার চাপানোর প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন, পরন্তু ভয় দেখিয়ে কর আদায়ের জন্য এবং বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য একদল শিখ প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন (প্রাকবৃটিশ ভারতীয় সমাজ, পৃ: ১৩২)।

৪. মহর্ষিদের অসংখ্য করের মধ্যে কয়েকটি নমুনা নিমড়বরূপ :
ক. গরুর গাড়ি করে মাল পাঠালে ধুলা উড়তো, তাই গাড়ির মালিককে যে কর দিতে হতো, তার নাম ‘ধুলট’।
খ. প্রজা নিজের জায়গায় গাছ লাগালে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘চৌথ’।
গ. প্রজা আখ গাছ থেকে গুড় তৈরি করলে দিতে হতো ‘ইক্ষুগাছ’ কর।
ঘ. প্রজার গরু-মোষ মারা গেলে দিতে হতো ‘ভাগাড় কর’।
ঙ. নৌকায় মাল উঠানো-নামানোর জন্য দিতে হতো যে কর তার নাম ছিল ‘কয়ালী’।
চ. ঘাটে নৌকা ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ছিল ‘খোটাগাড়ি কর’।
ছ. জমিদারের সঙ্গে দেখা করলে দিতে হতো যে কর তার নাম ‘নজরানা’। জ. জমিদার হাজতে গেলে দিতে হতো ‘গারদ সেলামী’ কর।
(তথ্য, গণঅসন্তোষ ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, স্বপন বসু, পৃ. ১৬৬)।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রতনে রতন চিনে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও রতন চিনতে ভুল করেননি। দাদা দ্বারকানাথ ও পিতা দেবেন্দ্রনাথের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে স্বপন বসু লিখেছেন : “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন করলেন চৌদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথকে। এও এক বিস্ময়! অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী, প্রতারণা ও কলাকৌশলে রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তাঁর পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে, পিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য (ঐ, স্বপন বসু)।

রবীন্দ্র মানস গঠন
বৈষয়িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ, ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ও বাঙালী বাবু সমাজের পথিকৃৎ তথাকথিত রাজা রামমোহনের যোগ্য উত্তরসূরি। অপরদিকে কাব্য ও সাহিত্য ভাবনায় তিনি ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী ইংরেজ দালাল ঋষি বঙ্কিম ও তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের যোগ্য প্রতিনিধি। তাই রবীন্দ্র আলোচনার পূর্বে ঈশ্বর গুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ব্রিটিশ রচিত প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাস উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ ছাইচাপা দিয়েছে। ব্রিটিশের অন্ধ অনুকরণে অভ্যস্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত সরকার একইভাবে দেশের পাঠ্যপুস্তকে উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ উন্মোচনের চেষ্টা করেনি। ফলে সত্যানুসন্ধানী লেখকের সঠিক তথ্যাবলী অনেকের কাছে নতুন মনে হবে বৈকি।

ঈশ্বর গুপ্ত
আমরা জানি ঈশ্বর গুপ্ত যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। অর্থাৎ প্রাচীন ও আধুনিক কাব্য প্রতিভা ঈশ্বর গুপ্তকে আশ্রয় করেছে। তাঁর জন্ম ১৮১২ খ্রীস্টাব্দে। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন তবে পতড়বী দুর্গামণি দেবীর সঙ্গে তিনি আজীবন সংসার করেননি। আশুতোষ দেবের ভাষায়Ñ “ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোন সাধারণ কবি ছিলেন না, বরং অসাধারণই ছিলেন। কারণ সে যুগের অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক পত্রপত্রিকার বাজারে তিনি বিখ্যাত পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদনা করতেন। এছাড়াও ‘সংবাদ রতড়বাবলী’, ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রভৃতি তাঁর সম্পাদিত সাময়িক পত্রিকা ছিল। বোধেন্দু বিকাশ প্রভৃতি প্রবন্ধও তাঁর দ্বারা রচিত হয়। সবচেয়ে মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কথা হলো, স্বাধীনতা আন্দোলনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত সেই বঙ্কিমচন্দ্রের ইনি ছিলেন গুরু (নতুন বাঙ্গালা অভিধানের চরিতাবলী অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১১১৫, আশুতোষ দেব সংকলিত)।

􀁑 “তিনিই হচ্ছেন আধুনিক কালের ‘কবিগোষ্ঠীর প্র ম প্রবর্তক’। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ অধিকারী, দীনবন্ধু মিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রধান চার শিষ্য’। (সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড)। এহেন মহান গুরু ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্য প্রতিভার নমুনা পেশ করা হলো :
১. একেবারে মারা যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)
হাঁসফাঁস করে যত প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে।।
বিশেষত: পাকা দাড়ি পেট মোটা ভূড়ে।
রোদ্র গিয়া পেটে ঢোকে নেড়া মাথা ফূড়ে।।
কাজি কোল্লা মিয়া মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি
কাছাখোল্লা তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি।
বি:দ্র: ইংরেজদের সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে খুশী হয়ে তিনি উক্ত কবিতা রচনা করেছেন।

২. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ-ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি লিখলেন :
চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়।।
ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়।
মুক্তমুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।।
(দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলী, পৃ. ১৯১)
৩. মুসলমানদের হাতে ব্রিটিশের পরাজয়ে লিখলেন :
“দুর্জয় যবন নষ্ট, করিলেক মানভ্রষ্ট
সব গেল বৃটিশের ফেম
শুকাইল রাঙ্গা মুখ ইংরাজের এত দুখ,
ফাটে বুক হায় হায় হায়।।”

৪. দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ যখন বেগমসহ গ্রেফতার হলেন এবং তাঁর সন্তানদের কাটা মাথা তাঁকে উপহার দেওয়া হলো তখন ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন :
“বাদশা-বেগম দোঁহে ভোগে কারাগার।।
অকারণে μিয়াদোষে করে অত্যাচার।
মরিল দু’জন তাঁর প্রাণের কুমার।।
একেবারে ঝাড়ে বংশে হল ছারখার।”

৫. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে এবং রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি ভক্তিতে লিখলেন:
ক. “জয় হোক বৃটিশের, ব্রিটিশের জয়।
রাজ অনুগত যারা, তাদের কি ভয়।”
খ. এই ভারত কিসে রক্ষা হবে
ভেব না মা সে ভাবনা।
সেই তাঁতীয়া তোপীর মাথা কেটে
আমরা ধরে দেব ‘নানা’।”
(দিল্লীর যুদ্ধ গ্রন্থাবলী, পৃষ্ঠা ৩২০, ১৩৬)
[“প্রিয় পাঠক, এই হলো বাঙালী বাবু সমাজের গুরুস্থানীয় চিন্তাবিদ কবির চিন্তা ও কবিত্বের নমুনা। তাঁরই যোগ্য শাগরেদ ঋষি বঙ্কিম।”]

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অখণ্ড ভারতবর্ষে যখন ইংরেজের রাজত্ব তখন তাদের প্রয়োজন হয়েছিল একদল লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঐতিহাসিক ও বিশ্বস্ত কর্মচারীর। ইংরেজ জাতি তা সংগ্রহ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায় হতে। ঐ হিন্দু লেখকগোষ্ঠীর গুরু হিসেবে ধরা যেতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে। কারণ তার জন্যই বলা হয়, ‘আমাদের দেশের সকলের কবি’Ñ অর্থাৎ শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত এবং নিরক্ষরদের কাছেও তিনি সমান প্রিয়।

 তাঁর সম্পর্কে শিষ্য বঙ্কিমের উক্তি নিমড়বরূপ :
১. “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালীর কবিÑ ঈশ্বর গুপ্ত বাঙ্গালার কবি। এখন আর খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে নাÑ জন্মিবার যো নাই, জন্মিয়া কাজ নাই।” মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে শেষ সিদ্ধান্তে বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্তের জন্য লিখিয়াছেন, তাঁহার যাহা আছে, তাহা আর কাহারও নাই। আপন অধিকারের ভিতর তিনি রাজা (সমালোচনা সংগ্রহ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৫৫, পৃ. ২১৫-২১৭)।

২. “বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্য গুরু ছিলেন, বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন।” (ঐ, পৃ. ২৫৩)।

বঙ্কিম মানস
১. “হিন্দু জাতি ভিনড়ব পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গল মাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব। অপিচ, যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে। হয় হউক, আমরা সেই জন্য আত্মজাতির মঙ্গল সাধনে বিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিত হয়, তাহাও করিব।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৯)।

২. “ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবেÑ কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই  তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতিদুর্দম, অজেয়। μিয়াবাড়িতে কাক আর কুকুর, আদালতে মুসলমান।” (বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ণ- ১২২৭, পৃ. ৪০১)।

৩. আনন্দমঠে বঙ্কিম লিখেছেন, “মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল, হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু সিপাহী ইংরাজের হইয়া লড়িল। হিন্দুরা রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিনড়ব জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই। আজিও ইংরাজের অধীন ভারতবর্ষে (হিন্দু) অত্যন্ত প্রভুভক্ত।”

৪. ভারতীয় ঐক্যের পন্থা সম্পর্কে ঋষি বঙ্কিম বলেন, “ভারতবর্ষীয় নানা জাতি একমত, একপরামর্শী, একোদ্যোগী না হইলে ভারতবর্ষের উনড়বতি নাই। এই মতৈক্য, একপরামর্শীত্ব, একোদ্যম কেবল ইংরেজীর দ্বারা সাধনীয়। কেননা এখন সংস্কৃত লুপ্ত হইয়াছে। বাঙ্গালী, মহারাষ্ট্রী, তৈলঙ্গী, পাঞ্জাবী ইহাদের সাধারণ মিলনভূমি ইংরাজি ভাষা। এই রজ্জুতে ভারতীয় ঐক্যের গ্রন্থি বাঁধিতে হইবে।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬-১৭) (পাঠকবৃন্দ, বঙ্কিম আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, তথাপি আমাদের কবিগুরুর পূর্বসূরি হিসাবে কিঞ্চিৎ উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে।)

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্ম ১৮৬১ সালে এবং মৃত্যু ১৯৪১ সালে। তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তাঁর ভূমিকাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি সমকালীন বাঙালী বাবু সমাজের নয়নমণি এবং ঠাকুরবাড়ির যথাযোগ্য উত্তর পুরুষ ছিলেন বিধায় বাঙালী হিন্দু চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাঁর যুগে বাঙালী হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগ যে চেতনায় সাহিত্য সৃষ্টি করতেন তিনি তার ব্যতিμম ছিলেন না। কেউ যদি ভিনড়বমত পোষণ করেন তাহলে বলবো, অনেক ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক, সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে পড়ে তিনি হয়তো স্রোতের বিপরীতে কিছু কথা বলেছেন তবে যখনই অবস্থা অনুকূলে এসেছে তখনই তিনি সমকালকে আঁকড়ে ধরেছেন। অবশ্য তিনি যদি সমকালীন ইংরেজ চাহিদার বিরুদ্ধে মাতামাতি করতেন তাহলে যেভাবে তিনি আজ সমাদৃত হচ্ছেন হয়তো তা নাও হতে পারতেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা সত্য কথা লিখেছেন তারা ইতিহাসের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছেন। এরূপ তিনজন বাঙালী ভদ্রলোক হচ্ছেন যথাμমে হরিশচন্দ্র, শিশির কুমার ও দীনবন্ধু মিত্র। দীনবন্ধু ঋষি বঙ্কিমের সহপাঠী এবং সরকারি কর্মচারী ছিলেন। যদিও তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব প্রদান করা হয়েছিল তবু তিনি চিরদিন নীলকরদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ দীনবন্ধু যদি ইংরেজ বিরোধিতা না করতো তবে তাঁর পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং পরে ডাইরেক্টর জেনারেল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। (দ্র: নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ, প্রমোদ সেনগুপ্ত)।

মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্রকে অত্যন্ত সমীহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ তাঁর জানা ছিল যে, বঙ্কিম ব্রিটিশরাজের এক নম্বর বাছাই করা ব্যক্তি। তিনি বঙ্কিম রচিত চরম সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট আনন্দমঠে রচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানে সুর দেন এবং নিজে গেয়ে বঙ্কিমকে শোনান। (রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৬)।
গুরু বঙ্কিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখলেন :
“ম্লেছ সেনাপতি এক মহম্মদ ঘোরী
তস্করের মত আসে আμমিতে দেশ।”
(প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী, পৃ. ৩৭)।

উক্ত সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাহিত্য চর্চা ছিল আরও ভয়াবহ। বাঙালী জাতীয়তার শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের রচিত প্রবন্ধ, সাহিত্য, নাটক, প্রহসনের বিষয়বস্তু ছিল হিন্দুর গৌরব গাথা এবং মুসলমানদের প্রতি আμমণ। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী সদস্য। ঠাকুরবাড়িতে যেসব নাটক হতো সেগুলোর লেখক ছিলেন তাঁরাই এবং অভিনয়ও করতেন অনেক ক্ষেত্রে ঐ বাড়ির পুরুষ ও মহিলারা।

যে ভাষা ও বিষয় সেখানে ঝংকৃত হতো তার একটি নমুনা :
“ওঠ! জাগ! বীরগণ। দুর্দান্ত যবনগণ,
গৃহে দেখ করেছে প্রবেশ।
 হও সবে একপ্রাণ, মাতৃভূমি কর ত্রাণ,
শত্র“দলে করহ নিঃশেষ।।
বিলম্ব না সহে আর, উলঙ্গিয়ে তরবার
জ্বলন্ত অনলসম চল সবে রণে।
বিজয় নিশান দেখ উড়িছে গগনে।।
যবনের রক্তে ধরা হোক প্লাবমান
যবনের রক্তে নদী হোক বহমান
যবন শোণিত বৃষ্টি করুক বিমান
ভারতের ক্ষেত্র তাহে হোক বলবান।
এত স্পর্ধা যবনের, স্বাধীনতা ভারতের
অনায়াসে করিবে হরণ?
তারা কি করেছে মনে, সমস্ত ভারতভূমে
পুরুষ নাহিক একজন।”
যায় যাক প্রাণ যাক, স্বাধীনতা বেঁচে থাক
বেঁচে থাক চিরকাল দেশের গৌরব।
 বিলম্ব নাহিক আর, খোল সবে তরবার
ঐ শোন ঐ শোন যবনের রব।
এইবার বীরগণ কর সবে দৃঢ়পণ
মরণ শয়ন কিংবা যবন নিধন,
যবন নিধন কিংবা মরণ শয়ন
শরীর পতন কিম্বা বিজয় সাধন।”
(সরকার সাহাবুদ্দীন আহমেদ, ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, ১৯৯৮, পৃ. ২৮৩)।

[মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী প্রগতিশীল যবনগণের উপলব্ধিতে কি এখনও পরিষ্কার হয়নি বাঙালী বাবু সমাজ এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আসলে কোন বিশ্বের কবি? মুসলিম বিশ্বের না হিন্দু বিশ্বের? হিন্দু বিশ্বতো বর্তমান ভারতকেই বুঝায় আর ভারতে প্রত্যেহ যবনদেরকে কচুকাটা করা হচ্ছে, তাদের রক্তে ভারতভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের যবনগণ যদি ভারতভূমির উর্বরতার জন্য স্বীয় রক্ত দান করতে চান তবে ’৪৭-এর সীমানা মুছে দিলেই চলবে, আর কিছু করতে হবে না।]
উপরোক্ত কবিতায়/গানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, বাঙালী হিন্দুদের স্বাধীনতার চেতনা আর মুসলমানদের স্বাধীনতার চেতনা এক নয়। মুসলমানরা যাকে অধীনতা মনে করে বাঙালীরা তাকে স্বাধীনতা মনে করে পক্ষান্তরে মুসলমানদের বিজয় বাঙালীদের পরাধীনতার নামান্তর।

রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি কারা ছিল তা তাঁর বক্তব্য ও লেখনী থেকে অনুভব করা সহজ হবে। তাই নিমেড়ব কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো।
১. হিন্দু মেলা যে সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ঠাকুর বাড়িরই অবদান। রবীন্দ্রনাথ দাবী করেছিলেন যে, তাঁদের বাড়ির সহায়তায়ই হিন্দু মেলার জন্ম হতে পেরেছিল।” রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা হিন্দু মেলাতেই সর্বপ্রম লক্ষণীয়। এই মেলায় দেশের স্তবগান, গীত, দেশানুরাগের কবিতা পঠিত, দেশী শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি প্রদর্শিত ও দেশী গুণীলোক পুরস্কৃত হইত।... এই মেলার প্রম উদ্দেশ্য, বৎসরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা।... যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দুদিগের জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইতে থাকে। আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্ম-কর্মের জন্য নহে, কেবল আমোদ প্রমোদের জন্য নহে। ইহা স্বদেশের জন্যÑ ভারতভূমির জন্য। (যথাμমে-জীবন-স্মৃতি, রবীন্দ্র রচনাবলীÑ ১০, পৃ. ৬৬/ যোগেশচন্দ্র বাগল : হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত (কলকাতা মৈত্রী-১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৭)।

২. হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ‘জাতীয় সভা’ ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে। মুসলমান, নিমড়ববর্ণের হিন্দু ও খ্রীস্টানদের এই সভায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। (জাতীয় সভা মধ্যস্থ, ২৩ অগ্রহায়ণ ১২৭৯, পৃ. ৫৪২)।
৩. হিন্দু-মুসলিম বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ঐ হিন্দুমেলা ও ‘জাতীয় সভা’ থেকেই।... মেলার কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য।... সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত না হলেও তাঁরা সμিয়ভাবে মেলার কাজে অংশগ্রহণ করতেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা রচনার মাধ্যমে। (তথ্য : যোগেশচন্দ্র বাগল, ঐ, পৃ. ৬ এবং ৪৮)।

৪. হিন্দু মেলার নেতা ও রবি ঠাকুরের বড় ভাই তাঁর জীবন স্মৃতিতে লিখলেনÑ হিন্দু মেলার পর হইতে কেবলই আমার মনে হইত কী উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশ প্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম নাটকে ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা ও ভারতের গৌরব কাহিনী কীর্তন করিলে হয়তো কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলেও হইতে পারে। এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া কটকে থাকিতেই আমি পুরুবিμম নাটকখানি রচনা করিয়া ফেলিলাম। (তথ্য: জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১৪১)।

৫. জ্যোতি বাবুর অপর তিনটি নাটক হচ্ছে যথাμমে সরোজিনী, অশ্র“মতি ও স্বপড়বময়ী। নাটকগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল নিমড়বরূপ :
ক. সরোজিনী : সম্রাট আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মেবারের রাজপুত রাজা লক্ষণ সিংহের লড়াই।
খ. অশ্র“মতি : সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে রাজা প্রতাপ সিংহের লড়াই।
গ. স্বপড়বময়ী : সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শুভ সিংহ এর বিদ্রোহ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর এসব লেখকের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, এরই ফলে গণমানুষের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হবে এবং জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। জ্যোতিবাবুর সরোজিনী নাটকের (১৮৭৫) সংলাপের নমুনা হচ্ছেÑ
‘সরোজিনী’ ॥ মা চতুর্ভুজা! যাদের জন্য পিতার আজ এরূপ বিষম ভাবনা হয়েছে, সেই দুষ্ট মুসলমানদের শীঘ্র নিপাত কর।
লক্ষণ ॥ বৎসে! মুসলমানদের নিপাত সহজে হবার নয়। তার পূর্বে অশ্র“পাত করতে হবে। স্বপড়বময়ীর (১৮৮২) অন্যতম চরিত্র ‘সুরজমল’ এর সংলাপ হচ্ছে : “যেখানে মুসলমান থাকে সেখানকার বাতাসও যেন আমার বিষতুল্য বোধ হয়।” নাটকের প্রধান চরিত্র শুভসিংহ এর সংলাপÑ
 ... দেব মন্দির সকল,
 চূর্ণ চূর্ণ করিতেছে ম্লেছ পদাঘাতে,
বেদ-মন্ত্র করিতেছে লোপ,
গো-হত্যা নির্ভয়ে করে রাজপথ মাঝে।
(তথ্য : কোলকাতাকেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী, এম.আর. আকতার মুকুল, পৃ. ৪৯)।

 [পাঠকবৃন্দ, জ্যোতিদাদার এরূপ মহান নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন বিশ্বকবি (হিন্দু বিশ্বÑমুসলিম বিশ্ব নয়) রবিঠাকুর।]
এরূপ একটি কবিতার নমুনাÑ
জ্বল জ্বল চিতা! দ্বিগুণ দ্বিগুণ
পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন
জুড়াবে এখনই প্রাণের জ্বালা।।
শোন্রে যবন! শোন্রে তোরা!
 যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী রলেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে।।
(তথ্য: জ্যোতিদার নাট্যসংগ্রহ (কোলকাতাবিশ ¦ভারতী), পৃ. ২২৫)
[সুতরাং বাংলাদেশী রবীন্দ্রভক্ত যবনগণ, আনন্দে নৃত্য কর]
৬. ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মীয়দের সভায় হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের পোশাক পরিচ্ছদের পার্থক্য কিভাবে রক্ষিত হবে তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেনÑ
“ধুতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পাজামাটা বিজাতীয়।”(রবীন্দ্র রচনাবলী-১০, জীবন স্মৃতি, পৃ. ৬৭)
[উপরোক্ত আলোচনার পর রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি কারা আর বিজাতি কারা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।]
* ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতন ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে ব্রাহ্ম শিক্ষক কুঞ্জলাল ঘোষ কবির কাছে জানতে চান ছাত্ররা প্রণাম করলে তা নেওয়া হবে না নিষেধ করা হবে? উত্তরে রবিবাবু লিখেন, “যাহা হিন্দু সমাজ বিরোধী তাহাকে এ বিদ্যালয়ে স্থান দেওয়া চলিবে না; সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে, ছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ অধ্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্বক প্রণাম ও অন্যান্য অধ্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে। এই নিয়ম প্রচলিত করাই শ্রেয়।” (রবীন্দ্র জীবনী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭)।

* “যে কবি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানিয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন, সেই রবীন্দ্রনাথই অপরের বেলায় ধুয়ো তোলেন এতে হিন্দু ধর্মের প্রভূত ক্ষতি হবে।” লেখক আরও লিখেছেন, “ভারতের বৃহত্তর অনুনড়বত হরিজনেরা আম্বেদকরের নেতৃত্বে যখন মাথা তুলতে চেয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে গান্ধীর কথা শুনতে আবেদন জানান। কারণ গান্ধী উপবাস শুরু করেছিলেন এই জন্য যে, অস্পৃশ্যদের পৃ ক নির্বাচন মেনে নিলে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। আম্বেদকরের সামনে যে বিরাট সুযোগ এসেছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তার সঙ্গে হিন্দুদের এলিট শ্রেণী মিলে এমন চাপ সৃষ্টি করলেন যে, তার ফল দাঁড়ালো এইÑ যদি অনশনে গান্ধী মারা যান তার ফল হবে মারাত্মক। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর জন্য করুণ সুরে বাণী লিখলেন, “আজ তপস্বী উপবাস আরম্ভ করেছেন, দিনের পর দিন তিনি অনড়ব নেবেন না। কিন্তু তাঁর বাণীকে গ্রহণ করাই তার অনড়ব, তাই দিয়ে তাঁকে বাঁচাতে হবে।” (জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও আম্বেদকর, পৃ. ৪৮, ৪৯)।

(উপরোক্ত উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি তালিকায় রয়েছে শুধু বর্ণ হিন্দু, নিমড়বশ্রেণীর হিন্দুরাও নয়।)
* রবীন্দ্র-জাতীয়তার উৎস মূল : “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল যদিও সজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনো এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর পৃথিবী বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবু বাস্তব সত্য এই যে, তাঁর কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোন মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনো এক ছত্রও লিখেননিÑ যদিও তাঁদের অসংখ্যই ভারতেই আবির্ভূত হয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ঊনিশ শতকী বাংলায় জাতীয়তা জ্ঞানের উৎসমূল কোথায় ছিল।”
(ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০০৩)।

* সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজগণই বর্ণ হিন্দুদেরকে হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক গুরু প্রকাশ্যেই তাহা স্বীকার করিয়াছেন। “যে সকল অমূল্য রতন আমরা ইংরেজদের চিত্তভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলামÑ স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা ও জাতি প্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে তাহা হিন্দু জানিত না।” (বঙ্কিম রচনাবলী, পৃ. ২৪০-৪১)।

* বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই সৃষ্টি করা।” (‘ভারতী’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন আবুল আসাদ তাঁর ‘একশ’ বছরের রাজনীতি’ বইতে)।মাসিক ইতিহাস অন্বেষা

No comments:

Post a Comment