স্বনির্ভর বাংলাদেশ নির্মাণে অবশ্যই ভারতের বিরোধিতা করতে হবে_ আহমদ ছফা।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমি এ রাষ্ট্রের নাগরিক। এই নিয়ে আমার গর্বের অন্ত নেই। অতীতের কোন সময়ে বাঙ্গালি একক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পেরেছে ইতিহাসে তেমন প্রমাণ বিশেষ নেই। শশাঙ্কের কথা বলা যায় বটে কিন্তু শশাঙ্ক বাঙ্গালি ছিলেন এই প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি। তারপরেও ভারতবর্ষের দিল্লীকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতিকূলে এখানে নানা বংশের শাসকেরা রাজত্ব করেছেন। কিন্তু তাদের কেউই বোধ করি বাংলার মাটির সাক্ষাৎসন্তান ছিলেন না।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতি সর্বপ্রথম নিজেদের একটা জাতিরাষ্ট্র গঠন করে। বাঙ্গালি জাতির নিজস্ব একটি রাষ্ট্র গঠন করার ঘটনাটি ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা। উপমহাদেশের অন্য দুটি রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে অধিকতর রাষ্ট্রবিজ্ঞানসম্মত আধুনিক রাষ্ট্র বলে মেনে নিতে হয়। ভারত কিংবা পাকিস্তানকে জাতীয় রাষ্ট্র বলা যাবে না। ভারত রাষ্ট্র বটে কিন্তু ভারতীয় জাতি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এ কথা ভারতীয় চিন্তানায়করাই বলতে আরম্ভ করেছেন। বাংলাদেশ একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্র এবং জাতিও বটে।
এই রাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়াটিও লক্ষ করার মত। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সংগ্রামের উন্মেষ, স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার বিকাশ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পরিণতি। বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার প্রতিটি ঘটনা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের অনুকরণে ভারতের আসাম, পাঞ্জাব এবং কাশ্মীর ইত্যাদি রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছে।
কথাটা অনেকেই বলে থাকেন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত করে পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর ভেতর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। এটা পুরা সত্য নয়, অর্ধসত্য। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতানুসারে ভারত হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের দেশ [একথা যেমন সত্য] নয়, তেমনি গান্ধী-নেহেরু মওলানা আজাদের অনুসৃত মতবাদ মোতাবেক ভারত উপমহাদেশ এক জাতির দেশও নয়। ভারত বহুভাষী, বহুধর্মাবলম্বী এবং বহুজাতির জনগোষ্ঠির আবাসভূমি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়েই সেই সত্যটা প্রমাণিত হল।
আজকের যেটা বাংলাদেশ সেটা একসময়ে অবিভক্ত ভারতের অন্তর্গত অখণ্ড বাংলার অংশ ছিল। তারপরে এই অঞ্চল পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই প্রতিটি বিভাজনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ নিজস্ব একটা স্বতন্ত্র চরিত্র অর্জন করেছে। আমরা পাকিস্তানের অংশ নই বলেই গর্ববোধ করি। একই কারণে ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অন্তর্ভুক্ত রাজ্য নই বলেও আমাদের গর্বের অন্ত নেই।
আমি মুজিবের অন্ধভক্ত নই, কখনও ছিলাম না। তথাপি নির্মোহ বিচারে বাঙ্গালি জাতির দুহাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁকে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য ব্যক্তিত্ব মনে করি। আমার ভুল হতে পারে। তবুও এটা আমার বিশ্বাস। মুজিবের মূল্যায়ন করে একটি রচনায় আমি লিখেছিলাম বাঙ্গালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য চর্যাপদ নয়, বৈষ্ণবগীতিকা নয়, সোনার তরী কিংবা গীতাঞ্জলি কোনটা নয়, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতি হল–‘আর দাবায়া রাখতে পারবা না’।
[কোন] জাতিকে যদি টিকে থাকতে হয় তার নিজস্ব একটা নির্ভরযোগ্য অর্থনীতি থাকতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সিকি শতাব্দী অতীত হয়ে গেল তবুও বিদেশি পর্যবেক্ষকরা একটি প্রশ্ন প্রায়শ করে থাকেন, ভারতের পূর্বপ্রান্তে যে একচিলতে ভূমি–যেখানে অভাবের করুণ হাহাকার এবং দারিদ্রের মর্মপীড়িত দীর্ঘশ্বাস বাতাসে রোদনের মত ঘুরে বেড়ায় সেই দেশটি–নিজের পায়ে ভর দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারবে কি? এটা একটা খুবই প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান প্রশ্ন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে না পারলে স্বাধীনতার গালভরা বক্তব্য অধিক তাৎপর্য বহন করে না।
বাংলাদেশের তিনপাশে রয়েছে ভারতের মত একটি শিল্পোন্নত রাষ্ট্র। সে পৃথিবীর নবমতম শিল্পোন্নত দেশ এবং আঞ্চলিক শক্তিও বটে।
ভারতের ক্রমপ্রসরমান শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রগতির প্রভাব অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ কি করে তার নিজস্ব একটি অর্থনীতি নির্মাণ করবে? এই জিনিশটি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারেনি।
কেউ ভারতপ্রীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কেউ কেউ ভারতবিদ্বেষ মূলধন করে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার করেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রের নিজস্ব একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি করার প্রয়াস কেউ গ্রহণ করেনি।
এই সংকীর্ণ পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। তবুও আমি মনে করি, একটা স্বনির্ভর [দেশ] নির্মাণ করতে হলে আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতের বিরোধিতা করতে হবে। এখানে অনেকে ভারত বিরোধিতা মানে হিন্দু বিরোধিতা বুঝে থাকে। কিন্তু আমি কথাটা বলছি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ছোটদেশকে তার নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বড়দেশের বিরোধিতা করতে হয়। এর মধ্যে সংকীর্ণতা কিংবা হীনমন্যতা খোঁজার কোন অবকাশ নেই। ছোটদেশকে তার নিছক ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে বৃহত্তর প্রতিবেশির প্রতিবন্ধকতার জাল ছিন্ন করতে হয়। যে জাতি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করা শেখেনি তাকে বড় দেশের লেজুড় হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়।
ভারত বিরোধিতা মানে হিন্দু বিরোধিতা বুঝে থাকে।তবুও আমি মনে করি, একটা স্বনির্ভর [দেশ] নির্মাণ করতে হলে আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ভারতের বিরোধিতা করতে হবে।
নিছক শত্রুতা, নিছক ঘৃণা, নিছক বিরোধিতা–এগুলো কোন কাজের কথা নয়। অন্ধকারের শক্তির ওপর আস্থাস্থাপন করলে রসাতলে যাওয়ার পথটাই পরিষ্কার হয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা, পারস্পরিক কল্যাণকামনা–এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিশ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির উজ্জীবনের প্রশ্নে বড়দেশের বিরোধিতা করা একটি স্বাস্থ্যকর লক্ষণ।
তাইওয়ান যদি মূল চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করত তো এত দ্রুত তার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটত না। কোরিয়া জাপানের পার্শ্ববর্তী একটি অসহায় দেশ ছিল। শিল্পোন্নত জাপানের কাছে নতিস্বীকার না করে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবার সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণে আজকের পৃথিবীতে কোরিয়া একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করতে পেরেছে।
ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করার জন্য একটি নিজস্ব অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। নইলে ক্রমসম্প্রসারমাণ ভারতীয় শিল্পবাণিজ্যের চাপে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান সুদূর পরাহত হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথম প্রকাশ: বাংলাদেশ: জাতি রাষ্ট্র এবং গন্তব্য, আজকের কাগজ, ২০ জুন ১৯৯৬, ৬ আষাঢ় ১৪০৩।
সলিমুল্লাহ খান কর্তৃক সম্পাদিত, আহমদ ছফার ৭২তম জন্মদিনে (৩০ জুন ২০১৪),আহমদ ছফা বিদ্যালয় ফেইসবুক পেইজে পুণঃপ্রকাশিত
No comments:
Post a Comment