Thursday 30 March 2017

পর্ব তিন। রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ।


পর্ব তিন। রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ।

রবীন্দ্রনাথের মুসলিম বিদ্বেষ
জোড়া-সাঁকোর ঠাকুর পরিবার মূলত : By the British, of the British & for the British empire. সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট উক্ত পরিবার বংশানুμমিকভাবে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের অনুকূলেই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। উক্ত পরিবারের উগ্রহিন্দুত্ব এবং সময়ে সময়ে মুসলমানদের অনুকূলে ছিঁটেফোটা বক্তব্য প্রদানও মূলত: ব্রিটিশের স্বার্থেই নিবেদিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের চরিত্রও এর ব্যতিμম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ কোন কোন সময় স্বীয় গোষ্ঠীস্বার্থে অথবা প্রভুর স্বার্থে পরস্পর বিরোধী যেসকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। আলোচনার এই অংশে তাঁর মুসলিম বিদ্বেষের ঐতিহাসিক তথ্যাদি উপস্থাপিত হলো।
১. “কবি রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের পূর্ণ মুসলমান হয়ে থাকাটা বোধ হয় পছন্দ করতেন না। সেই জন্য তিনি বলতেন, ‘মুসলমানেরা ধর্মে ইসলাম অনুরাগী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা হিন্দু মুসলমান’।” (আবুল কালাম সামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি, পৃ. ১৫০)।
২. মরহুম মোতাহের হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখায় ইসলাম ও বিশ্বনবী সম্পর্কে কোন লেখা নেই কেন? উত্তরে কবি বলেছিলেন, “কুরআন পড়তে শুরু করেছিলুম, কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি, আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভাল লাগেনি”। (দ্র: বিতণ্ডা : সৈয়দ মুজিব উল্লাহ, পৃ. ২২৯)।
৩. মুসলমান শ্রমিকদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বিরক্ত কবি লিখলেন : “কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ড হাতে উপদ্রপের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, লক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজের প্রতি। তাহাদের যথেষ্ট শাস্তিও হইয়াছিল।... কেহ বলিল মুসলমান বস্তিগুলো একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেওয়া যাক। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪২৮-৪২৯)। (অথচ কবিবাবু হিন্দু সন্ত্রাসীদের বাড়িঘর উড়াইয়া পোড়াইয়া দেওয়ার কথা কখনও বলেননি)।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবিরবিরোধিতা : আমাদের দেশের একশ্রেণীর জ্ঞানপাপী, অন্ধ রবীন্দ্র ভক্ত অথবা ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথাও ফলাও করে প্রচার করেন অথচ এসকল প্রচারণার সাথে ঐতিহাসিক সত্যের কোন সম্পর্ক নাই। অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলেন, কবি ১৯০৬ সাল থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁর লেখনী পরিচালিত করেছেন কিন্তু ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয় না। সংক্ষেপে রবীন্দ্র জীবনী পর্যালোচনা করলে ব্যাপারটি বুঝা যাবে।
“কবি কিশোর বয়স থেকে মুসলমান বিরোধী কবিতা/ গান রচনা করেছেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর কলিকাতার সাম্প্রদায়িক নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে একের পর এক মুসলিম বিরোধী কবিতা-গান রচনা করেছেন। কবি উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিরোধী বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ পাল ও লালা লাজপত রায়ের সাথে সμিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের সূচনা থেকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। কোনভাবেই যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়নি তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে না গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছেন। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কবি মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন এই জন্য যে, নতুন পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশেই ছিল কবির জমিদারী। প্রজারা প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান। এমতাবস্থায় নিজ জমিদারীকে নির্বিঘড়ব করার জন্য এবং ইংরেজ প্রভুদেরকে খুশী করার জন্য তিনি কিছুদিন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু যখন ১৯১২ সালে ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষণা দেয় তখনই কবি পুনরায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
১. ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করা হয়। তখন কবির বয়স ছিল ৫১ বছর। ঠিক তার দু’দিন পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। ঐ গুরুত্বপূর্ণ সভায় বাঘা বাঘা হিন্দু নেতারা উপস্থিত ছিলেন। নতুন রাজ্য পুনর্গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন কিনা? বা শিক্ষা বিষয়ে করণীয় কি? আলোচনার জন্য এক জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ সভা হয় কলকাতার টাউন হলে। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ২য় খণ্ড, ৪র্থ পর্ব)।
২. “তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ চাননি যে, তার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত মুসলমান কৃষক ও শ্রমিক সন্তান এবং অনুনড়বতরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো পেয়ে ধন্য হোক।... বলতে আরো লজ্জা হয় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে (যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হয় তার জন্য) ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নীচতা এত নীচে নেমেছিল যে, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রƒপ করে বলতেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়।” (তথ্য, জীবনের স্মৃতিদ্বীপে : ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবুল আসাদের ১০০ বছরের রাজনীতি থেকে উদ্ধৃত, পৃ. ৭২) (উলে-খ্য, উক্ত আশু বাবু ছিলেন রবি ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়)
৩. ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন গৃহপালিত পশু। (নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অব আননোন ইন্ডিয়া)।
৪. তখনকার ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৬-এর ১১ সেপ্টেম্বর আরবি, ফার্সী মিশ্রিত চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানান পরিবর্তন যজ্ঞে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত স্বীকৃতি দেন। রবিবাবুর স্বাক্ষরের তলায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সই করেন। ( গোলাম আহমাদ মোর্তজা, এ এক অন্য ইতিহাস, পৃ. ১৬৬)।
৫. বিভাগ-পূর্ব ভারতের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি উঠলে রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করে বলেন : “ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম শাসন কায়েম হবে। সে জন্য হিন্দুদের মারাত্মক ভুল হবে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়া।”... “মহাত্মা গান্ধীকে মুসলমানেরা পুতুলে পরিণত করেছে। তুরস্ক ও খেলাফতের সাথে হিন্দু শাস্ত্রের কোন সংশ্রব নেই। (সাপ্তাহিক সুলতান, ১৯২৩ সালের জ্যেষ্ঠ সংখ্যা)।
যা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের আগে মুসলমানদের পক্ষে একটি লাইনও লিখেননি, একটি কথাও বলেননি। ১৯০৬ সাল থেকে মাঝে মাঝে কিছু বলার চেষ্টা করেছেন তবে যখনই দেখেছেন কোন কারণে মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে তখনই তিনি ভদ্রতার, মানবতার মুখোশ ছুঁে ড় ফেলে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর স্বরূপ কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রমত তিনি ছিলেন একজন মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হিন্দু কবি, দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী। বিদেশেও রবীন্দ্রনাথকে এরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯১৬ সালের ৬ অক্টোবর সানফ্রান্সিসকো একজামিনার পত্রিকায় লিখা হয়েছিলÑ বাংলায় “গতকাল নোবেল প্রাইজ বিজয়ী হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হত্যার চμান্তের সংবাদ পুলিশের নিকট পৌঁছামাত্র প্যালেস হোটেলে তার এপার্টমেন্টে এবং কলম্বিয়া থিয়েটারে যেখানে বিকালে তার ভাষণ দেবার কথা ছিল সেখানে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।” [পত্রিকাটি রবীন্দ্রনাথকে ‘হিন্দু কবি’ বলেছে। সত্যি তিনি হিন্দু কবি ছিলেন। মুসলমানের জন্য এক বর্ণও লিখেননি। মুসলমানের প্রতি ছিল তার তীব্র ঘৃণা। (অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্বীকারোক্তি।)]
(তথ্য : সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, পৃ. ৪৭১)
􀀠 রবীন্দ্র চরিত্রের বৈপরীত্য-
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন একই সরলরেখায় চলেননি। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কট্টর সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষী। চরমপন্থী তিলক, দস্যু সর্দার শিবাজী, উগ্রবাদী লালা লাজপত রায় থেকে আরম্ভ করে সকল সন্ত্রাসীদের পক্ষে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে, মুসলিম স্বার্থবিরোধী সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের সূচনাতে এবং বিস্তার লাভ পর্যন্ত সময় তিনি উক্ত আন্দোলনে যথাসাধ্য অবদান রাখতেন। কিন্তু উক্ত আন্দোলন যখন ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়তো তখন কবিকে দেখা যেত বিপরীত ভূমিকায় অথবা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চরম মুসলিম বিরোধী তিলকের নেতৃত্বে সংগঠিত শিবাজী উৎসবে, গরুরক্ষা আন্দোলনে কবি সূচনাতে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার পর্যন্ত কবি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় তিনি পুরোভাগে ছিলেন। বিশের দশকের খেলাফত আন্দোলন ও তিরিশের দশকের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনেও কবি খোলাখুলি হিন্দু স্বার্থের পক্ষে ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। উক্ত আন্দোলনসমূহ যখন সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পর্যায়ে পৌঁছাত তখন কবির অন্যরূপ দেখা যেত। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম : “তিনি ভয়াবহ দাবানল সৃষ্টি করতেন এবং পরে দূরে বসে ভস্মীভূত ছাইভস্মের পক্ষে কলম ধরতেন।” এটার আর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এই, “তিনি মনের তাগিদে সাম্প্রদায়িক আগুন প্রজ্বলিত করতেন কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছায় নিজেকে সংযত করতেন।” এর আরও একটি ব্যাখ্যা হতে পারে আর তা হলো, “তিনি পারিপার্শ্বিক প্রভাবে সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যেতেন কিন্তু পরবর্তীতে এর ভয়াবহ রূপ দেখে ভয়ে বা বিবেকের তাড়নায় পিছিয়ে আসতেন।”
উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ ইতিহাসের আলোকে আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কেউ আমার সাথে একমত না হলে আমার কোন দুঃখ নেই। বাংলাদেশের অসংখ্য রবীন্দ্রভক্তের শুভ দৃষ্টি লাভে আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনকে কয়েকটি ভাগ করে অন্তত একটি ভাগকেও অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বলা যায় কিনা? কিন্তু আমি হতাশ হয়েছি। আমার হতাশার কারণ নিমড়বরূপ :
১. ১৯০৫ সালে কবির বয়স ছিল ৪৫। অর্থাৎ তিনি তখন কোন আবেগতাড়িত তরুণ-যুবা ছিলেন না, তবু তিনি শুধুমাত্র নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
২. ১৯০৬ সাল থেকে কবি কিছুটা ভিনড়বরূপে আবির্ভূত হলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত দেখা গেল তিনি তাঁর প্রবন্ধে হিন্দুমুসলিম বিরোধ সম্পর্কে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করছেন, উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য প্রবন্ধ লিখছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। এ সময়টা ছিল বঙ্গভঙ্গের যুগ।
৩. কিন্তু ১৯১২ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলো এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলো তখন কবি আবার ১৯০৪-০৫ এর ভূমিকায় ফিরে এলেন। হিন্দু-মুসলিম সমতার কথা, সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা ভুলে গেলেন। তিনি আবার কট্টর বর্ণ হিন্দুতে পরিণত হলেন।
৪. ১৯১৪ সাল থেকে কবি পুনরায় মুসলমানদের পক্ষে সহানুভূতিপূর্ণ দু’চারটা প্রবন্ধ, বাণী লিখতে শুরু করলেন। আমরা ধরে নিলাম তাঁর বোধোদয় হয়েছে।
কিন্তু খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকালে গান্ধীর নেতৃত্বে যখন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন কবি আবার সাম্প্রদায়িক বর্ণ হিন্দু হয়ে গেলেন এবং বললেন, “ভারতে স্বায়ত্তশাসন এলে মুসলমান শাসন কায়েম হয়ে যাবে”। তিনি হিন্দুদেরকে যৌথ আন্দোলন থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেরও বিরোধিতা করেছেন কবি, কারণ মুসলিম ‘ফোবিয়া’। ১৯৩৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির নেতৃত্বে আরবিফাসীর্  মিশ্রিত চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে কোন কোন সময় নিজেকে মুসলিম হিতৈষী হিসেবে প্রমাণ করেছেন, কিন্তু কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে তিনি ছিলেন বর্ণবাদী হিন্দু। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য মূল্যায়ন করলে বলা কঠিন, তিনি আসলে কি ছিলেন? তিনি কি ব্রাহ্ম, নাকি হিন্দু, না বাউল, না সুবিধাবাদী। তবে প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় বলতে পারবেন, কবি ব্রিটিশের এজেন্ট হিসেবে কোনরূপ বৈপরীত্য দেখাননি। তবে হ্যাঁ এখানেও কথা থাকতে পারে। জীবনের সর্বশেষ বছরে তিনি দু-একটি সত্য কথা স্বীকার করেছেন, আর তা হলো :
১. “আর মিথ্যা লেখার প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দুমুসলমােনর মাঝখানে প্রকট বিরোধ আছে, আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তা নয়Ñ আমরা বিরুদ্ধ।... (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, পৃ.৬২৮)। ঠাকুরের কথায় কেউ যদি প্রশড়ব করে এতদিন মিথ্যা লেখার প্রয়োজন ছিল এখন হঠাৎ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল কেন? এর জবাব কী?
২. “আজ আমি বলিতেছি, ভারতবর্ষের দীনতম, মলিনতম কৃষককে আমি ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিব, আর ঐ যে রাঙ্গা সাহেব টম্টম্ হাঁকাইয়া আমার সর্বাঙ্গে কাদা ছিটাইয়া চলিয়া যাইতেছে উহার সহিত আমার কানাকড়ির সম্পর্ক নাই।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২শ খণ্ড, পৃ. ৫৬)।
৩. “আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে; প্রিয় হবার নয়।” (রাশিয়ার চিঠি, পৃ. ৫৯)।
অতএব বুঝা গেল কবি এতদিন ব্রিটিশ সরকার ও বর্ণবাদী হিন্দুদের প্রিয় হওয়ার জন্য সত্য থেকে দূরে ছিলেন। মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পেয়ে একেবারে শেষ দিকে তিনি সত্য হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও তিনি দীনতম, মলিনতম কৃষকদের উনড়বতির জন্য কিছু করেছেন এমন নজির নেই। যথা-
১. “সমগ্র ঠাকুর পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করেনি। স্কুল করা, দীঘি কাটানো এসব কখনো করে নাই। মুসলমান প্রজাদের ‘টিট’ করার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল।” (অনড়বদা শংকর রায়, দৈনিক বাংলাবাজার, তাং ১৪/৪/৯৭ এবং ০১/০৫/৯৭)।
২. “চারিদিকে নিষ্ঠুরতার এবং দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে রবীন্দ্রনাথের প্রাইভেট সেμেটারী অমিয় চμবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রজা সাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুর মশাই ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন, “বল কি হে অমিয়, আমার রথীন (কবির একমাত্র পুত্র) তাহলে খাবে কী?” (অনড়বদা শংকর রায়, ঐ)।
রবি ঠাকুরের আর একটি বৈপরীত্যের বিষয় উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্র মাটির দেশকে রক্ত মাংসের মা বানিয়ে তাতে দেবত্ব আরোপ করে রক্ত ও মস্তকভোজী দেবী বানিয়ে হিন্দুদেরকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং মাতৃবন্দনার গান ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করে সারাদেশে ভয়াবহ হিন্দুমুসলিম সংঘাত বাঁধিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দীক্ষাগুরু বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ এর আদলে মাতৃবন্দনার গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ লিখে ফেললেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনিই আবার এর বিরুদ্ধাচরণ করে লিখলেন-
১. “মাটির দেশকে মা বানিয়ে নেওয়া হলো, আবার দেবীর মত মনে করে দেশ-মায়ের কাছে সাহায্য চাওয়া হলো। কবির মতে, ওটা একটা নেশা ছাড়া কিছু নয়। তিনি লেখেন, কেননা, আমি এই বলি, দেশকে সাদাভাবে দেশ বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না,Ñ চিৎকার করে মা বলে, দেবী ব’লে, মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়Ñ তাদের সেই ভালবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়, যেমন নেশার প্রতি। (ভারতে জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথ; সংগ্রহেÑ অধ্যাপক দীপেন চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১২৭)।
২. কবি দেশকে মা’ মা’ বলে ডাকাকে প্রমে সমর্থন করেছিলেন এবং সেইভাবে গান-কবিতাও লিখেছিলেন। কিন্তু নিজের ভুল নিজেই শুধরে নিয়ে স্পষ্টভাবে দেশের লোককে জানিয়েছেন (ক) “শুধু মা’ মা’ বলে দেশকে যারা ডাকাডাকি করে তারা চিরশিশু। দেশ বৃদ্ধ শিশুদের মা নয়, দেশ অর্ধ নারীশ্বর- মেয়ে পুরুষের মিলনে তার উপলব্ধি।” (চার অধ্যায়, ১৯৩৪) (খ) বাংলাদেশের মেট্রিয়ার্কী বাইরে নেই, আছে নাড়ীতে। মা’ মা’ শব্দে হাম্বাধ্বনি, তা আর কোন দেশের পুরুষ মহলে শুনেছ কি? (ল্যাবরেটরী, ১৯৪০ দ্র:) [সংগ্রহ ঐ, পৃ. ১৯- ২০]
৩. অধ্যাপক দীপেন চট্টোপাধ্যায় কবির জন্য আরও লিখেছেনÑ “রবীন্দ্রনাথ ভাবাদর্শের দিক থেকে এই নগড়ব শক্তির উপাসনার বিরুদ্ধে ছিলেন। ভারতে শক্তি উপাসনা হয়ে আসছে ভয়ংকরী মা কালীর মূর্তিতে। ধার্মিক বিভ্রান্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সাধ্যমতো তা প্রত্যাখ্যান করেন। (ঐ, পৃ. ২০)। (বাঙালীর কবি রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশী এলিটগণ এখনও মা’ মা’ শব্দের হাম্বাধ্বনির মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারেনি)।
রবীন্দ্র প্রতিভা
রবীন্দ্র প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সমকালকে অন্তরচোখে উপলব্ধি করতে হবে। আমি অত্র প্রবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরের মেয়াদে যোগ্যতার মাপকাঠি ব্রিটিশ শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের পরিমাণের উপর নির্ভর ছিল। শাসককুলের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম ব্যক্তিগণকে জিরো থেকে হিরোতে পরিণত করা হয়েছিল পক্ষান্তরে বিরুদ্ধবাদীরা যতই যোগ্যতাসম্পনড়ব হোক না কেন তাদেরকে দেশের কোন কর্মকাণ্ডে জড়িত করা হয়নি, তদুপরি তৎকালীন ইতিহাসের কোথাও তাদের নাম পর্যন্ত খুেঁ জ পাওয়া যাবে না।
ব্রিটিশ শাসকগণ বাংলা এবং ভারতকে শাসন করার লক্ষ্যে প্রম ১২০ বছর বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এবং পরবর্তী ৭০ বছর হিন্দুমুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে কিছু লোককে বাছাই করে নিজেদের শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য। উক্ত বাছাইকৃত লোকগুলোই ছিল তৎকালীন ইতিহাসের বরপুত্র। তাদের মধ্যে সমাজের সকল পেশার লোকই ছিল। এসব লোকদেরকে ইংরেজী ভাষা লিখতে পড়েত জানলেই চলতো। তাদের হুকুমসমূহ পড়তে পারা এবং কাজ শেষে একটি রিপোর্ট প্রদান করতে পারাই যথেষ্ট ছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যে নিয়মে তাদের আজ্ঞাবহ চাকর সৃষ্টি করতো তা সাধারণত এইরূপ ছিল।
১. “বঙ্গবাসীকে দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে বশে আনতে হলে যাদেরকে নেতা বানানো হবে তাদের কিছুটা শিক্ষিত হতেই হয়। সেইজন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বা তাদের গৃহভৃত্যের কাজ দিয়ে বা ছোট ছোট স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা চালু ছিল। ঐ সময়কার তথাকথিত শিক্ষিত, যারা স্কুল ফাইনাল বা মেট্রিক পাস ছিল না, অথচ তাবেদারী, গোলামী ও বেঈমানীমূলক কাজ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত ও যোগ্য, তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা করে ফেলল, এবং ঠিক হলো যে, তারা মেট্রিক পরীক্ষায় না বসেও ডিগ্রী পরীক্ষায় বসতে পারবে।” (তথ্য : কলিকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫)
২. “এইসব স্যার উপাধিপ্রাপ্ত পণ্ডিতেরা সকলেই যে খুব পণ্ডিত ছিলেন তা নয়, এমন কিছু অপণ্ডিতও এই স্যার’দের দলে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছেন যাঁরা আসলেই মূর্খ। কিন্তু ব্রিটিশের বিশ্বাসভাজন হওয়া, বিশেষ করে বিপ্লবীদের দমিয়ে দেওয়া, লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়া, অকথ্য অত্যাচার চালানো, অনাদায় কর আদায় করতে অকথ্য নির্যাতন চালানোর বিনিময়েই হয়েছিল তাঁদের এই উপাধি।
এসব স্যারদের পাণ্ডিত্যের দু-একটি নমুনা ব্যতীত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
১. মহারাজা স্যার প্রতাপ সিং ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ মহিলাকে বলতে চেয়েছিলেন, প্রত্যেক মুহূর্তেই এই ইংল্যান্ড আমার ভাল লাগছে। সুন্দর ঘাসের উপর সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ পুরুষ
ও মহিলারা এই যে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াচ্ছেন, এটাআমার খুবই ভাল লাগছে। ইংরেজীতে উপরোক্ত কথাটা তিনি বলেছিলেন এইভাবে- Lekin, lady, I every time happy this England, horses gentleman, ladies gentlemen, and grass is gentleman.
২. সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে দিল্লীর দরবারে লর্ড কার্জন ও তাঁর স্ত্রী হাতিতে চড়ে গিয়েছিলেন। এটা স্যার প্রতাপের ভাল লাগেনি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “You eating knife and fork, I eating knife & fork. I not knowing this knife & fork. Great Mogul he knowing how mount this elephant. You not knowing. You sitting howdah in uniform with english lady. Great Mogul he mount properly. He dressed in white Moslin and squat by himself on elephants back. You sitting howdah, we laughing, you not knowing.” (বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস, ধনঞ্জয় দাস মজুমদার, প্রম খণ্ড, পৃ. ১২১)
৩. ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে ডাকা হতো টি.এন. মুখার্জী বলে। লেখাপড়া বেশি জানতেন না। মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের চৌকিদার ছিলেন। কর্মপটুতার জন্য হয়ে গেলেন উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্তা। মাইনে মাসিক ছয়শত টাকা। স্যার উইলিয়াম হান্টার তাকে কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের উচ্চকর্মী হবার সুযোগ করে দেন। পরে কলকাতা মিউজিয়ামের সুপারিনটেনডেন্ট পদে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি তার সহোদর দাদা রঙ্গলাল বাবুর সঙ্গে সহযোগিতা করে বিশ্বকোষ সৃষ্টি করেন। বেশি লেখাপড়া না জেনে ইংরেজী পুস্তক Art Manufacture of India, Visit to Europe বইগুলো লিখে ফেললেন। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, নীরদ বরণ হাজরা, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ)।
(উপরোক্ত উদাহরণগুলো দেখে অনেক পাঠক নিশ্চয় খুবই আফসোস করছেন কেন সে সময় দুনিয়াতে এলাম না। যদি আসতাম তবে ইংরেজের দালালী করে চৌকিদার থেকে বিশ্বকোষ প্রণেতা হওয়া যেত আবার স্যার-নাইট খেতাবও অর্জন করা যেত। বই না লিখেও গ্রন্থ প্রণেতা হওয়া যেত। উক্ত পাঠকবৃন্দের অবগতির জন্য বলছি, এখনও বাংলাদেশে অনেক ঘোড়ার ডক্টরেট রয়েছে, টাকা খরচ করলে অথবা সাম্রাজ্যবাদের দালালী করলে হরেকরকম ডিগ্রী, খেতাব পাওয়া কোন ব্যাপার নয়। আর বেশি নাম করতে চাইলে তসলিমা নাসরিনকে অনুসরণ করুন।)
৪. আর একটি কথা বলে রাখা ভাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রম তৈরি হয়েছিল ২টি উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি হল সিভিলিয়ান অফিসার ও ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা, আর দ্বিতীয়টি হলো একটি প্রভুভক্ত অনুগত স্তাবকদল তৈরি করা। শান্তিনিকেতনের কোন শাখা প্রশাখা না থাকলেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল ব্রিটিশদের সহকারী কেন্দ্রÑ শান্তিনিকেতনকে বস্তুত কলকাতার উপক্ষেত্র বলা যায়। বিশেষত: রবীন্দ্রকালে [ড. নীরদ বরণ হাজরা, কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, পৃষ্ঠা- ভূমিকা ৬।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ঠ া ক ুর ব া ি ড় ে ক একটি ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেখানে দেশী বিদেশী অনেক ভাষাভাষী অনুবাদক ও লেখক অবস্থান করত। তারা ব্রিটিশের ফরমায়েশ অনুযায়ী কবিতা, নাটক গ্রন্থ লিখত, অনুবাদ করত এবং কোন না কোন বাঙালীর নামে ছাপিয়ে দিত। বিখ্যাত কবি ইয়েটস ও মি. নেভিনসন ওরফে দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কবিকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য হয়ে যেমন মিস মার্গারেট নোবল অবিবাহিতা হয়ে আজীবন স্বামীজির পাশে ছিলেন ঠিক তেমনি দীনবন্ধু এন্ড্রুজ ৩৩ বছর বয়সে ভারতবর্ষে আসেন এবং আজীবন ভারতবর্ষে থেকে যান। তাঁর প্রধান আবাসস্থল ছিল শান্তিনিকেতন। উপরোক্ত মন্তব্যের সপক্ষে কয়েকটি প্রামাণ্য তথ্য উল্লেখ করা হলো :
১. কবির শান্তিনিকেতনের শিক্ষক কর্মী সহযোগী ও বান্ধবের দল যারা ছিলেন তাঁরা অনেকে নানা ভাষার যোগ্য অনুবাদকও ছিলেন। কবির প্রতিভা বিকাশের পূর্বে এতদিন যারা সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন তাঁরা বেশির ভাগই মুসলমান। যেমন মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, হালি, মীর্জা গালিব, ফিরদৌসী প্রমুখ ভারতীয় ও বহির্ভারতীয় কবি ও সাহিত্যিক। তাঁদের বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্য রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার বহু মিল দেখে কবি তাদের ভাব চুরি করেছেন না লিখে কথাটা উল্টোভাবে লেখা হলো ‘সমাজ দর্পণে’। “কবির জন্মের পূর্বেই মধ্যযুগের সাধকেরা বিনা স্বীকৃতিতেই চুরি করে নিয়েছেন। অদৃশ্য সিঁদ কাটবার কোথাও কোন একটি সহজ পথ নিঃসন্দেহে আছে।” (সূত্র : ডেইলী পত্রিকা, দৈনিক বাংলাবাজার, তারিখ ১/৫/১৯৯৭)।
২. “ঠাকুরবাড়ির ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কবিতা, কাব্য, গান, চিত্রাঙ্কনের প্রতিভা অধিকাংশেরই ছিল। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহা ছাড়া অর্থের জোরে বহু প্রতিভাবান ও প্রতিভাবতীদের তাঁরা পুষতে পারতেন, ইচ্ছামতো আনাতে পারতেন ও পারতেন ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে।” (অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ২৩)।
৩. কিছু গবেষকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথকে তৈরি করে নিয়েছেন ব্রিটিশ, আর নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। আমরা সকলে তাতে একমত হই আর না হই, কবির প্রখর প্রতিভা অনস্বীকার্য জেনেও তার পারিবারিক প্রারম্ভিক আলোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, যদিও তিনি কবিতা লিখতে পারতেন হঠাৎ একদিন তাঁর ভাগেড়ব জ্যোতিপ্রকাশ মামাকে ডেকে বললেন, “তোমাকে কবিতা লিখিতে হইবে। ইহার পর চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার কি করিয়া লিখিতে হয় তাহাও শিখাইয়া দিলেন। তখন তাহাকে আর কে ঠেকাইয়া রাখে।” (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩)
৪. “একটা কথা উড়িয়ে অস্বীকার করা যাবে না যে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পূর্বে কবির বাজারদর ছিল খুব নীচুমানের। মূল্য নির্ধারকেরা অনেকে লিখেছেন, “ঠাকুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশড়বপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল। এবং এটা ছিল ১৯১৪ সালে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির এক বছর পরে।” (জাস্টিস আবদুল মওদুদ; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর, ১৮৯২, পৃ. ৪০৮)।
৫. “এই প্রেক্ষিতে স্মরণ করা যাইতে পারে যে, ১৯০৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সঙ্গীতের উপর একটা ডিগ্রী দেবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অক্সফোর্ডের তদানীন্তন চ্যান্সেলর লর্ড কার্জন এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেন। কার্জনের বক্তব্য হলো, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিসম্পনড়ব গুণী ভারতবর্ষে আছেন।” (অধ্যাপক ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ : রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৪৮)।
৬. “১৯০০ সালে কবির বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে তিনি লিখেছিলেন, ভাই, একটা কাজের ভার দেব?... আমার গ্রন্থাবলী ও ক্ষণিকা পর্যন্ত কাব্যের কপিরাইট কোন ব্যক্তিকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পার? শেষের যে বইগুলি বাজারে আছে, সে আমি সিকিমূল্যে তার কাছে বিμি করবÑ গ্রন্থাবলী যা আছে, সে এক-তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব। (কারণ এটাতে সত্যের (সত্যেন্দ্রনাথ) অধিকার আছে। আমি স্বাধীন নই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে লোক কিনবে সে ঠকবে না... আমার প্রস্তাবটা কি তোমার কাছে দুঃসাধ্য বলে ঠেকছে? যদি মনে কর, ছোটগল্প এবং বৌ-ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষী কাব্য গ্রন্থাবলীর চেয়ে খরিদ্দারের কাছে বেশি সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, কাব্য গ্রন্থগুলোই লাভজনক।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ৭৯)।
(সুতরাং দেখা যাচ্ছে গ্রন্থের ব্যাপারে কবি স্বাধীন নন, তাতে অন্যের অধিকার আছে)।
৭. একমাত্র কালীপ্রসনড়ব বিদ্যাবিশারদ তার ‘মিঠেকড়া’তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, “রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। কিন্তু বরাবর এতো নির্বোধের মত লিখলে চলে কখনো।” (জ্যোতির্ময় রবি, ও কালোমেঘের দল, সুজিত কুমার সেনগুপ্ত, পৃ. ১১১)।
৮. “পাঁচকড়ি বাবু সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে, রবীন্দ্রনাথের μমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র।... কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগ বিশুদ্ধ ন্যাকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেনÑ রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ঐ)।
৯. রবীন্দ্র গবেষকদের বক্তব্য এই যে, রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতাটি মধ্যযুগের পারস্যের কবি মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর কবিতার নকল। যেটি পরে প্রমাণিত হয়েছে। যথা-
“বায্ আঁ, বায্ আঁ
হর আঁচে হাস্তী বায্ আঁ।
 গর কাফির গর গবর ওয়া
বোত পরস্তী বায্ আঁ।
ইদরগাহে মা দরগাহে
না উম্মীত নীস্ত।
শতবার গর তওবাহ শিকস্তী বায্ আঁ।”
রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
“এসো হে আর্য,এসো অনার্য
হিন্দু মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ
এসো এসো খ্রিস্টান।
মা’র অভিষেক এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”
(দ্র: ডেইলী পত্রিকা, দৈনিক বাংলাবাজার, তাং ১/৫/১৯৯৭)
১০. “রবিঠাকুরের রচিত ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ এবং ‘মানসী’ কাব্যের ‘বধূ’ কবিতা দু’টির ভাব ও কাঠামো ইংরেজ কবি মি. শেলী ও মি. ওয়ার্ডস্ ওয়ার্থের কবিতার অনুরূপ বলে অনেক গবেষকের মত। নারায়ণ বিশ্বাস প্রমে ধরে দেন ‘গোরা এবং ‘ঘরে বাইরে’ নকল। একথা অবশ্য আগে বলার চেষ্টা করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন সেন। তারপর পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত একটি মেয়ে ও ‘গোরা’ এবং ‘ঘরে বাইরে’র সাথে দু’টি ইংরেজী উপন্যাসের সাদৃশ্যের কথা বলেছিলেন। এর বেশি বলতে সাহস পাননি। কালী মোহন ধরে দিয়েছিলেন রবীন্দ্র কবিতার নকল।” (সূত্র : ঐ)।
১১. “এই রবীন্দ্রনাথই ড. ডেভিডের মধ্যস্থতায় আন্ডারসনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘চার অধ্যায়’ লেখেন। এটা এখন প্রমাণ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ‘ঘরে বাইরে’ও তাঁকে টাকা দিয়ে লেখানো হয়।” (সূত্র : ঐ)।
১২. “তিনি (দীনবন্ধু এন্ড্রুজ) রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী যেখানে উচ্চাঙ্গের বলিয়া মনে করিতেন না, উহাকে সাহিত্যিক করিয়া দিতেন।... রবীন্দ্রনাথের যেসব মত তাঁহার ভাল লাগিত না তাহা বদলাইয়া নিজের বিচার অনুযাযী পরিবর্তন করিয়া দিতেন। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু সম্ভব শ্রেষ্ঠ এনড্রুজ বলিয়া দেখাইতে চাহিতেন।” (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩)।
১৩. অমিতাভ চৌধুরী তাঁর ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ পুস্তকে লিখেছেন, “গীতাঞ্জলি নামটাই ধার করা। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন শিলাইদহের কুমারখালী অঞ্চলে। কুমারখালীর বিশিষ্ট তান্ত্রিকের সঙ্গে পরিচিত হন। বাংলা ১২৯৫ অর্থাৎ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যার্নব মশাই একটি বই লিখেন। বইটির নাম ‘গীতাঞ্জলি’। কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রে মহেশচন্দ্র দাস মুদ্রিত করেন।”
“...‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর জনরবের কি ধুম- রবীন্দ্রনাথ কোন বাউলের খাতা চুরি করে ছেপে দিয়েছেন। ... শেষে অবশ্যি নামও জানা গেল। স্বয়ং লালন ফকির মহাশয়ের বাউল গানের খাতা চুরি করেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আজ অবিশ্বাস্য শুনালেও একথা কিন্তু সত্য, সেদিন বহু ব্যক্তি শান্তিনিকেতনের বিভিনড়ব কর্তাকে বলেছেন এবং লিখেছেন, রবিবাবু বড় কবি স্বীকার করি।... যাকগে, তা গীতাঞ্জলির খাতাটা এবার উনি ফিরিয়ে দিন। প্রাইজ তো পেয়েই গেছেন, অনেক টাকাও হাতে এসে গেছে, ওতো আর কেউ নিতে যাচ্ছে না, তা, গান লেখা খাতাটা উনি দিয়ে দিন।” (জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল, সুজিত কুমার সেনগুপ্ত, পৃ. ১৬১)।
নীরদ বাবু দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র যে কবিতাগুলো অনুবাদ করে বা করিয়ে তিনি পেয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ,সেগুলো ইংরেজ কবিদের নকল মাত্র। এটা তার ভিত্তিহীন দাবি নয়। কবির ইংরেজী করা গীতাঞ্জলির ৬১, ২৬ ও ৮৬ নং কবিতাগুলোর পাশাপাশি ইংরেজ কবি ঝড়ষড়সড়হ এবং ঝঃ. ঋৎধহপরং-এর কবিতা বা গান পরস্পর সাজিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা কবিতার সঙ্গে ইংরেজ কবিদের বহুলাংশেই মিল রয়েছে। অনেকের ধারণা, ভাব ও ভাষায় মিল রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। তাহলে কি তাঁদেরই (ব্রিটিশদের) ইঙ্গিতে বিলেতের কবিদের ‘থীম’ তাঁকে পূর্বেই গোপনে পরিবেশন করা হয়েছিল?” (আত্মঘাতী বাঙালী, নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড)।

‘গীতাঞ্জলি’র গুপ্ত রহস্য বলতে গেলে আরও দু- একটি কথা জানানো প্রয়োজন। ‘গীতাঞ্জলি’ যারা দেখেননি তারা অনেকে মনে করেন যে, মোটা ‘গীতাঞ্জলি’ বইখানার পুরো ইংরেজী অনুবাদ বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর তাঁর কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁরা দিয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ।
“ইহার পর ইংরেজী ‘গীতাঞ্জলি’তে রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কবিতার অনুবাদ আছে বলা প্রয়োজন। ইহার নাম ‘গীতাঞ্জলি’ হইলেও বইটিতে বাংলা গীতাঞ্জলির সব গান (বা কবিতা) অনুদিত হয় নাই। বাংলাতে ১৫৭টি গান ছিল, উহার মধ্যে শুধু ৫৩টি মাত্র ইংরেজী করা হইয়াছিল, ইংরেজী ‘গীতাঞ্জলি’তে সবশুদ্ধ ১০৩টি কবিতা ছিল (বইটি বড় টাইপে মাত্র ১০১ পৃ. হইয়াছিল, দাম হইয়াছিল মাত্র চার শিলিং ছয় পেন্স, আমাদের টাকায় তিন টাকা ছয় আনা)। বাকি ইংরেজীতে অনুদিত কবিতা আসিয়াছিল প্রধানত ‘নৈবেদ্য’ ও ‘খেয়া’ হইতে, অল্প কয়েকটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবিতা হইতে।” (দ্র: ঐ, পৃ. ১৪২)।

বঙ্গভঙ্গ যখন রদ হয় তখন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস। কত রক্তারক্তি, গুলি, জেল প্রভৃতির তাণ্ডবনৃত্য। কবি তখন সপক্ষ-বিপক্ষ কোন পক্ষেই না গিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য খুবই কর্মব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়েও তিনি বিলেতে, বিলেতে একবার নয়Ñ বহুবার তাঁকে যেতে হয়েছে। এমন যে তাঁর প্রতিভার বিচার হয়েছে তার লেখার উপর তারপর তাঁকে তাঁর প্রাসাদে থাকা অবস্থায় পুরস্কৃত করা হয়েছে। বরং ১৯১২তে বঙ্গভঙ্গ হয় আর ১৯১৩-তে তিনি দেশে ফেরেন অক্টোবরে। আর তাঁর পিছনে পিছনে নভেম্বর মাসেই তাঁর নোবেল প্রাইজের সংবাদ পৌঁছাল, কোন শর্ত হয়েছিল কিনা? কোন রাজনৈতিক চμান্ত হয়েছিল কিনা? (কালান্তর, বিশ্বভারতী ১৩৫৫ সংস্করণ, পৃ. ১৬৯)।

‘জনগণমন’ তিনি লিখেছেন আশুতোষ চৌধুরীর পরামর্শে, ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে। আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন তাঁর ভাইঝি জামাই, প্রমথ চৌধুরীর বড় ভাই। ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জকে তিনি ভারতের ভাগ্য বিধাতা আখ্যা দিয়ে লিখেছিলেন উক্ত গান। এর প্রম লাইনটি হচ্ছে : ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা’
উক্ত সময়ে নোবেল প্রাইজ প্রদান কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন সম্রাট ৫ম জর্জ। অনেকের মতে সম্রাট ৫ম জর্জ খুশী হয়ে কবির জন্য নোবেল প্রাইজের ব্যবস্থা করেছিলেন।

রবীন্দ্র প্রতিভা সম্পর্কে আমার নিজের কোন কথা নেই। উপরোক্ত মনীষীদের বক্তব্য-মন্তব্য থেকে পাঠক যা অনুমান করবেন, আমার অনুমানও তাই।
রবীন্দ্র চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
ইতিপূর্বে আমি যে সকল তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ রাজশক্তির মনোনীত ব্যক্তি, ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট বিশ্বকবি এবং আজীবন তিনি ব্রিটিশের পক্ষেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এহেন সাম্রাজ্যবাদের গোলাম নিশ্চয়ই কোন স্বাধীন ব্যক্তির ও জাতির আদর্শ হতে পারে না। এরূপ ব্যক্তির সাহিত্য সাধনা স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত না করে ভূলুণ্ঠিত করে। এরূপ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দেশ ও জাতিদ্রোহী তৎপরতার কারণেই ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ ভারতবর্ষে দীর্ঘায়িত হয়েছিল। ব্রিটিশের মনস্কামনা পূর্ণ করতে এসব মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীগণ বাঙালী জাতীয়তাবোধের চেতনাকে, গর্বকে, স্বকীয়তাকে বর্ণবাদী আর্য সাম্রাজ্যের পদতলে বিসর্জন দিয়েছিল। ইতিহাস পাঠকগণ একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, ব্রিটিশ শাসকদেরকে এদেশে ডেকে আনা, ক্ষমতায় বসানো, ভারতব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনসহ সবকিছুতেই বাঙালী বাবুদের রক্ত-ঘাম-শ্রম সর্বোচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ সকল নির্বোধ বুদ্ধিজীবীগণ কোন বাংলা ভাষাভাষী দেশনায়ক খুেঁ জ পাননি অথবা খোঁজার চেষ্টা না করে ব্রিটিশের প্রেসμিপশন মোতাবেক রাজপুত, মারাঠা ও শিখ জাতির ব্যক্তিদেরকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল। ফলে বাঙালী জাতীয়তার খাত বদল হয়ে ভারতীয় জাতীয়তায় রূপান্তরিত হয় এবং ভারতবর্ষের রাজধানী এবং কর্তৃত্ব বাঙালীদের নিকট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে দিল্লীতে এবং বর্ণহিন্দু আর্যদের নিকট চলে যায়।
তাহলে ফল দাঁড়াল কি? ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা গেল, রাজধানী বা কর্তৃত্ব কোনটাই আর বাঙালীদের হাতে নেই। বাঙালীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর পরই বর্ণবাদী আর্য ভারতের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো। যার অনিবার্য ফলশ্র“তি হলো আমাদের ভগড়ব-জরাজীর্ণ কোলকাতা শহর ও দিল্লীর পশ্চাৎভূমি বা শোষণের ক্ষেত্র পশ্চিম বাংলা। আরেকটি ঐতিহাসিক শিক্ষা সকলের স্মরণে থাকা দরকার, তা হলো, পশ্চিমা মুসলমানেরা পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে প্রম শ্রেণীর মুসলমান মনে করতো না এবং উত্তর ভারতের আর্য হিন্দুরাও তদ্রƒপ পশ্চিম বাংলার হিন্দুরদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু মনে করে। পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ পশ্চিমা মুসলমানদের অহংকারকে ১৯৭১ সালে চূর্ণ করতে সক্ষম হলেও পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা আর্য প্রাধান্যকে, প্রভুত্বকে ইতিহাসের শাস্তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা ছিল রাজধানী কোলকাতার শোষণের ক্ষেত্র আর বর্তমানে কলকাতা হচ্ছে দিল্লীর শোষণের ক্ষেত্র।
তবে আশার কথা হচ্ছে, ইতিমধ্যে পশ্চিম বাংলার কিছুসংখ্যক স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রগোষ্ঠীর অশুভ কার্যকলাপের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে এবং নিজেদের আশু কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। বাঙালীদের স্বাধীনতার শত্র“- মিত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীরা এতদিন যেসকল বাঙালী বুদ্ধিজীবী যথা হরপ্রসাদ, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ গংকে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক হিসেবে সম্মান করেছিলেন তাদেরকেই অদূর ভবিষ্যতে বাঙালী স্বাধীনতার শত্র“পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং বাঙালী স্বাধীনতার সত্যিকার বীর পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শরৎ বসু, সুভাষ বসু, শেরে বাংলা, আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে মর্যাদা দান করবে। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন পশ্চিম বাংলাকে আর্য হিন্দুদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোন স্বাধীন মানুষের আদর্শ হতে পারে না। এখন আমরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব তাঁর সামাজিক চিন্তাধারা আমাদের চলার পথে অনুকরণযোগ্য কিনা? সামাজিকভাবে তিনি ছিলেন প্রজাপীড়ক বর্ণবাদী জমিদার। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অবাধ যৌনাচার বা ব্যভিচারের পক্ষে। কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বোধগম্য করা হলো:
১. “কবির সঙ্গে তার (বৌদি) কাদম্বরীর অবৈধ প্রেমকে কেন্দ্র করে নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংঘর্ষ হয়েছিল। সেটাকে কেন্দ্র করে ডক্টর নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত ‘পাপের ছাপে’ লেখায় কবি বিরুদ্ধ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ঠাকুরবাড়ির সুভোঠাকুর সম্পাদিত ‘ভবিষ্যত’ পত্রিকায় কবির বিরুদ্ধে লেখা বের হয়- পয়েট টেগোর কে হন তোমার জোড়াসাঁকোতেই থাকো/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি, মোর কেহ হয় নাকো।” (অধ্যাপক দীপন চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩)।
২. “রবীন্দ্রনাথ নিজেকেও বাউল বলে পরিচয় দিয়েছেন। ড. সুধীর বাবু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “তাঁর কোন কোন রচনাকে তিনি ‘রবীন্দ্র বাউলের রচনা’ বলে মেনে নিয়েছেন।” (দ্র: ‘দেশ’, পৃ. ৩৬, ডিসেম্বর ১৯৯১)।
৩. “বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী বাউলদের সম্পর্কে লিখেছেন, “দেহের মধ্যেই তাহাদের বিশ্ব। জাতি ও সমাজের বন্ধন উভয়ের কাছেই অর্থহীন।” (বাংলার বাউল, শ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী, পৃ. ২)।
৪. “মিথুনাত্মক যোগসাধনা আধ্যাত্ম্যবাদী বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার মূল পদ্ধতি। বাউলের সাধনা দেহকেন্দ্রিক। ‘দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুর’ অন্বেষণই বাউলের সাধনার সার।” (দ্র: বসন্ত কুমার পাল, মহাত্মা লালন ফকির, পৃ. অবতরণিকা-১০)।
সুতরাং পাঠকবৃন্দ বুঝতেই পারছেন, আমাদের বাউল কবি রবি ঠাকুর সুযোগ পেলেই ‘দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুর’ খোঁজায় লিপ্ত হতেন। এ বিষয়ে তিনি কোন রাখঢাকের ধার ধারতেন না। দু-একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকবৃন্দ বুঝে নিবেন :
১. “আমাদের ভারতীয় সমাজে কথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষই অতিমানুষ, মহান মানুষ, প্রতিভাবান মানুষের প্রতি ভক্তির মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে তাঁকে বানিয়ে ফেলেন ঋষি-মহাঋষি, যোগী, মুণি, সাধকÑ সবশেষে ভগবান পর্যন্ত করে ফেলেন তাঁকে। অপরদিকে, চরিত্রহীন, লম্পট, সমাজবিরোধী, অসংযমী, ব্যভিচারী প্রভৃতি লোককে সমাজের এত পরির্তন হওয়া সত্ত্বেও ভাল চোখে দেখা হয় না। কবির ব্যক্তিগত ব্যবহারিক জীবনে নারীসঙ্গ, অবাধ মেলামেশা, যৌনতা বিষয়ে বিতর্ক আনবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী।” (এ এক অন্য ইতিহাস, গোলাম আহমাদ মোর্তজা)।
১৯২৮ সালের ১লা ফেব্র“য়ারি তাঁর সেড়বহধন্য দিলীপ কুমার রায়কে কবি এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। বিষয়- নারীর ব্যভিচার। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, “সমাজে যদি অশান্তি না ঘটে তাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। ব্যভিচারের ফলে যদি সন্তান সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আজকাল সেটাও সমস্যা নয়। কেননা কন্ট্রাসেপটিভ বেরিয়ে গেছে। নিবারণের উপায়গুলোও সহজ। সুতরাং গর্ভধারণ করতে হয় বলে দেহকে সাবধান রাখার দায় আর তেমন নেই।... সমাজ নিজের প্রয়োজনবশত: স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখে। ঠেকিয়ে রাখতে তার অনেক ছলবল- কৗশল অনেক কড়াকড়ি, অনেক পাহারার দরকার হয়। কিন্তু প্রয়োজনগুলোই যখন আলগা হতে থাকে, তখন স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখা আর সহজ হয় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের দৃষ্টান্ত দেখ না। আমার যখনই ক্ষিদে পায়, তখন আমার গাছে যদি ফল না থাকে, তবে তোমার গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতে আমার স্বভাবতই ইচ্ছা হয়। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তি সম্পত্তির সীমা রক্ষা করা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে অত্যাবশ্যক, এজন্যই ফল পেড়ে খাওয়াটা চুরি। এই চুরি সম্পর্কে সমাজ আমাদের মনে যে সংস্কার দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছে সেটা নিজের ব্যবস্থা রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে।... বস্তুত: চুরি না করার নীতি শাশ্বত নীতি নয়। এটা মানুষের মনগড়া নীতি। এ নীতিকে পালন না করলে সমাজে যদি অশাস্তি না ঘটে, তবে পরের দ্রব্য নেওয়া চুরিই নয়। এই কারণে তুমি দিলীপ কুমার রায় যদি আমি রবীন্দ্রনাথের লিচু বাগানে আমার অনুপস্থিতিতে লিচু খেয়ে যাও, তুমিও সেটাকে চুরি বলে অনুশোচনা কর না। আমিও সেটাকে চুরি বলে খড়গহস্ত হই না। ব্যভিচার সম্বন্ধে এই কথাটাই খাটে। এর মধ্যে যে অপরাধ সেটা সামাজিক। অর্থাৎ সমাজে যদি অশান্তি ঘটে, তবে সমাজের মানুষকে সাবধান হতে হয়। যদি না ঘটে, তাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। (দ্র: অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ পড়ে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়েছেন এবং অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন কেন আমাদের দেশে রবীন্দ্রভক্ত এত বেশি এবং বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরীন রবীন্দ্র ভক্ত বুদ্ধিজীবীদের নামে ‘ক’ ‘খ’ লিখতে বাধ্য হয়েছেন। রবীন্দ্র ভক্তরা কি ঋষি কবিকে ভক্তি করেন, নাকি রক্ত মাংসে গড়া ষড়রিপুর দাস বাউল কবি রবীন্দ্রনাথকে বেশি ভালবাসেন?

No comments:

Post a Comment