Sunday 19 March 2017

স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা।


স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা_শাহিদ আহমদ হাতিমী
 ::
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বিচিত্র পৃথিবীর অপূর্ব সুন্দর একটি দেশ। যার আকাশটা উদার অসীম নীল। ভূমিটা সবুজ-শ্যামল, উর্বর-সমতল। দেশটিতে আছে মাটির মমতা ভরা ঘরবাড়ি, প্রাণ জুড়ানো ফসলের হাসি, খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। আছে এদেশের মানুষগুলোর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট। ঈদে-ঈদগাহে, কীর্তনে-মন্দিরে, পূঁজায়-গীর্জায় উৎসব পালনের স্বাধীনতাও আছে। আছে ধর্ম-বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধার চেতনায় স্বাধীনতা সংগ্রামে এক হওয়ার ঐতিহ্য। আছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রক্ত দেয়ার অধ্যায়। আছে ভাষা আন্দোলনের সোনালী ইতিহাস। আছে মওলানা ভাসানীর দাবি, শেখ মুজিবের ভাষণ, জিয়াউর রহমানের ঘোষণা। রয়েছে ষাটগম্বুজ স্থাপনা, লালবাগ কেল্লা, নয়নকাড়া সংসদ ভবনসহ নানা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। আরও আছে সবুজের ছায়াময় বিস্তৃত জমিন। সোনালী ধানে ভরা ক্ষেত। রয়েছে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা ছোট-বড় নদ-নদী। অনেক কিছুই আছে। দেশটির রূপ-রস, সৌন্দর্য-মাধুর্য্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে সবাই বলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়েও অনেকে লিখেন কিন্তু এই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা, ত্যাগ, অবদান ও আত্মদানের কথা অনেকেই লিখেন না বা লিখতে চান না। চলমান প্রয়াসে সে বিষয়ের আলোকপাত।

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। অনেকের মতো আলেম সমাজও এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অসংখ্য উলামায়ে কেরামগণ তাদের জানমাল, শক্তি সামর্থ্য দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীকার আদায়ে ও মজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর সাক্ষাৎকার, যা মার্কিন টেলিভিশন এবিসির মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক বব ক্লার্কের এক প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, আলেম সমাজ মুক্তিযুদ্ধে জনগণের পাশে ছিলেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেণহাস লেখেন- ‘কুমিল্লার নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে আমার সফরকালে আমি দেখেছি, পাঞ্জাবি অফিসারগণ বাঙালিদের ইসলামের আনুগত্যের প্রতি সব সময়ই সন্দেহ পোষণ করত। তারা বাঙালি মুসলমানদের কাফের ও হিন্দু বলত।’
‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ এ বাণীর মর্ম অনুধাবন করে স্বদেশপ্রীতির প্রেরণায় কত মানুষ যে যুগে যুগে কত স্বার্থ ত্যাগ করেছে, তার হিসেব নেই। প্রকৃত দেশপ্রেমিক দেশ ও জাতির জন্য প্রাণ দেওয়াকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে। প্রকৃত অর্থে দেশ ও জাতির সেবায় তথা মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে পারলে সত্যিকার দেশপ্রেমিকরা নিজেকে ধন্য মনে করেন। দেশের স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন, মানবতা যেখানে বিপর্যস্তÍ, সেখানে দেশ ও দেশবাসীর মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করা সবার জন্য একান্ত প্রয়োজন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অনেক রক্তের বিনিময় ১৯৭১ সালে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে হিজল-তমাল, তরুলতা আর সবুজ-শ্যামলতায় ঘেরা রূপসী বাংলাদেশ। বিশ্বের দরবারে আমাদের আত্মপরিচয় ঘটেছে স্বাধীন বাঙালী জাতি হিসেবে।
অনেকের ধারণা, আলেম সমাজের পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধে কওমী মাদরাসাগুলোও তেমন অবদান রাখেনি। তাদের ধারণা ভুল। এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের শীর্ষ কওমী মাদরাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম মাদরাসা হলো চট্টগ্রামের জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা। এই মাদরাসাটি ইতিহাসের স্বাক্ষী। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে পটিয়া মাদরাসার একাধিক শিক্ষককে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিৎ হয়, পটিয়া মাদরাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন, তখনই (১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল) পটিয়া মাদরাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষনে পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও ক্বারী মাওলানা জেবুল হাসানসহ অনেকেই শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর রাজাকার বাহিনীর হাতে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য দেশের একজন স্বনামধন্য আলেমও শহীদ হয়েছিলেন। তার নাম মাওলানা অলিউর রহমান। ১৪ ডিসেম্বর উনার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বেয়নেট দ্বারা খুচিয়ে খুচিয়ে উনাকে হত্যা করে। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার জয়দা গ্রামের মাওলানা বাড়ির সবাই মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। মাওলানা বাড়ির ছেলে মাওলানা হাবীবুর রহমান, যিনি সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এর সনদ ক্রমিক নং ১০০৯। মাওলানা বাড়ির জামাই হাফেয মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আহমদ ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধা। উনার ক্রমিক নং ৯৫২। এইরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
“মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য রাজবাড়ী জেল খানায় মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাওলানা কাজী ইয়াকুব আলীকে গলা কেটে হত্যা করে, তারপর তার পেটের মাঝখানে পাকিস্তানি পতাকা পুঁতে দিয়ে বলে, ‘আভি শালা জয় বাংলা বোলো’।
শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালে এই দেশে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসাকেন্দ্রিক আলেমদের সংগঠন “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” এর নেতারাও কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অনেক ফতোয়া, বিবৃতি দিয়েছিলেন। “১৯৭১ সালে দেওবন্দি আলেম শায়খুল ইসলাম মুফতী আমীমুল এহসান রাহ. পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফতোয়া দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া সরকার তাঁকে জোর করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাংলাদেশে ফিরলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রধান খতীব হিসেবে নিযুক্ত করেন।
১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সবচেয়ে বড় কওমী মাদরাসার প্রধান মুহতামিম ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রাহ. পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অনেক বড় বড় আলেম তার ফতোয়া শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অনেক মুক্তিযুদ্ধাকে আল্লামা তাজুল ইসলাম নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।
সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত সেই বইটির নাম- ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে।’ এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায় শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেবার রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন মত ও পেশার লোকেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলার আলেম সমাজও এর থেকে দূরে ছিলেন না। তবে আলেমরা কিন্তু আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগ করতেন না। কওমী মাদরাসা পড়ুয়ারা শুধু দেশ মাতৃকার টানে ও নির্যাতীত নারীদেরকে পাকিস্তানী হানদার বাহিনীর লালসার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তথাকথিত কিছু ইসলামী দলের কতিপয় ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপকর্মকে ভিত্তি করে দয়া করে সকল আলেম উলামাদেরকে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বলে গালি দিবেন না।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল জালিম-মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা ছিল জালিম। এ দেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ জালেমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তার পক্ষে কথা বলা, এটাই বিবেকের দাবি। মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী, আড়াইহাজার থানা কমান্ডার শামছুল হক (সাবেক এমপি) এর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি লালবাগ মাদ্রাসার ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। আমি হাফেজ্জী হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা কী হবে? হুজুর বললেন, অবশ্যই জালেমদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। তাঁর এ কথায় আমি পাকিস্তানিদের জুলুমের প্রতিবাদের প্রেরণা পাই এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা, তারেক ওয়াহিদ বাট তার ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডার ইসলাম আওর পাকিস্তান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালামের কথায়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমি করাচি ইউসুফ বিন্নুরী মাদরাসার ছাত্র। একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদরাসায় এলে তাঁকে এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাদ্দারকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁকে কি এখনো হত্যা করা হয়নি? এ কথা শুনে মুফতি মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন, কাকে গাদ্দার বলছো? মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন সুন্নি মুসলমান। প্রত্যেক মুসলমানের জানমালের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
মুফতি মাহমুদ রাহ. ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহইয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। [সূত্র: কাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী/সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট, মুফতি মাহমুদ নাম্বার, পাকিস্তান] তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং এ দেশের মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে অনেক আলেমরা কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শাহখুল হাদিস মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রাহ. প্রিন্সিপাল, মালিবাগ মাদ্রাসা ঢাকা, শায়খুল হাদিস মরহুম তাজাম্মুল আলী সিলেট, মাওলানা আবুল হাসান যশোরী রাহ., ময়মনসিংহের মরহুম মাওলানা আরিফ রাব্বানী, মুফতি নুরুল্লাহ বি-বাড়িয়া, মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, জমিয়ত নেতা আল্লামা মুস্তফা আযাদ আরজাবাদ ঢাকা, খলিফায়ে মাদানী মাওলানা আব্দুল মতিন চৌধুরী শায়খে ফুলবাড়ি, জাঈমুল ক্বওম মাওলানা হাবিব উল্লাহ সিলেট প্রমুখ আলেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে শায়খুল হাদিস কাজী ম’তাসিম বিল্লাহর ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা, প্রখ্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যিদ আসআদ মাদানী রাহ.’র ভূমিকা অবিস্মরণীয়। পাকিস্তান বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা করলে তিনি তাৎক্ষণিক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মিটিং আহ্বান করে তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর জোরালো বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এরপর পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করলে তিনি তার প্রতিবাদে লাখো জনতা নিয়ে দিল্লিতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের দিল্লি অফিসে বিদ্যমান রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে হাফেজ্জী হুজুর রাহ.’র হাতে বায়আত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে হাফেজ্জী হুজুরের মতো রাজাকারের শিষ্যত্বে এলেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, হাফেজ্জী হুজুর রাজাকার ছিলেন না। একাত্তরের যুদ্ধ আমরা জালেমদের বিরুদ্ধে করেছি, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের বাম রাজনীতিকরা ইসলামী দলগুলোর চরিত্রের ওপর বিচার করে আলেমদের রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। অথচ তারা জানেন না, আলেমরা ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা না করলে আজো এই ভারত উপমহাদেশ পরাধীন থাকতো।”
২০০৫ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ একটি জাতীয় দৈনিকে লেখক মুহাম্মদ ফায়জুল হক ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে আলেম মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামে লেখায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নিরীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা স্বাধীন বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা আলেম মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ বিন সাঈদ জালালাবাদী ইসলামের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং মানুষকে ইসলামের আলোকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতেন।
আমরা এ ক্ষুদ্র প্রয়াসে স্বাধীনতাযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা, অবদান এক পলক উপখ্যান ও কিছু কথা এবং কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা আলেমের নাম, [প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতায় যাঁদের অবদান রয়েছে] তাঁদের সম্পর্কে যৎসামান্য হলেও জানতে পারলাম। এ ধরণের বহু আলেম নিঃসন্দেহে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁদের সঠিক ইতিহাস জানি না বা জানারও প্রয়োজন মনে করি না। আলেমসমাজও এর প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কিন্তু এতে যে আলেম সমাজ সাধারণ জনগণ থেকে দূরে থেকে যাচ্ছেন, এটা অবশ্য আলেম সমাজের বোঝা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি এবং সে সাথে একটি আহবান জানাচ্ছি। এখানে একটি বিষয় বলাবাহুল্য যে, সেক্যুলার রাজনীতি যারা করেন, তারা আলেমদের থেকে দূরে থাকার কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধে আলেমদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে থাকেন। আলেমসমাজকে স্বাধীনতাবিরোধী মনে করার একটি বড় কারণ হলো, স্বাধীনতার পর এ দেশে বেশ কিছু জাতীয় দিবস, যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি দিবস সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়। কিন্তু এসব দিবসে সাধারণত আলেমসমাজ ও ইসলামী দলগুলোর কোনো ভূমিকা থাকে না, তারা এর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না। এতে স্বাভাবিকভাবেই আলেমদের প্রতি সাধারণ মানুষের সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং তারা আলেমদের থেকে দূরে সরতে থাকেন। অথচ বিষয়টা এমন না হয়ে যদি আলেম সমাজ এসব জাতীয় দিবসগুলো ইসলামী ভাবধারায় তাঁদের মতো করে পালন করতেন। সেসব দিবসে তাঁরা যদি আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, দোয়া মাহফিলের আয়োজন করতেন, তাহলে মনে হয় আলেম সমাজ অহেতুক সমালোচনার পাত্র হতেন না এবং সাধারণ মানুষ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ সুশীলসমাজের সঙ্গে আলেমদের যে দূরত্ব রয়েছে, তা অনেকাংশে কমে যেত এবং সাধারণের সঙ্গে তাদের সেতুবন্ধন তৈরি হতো। আলেমরা হতেন সমাজের সব শ্রেণীর শ্রদ্ধাভাজন। আমাদের মনে হয়, বিষয়টা আলেমসমাজের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা আলেমদের সঠিক ইতিহাস রচিত হোক, সাধারণ ও আলেমদের মাঝে তৈরি হোক সেতুবন্ধন। আলেমরা হোন সবার শ্রদ্ধাভাজন, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। মুহতারাম আলেমগণের প্রতি এই আহবানটুকুই করছি, আমরা আপনারা এ দেশের নাগরিক। আমাদের ধর্ম শিখিয়েছে “হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান”। সুতরাং আসুন দেশ ও রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিগুলোর প্রতি একটু মনযোগী হই। বিশেষত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত দিবসগুলো পালন করি।

তথ্য সূত্র.
১। আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলী।
২। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিল পত্র (৩য় খণ্ড)
৩। স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র, বেলাল মোহাম্মদ।
৪। আমি বিজয় দেখেছি, এম আখতার মুকুল।
৫। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়েকেরাম, সৈয়দ মবনু।
৬। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস (২য় খণ্ড), আবু মুহাম্মদ দেলওয়ার হোসেন।
৭। শায়খুল ইসলাম মুফতী আমিমুল এহসান, জীবন ও কর্ম (ইফা প্রকাশিত)।
৮। ফখরে বাঙাল মাওলানা তাজুল ইসলাম ও উনার সাথীবর্গ, নূরুজ্জামান (ইফা প্রকাশিত)।http://komashisha.com/files/?p=5156

লেখক : কলামিস্ট, সম্পাদক-পুষ্পকলি।

No comments:

Post a Comment