শেষ পর্ব । রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন ।
রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি
(‘রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি’ এই অংশটি আমার ছাত্রজীবনে রচিত, যখন আমি বিশ্বাস করতাম, রবীন্দ্রনাথের নামে প্রকাশিত কাব্যসমূহ তাঁর মৌলিক রচনা)
প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা কবিতায় প্রকৃতি বিপুল এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের ভাষার সর্বকালের কাব্যে প্রকৃতির উপর কবিদের নির্ভরতা লক্ষণীয়। তাঁরা যে শুধুমাত্র প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন তাই নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে জীবনকে সম্পর্কিত করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে, প্রকৃতির কোন উপাদান থেকে মানুষ বিচ্ছিনড়ব নয়।
প্রাচীন চর্যাপদের মানুষের বসবাস ছিল প্রকৃতি নির্ভর এবং তৎকালীন কবিদের রূপকের বিন্যাসের সম্বলও ছিল প্রকৃতি, যদিও রূপকের মাধ্যমে তত্ত্ব প্রচারই চর্যাপদের মূল লক্ষ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে নারীর প্রণয় লিপ্সার বিভিনড়ব প্রকাশকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের সময় যা সত্য ছিল রবীন্দ্রনাথের কালেও তা সত্য রয়েছে বরং বলা যায়, অধিকতর সত্য হয়েছে। আমাদের কবিতায় প্রকৃতিকে অধিকতর ব্যবহারের কারণ সম্ভবতঃ এই যে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন ভূমির সাথে সম্পর্কিত এবং গ্রামের সঙ্গে নিবিড়তম ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রকৃতির বিচিত্র ব্যবহার প্রত্যক্ষ করি। গ্রামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিবিড়তর হবার ফলেই তিনি প্রকৃতির উদার দাক্ষিণ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। পৈত্রিক জমিদারীর দায়িত্বভার পেয়ে তিনি বর্তমান কুষ্টিয়ার শিলাইদহের সদর কাচারীতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এ স্থানটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। তিনি পদ্মা নামক নৌকায় আরোহণ করে জমিদারী তদারকির উদ্দেশ্যে এখান থেকে কুষ্টিয়া, কুমারখালী, শাহজাদপুর ও অন্যান্য স্থানে গমন করতেন। এভাবে নদীপথে বারবার ভ্রমণের ফলে পল্লী বাংলার বিচিত্র প্রকৃতির সাথে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন। প্রকৃতির বিচিত্র শোভা তাঁর দৃষ্টিকে আপ্লুত করেছিল, হৃদয়কে উদ্বেল করেছিল। ফলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতিকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে অবলম্বন করে জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধকে প্রকাশ করতে সচেষ্ট ছিলেন। বলাকা কাব্যগ্রন্থের চঞ্চলা কবিতাটি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই কবিতায় গতির একটি উপলব্ধি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি নদীর চিত্রকল্পের মাধ্যমে সে উপলব্ধিকে ব্যক্ত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ স্বীয় অনুধ্যান, উপলব্ধি ও নিভৃত চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। কখনও দৃশ্যপটে এনেছেন প্রকৃতির স্থায়ী সম্পদ নদী, পাহাড়, প্রান্তর, সমুদ্র আর কখনও এনেছেন ভূমি থেকে উদ্গত বৃক্ষ ও তৃণলতা। এছাড়াও পরিবেশ পরিস্থিতি উপস্থাপনে তিনি ঝড়, বাতাস, রৌদ্রের মতো প্রাকৃতিক μিয়াকাণ্ডকে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে অন্য কেউ এত সূক্ষ্মভাবে প্রকৃতির ব্যবহার করেনি এবং এত বিচিত্রভাবে মানুষের অনুভূতি কবিতায় ব্যক্ত হয়নি।
রবীন্দ্রকাব্যে সকল বোধ প্রকাশের অবলম্বন ছিল প্রকৃতি। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে প্রকৃতির সত্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত করে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ‘চিত্রা’ নামক উন্মোচনী কবিতায় কবি বলেছেন, ‘অজস্র আলোকছটা নীল আকাশকে উজ্জ্বল করেছে’। সুখ কবিতাটিতে তিনি চিত্তের প্রসনড়বতাকে প্রকৃতির প্রসনড়বতার উপর নির্ভরশীল করেছেন। সিড়বগ্ধ বায়ু প্রবাহ, ধীর কল্লোলে নদী প্রবাহ, ঘনছায়াপূর্ণ বৃক্ষগুল্ম, আম্রমুকুলের গন্ধ ও বিহঙ্গের কলগুঞ্জনের অবতারণা করে তিনি প্রসনড়বতার পটভূমি নির্মাণ করেন। প্রেমের অভিষেক কবিতায় কবি প্রেমের যে অমরাবতীর বর্ণনা দিয়েছেন, সে অমরাবতী নির্মিত হয়েছে প্রকৃতির সাহায্যে।
প্রকৃতি ব্যবহারে রাবিন্দ্রীক স্টাইল
প্রকৃতির উপর মানব স্বভাবের গুণাবলী আরোপ করা যায় আবার প্রকৃতির গুণাবলী মানুষের উপর আরোপ করা যায়। উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কবি যখন বলেন বিষণড়ব নদীতীর, তখন মানব চিত্তের বিষণড়বতা নদীতীরের উপর আরোপ করেন। রবীন্দ্রনাথ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব স্বভাবকে প্রকৃতির উপর আরোপ করেছেন।
প্রকৃতিকে আবার ভিনড়বভাবেও উপস্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানুষের উপর আরোপ করে মানুষকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। শেক্সপীয়র শীতের পাতাঝরা গাছের সঙ্গে একজন বয়স্ক ব্যক্তির তুলনা করে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানব জীবনের উপর আরোপ করেছেন।
শেলী যে অর্থে একটি আদর্শ পরিমণ্ডল নির্মাণ করার জন্য প্রকৃতিকে বিশেষ রূপে আবিষ্কার করার কথা ভেবেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি তার মানস সুন্দরীকে, জীবনদেবতাকে অথবা অলৌকিক সৌন্দর্যকে আবিষ্কারের জন্য আরোপিত বিশেষ বিশেষ স্বভাবে অলংকৃত করে প্রকৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল একটি অলৌকিক সৌন্দর্যের সত্তাকে প্রকাশ করা, প্রকৃতি সেই প্রকাশের ক্ষেত্রে কবির সহায়ক হয়েছে। এ জন্য রবীন্দ্র কাব্যে প্রকৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়নি, প্রাকৃতিক চিত্রগুলি বিশেষ প্র াবদ্ধ সাধারণ চিত্রে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ জাগতিক বস্তু কবি চেতনার প্রতীক হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, জাগতিক বস্তুর দিকে কবির প্রধান লক্ষ্য কখনও ছিল না।
মানস সুন্দরী কবিতার মর্মবস্তু হচ্ছে, মানস সুন্দরী রূপিনী কবির যে প্রেরণা অথবা যে সৌন্দর্য কবিচিত্তে একটি উপলব্ধি নির্মাণ করেছে সে অন্তর্চেতনাকে উপস্থিত করা। এই অন্তর্চেতনাকে কবি উপস্থিত করেছেন প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এ বর্ণনায় কবি ২টি চিত্র উপস্থিত করেছেন। প্রমতঃ শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেহকে প্রসারিত করে সায়াহ্ন আলোকে যে পদ্মা জেগে আছে, সে পদ্মার উপমা। দ্বিতীয়তঃ সন্তর্পণে নদীতীরে সন্ধ্যার পদার্পণের সিড়বগ্ধ রূপকল্প। এ কবিতায় কবি প্রকৃতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে নির্জনতাকে এবং প্রশান্তিকে সর্বত্র প্রবাহিত করে পৃথিবীর বুকে যে রাত্রি নেমে এসেছে তার বিবরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে কবি মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থার বিকল্প হিসেবে প্রকৃতির চিত্তকে উন্মোচন এবং তার মাধ্যমে মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।
চৈতালী কাব্যের ভূমিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন তার সারকথা হচ্ছে, চতুর্দিকে তিনি যে দৃশ্য দেখেছেন সে দৃশ্যের কোন কোনটি তার নিকট অভাবিত মনে হয়েছে এবং সে অভাবিত অংশের খণ্ড খণ্ড অংশ তিনি চৈতালী কাব্যে উপস্থাপন করেছেন। চৈতালীতে তিনি শুধুমাত্র নির্জনতা ও শ্রান্ত শ্রীর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেননি।
মধ্যাহ্ন কবিতাটিতে কবি দুপুরের একটি সুষুপ্ত অবস্থার পরিচয় অংকন করেছেন। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে মধ্যাহ্নের আবহ নির্মাণই কবির মূল লক্ষ্য ছিল। এ অবস্থাটি কবির অন্তর্লোকের। প্রভাত কবিতাটিতেও আমরা একই আবহের নির্মাণ কৌশল লক্ষ্য করি। সেখানে পরিচ্ছনড়ব ঊষার সিড়বগ্ধতা এবং শীতলতাকে কবি প্রভাতকালের আবহ নির্মাণে ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্র বিশ্বাস : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজগতের সুষম সংগতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজগত একটি মৌলিক সংগতিতে সংরক্ষিত। বিভিনড়ব কবিতায় তিনি এই সংগতির সাথে একাত্ম হতে চেয়েছেন।
মহুয়া কাব্যগ্রন্থের বোধন কবিতায় আমরা দেখতে পাই যে, কবি নির্দয় নবযৌবনের ভাঙ্গনের কথা বললেও তাঁর নিকট সে ভাঙ্গনটা হচ্ছে একটি আনন্দের নতুন পট উন্মোচনের মতো। দায়মোচন কবিতায় কবি লিখেছেন,
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি।
যা পেয়েছি তাই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাইনি সেই বড়ো নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন,
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।
এ কবিতায় কবি সকল অবস্থার শৃঙ্খলিত সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসের কথা ঘোষণা দিয়ে একটি শান্তি ও নিশ্চিন্ততাকে কামনা করেছেন।
‘পরিচয়’ কবিতায় কবি দুর্যোগের মধ্যেও নৈরাশ্যজয়ী একটি পটভূমির কল্পনা করেছেন। কবি লিখেছেন,
সে দুর্যোগে এসেছিনু তোমার বৈকালী,
কদম্বের ডালি।
বাদলের বিষণড়ব ছায়াতে,
গীতহারা প্রাতে।
নৈরাশ্যজয়ী সে ফুল রেখেছিল কাজল প্রহরে,
রোদ্রের স্বপন ছবি রোমাঞ্চিত কেশরে কেশরে।
আছি, যাত্রী, দুর্দিনে, দুয়ার প্রভৃতি কবিতায় কবির মূল কথা হলো- “পৃথিবীতে আঘাতের অন্ত নেই কিন্তু বিপুল শান্তি তবুও অক্ষুণড়ব থাকে।”
‘রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি’ বিষয়ক আলোচনার সমাপ্তিপর্বে কবির ‘রূপ-বিরূপ’ কবিতার আলোচ্য বিষয় স্মরণযোগ্য। এ কবিতায় কবি এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি সমগ্র জীবনব্যাপী প্রকৃতির বিচিত্র ভাষা পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। সে ভাষার স্বরূপে ভিনড়বতা ছিল। কোথাও তা ছিল রহস্যঘেরা অরণ্যের ছায়াময় ভাষা, কোথাও তা কুসুম প্রগলভ রূপকের ভাষা, কোথাও তা ছিল প্রাচীন পর্বতের ধ্যানমৌনতার ভাষা। কবির বক্তব্যে যে প্রগলভতা, রহস্য এবং ধ্যানমৌনতার কথা বলা হয়েছে তা মূলত কবিচিত্তের রহস্য প্রবণতা, প্রগলভতা ও ধ্যানমৌনতার অনুভূতি।
এক কথায় বলা যায়, রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি উপাদান মাত্র- প্রকৃতি চর্চাটা এখানে মুখ্য নয়।
আদর্শ হিসেবে রবিন্দ্রনাথঃ
এ পর্যায়ে আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ কখনো পশ্চিম বাঙলার বাঙালীদের এবং পূর্ব বাংলার বাংলাদেশীদের আদর্শ হতে পারেন না। তাঁর জীবনালেখ্যে আমরা যা পাই তা হলো :
১. তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা মিটাতেই তিনি আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
২. তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা কোন বাঙালী বীরকে আদর্শস্থানীয় হিসেবে নিজ সাহিত্যে স্থান দেননি। ফলে জাতীয়তাবোধ বাংলার সীমানায় কেন্দ্রীভূত থাকেনি।
৩. তিনি বাঙালী জাতিসত্তাকে আর্যভারতীয় জাতিসত্তার পদপ্রান্তে বিসর্জন দিয়েছেন।
৪. তিনি সাধারণ বাঙালীদের কল্যাণার্থে কখনও কিছু করেননি, লেখেননি।
৫. তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ব্রিটিশ প্রভুদের গোলাম সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিল, বাংলার উত্থানের কাজে নিয়োজিত হয়নি।
৬. তিনি বাংলার এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কখনও একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি বা একটি লাইনও লিখেননি। তদুপরি ভবিষ্যত স্বাধীন ভারতের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন হিন্দী ভাষা, বাংলা নয়।
রবীন্দ্রনাথ কখনো বাংলাদেশের জনগণের অনুকরণীয় হতে পারেন না। তার কারণসমূহ নিমড়বরূপ :
১. ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরাই বাঙালী ছিল মুসলমানরা নয়। দু’টি উদাহরণ দেখুন:
ক. “তিনশত বৎসরের মধ্যে বাঙালী ধর্ম রক্ষার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই।” (বাঙ্গালার ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার)।
খ. “ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।” (শ্রীকান্ত : ১ম পর্ব, ১ম অধ্যায়, ২য় পৃষ্ঠা)।
২. রবীন্দ্রনাথ বাঙালী হিন্দুদের কবি ছিলেন, মুসলমানদের নয়। যথা- “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীয় আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছে, তাতে শারদীয় পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ কতবার এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহররমের চাঁদ উঠেনি। সে চাঁদ উঠাবার ভার ছিল নজরুল ইসলামের উপর। এতে দুঃখ করার কিছুই নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কাজেই কঠোর সত্য।” (বাংলাদেশের কালচার, আবুল মনসুর আহমদ, পৃ. ১০৩)।
৩. রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট, তাঁর সাহিত্যও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের সাহিত্য। সুতরাং তার অনুসরণে এদেশের স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে।
৪. রবীন্দ্র সাহিত্য হিন্দু সংস্কৃতি নির্ভর এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থিত। সুতরাং এরূপ সাহিত্যে বাংলাদেশের কোন কল্যাণ নেই। যথা- “দেশের প্রাণ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে মনগড়া অথবা পরদেশী সংস্কৃতি বা সাহিত্যের প্রবর্তনে পৃথিবীর কোন জাতির কখনোই মঙ্গল হয়নি। মূল বৃক্ষের ন্যায় সংস্কারকেও একেবারে মাটির অন্ধকার ফঁেু ড় উঠতে হবে।” (শ্রী সজনী কান্ত দাস, দীপালী উৎসব, পৃ. ১৩৯)।
৫. শুধু রবীন্দ্র সাহিত্য নয়। সাম্রাজ্যবাদেরএজেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী কোন কবি-লেখকের সাহিত্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদ লিখিত বাংলাদেশের ‘কালচার’ নামক অতি মূল্যবান বই থেকে উদ্ধৃতি পেশ করছি।
“পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উনড়বত সাহিত্য। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন।
তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়, কারণ এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয়।
এ সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন দান নেই, শুধু তা নয় মুসলমানের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোন প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে, সে কারণ এই যে, এই সাহিত্যের স্রষ্টা মুসলমান নয়, এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমান নয় এবং এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথা ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু-মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই করেছেন তাঁরা।
নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না।...
ত্যাগের আদর্শ, বৈরাগ্যের আদর্শ, ভক্তিবাদের আদর্শ, প্রেমের আদর্শ সমস্তই উঁচু দরের আদর্শ। এইসব আদর্শকে বুনিয়াদ করে নারী প্রেমকে কেন্দ্র করে হিন্দু শিল্প-মনীষা যে সাহিত্য রচনা করেছে সে সবই হয়েছে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য এবং তা পড়ে অপর সকলের মতই মুসলমান রস পিপাসুরাও পিপাসা নিবারণ করে থাকে।
কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানরা তাদের জাতীয় সাহিত্য মনে করতে পারে না। কারণ ত্যাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-প্রেম যতই উঁচু দরের আদর্শ হউক, মুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ-বৈরাগ্য ও মুণি ঋষির ধর্ম মুসলমানের ধর্ম তেমনি হক-ইনসাফ ও জেহাদ-শহীদের ধর্ম। প্রতীকবাদী সুন্দর পূজারী আর্টবাদী হিন্দু সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মুসলিম সংস্কৃতি তেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়।
হক-ইনসাফবাদী কল্যাণমুখী, মুসলিম সংস্কৃতি তাই সমাজকেন্দ্রিক।...
এ জন্যই বর্তমান বাংলা সাহিত্য মুসলিম সমাজ মনে কোন প্রেরণার স্পন্দন জাগাতে পারেনি। তাই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে প্রতিবেশী হিন্দু ভাইকে আনন্দে নৃত্য করতে দেখেও মুসলিম সমাজমে নর একটি তারও ঝনাৎ করে উঠেনি। বিশ্ব-কবির ‘মাথানত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’র অত বড় আবেদনে একটি মুসলমানের মাথা এক ইঞ্চি হেঁট হলো না।
তার বদলে যেদিন এক অচেনা-অজানা বালক হঠাৎ জিকির দিয়ে উঠলো : ‘বল বীর উনড়বত মম শির’ সেদিন রিক্ত, ক্লান্ত, ঘুমন্ত ও জীবনমৃত মুসলমান ধচমচ করে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হুংকার দিয়ে উঠলো- ‘উনড়বত মমশির’। কারণ এ যে তারই অন্তরের ঘুমন্ত শিশুর চিৎকার। এ যে তারই জীবনের কথা। তাই নজরুল ইসলামের আকস্মিক আবির্ভাব মুসলিম সমাজ মনকে এমন করে আলোড়িত করতে পেরেছে।
মুসলমানের বিবেচনায় মানব জীবনের সুখ-দুঃখ আলো-আঁধার, হাসি-কানড়বা, তাদের দেবত্ব-পশুত্ব, তাদের হীনতা-ক্ষুদ্রতা, তাদের সংগ্রাম-সাধনা এ সবই সাহিত্যের বুনিয়াদ এবং নজরুল ইসলাম এই জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। শুধু এই কারণেই নজরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রম জাতীয় কবি।
সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলো, তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিভাবে? আমার ঐতিহ্য, আমার ইতিহাস, আমার কিংবদন্তী, আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়, সে সাহিত্য আমার উৎস হবে কেমন করে। রাম-লক্ষ্মণ, ভীম-অর্জুন, সীতা-সাবিত্রী, রাধা-কৃষ্ণ, মথুরা-অযোধ্যা, উজ্জ্বয়িনী-ইন্দ্রপ্রস্থ, হিন্দুর মনে যে স্মৃতি কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে, যে ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায়, মুসলিম মনে কি তা করতে পারে?
তেমনি আবার আলীহামযা, সোহরাব-রুস্তম, শাহজাহান-আলমগীর, হাযেরা-রাবিয়া-চাঁদ সুলতানা, সিরাজ-কাসেম, ঈশা খাঁ-মুসা খাঁ, গৌড়-সোনারগাঁ, মুসলিম মনে যে স্মৃতি-কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে বা ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায় হিন্দুর মনে তা করতে পারে না। এটা শুধু মুসলিমের কথা নয়। তামাম দুনিয়ায় সকল জাতি সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। সব জাতির জাতীয় চেতনাই জাগে তার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। যতদিন সে ঐতিহ্যকে বুনিয়াদ করে সাহিত্য রচিত না হবে ততদিন সে সাহিত্য থেকে কোন জাতি প্রেরণা পাবে না।” বাংলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নকল করে বড় হতে পারবে না। তাকে বড় হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের উপর দাঁড়িয়ে, নিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সতীর্থদের লিখিত সাহিত্য অনুকরণ ও অনুসরণের অনিবার্য পরিণাম বাঙালীত্বের মৃত্যু, একইভাবে উক্ত সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুসরণ বাংলাদেশীত্বের মৃত্যু ঘটাবে। মূলত: বাংলাদেশী জাতিসত্তার মৃত্যু ঘটাতেই আর্যভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী চμ এদেশে রবীন্দ্র ভক্তের চাষাবাদে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
উপসংহার
ঐতিহাসিক নিরীক্ষকের প্রয়োজন হয় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সার্থক ব্যবহার, ভক্তের চোখ ও কান থাকাই যথেষ্ট আর অন্ধ ভক্তের শুধু কান থাকলেই চলে। অতিভক্তি যে সব সময় সুখকর হয় না তা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু যন্ত্রণার পর পরই।
“ভক্ত, অভক্ত না অতিভক্ত- নির্ধারণ করা মুশকিল। প্রচুর বাঙালী দর্শক এসে প্রতীক্ষা করছেন তাঁর মরদেহ দেখার। জয়ধ্বনি হচ্ছিল জোরে জোরে। ভক্তির প্রাবল্যে ঠাকুরবাড়ির কোলাপসিবল গেট ভেঙ্গে ফেলল জনতা। ভক্তরা কবির মরদেহ সাজানো খাট থেকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন জনস্রোতের মাঝখানে। কবি নিষেধ করে গিয়েছিলেন তবুও ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি জয়’ ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিত হতে লাগলো বারে বারে। বাঙালী রবি ভক্তদের এতই ভক্তির আধিক্য যে, কবির স্মৃতি বাড়িতে রাখার জন্য প্রায় সারা জীবন ধরে তাঁর সযতেড়ব সংরক্ষিত মাথাভর্তি শুভ্র কেশ, চিত্তাকর্ষক দাড়ি অনেকে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। শেষে দেখা গেল, শ্মশানে যাওয়ার পূর্বে কবির চেহারাই বদলে দিয়েছেন অতি ভক্তের দল।
যখন মুখাগিড়ব করা হয়, তখন রবীন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল বিকৃত। জনতার এতই রবি অনুরাগ যে, স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তাঁর মাথার চুল ও মুখের দাড়ি সব উপড়ে নিয়ে যাওয়া হযেছে। এই হলো গিয়ে কবির প্রয়াণের শেষ দৃশ্য। (অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ১৩৬-৩৭)।
ঠাকুরবাড়ি
৪৩টি বেশ্যালয়ের মালিক, মাদক ও দাস ব্যবসায়ী, লবণের এজেন্ট এবং নীলকর দ্বারকানাথ ওরফে প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাজ্যবিহীন রাজা রামমোহনের সাগরেদ দ্বারকানাথ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দোসর বা গোলাম। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এবং শাসন-শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রণীত বহুল পরিচিত ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির সূতিকাগার হিসেবে ঠাকুরবাড়িকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভের জন্য কয়েকটি উদ্ধৃতি প্রদত্ত হলো।
১. “অনেকের মতে, হিন্দু-মুসলিম বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ঐ ‘হিন্দুমেলা’ ও জাতীয় সভা থেকে। এ মেলার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নে ঠাকুরবাড়ির আর্থিক ও মানসিক সাহায্য আর সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেলার কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য। প্রম দিকে মেলার সম্পাদক ছিলেন গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পঞ্চম অধিবেশনের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ষষ্ঠ ও সপ্তম অধিবেশনের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। অষ্টম অধিবেশনে তিনি হন সহ-সভাপতি। অষ্টম অধিবেশনের সহ-সম্পাদক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত হননি বটে, কিন্তু মেলার কাজে তাঁরা সμিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা রচনার মাধ্যমে। তথ্য : যোগেশ চন্দ্র বাগল, হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত, পৃ. ৬ এবং ৪৮)।
২. রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ জীবনালেখ্য যদি খুব খুঁটিয়ে দেখা যায় তাহলে অন্ধভক্ত ও স্বপক্ষীয়দের বাদ দিলে আরো দু’টি পক্ষ থাকে, একটি বিপক্ষ এবং অপরটি নিরপেক্ষ। এই শেষ দু’টি পক্ষের অনেকের একথা বলা অস্বাভাবিক নয় যে, ব্রিটিশের হাতে ভারতকে তুলে দেওয়ার চμান্তে যে দলটি সμিয়ভাবে কাজ করেছে তার মধ্যে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির অনেক পুরুষ ও মহিলা। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে অনুগত ভারতীয়দের সঙ্গে ইংরেজদের পরামর্শ, পরিকল্পনা গ্রহণ, মদ-মাংস, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ব্যভিচার বা ইন্দ্রিয় রসের ছড়াছড়ি করিয়ে দেওয়ার মূল কারখানা যে ক’টি ছিল ঠাকুরবাড়ি তার শ্রেষ্ঠতম না হলেও শ্রেষ্ঠতর হওয়ার দাবিদার। এই সাংঘাতিক ধারণার সাথে আমরা সহজে একমত হতে পারব না, কিন্তু এই দাবিকে খুব সহজে উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধাও নেই আমাদের। কারণ এঁদের পক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দও আছেন। স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন, বাঙালী জাতির সর্বনাশ করেছে ঠাকুরবাড়ি। বাঙালী জাতির পৌরুষ সৃষ্টিতে সহায়ক না হয়ে ক্ষতিকারক হয়েছে ঐ ঠাকুরবাড়ি। এক কথায় ঠাকুর বাড়ির কালচার সম্পর্কে স্বামীজীর মনোভাব ছিল অত্যন্ত কঠোর। (দ্র: গোলাম আহমাদ মোর্তজা, এ এক অন্য ইতিহাস, পৃ. ১৯০)।
৩. “কিন্তু স্বামীজী ঠাকুরবাড়ির কালচার সম্পর্কে কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন, ঠাকুরবাড়ির প্রভাব বাঙালী জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। তাঁর মত ছিল, ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য, দর্শন বাঙালীর সমাজে পৌরুষ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে না।
তিনি রুঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, এই পরিবার ইন্দ্রিয় রসের বিষ বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাঁর তীব্র মন্তব্য, আমার জীবনোদ্দেশ্য রামকৃষ্ণ নয়, বেদান্ত নয়, আর কিছুই নয়- শুধু জনগণের মধ্যে পৌরুষ আনা।” (দ্র: পবিত্র কুমার ঘোষ, সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা, ১ ফেব্র“য়ারি, ১৯৯৭)।
“দূরদর্শী স্বামী বিবেকানন্দ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা বুঝেছিলেন বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা তার সত্যতা মেনে নিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত এখনো বয়োঃপ্রাপ্ত হয়নি।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের উপলব্ধি যেদিন সকল চিন্তাশীল বাঙালীর মনে ছড়িয়ে পড়বে সেদিন হলওয়েল মনুমেন্টের মতো, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-পরবর্তী কেশরাশির মতো, ঠাকুরবাড়ির সকল স্থাপনা জনতা সমূলে উপড়ে ফেলে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে। সেদিনই বাঙালী ও বাংলাদেশীদের মিলনের সদর দরজা উন্মুক্ত হবে। কেননা ঠাকুরবাড়ি ও তার সমগোত্রীয় অন্যান্য ঋষিবাড়িতে ব্রিটিশ রোপিত সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষসমূহের ফল ও রস অমৃতজ্ঞানে গ্রহণ করার ফলেই উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের সূচনা ও বিকাশ ঘটেছে।
সূত্র
এস. এম. নজরুল ইসলাম
প্রকাশক ও সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস অন্বেষা
১ম প্রকাশ, ইতিহাস-অন্বেষা, আগস্ট ২০০৫
[লেখকের ‘জাতির উত্থান-পতনের সূত্র’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া]
http://itihashonnesha.blogspot.co.uk/2012/01/blog-post_30.html?m=1
No comments:
Post a Comment