মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব - আহমদ ছফা
আহমেদ ছফা আমার প্রিয় একজন লেখক । যিনি সব সময় সত্য কথা বলতে ভয় পেতেন না এবং সকল অন্যায় এর প্রতিবাদ করতেন । এই সেই ছফা যিনি স্বাধীনবাংলাদেশে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর পরিবারকে গৃহহীন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং তাদের পাশে দারিয়েছিলেন । আজ উনার লিখা একটি বই সম্পূর্ণ তুলে ধরছি আপনাদের জন্য । মুজিবের শাসন: একজন লেখকের অনুভব - আহমদ ছফা চোদ্দই আগস্টের রাতে আমি নতুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সাতাশ নম্বর সড়কের একটি হোস্টেলে এক বন্ধুর সংগে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
সাতাশ নম্বর আর বত্রিশ নম্বর সড়কের ব্যবধান বড় জোড় তিন থেকে চার'শ গজ। এই বত্রিশ নম্বরেই দারাপুত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আনুমানিক রাত এগারোটা হবে হয়ত। বত্রিশ নম্বর পেরোবার সময় খাকি পোষাক পরা আট দশজন পুলিশ দেখলাম। কয়েকজন অফিসার, বাকিরা সেপাই। বন্দুক উঁচিয়ে রাস্ট্রপতির বাসভবনের সামনের সড়কের মুখে পাহারারত। এই পথে বেশ ক'দিন থেকে যাওয়া আশা করছি। প্রায়ই দেখতাম ঘুণটি ঘরে দু'জন থেকে তিনজন সেপাই দাঁড়িয়ে। কোন অফিসার দেখেছি মনে পড়ে না। আজ পাহারাদারদের দল ভারি দেখেও মনে কোন ভাবান্তর আসেনি। আগামিকাল পনেরোই আগস্ট বেলা দশটার দিকে রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এককালের বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আগমন করছেন। হয়ত সেজন্য এই অধিকসংখ্যক সেপাই-সান্ত্রীর আনাগোনা।
এখন পর্যন্ত সবকিছু পুর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঘটে আসছে। কোথাও কোনো ঝঞ্জাট ঘটেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনোপলোক্ষে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেছে সাজানো গোছানোর পালা। রাস্তার এবড়ো-থেবড়ো গর্তগুলোতে সুরকি পড়েছে। রোলার ঘুরছে, পীচের আস্তরণ বসেছে। গত এক পক্সকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, কলভবনে, বাণিজ্যভবনে, বিজ্জানভবনে জোর মেরামতির কাজ চলছে। অনেকদিন অনাদরে মৃত জন্তুর কন্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়ামুড়ো দেয়ালগুলো চুণ, সুরকির প্রসাধন স্পর্শে হেসে উঠেছে। সমস্ত এলাকাটায় একটা সাজ সাজ রব, তাড়াহুড়ো ব্যস্ততা এসব তো আছেই। রাতের আঁধারে শক্তহাতে আলকাতরা দিয়ে দাবড়া করে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে চ্যালেন্জ করা দেয়াল লিখনসমূহ নবীন চুনের প্রলেপের তলায় ঢাকা পড়েছে। সুন্দরীর ললাটের সিন্দুর বিন্দুর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সুউচ্চ শুভ্র প্রাচীরের কপোলদেশে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে লেখা সুন্দর সুন্দর লিখনমালা দৃস্টিকে দূর থেকে টেনে নিয়ে যা্য়।
শেখ মুজিব বন্গবন্ধু, বাঙালি জাতির ত্রানকর্তা, সমাজতান্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মহানায়ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লৌহমানব ইত্যাদি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নানান রঙের চিত্রলেখায় সেজে সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারদিকে একটা উৎসবের হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা কালো কালো সাপের শরীরের মত চেকন বাঁকা রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে উল্লসিত অভিনন্দন বুকে ধারন করে রাতারাতি ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। তোরণরাজি মাথা তুলেছে। সর্বত্র একটা উৎকন্ঠার ভাব। আগামীকাল কাঁটায় কাঁটায় বেলা দশটায় তিনি আসছেন। প্রায় এক পক্ষকাল ধরে দিনে রাতে কাজ চলছে। উপাচার্যের আহার নেই, নিদ্রা নেই। সাড়ে সাত লক্ষ টাকা নগদে বলিয়ে দিয়েও মনে মনে তিনি সস্তিবোধ করতে পারছেন না। দৈবাৎ যদি কোন ত্রুটি থেকে যায়, আর সেখানেই যদি মহামানবের দৃস্টি আটকে যায়, তিনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্রপতির এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আগমন। তিনি শুধু রাস্ট্রপতি নন, বাঙালি জাতির পিতা, মুক্তিদাতা, বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষের বন্ধু বন্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সরকার সমর্থক ছাত্রদলটির হোমরা-চোমরা কর্মীদেরও বেশ ব্যস্তদিন কাটছে। তারা দিবসে কাজের তদারক করে, রজনীতে পাহারায় থাকে। বাংলাদেশে দুস্ট লোকের অভাব নেই। রাস্ট্রপতির আগমনের সন্গে সম্পুর্ণ সংগতিহীন অলুক্ষণে কোন দেয়াল লিখন লিখে যেতে পারে, অনেক অর্থব্যয়ের শ্রমের শিল্পকর্মগুলোর অংগহানি ঘটাতে পারে, সুন্দর চিত্রলেখাসমুহের লাবণ্যহানি করতে পারে, এরকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আগেভাগেই এই শতর্কতামুলক ব্যবস্থা। পুরো দায়িত্বটা রাস্ট্রপতির জ্যেস্ঠপুত্র শেখ কামাল গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ দেহ এবং বাহু বিশিস্ট বন্ধুদের নিয়ে অবিরাম চরকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গোঁড়া সমর্থক ছাত্র এবং শিক্ষকদের মনোভংগিটা এরকম যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে চরণ ফেলামত্রই বাংলাদেশে একটি অভিনব যুগের অভ্যুদয় ঘটবে। শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে আগমটা ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে তাঁর নতুন শাসনতান্ত্রিক বিধি চালু করার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
উনিশ শ' পচাঁত্তর সাল শুরুর দিকে তিনি বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের বেশকিছুকে জেলে ভরেছেন। তাঁর একনায়কত্বের প্রতিস্পর্ধী তরুণ বয়স্ক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের খুশীমাফিক হত্যা করেছেন এবং সে কথা বলে প্রকাশ্যে গর্ববোধ করতেও তাঁকে দেখা গেছে। প্রধানমন্রির স্থলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাস্ট্রপতি হয়ে বসেছেন। তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগ অন্য দুটো সমর্থক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়মী পার্টির কেউ কোনো ওজর আপত্তি উত্থাপন করেননি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার সংগে জড়িত এই তিনটি দলের প্রত্যেকটিরই টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানোর ছিল একেবারে অপরিহার্য। মুজিব থাকলে তাঁরা সবাই আছেন, তিনি নেই তো কেউ নেই। তাই তাঁদের কারো পক্ষে এই জননন্দিত অধিনায়কের কোনো সিদ্ধান্তকে দলীয় কিংবা আন্ত:দলীয় শৃংখলা প্রয়োগ করে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই তিনি তাঁর প্রতি সমর্থনবিমুখ পত্র-পত্রিকাসমুহের মুখ প্রায় বন্ধ করে নিয়ে আসছিলেন।
বিরোধী পত্রিকাগুলোতে সরকারি বিজ্গ্জাপন বন্ধ করে দিয়ে, সাংবাদিকদের গ্রফতার করে, সম্পাদকদের জেলে পুরে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে ইত্যাদি নানা ছলছুতোর সাহায্যে অনেকগুলো দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশ সাফল্যজনকভাবে বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। এই চরম মার হজম করেও যে গুটিকয়েক পত্রিকা প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে বেঁচেছিল, সগুলোর বিরুদ্ধে কোন রকমের অভিযোগহীনতাকেই অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বন্ধ করে দিলেন। তারপরে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিরোধী কোন দলের মালিকানাধীন কোন পত্রিকা ছিলনা। ব্যক্তি মালিকানাধীন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল একেবারে অল্প। শেখ সাহেবের নিজের দল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সমর্থক দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলকে তিনি অংগুলি হেলনে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে ইচ্ছে পরিচালনা করতেন। এই দলগুলোর ঘোষিত রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হোক না কেন, কার্যত তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের সব রকম নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। অংগদলসমুহের পরামর্শে নাকি নিজের বিবেচনা অনুসারে তা বলা খুব মুশকিল। তিনি সরকারি দলটি এবং সরকারের অন্ধ সমর্থক দল দুটোকে ভেংগে একটি মাত্র জাতীয় দল গঠন করার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন। আর নতুন জাতীয় দলের নামকরন করলেন, "বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ" সংক্ষেপে বাকশাল।
বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষনার পরে তখন পর্যন্ত যে কয়টি ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বাংলাদেশ সরকারের সংগে আপোস রফা করে বেঁচেছিল, সগুলোকে পুরোপুরি সরকারি আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি সুদীর্ঘ বাহু প্রসারিত করলেন। বাংলাদেশে ব্যাক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল একেবারে স্বল্প। অনেকগুলোই সরকারি কোপানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইয়ুব আমলে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। বাংলা পত্রিকাটির নাম ছিল "দৈনিক পাকিস্তান"। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর "দৈনিক বাংলা" নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম ছিল "মর্নিং নিউজ"। এ দুটি পত্রিকা ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারের প্রত্যক্ষ এখতিয়ারে আরো তিনটি পত্রিকা চলে আসে।
তার দুটি দৈনিকের মধ্যে একটি বাংলা এবং একটি সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা। ইংরেজি দৈনিকটির পাকিস্তান নাম ছিল, "পাকিস্তান অবজারভার"। স্বাধীনতার পর "বাংলাদেশ অবজারভার" নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা কাগজটি আগে থেকেই "দৈনিক পূর্বদেশ" নামেই পরিচিত ছিল এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির নাম ছিল "চিত্রালী"। এই পত্রিকা তিনটির মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী যিনি ন'মাসের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যকলাপ সমর্থন করেছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্থনের পূ্র্বে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহন করেছিলেন। তাই পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে পত্রিকা তিনটির প্রকাশনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে বাংলাদেশ যুব আওয়ামী লীগ প্রসিডিয়ামের সভাপতি কেন্দ্রীয় বাকশালের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং রাস্ট্রপতির বুদ্ধিবিবেচনার একমাত্র ভরসা বলে কথিত জনাব শেখ ফজলুল হক মনি স্বাধীনতার পরে একেবারে শূন্যাবস্থা থেকেই তিন তিনটি পত্রিকার জন্মদান করেছিলেন। একটি ছিল বাংলাদেশের বিচারে ইর্ষাযোগ্য মানের অধিকারী ইংরেজি দৈনিক, নাম "বাংলাদেশ টাইমস", বাংলা দৈনিকটির নাম "বাংলার বাণী" এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির "সিনেমা" নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটরের কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনকালে জনাব শেখ ফজলুল হক মনির মত অনেকেই এরকম সামান্য অবস্থা থেকে অকল্পনীয় অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন।
অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাংখা ছিলা না বলে টাকা-পয়সাকে এমন সুন্দর লাভজনকভাবে বিনিয়োগ করতে পারেননি। ওপরে বর্ণিত তিনটি বাংলা এবং তিনটি দৈনিকের প্রত্যেকটিই সরকার সমর্থন করে যেত। এই সমর্থন অনেক সময় এতো দাসোচিত এবং অমার্জিত রুপ গ্রহণ করত যে, রুচিবান মানুষদের পিড়িত না করে ছাড়ত না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকেরা সরকারের সুনজরে পড়ার জন্য তোষামোদ এবং তোয়াজে কে কার চাইতে অধিকদুর যেতে পারেন সেজন্য রীতিমত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যদিও সেসব লেখা পাঠ করে বিবমিষা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না। রাজধানী ঢাকা থেকে তখন প্রকাশিত উল্লিখিত ছয়টি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আরো কয়েকটি পত্রিকা তখোনো ছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় যেটি সবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে পত্রিকার নাম "দৈনিক ইত্তেফাক"।
এই পত্রিকাটির সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা ভাসানী এই কাগজটির প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া ছিলেন পত্রিকাটির মালিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রাতিম্বিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তফাজ্জল হোসেন সাহেব নিজেও ছিলেন একজন আওয়ামী লীগার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর পরামর্শ-বুদ্ধি-বিবেচনা আওয়ামী লীগ মহলে অপরিসীম মর্যাদা এবং গুরুত্বসহকারে গৃহীত হত।
জন্মের শুরু থেকেই এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান করে আসছিল। উনিশ শ' পয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভুমিকা পালন করেছিলেন, "ইত্তেফাক" পত্রিকা এবং সম্পাদক তফাজ্জল হোসেনের অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিভা তাঁর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন প্রকাশ করার অভিযোগে আই্য়ুব খান সরকারের গভর্নর মোনেম খান পত্রিকাটির প্রকাশ বন্দ্ধ করেছিলেন এবং ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের আইয়ুব বিরোধী অভ্যুত্থানের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে সাময়িক সরকারকে বাধ্য হয়ে এই পত্রিকাটির ওপর থেকে নিষিধাগ্জা প্রত্যহার করে নিতে হয়। "ইত্তেফাক" যেসব সময়ে আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন করে আসছিল ইত্তেফাকের ভুমিকাটি অতটা মর্যাদাবিবর্জিত ছিলনা। এই কাগজে মাঝে মাঝে গণতান্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি তুলে ধরার চেষ্টা করত।
ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির সপক্ষে কখনো-সখনো, দু'চার কথা নরমে-গরমে সাহস করে লিখে বসত। "ইত্তেফাক" ছাড়া অপর প্রাচীন দৈনিক পত্রিকাটির নাম "আজাদ"। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম লীগের পুরোধা, কৃতবিদ্য পন্ডিত এবং এক সময়ের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের নাম করা সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এই প্রাচীনতম পত্রিকাটির প্রতিস্ঠাতা সরকার ঘেঁষা। বাংলাভাষা আন্দোলন ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ-সংস্লিষ্ট ব্যাপারে যখনই বিরোধ উপস্হিত হত সব সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন করত। মওলানা আকরম খাঁ যতদিন বেঁচে ছিলেন এই সুচিহ্নিত ভুমিকা "আজাদ" পত্রিকা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। মাওলানা সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদের প্রাক্তন ভুমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকা হিসেবে পূর্বের জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসেছিল।
পরিচালনার ত্রুটিই সম্ভবত এর মুখ্য কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোন রকমের ধারদেনা করে আজাদ পত্রিকার দিন চলছিল। সরকারের বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। মাঝখানে একবার সরকার পত্রিকাটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন। মোজাফফর আহমদের বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পত্রিকাটির নাম "সংবাদ"। এই কাগজে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমর্থন জ্জাপন করত। এই দুটি দলই যৌথভাবে ভারত থেকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কিম্বা বলা যায় তারও আগে থেকে অধিকাংশ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে ছায়ার মত অনুসরন করে আসছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই পার্থক্য কমতে কমতে একেবারে শুন্যের কোটায় এসে ঠেকেছিল। অধিকন্তু তিনদল মিলেমিশে একদল সৃষ্টির পরে একদলীয় সরকার পদ্ধতির মুখ্য নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের যাবতীয় কার্যকালাপের প্রতি সমর্থন যোগানো পত্রিকাটির একটি নৈতিক কর্তব্যও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাটিতেও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হত। স্বাধীনতার পর "জনপদ" নামে আরেকটি বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য জনাব কামরুজ্জামান ছিলেন পত্রিকাটির নেপথ্য মালিক। এটিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা। "দি পিপল" নামে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছুকাল পূর্বে জন্মলাভ করেছিল।
জনৈক উঠতি বাঙালী ধনী ছিলেন পত্রিকাটির স্বত্তাধিকারী। উনিশ শ' একাত্তর সালের মার্চর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে কাগজটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতে গাণ্দ্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকুল্যে কাগজটির পুন:প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পুনরায় কাগজটির প্রকাশ ঘটার পর থেকে সব সরকারকেই সমর্থন দান করেছিল। উনিশ শ' একাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি একবার মাত্র সরকারি গুলিবর্ষন করার প্রতিবাদ করে গরম খবর পরিবেশন করেছিল বলে প্রচন্ড হুমকির মুখে ভাল ছেলের মত সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়। উনিশ শ' পচাত্তর সালের শুরুর দিকে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে পুরোপুরি বন্দ্ধ ঘোষনার পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সমর্থক পত্রিকা গণকন্ঠের প্রকাশ রুদ্ধ, সম্পাদক দেশের খ্যাতনামা কবি জনাব আল মাহমুদ কারারুদ্ধ এবং ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পূর্বেও "গণকন্ঠ" পত্রিকাটি বন্দ্ধ করার জন্য সরকার নানাধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্জাপন দেয়া হত না, দুয়েকবার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। আইনের ফ্যাঁকড়া তুলে মুদ্রণ এবং প্রকাশের পথে কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। মাঝখানে একবার বন্দ্ধও করে দেয়া হয়েছিল।
সাংবাদিকদের সমবেত দাবির মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ ঘোষনার সাথে সাথে প্রকাশ রহিত হয়ে গেল। গণকন্ঠের পিছু পিছু সরকার বিরোধী দলীয় ইংরেজি "সাপ্তাহিক ওয়েভ" এবং "হলিডে" কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকে পরেছিল। পরে দুটোকেই বন্ধ করে দেয়া হয় এবং আপত্তিজনক সংবাদ পরিবেশনের দায়ে "হলিডে" সম্পাদক জনাব এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। জনাব আলী আশরাফ সম্পাদিত বাংলা "সাপ্তাহিক অভিমত" - এরও একই পরিণতি ঘটে। বিরোধীদল তো ছিলই না। বিরোধীদলীয় পত্রপত্রিকাগুলোকেও নির্মমভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সরকার সমর্থক পত্রিকাসমুহ এবং সরকারের অন্য দুটো অংগদলের মুখপত্রগুলো প্রতিটি স্বৈরাচারী পদক্ষেপকে একেবারে নির্লজ্জভাবে অভিনন্দিত করে যাচ্ছিল। তথাপি শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন কায়েম করার প্রাক্কালে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা একেবারে কমিয়ে এনে গণমতের বাহনগুলোর কর্তৃত্ব নির্ভরযোগ্য হস্তে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হবে ঠিক হল। দুটি বাংলা এবন দুটি ইংরেজি এবং এটাও ঠিক হল যে বাদ বাকি পত্রিকাসমুহ বন্ধ করে দেয়া হবে। "ইত্তেফাক" কাগজটিকে পুরোপুরিভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হল।
"ইত্তেফাক" ছাড়া অপর যে বাংলা কাগজটি বেঁচে থাকবে সেটির নাম "দৈনিক বাংলা"। ইংরেজি কাগজ দুটির নাম "বাংলাদেশ অবজারভার" এবং "বাংলাদেশ টাইমস"। এসব পত্রিকাগুলো একেবারে সরকারি পত্রিকা এবং সাংবাদিকেরা সরকারি কর্মচারীরুপে চিহ্নিত হবেন বলে ঘোষনা দেয়া হল। একসংগে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে গোটা দেশের সাংবাদিকবৃন্দ এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হন। এই নির্মম অর্তসংকটের দিনে সাংবাদিকেরা সবান্ধবে বেকার হয়ে পড়ার ফলে তাঁদের সামনে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোন পন্থা উম্মুক্ত রইল না। যে চারটি পত্রিকা প্রকাশিত হবার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেছে, সেগুলোতে কোনো রকমে স্থান করে নেয়ার জন্য প্রতিটি সাংবাদিকই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভিন্ন কোন আচরন আশাও করা বোধহয় সম্ভব ছিলনা। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাঁদের কর্মসংস্থান করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দান করেছিলেন এবং সরকার থেকে তাঁরা অল্প-স্বল্প মাইনেও পাচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সাংবাদিকদের মাথায় যে চিন্তাটা প্রথমে এসেছিল তাতে বাহ্যত দাসোচিত আত্মসমর্পন এবং সুবিধাবাদি চরিত্রের পরিচয় স্পষ্টতভাবে ফুটে উঠলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিচারে তাই-ই ছিল একান্ত বাস্তব এবং যুক্তিসংগত। প্রতিটি আলাদা আলাদা পত্রিকার সাংবাদিকেরা ভাবলেন তারা আগেভাগে যদি সরকারি দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই দিয়ে বসেন, সরকার অনুকম্পা করে তাঁদের কথাটি বিবেচনা করে দেখবেন। এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে যাবার বেশ কয়েকদিন পূর্বে "দৈনিক পূর্বদেশ" পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ সদলবলে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতরে গমন করে সই করা আবেদনপত্রসমুহ জমা দিয়ে এসে মনে করলেন, যা্ক্ নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এই ঘটনার পর থেকে অন্যান্য চালু এবং বাতিল পত্রিকার কর্রমরত সাংবাদিকদেরও বোধদয় ঘটল।
তাঁরা ভাবলেন, পূর্বদেশের সাংবাদিকদের মত তাঁরাও যেয়ে যদি বাকশালের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই না করেন, তাহলে তাদের চাকুরি হবে না এবং চালু পত্রিকায় কর্মরত থাকলে চাকুরিটি টিকবে না। সরকারি পত্রিকায় সরকারিদলের লোকদের কাজ পাবার নৈতিক দাবীই সবচেয়ে বেশী। তারপর থেকে সাংবাদিকেরা দিগ্বিদিক জ্ঙান হারিয়ে দল বেঁধে নিয়মিত বাকশাল অফিসে ধাওয়া করতে থাকলেন। প্রতিটি পত্রিকার সরকারসমর্থক সাংবাদিকেরা উদ্যোগী হয়ে সহযোগী এবং কলাকুশলীদের টেনে নিয়ে জাতীয় দলের অফিসে হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। রাস্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ বলে কথিত সংবাদপত্রের কারিগরদের একাংশ পেশাগত মর্যাদা, স্বাধীনতাস্পৃহা, সত্য এবং ন্যায় - সাংবাদিকতাবৃত্তির সংগে সংস্লিষ্ট ইত্যাদি মহত অনুষংগসমুহ বাদ দিয়ে যে নাটকের অবতারনা করেছিলেন বাংলাদেশের সমাজে অনতিবিলম্বে তার প্রভাব অনুভুত হতে শুরু করে।
অবশ্য সাংবাদিক মাত্রেই যে বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। চাপের মুখে বাকশাল সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করে একজন সাংবাদিককে আমি সত্যি সত্যি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। বেশ ক'জন সাংবাদিক ভয়ভীতি অগ্রা হ্য করে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতার আদর্শ এবং নীতিতে অটল ছিলেন। "ইত্তেফাক" পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আসাফউদ্দৌলা রেজা আবেদনপত্রে সই করেননি। এই অভিযোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় "ইত্তেফাক" প্রকাশ পাওয়ার সময় তাঁর চাকরি চলে যায়।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষনা করেছিলেন যে আমলা, কর্মরত সাংবাদিক, স্বায়ত্বশাসিত এবং আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমুহের কর্মচারীবৃন্দ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক যে কেউ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবশ্য কাকে সদস্যপদ দেয়া হবে, কাকে হবে না সটি সম্পুর্নভাবে কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়। যে কেউ ইচ্ছে করলে সরকারি দলে যোগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘোষনা। আসলে যোগ না দিলে কারো নিস্তার পাবার উপায় ছিলনা।
ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি বেসরকারি দফতর স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন যে, সবাইকে জাতীয়দলে যোগ দেয়ার আবেদনপত্রে সই করতে হবে। কতৃপক্ষ যাকে বিপজ্জনক মনে করেন সদস্যপদ দেবেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকুরি-বাকরি, ব্যাবসা-বানিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে জাতীয়দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যোগদান করার একটা হিড়িক পড়ে গেল।
শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুস্ঠানিকভাবে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষন জ্জাপনের উদ্দেশ্যে গোটা দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে ভেজা কাকের মত সুদীর্ঘ মানুষের সারি কিভাবে রাস্তায় তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, যাঁরা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন না। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র ভিজে শরীরের সংগে একশা হয়ে গিয়েছিল। এই সুবিশাল জনারন্যে আমাদের দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলান্জলি দিয়ে সশংকিতচিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিল। নাগরিক জীবনের সর্বত্র একটা আতন্কের কৃষছায়া প্রসারিত করে আসছিল। এ ধরনের চিন্তা, বুদ্ধি এবং সাহসরোধী পরিবেশে যেখানে মানুষের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না, বেঁচে থাকা বলতে শুধু বোঝায় কোন রকমে পশু অস্তিত্বের সংরক্ষণ। নৈতিক সাহস, মানবিক মুল্যবোধ ইত্যাকার সুসভ্য জীবনের বোধগুলো বাংলাদেশে সর্বপ্রকারের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সবখানে আতন্ক, উদ্বেগ। এ তো গেল একদিকের চিত্র।
অন্যদিকে গ্রাম-বাংলার মানুষদের অবস্থা দুর্দশার শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে। দেশে অভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্ষুধার তাড়নায় মা সন্তান বিক্রি করছে। স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করছে। বিনা কাফনে লাশ কবরে নামছে। সৎকারবিহীন অবস্থায় লাশ শৃগাল-কুকুরের আাহার্য হওয়ার জন্য পথে পথে পড়ে থাকছে। চারদিকে জ্বলন্ত বিভীষিকা, চারদিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন রব। এই অন্নহীন বস্ত্রহীন মানুষের দংগল একমুঠো ভাত, এক ফোটা ফেনের আশায় ঢাকা শহরে এসে শহরের ফুটপাতে চিৎ হয়ে মরে থাকছে। একদিকে উদ্ধত উলংগ স্বৈরাচার, অন্যদিকে নির্মম দারিদ্র, বুভুক্ষা এই দুইয়ের মাঝখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অতি কষ্টে, অতি সন্তর্পনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল।
অর্থনৈতিক অন্তর্দাহের আঁচ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও লেগেছে। অনেকগুলো পরিবার মাছ-মাংস স্পর্শ করা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। কোনো কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা দু'বেলা ভাত খেত দু'বেলা আাটা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আবার অনেক পরিবারের দু'বেলা আটাও জোটে না। অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ক্ষমতার সংগে যাঁরা যুক্ত তাঁদের সুযোগ-সুবিধের অন্ত নেই। তাঁদের হাতে টাকা, ক্ষমতা সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন তাঁদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সহায়, সরকারি আমলারা আ্জ্গাবহ মাত্র, সামাজিক সুনীতি, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-কানুন কোন কিছুর পরোয়া না-করলেও তাঁদের চলে।
উনিশ শ' একাত্তুর সালের যুদ্ধের পর থেকে এই শ্রেণীটি বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্যের থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে ডাঁটো হয়ে মাথা তুলছিল। ঢাকা শহরের প্রশস্ত রাজপথ থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিস্ঠান, ব্যাবসায়ীর আড়ত, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রেডিও-টেলিভিশন, লেখক-সাহিত্যিকদের আড্ডা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির এমনকি দূর-দুরান্তের পল্লীগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় এই হঠাৎ জন্মানো নব্যনবাবদের সীমাহীন প্রতিপত্তি। এদের অনুমোদন ছাড়া মরণোম্মুখ রোগী এক ফোটা ওষুধ পেত না, শীতার্ত উলংগ অসহায় মানুষের পরনে রিলিফের একখানি বস্ত্র উঠত না, এক সের রেশনের চাল কি আটা বিলি হতে পারত না।
বিধ্ধস্ত বাংলাদেশের জনগনের সাহায্যার্থে যে দেশ থেকেই সাহায্য আসুক না কেন এই শ্রণীটির দুষ্ট ক্ষুধার চাহিদা মিটাতে সবকিছু শেষ হয়ে যেত। এদের অনুমোদন ছাড়া কোন অফিসে একজন সামান্য পিয়নের নিয়োগপত্র পাওয়ার সম্ভাবণা ছিল না, যোগ্যতা যাই হোক না কেন। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যেত না। ছাত্রকে স্কুলে। বেবাক দেশের দশদিকে এরা ছড়িয়েছিল। আমলাদের মধ্যে, নিম্নশ্রেণীদের মধ্যে, শিক্ষকদের মধ্যে, গায়ক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে অন্তরীক্ষে অবস্থান করে একজন মাত্র মানুষ সবকিছুর সুতো ধরে রয়েছেন তিনি বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার তিন বছর সময়ের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এ দুটো শব্দ পরস্পরের পরিপুরক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেখ মুজিব যদি বলতেন আমিই হলাম গিয়ে বাংলাদেশ, তাহলে তিনি এতটুকুও মিথ্যে বলতেন না।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়ে একে একে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর গলা টিপে ধরেছিলেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন। তাদের ঘরবাড়ি ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন, পরিবার-পরিজনের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন। তাদের কাউকে গ্রেফতার করে কারাগারের উদরে নিক্ষেপ করেছেন। দেদার নেতা এবং কর্মী হত্যা করেছে রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামে-গন্জে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী দমন করার নামে সরল মানুষদের পাখির মত গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিব বিরোধী কোন কিছুর আভাস পাওয়ামাত্রই রক্ষীবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে গেছে। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, ভেংগে-চুড়ে তছনছ লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা তিরিশ বছর বয়স্ক সিরাজ সিকদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদ কক্ষে উল্লসিত উদ্ঘোষনায় ফেটে পড়ে বলেছিলেন, এখন কোথায় সিরাজ সিকদার? গ্রফতার, নির্যাতন এসব শেখ মুজিব প্রশাসনের একটা অ্ত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিল, সম্পাদক আ.স.ম. আবদুর রব সহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী, জাতীয় লীগের অলি আহাদ অনেককেই তিনি কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। বিপ্লবী মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের কথা বাদ দিয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকবোধ আস্থাশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উপস্থিতিও বরদাশত করতে পারতেন না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর তিনি দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য সময়ে অসময়ে হুন্কার দেয়া ছাড়া কোনো বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেননি।
পক্ষকান্তরে তার বিরোধীদের সমুলে বিনাশ করার এক সর্বনেশে খেলায় মেতে উঠেছেন। এমনকি সে বিরোধিতা নিজের দলের লোক থেকে এলেও এবং একান্ত ন্যায়সংগত হলেও তিনি সহ্য করেননি। দৃশ্যত বিরোধীদলবিহীন খোলা ময়দানের তিন তিনটি দলের সর্বময় কর্তা হওয়া স্বত্তেও তিনি নিশ্চিত বোধ করতে পারছিলেন না। তিনটি দলকে এক করে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী থেকে রাস্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংবিধান বাতিল ঘোষনা করলেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সংগে বয়-বেয়ারাদের মত আচরন করলেন। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ দলের পাটাতনে দাঁড়িয়েই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরিসরে নিজেকে বাঙালি জাতির সংগ্রামী প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে নিতে পেরেছিলেন এবং বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের নায়করুপে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিন বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ দলটির অস্তিত্ব বিলীন করে দিলেন। উনিশ শ' উনসত্তর সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁকে ভাগ্যদেবতা অযাচিতভাবে কৃপা করে আসছে। উনিশ শ' উনসত্তর সালে আইয়ুব বিরোধী অভ্যূথ্থানের ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যণ্ত্র মামলে উঠিয়ে নিতে হয়। কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বাঙালি জাতীর জনক এবং অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি জনগনের আস্থা ভালবাসা তাঁর মস্তকে হিমালয় পর্বতের চুড়োর মত উত্তুংগ মহিমায় বিভুষিত করেছে। গোটা জাতি তাঁর পেছনে।
এর পূর্বে কোন বাঙালি নায়কের পেছনে মানুষ অকৃত্ত্রিম আস্থা এবং স্বত:স্ফুর্ট ভালাবাসা এমন করে বিলিয়ে দেয়নি। তার আগেও এরকমটি ঘটেছে বারবার। যে-কোন বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব, উপবিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিব কোন যাদুমন্ত্র বলে কারাগারে ঢুকে পড়েছেন। ঘটনার নিয়মে ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বিজয়ী বীরের মত শেখ সাহেব দৃপ্ত পদক্ষেপে প্রকাশ্য সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে নেতার আসনটিতে বিনাদ্বিধায় বসে পড়েছেন। শেখ মুজিবকেই ঘটনাটির নায়ক বলে লোকে বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। তাঁর নিজের দলের মধ্যেও এ নিয়ে বোধকরি কোন প্রশ্ন কখনো উঠেনি। উনিশ শ' একাত্তর সালের পঁচিশে মার
সোর্স: http://www.somewhereinblog.net
No comments:
Post a Comment