Friday 24 March 2017

বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াক, দিল্লির শাসকরা এবং আনন্দবাজার তা চায় না- আহমদ ছফা


বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াক, দিল্লির শাসকরা এবং আনন্দবাজার তা চায় না-

আহমদ ছফা
কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীর পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি বাংলাবাজার পত্রিকা  (৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) তিন কিস্তিতে আবার ছাপে।এখানে তার অংশ বিশেষ প্রকাশ করা হল।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিদ্বন্দি না পরিপূরক?

আহমদ ছফা: কোন সাহিত্য বা সংস্কৃতি কারো প্রতিদ্বন্দী হয় না। সাহিত্য-সংস্কৃতি হচ্ছে প্রবাহে প্রবাহে সম্মিলন। ধর্ম প্রতিদ্বন্দী হতে পারে, হয়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতি কখনই হয় না।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার বই আমদানির ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্প মার খাচ্ছে। এমন অভিযোগ বাংলাদেশের সাহিত্য এবং প্রকাশনার স্বার্থে পশ্চিম বাংলার বই আমদানি বন্ধ করার কথাও শুনেছি এবং পশ্চিম বাংলার কোন বইকে এ বছর(১৯৯৮)ঢাকার একুশের বই মেলায় ঢুকতে দেয়া হয় নি। এ বিষয়ে-

আহমদ ছফা: আগে যেটা হত আমদানি তো হতই, অনেকে কোলকাতার প্রকাশকের কাছ থেকে ট্রেসিং নিয়ে এসে এখানে ছেপে বিক্রি করতেন। এতে আমাদের বইমেলা বা বইয়ের বাজারে আমাদের(বাংলাদেশের) বই বিক্রি হত না। ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কলকাতার বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং কোলকাতার সেই বইয়ের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে কোনও বইয়ের বাজার এখানে গড়ে ওঠে নি। বই লেখা তো যথেষ্ট নয়, বই প্রমোট করা, বইয়ের আলোচনা করা, নানা কারণে সেসব এখানে হয় নি। স্বাধীনতার পর নানারকম দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের গ্রন্থশিল্পটা বিকশিত হতে পারে নি। কিন্তু কোলকাতার গ্রন্থশিল্প অনেকদিন আগে থেকেই বিকশিত। সেই সুত্রে কোলকাতার বই বাংলাদেশের সমস্ত বইয়ের বাজার দখল করে নিল। এর মধ্যে আনন্দ বাজারের বইই ছিল শীর্ষে। পুলিশ দিয়ে এটা বন্ধ করা যায় না। ১৯৯৪ সালে বুকে পোস্টার দিয়ে এর প্রতিবাদ করলাম। অন্য কোন প্রকাশকের বই নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজার বইয়ের বিরুদ্ধে।

যে বইয়ের জন্যে ইলিয়াসকে(আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) আনন্দ পুরস্কার দেয়া হয়েছে, সেই বইতেই(খোয়াবনামা) আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালির শত্রু।

বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে।
কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না। বই যেমন সংস্কৃতির বাহন, তেমনি পণ্য। ইকোনমিক্স-এ একটা কথা আছে-Nurse the baby protect the child, Free the adult আমাদের প্রকাশনা শিল্প পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতেই হবে।

ভারতের বইয়ের কপিরাইট কিনে এখানকার প্রকাশকরা ছাপুন আপত্তি নেই। সুনীলের(গঙ্গোপাধ্যায়) কোন বই কপি রাইটে কিনে এখানে ছাপা হলে আমাদের কমপোজিটার, ছাপা খানা, দপ্তরি, পাইকার সবাই টাকা পাবে। তবে Medical Science, Technology-এর বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এ কথা বলি না। কারণ এসব বই আমেরিকা থেকে আনলে যদি পাচ’শ ডলার লাগে, ভারত থেকে আনতে লাগে এক’শ ডলার। এবং আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য প্রকাশনার বইয়ের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করিনা।

প্রশ্ন: কোলকাতার বই মেলা তো—

আহমদ ছফা: (উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে) দেখুন, আমরা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা কেন কোলকাতাকে অনুসরণ করতে যাবো। আপনার পত্রিকাতেই পড়েছি- কোলকাতা বই মেলার আমন্ত্রণপত্রে প্রথমে হিন্দি তারপর ইংরেজী এবং শেষ তিন নম্বরে বাংলার স্থান। যদি ভবিষ্যতে পশ্চিম বাংলায় ওই তিন নম্বর স্থান থেকেও বাংলা ভাষা মুছে যায় মোটেই অবাক হবো না। কারণ এটাই ভারত সরকারের পলেসি এবং এতেই ভারতের ‘ঐক্য সংহতি’ দৃঢ় হবে।

আমাদের একুশের মেলা বাংলা ভাষার মেলা, বাংলাদেশের বইমেলা। একটি স্বাধীন জাতি হিশেবে, স্বাধীনভাবেই আমাদের চলার পথ আবিস্কার করতে হবে। আপনারা(পশ্চিম বাংলা ও ভারতের বাঙালিরা) জাতি হিশেবে স্বাধীন নন। আপনাদের ভাষাও সেখানে স্বাধীন নয়, আপনারা দিল্লি এবং হিন্দি সমান। সবক্ষেত্রে দিল্লি এবং হিন্দির নির্দেশ মেনেই আপনাদের চলতে হয়। পরাধীন জাতি হিশেবে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মানসিকভাবেও এই দাসত্বকে আপনারা(ভারতের বাঙালিরা) মেনে নিচ্ছেন। কারণ ‘ভারতের ঐক্য সংহতি রক্ষা’র দায় এখন আপনাদের কাধে। তাই স্বাধীন হবার ইচ্ছেও আর থাকছে না। কিন্তু আমরা ‘পাকিস্তান সংহতি’কে কবরে পাঠিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতাকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে যাব না। যদি কোনদিন স্বাধীন হয়ে স্বাধীন চিন্তা এবং পথকে আবিস্কার করতে পারেন, সেদিন নিশ্চয় আমরা পশ্চিম বাংলা ও কোলকাতার দিকে তাকাব।

প্রশ্ন: আপনি আনন্দবাজার প্রকাশনার কথা বললেন, কিন্তু অন্য প্রকাশনার বইও তো একুশের বইমেলায় ছিল না?

আহমদ ছফা: না, একুশে মেলার বিষয়টা আলাদা। একুশের মেলা ছাড়া অন্য যেসব বইমেলা হয় তাতে থাকে। একুশের মেলা হল বাংলাদেশের লেখকরা কতটুকু উঠলেন, কতটুকু বিকশিত হলেন তার মান নির্ণয়ের মেলা। এখানে অন্য বই থাকবে না। আন্দোলন করে একুশের মেলাটিকে আমরা নিজেরে বইয়ের মেলা করতে চাইছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অন্য কোনও স্থানের বই একুশের বইমেলায় থাকবে না। এই দাঁড়াচ্ছে মূল ব্যাপারটা-

আহমদ ছফা: হ্যা, তবে কোন ভারতীয় বই যদি বাংলাদেশে ছাপা হয় তাবে সে বই মেলায় থাকতে পারবে। এইটুকু যদি না করতে পারি, তবে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম কেন? আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে বলি।

একবার আনন্দবাজারের বাদল বসু আমার একটা ইন্টারভিউয়ের প্রতিবাদ করে খুব খারাপ কথা বলেছিলেন। তারপর আমাদের দেশের প্রবীণ লেখক শওকত ওসমান বললেন, আহমদ ছফা খুব খারাপ লোক। উনি(শওকত ওসমান) খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দটা আমি বলছি না। এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোন বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোনও বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদি দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিশেবে ছোট লেখক নন, তার অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভাল। এই অবস্থা দেখে শওকত ওসমানকে আমি বললাম, দেশটা আমরা বাল ছেড়ার জন্য স্বাধীন করেছি?
আনন্দবাজার ‘দেশ’ পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) সংখ্যায় বদরুদ্দীন উমরের রচনা নিয়ে যা করল, এসব বদমাইশি আর আমরা হতে দেব না। আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে কোলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে কাজ করছেন। আর আনন্দবাজার আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে সংখ্যা বের করেছে স্রেফ বাংলাদেশে তাদের মার্কেট রাখার উদ্দেশ্যে।

প্রশ্ন: দিন কয়েক আগেই স্বাধীন বাংলা পত্রিকার জন্যে বদরুদ্দীন উমরের একটি সাক্ষাতকার আমি গ্রহণ করেছি। সেই সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতি প্রসঙ্গে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন যে, এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায়(২১ফেব্রুয়ারি ’৯৮ সংখ্যায়) তার (বদরুদ্দীন উমর) একটি লেখা প্রকাশের জন্যে বাংলাদেশ সরকার দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি এখানে(বাংলাদেশে) নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বদরুদ্দীন ওমর আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ কিন্তু জানান নি। বরং আমাকে কোলকাতা গিয়ে তার লেখাটি পড়তে বললেন। বাংলাদেশ সরকার যদি ‘দেশ’ পত্রিকার কোন সংখ্যা এখানে আসতে না দেয়, তা হলে আনন্দবাজারের কী করার থাকতে পারে? এবং এখানে তাদের ‘বদমাইশিটাই বা কোথায়?

আহমদ ছফা: হ্যা, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপর আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, কিংবা সব ঘটনাটি জেনেছি। ব্যাপারটা হচ্ছে-‘দেশ’ পত্রিকা একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে ভাষা আন্দোলনের গবেষক লেখক বদরুদ্দীন উমরের কাছে একটি লেখা চাইলে, উমর তাদের জানান যে, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার ঘরানার লেখক নন। এরপর আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে বদরুদ্দীন উমরকে জানানো হয় যে, ভাষা আন্দোলনের উপর তিনি যা লিখবেন তাই দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে। এবং দেশ পত্রিকায় উমরের ওই লেখাটি ছাপা হলে দেশ পত্রিকার ওই সংখ্যার চালান বর্ডারে আটকে দেয়া হয়। এতে দেশ পত্রিকার সম্পাদক উমরের লেখাটি প্রকাশ করার জন্যে কোলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশন মারফত বাংলাদেশ সরকারের কাছে দুঃপ্রকাশ করে ক্ষমা চায় এবং উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে শওকত আলীর একটা লেখা যোগ করে দেয় পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।

শওকত আলীর লেখাটিও ২১ফেব্রুয়ারি সংখ্যার জন্যে দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশ পত্রিকার মূল সংখ্যায় শওকত আলীর লেখাটা ছিল না। পরে যখন তারা (দেশ পত্রিকা) বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি পত্রিকা থেকে বাদ দেন তখন সেই শূন্যস্থান তারা পূরণ করেন শওকত আলীর লেখাটি দিয়ে। এই মিথ্যাচার এবং কপটতা আনন্দবাজারের পক্ষে সম্ভব। লেখা চেয়ে নিয়ে লেখা ছাপার পর তা পত্রিকা থেকে বাদ দেয়া এবং লেখাটি আনন্দবাজার ভুল করে ছেপেছে বলে কোলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্য লেখা যোগ করে তা (দেশ পত্রিকা) এখানে পাঠানো এসব করতে গিয়ে আনন্দবাজার একবারও বদরুদ্দীন কিংবা শওকত আলীকে কিছু জানাবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। আপনি বলুন এসব বদমাইশি ছাড়া আর কি?

আমাদের ইতিহাস আমরা লিখবো না, লিখবে আনন্দবাজার। এত রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা, তার একটা দাম আছে। একবার নীরদ চৌধুরী তথাকথিত বাংলাদেশ লেখার কারণে দেশ পত্রিকা এখানে বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাপ্তাহিক দেশ পাক্ষিকে পরিণত হয়। এখন যদি ‘দেশ’ আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেই তবে তা মাসিক হবে। সেটা আমরা এখনই করতে চাই না, কারণ পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাটা টিকিয়ে রেখেছেন লেখকরা। আর কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার চর্চা নেই। বাংলা ভাষার ওপর ওখানে(পশ্চিম বাংলায়) যে আক্রমণটা চলছে সেই সময় আমরা যদি পশ্চিম বাংলার বই আমদানি করা বন্ধ করে দেই, তবে তার সুযোগ নেবে এখানকার মৌলবাদীরা, এবং ওখানকার বাংলা ভাষার চর্চা চরম বিপদে পড়বে।

দীঘদিন ধরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার অনুকূলে নয়। পশ্চিম বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মাড়ওয়ারী এবং গুজরাটিরা। আর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হয় দিল্লি থেকে। এমনকি বামফ্রন্ট সরকারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হয় হিন্দি বলয়ের স্বার্থকেই। এই হিন্দি বলয়ই ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে বাংলা ভাষা পশ্চিম বাংলায় টিকে আছে তার কারণ সেখানকার লেখকরা এখনো বাংলা ভাষায় লিখছেন। বাংলা ভাষার প্রতি প্রেমের কারণেই আমরা পশ্চিম বাংলার এই আমদানি বন্ধ করছি না। এমনকি আমরা চাই না ‘দেশ’ পত্রিকার মত একটি কাগজ বন্ধ হয়ে যাক। পশ্চিম বাংলার প্রতি আমাদের এই অনুভবটা আপনি পৌঁছে দিবেন।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশে তিন জন মানুষ মারা গেছেন। আর মমতা বন্দোপাধ্যায় এখানকার ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, কোলকাতা শহরতলীতেই মারা গেছেন একশজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একশ জনকে আমরা পঞ্চাশ ধরতে পারি। এই তিনজন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আনন্দবাজার যে কাণ্ডটা করল এটা কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি কোন ভদ্রোলোক করে না। মনে বিষ না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: যদি বলা হয় প্রতিযোগিতায় না পারার কারণে এই ক্ষোভ?

আহমদ ছফা: হ্যা, একথা বলতে পারেন। তবে আমি রেপড হচ্ছি আপনি ভাববেন না আমি মজা পাচ্ছি। আনন্দবাজারের একটা সাকসেসফুল ব্যাপার আছে। পশ্চিম বাংলার বাঙালির টাকা নেই। কিন্তু আনন্দবাজার টাকা করেছে। সাহিত্যটাকে তারা ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করেছে এবং সমস্ত লেখককে তারা পূজা সংখ্যার লেখক-এ পরিণত করেছে। তারা তাদের পচাত্তর বছরের ঐতিহ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রোয়িং প্রসেসে হস্তক্ষেপ করেছে। একজন সাধারণ লেখককে পুরস্কার দিয়ে তুলে ধরে, অন্যদিকে একজন সত্যিকার ভাল লেখককে অপমান করে। যেমন তারা তসলিমা নাসরিনকে পুরস্কার দিয়ে দুই কোটি টাকা আয় করেছে। আপনি যদি চান আমি হিশাব দেব। এখানে তারা পাচটি আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের হস্ত এখানে প্রসারিত হচ্ছে।

হিন্দির এত বড় এজেন্ট হচ্ছে আনন্দবাজার। আমি এইভাবে ব্যাখ্যা করবো। জানি না আপনারা পশ্চিম বাংলার লোকেরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। নানাভাবে ভারত ফাদ পেতে রাখছে। সেই ফাদে আমাদের পড়ার অপেক্ষা। আমরা যদি ভারত বর্ষের ফাদে পড়ি, পশ্চিম বাংলার লোকদের কর্তব্য হবে- আমাদের স্বাধীন অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা। না হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের অবস্থাও গয়া হবে। পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে।

একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।
প্রশ্ন: বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করে বলেন-

আহমদ ছফা: পাকিস্তান ভেঙে যদি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেন তবে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলোই বা তা পারবেন না কেন? এবং কোন অধিকারে দিল্লি তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাঙালি, কাশ্মীরী, নাগা ইত্যাদী জাতিগুলোর ওপর রাজনৈতিক শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির ওপর হিন্দির স্টিমরোলার চালাবে?

আনন্দবাজার শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও শত্রু এবং বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের প্রয়োজনে শুধু দিল্লি বা হিন্দির বিরুদ্ধে নয়, আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে একদিন আপনাদের (পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের) দাঁড়াতে হবে।
ফারাক্কা তৈরি করেছিল বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্যে। কিন্তু ফারাক্কার কারণে পশ্চিম বাংলার কম ক্ষতি হয় নি। ভারতের পানি অবরোধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানি যখন ফারাক্কা অভিযান(১৯৭৬) করেছিলেন, আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, আনন্দবাজার কি কুৎসিত এডিটোরিয়াল লিখেছেন। এখন আবার দেখবেন, কিভাবে তারা ভাষা পাল্টালেন। বাংলাদেশের রস পায় বলে পশ্চিম বাংলায় আনন্দবাজার দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দবাজারকে কিভাবে টোন ডাউন করতে হয় আমরা জানি। এমনিতে আনন্দবাজার যথেষ্ট ভাল বই ছাপে, দেশ পত্রিকা একটি সুসম্পাদিত পত্রিকা। কিন্তু একটি পত্রিকা একটি জাতির সুসাহিত্যকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে রাখে, এটা পৃথিবীর অন্য কোথাও আপনি পাবেন না।

প্রশ্ন: নিজস্ব কোন সাহিত্য ধারা আপনারা কি তৈরি করেছেন?

আহমদ ছফা: এখনো পারিনি। কিন্তু আমরা বসে থাকব, এটা ভাবাও ঠিক নয়।

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার পাঠকদের সম্পর্কে-

আহমদ ছফা: পশ্চিম বাংলার পাঠকরা এত ভাল। সেখানে গলির মোড়ে মোড়ে বিদগ্ধ লোক পাওয়া যায়। দেশ পত্রিকাতে যে সমস্ত পাঠক চিঠি লেখেন, চিঠিগুলো যেভাবে গুছিয়ে লেখেন, পৃথিবীর কম দেশেই এমন গুছিয়ে লেখেন। অন্য পাঁচটা দেশের সাহিত্য এবং পত্রিকা পড়েই একথা বলছি । পশ্চিম বাংলায় ভাল মানুষের সংখ্যা কম নয়, অনেক Unfortunately তারা অসহায়। অর্থনৈতিকভাবে তারা অসহায় এবং সংস্কৃতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তারও অসহায় শিকার তারা।

No comments:

Post a Comment