Sunday 26 March 2017

মহাজন হিন্দুদের সহযোগিতায় ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন


মহাজন হিন্দুদের সহযোগিতায় ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন

এম আর আখতার মুকুল
“……সিরাজউদ্দৌলার পতনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কুসিদজীবী মহাজন শ্রেণীর হিন্দুদের ইংরেজের সঙ্গে সহযোগীতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজদের কুটকৌশল। সিরাজউদ্দৌলার পতন বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য আশাভঙ্গের কারণ হয়েছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বছর হচ্ছে ১৭৯৩ সাল। ভারতের ততকালিন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির খাজনা এবং রাজস্ব আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়।

এই বিশেষ পদ্ধতির ফলে মুসলমানদের ভূস্বামীগত অধিকার কৌশলে বিলুপ্ত করা হয় এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু আমলা এবং গোমস্তারা ক্রমান্বয়ে এসব জমিদারি আত্মসাত করে এবং প্রতাপশালী জমিদারে পরিনত হয়।
অর্থাত, সর্বতোভাবে মুসলমানরা স্বত্বহীন অসহায় মানবগোষ্টিতে পরিনত হয়। এর পরে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যার্থতা মুসলমানদের জন্য চরম সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াল।এই তিনটি ঘটনাই ইংরেজ রাজত্বে মুসলমানদের অসহয়তা প্রমানিত করে। মুসলমানরা রাজশক্তি হারাল। একই সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং ইংল্যান্ডের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য রাজস্ব ও জমিদারি ব্যবস্থার যেসব সংস্কার করল তার সবই গেল মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিকূলে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তনের ফলে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিস্কর বা লাখেরাজ (ওয়াকফ) জমির বাজেয়াপ্তির ফলে মুসলমানরা কপর্দকহীন নি:স্ব হলো এবং মুসলমান জমিদারদের হিন্দু তহশিলদার নায়েব মুহরি ও গোমস্তা ইংরেজদের কৃপা-অনুগ্রহে ভূস্বামীর অধিকার লাভ করল। শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর আরেকটি আঘাত এল যখন লর্ড বেন্টিংক ফার্সির পরিবর্তে এদেশে ইংরেজিকে রাজভাষা হিসাবে ঘোষনা করলেন। দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এর ফলে যে পরিবর্তন এল তা সুদুরপ্রসারী ছিল। কিন্তু মারাত্মক সর্বনাশ হলো ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য। মুসলমানদের যখন এহেন অবস্থা তখন কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দুরা আপনা স্বার্থ চিন্তায় সুপরিকল্পিতভাবে ইংরেজদের সহযোগীতা করে।

১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে যখন সিভিলিয়ানদের বাংলা শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হিন্দুদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে এবং বাংলা গদ্যসৃষ্টিকে উপলক্ষ করে কোলকাতার মান্যগণ্য প্রতাপশালী হিন্দুদের সঙ্গে ইংরেজদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ঘটে।হিন্দু কলেজে বাঙ্গালী হিন্দুরা লেখাপড়া করতে থাকে এবং ইংরেজি শিক্ষায় মনোনিবেশ করে। এ সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় প্রমানিত হয় যে, উনিশ শতকের সূচনা থেকেই হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগীতা করেছিল। রাজস্ব সংস্কারের ফলে ইংরেজদের আশাতীত লাভ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের টাকা এবং কাঁচামালের সাহায্যে ইংল্যান্ডের ডান্ডী, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার প্রভৃতি বাণিজ্য প্রধান শহরগুলোর দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুদের ভাগ্যেরও দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং এদেশে প্রতাপশালী নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হয়।

ঊনিশ শতকে কিছু মুসলমান তাদের উপর যে অন্যায় আচরণ হচ্ছে সেজন্য বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং সেজন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা করেননি। এক্ষেত্রে তীতুমীরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূলত তীতু মিয়ার আন্দোলনের সূত্রপাত ছিল মুসলমান সমাজের জন্য একটি সংস্কার আন্দোলন। এই সংস্কার আন্দোলনকে ফরায়জী আন্দোলন বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলাকে কেন্দ্র করে তীতুমীর তাঁর আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। এই সংস্কার আন্দোলনে হাত দিতে গিয়ে তীতুমীরকে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। এবং সংঘর্ষ ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারন করে হিন্দুরা তীতুমীরের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের সহায়তা কামনা করে। তখন তীতুমীরকে বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নারকেলবাড়িয়ায় একটি স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ইংরেজ সরকার তখন বিচলিত বোধ করে। বারাসাতের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার তীতুকে দমন করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হন। শেষ পর্যন্ত তীতুকে দমন করবার জন্য মেজর স্কট নামক একজন ইংরেজ কোলকাতা থেকে একটি পদাতিক বাহিনী নিয়ে তীতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। তীতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরি করে দুর্ধর্ষ ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং ১৮৩১ সালের ২২ শে নভেম্বর শহীদ হন।

ফরাজী আন্দোলন শুরুতে কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজে ধর্মীয় আচরনের ক্ষেত্রে যেসব ভ্রান্তি অনুপ্রবেশ করেছে সেগুলোর সংশোধন করা কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে হিন্দু জমিদারগণ এ আন্দোলনকে তাদের ক্ষমতা থেকে উতখাত করার আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করল। যার ফলে শেষ পর্যন্ত ফারাজী আন্দোলনটা একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দী বাঙ্গালী হিন্দুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাল। এ সময় কোলকাতায় অবস্থানকারী বিত্তবান এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় মধ্যযুগ অতিক্রম করে ততকালীন ইউরোপের আধুনিকতার সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছে। যে সমস্ত প্রতিভাশালী হিন্দু এ যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই পাশ্চাত্য বিদ্যাবত্তায় দীক্ষিত এবং ভারতীয় হিন্দুর ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। এরা একেকজন একেক ধারার উদগাতা হয়েছিলেন। কেউ ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, কেউ ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ সামাজিকতার ক্ষেত্রে, কেউবা হিন্দুদের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ন বসু, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইত্যাদি।

এদের প্রত্যেকের সামগ্রিক চিন্তাধারা ছিল হিন্দু সমাজকে সমৃদ্ধ করা এবং হিন্দুদের সৌকর্য উদঘাটিত করা। এদের কারো দৃষ্টিতেই প্রতিবেশী মুসলমান চিহ্নিত হয়নি। এদের কারো বক্তব্যেই মুসলমানকে নিয়ে নয় এবং মুসলমান ও হিন্দু মিলিয়ে একটি জাতিসত্তার কল্পনা এদের কারোই ছিল না।
রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলন হিন্দু ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আচরণগত দিক থেকে হিন্দু সমাজের বিকলতা এবং বিভ্রান্তি দূর করে আর্য সমাজে উদ্ভুত আদি বৈদিতদার পুনরজ্জীবন কামনা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজের ধর্মভিত্তিক কিছু সামাজিক আচরণের সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুদের প্রাচীন গৌরব সম্পর্কে হিন্দু সমাজকে অবহিত করতে চেয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু মনে গর্ব এবং আত্মপ্রসাদ সৃষ্টির প্রয়াসী হয়েছিলেন। এরা কেউ ব্যক্তি জীবনে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না এবং কর্মজীবনে এদের আচরণে মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশিত বা প্রমাণিত হয়নি কিন্তু এরা প্রত্যেকেই আপন আপন জীবনচর্চায় হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন্, মুসলমান সমাজের নয়।

সুতরাং ঊনিশ শতকের রেনেসাঁ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে সে কথাটি বিভ্রমাত্মক। এদের কারো আবেদনই নিম্নবর্ণের অচ্ছ্যুত হিন্দু সমাজের প্রতি ছিল না, এদের আবেদন কোলকাতার বাইরে বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চলে প্রসারিত ছিল না এবং মুসলমান সমাজ এদের চিন্তায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত ছিল।
উপরন্তৃ বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনার সাহায্যে হিন্দুকে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাড় করিয়েছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিবেচনায় মুসলমান ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাগুলোতে হিন্দুদের বিরুদ্ধ পক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন উপণ্যাসের হিন্দু নায়কগণ মুসলমানকে পর্জদস্তু করতে চেয়েছে এবং করেছে।

(চলবে)

উৎসঃ কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি

No comments:

Post a Comment