Saturday 25 March 2017

বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য-আহমদ ছফা


বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য-আহমদ ছফা

কলকাতা বইমেলা ’৯৯ সংখ্যার জন্য কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীর পক্ষে আহমদ ছফার এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি বাংলাবাজার পত্রিকা  (৩১ জানুয়ারি ১৯৯৯ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) তিন কিস্তিতে আবার ছাপে।এখানে তার অংশ বিশেষ প্রকাশ করা হল।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম, সব ক্ষেত্রেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে-

আহমদ ছফা: হ্যা, এটা একটা মজার প্যারাডকস। যেমন ধরুন বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলেন, মুসলমানরা জলকে পানি। কিন্তু বাংলার বাইরে সবাই, হিন্দু-মুসলমান উভয়েই পানি বলেন। এই জল-পানি নিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানরা একশ বছর লড়াই করছে। যাহা জল তাহাই পানি। যাহা পানি তাহাই জল। এখন আমাদের এখানে কি হচ্ছে।

দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো, লড়াইয়ের যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে কেউ যেতে চাইছে না বলে কতগুলো প্রতীক তৈরি হয়েছে। যে কোন ইতিহাসকে দলীয়করণ করার এই যে অনুদারতা, অসত্যতা, এর কারণ ইতিহাস বলতে তারা জনগণের ইতিহাস বোঝেন না। বোঝেন দলের ইতিহাস, ব্যক্তির ইতিহাস।
ইতিহাস তো জনগণের ইতিহাস হবে। কিন্তু এখানে নেতা এবং দলের ইতিহাস সবাই তুলে আনছেন। এর কারণ হচ্ছে, সংঘাতের আসল ক্ষেত্র থেকে, জনগণকে সংঘাতের প্রতীকে ফেরত নেয়া। যেমন আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী, বাঙালি না মুসলমান? এগুলো একটা থেকে আর একটার বিরোধী নয়। আমরা যেমন বাঙালি, তেমনি বেশিরভাগ লোক মুসলমান। আমরা যেমন বাংলাদেশী তেমনি বাঙালিও। কিন্তু এগুলো তৈরি করা হচ্ছে, ক্ষমতার মালিকানা কে নেবে, এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতিটা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

ফরাসি বিপ্লবের সঠিক ইতিহাস এখনো অনুসন্ধান করা হচ্ছে। রুশ বিল্পবের সময় স্টালিন এবং ট্রটস্কির ভূমিকা নিয়ে লাখ লাখ পাতা লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির এতবড় একটা ঘটনা, সেটা নিয়ে মতদ্বৈততা, বিতর্ক এসব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। একাত্তরের যুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু এখানে সবাই মিথ্যা বলছেন কেন? মিথ্যেকে পূজো করছেন কেন? এর একমাত্র কারণ মিথ্যে বললে এখানে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।

প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলন থেকে যে অসাম্প্রদায়িক জাতী চেতনার উন্মেষ তার চূড়ান্ত রূপ স্বাধীনতা। এই সুত্রে আশা করা গিয়েছিল বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠবে। ওই আশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আহমদ ছফা: প্রথমত আমি অনেকগুলো পরিচিত চিন্তার বিরোধিতা করব। যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত ছাত্র, বেশির ভাগ মুসলমান। আওয়ামী মুসলীম লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এককালে ছিলেন পাকিস্তানি। আমার শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তার কাছে শেখ মুজিবের কিছু ছবি আছে, সেই ছবিতে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর শেখ মুজিব হাউমাউ করে কাঁদছেন। হিন্দু-মুসলমানদের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হল। তারপর পশ্চিমাদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে তারা (বাঙালি মুসলমানরা) পারে না। এল সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত নির্বাচন। এইভাবে একটা প্রেক্ষিত তৈরি হল এবং বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের টেনে আনলেন। এই ক্ষেত্রে প্রেমের চাইতে যে জিনিসটা বেশি কাজ করেছে, তা হল তাদের বাস্তব প্রয়োজন। অর্থাৎ যে অর্থে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলতে আমরা যা চিন্তা করি, একটা আইডিয়াল সিচুয়্যেশন, সেটা বোধ হয় এ ক্ষেত্রে কল্পনা করা ঠিক হবে না। (আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন মুসলিম লীগের জুনিয়র পার্টনার-ছফা)

তবে কোলকাতা থেকে এটা কল্পনা করার বোধ হয় সময় এসেছে এই কারণে যে, ভাষা আন্দোলন তার নিজস্ব প্রেক্ষিত ছাড়িয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যরকম একটা তাৎপর্য নিয়ে আসছে। কিন্তু উৎসের(ভাষা আন্দোলনের) দিকে গেলে দেখব লক্ষ্য ছিল চাকরি/বাকরি ইত্যাদি। আগেই বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি থ্রি ফোরের ছাত্র। ছাত্র বয়সে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে গেলে এসব কথা আমরা শুনতাম। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, বাংলায় পাস করে আমরা চাকরি পাব না, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হবো, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে হেরে যাব। সেই সময় শহিদুল্লাহ সাহেবের(ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) একটা কথা- পাকিস্তানিরা যখন বলল, ইসলামের ভিত্তিতে যেহেতু পাকিস্তান, তাই ইসলামের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ইসলামকেই যদি তোমরা অগ্রাধিকার দিতে চাও তবে আরবিকে রাষ্ট্রভাষা কর, তোমরাও শিখবে, আমরাও শিখবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে রাজি হয় না। এইভাবে নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষা আন্দোলনে আজকে আমরা যা আবিষ্কার করেছি সেই জিনিসটা প্রথমে ছিলনা।

‘চীন দেখে এলাম’ বইতে মনোজ বসু লিখেছিলেন, শেখ মুজিব পিকিংএ তাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে ছাড়াবো। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মনোজ বসু বইটা প্রত্যাহার করে নেন। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা শেখ সাহেবের মনে থাকতে পারে। আমার মনে হয় এতে কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। বীরেন শাসমলের ছেলে নিমলানন্দ শাসমল,  ‘ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইতে তিনি লিখেছেন, আজকে যে কারণে আমরা শেখ মুজিবকে মালা দেই, সেই একই কারণে শেখ আবদুল্লাহকে জেলে পাঠাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে প্রথম ভৌগোলিক দুরত্বের কারণে। ভারতের সাথে কাশ্মীরের কন্টিগিউয়াস(contiguous) এরিয়া। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখলে বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হবে। আর এ সমস্ত ইস্যুতে আমি একজন সামান্য মানুষ। চূড়ান্ত মতামত দেবার ক্ষমতা আমার নাই।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের অনেক কবি, সাহিত্যিক দাবি করেন, ঢাকাই হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাজধানী। এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা আছে–

আহমদ ছফা: ‘রাজধানী’ করার শব্দটা খুব ভাল শব্দ নয়। তবে এ শব্দটা প্রথম উচ্চারণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরা তো ব্যবসায়ী লেখক, যখন যেখানে যেমন বোঝেন কোপ মারেন। আবার ‘দেশ’ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায়(২১ ফ্রেবুয়ারী ১৯৯৮ সংখ্যা) ‘প্রবাসে বাংলা ভাষা’য় বাংলাদেশের ভূমিকাকে তিনি গৌণভাবে দেখিয়েছেন। রাজধানী শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কারণ মানুষ যেখানে থাকেন, তার সংস্কৃতিও সেখানে থাকে। এক সময় ব্রজবুলি সাহিত্য তৈরি হয়েছিল, এক সময় মঙ্গলকাব্যও লেখা হয়েছিল, একসময় পুথিসাহিত্যও তৈরি হয়েছিল। সারা বাংলা জুড়ে নানা বাকে নানা সাহিত্য তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের সাহিত্য এখনকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, এখানকার জীবন, সংগ্রাম,রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এসব নিয়ে লেখা হবে। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সেখানকার মত বিকশিত হবে।

তবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। বাংলা এখানে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় ভাষা। সেই কারণে বাংলা ভাষা এখানে যে পেট্রোনাইজেশনটা পাচ্ছে সেটা পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা পাচ্ছে না। বাংলা ভাষা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) একটি ‘প্রাদেশিক’ ভাষা, এবং হিন্দির দ্বারা চূড়ান্তভাবে কোণঠাসা। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার জন্যে যে প্রেট্রোনাইজেশনটা দরকার আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা তা পাচ্ছে না। কারণ, জাতিগতভাবে বাঙালি সেখানে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যারা খুব পরিচিত, একটা সময় পর্যন্ত তারা এখানকার সাহিত্যকে সার্ভ করেছেন তাদের অনেকেই এখন সাহিত্য ক্ষেত্রে একটা সময় যারা জ্বলে উঠেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বর্জ্য পদার্থের কাছাকাছি এসে গেছেন।

নতুন প্রজন্মের কাছে পলিটিক্যাল ডেসটিনি না থাকলে, পলিটিক্যাল গোল ক্লিয়ার না থাকলে, শিল্প সাহিত্য তার প্রধান ভিকটিম হয়।
এখন বাংলাদেশের চিত্র কোন দিকে যাবে তার দিশা নেই। আপনি দেখবেন হাজার হাজার পাতা পত্র-পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শ করার মত পঞ্চাশটি পাতা আপনি সেখানে পাবেন না। কাজেই অতিকথন করে লাভ নেই। তবে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনা আছে, সেই সম্ভাবনাকে যদি একসপ্লয়েট করতে পারি, তাবে বাংলার এই অংশের সাহিত্যে একটা নতুন যুগ আসতে পারে। এবং তা যদি হয় তবে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাও সাহিত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। সেসব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু শক্তি ও প্রেরণা দিতে পারবে। ‘রাজধানী’ শব্দটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েন করেছিলেন বাংলাদেশে বই বেচার জন্যে।

প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা বা বাংলা নবজাগরণ বিষয়ে-

আহমদ ছফা: হ্যা, ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তার রেজাল্ট আমরা সবাই কমবেশি ভোগ করেছি। বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে, আধুনিক সাহিত্য, আধুনিক সংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা এসব আমরা পেয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতা থেকে। তবে একে রেনেসাস বলা ঠিক নয়। তবে এর মধ্যে রেনেসাসের অঙ্কুর ছিল। পরবর্তীকালে যা হয়েছে, তা হল রিভাইভিলিজম। বঙ্কিম, ভুদেব থেকে এমনকি রামমোহন রায় হিন্দু রিভাইভলিজাম থেকে মুক্ত নন। আমি জানি না, পশ্চিম বাংলার বিদগ্ধ সমাজ আমার কথা গুলোকে কিভাবে নেবেন। আমি মুসলিম সমাজের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতাকে রেনেসাস বলা ঠিক নয়। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ।
যেমন বিদ্যাসাগর তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ, সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অত্যন্ত কম। একথা রামমোহন রায় এবং তার সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম নয়, নিম্মবর্গের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ সখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরের এর কোন প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।

প্রশ্ন: ঊনবিংশ শতাব্দির বিতর্কিত চরিত্র বঙ্কিম, তার সাহিত্য প্রতিভা এবং রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে-

আহমদ ছফা: বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে বাংলার মুসলমান লেখকরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমকে সমর্থন করেন এমন লোক বাংলাদেশে অল্প নয়। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিমকে দেখেন। আমি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে যে বইটি (শতবর্ষের ফেরারী) লিখেছি তাতে নতুন কথা কিছু লিখিনি। সুশোভন সরকারের ছেলে সুমিত সরকার ইংরেজী ভাষায় বঙ্কিম ও হিন্দুত্ব বিষয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের বই লিখেছেন। লেখক হিশেবে বঙ্কিম নবযুগের উদগাতা। তিনি মানবিক এবং সেকুলার চিন্তার ধারক-বাহক। কিন্তু বঙ্কিম যখন রাষ্ট্র চিন্তা করেন, তখন হিন্দু রাষ্ট্র চান।

গিরিলাল জৈন্য ফেনামেনন বলে একটা বই লিখেছেন। এই বইটিকে বিজিপির বাইবেল বলা হয়। এই বইটিতে তিনি বঙ্কিমকে কিভাবে দেখেছেন। আজকে বিজেপির কোন ফোরাম থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হয় না, রবীন্দ্রনাথ তাদের কোন কাজে আসবে না। স্বয়ং নীরদ চৌধুরী বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ খ্রীস্টান চিন্তা-চেতনা প্রচার করেছেন। আমি বুঝতে পারি না, পশ্চিম বাংলার লোক বঙ্কিমের প্রতি অন্ধ অনুরাগ কেন রাখবেন। তারা তো অনেক বেশি মুক্তচিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বঙ্কিমের প্রশ্নে তারা ঢোক গেলেন কেন? (আরো দেখুনঃ বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা )

প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলার সাহিত্য চর্চায় আপনি কি সাম্প্রদায়িকতার কোন আভাস পান?

আহমদ ছফা: না, এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না।

প্রশ্ন: বিদ্বেষহীন সুস্থ সম্পর্কের জন্যেই প্রয়োজন খোলামেলা মত প্রকাশ-

আহমদ ছফা: এটা অবশ্য ভাবার বিষয়। হ্যা, কিছু পাইতো বটেই। যেমন পশ্চিম বাংলার এক জনপ্রিয় সাহিত্যিক যিনি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় তার একটি উপন্যাসে লিখেছেন, মুসলমানরা কোরআন পড়েন উর্দু ভাষায়।

প্রশ্ন: কেউ যদি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের জটায়ুর মত লেখেন যে উট তার পাকস্থলিতে জল বোঝাই করে মরুভূমির পথে হেটে চলছে…এটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কি? এ ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতা নয়, অজ্ঞতা বলাই কি যুক্তিসঙ্গত নয়?

আহমদ ছফা: হ্যা, তা বলতে পারেন। কিন্তু এত অজ্ঞ হওয়ার তো কথা নয়। আর এত অজ্ঞ হলে উপন্যাস লিখতে এসেছো কেন? এমন-কী ‘প্রেম নেই’ বলে যে উপন্যাসটার তারিফ করা হয়, তাও লেখা হয়েছে মুসলিম লীগের স্ট্যান্ডটাকে ভেরিফাই করার জন্যে। কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে কোন কিছুই বলা হয় নি।

যে প্রেক্ষিতটা ওখানে (পশ্চিম বাংলায়) রয়েছে, আমার বিবেচনায় তা দূষিত। অনেকেই লিখবার আগে ধরে নেয় জিন্নাহ একজন ক্রিমিনাল। পশ্চিম বাংলায় প্রচুর সুস্থ লোক রয়েছে, অসাম্প্রদায়িক লেখক আছেন যথেষ্ট কিন্তু এনটায়ার প্রেক্ষিতটাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছেন না।
প্রশ্ন: পশ্চিম বাংলা বা কোলকাতা সম্পর্কে আপনার এই সমালোচনা কি যুক্তিবাদী মননশীল জায়গা থেকে না কোনও ধর্মীয় অনুভূতি থেকে-

আহমদ ছফা: বাইরের লোক যখন দেখেবেন, আমি যখন সাফারার, অন্য লোক এর মধ্যে ধর্মীয় সত্তা খুজে পাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা আমার জীবনে। আমি আমার গ্রামে থাকতে পারি না, মোল্লারা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। কারণ আমি ইসলামের কিছুই করি না, বিশ্বাসও করি না। আমার জীবনের মধ্যে কাজ করে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উপজাতি।

মুসলমান সমাজকে সকলে কনডেম করেন। বাংলা সাহিত্যের ষাটভাগ সাহিত্য সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। সুতরাং আমার জনগোষ্ঠীর ওপর যে সাংস্কৃতিক অত্যাচারগুলো হয়েছে, আমি সেটাকে যদি ডিফেন্ড করি অনেকে সাম্প্রদায়িক মনে করতে পারেন।
কিন্তু আমার মনে হয় না পশ্চিম বাংলার মানুষ আমাকে ভুল বুঝবেন। আমি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত একটা জিনিসকে তুলে ধরছি। আপনি যদি এখানকার (বাংলাদেশের)হিন্দুদের সাথে কথা বলেন, দেখবেন তারা শামসুর রাহমান বা অন্যান্যদের থেকে আমাকে বন্ধু হিশেবে বেশি পছন্দ করবেন, যদি মাঝখানে ভারতের প্রসঙ্গটা না আসে। আমাদের দেশে যদি একজনও হিন্দু না থাকে তবে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের নিয়ে আমি বাচতে পারবো না।

No comments:

Post a Comment