Saturday 25 March 2017

ঔপনিবেশিক শাসনে মুসলমানদের প্রতি শোষক ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গি _এম আর আখতার মুকুল


ঔপনিবেশিক শাসনে মুসলমানদের প্রতি শোষক ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গি

এম আর আখতার মুকুল
“…….. সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭ সালে) ফলে ব্রিটিশদের কাছে মুসলমানরা কুচক্রী এবং দুরভীসন্ধিপরায়ন বলে চিহ্নিত হলো। এভাবে চিহ্নিতকরণের ফলে মুসলমানরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভে বঞ্চিত হলো। একটি মুসলিম বিরোধী মনোভাব ব্রিটিশ শাসকদের মনে দানা বাঁধতে লাগল। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের বিরূপতার আর একটি কারণ ছিল। ব্রিটিশরা যে ধর্মের অনুসারী সে ধর্ম অর্থাত খ্রিষ্টান ধর্ম একটি বিশ্ব ধর্ম। তেমনি মুসলমানরা যে ধর্মের অনুসারী অর্থাত ইসলাম ধর্ম, সেটাও বিশ্বধর্মী। উভয় ধর্মই সকল মানুষের আনুগত্য দাবি করে। ইসলাম যেমন বিশ্বজনীন ধর্ম তেমনি খ্রিষ্টান ধর্মও। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দে মুসলমানদের নিষ্প্রভ প্রমান করবার জন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং ধর্মতাত্ত্বিকগন ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ভাষ্য রচনা করতে লাগলেন। তাদের রচনায় ইসলামের প্রতি এক প্রকার অসহনশীল মনোভাব প্রকাশ পেতে লাগল।

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের বহু অংশ অধিকার করেছিল। অটোমান তুর্কীদের প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ এবং বিরুদ্ধতার কারণে ইউরোপীয় খ্রিষ্টানগণ ইসলামের প্রতি একটি বিকৃতী মনোভাব লালন করতে লাগলো। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি মুসলমানদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের বিরূপতার তিনটি কারণ সুস্পষ্ট হচ্ছে। একটি হলো সিপাহী বিদ্রোহ, দ্বিতীয়টি হলো ইসলামের প্রতি খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিরূপতা এবং তৃতীয়টি হলো অটোমান শাসকদের প্রতি ইউরোপীয় শাসকদের বিরূপতা।

ইংল্যান্ডে সে সময় একটি বিশ্বাস ছিল যে, মুসলমানদের নেতৃত্বেই সিপাহী বিদ্রোহ রূপ পেয়েছিল এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন রক্ষা পেয়েছে অংশত হিন্দুদের সহায়তায়। এ ধারনার কারণ হলো হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ব্রিটিশরা লক্ষ্য করেছিল। স্যামওয়েল স্মিথ নামক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বলেছিলেন যে, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মুসলমানদের কারণেই ব্রিটিশ বিরোধীতা বিদ্যমান রয়েছে। এই চিন্তা ব্রিটিশদের মনে বহুদিন পর্যন্ত প্রোথিত ছিল তার প্রমান আমরা পাই ১৯১০ সালে স্যার হ্যানরি জনস্টোন –এর মন্তব্যে। এত পরে এসেও জনস্টোন বলছেন যে, সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতের একটি মুসলিম সাম্রাজ্য স্থাপনের শেষ চেষ্টা এবং এই চেষ্টায় মুসলমানরা হিন্দু এবং ইংরেজ উভয়কেই তাদের বিপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করেছিল।

কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি

ইসলামের সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের একটি প্রবল বিরোধ ছিল। খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকগণ ভারতবর্ষে ইসলামকে তাদের প্রচন্ড বিপক্ষ হিসাবে ধরে নিয়েছিল। খ্রিষ্টান ধর্ম ভারতবর্ষে এসেছিল ইউরোপ থেকে এবং খ্রিষ্টধর্মের প্রবক্তাগণ একটি মিথ্যা অহমিকা নিয়ে এদেশের মানুষকে আলো দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। বাইবেলের বানী প্রচারের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা পেয়েছেল তারা মুসলমানদের কাছ থেকে। স্যার আলফ্রেড লায়াল ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে লিখেছিলেন যে, ভারতবর্ষে খ্রিষ্টানদের দায়িত্ব হবে বাইবেলের প্রচারের ক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ ঘোষনা করা। অর্থাত সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এদেশে খ্রিষ্টান ধর্মকে স্থায়ী আসন দেওয়ার চেষ্টা করা।

অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে ব্রিটিশদের চিরকাল রাজনৈতিক ভাবনা ছিল। প্রথমে ব্রিটিশরা কিন্তু রুশ ভীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুরস্ককে সমর্থন জানিয়েছিল। গ্লাডস্টোন যখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর ঘটনা নিয়ে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। পুস্তিকাটির নাম “The Bulgarian Horror and the Question of the East” এই পুস্তিকা প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় দু’শ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায় এবং মূলত এই পুস্তিকা প্রচারের ফলে ব্রিটিশ জনসাধারণের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি বিরূপতা গড়ে ওঠে। এই পুস্তিকাটি এমন এক সময়ে প্রচারিত হয় যখন ভারতবর্ষের মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের বিদ্বেষ সুস্পষ্ট এবং ব্রিটিশ জনসাধারণ তুর্কী সাম্রাজ্যের আশু পতন কামনা করতে লাগলো। তুরস্কের বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিক্ষোভ ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের বিদ্বেষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ কারণে সংশ্লিষ্ট যে, তুরস্কের সুলতান ভারতীয় মুসলমানদের কাছে খলিফা হিসাবে সম্মানিত ছিলেন। তুরস্কের প্রতি বিদ্বেষ ভারতীয় মুসলমানদেরকে ব্রিটিশদের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তোলে। ভারতীয় মুসলমানগণ তুরস্কের প্রতি বিরুদ্ধতা ইসলামের প্রতি প্রচন্ড বিরোধীতা বলে গণ্য করলেন। খলিফা সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্রনায়ক নন বটে; কিন্তু ধর্মনায়ক হিসাবে তিনি স্বীকৃত ছিলেন। সুতরাং খেলাফতের উচ্ছেদের অর্থ হচ্ছে ইসলামের উচ্ছেদের সূত্রপাত। মুসলমানরা তখন এভাবেই চিন্তা করছিল।

সুতরাং ভারতবর্ষে মুসলমানদের একটি নতুন রাজনৈতিক চৈতন্যের সুত্রপাত ঘটল খেলাফতকে কেন্দ্র করে। এ সময় বিশেষভাবে লক্ষ করা যায় যে, অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিক ইসলাম ধর্মকে আক্রমন করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রফেসর মনির উইলিয়াম তাঁর Progress of Indian Religious Thought নামক গ্রন্থে ইসলামকে চিহ্নিত করেছিলেন “ইহুদিবাদের জারজপুত্র” হিসেবে এবং রসুলের জীবনীকার স্যার ইউলিয়াম ম্যুর লিখেছিলেন যে, বিশ্ব সভ্যতা, স্বাধীন চিন্তা এবং সত্যের কঠোরতম শত্রু হচ্ছে মোহাম্মদের তরবারি এবং কোরান। আর একজন তথাকথিত মহাপন্ডিত ম্যালকম ম্যাককোল ইসলামকে একটি বর্বর ধর্ম বলে আখ্যায়িত করেন। তার দৃষ্টিতে ইসলামের বর্বরতার চারটি কারন ছিল। একটি হচ্ছে বহুবিবাহ, আর একটি হচ্ছে দাসপ্রথা, আর একটি হচ্ছে স্বাধীন চিন্তার অস্বীকৃতি এবং চতুর্থ হচ্ছে মুসলমানদের সঙ্গে পৃথিবীর অবশিষ্ট মানবগোষ্ঠীর চিরকালীন ব্যবধান সৃষ্টি।

সর্বভারতের মুসলমানদের জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাঙালির জন্য বেদনাপূর্ণ একটি ঘটনা পূর্বেই ঘটেছিল। সেটা ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে। কোম্পানীর শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবং এ-উপমহাদেশে বিদেশী শাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রবল প্রতিবা সিরাজউদ্দৌলা করছিলেন তার ফলস্বরুপ চক্রান্তের শিকার হয়ে তাঁকে মৃতুবরণ করতে হয়। নবার সিরাজউদ্দৌলার পতনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কুসিদজীবী মহাজন শ্রেণীর হিন্দুদের ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগীতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজদের কুটকৌশল।”

(চলবে)

উৎসঃ কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি

এম আর আখতার মুকুল
এম. আর আখতার মুকুল (জন্ম: ৯ আগস্ট, ১৯৩০ - মৃত্যু: ২৬ জুন, ২০০৪)সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’-এর কথক। জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ আগস্ট বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের অন্তর্গত চিংগাসপুর গ্রামে। পুরো নাম মুস্তাফা রওশন আখতার মুকুল। পিতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক সা’দত আলি আখন্দ, মাতা রাবেয়া খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং এ কারণে তাঁকে একাধিকবার জেল খাটতে হয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ সালে জেল থেকেই স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। জীবিকার জন্য তিনি বীমা কোম্পানি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে সাংবাদিকতার পেশায়। বিভিন্ন সময়ে তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস অফ পাকিস্তান (ইউপিআই)-এর ঢাকা ব্যুরো প্রধান ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গন পরিদর্শন শেষে তাঁর রচিত এবং স্বকণ্ঠে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ চাকরি হারিয়ে অনেক বছর তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। এ সময় জীবিকার তাগিদে তাঁকে এমনকি পোশাক প্রস্ত্ততকারক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে। ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সম্পাদনার দ্বিতীয় পর্যায়ে কিছুদিন কাজ করেছেন।পরে তিনি ঢাকায় সাগর পাবলিশার্স নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

এ সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর রচিত ৬০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পল্লী এক্সপ্রেস (অনুবাদ, ১৯৬০), রূপালী বাতাস (১৯৭২), রূপালী বাতাস সোনালী আকাশ (১৯৭৩), মুজিবের রক্তলাল (১৯৭৬), ভাসানী মুজিবের রাজনীতি (১৯৮৪), পঞ্চাশ দশকে আমরা ও ভাষা আন্দোলন (১৯৮৫), চল্লিশ থেকে একাত্তর (১৯৮৫), আমি বিজয় দেখেছি (১৯৮৫), বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন (১৯৮৬), লন্ডনে ছক্কু মিয়া (১৯৮৬), ওরা চারজন (১৯৮৬), কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি (১৯৮৭), বায়ান্নোর জবানবন্দী (১৯৮৭), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, ১৯৮৭), লেছড়াগঞ্জের লড়াই (১৯৮৭), নকশালদের শেষ সূর্য (১৯৮৯), একাত্তরের বর্ণমালা (১৯৮৯), বিজয় ’৭১ (১৯৯০), আমিই খালেদ মোশাররফ (১৯৯০), মহাপুরুষ (১৯৯১), একুশের দলিল (১৯৯২), দুমুখী লড়াই: আমরাই বাঙালী (১৯৯২), আমাকে কথা বলতে দিন (১৯৯৩), বাংলা নাটকের গোড়ার কথা (১৯৯৪), কে ভারতের দালাল (১৯৯৫), খন্দকার থেকে খালেদা (১৯৯৬), একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা (১৯৯৭), বঙ্গবন্ধু (১৯৯৭), জিন্নাহ থেকে মুজিব (১৯৯৮) এবং ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা (১৯৯৯)। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ২০০৪ সালের ২৬ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। [বাংলা পিডিয়া]

No comments:

Post a Comment