Sunday 16 July 2017

বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসার অসহায় এবং নিঃস্ব মায়েরা এখনও সন্তানের স্পর্শ অনুভব করে ।

srebrenica-massacreস্রেব্রেনিৎসার অসহায় এবং নিঃস্ব মায়েরা এখনও সন্তানের স্পর্শ অনুভব করে ।
বসনিয়া হ্যারৎজেগোভিনার যুদ্ধে ঠিক কত মানুষ মারা গেছে তার সঠিক হিসাব এখনো মেলেনি৷ স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমান পুরুষ এবং অল্প বয়স্ক ছেলে প্রাণ হারিয়েছেন৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই আকারে গণহত্যা সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় সংঘটিত হয়েছে৷ ১৫ বছর এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে৷ কিন্তু যে সব মহিলা হারিয়েছেন স্বামী, ভাই বা সন্তানকে তাদের অবস্থা আজ কেমন ? তারা কিভাবে আছেন ?
সম্প্রতি বসনিয়া যুদ্ধের আরেক নেতা রাদোভান কারাদিচকে হাজির করা হয়েছে ডেন হাগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালতে৷ কিন্তু তিনি আদালতে হাজির হচ্ছেন না৷ তিনি সময় চাইছেন৷ গত সপ্তাহেই তাঁর আদালতে প্রথমবারের মত হাজির হওয়ার কথা ছিল৷ মামলার প্রথম শুনানি৷ কিন্তু রাদোভান কারাদিচ ছিলেন অনুপস্থিত৷ আদালতের বিজ্ঞ কৌঁসুলিরা পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যার জন্য কারাদিচকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে৷ আদালতে তা প্রমাণ করা হবে৷ কিন্তু কারাদিচ কোথায় ? মিলোসোভিচের মত তিনিও কি আইনকে ফাঁকি দিতে পারবেন ? আমরা কি সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি ?
ডেন হাগের আদালতে বিচারপতি ওগোন কোন্ শুরু করেন বিচারকার্য কারাদিচের অনুপস্থিতিতে৷ ২০ মিনিট এভাবেই চলে৷ এরপর আদালত মুলতবি ঘোষণা করা হয়৷ কারাদিচ ঠিকই আদালত থেকে দূরে ছিলেন, কিন্তু খুব কাছেই ছিলেন স্রেব্রেনিৎসার সেসব মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যা- যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, যারা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন৷ তাদের বলা হচ্ছে ‘স্রেব্রেনিৎসার মায়েরা'৷ বসনিয়া হ্যারৎসেগোভিনা থেকে তারা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন৷ তারা সবাই বিচার চান৷ তারা দেখতে চান রাদোভান কারাদিচের শাস্তি হোক৷
ফেরিদা নিসিচ বসনিয়ার নাগরিক৷ তিনি এসেছেন ডেন হাগে৷ আক্ষেপের সঙ্গে তিনি জানান, বিচারকার্য যেভাবে চলছে তা একেবারেই ঠিক নয়৷ কারাদিচকে সময় দেয়া হচ্ছে৷ শাস্তি নয় সে সময় পাচ্ছে৷ গণহত্যার পর বেশ কয়েক বছর সে খুব ভাল ছিল৷ সে সুখে সময় কাটিয়েছে৷
যে সব মহিলা ডেন হাগে উপস্থিত ছিলেন ১৯৯৫ সালের স্রেব্রেনিৎসার গণহত্যায় তারা তাদের বাবা, স্বামী, সন্তান এবং ভাইকে হারিয়েছেন৷ শুরুতেই বলা হয়েছে স্রেব্রেনিৎসায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমান পুরুষ এলং ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে৷ সবাই প্রাণ হারিয়েছেন সার্বিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে৷ কারাদিচ সে দোষে দোষী৷ রাটকো ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার নীল নক্সা আঁকেন৷ কারাদিচ সেই অনুযায়ী কাজ করেন৷ রাটকো ম্লাদিচ এখনো পলাতক৷
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্ব সেনারা প্রায় প্রিতিদিনই বসনিয়ার মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম এবং শহরগুলোতে হানা দিত৷ বসনিয়ার মহিলা এবং শিশুদের তারা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়েছে৷ সার্বরা কখনোই স্রেব্রেনিৎসা ছেড়ে চলে যায়নি৷ তারা সবসময়ই আশে পাশে থাকতো৷ ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ব সেনারা গণহত্যা চালায়৷ প্রায় ৩০ হাজার বসনীয় নারী-পুরুষ-শিশুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়৷ তাদের দোষ ছিল একটাই - তারা ধর্মে মুসলমান৷ এই ৩০ হাজারের মধ্যে ৮ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়৷
জার্মান মহিলা আইনজীবি হিলডেগ্রাড উরটস রেট্সলাফ৷ ৫৮ বছর বয়স্কা উরটস-রেট্সলাফ ১৯৯৫ সাল থেকে ডেন হাগে আইনজীবি হিসেবে কাজ করছেন৷ মিলোসোভিচের বিপক্ষে তিনি লড়েছিলেন৷ কিন্তু মিলোসোভিচের পরিণতি কি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি৷ ১৯৯৬ সালে তিনি বসনিয়ার গোরাসেতে যান প্রমাণাদি যোগাড় করার জন্য৷ ধ্বংসস্তুপের মধ্যে, নদির মধ্যে, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি মাসের পর মাস সেখানে প্রমাণ খুঁজেছেন৷ বেশ কিছুদিন গোরাসদেতে তাঁকে থাকতেও হয়েছে৷ এরপর আরো কিছুদিন থাকতে হয়েছিল শানস্কিতে৷ তিনি বললেন, তখন আমাদের নানা রকম হোটেলে থাকতে হয়েছিল৷ সেখানে সবাই হোটেল বলে৷ কোন হোটেলেরই কোন নাম নেই৷ সে হোটেলগুলোতে কোন হিটিং সিস্টেম নেই৷ দেয়ালগুলো নষ্ট হয়ে গেছে৷ গোরাসেদের চেয়ে ভয়ানক অবস্থা ছিল৷ শীতকালে আমরা সারাটা সময়ই ঠান্ডায় জমে ছিলাম৷
বসনিয়ায় যুদ্ধের সময় সার্ব সেনারা মেয়েদের গণহারে ধর্ষণ করেছিল৷ ধর্ষণের পর হত্যা৷ তিনজন উচ্চপদস্থ সেনার সে জন্য সাজা হয়েছিল৷ সবাই শাস্তি হিসেবে পেয়েছিলেন ২৮ বছরের কারাদন্ড৷ বসনিয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যে ধর্ষণের জন্য এদের আটক করা হয়েছে৷ যুদ্ধাপরাধে তাদের সাজা হয়েছে৷ মানবাধিকার লংঘনের জন্য আজ তারা সাজা ভোগ করছে৷ এই প্রথম বারের মত এধরনের ঘটনা ঘটছে৷
রাদোভান কারাদিচের গ্রেপ্তার, তাঁর শাস্তি এবং রাটকো ম্লাদিচের পালিয়ে বেড়ানো প্রসঙ্গে উরটস রেট্সলাফ জানান, আমি অনেক সময় ভেবেছি, নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি আমি এখানে কি করছি ? কার কি হল তাতে কিছুই এসে যায় না৷ এদের সবার বিরুদ্ধে মামাল দায়ের করা হয়েছে৷ সবাই তাদের খুঁজছে এবং তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে৷ মাঝে মাঝে মনে হয়, নাহ্, অনেক হয়েছে এবার সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেই৷ এখানে শুধু শুধু সময় নষ্ট৷ আমার স্বামী প্রায়ই আমাকে বলেন, এতগুলো আসামীর মধ্যে থেকে যখন অন্তত একজন ধরা পড়ে এবং তাঁকে শাস্তি দেয়া হয় তখন তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি সাফল্য৷ এটিই বিচার!
প্রতিবেদক: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: আব্দুস সাত্তার
http://m.dw.com/bn/স্রেব্রেনিৎসার-অসহায়-এবং-নিঃস্ব-মায়েরা/a-4884966

No comments:

Post a Comment