ভারত ভাগ না হলেও বাংলাকে ভাগ করতেই হবে, এটাই ছিল হিন্দুদের দাবী।
যে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল সর্বাত্মকভাবে-১৯৪৭ সালে তারাই হয়ে দাঁড়ালো বঙ্গভঙ্গের প্রধান সমর্থক আর মুসলমান সম্প্রদায় করলো বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা। কারণ একটাই, ১৯০৫ সালে বাংলার রাজনীতিতে, শিক্ষায়, পেশায় এগিয়ে থাকা বর্ণ হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল প্রশ্নাতীত। অখণ্ড বাংলায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন থাকার প্রতিশ্রুতিও ছিল নিশ্চিত। বঙ্গভঙ্গ হলে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির এই ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ ৪২ বছরের ব্যবধানে বাংলার রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য স্থাপিত হয়ে গেছে। বাংলা অবিভক্ত থাকলে সেখানে মুসলমানদের প্রাধান্যই বজায় থাকবে। হিন্দু প্রাধান্যের কোনোরকম সম্ভাবনাই নেই। অথচ বাংলাকে বিভক্ত করলে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কেবলমাত্র এ কারণেই হিন্দু নেতারা বঙ্গভঙ্গের দৃঢ় সমর্থক হয়ে পড়েন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে অখণ্ড বাংলা যদি ভারতের মধ্যেও থাকে, তাহলে সেখানেও মুসলমানদেরই প্রাধান্য থাকবে। মন্ত্রিসভার প্রধান একজন মুসলমানই হবে। এ ব্যাপারটা হিন্দু নেতাদের পছন্দ হয় নি।
১৯৪৭ সালের ২২শে মে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ প্যাটেলের কাছে এক চিঠিতে লিখলেন ''ক্যাবিনেট মিশনে* যেরকম বলা হয়েছে সেরকম একটা শিথিল কেন্দ্রীয় সরকার হলেও বাংলায় আমাদের নিরাপত্তা থাকবে না। পাকিস্তান হোক আর নাই হোক বর্তমান বাংলাকে ভেঙ্গে আমরা দুটি প্রদেশ গড়ার দাবি করছি।” আগের মাসে (৪ এপ্রিল ১৯৪৭) প্রাদেশিক হিন্দু কনফারেন্সের সভাপতির ভাষণে এম. সি. চ্যাটার্জি বললেন, “বাংলার হিন্দুদের একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে অবশ্যই একটা পৃথক প্রদেশ গড়তে হবে। এটা বিভাজন নয়-হিন্দুদের জীবন-মরণের প্রশ্ন”।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য বি. সি. সিনহা ১৯৪৭ সালের ৫ জুন প্যাটেলকে এক পত্রে লেখেন যে—“পুরো বাংলাও যদি ভারতে যোগ দেয় তাহলেও কম বেশি বর্তমানে যে অবস্থা আছে সেই অবস্থাই বজায় থাকবে এবং বাংলায় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করার ধারণা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে। নিজেদের হাতে প্রশাসনের ভার না পেলে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অতএব ভারতে থাকতে চাইলেও বাংলাকে অখণ্ড রাখা যাবে না।”
সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে দেশটাকে মুসলমানরাই ভাগ করেছে। আর সেই সাথে সহযোগিতা করেছে তফসিলি হিন্দুরা। কোনো মুসলমান নেতাই বাংলাকে ভাগ করতে চাননি। বাংলাকে ভাগ করার দাবি হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসের হিন্দু নেতাদের। তাঁরাও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রাধান্যের বাইরে বাংলার একটা অংশ নিয়ে সেখানে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গভঙ্গের দাবি করেছেন এবং তাদের দাবিমতই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে দু'ভাগ করা হয়েছে। তাই বাংলাকে ভাগ করেছে বর্ণ হিন্দু নেতৃত্ব-মুসলমানরা নয়। আর তফসিলি হিন্দুরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই সমর্থন করেছে মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির।
(কার্তিক ঠাকুর, তফসিলী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ইতিহাস, র্যামন পাবলিশার্স, প্রথম প্রকাশ, ২০০৮, ঢাকা, পৃ. ৬৮-৭২)
নোটঃ
*১৯৪৬ সালের মে মাসের ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব ছিল ভারতকে অখণ্ড রাখার সর্বশেষ প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবে কনফেডারেশানের ভিত্তিতে উত্তর ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলো নিয়ে একটি শায়ত্বশাসীত অঞ্চল, বাংলা ও আসাম নিয়ে শায়ত্বশাসীত অঞ্চল এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে আরেকটি শায়ত্বশাসীত অঞ্চলের প্রস্তাব ছিল। দিল্লি কেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মুদ্রানীতি, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নীতির দায়িত্ব থাকবে কেবল।আঞ্চলিকভাবে থাকবে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যান্য ক্ষমতা। মুসলিম লীগ সেটা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে। সূত্র : মূলধারা বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment