Saturday 15 July 2017

ভারতের হিন্দু ব্রাহ্মণদের বৈষম্য মূলক আচরণের কারণে পিছিয়ে পড়েছে মুসলমানরা।


ভারতের হিন্দু ব্রাহ্মণদের বৈষম্য মূলক আচরণের কারণে পিছিয়ে পড়েছে মুসলমানরা।

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভালোমন্দ অনেকটাই নির্ভর করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতার ওপর। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতা উদার ও মানবিক গুণসম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত থাকে। আমাদের উপমহাদেশের জনসাধারণের দুর্ভাগ্য এই যে, এখানে সেই গুণটি মারাত্মকভাবে অনুপস্থিত।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের তৈরি প্রতীচী ইনস্টিটিউট ¯œ্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ডের সহযোগিতায় প্রত্যক্ষ সমীক্ষার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের জীবনমানের সম্প্রতি যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন, তাতে ওই অনুপস্থিত গুণটি খুবই দৃষ্টিকটুভাবে ধরা পড়েছে। ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেনÑ পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র এবং বঞ্চিত মানুষদের সিংহভাগই মুসলিম। জীবনের মানের নিরিখে তারা অসামঞ্জস্যভাবে দরিদ্র এবং বঞ্চিততর।

রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেনÑ আমাদের সমাজজীবনে বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক অপরিচয় আছে। তার থেকে আসে অজ্ঞানতা। সেখান থেকে জন্মায় অবিশ্বাস। তার থেকে আসে অসহিষ্ণুতা। সেখান থেকে তৈরি হয় অশান্তি, যা কখনও কখনও দাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ই এ সমস্যা ঠেকানোর পথ এবং সেটা সরকারের নয়, সমাজের দায়িত্ব বলে শঙ্খ বাবু মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দৈন্যদশাকে এক কথায় ফুটিয়ে তুলেছেন সর্বভারতীয় ইংরেজি নিবন্ধকার ড. এস আউসাফ সাইদ ভাসফি। তিনি লিখেছেন, ‘মুসলিমদের অবস্থা দলিতদের থেকেও সঙ্গিন। একমাত্র সেক্টর যেখানে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ব্যাপকতর তা হলো জেল।’

সেখানকার মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য কয়েক বছর আগে ভারত সরকার এক বিশেষ কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। তার নেতৃত্বে এ কমিটি ভারতজুড়ে মুসলিমদের ওপর বিশাল সমীক্ষা চালায়। প্রায় দেড় বছর ধরে সমীক্ষা করার পর কমিটি প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার একটি বিশাল রিপোর্ট তৈরি করে। এখানে তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমরা কেবল শিক্ষা ও চাকরিÑ এ দুইটি বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা নেব।

সাচার রিপোর্টে শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবস্থা করুণ ও শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবেÑ ‘মুসলিমরা দুই ধরনের অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। একদিকে শিক্ষার স্তর নিম্ন, অন্যদিকে শিক্ষার গুণগত মানও নিম্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলিমদের আপেক্ষিক অংশীদারি দীর্ঘকাল ধরে জাতি ব্যবস্থার শিকার তফসিলি জাতির মানুষদের চেয়েও খারাপ।’ পশ্চিমবঙ্গ-বিহারের ১ হাজার মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে কোনো বিদ্যালয়ই নেই। সারা দেশে মুসলিমপ্রধান গ্রামগুলোর এক-তৃতীয়াংশে কোনো বিদ্যালয় নেই। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তো নেই-ই। রিপোর্ট অনুযায়ী, শহর অঞ্চলে মুসলিমদের অন্তত ৬০ শতাংশ স্কুলের দরজায় পা দেয়ার সৌভাগ্যও হয়নি।

আর সোনার হরিণ চাকরির কী হাল! সেটা আগে তেমন খারাপ ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনের সময় চাকরিতে মুসলিমদের অবস্থান ছিল খুব ভালো। তখন চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪ শতাংশ। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর এ কথা বলেছেন সিনিয়র সমাজবাদী মন্ত্রী মুহাম্মাদ আযম খান। তিনি বলেন, “১৯৪৭ সালে যখন দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় তখন দেশের সরকারী চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪%, আজ এটা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশে। এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মসংস্থানে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব দলিতদের থেকেও কম।” (সূত্র : ছঁড়ঃধ ভড়ৎ ধষষ গঁংষরসং : ঝধসধলধিফরং নু অসরঃধ ঠবৎসধ, ঞযব ধংরধহ অমব)

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর থেকে মুসলিমদের সঙ্গে শুধু শোষণ হয়েছে। তাদের অবস্থার একটু উন্নতি হয়নি বরং মহা অবনতি হয়েছে। ১৯৭১ সালের তালুকদার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ীÑ পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারে ২৬৪ জন আইএএস অফিসারের মধ্যে মাত্র ২ জন মুসলিম। গোপাল কৃষ্ণ রিপোর্ট অনুসারেÑ উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যাবিশিষ্ট তিন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারের ক্লাস ওয়ান সেক্টরের অফিসারের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই। সর্বভারতীয় মোট ২ হাজার ২৩২ জন ক্লাস ওয়ান অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩৬ জন মুসলিম।

এর মধ্যে ২২ জনই কেরালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উল্লেখ্য, কেরালাতে অনেক মুসলিম আছে। ভারতের সব থেকে শিক্ষিত, সচ্ছল ও ক্ষমতাশালী মুসলমানের বসবাস কেরালায়।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মুসলিমদের সংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব কেমন। বার বার কমিশন গঠন করা হয়েছে, কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। সুপারিশও করেছে। কিন্তু সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই মুসলিমদের অবস্থার উন্নতিও হয়নি। ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন ৩২ শতাংশ মানুষ। যাদের পরিবারের লোকদের মাথাপিছু খরচ ২৬ টাকার কম তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে বলে ধরা হয়। স্বাধীন হওয়ার পাঁচ যুগ পরেও একটি দেশের ৩২ শতাংশ মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস নিঃসন্দেহে লজ্জাকর। কিন্তু তার থেকেও লজ্জার ব্যাপার হলো সেই দেশের একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের ৪৯.৯ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস। হ্যাঁ, আমি মুসলমানদের কথা বলছি। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ৪৯.৯ শতাংশ মুসলিম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, যা জাতীয় গড়ের থেকে অনেক বেশি। এটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জন্য খুবই লজ্জার। প্রশ্ন উঠে, ভারত কি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ?

দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মুসলিমদের বিপিএলে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি। অথচ সারা দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ দরিদ্রকে সেই সুবিধা দেয়া হয়েছে। ফলে তারা অতিরিক্ত রেশন, কমদামে খাদ্যদ্রব্য, বিনা খরচে বিদ্যুৎও পান না। গ্রামীণ মুসলিমরা ৬০ শতাংশ ভূমিহীন। ভিটেমাটি ছাড়া চাষবাস করার জন্য কোনো জমি নেই। অথচ ১৯৫০ সালের সংবিধান ও সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী, জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হয়েছিল। নির্দিষ্টসংখ্যক সম্পত্তি ছেড়ে, অতিরিক্ত জমি সরকার গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে। তাহলে কি মুসলমানরা এ জমি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল? তাদের কোনো জমি দেয়া হয়নি? কেন আজ ৬০ শতাংশ মুসলিম ভূমিহীন?

অথচ দেখা যাচ্ছে, তফসিলি জাতি বাদ দিলে সবাই সুখেই আছে। দারিদ্র্যের ছোবল থেকে বেঁচে আছে। অথচ মুসলিমরা দারিদ্র্যের দংশনে কাতরালেও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অবাক করা ব্যাপার হলো, দেশের ৪০ শতাংশ মুসলমানপ্রধান গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নেই! ফ্রি চিকিৎসা পাওয়া তো দূরের কথা। বিচার বিভাগ, লোকসভা ও রাজ্যসভাতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম।

তাই প্রশ্ন আসতেই পারেÑ তাজমহলের দেশ, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দেশ ভারতে কেন এ মুসলিমবঞ্চনা? যে দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আর আধ্যাত্মিক দ্যুতিতে আলোকিত বিশ্ব; যে দারুল উলুম দেওবন্দ আর নাদওয়াতুল ওলামার হিরন্ময় শিক্ষার জ্যোতিতে গোটা জাহান মাতোয়ারা, সে দেশের মুসলমানদের কেন এ দৈন্যদশা? মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মকবুল ফিদা হুসেন, এ আর রহমান, আজহার উদ্দিন, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী আর বলিউডের খানরা কি সে দেশের জন্য কোনো কৃতিত্ব নিয়ে আসছেন না? দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতিকে বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করায় অবদান কি কম তাদের? সুতরাং বঞ্চনাটা ভেবেচিন্তে করা হোক। জেনে রাখা উচিত, মুসলমানরা ফেলনা নয়। তাদের বিশ্বাসের ভিতের জোরেই টিকে আছে গোটা বিশ্ব।
http://www.alokitobangladesh.com/todays/news_print/173924/2016/03/15

No comments:

Post a Comment