Saturday 15 July 2017

নৈতিকতাভিত্তিক সমাজ গঠনে ইসলামের ভূমিকা




[নৈতিকতাভিত্তিক সমাজ গঠনে
ইসলামের ভূমিকা
তারিক রামাদান

ইউরোপ-আমেরিকা, তথা পাশ্চাত্যে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান অভিবাসন তাদের সেখানকার সমাজ ও জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছে। কিন্তু অমুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমা জগতে ইসলাম অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির শিকার। ফলে মুসলমানরা বৈষম্য ও দুর্ভোগের সম্মুখীন। বহু মতভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজের দাবিদারদের কাছেও মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা উপেক্ষিত। এই প্রেক্ষাপটে নিম্নের অনূদিত লেখাটি গুরুত্ববহ]

আসুন, আমরা এ বিষয়ে একমত হই : আমরা বহু মতের সমাজে বাস করি। আর বহু মত থাকা অনিবার্য বাস্তবতা। আমরা নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। তবে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পটভূমি রয়েছে। তাই আমরা কমিউনিটির ভেতরে পরিচয় নিয়ে সম্ভাব্য সঙ্ঘাত দ্বারা তাড়িত হতে পারি না। বরং ভাবতে হবে, কিভাবে নানামুখী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ পটভূমিতে অভিন্ন নৈতিক কাঠামো নির্ধারণ করে একে এগিয়ে নিতে পারি? বহু মতের সমাজের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে বৈচিত্র্য, সমঅধিকার, বর্ণবাদ, দুর্নীতি প্রভৃতি। আর আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হলো অর্থনৈতিক সঙ্কট, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অভিবাসন প্রভৃতি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নাগরিকত্বের শক্তিশালী ও কার্যকর নৈতিক ভিত্তি থাকা চাই।
সে লক্ষ্যে পৌঁছার একটি মূলনীতির কথা বলছি। নাগরিকত্বের যে বৈচিত্র্য, তা ফুটে উঠতে হবে। আমাদের এ মর্মে একমত হওয়া আবশ্যক যে, কেউ নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার রাখে না। আমাদের এই উপলব্ধি থাকতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট সব ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্যের অবদান নিয়েই আমাদের অভিন্ন জীবন। কিভাবে জীবনধারায় এসব ঐতিহ্য সন্নিবেশ করা যেতে পারে, আলোচনার মাধ্যমে তা নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মুসলমানদের নতুন উপস্থিতির প্রসঙ্গ আসলে আলোচনা ফলপ্রসূ করা কঠিন বৈকি। কারণ, ইসলামকে মনে করা হয় একটা ‘সমস্যা’। সমৃদ্ধ ও উদ্দীপনাসঞ্চারী বৈচিত্র্য সন্ধানীদের জন্য ইসলাম যে একটি উপহার, তা কিন্তু উপলব্ধি করা হয় না কখনো। আর এটা হলো একটা ভুল। ইসলাম অনেক অবদান রাখতে সক্ষম। বর্তমান যুগে মানুষ রাজনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে যে আচরণ করে চলেছে, তা আইনসম্মত হতে পারে; তবে এতে নীতি-নৈতিকতার অভাব সুস্পষ্ট।
নৈতিকতাভিত্তিক এবং যথাযথ লক্ষ্য অভিসারী শিক্ষাই যে মূল বিষয়, সে সম্পর্কে বহু করণীয় ও বর্জনীয়ের উল্লেখ রয়েছে ইসলামি সাহিত্যে। অন্যদের সাথে যোগাযোগ, শিক্ষণ ও শিক্ষাদানের জন্য ব্যক্তির যে দায়িত্ব, সেটাই ইসলামের বাণীর মূলকথা। মুসলমানরা ‘অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রে ইসলামের বাণীর সাক্ষ্যদাতা’ হবে বলে আশা করা হয়। এর অর্থ হলোÑ চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলা, প্রতারণা ও দুর্নীতির প্রতিরোধ এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা। রাজনীতির ক্ষেত্রে সততা এবং অর্থনীতির অঙ্গনে সুদভিত্তিক আন্দাজ অনুমান প্রত্যাখ্যানÑ এই দু’টি মূলনীতি মুসলিম নাগরিক ও বিজ্ঞজনকে নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবনে উদ্বুদ্ধ করছে যাতে সামষ্টিক জীবনের সাথে আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কের নৈতিকতা এক হয়ে যায়।
(পশ্চিমা দেশগুলোতে) মুসলিমদের উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে উপলব্ধি করা উচিত। এতে গ্রিক-রোমান এবং ইহুদি-খ্রিষ্টান যে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শেকড় রয়েছে ইউরোপের, তার সর্বনাশ ঘটবে না। কিংবা অন্ধ বিশ্বাস ও গোঁড়ামি আমদানি করে না মুসলমানরা। তাদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় না। এসব ধর্মীয় বিধিবিধান আইনের আওতায় ও প্রকাশ্য জনজীবনে পালনযোগ্য। আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার ক্ষেত্রে মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইউরোপের সংস্কৃতি যেসব মূলনীতির ওপর সংস্থাপিত, তার কয়েকটির পুনরুজ্জীবন ঘটতে পারে এর মধ্য দিয়ে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, মুসলমানরা দেশের অন্যান্য নাগরিককে মনে করিয়ে দেয়, নৈতিকতার পুরনো ঐতিহ্য ত্যাগ করে সে জায়গায় আপাত নিরপেক্ষ আইনের শাসন কিংবা মুক্তবাজারি মূল্যবোধ বসিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। আইনের শাসন, সমতা এবং গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার বিষয়ে একমত হওয়াই যে যথেষ্ট নয়, তা নিশ্চিত। সমাজে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সঙ্কট বিদ্যমান, সেগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ আমাদের জনজীবনে নিছক অধিক দক্ষতাই নয়, সেই সাথে অধিক নীতি-নৈতিকতাও প্রয়োজন।
অভিন্ন নৈতিকতার ধরনের ব্যাপারে আমরা মতৈক্যে উপনীত হতে পারি কি না, তা ভিন্ন বিষয়। তবে এসব নিয়ে গভীর আলোচনা প্রয়োজন। এটাই বহুমতের সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের উপায়। জাতীয় পরিচয়, মূল্যবোধ কিংবা ব্রিটিশ হয়ে ওঠা নিয়ে ভাসাভাসা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায় না। আর আমরা যেন বৈচিত্র্যকে কিছুতেই প্রতিবন্ধক মনে না করি। অভিন্ন যে মানবতার অধিকারী আমরা, তার নিরিখেই আমাদের অভিন্ন নাগরিকত্বভিত্তিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

লেখক : ইউরোপের খ্যাতনামা ইসলামি চিন্তাবিদ। তিনি প্রখ্যাত মিসরীয় ইসলামি লেখক ও বুদ্ধিজীবী সাঈদ রামাদানের দৌহিত্র।

No comments:

Post a Comment