বসনিয়া যুদ্ধ: ৯০-এর দশকের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি
বসনিয়ার যুদ্ধ ছিল বিগত নব্বুইয়ের দশকে সংঘটিত একটি বড় ট্র্যাজেডি।
এ যুদ্ধে নিহতদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। মুসলমানদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল সার্বরা। এই যুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণ এমনকি শিশু কন্যাদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বর্বর সার্বরা। কথিত সভ্য ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনও এতবড় গণহত্যা ও জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ঘটেনি।
বসনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৯২ সালের সাতই এপ্রিল ও শেষ হয় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। বসনিয়ার মুসলমানরা ষাট ও সত্তুরের দশকের দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল। এ সময় তাদের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণও ঘটছিল। মার্শাল টিটোর জোটনিরপেক্ষ নীতির সুবাদে বসনিয় মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। ফলে তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু হয়। ১৯৮০ সালে মারা যান টিটো। কিন্তু সার্বরা বসনিয়ার ও কোসোভোর মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বা ইসলামী মনোভাবের বিস্তার- কোনোটাকেই সহ্য করতে পারছিল না।
ইয়োগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পতন ঘটে ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে। এ সময় দেশটিতে রাজনৈতিক বিভেদ জোরদার হয়। ১৯৯১ সালের ২৫শে জুন ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইয়োগোস্লাভিয়ার মুসলমান ও ক্রোয়াটরা সার্বদের কর্তৃত্বকে পছন্দ করতো না। তাই মুসলিম ও ক্রোয়াট সংসদ সদস্যরা স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছিলেন।
কিন্তু এই দাবির বৈধতা অর্জনের পথে বাধা দিতে থাকে ইউরোপিয় ও মার্কিন সরকার। তারা গণভোটের শর্ত জুড়ে দেয়। বসনিয় সার্বরা গণভোট বর্জন করে। বরং তারা বসনিয়ায় সার্বদের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু বসনিয়ার সরকার পূর্ব-সমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী গণভোট দেয়। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নজরদারিতে অনুষ্ঠিত এই গণভোটে দেশটির ৬৪ শতাংশ নাগরিক একটি অবিভক্ত ও স্বাধীন বসনিয়া গড়ার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর দিনই তথা ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল বসনিয়া হার্জেগোভিনা সার্বদের আগ্রাসনের শিকার হয়।
১৯৯২ সালের ত্রিশে মে জাতিসংঘ বসনিয়ার সংঘাতে হস্তক্ষেপের দায়ে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মে মাসের শেষের দিকেই বসনিয়ার যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে বসনিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলিয়া ইজ্জতবেগোভিচ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, সাবেক ইয়োগোস্লাভিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে সার্বরাই লাভবান হচ্ছে। কারণ, এর ফলে বসনিয়া আত্মরক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। জাতিসংঘ বসনিয়ার প্রেসিডেন্টের এই প্রতিবাদকে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। মার্কিন, ফরাসি, রুশ, ব্রিটিশ ও স্পেনিশ সরকারও এক বিবৃতিতে সাবেক ইয়োগোস্লাভিয়ায় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়ে বলেছে যে আন্তর্জাতিক বাহিনী মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে তারা বসনিয়ার ৬ টি অঞ্চলকে (সারায়েভো, বিহাচ, তুজলা, গোরাজদে, জেপা ও সেব্রেনিৎসা) নিরাপদ জোন ঘোষণার প্রস্তাব দেয় যাতে মুসলমানরা সার্ব হামলা থেকে রক্ষা পায়। ১৯৯৩ সালের ২২ শে জানুয়ারি ওয়েন-স্টোলটেনবার্গ প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিবাদমান তিন পক্ষই এই শান্তি প্রস্তাব মেনে নেয়।
১৯৯৩ সালের মে মাসে সার্ব ও ক্রোয়াটরা যুদ্ধ-বিরতি লঙ্ঘন করে বসনিয়ার আরো কিছু অঞ্চল দখল করে। একই বছরের ত্রিশে জুলাই বিবাদমান তিনটি পক্ষ ওয়েন-স্টোলটেনবার্গ প্ল্যান মেনে নেয়। প্ল্যানে বসনিয়া হার্জেগোভিনায় তিনটি জাতির সহাবস্থানে একটি যুক্তরাজ্য গঠনের কথা বলা হয় যার কেন্দ্র শুধু পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। রিপাবলিকস অফ বসনিয়ান ইউনিয়ন নামের এই নতুন রাষ্ট্রের ৫২ শতাংশ ভূমি বসনিয়ার সার্বদেরকে, ১৭ শতাংশ ক্রোয়াটদেরকে এবং ত্রিশ শতাংশ দেয়া হয় মুসলমানদেরকে। রাজধানী সারায়েভোর জন্য থাকে এক শতাংশ ভূমি যা দুই বছর জাতিসংঘের অধীনে থাকবে। তিন পক্ষ ওই শান্তি প্রস্তাব মেনে নেয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে এবং এভাবে তা ব্যর্থ হয়।
এরপর আরো কয়েকটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সার্বরা ১৯৯৫ সালের মে মাসে সারায়েভো ও তুজলায় ব্যাপক গোলা বর্ষণ করে। ফলে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক বসনিয় মুসলমান নিহত হয়। এ ছাড়াও সার্বরা ন্যাটোর হামলা ঠেকাতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ২০০’রও বেশি সেনাকে পণবন্দী করে। এই শান্তিরক্ষীরা পণবন্দী হওয়ায় জাতিসংঘ গোরাজদে অঞ্চলে সার্বদের তীব্র হামলার কোনো জবাব দেয়নি। জাতিসংঘ সার্বদের সঙ্গে অপোস রফা করার কথা অস্বীকার করে আসলেও একই সময়ে শান্তিরক্ষীরা সারায়েভোয় সার্ব-অধিকৃত অঞ্চল থেকে সরে আসলে সার্বরা পণবন্দী শান্তিরক্ষীদের ছেড়ে দেয়।
এ ছাড়াও সার্বদের জঙ্গি বিমানগুলো বসনিয়ার নিষিদ্ধ অঞ্চলের আকাশেও অবাধে টহল দিয়ে বেড়ায়। অবশেষে সার্বরা ১৯৯৫ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের রক্ষীদের কোনো বাধা বা প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সেব্রেনিৎসা ও জেপা শহরটি দখল করে নেয়। জাতিসংঘের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবে অনুযায়ী সেব্রেনিৎসা শহরটি নিরাপদ অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সার্বরা শহরটি দখল করে সেখানকার হাজার হাজার বেসামরিক মুসলমানকে হত্যা করে ও হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে। নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তাদের বেশিরভাগই ছিল বৃদ্ধ ও যুবক। রাতকো মিলাদিচের নেতৃত্বাধীন সার্ব বাহিনী এই গণহত্যা চালায়।
২০০৪ সালে যুদ্ধ-অপরাধ আদালতের রিপোর্টে বলা হয়, ২৫ থেকে ত্রিশ হাজার বসনীয় মুসলিম নারী ও শিশুকে জোর করে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্থানান্তরের সময় তাদের এক বিপুল অংশ ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হয়। নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, এইসব হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ অভিযানের ফসল। বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা কখনও কখনও কোনো একটি অঞ্চলে হামলা চালানোর পর সেখানকার সমস্ত পুরুষকে হত্যা করতো অথবা অপহরণ করতো এবং সেখানকার নারীদের ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করতো।
তারা বহুবার গর্ভবতী নারীর পেট ছুরি দিয়ে কেটে শিশু সন্তান বের করে ওই শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছে মায়ের চোখের সামনে এবং কখনওবা আরো অনেকের চোখের সামনেই। আরো মর্মান্তিক ব্যাপার হল এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস পাশবিকতার বহু ঘটনা ঘটানো হয়েছে হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীদের চোখের সামনেই। এমনকি মাত্র ৫ ছয় মিটার দূরে যখন সার্ব সেনারা এইসব পাশবিকতা চালাতো তখনও হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা কেবল বোবা দর্শকের মতই নীরব থাকতো ও হেঁটে বেড়াতো। জার্মানির একজন সাংবাদিক এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন একজন মার্কিন কমান্ডার।
সাবেক মার্কিন সেনা কমান্ডার জন শিইহান মার্কিন সিনেটে জানিয়েছেন, হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা নৈতিক অধঃপতনের কারণেই নিস্ক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।ফলে ১৯৯৫ সালে সেব্রেনিৎসায় হামলা চালাতে সাহসী হয় সার্বরা। ন্যাটোর সাবেক এই সেনা কমান্ডার আরো বলেছেন, হল্যান্ডের সেনারা পিছু হটার কারণেই সার্বরা সেব্রেনিৎসায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমানকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
মানবতার বিরুদ্ধে এইসব ভয়াবহ অপরাধের দায় কেবল মিলোশেভিচ ও কারাদিচের মত সার্ব নেতার ঘাড়ে চাপানো হলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যসহ নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় জাতিসংঘের দায়িত্বহীন ভূমিকা ও ন্যাটো জোটের আওতায় পশ্চিমা সরকারগুলোর অন্যায্য ভূমিকার কারণেই এই মানবীয় বিপর্যয় ঘটেছিল পশ্চিমা সরকারগুলোর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় বসনিয়ার মজলুম মুসলমানদের সহায়তার নামে সেখানে সেনা পাঠানো সত্ত্বেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি। বরং তাদের জন্যই নিহত হয়েছে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ।
মার্কিন সরকারসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলেও এখনও একই ধরনের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও ফিলিস্তিনের ঘটনাপ্রবাহই এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য। আসলে এইসব মুসলিম দেশকে টুকরো টুকরো বা আরো ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই পাশ্চাত্য এ ধরণের প্রতারণা চালাচ্ছে। মুসলিম জাতিগুলোর ওপর গণহত্যা বা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানও পশ্চিমা শক্তিগুলোর এ জাতীয় পদক্ষেপের অন্যতম লক্ষ্য। #
রেডিও তেহরান/এএইচ/এআর/২৮
http://bangla.irib.ir/surya/item/71061-বসনিয়া-যুদ্ধ-৯০-এর-দশকের-সবচেয়ে-বড়-ট্র্যাজেডি
বসনিয়ার যুদ্ধ ছিল বিগত নব্বুইয়ের দশকে সংঘটিত একটি বড় ট্র্যাজেডি।
এ যুদ্ধে নিহতদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। মুসলমানদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল সার্বরা। এই যুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণ এমনকি শিশু কন্যাদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বর্বর সার্বরা। কথিত সভ্য ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনও এতবড় গণহত্যা ও জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ঘটেনি।
বসনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৯২ সালের সাতই এপ্রিল ও শেষ হয় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। বসনিয়ার মুসলমানরা ষাট ও সত্তুরের দশকের দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল। এ সময় তাদের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণও ঘটছিল। মার্শাল টিটোর জোটনিরপেক্ষ নীতির সুবাদে বসনিয় মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। ফলে তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু হয়। ১৯৮০ সালে মারা যান টিটো। কিন্তু সার্বরা বসনিয়ার ও কোসোভোর মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বা ইসলামী মনোভাবের বিস্তার- কোনোটাকেই সহ্য করতে পারছিল না।
ইয়োগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পতন ঘটে ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে। এ সময় দেশটিতে রাজনৈতিক বিভেদ জোরদার হয়। ১৯৯১ সালের ২৫শে জুন ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইয়োগোস্লাভিয়ার মুসলমান ও ক্রোয়াটরা সার্বদের কর্তৃত্বকে পছন্দ করতো না। তাই মুসলিম ও ক্রোয়াট সংসদ সদস্যরা স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছিলেন।
কিন্তু এই দাবির বৈধতা অর্জনের পথে বাধা দিতে থাকে ইউরোপিয় ও মার্কিন সরকার। তারা গণভোটের শর্ত জুড়ে দেয়। বসনিয় সার্বরা গণভোট বর্জন করে। বরং তারা বসনিয়ায় সার্বদের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু বসনিয়ার সরকার পূর্ব-সমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী গণভোট দেয়। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নজরদারিতে অনুষ্ঠিত এই গণভোটে দেশটির ৬৪ শতাংশ নাগরিক একটি অবিভক্ত ও স্বাধীন বসনিয়া গড়ার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর দিনই তথা ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল বসনিয়া হার্জেগোভিনা সার্বদের আগ্রাসনের শিকার হয়।
১৯৯২ সালের ত্রিশে মে জাতিসংঘ বসনিয়ার সংঘাতে হস্তক্ষেপের দায়ে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মে মাসের শেষের দিকেই বসনিয়ার যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে বসনিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলিয়া ইজ্জতবেগোভিচ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, সাবেক ইয়োগোস্লাভিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে সার্বরাই লাভবান হচ্ছে। কারণ, এর ফলে বসনিয়া আত্মরক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। জাতিসংঘ বসনিয়ার প্রেসিডেন্টের এই প্রতিবাদকে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। মার্কিন, ফরাসি, রুশ, ব্রিটিশ ও স্পেনিশ সরকারও এক বিবৃতিতে সাবেক ইয়োগোস্লাভিয়ায় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়ে বলেছে যে আন্তর্জাতিক বাহিনী মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে তারা বসনিয়ার ৬ টি অঞ্চলকে (সারায়েভো, বিহাচ, তুজলা, গোরাজদে, জেপা ও সেব্রেনিৎসা) নিরাপদ জোন ঘোষণার প্রস্তাব দেয় যাতে মুসলমানরা সার্ব হামলা থেকে রক্ষা পায়। ১৯৯৩ সালের ২২ শে জানুয়ারি ওয়েন-স্টোলটেনবার্গ প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিবাদমান তিন পক্ষই এই শান্তি প্রস্তাব মেনে নেয়।
১৯৯৩ সালের মে মাসে সার্ব ও ক্রোয়াটরা যুদ্ধ-বিরতি লঙ্ঘন করে বসনিয়ার আরো কিছু অঞ্চল দখল করে। একই বছরের ত্রিশে জুলাই বিবাদমান তিনটি পক্ষ ওয়েন-স্টোলটেনবার্গ প্ল্যান মেনে নেয়। প্ল্যানে বসনিয়া হার্জেগোভিনায় তিনটি জাতির সহাবস্থানে একটি যুক্তরাজ্য গঠনের কথা বলা হয় যার কেন্দ্র শুধু পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। রিপাবলিকস অফ বসনিয়ান ইউনিয়ন নামের এই নতুন রাষ্ট্রের ৫২ শতাংশ ভূমি বসনিয়ার সার্বদেরকে, ১৭ শতাংশ ক্রোয়াটদেরকে এবং ত্রিশ শতাংশ দেয়া হয় মুসলমানদেরকে। রাজধানী সারায়েভোর জন্য থাকে এক শতাংশ ভূমি যা দুই বছর জাতিসংঘের অধীনে থাকবে। তিন পক্ষ ওই শান্তি প্রস্তাব মেনে নেয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে এবং এভাবে তা ব্যর্থ হয়।
এরপর আরো কয়েকটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সার্বরা ১৯৯৫ সালের মে মাসে সারায়েভো ও তুজলায় ব্যাপক গোলা বর্ষণ করে। ফলে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক বসনিয় মুসলমান নিহত হয়। এ ছাড়াও সার্বরা ন্যাটোর হামলা ঠেকাতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ২০০’রও বেশি সেনাকে পণবন্দী করে। এই শান্তিরক্ষীরা পণবন্দী হওয়ায় জাতিসংঘ গোরাজদে অঞ্চলে সার্বদের তীব্র হামলার কোনো জবাব দেয়নি। জাতিসংঘ সার্বদের সঙ্গে অপোস রফা করার কথা অস্বীকার করে আসলেও একই সময়ে শান্তিরক্ষীরা সারায়েভোয় সার্ব-অধিকৃত অঞ্চল থেকে সরে আসলে সার্বরা পণবন্দী শান্তিরক্ষীদের ছেড়ে দেয়।
এ ছাড়াও সার্বদের জঙ্গি বিমানগুলো বসনিয়ার নিষিদ্ধ অঞ্চলের আকাশেও অবাধে টহল দিয়ে বেড়ায়। অবশেষে সার্বরা ১৯৯৫ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের রক্ষীদের কোনো বাধা বা প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সেব্রেনিৎসা ও জেপা শহরটি দখল করে নেয়। জাতিসংঘের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবে অনুযায়ী সেব্রেনিৎসা শহরটি নিরাপদ অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সার্বরা শহরটি দখল করে সেখানকার হাজার হাজার বেসামরিক মুসলমানকে হত্যা করে ও হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে। নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তাদের বেশিরভাগই ছিল বৃদ্ধ ও যুবক। রাতকো মিলাদিচের নেতৃত্বাধীন সার্ব বাহিনী এই গণহত্যা চালায়।
২০০৪ সালে যুদ্ধ-অপরাধ আদালতের রিপোর্টে বলা হয়, ২৫ থেকে ত্রিশ হাজার বসনীয় মুসলিম নারী ও শিশুকে জোর করে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্থানান্তরের সময় তাদের এক বিপুল অংশ ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হয়। নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, এইসব হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ অভিযানের ফসল। বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা কখনও কখনও কোনো একটি অঞ্চলে হামলা চালানোর পর সেখানকার সমস্ত পুরুষকে হত্যা করতো অথবা অপহরণ করতো এবং সেখানকার নারীদের ধর্ষণের পর তাদের হত্যা করতো।
তারা বহুবার গর্ভবতী নারীর পেট ছুরি দিয়ে কেটে শিশু সন্তান বের করে ওই শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছে মায়ের চোখের সামনে এবং কখনওবা আরো অনেকের চোখের সামনেই। আরো মর্মান্তিক ব্যাপার হল এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস পাশবিকতার বহু ঘটনা ঘটানো হয়েছে হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীদের চোখের সামনেই। এমনকি মাত্র ৫ ছয় মিটার দূরে যখন সার্ব সেনারা এইসব পাশবিকতা চালাতো তখনও হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা কেবল বোবা দর্শকের মতই নীরব থাকতো ও হেঁটে বেড়াতো। জার্মানির একজন সাংবাদিক এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন একজন মার্কিন কমান্ডার।
সাবেক মার্কিন সেনা কমান্ডার জন শিইহান মার্কিন সিনেটে জানিয়েছেন, হল্যান্ডের শান্তিরক্ষীরা নৈতিক অধঃপতনের কারণেই নিস্ক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।ফলে ১৯৯৫ সালে সেব্রেনিৎসায় হামলা চালাতে সাহসী হয় সার্বরা। ন্যাটোর সাবেক এই সেনা কমান্ডার আরো বলেছেন, হল্যান্ডের সেনারা পিছু হটার কারণেই সার্বরা সেব্রেনিৎসায় প্রায় ৮ হাজার মুসলমানকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
মানবতার বিরুদ্ধে এইসব ভয়াবহ অপরাধের দায় কেবল মিলোশেভিচ ও কারাদিচের মত সার্ব নেতার ঘাড়ে চাপানো হলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যসহ নানা সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় জাতিসংঘের দায়িত্বহীন ভূমিকা ও ন্যাটো জোটের আওতায় পশ্চিমা সরকারগুলোর অন্যায্য ভূমিকার কারণেই এই মানবীয় বিপর্যয় ঘটেছিল পশ্চিমা সরকারগুলোর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় বসনিয়ার মজলুম মুসলমানদের সহায়তার নামে সেখানে সেনা পাঠানো সত্ত্বেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি। বরং তাদের জন্যই নিহত হয়েছে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ।
মার্কিন সরকারসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলেও এখনও একই ধরনের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও ফিলিস্তিনের ঘটনাপ্রবাহই এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য। আসলে এইসব মুসলিম দেশকে টুকরো টুকরো বা আরো ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই পাশ্চাত্য এ ধরণের প্রতারণা চালাচ্ছে। মুসলিম জাতিগুলোর ওপর গণহত্যা বা জাতিগত শুদ্ধি অভিযানও পশ্চিমা শক্তিগুলোর এ জাতীয় পদক্ষেপের অন্যতম লক্ষ্য। #
রেডিও তেহরান/এএইচ/এআর/২৮
http://bangla.irib.ir/surya/item/71061-বসনিয়া-যুদ্ধ-৯০-এর-দশকের-সবচেয়ে-বড়-ট্র্যাজেডি
No comments:
Post a Comment