কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ
কেমন আছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ? ২০১১ সালের জনগণনার ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের তথ্য এবং অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ ও গাইডেন্স গিল্ডের ‘লিভিং রিয়ালিটি অব মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ রিপোর্টের ভিত্তিতে তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব। গোটা ভারতে আর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেমন আছেন।
২০০১ সালে রাজ্যে ২৫.২% মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের ছিলেন যা ২০১১ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭.০১%। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ২০১১ সালে শহরে বসবাস করতেন ২২.৩৪%, এবং গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করতেন ৭৭.৬৬%। কিন্তু সর্বভারতীয় গড়ে মুসলমানদের ৩৯.৯১% শহরে এবং ৬০.০৯% গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করেন। অর্থাৎ, ভারতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় অনেক বেশি গ্রামীণ, অতএব গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত।
অন্য দিকে, শূন্য থেকে ছয় বছরের শিশুদের মধ্যে হাজার পুরুষ প্রতি রাজ্যের মুসলমান সমাজে ৯৬১ জন মহিলা রয়েছেন, যেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৯৫৩। নারী শিশুদের অনুপাত মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তাই আগামী দিনে এই সমাজের উন্নয়নের জন্য মুসলমান নারীদের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
শিক্ষা
২০১১ সালে রাজ্যে মুসলমানদের সাক্ষরতার হার ছিল ৬৮.৮%, এবং হিন্দুদের মধ্যে এই হার ছিল ৭৯.১%। অর্থাৎ, শিক্ষাগত দিক থেকে মুসলমানরা রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছেন। জেলাভিত্তিক তথ্যের দিকে তাকালেও দেখা যাবে যে একমাত্র দক্ষিণ দিনাজপুর বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত জেলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার হিন্দুদের তুলনায় কম।
আবার, ২০০১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, ১০ বছরে রাজ্যে মুসলমানদের সাক্ষরতার হার বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ, যা হিন্দুদের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৬.৭ শতাংশ। সাক্ষরতার হারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ গোটা দেশের গড়ের তুলনায় সামান্য হলেও এগিয়ে। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালের তুলনায় দেশের ক্ষেত্রে যেখানে মুসলমানদের সাক্ষরতার হার বেড়েছে ৯.৪ শতাংশ বিন্দু, পশ্চিমবঙ্গে তা বেড়েছে ১১.৩ শতাংশ বিন্দু।
উচ্চশিক্ষার দিকে তাকালে দেখব যে রাজ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মাত্র ২.৭% মানুষ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা পেয়েছেন, হিন্দুদের মধ্যে সেই হার ১০.৭%। আরো চিন্তাজনক হল, সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে— গোটা দেশে ৪.৬% মুসলমান মানুষ স্নাতক স্তরের শিক্ষা পার করেছেন (সূত্র: কর্মসংস্থান সংক্রান্ত ভারতের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্ট, ২০১১-১২)।
স্ন্যাপের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, যে সমস্ত ব্লকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৫০% বা তার বেশি, সেই ব্লকে প্রতি ১০,০০০ মানুষে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৭.৭টি। যে ব্লকে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৫% বা তার কম, সে সব ব্লকে এই সংখ্যা ১১.৩।
মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রেও মুসলমান-প্রধান ব্লকে এদের সংখ্যা গড়ের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ, মুসলমান প্রধান এলাকায় সরকার পর্যাপ্ত শিক্ষার পরিকাঠামো গড়তেই ব্যর্থ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা যে শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে রয়েছেন, এটা তার একটা বড় কারণ।
কর্মসংস্থান
জনসংখ্যার অনুপাতে রাজ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ৩৪.৫% মানুষ কর্মরত, যেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩৯.৩%। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে এই অনুপাত মুসলমানদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় কম। মুসলমানদের নারীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত মাত্র ১৪%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে যা ১৯%, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত হিন্দুদের ৫৮.৪% এবং মুসলমানদের ৫৪.১%। অর্থাৎ, জনসংখ্যার অনুপাতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান সম্প্রদায়ের কম সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
যারা কর্মরত, তারা কোন পেশায় নিযুক্ত আছেন? রাজ্যে কর্মরত মুসলমান মানুষের মধ্যে কৃষকের অনুপাত হিন্দুদের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের কর্মরত মানুষের মধ্যে ক্ষেতমজুরদের অনুপাত যেখানে ৩১.৩%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা ২৮.২%। মুসলমান সম্প্রদায়ের ১২.৬% মানুষ যেখানে গৃহশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, হিন্দুদের ক্ষেত্রে মাত্র ৬.৫% মানুষ এই কাজে নিযুক্ত আছেন। শুধু তাই নয়, সারণি থেকে এ কথাও স্পষ্ট যে স্বনিযুক্ত ও ঠিকা শ্রমিকের অনুপাত মুসলমান মানুষের ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় অনেকটাই বেশি, এবং নিয়মিত বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিকের অনুপাত বেশ কম। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা মূলত কায়িক শ্রম ও ঠিকা কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে থাকেন। স্ন্যাপের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, গ্রামীণ বাংলায় ৮০% মুসলমান গৃহস্থ্যের পারিবারিক আয় মাসিক ৫০০০ টাকার কম, শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা প্রায় ৬৫%। অর্থাৎ রাজ্যের মুসলমানদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন।
রাজ্যের মুসলমানদের মাত্র ৩.৩% মানুষ সরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেন, যেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১২.৮%। সরকারি কাজে মুসলমানদের উপস্থিতি সর্বভারতীয় গড়ের তুলনাতেও বেশ খারাপ। সরকারি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের এই করুণ ছবি এক দিকে যেমন শিক্ষাগত দিক থেকে মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ, তেমনই সরকারের ঔদাসীন্যের দিকেও আঙুল তোলা প্রয়োজন। সাচার কমিটি নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে অনেক বিতর্ক হওয়ার পরেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত, তথ্যের অধিকার আইনে লব্ধ, তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে কলকাতা পুলিশে ৯.৪৩%, কলকাতা পুরসভায় ৪.৭৯% মুসলমান কর্মী রয়েছেন। ২০০৭ সালে এই সংখ্যাগুলি ছিল যথাক্রমে ৯.১৩% এবং ৪.৪৭%। অর্থাৎ, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক, বিগত ৮ বছরে প্রায় কোনও পরিবর্তন হয়নি।
জন্মহার
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গে জন্মহার সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় কম। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজে জন্মের হার হিন্দুদের তুলনায় বেশি। কিন্তু, শুধু এ টুকু বললে অর্ধসত্য বলা হবে। ২০০১’র তুলনায় রাজ্যে মুসলমান সমাজে জন্মহার দ্রুত গতিতে কমেছে। ২০০১ সালে এই হার ছিল ৪.১। অর্থাৎ, প্রচলিত ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে গড়ে প্রতি মুসলমান নারীর সন্তান প্রসব কমছে।
মুসলমান সমাজে দারিদ্র হিন্দুদের তুলনায় বেশি, শিক্ষার বিস্তার কম। জনসংখ্যা তত্ত্বের মতে, আর্থিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে উন্নত হলে সমাজে সন্তান ধারণের হার কমে। কিন্তু মুসলমান সমাজে সেই ধরনের কোনও ব্যাপক উন্নয়ন না হলেও, এই হার দ্রুত কমছে। আবার পশ্চিমবঙ্গের মোট জন্মহার বিগত কয়েক বছরে যে ভাবে কমেছে তা ভারতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই প্রচলিত জনসংখ্যা তত্ত্বের বাইরে গিয়ে গবেষণা করে দেখা দরকার যে কঠিন আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য দম্পতিরা সন্তান ধারণের হার কমাচ্ছেন কি না?
২০১১ সালের জনগণনার প্রকাশিত হিসেব এবং স্নাপ সমীক্ষা অনুযায়ী রাজ্যের মুসলমান সমাজ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। সেই পিছিয়ে থাকা নিয়ে যত তর্ক হয়, তার অধিকাংশই খণ্ডিত, যেন তা রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের আলোচনা থেকে বিচ্ছিন্ন। একটা কথা মনে রাখলে মুসলমানদের উন্নয়নসংক্রান্ত আলোচনাটিকে রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে দেখতে সুিবধা হবে। রাজ্যে জনসংখ্যার ৬৩%-র বয়স এখন ৩৫ বছরের কম। হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৫৯.৭%, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৭১%। অর্থাৎ, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান সমাজ বর্তমানে তরুণতর। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তরুণদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সার্বিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন করতে হলে তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে যেহেতু এই তরুণেরা জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ, মুসলিম যুবসমাজ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি করলেন, তা রাজ্যের উন্নয়নে বড় প্রভাব ফেলবে।
তাই মুসলমান সমাজের উন্নয়নের কথা বললে যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জিগির তোলেন, তারা পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক উন্নয়নেরই বিরোধিতা করছেন। যে রাজনীতিকরা সত্যিই মুসলমান সমাজ তথা রাজ্যের উন্নয়ন চান, তারা সস্তা রাজনীতিতে আটকে থাকলে চলবে না। কোন অঙ্কে ভোটে জেতা যাবে, সেই হিসেব ছেড়ে তারা মুসলিম যুবসমাজের শিক্ষার উন্নতির দিকে নজর ফেরান। তাঁদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবুন। মুসলমান সমাজকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।
No comments:
Post a Comment