Sunday 16 July 2017

বসনিয়া মুসলিম গণহত্যার যুদ্ধের দুই যুগ।

srebrenica-massacre
বসনিয়া মুসলিম গণহত্যার যুদ্ধের দুই যুগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে বসনিয়ার যুদ্ধে। এই যুদ্ধের প্রধান শিকার হয় মূলত বসনিয়ার মুসলমানরা। সেই গণহত্যার ২৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল ৭ এপ্রিল।
বসনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল। শেষ হয় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। প্রায় চার বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে মূলত বসনিয়ার মুসলমানদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে জাতিগত ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালায় সার্বরা। নির্বিচার গণহত্যা ও ধর্ষণ যুদ্ধজয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে সার্বরা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে এক লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে, বাস্তুচ্যুত হয় ২২ লাখ।
বিভেদের শুরু
সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র ভেঙে ছয়টি স্বাধীন দেশ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯২ সালের ১ মার্চ যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তখন শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তিন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বসনিয়াক নামে পরিচিতরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তারা ছিল স্বাধীন বসনিয়া গঠনের পক্ষে। অপর দুই জাতি বসনীয় ক্রোয়েট ও বসনীয় সার্বরাও নতুন করে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তোলে। ক্রোয়েটরা প্রতিবেশী ক্রোয়েশিয়ার আর সার্বরা সার্বিয়ার সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়।
স্বাধীনতার দাবি
সার্বদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেতে যুগোস্লাভিয়ার মুসলমান ও ক্রোয়েটরা বরাবরই স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের এই দাবির বৈধতা অর্জনের পথে বাধা হিয়ে দাঁড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও মার্কিন সরকার। তারা গণভোটের শর্ত জুড়ে দেয়। বসনীয় সার্বরা গণভোট বর্জন করে তাদের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু বসনিয়ার সরকার পূর্বসমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী গণভোট দেয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই গণভোটে দেশটির ৬৪ শতাংশ নাগরিক একটি অবিভক্ত ও স্বাধীন বসনিয়া গড়ার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপীয় কমিউনিটির স্বীকৃতির দিনই ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল সার্ব আগ্রাসনের শিকার হয় বসনিয়া-হার্জেগোভিনা।
সংঘাতের শুরু
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব-বিভেদ সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে বসনিয়ার পূর্বাঞ্চলে। এই সুযোগে সার্বিয়ার সীমান্ত লাগোয়া ওই অঞ্চলে সার্বিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় সার্ব জাতীয়তাবাদীরা। বহিরাগত ও দখলদার এই সার্বদের নেতৃত্ব দেন রাদোভান কারাদজিচ। সার্বিয়ার সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি ১৯৯২ সালের ২ মে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো দখল করেন। বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের বিতাড়িত করে বসনিয়ার বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সার্বদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। আর নিজেকে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। দখল করা এ রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন সার্বিয়ার সাবেক সেনা কর্মকর্তা রাতকো ম্লাদিচ। ‘বসনিয়ার কসাই’ নামে কুখ্যাত ম্লাদিচের নেতৃত্বে সার্ব সেনারা বসনিয়ার একের পর এক এলাকার দখল নিতে শুরু করে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ক্রোয়েট ও মুসলমানরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
সার্বদের পাশবিকতা
১৯৯৫ সালের গোড়ার দিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল সার্বদের প্রতি বসনিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। কিন্তু তারা আহ্বানে সাড়া দেয় না। ফলে বিমান হামলা শুরু করে ন্যাটো। যৌথ হামলার মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় সার্বরা। কিন্তু পরাজয়ের আগে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায় ম্লাদিচ বাহিনী। জাতিসংঘ ঘোষিত বসনিয়ার ‘নিরাপদ এলাকা’ সেব্রেনিচায় আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ নিরস্ত্র মুসলমানের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালায় তারা। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে আট হাজার মুসলমানকে হত্যা করে ম্লাদিচের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় গণহত্যা। সেব্রেনিচা ছাড়া আরো পাঁচটি অঞ্চল—সারায়েভো, বিহাচ, তুজলা, গোরাজদে ও জেপাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে সার্বদের হামলা থেকে মুসলমানরা রক্ষা পায়। ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্যারিসে সই করা ডেটন চুক্তি অনুসারে সেনা প্রত্যাহার করে সার্বরা।
কাঠগড়ায় গণহত্যাকারীরা
২৪ মার্চ গণহত্যার দায়ে সার্ব নেতা কারাদজিচকে ৪০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল। নেদারল্যান্ডসের হেগে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফরমার যুগোস্লাভিয়ার (আইসিটিওয়াই) বিচারকরা রায়ে বলেছেন, বসনিয়া সংঘাতে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কারাদজিচ দায়ী। আলোচিত সেব্রেনিচা হত্যাযজ্ঞের জন্যও তিনি দায়ী। যাবতীয় তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত হয়, সব বসনীয় মুসলমানকে হত্যা করার অভিপ্রায় ছিল তাঁর। কারাদজিচ দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে থাকার পর ২০০৮ সালে বেলগ্রেডে গ্রেপ্তার হন।
সার্বিয়ার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচ মারা যান ২০০৬ সালে। এর ফলে তত্কালীন নেতৃত্বের মধ্যে সর্বশেষ শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কুখ্যাত সার্ব সামরিক বাহিনীর প্রধান ম্লাদিচের বিচার হবে। তাঁর রায় আগামী বছর হওয়ার কথা। ১৯৯৫ সালের শেষদিকে যুদ্ধের পরপরই সার্ব কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে জাতিসংঘ। গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ৪৬ সার্ব নেতা ও সামরিক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেন আদালত।
http://www.kalerkantho.com/home/printnews/344260/2016-04-06

No comments:

Post a Comment