Monday 17 July 2017

কথাশিল্পী আল মাহমুদ |

FB_IMG_1500338325778
আল মাহমুদের জন্মদিনে
কথাশিল্পী আল মাহমুদ | ফজলুল হক সৈকত।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আমি গল্প-উপন্যাস লিখি। সেটা আগে থেকেই। আমার একটা ধারণা হয়েছে যে, উপন্যাস লিখলেই যে সেটা তিনশ’ পৃষ্ঠা হতে হবে, এর কোনো তাৎপর্য নেই। অনেকে পড়তেও চায় না। আমি ছোট উপন্যাস লেখা শুরু করেছি।
আমি গল্প-উপন্যাস লিখি। সেটা আগে থেকেই। আমার একটা ধারণা হয়েছে যে, উপন্যাস লিখলেই যে সেটা তিনশ’ পৃষ্ঠা হতে হবে, এর কোনো তাৎপর্য নেই। অনেকে পড়তেও চায় না। আমি ছোট উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলোকে বড় গল্প মনে হলেও তাতে উপন্যাসের বিভঙ্গ আছে; প্রেম-প্রীতি, আনন্দ-বেদনা আছে। অনেকে এ ধরনের উপন্যাসকে মাইক্রো উপন্যাস বলে। তবে সব মিলিয়ে আমার যে কাজ সেটা একজন কবিরই কাজ। (সূত্র: আহমদ বাসির, ‘আল মাহমুদের মুখোমুখি’, প্রেক্ষণ, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৭, ১২৮)—এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের কথাসাহিত্য-ভাবনা সম্বন্ধে বলছিলেন আল মাহমুদ। ‘সোনালী কাবিন’খ্যাত কবি আল মাহমুদ (জন্ম: ১১ জুলাই ১৯৩৬, মৌড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) গদ্যসাহিত্যেও বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
নিরন্তর এই লেখক আজও তারুণ্য, রহস্য, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, প্রকৃতির সাথে মানুষের কাজ ও কলার সাদৃশ্য ও সান্নিধ্য, প্রেম-বিচ্ছেদ, আনন্দ-যন্ত্রণার বর্ণনাকারী হিসেবে বর্তমান,—বয়সের ভার, দারিদ্র্য কিংবা সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-পেশাগত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শিখরে। উপন্যাস কিংবা গল্পের কাঠামোকেও তিনি প্রদান করে চলেছেন কাব্যের সৌকর্য ও শোভা। জীবনানন্দের মতো কবিতা এবং কথাসাহিত্য—উভয় ধারাতেই শক্তিশালী এই প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বিরাট অহংকার। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে—১৯৬৭ সালের জুলাই কিংবা আগস্টের কোনো এক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে কবি জসীমউদ্‌দীনকে তিনি এক পত্রে লিখেছিলেন:
আমার গদ্য আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হয়েছি। এদিকটা প্রসারিত করার জন্য আপনার উপদেশ আমাকে দারুণভাবে প্রাণিত করেছে, আমারও বিশ্বাস, আমরা যারা শুধু কবিতা নিয়ে আছি তারা অল্পাধিক গদ্য রচনা করলে এ দেশে গদ্য সাহিত্যের এমন দুর্গতি হতো না। অন্তত প্রত্যেক কবি একটি বা দুটি উপন্যাস অথবা প্রবন্ধ বই রচনা করলে আমাদের সাহিত্যের চেহারা পাল্টে যেত। অধ্যাপকদের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে কবিদেরই এগিয়ে আসা উচিত। একথা একদিন আমি শামসুর রাহমানকেও বলেছিলাম। (চাঁড়ুলিয়া, ওমর বিশ্বাস সম্পাদিত, ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০০১, ২৪৬)
চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক ও ‘সবুজপত্র’ সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীও তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে সাহিত্যের অধ্যাপকদের সম্বন্ধে কিছুটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। অধ্যাপকদের বিষয়ে আল মাহমুদের অভিযোগ কী, তার দিকে আপাতত বেশি মনোযোগ স্থাপন না করেই বলছি, আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি তিনি কথাসাহিত্য নিয়ে বেশ নিরীক্ষা-প্রবণতার পরিচয় রেখেছেন।
দুই
পঞ্চাশের দশকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি আল মাহমুদ। সোনালী কাবিন (প্রকাশকাল: ১৯৭৩) তাঁর সর্বাধিক উচ্চারিত রচনা। প্রায় ৬ দশক ধরে বিরতিহীন লিখে চলেছেন তিনি। গ্রন্থ-সাময়িকপত্র-সভা-সেমিনার-অনুষ্ঠান-বেতার-টেলিভিশন—সর্বত্র তাঁর অবাধ-সাবলীল বিচরণ আজও আমাদেরকে প্রেরণা যোগায়। কবি-কথাশিল্পী—বাঙালির সরব ভাষ্যকার আল মাহমুদ। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন। সাংবাদিকতার সাথে জড়িত হন ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরে। তখন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। কবিতা রচনা ছাড়াও আল মাহমুদ প্রায় নিয়মিত লিখছেন উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কলাম-শিশুতোষ রচনা। বাংলাদেশের রাজনীতি-সংস্কৃতি আর সামাজিক বিকাশধারার অন্যতম নিবিড় ভাষ্যকার তিনি।

ঐতিহ্য আর মানবিক-প্রবণতা বিবৃতিতে তাঁর খ্যাতি অসামান্য। গ্রামীণ জীবনের মাহাত্ম্য আর নগরজীবনের বহুবিধ জটিলতা তাঁর রচনাবলিতে অনায়াসে পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে চলেছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সত্যযুগ পত্রিকায় তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ কি ৫৫ সালে। প্রখ্যাত সম্পাদক তাঁকে তখন গদ্য লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সত্যযুগ-এ তখন মাহমুদের একটি কবিতাও ছাপা হয়েছিল। পরে, ১৯৫৫ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় আল মাহমুদের তিনটি কবিতা—‘প্রবোধ’, ‘একদিন অন্ধকারে’ ও ‘সিম্ফনি’ প্রকাশ করেন। সেই থেকে অবিরাম প্রায় ৬০ বছর ধরে লিখে চলেছেন কথাকারিগর আল মাহমুদ।
মানব জাতির ইতিহাস, প্রেম ও স্বজাত্যবোধ, মাটি ও মানুষের নিবিড়তা, সত্য ও মিথ্যার মোড়ক, চাতুরি ও স্পষ্টতা বিশেষ প্রহরে আল মাহমুদের কথাশিল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আর কাঠামোতে থাকে পর্যবেক্ষণ-পরিবর্তন প্রবণতা এবং প্রাতিস্বিকতা প্রতিষ্ঠার বলয়। হাল আমলে তাঁর রচিত একটি উপন্যাসের বিষয়চিন্তা ও কাঠামোশৈলীর দিকে আমরা খানিটা নজর দিতে পারি। পোড়ামাটির জোড়া হাঁস (প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০১৩, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড) উপন্যাসটিতে আল মাহমুদ হাজার বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাস আর মানুষের অগ্রগমণকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রেমকে। জীবনানন্দের বহুল পঠিত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর মতো করে মানব-সভ্যতার দেয়ালে খানিকটা গাঁ ঘেঁষে আল মাহমুদ কাহিনী-বয়নের শুরুতে বলছেন: ‘হাজার হাজার বছর ধরে...’। বিস্ময়ের ব্যাপার এখানেও রয়েছে বনলতা সেন। আর আছে আরেক নারী পল্লবী। আছে পুরুষ চরিত্র আনন্দ। উপন্যাসটির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়—নারীর প্রাকৃতিক প্রেম ও পুরুষের হৃদয়লীলা। অন্তহীন নারী পল্লবী এবং সম্ভাবনাময় পুরুষ আনন্দের মানসিক দ্বন্দ্ব আছে এখানে। উর্বরা জমির মতো ভরাট গতর আর কামকাতর কৃষককন্যা বনলতার রহস্য হয়ত আটকে থাকে মানুষের অনাদিকালের স্বপ্নভরা ফসলের মায়াবী মাঠের প্রান্তে।

বনলতার মাতৃত্ব, পল্লবীর সখিত্ব আর আনন্দের নারীমগ্নতা—সব মিলিয়ে সরল কাহিনীতে মানব-মানবীর সনাতন প্রেমের গল্পই পরিবেশিত হয়েছে। আর কাহিনীর কারিগর কৌশলে তাঁর পাঠককে হাজির করেছেন ধর্মতত্ত্বের সৃজনরহস্যে। উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র কাব্যময়তা কিংবা প্রেমের দ্বান্দ্বিকতা ও রহস্যের উত্তরণ-পর্ব কি-না, তা হয়ত পরবর্তীকালে গবেষকগণ বিবেচনা করে দেখবেন। তবে, এখানে পোড়ামাটিতে তৈরি আদি মানুষ—আদম ও হাওয়ার প্রেম—অতঃপর জগতের সকল রহস্য ও জটিলতার ব্যাপ্তিকে তিনি ধরতে চেষ্টা করেছেন বিশেষ, নির্বিশেষ ও রূপকের অন্তরালে। উপন্যাসটির শেষাংশের পাঠ নেওয়া যাক:
সব প্রেমেরই ঘটনা থাকে। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেউ ইতিহাসের মর্যাদা দেয় না। লোকে বলে প্রেমে অন্ধ হয়ে যাওয়া একটা অবস্থার কথা। যে অবস্থা এখন আনন্দের। সে কেবল দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে এবং মুখে বিড়বিড় করে কাব্যের পঙক্তিটি উচ্চারণ করে। তার মধ্যে প্রকৃত কবিত্বশক্তি লুকায়িত আছে বলে সবারই মনে হতে থাকে। আনন্দ নিজের ওপর আস্থা হারায় না। সে কবিতাকে মনে হয় খানিকটা নিজের আয়ত্বে এনে তারই চর্চা করে এগিয়ে যাচ্ছে।
বনলতা মাঝে মাঝে বিনয় প্রকাশ করে সমঝোতার চেষ্টা করতে চায়। কারণ তার আছে গর্ভে সন্তান। এ জন্য তার মধ্যে নারীসুলভ হিংস্রতা খানিকটা চাপা পড়ে থাকে। তার বদলে তার ভেতরে মাতৃত্ব প্রবল হয়ে উঠেছে। যেখানে তার সন্তান আসছে। সেই সন্তানের জন্য যে ব্যাকুল-বিহ্বল হয়ে অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে পল্লবী তার দেহবল্লরী সবার সামনে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে পুলকে, শিহরণে কাঁপছে। সবকিছুই মোটামুটি আনন্দঘন এক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে।
অন্য দিকে এই কাহিনীর রচনাকারী এখন সমাপ্তিতে পৌঁছতে চায়। যদিও গায়ের জোরে সমাপ্তিতে পৌঁছা যায় না। তবে অবস্থা যে রকম আছে, সেভাবেই সমাপ্ত করার নামই হলো শেষ। তামাম শোধ।
শেষের আলোয় এই কাহিনীর সমস্ত চরিত্রই উদগ্রীব এবং ঘটনার পারম্পর্য পরিসমাপ্তিতে না পৌঁছালেও এই কাহিনীর বর্ণনাকারী যেহেতু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বলতে চান—আর কিছু নেই। এ কথাই এখন প্রাধান্য লাভ করেছে। শেষ মানে আর বলার-চলার কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। এখানেই তবে শেষ হোক। সমস্ত চরিত্রের অন্তর্জালা ও স্বপ্নকল্পনা।
‘অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নায়ক ও নায়িকা মিলে গেল’ কিংবা ‘নটে গাছটি মুড়োলো আমার গল্প ফুরোলো’ ধরনের বাংলা সিনেমার মতো অথবা বাঙালির রূপকথার মতো ঐতিহ্যিক সুর হয়ত আমরা এখানে পেয়ে যাই। কিন্তু আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য কথা—পৃথিবীর কাহিনী যে চলমান, প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে ইতিহাসের উপাদান—সভ্যতা যে স্থির নয়, এর যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, অতএব মানুষের গল্পের ও বিকাশেরও যে কোনো পরিসমাপ্তি থাকতে পারে না; আর এসবের ভেতরেই থাকে মানুষের স্বপ্ন ও তৃপ্তি—সেই আখ্যানই বোধ করি কথাকার সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এই কাঠামো ও কৌশল অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ও বিশেষভাবে চিন্তা-জাগানিয়া।
আল মাহমুদ কোনো উপন্যাস লেখা শেষ করে তারপর ছাপতে দিয়েছেন এমন নজির নেই। সবগুলোই কোনো-না-কোনো সাহিত্যপাতা বা সাময়িকীর জন্য ধারাবাহিকভাবে বা আংশিকভাবে রচিত; পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। তিনি একটানা উপন্যাস লেখাটাকে কঠিন কাজ ভেবেছেন। ধীরে ধীরে লেখা শেষ করার কারণে তাঁর কাহিনীতে কিংবা কোনো পরিচ্ছেদের পরিসমাপ্তিতে প্রায়শই নাটকীয়তার আভাস মেলে। প্রথম উপন্যাস ডাহুকী ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও গল্প লিখছেন বেশ আগে থেকেই। গল্প লিখে হাত পাকিয়ে, সাংবাদিক আল মাহমুদ, কবিতার পাশাপাশি গদ্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বোধকরি। তো ডাহুকীতে কী আছে?—আছে প্রধান নারী চরিত্র আতেকার গ্রামে ছুটে যাওয়ার ঘটনা। বাঙালি মুসলমান ও নগরে বসবাসকারী এক নারীর ভেতরে টানাপোড়েন, শহর ছেড়ে শেকড়ের সন্ধানে ছুটেচলার যে প্রাণান্ত আবেগ—সে সব তিনি জানাতে চেষ্টা করেছেন।
আর আস্তিকতা যে মানুষের প্রকৃত পরিচয়, নাস্তিকতার ভেতরেও যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক প্রকারের আস্তিকতা, তাও প্রকাশ করেছেন তিনি ডাহুকীতে। ৩৮ বছরে পদার্পণ-করা আতেকার কৈশোরকাল বর্তমান কাহিনীর ক্যানভাস। স্কুলে যাওয়ার সাথী কেরামতকে ভুলতে পারেনি আতেকা। গল্পের পরিসরে চত্রির হিসেবে প্রবেশ করেছে আতেকার স্বামী অধ্যাপক শাহেদ, কেরামতের স্ত্রী সুফিয়া বানু, দর্শনের অধ্যাপক ফিরোজা বেগম প্রমুখ। অতৃপ্ত দাম্পত্য মূল সুর হলেও উপকাহিনীরূপে স্থান পেয়েছে শাহেদের কৈশোরকালে বেশ্যাপাড়ায় কোনো এক নারীর পরম মমতার স্পর্শ-কথা। আতেকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। শাহেদ-আতেকা দম্পতি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ালেও সংসারে তাদের সুখ আসেনি। এক পর্যায়ে আতেকার বান্ধবী ফিরোজার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে শাহেদ। নানান ঘাত-প্রতিঘাত, মনোবাস্তবিক সামাজিক স্তর পেরিয়ে গল্পটির ক্যানভাসে আতেকার মানসিক পরিবর্তনের ছায়া প্রতিফলিত হয়। আতেকার প্রথম শিক্ষক ইমাম সাহেবের সান্নিধ্য ও পরামর্শ লক্ষ্যণীয়:
‘আল্লাহ তোমার মতি সুস্থির করবেন। মনে রাইখো, হুদাই ভোগের মইধ্যে সুখ নাই আল্লারে যত বেশি ইয়াদ করবা, আল্লাহ তত বেশি তোমার ইয়াদ করব।’ (আল মাহমুদ রচনাবলী-২, ঐতিহ্য, ২০০২, ৩০৬)
উপন্যাসটির সংলাপে একটা বিশেষ গ্রাম্য-ঢঙ আছে। আতেকা এবং তার কিশোরবেলার সাথী কামরুন-এর মধ্যকার একটি কথোপকথনের বর্ণনার দিকে দৃষ্টি রাখা যাক:
— এই কামরুনী গাইয়ের নিচে কী দেখছ?...
— আমি গাইয়ের নিচে বইসা তর হাইরে দেখি।
— বেশি দেখিস না। তাইলে কইলাম কেরামত ভাই গাই ছাইড়া তর উলান ধইরা দোয়াইব। তাড়াতাড়ি বাইর অইয়া যা।
— তর মতন গাই থুইয়া তর বাপের বান্ধা রাখাইল্যা আমার ওলান ধরব ক্যান লো বান্দরনি। তরটা চুইষ্যাইত কেরামত মিঞার চিকনা বাড়তাছে।’ (আল মাহমুদ রচনাবলী-২, ঐতিহ্য, ২০০২, ১৬৮)
বাংলাদশের অভ্যুয়ের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, স্বাধীনতা ও নেতৃত্ব বিষয়ে নানান মতান্তর প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ছায়া পড়েছে আল মাহমুদের কাবিলের বোন (১৯৯৩) ও উপমহাদেশ (১৯৯৩) উপন্যাসদ্বয়ে। ভিন্ন নাম হলেও আসলে বই যে একটি তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-বর্ণনাকারী তিনি। ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ইতিহাসলগ্নতা বোধকরি এমনই। যেমন ২০১৪ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো সারা-প্রচেষ্টা জুড়ে প্রকাশ করে চলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস—তার প্রতিটি বই যেন ধারাবাহিক রচনা কিংবা পরেরটি আগেরটির নতুন সংস্করণ (নোবেলপ্রাপ্তির পর এক সাক্ষাৎকারে লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী)। সমাজচিন্তক আল মাহমুদ অভিজ্ঞতা থেকে অনুভূতি ও ধারণাগুলোকে সাজিয়েছেন কথা-কাহিনীর স্তরে স্তরে। কখনো বানিয়ে বা আরোপ করে কিছু লিখতে চেষ্টা করেননি। বিশ্বাস এবং অনুভবে তিনি স্থির কথানির্মাতা। কাবিলের বোন-এ বাংলা-উর্দু-ফারসি ভাষার মিশ্রণ আছে।
এটি বাঙালি কথানির্মাতা ও কবি মাহমুদের নিজের ভাষা—বানানো নয়। তিনি বড় হয়েছেন কনজারভেটিভ মুসলিম পরিবারে। সেখানে ছিলেন মাদ্রাসা-পড়ুয়া ব্যক্তি, শিক্ষক-ব্যবসায়ী, মাওলানা। কাজেই একটি মিশ্র-সংস্কৃতি ও ভাষাবোধ তাঁর চেতনায় ছিল। উপমহাদেশ-এ মুসলমান পুরুষ কবি মীর হাদী এবং হিন্দু নারী নন্দিনীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তিনি সমকালীন সামাজিক অবস্থা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারত-পাকিস্তান ও স্বপ্নে-জাগা বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
কবি ও কোলাহল (১৯৯৩) উপন্যাসে রবীন্দ্র-বিরোধীতার প্রসঙ্গ আছে—আছে রবীন্দ্রনাথের অনতিক্রম্য প্রাসঙ্গিকতার কথাও। এছাড়া, এখানে প্রতিফলিত হয়েছে কমিউজম সম্বন্ধে মত-বিরোধ ও চিন্তার বৈশাদৃশ্য এবং স্বপ্নময়তা ও বাস্তবতা-বিরোধিতার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার চিত্রাবলী। প্রকৃত পক্ষে লেখক বাস্তবকে, সমকালীনতা ও স্বপ্নময় সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। পাঠককেও সে ধারণার সাথে পরিচিত করে তুলতে চেয়েছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন, মানবিকতা, যৌনতার স্বাভাবিকতার কাহিনী তাঁর নিশিন্দা নারী (১৯৯৫)। এখানে জাদুময়তা আছে, অনর্গল গল্প বলার ভঙ্গি আছে। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের একবসায়—একরাতে লেখা উপন্যাস রক্তগোলাপ (১৯৬৪)।
আল মাহমুদ তাঁর যেভাবে বেড়ে উঠি (১৯৮৬) আত্মজীবনীমূলক রচনাকে উপন্যাস বলতে চেয়েছেন—এটিকে তিনি নিজের জীবনের ঘটনার আবর্তে গড়ে ওঠা ‘ফিকশন’ বলতে চান। কহিনীটিতে নায়কের অস্থিরচিত্ততা এবং অল্পবয়সী বালকের জীবন-উপলব্ধি জীবনশিল্পী আল মাহমুদের দর্শনেরই প্রতিফলন মাত্র। জীবনসত্যের, শিল্পসত্যের এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ হতে পারে বইটি। নারী ও নারীর দ্বন্দ্ব যে আমাদের ভারতীয় পরিবারের ঐতিহ্য ও স্বাভাবিক ছবি—তার গল্প পাওয়া যায় মাহমুদের পুত্র উপন্যাসে। ছেলে বিয়ে করলে পর হয়ে যায় কি-না, সে শ্বশুরবাড়ির লোক হয়ে পড়ে কি-না—এসব জিজ্ঞাসার সমাধান পাওয়া যেতে পারে গ্রন্থটিতে। আগুনের মেয়ে (১৯৯৫) অসাধারণ এবং এবং বিশেষ উপন্যাস। আমাদের লৌকিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ঐশ্বরিক ভাবনার দ্বন্দ্ব ও মীমাংসা, জ্বীন ও ইনসানের মধ্যকার সম্বন্ধ, ধর্মীয় ও সামাজিক উপলব্ধি, দার্শনিকতা নানান বিষয়ের সমাবেশ আল মাহমুদের এই উপন্যাসখানি। আকারে ছোট এই গ্রন্থটিকে একটি সার্থক সৃষ্টি বলে দাবি করেন লেখক। আগুনের মেয়ে সম্বন্ধে আল মাহমুদের একটি বক্তব্য এখানে তুলে দেওয়া হলো:
আমি বইটা লিখছিলাম এই কারণেই যে, আমাদের সব সমাজের অভ্যন্তরে, আমরা যেহেতু মুসলমান, আমরা যেহেতু কোরআন পাঠ করি আমরা জ্বিনের ওপর বিশ্বাস করি। আরেকটি কথা—পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যে উপন্যাস তার নাম হলো এরাবিয়ান নাইটস। এরপর এর তুলনায় আর কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি। এই উপন্যাসের একটা বড় উপাদান হলো জ্বিন চরিত্র। তাহলে আমরা জ্বিনকে কেন ব্যবহার করব না? এই জন্যে একটা পরীক্ষামূলক গল্প আমি লিখলাম। আমি এই উপন্যাস দিয়ে আমাদের সবচেয়ে যারা আধুনিক লেখক তাদের একদম নাড়িয়ে দিয়েছি।
আমরা কল্পস্টোরি করি। আমরা জ্বিনে বিশ্বাস করি; জ্বিন আছে, কিন্তু তা আমাদের গল্পে নেই। আগের দিনের লেখকরা এরাবিয়ান নাইটস যারা লিখেছেন, তৈরি করেছেন, তারা এটাকে জাদু হিসেবে নিয়েছেন। হিন্দু শাস্ত্রেও কিন্তু জ্বিনের কথা আছে। গন্ধম চরিত্র আছে। এসবই কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু আগুনের মেয়ে আমি লিখেছি আমার গভীর বিশ্বাস থেকে। (‘উপন্যাসের জন্য আমাকে এক সময় স্মরণ করা হবে’, সাক্ষাৎকার, চাড়ুলিয়া, পূর্বোক্ত, ১৪৫)
আল মাহমুদের পুরুষ সুন্দর (১৯৯৪) উপন্যাসটি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। আছে প্রবল নিন্দা। অনেকে মনে করেন এটি অশ্লীল—এমনটা না লিখলেও পারতেন তিনি। অবশ্য এর বিচার এখন সময়ের কাছে। যে পারো ভুলিয়ে দাও (১৯৯৬) গ্রন্থটি সম্ভবত তাঁর একটি বৃহৎ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। যদিও বইতে তা উল্লেখ নেই। তবে কাহিনীর হঠাৎ থেমে যাওয়া আর লেখকের আলাপচারিতা থেকে বিষয়টি ধারণা করা যায়। গ্রন্থটির গল্প-পরিসর লেখকের নানার বাড়ি। মামাদের কাহিনী আর চরিত্রের ভালোমন্দ নিয়ে গড়ে উঠেছে গল্পের ক্যানভাস। ঘটনা বিবরণে তিনি সত্যনিষ্ঠ। কোনো কথা আরোপ করেননি, বানিয়ে লেখেননি। কেবল ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে গেছেন।
আর চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১) উপন্যাসটির বিষয় হলো মিডিয়ায় নারীর পণ্য হিসেবে উপস্থাপন এবং ফটোগ্রাফির নানান কৌশল ও কলা। তিনি সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন এই গ্রন্থের বয়নের সময়। দায়িত্বশীল সাংবাদিক আল মাহমুদ কাহিনীর মধ্য দিয়ে শুধু সত্য সংবাদই প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন এখানে। চারপাশে দেখা সমাজের শ্লীলতা-অশ্লীলতার চেহারা পাওয়া যাবে হরিৎ খোলস উপন্যাসে। কবি আল মাহমুদ জাত কথাশিল্পী। এই প্রসঙ্গে তাঁর সাক্ষ্য:
যদি আমি কবিতা না লিখতাম তাহলে গদ্যশিল্পই তৈরি করতাম। আমার কিন্তু সমস্ত ঝোঁক ছিল কথাসাহিত্যের দিকে। বাইচান্স কবিতা লেখা শুরু করি, সেই চলা শুরু।’ (চাড়ুলিয়া, ওই, ১৪৬)
তিন
কবিতার পাশপাশি কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের আবির্ভাব এদেশের গদ্যসাহিত্যের অভিযাত্রায় এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি যখন গল্প-কাঠামো নির্মাণ করেন, তখন যেন খুব সাবধানে তৈরি করেন বাংলাদেশের বুক। আল মাহমুদ গল্প লিখেছেন ধীরে-সুস্থে; খ্যাতি ও প্রশংসার আকর্ষণ তাঁকে টলাতে পারেনি। তাঁর গল্প-পরিকল্পনায় এবং পরিবেশনশৈলীতে রয়েছে নিবিড়চিন্তার ছাপ। প্রখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদ মন্তব্য করেছেন:
‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এত কয়টা ভালো গল্প বেড়িয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্বে ঈর্ষণীয় মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’ (প্রেক্ষণ, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৭, ১৫০)
মানুষ-জীবন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি আল মাহমুদের গল্পের মূল ক্যানভাস। নারী—তার রূপের বর্ণনা, প্রকৃতির সাথে নারীর তুলনা, পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান এবং নিয়তির অমোঘতা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে আল মাহমুদের গভীর গ্রামপ্রীতি। গল্পকথক গল্পটির প্রারম্ভেই প্রকৃতির বিচিত্র রঙ আর শোভার সাথে ভালোলাগার মানুষকে মিলিয়ে অনুভব করেন। পানকৌড়ির আভরণ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি; মনে পড়ে যায় সদ্য পরিণীতা স্ত্রীর মুখ-আদল। রোদে গায়ের পানি শুকাতে-থাকা পানকৌড়ির মাঝে তিনি যেন কেবলই দেখতে পান চুল-শুকাতে-থাকা স্ত্রী নাদিরার কোমল মুখ।
গল্পকার ভালোবাসেন দেশকে আর প্রিয় মানুষকে। তাই দেশের, প্রকৃতির নির্মলতায় বারবার খুঁজে ফেরেন প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পের প্রতীকী তাৎপর্য স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এসেছে। নববিবাহিতা স্ত্রী তার প্রথম রক্তের অসুবিধার দরুন স্বামীর রতিক্রিয়ার খায়েশকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলে স্বামীকে আদর করে রাগ করতে বারণ করে। স্বামী সেখানে সফল হতে না পেরে শিকারে গিয়ে সমতুল্য এক উত্তেজনা অনুভব করতে চায়। বিলের বর্ণনা লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় বহন করে। লেখক কাদাকেও জীবন্ত করে তুলতে পারেন। তবে পানকৌড়িই আসল। তার বুক, পুচ্ছ ও পাখনায় যুবকটি তার স্ত্রীর দেহের পেলব কৃষ্ণ শোভা ও কমনীয়তা দেখতে পায়। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু যুবকের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা পানকৌড়ির পড়ন্ত দেহে রক্তের ছোপ এঁকে দেয়। যেন স্ত্রীর প্রথম রক্তের বাধা পেরিয়ে সেখানে নতুন এক রক্ত সাগরের সম্ভাবনা দেখা দেয়। পানকৌড়ি মরে গেল। স্ত্রীরও কুমারিত্ব ঘুচল। যেটা নারীর জীবনে একই সাথে পুরনো সত্তার মৃত্যু ও নুতন জীবনের শুরু।
‘ভেজা কাফন’ গল্পে এক সাধারণ নারী নূরীর জীবনে ঘটে-যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনার সমাবেশ আমাদের চোখে পড়ে। নূরী অসুস্থ; হৃদরোগে ভুগছে। তার লেখা চিঠিতে আমরা পাই মৃত্যুভয় আর ক্ষমা-প্রার্থনার আকুলতা। সে লিখেছে: ‘আমি বাঁচব না। আমাকে মাফ করে দিও।’ ডাক্তারের মতে নূরী আর মাত্র ছয় মাস বাঁচবে। মা-বাবা হারা নূরী ভাইয়ের সহযোগিতায় চিকিৎসা চালাতে থাকে। স্বামী সাজ্জাদের প্রতিও তার বেশ আস্থা। মৃত্যুপথযাত্রী নূরী তার পুরনো বন্ধুদেরকে যে-সব লম্বা-লম্বা চিঠি লিখত সেগুলো ডাকে পাঠাত সাজ্জাদের হাতে। একদিন সত্যি সত্যি সব ছেড়ে পরপারের পথে পাড়ি দিল জীবনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণ-প্রত্যাশায় নিমগ্ন নূরী। সাদা কাফন-মোড়ানো দেহ তার চারপাশের আপনজনের কান্নার ভারে আর বৃষ্টি-উত্তর প্রবল বাতাসে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছিল যেন। নাকফুলছাড়া নূরীর মুখ বড় অচেনা হয়ে পড়ে সাজ্জাদের কাছে; লাল শাপলার গুচ্ছ তুলে-ফেলা পুকুরের টলটলে জলের মতো মনে হয় নূরীর ভেজা কাফনমোড়া মুখ। প্রকৃতির সন্তান নূরী যেন প্রকৃতিরই অকৃত্রিম স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় স্বামীর স্মৃতিনিবিড় ভাবনাবলয়ে। নিয়তি যেন কিছুতেই আমাদেরকে সহজ-পথে হাঁটতে দিতে চায় না—গল্পকার বোধহয় এই অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন এ গল্পে।
সাংসারিক-পারিবারিক জীবনের নৈমিত্তিক ঘটনা আর দাম্পত্য-জটিলতার ভাষাচিত্র আল মাহমুদের ‘পাতার শিহরণ’ গল্পটি। স্বামীকে হারাতে না-চাওয়া এক ঘরমুখো স্ত্রীর মানসিক দোলাচল, অনাস্থা, সিদ্ধান্তহীনতা আর শেষত নিশ্চলতা এই গল্পের মূল আভাসকেন্দ্র। নতুন চাকুরিতে যোগ দিতে যাবার জন্য অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েও যুবতী কাজের মেয়ে ঘরে রেখে যেতে সাহস পায় না মধ্যবিত্তস্বভাবের বাঙালি নারী পাতা। বাঙালি নারীর স্বামী-নির্ভরতা কিংবা স্বামীর প্রতি অবিচল আকর্ষণ চিত্রণে বর্তমান গল্পে লেখক বেশ আন্তরিক; পাতার সন্দেহ-বাতিকতা প্রকাশে প্রকারান্তরে তার ভালোবাসার অকৃত্রিমতাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন গল্পকার। দাম্পত্য-দলিল পরিবেশনের পাশাপাশি গল্পটিতে কথাশিল্পী চাকুরির নির্বাচনী বোর্ড, শহর ও গ্রামের পরিবেশগত ভিন্নতা—বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষের শহরপ্রীতি প্রভৃতি প্রসঙ্গের বিশ্বাসযোগ্য কিছু বিবরণও উপস্থাপন করেছেন সামাজিকের দায় থেকে। জীবন চলার পথে গল্পকার দেখা-শোনা-জানা বিষয়গুলোকে গল্পের পাতায় পাতায় সাজিয়েছেন অভিজ্ঞ শিল্পীর দিকজয়ী তুলির জাদুময়ী স্পর্শে।
‘তৃষিত জলধি’ গল্পটি ভ্রমণ-বিষয়ক বাস্তব ঘটনার বিবরণ। গল্পকথক তার জবানিতে জানাচ্ছেন বিচিত্র পেশার মানুষের চরিত্র-প্রবণতা আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির আভাসচিত্র। গল্পটির শুরুতে কথক পাঠককে বলছেন তার ভ্রমণ-অনুষঙ্গ: ‘বঙ্গোপসাগরে প্রমোদ-ভ্রমণে এসে সারাদিনের ক্লান্তিকর ছোটাছুটি আর হৈ-হুল্লোড় ছাড়া আমার জন্য জাহাজটির মধ্যে তেমন পরিতৃপ্তিকর কোনো অবকাশ ছিল না।’ একটি প্রমোদ-তরীতে রাষ্ট্রপতির সাথে ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-নিরাপত্তাকর্মী-শিক্ষার্থী। এই প্রতীকি গল্পে কথাশিল্পী আল মাহমুদ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহ নির্মাণ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা আর ঠক-প্রবণতা গল্পটির ক্যানভাস। গল্পে বর্ণিত রাষ্ট্রপতিকে একদিন রাতে জাহাজের ছাদে বসে থাকতে দেখা যায়—একাকী; তখন তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা ঘুমরত। আমাদের ভূমি-অধিকর্তা-চারপাশ যে গভীর অনিশ্চয়তা আর গন্তব্যহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত—তারই চিত্রাভাস বর্তমান গল্পটিতে উপস্থাপিত।
মফস্বলের কলেজশিক্ষকদের প্রাত্যহিক সংকট আর প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গন্ধের উৎস’ গল্পে। জিহান নামক এক কলেজ শিক্ষকের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন নবাগত ইংরেজি শিক্ষক রব; আলাপ-প্রেম-বিয়ে-সংসারে গড়ায় তাদের সম্পর্ক। কিছুকাল পরে দূরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায় জিহান। তার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না স্বামী রব। চারপাশে সে যেন কেবলই অনুভব করে জিহানের গায়ের গন্ধ। এ গল্পে পারিবারিক টানাপড়েন, স্মৃতিলগ্নতা, ইন্দ্রিয়চেতনার প্রখরতা বিবৃত হয়েছে একজন সমাজবিজ্ঞানির দৃষ্টিতে।
‘জলবেশ্যা’র প্রস্তুতিপর্ব দীর্ঘ হলেও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে সমস্ত পরিমণ্ডলটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং তা শেষের অভিযানটাকে প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য করে তুলেছে। তবে মিলনের অবস্থানে সাপের ঝুঁড়িতে পা-দেওয়া জলবেশ্যার পক্ষে এত অভ্যস্ত জিনিস না আকস্মিক এর দুর্ঘটনা? যে নির্লিপ্ততার সঙ্গে মিলনকাঙ্ক্ষী পুরুষটার সাপের ছোবল খাওয়া অচৈতন্য দেহকে জলবেশ্যা নিজের হাতে ও কাঁধে তুলে পুরুষটার নৌকাতে ফেলে দিল তাতে বস্তুতই মেয়েটার চারিত্রায়নে নতুন এক মাত্রা যুক্ত হলো। সমস্ত বিবরণটাই যথাযথভাবে কল্পনাসমৃদ্ধ। ‘মীর বাড়ির কুরসীনামা’য় লেখকের খুঁটিনাটির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি ও গ্রামীণ মুসলিম জীবনের পরিমণ্ডল রচনায় অভ্রান্ত কৌশল রাতটার যৌন-নৈপুণ্য ও তা অবলোকন করে এক অতৃপ্ত স্ত্রীর আফসোস ও কামনাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত করে তুলেছে। লেখকের মাস্টারি হাত এই দুই ধরনের যৌনতার উন্মোচনকে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক ও বিশ্বসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
‘পশুর নদীর গাংচিল’ গল্পে সুন্দরবন, ও পাশে নদী আর গাছ-গাছালির কোলে বেড়ে ওঠা চৌদ্দ বছরের কিশোরী ‘কর্পূর’ ও পনেরো-ষোল বছরের ‘রতনের’ জীবন-জীবিকার এমন একটি খণ্ডচিত্র চিত্রিত হয়েছে যা ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে ধারণা দানে যথেষ্ট। গল্পে জানা যায়, ‘গাঙ পাহারাওলা আর বাদাবনের জানোয়ার দুটোই তো এক জাতের।’ আরো এক শ্রেণীর মানুষ জানোয়ার হয়ে ওঠে। যারা জাহাজ ভিড়িয়ে কর্পুরের ছাগল তুলে নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চায় না। গল্পটি এখানে এসে মোড় নেয়। পরে কর্পুর ছাগলের দাম বাবদ প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছয়টি নতুন কম্বল নিয়ে নেমে আসে। কর্পুরের এই জাহাজে ওঠা এবং নামা নিয়ে আল মাহমুদ যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বস্তবগ্রাহ্য।
‘পাতার শিহরণ’ এবং ‘নিশি বিড়ালের আর্তস্বর’ গল্পে নারীর নারীত্ব ও মাতৃত্ব যুগপৎ প্রকাশিত। গল্পের সাধারণ কাহিনী অসাধারণ হয়ে উঠেছে আল মাহমুদের হাতে। বিশেষত নারীর চরিত্র ও মনস্তত্ব খননে কোনো ইঙ্গিত নয়, ডিটেলসের আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত বাস্তবতাকে মূর্ত করেছেন আল মাহমুদ। ‘নিশি বিড়ালীর আর্তস্বর’ গল্পে মা হোমায়রা অকস্মাৎ ঘুম ভেঙ্গে বেড়ালের বাচ্চার যে মিহি ডাক টের পান তার ক্রমশ বিস্তার ধরে গল্প এগিয়ে যায়। এবং পাঠকও এগিয়ে যান। শেষে মধ্যরাতে ড্রেনের ময়লা স্রোত থেকে মা মেয়ে দু’জনে বেড়ালের বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে। সকালের দিকে মেয়ে সেতু যখন বেড়ালের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছে তখন তার ডাকে মা হোমায়রার ঘুম ভাঙ্গে না। এ-যেন সন্তান ফিরে পেয়ে এক মায়ের নিবিড় প্রশান্ত ঘুম।
উত্তম পুরুষে লেখা গল্প ‘গন্ধবণিক’ লেখকের আত্মজৈবনিক লেখা। কিন্তু আল মাহমুদ নিজে প্রকৃত শিল্পীর মতো শেষবধি নিজের লেখা থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যান এবং একটি দার্শনিক ধারণা মূল বিষয় হয়ে প্রতিষ্ঠা পায়। গন্ধবণিক লেখকের বাড়ি লাগোয়া নানা সম্পর্কের একজন প্রবীণ আতর বিক্রেতা। তিনি এক সময় সুখী, সম্ভ্রান্ত ও বিলাসী মানুষ ছিলেন। তাঁর সদালাপে মুগ্ধ ছিল মানুষজন। সুগন্ধ বিক্রয়ের সুবাদে তাঁর বন্ধুত্ব দাবি করতেন অনেকে। লেখকের মতে,
তার সুন্দর পকেট ঘড়িটা, আইভরির কলমদানী, স্ফটিকের ফুলদানী, হরিণের চামড়ার চশমার খাপ, কষ্টি পাথরের পেপারওয়েট, মৃগনাভি রাখার চন্দন কাঠের বকসো, রুপোর তৈরি জর্দার কৌটা আর সুগন্ধি চুরুটের মুখ কাটার চাকুটা হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে মহা আনন্দ পেতাম। (পৃষ্ঠা ৩৫)
গন্ধবণিকের বিষয় ও রুচির যে বর্ণনা আছে তাতে তিনি একজন বড় ধরণের মানুষ হয়ে ওঠেন পাঠকের কাছে। লেখক সে আয়োজন করেন গল্পে। এই গন্ধবণিক মারা যান যেদিন মাসিক বেতন পেয়ে লেখক নিজের বাড়িতে আসেন। স্মৃতিকাতর, ব্যথিত-দুঃখিত লেখক ওই গভীর রাতে স্ত্রীকে নিয়ে গন্ধবণিকের লাশ দেখতে যান। কী হলো সেখানে? কিছু হওয়ার চেয়ে হুইপ চালিয়ে পাঠকের মনে নতুন এক উপলব্ধি কেটে বসিয়ে দেন আল মাহমুদ।
মন্তু নানার মুখের দিকে ফিরে আঙ্গুল দিয়ে তার চোখের পাতি দুটি বন্ধ করতে একটু ঝুঁকতেই একটা উৎকট দুর্গন্ধের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়লো আমার নাকে। নাসারন্ধ্র দিয়ে বুকের ভেতর কুৎসিত গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। আমার নাভি মণ্ডলে অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে একটা বমির ভাব ছড়িয়ে পড়ল জিভে। মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার সর্বসত্তা অস্তিত্ব অসুস্থ, মুহ্যমান ও বিবমিষায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। (পৃষ্ঠা ৪২)
নিখুঁত এই অনুভূতি। মৃত মানুষ যে জীবিত মানুষের মতো আর মূল্য রাখে না—এই প্রভেদ গল্পে নৈপুণ্যের সাথে আল মাহমুদ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁর এ পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোর মধ্যে ‘গন্ধবণিক’ একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হিসেবে বিবেচিত হবে।
চার
আল মাহমুদের কথাসাহিত্যে কাব্যিক আবহ আছে; রয়েছে সৌন্দর্য আর প্রকৃতিনিবিড়তার ঘনিষ্ঠ ছবি। সমাজ—তার সমূহ উত্থান-পতন, মানুষের স্বপ্ন-আশাভঙ্গ আর প্রত্যাশার জাল তিনি তৈরি করেন দারুণ মমতায়। বর্ণনাকৌশলে তাঁর কাহিনী-কাঠামো পরিবার-কাঠামোরই এক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় যেন।

No comments:

Post a Comment