Tuesday 18 July 2017

সংখ্যালঘু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ।

সংখ্যালঘু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ।


মোহিত রায়
শিরোনামটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় একেবারেই অচ্ছুৎ জেনেও সরাসরি সমস্যার পরিচয়ে যাওয়ার জন্য এই উসকানি। না বললেও চলে যে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বলতে মুসলমান জনগোষ্ঠীকেই বোঝায়, ও তার চাপে অন্যান্য ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের এখানে কোন সংখ্যালঘু পরিচয় গড়েই ওঠেনি। অর্থাৎ সাঁওতাল সংখ্যালঘু বা নেপালি সংখ্যালঘু কথাটি বাংলায় অচল। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সবচেয়ে বড় সমস্যা যে এই জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ প্রবল দারিদ্রের মধ্যে রয়েছেন এবং তার সঙ্গে এই জনগোষ্ঠী দিনে দিনে ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। এই নিবন্ধ সংখ্যালঘু মুসলমানদের এই সমস্যার আলোচনায় যাবে না যদিও তা অবশ্যই জরুরী। তবে এই সমস্যা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এই নিবন্ধ প্রশ্ন করবে যে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের জন্য একটি সমস্যা হয়ে উঠছে কিনা এবং কেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কি বিশেষ সংখ্যালঘু ?
যদি প্রশ্ন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সত্যিই সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা তবে হয়ত লেখকের পাটিগণিতের জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। কিন্তু এটা বোঝা উচিত যে সংখ্যায় কম হলেই তাকে সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় না। সমাজের চোর, ডাকাত বা ব্রাহ্মণরাও সংখ্যায় কম কিন্তু তা বলে তাদের সংখ্যালঘু বলা হয় না, পাড়ার মাস্তানকে আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরা, ইরাকে সুন্নি মুসলিমরা বা ভারতের একটা বড় অংশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়েও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তখন তাঁদের আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না। সুতরাং জনসমাজে সেই অংশকেই সংখ্যালঘুর মর্যাদা দেওয়া হয় যারা সংখ্যায় কম হওয়ার ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র দ্বারা দীর্ঘদিন নিপীড়িত, সে নিপীড়ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত হতে পারে।
১৯৪০ সালে, দেশভাগ হবার অনেক বছর আগে বাবাসাহেব আম্বেদকার পাকিস্তান প্রস্তাব সর্ম্পকে আলোচনায় বলেছিলেন ‘সংখ্যালঘু বিনিময়ই নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান’।১ তিনি আরো বলেছিলেন যে ‘পাকিস্তান না হলে দেশে সাম্প্রদায়িক গোলমালে জড়িত থাকবে সাড়ে ছ কোটি মুসলমান আর পাকিস্তান হয়ে গেলে পড়ে থাকবে দুকোটি মুসলমান। ….আমার মনে হয় পাকিস্তান হিন্দুস্তানের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান করবে না কিন্তু তা যথেষ্ট পরিমাণে ক্মাবে’।২ পাঞ্জাবে দেশভাগের সময় কার্যতঃ জনবিনিময় ঘটে, ফলে পূর্ব পাঞ্জাবে (ভারতের পাঞ্জাব) মুসলমান জনসংখ্যা ৩৩.১% থেকে কমে দাঁড়ায় ১.৮%। ফলে আম্বেদকারের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী পাঞ্জাবে গত ৬০ বছরে হিন্দু-মুসলমান বা শিখ-মুসলমান সমস্যা আর ঘটে নি, পাকিস্তান থেকে নিয়মিত উদ্বাস্তু আগমনও আর হয়নি। বাবাসাহেবের এই উপদেশ পশ্চিমবঙ্গ শোনেনি, তাই উদ্বাস্তু সমস্যার শেষ আজও হল না, হল না ‘সাম্প্রদায়িক’ সমস্যার সমাধানও। ফলে ১৯৫১ সালের ১৯ শতাংশ সংখ্যালঘু এখন বেড়ে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতার জন্য কতটা রাষ্ট্র দায়ী আর কতটা মুসলমান সমাজের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী দায়ী তা বিতর্কিত। বামফ্রন্ট সরকার সার্বিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের দারিদ্র দূরীকরণে একেবারে ব্যর্থ, তার প্রভাব দরিদ্র মুসলমান সমাজসহ সব দরিদ্রকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এজন্য দারিদ্রকে মাপকাঠি করে যে উন্নয়নের কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন তা ধর্মনির্বিশেষে কারও জন্যই নেওয়া হয়নি। ফলে মুসলমান সমাজ যে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। যথেষ্ট সুযোগসুবিধা থাকা সত্বেও ঠিক একই অবস্থা ঘটেছে আদিবাসী ও অন্যান্য হিন্দু দরিদ্রতম মানুষদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মুসলমান সমাজের এই পশ্চাদপরতার জন্য মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে এই সংখ্যালঘু মুসলমানরাই কিন্তু ভারতে ও বাংলায় কয়েকশ বছর রাজত্ব করেছেন, ফলে এদেশে চিরকাল সংখ্যালঘুর দুরাবস্থা তাঁদের কখনোই ছিল না। এর পর দু’শ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বেও মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসনে ছিলেন না। বরং যুক্ত বাংলায় স্বাধীনতার পূর্বে মুসলিম লীগই ছিল প্রধান শাসক দল। সেজন্যই একদা-শাসক সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুসমাজের চিরকাল নিপীড়িত তফসিলি সমাজের পশ্চাদপরতার তুলনা করা চলে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত ক্ষেত্রে কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। দীর্ঘকালীন অবিশ্বাসের জন্য বাড়িভাড়া থেকে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে অনেক অসুবিধায় ভুগতে হয় তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মুসলমান সমাজের উপর শারীরিক অত্যাচার, নারীদের উপর অত্যাচার, সম্পত্তির লুণ্ঠন বা বিতাড়ন- এধরণের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে বিরল যা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ অভিঞ্জতা। এর জন্য (পরে আরো বিশদে আলোচনা করা হয়েছে) দেশভাগের প্রাথমিক ধাক্কার পর নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা চলে এসেছেন ও আসছেন।
ফলে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ তার দরিদ্র অংশের অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতি তেমন না ঘটাতে পারলেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দাপটে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই দাপটে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবস্থানকে ইতিমধ্যেই পাল্টাতে শুরু করেছেন। এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন, এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যাতে আরবি ভাষা ও ইসলামি বিষয় পড়া বাধ্যতামূলক। এর ছাত্রী ও অধ্যাপিকাদের বোরখা পরাও বেসরকারিভাবে বাধ্যতামূলক। এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে ক্রমশঃ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের শিক্ষা হয়ে উঠছে ধর্মীয় মাদ্রাসা ভিত্তিক, অন্য কোন ধর্মের এরকম আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে নেই। সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলতে উলেমা ইমামদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মুসলমান সমাজকে। সুতরাং এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বহুমাত্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের ধ্বংসের কাজ কম্যুনিস্ট, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণে শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটি ‘বিশেষ’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বললে হয়ত ভুল হবে না।
সংখ্যালঘু যেখানে সংখ্যাগুরু বিশ্বে
মনে রাখতে হবে মুসলমান সমাজের একটি আদর্শগত বিশ্ব ঐক্য রয়েছে। তার ধর্মীয় মানসে (যা মাদ্রাসা শিক্ষার ফলে আরো নিয়ত জোরদার হয়) একটি ‘উন্মা’-র ধারণা রয়েছে – – যার অর্থ একটি বিশ্ব মুসলিম সমাজ। এরকম একটি বিশ্বজোড়া ধর্মীয় সমাজের ধারণা অন্য কোন প্রধান ধর্মে নেই। ইসলামে খুব গুরুত্ব দিয়ে মানবজাতির মধ্যে মুসলমানদেরই শ্রেষ্ঠ বলে বলা হয়েছে। জনসংখ্যা অনু্যায়ী ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী, অর্থবলেও ইসলামি অনেক দেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভারতীয় বা আমেরিকান মুসলমানকে তাঁর ধর্মের জন্য সুদূর আরবে তীর্থ করতে যেতে হয়। সৌদি আরবে হজ করতে যাওয়ার সুবাদে সাধারণ মুসলমানেরও এই আন্তর্জাতিক যোগাযোগটি ঘটে। ফলতঃ একটি অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হলেও স্থানীয় মুসলিম সমাজের একটি বৃহত্তম মুসলিম সমাজের অংশ হিসেবেও অস্তিত্ব থাকে। যেমন আমরা দেখেছি যে ইসলামের খলিফার শাসন রক্ষার জন্য ভারতের মুসলমানরা বিখ্যাত খিলাফত আন্দোলন করেছিলেন এবং তার অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিলেন মোহনদাস গান্ধী। যদিও খলিফা শাসনের মূল কেন্দ্র তুরস্কেই তখন প্রগতিশীলরা সেই শাসন তুলে দেবার জন্য লড়াই করেছিলেন।
আজকের মুসলিম বিশ্ব পূর্বে এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমে আফ্রিকার আলজিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, মাঝখানে একমাত্র ভারত একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের এই বৃহত্তর মুসলিম সমাজে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অত্যন্ত দুর্বল বরং ইসলামি শরিযতী শাসনের প্রভাব মুখ্য। তুরস্কের মতন প্রায়-ইউরোপিয় ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এখন ইসলামি শাসনের দিকে এগোচ্ছে। সাধারণতঃ পৃথিবীর সব জায়গাতেই সংখ্যালঘু সমাজ কিছুটা রক্ষণশীল হয়, মনে করে স্থানীয় সংখ্যাগুরুরা তাদের বিশেষত্বকে খর্ব করতে চায়। সেজন্য তারা সামাজিক আদর্শের জন্য চেয়ে থাকে অন্যত্র তাদের সংখ্যাগুরু সমাজের উপর। গত তিন দশকে (ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে একটা শুরু ধরা যেতে পারে) বিশ্ব ইসলামি দুনিয়া ক্রমশঃ পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে। ঘরের পাশে পাকিস্তান বা বাংলাদেশও কোন প্রগতিশীল দিশা দেখাতে পারেনি। ফলে ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগও ভয়ানক সংকুচিত। এর সামগ্রিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজেও প্রবলভাবে রয়েছে ও এই সমাজও ধর্মীয় গোঁড়ামিই পছন্দ করছে।
মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখা যাক। ইরানে ইসলামি বিপ্লব হবার পর গত ত্রিশ বছরে সেখানের ইহুদী, খ্রিষ্টান বা জরথ্রুস্তপন্থী সংখ্যালঘুরা ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন হয়ে এসেছেন।৩ মিশরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিস্টানদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও (১০%) তাঁদের জনসংখ্যার সঠিক হিসেব পাওয়া দুষ্কর। বিশেষতঃ গত ৫০ বছর ধরে সেখানের ইসলামি রাষ্ট্রের কোপে পড়ে এই খ্রিষ্টান জনসমাজের ধর্মীয় মন্দির নির্মাণ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমে রয়েছে অনেক নিষেধাজ্ঞা, বারবার হয়েছে তাদের উপর আক্রমণ। ফলে খিস্টান সম্প্রদায় নিঃশব্দে দেশ ছাড়ছেন। আর আব্রাহামি ধর্ম (ইহুদী, খ্রিস্টান, ইসলাম) ছাড়া অন্য কোন ধর্মকে মিশর স্বীকার করে না ফলে মিশরের নাগরিকত্ব পেতে হলে হয় আব্রাহামি ধর্মের হতে হবে অথবা ধর্মকে উহ্য রাখতে হবে।৪ ইলসামি ধর্মান্ধতার মূল উৎস সৌদি আরবে তো ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রের সব আইনকানুন শরিয়ত মেনে চলে। মন্দির গির্জা গড়া যাবে না। এ অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের আরবশাহীর প্রায় সব দেশেই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবৈষম্যের দায়ে একসময় সারা পৃথিবী একঘরে করে রেখেছিল, ধর্মবৈষম্যের জন্য কেন যে ইসলামের পীঠস্থানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রীরা ভুলে গেলেন তা এক সপ্তম আশ্চর্য। কামাল আতাতুরক প্রভাবিত ধর্মনিরপেক্ষ সামরিকবাহিনী ও মধ্যবিত্তশ্রেণির চেষ্টায় তুরস্ক দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক না হয়েও ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখছিল, কিন্তু সম্প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে একটি ইসলামি দল তুরস্ককে ধর্মীয় সংকীর্ণতার দিকে নিয়ে চলেছে।
এই ইসলামি অভ্যুদয়ের দাপটে পশ্চিম ইউরোপে যেখানে সংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানরা বেশ কম (ব্রিটেনে ৩%, ফ্রান্সে ৮%) সেখানের সমাজও ইসলাম আতঙ্কে ভুগছে। লন্ডনের ভূগর্ভস্থ রেল, স্পেনের রেল, হল্যান্ডের চিত্রনির্মাতা (থিও ভ্যান গগ) বা লেখিকা (হিরসি আলি) সবাই আক্রান্ত। এই উন্মার এমনই মাহাত্ম্য যে আমেরিকায় একটি কোরান পোড়াবার কথা হয়েছিল, তাতেই দাঙ্গায় সুদূর আফগানিস্তানে, কাশ্মীরে বেশ কিছু লোক হতাহত, এমনকি ভারতীয় পাঞ্জাবে যেখানে মুসলমান সংখ্যা অত্যন্ত কম সেখানেও মুসলমানরা একটি চার্চ পুড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিগুলি ধ্বংসের পর কোন বৌদ্ধ প্রধান দেশে বা অঞ্চলে কোন মুসলমান আক্রান্ত হন নি, বা গুজরাতে অক্ষরধাম মন্দির আক্রান্ত হলে তামিলনাডু বা পশ্চিমবঙ্গে কোন মসজিদ আক্রান্ত হয় নি।
এবার আমরা প্রাচ্যের দুটি দ্রুত উন্নয়নশীল মুসলিম দেশের দিকে নজর ঘোরাতে পারি যদিও মুসলমান ভাবজগতে এদের কোন প্রভাব নেই। মুসলিম ভাবনা যেহেতু এখনও আরবদুনিয়া-কেন্দ্রিক, এজন্য ইসলামি উম্মাকে অনেকে আরব সাম্রাজ্যবাদ বলেন। মালয়েশিয়া তিন দশক আগেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছিল না, এখন মুসলমানরা জনসংখ্যায় ৬০ শতাংশ। ৪০% মানুষ অমুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। শুধু তাই নয় মালয়েশিয়ার সংবিধানের ১৬০ ধারা অনুযায়ী সব মালয় জনগোষ্ঠীর লোককে মুসলমান হতেই হবে এবং তাদের বিচারব্যবস্থা চলবে শরিয়তি আইন মেনে। অন্য ধর্মগুলি কোন মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না কিন্তু মুসলমানরা তা পারবে।৫ দিনে দিনে তাই সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা পারলে দেশ ছাড়ছেন। ৯০% মুসলিম ইন্দোনেশিয়া অনেকটা গণতন্ত্রী তবে বালি দ্বীপে থাকা মাত্র ৩% একেবারে নীরব হিন্দুদের মন্দিরের উপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে আক্রমণ হয়েছে কয়েকবার।৬ ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন ব্যবসার মূল আকর্ষণ বালি দ্বীপের উজ্জ্বল সংস্কৃতি যেখানে এখনো ভারতীয় তথা হিন্দু প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে এবং সেই সুবাদে বালির হিন্দুদের অস্তিত্ব এখনও রয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় যে ইসলামের বিশ্ব সমাজে মুক্ত বহুত্বমুখী গণতান্ত্রিক চিন্তার কোন দিশা কোথাও আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না। বরং আমেরিকা-ইউরোপে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা বজায় রাখার নাম করে ইসলামি গোঁড়ামি আরো জাঁকিয়ে বসেছে আর তাকে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের নামে সবচেয়ে সমর্থন জানাচ্ছেন বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রীরা। যাঁরা জেসাস খ্রাইস্ট সুপারস্টার নাটক চালিয়ে যায় বছরের পর বছর, নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগো লেখেন গসপেল এর্কডিং টু জেসাস খ্রাইস্ট-এর মতন উপন্যাস, সেই সমাজের বুদ্ধিজীবিরা হজরত মহম্মদ নিয়ে বিন্দুমাত্র ঠাট্টা-তামাসার বিরোধী, সেখানে ইসলামের সমালোচনা করে চিত্রনির্মাতা খুন হলেও তেমন প্রতিবাদ চোখে পড়ে না।
প্রতিবেশী
এবার দেখা যাক আমাদের একেবারে কাছের প্রতিবেশী দেশগুলির অবস্থা। আমাদের প্রতিবেশী বলতে এখন সার্ক-ভুক্ত (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন) ৮টি দেশকে ধরা যেতে পারে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান, আফগানিস্তান। এর মধ্যে ৪টি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক।
আফগানিস্তান সরকারিভাবেই একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র, এর আইন কানুন চলে কট্টর ইসলামি রীতিনীতি মেনেই। একদা বৌদ্ধ দেশে এখন ৯৯% মানুষ মুসলমান। তবু হাতে গোনা কয়েকটি শিখ পরিবার অত্যাচার থেকে বাঁচে না, বাঁচে না পাথরের বুদ্ধমূর্তিও। দেশের অনেকাংশ ইসলামি তালিবানদের অধীনে।
পর্যটকদের প্রিয় মালদ্বীপ সম্পূর্ণ ইসলামি দেশ। এখানে অন্য কোন ধর্মচর্চা নিষেধ। এমনকি মালদ্বীপের কোন নাগরিক অন্য কোন ধর্ম গ্রহণও করতে পারেন না। এবছর, ২০১০ সালে, ইসমাইল মহম্মদ দিদি নামক একজন মালদ্বীপের নাগরিক নাস্তিক জানতে পেরে সরকার তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। সে বেচারা প্রথমে লন্ডনে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চায় ও পরে আত্মহত্যা করে।৭
পাকিস্তান একটি ঘোষিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পাকিস্তানের ভিত্তিই হল ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব দেশের স্থাপনা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৯৬% মুসলমান, ১.৫% খ্রিস্টান ও ১% হিন্দু। জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানকে আরো ইসলামিকরণের পথে নিয়ে যান। হুদুদ অর্ডিনান্স জারী করে মুসলিম সম্প্রদায়কে শরিয়তি আইনের অন্তর্গত করেন। এর কিছু ধারায় অমুসলমানরাও অন্তর্গত হয়। ১৯৮০ সালে জারী হয় ব্লাসফেমি আইন যার দ্বারা হজরত মহম্মদ বা ইসলাম সম্পর্কে কোনরকম অবমাননা নিষেধ করা হয়। এছাড়া ইসলাম প্রচার-প্রসারে রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকে। এর ফলে পাকিস্তান এখন বিশ্ব ইসলামি সন্ত্রাসবাদের অন্যতম কেন্দ্র বলে গণ্য করা হয়। এই সর্বব্যপী ইসলামি প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র খ্রিস্টান ও প্রায় নিঃশেষিত হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি সৌধ ধ্বংসের পর পাকিস্তানে হাতে-গোনা কয়েকটি রয়ে-যাওয়া হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হয়।
আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র কিন্তু তার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মুসলমান ৯০%, হিন্দু ৯%। বাংলাদেশ বারবার সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেলেও এর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বারবার ফিরে এসেছে। সরাসরি সংখ্যালঘু বিরোধী আইন না থাকলেও পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও অর্থনীতিকে ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ হবার পর এই আইন নাম বদলে হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ (Vested Property Act) এবং এই আইনে একই ভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল চলে। এই আইনের ফলে বিপুল হিন্দু জমি ও সম্পত্তি দখল হয়। এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক আবুল বরকত এবং এই অসাধারণ গবেষণার জন্য তিনি এখন বিশ্বখ্যাত।৮ এছাড়া পূর্ব-পাকিস্তান আমলের মতন ধারাবাহিক হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর শারীরিক আক্রমণ, ধর্মস্থান ধ্বংস, নারীদের লাঞ্ছনা, জমি ও সম্পত্তি লুণ্ঠন অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার পর (সে সময় ধ্বংস হয়নি, কয়েকশো লোক তার ওপর চড়ে বসে) সারা বাংলাদেশ জুড়ে দাঙ্গা হয়। বাঙ্গালী মুসলমানেরা হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেই ক্ষান্ত থাকেনি, হিন্দুদের দোকান-বাড়ি-ঘর লুট করা, এমনকি ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম ভাঙচুর ও তছনছ করে। ১৯৯২-এ ভারতে (মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গের কোন মসজিদ ভাঙার জন্য নয়) বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যে ভয়ঙ্কর তান্ডব চলে তাতে ২৮,০০০ বাড়ি-ঘর, ৩,৬০০ মন্দির, ২,৫০০ দোকান-বাজার ধ্বংস হয়। খুন হন ১৩ জন।৯ ২০০১-এ বেগম জিয়ার নির্বাচনের পর থেকে শুরু হয় ধারাবাহিক সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন।১০ এর ফলে ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ, ১৯৭৪-এ ১৩.৫% ও ২০০১ সালে ৯.২ শতাংশ নেমে এসেছে, ২০১১-র জনগণনায় সম্ভবতঃ তা নেমে দাঁড়াবে ৭-৮ শতাংশে। অধ্যাপক বরকত তাঁর বইয়ে হিসাব করে বলেছেন যে ১৯৭১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ৬৩ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে উধাও হয়ে গেছেন। ‘১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ এ এই নিখোঁজ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৭০৫ জন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ তে প্রতিদিন গড়ে ৫২১ জন ১৯৮১-১৯৯১ এ প্রতিদিন গড়ে ৪৩৮ জন এবং এই সংখ্যাটি অনেক বেড়ে ১৯৯১ থেকে ২০০১ এ দাঁড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭৬৭ জন।১১ এই উদ্বাস্তু আগমন এখনও রোজ চলছে। বাংলাদেশের আরেকজন গবেষকের অধ্যয়নে বিষয়টিকে এ ভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে যে ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।১২
এবার দেখা যাক প্রতিবেশী চারটি অ–মুসলমান দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের কি অবস্থা।১৩
শ্রীলঙ্কা একটি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানের ৭০% বৌদ্ধ, ১৫% হিন্দু ও ৮% মুসলমান। এখানে কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই। সব সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন (বিবাহ, সম্পত্তি) ছাড়া আইনে ধর্মের কোন স্বীকৃতি নেই। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
নেপাল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র। এর কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানের ৮০% হিন্দু, ১১% বৌদ্ধ, ও ৭% মুসলমান। এখানে কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই। নেপালের সংবিধানের ২৩ তম ধারায় সব ধর্মাচারণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু যে কোন ধর্মান্তরকরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
ভুটান একটি রাজতন্ত্র যদিও তা গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরী ও নির্বাচনের জন্য অনেকগুলি পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে ৯০% বৌদ্ধ ও ১০% হিন্দু। ভুটানে কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই ও সব ধর্মের সমানাধিকার রয়েছে। তবে ভুটান সরকার ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিচ্ছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
ভারত তার সংবিধান অনুযায়ী একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এখানে কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। ২০০১-এ জনসংখ্যার ৮০.৬% হিন্দু ও ১৩.৪% মুসলমান। আইনগতভাবে এখানে কোন ধর্মাচরণে কোন বাধা নেই। ভারতে জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুপাত ১৯৫১ সালে ১০.৪% থেকে বেড়ে ২০০১ সালে ১৩.৪% হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই বৃদ্ধি আরো অনেক বেশী। বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুন্নত অংশের জন্য সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতকে নিয়ে প্রতিবেশী ৮টি দেশের ৪টি মুসলমানপ্রধান দেশেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সে সব দেশেই ইসলামি ধর্মীয় আইনের কড়াকড়ি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি ২টি হিন্দুপ্রধান ও ২টি বৌদ্ধপ্রধান দেশের সরকারি ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব অনুপস্থিত। মুসলমান প্রধান ও অপ্রধান দেশের পার্থক্য এখন নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত।
মুসলিম সংখ্যাসগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ
দেশ রাষ্ট্রধর্ম আইনী বিধিনিষেধ বিশেষ ব্যবস্থা
আফগানিস্তান ইসলাম ইসলামি মতে আইন অন্য ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই
মালদ্বীপ ইসলাম শরিয়তি আইন মালদ্বীপের নাগরিক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মও গ্রহণ করতে পারেন না।
পাকিস্তান ইসলাম হুদুদ অর্ডিন্যান্সের দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায় শরিয়তি আইনের অন্তর্গত ব্লাসফেমি আইন যার দ্বারা হজরত মহম্মদ বা ইসলাম সম্পর্কে কোনরকম অবমাননা নিষিদ্ধ
বাংলাদেশ ইসলাম অর্পিত সম্পত্তি আইনে হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল ধর্মীয় অত্যাচার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্রুত হ্রাস
অ-মুসলিম সংখ্যাসগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ
দেশ রাষ্ট্রধর্ম আইনী বিধিনিষেধ বিশেষ ব্যবস্থা
শ্রীলংকা
নেই
কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই
ভারত
নেপাল ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ
ভুটান ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ
ইসলামি বিশ্বে বা প্রতিবেশী মুসলমানপ্রধান দেশে যে সম্প্রদায়ের কোন ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র খুঁজে পাওয়া ভার, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেই সমাজের মূলধারার কাছে অন্য কোন ভাবনা আশা করার কোন কারণ থাকতে পারে না। মুসলমান সমাজের এই বিশ্ব ও প্রতিবেশী অবস্থানকে মনে রেখে আমরা এবার পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থানের পর্যালোচনা শুরু করতে পারি।
শিক্ষা
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানের সামগ্রিক পশ্চাদপরতা এবং তার উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা নিয়ে এই লেখকের কোন দ্বিমত নেই। একজন হিন্দু বা খ্রিস্টানের ক্ষেত্রে এরকম অবস্থায় যেসব কর্মকান্ডের প্রয়োজন একজন মুসলমানের ক্ষেত্রে তা অন্যরকম হবার কোন কারণ নেই। একটি সমাজের পশ্চাদপরতার অন্যতম কারণ শিক্ষা। শিক্ষার অগ্রসরতার জন্য প্রয়োজন অনেক বিদ্যালয়। কিন্তু সব ধর্মের শিশুদের জন্য বিদ্যালয় দরকার হলেও সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য নাকি চাই মাদ্রাসা। আমাদের আগমার্কা কমুনিস্ট সরকারের এটা গর্বের বিষয়। তাদের সর্বশেষ পুস্তিকায় এই সাফল্যের কথা বিস্তারিত জানানো হয়েছে – ১৯৭৭ সালে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ৪৩৮৮, তা ২০১০-এ বেড়ে হয়েছে ৪,৫০,০০০, ১০০গুণ বৃদ্ধি! টাকা খরচ বেড়েছে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার থেকে ৬১০ কোটি!১৪ এই মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কতিপয় মুক্তমনা মুসলমান যেমন গিয়াসুদ্দিন (ধর্মমুক্ত মানবতাবাদী সংগঠন) লেখেন ‘মুসলিম সমাজ আজ যে সবচেয়ে বেশী পশ্চাৎপদ তার অনেকাংশে দায়ী এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এবং মুসলিম সমাজের মাদ্রাসা সংস্কৃতি’।১৫ আর মাদ্রাসার পক্ষে থাকে সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস থেকে তাবৎ নকশাল বা এপিডিআর-এনজিওরা এবং নীরব সমর্থক বুদ্ধিজীবি/বিদ্বজ্জনেরা। এখন তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সিপিএমের মধ্যে মাদ্রাসা স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলেছে অথচ বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মুক্তমনা মানুষেরা সবাই এর বিরুদ্ধে।
মাদ্রাসায় আপত্তি কিসের? অন্য কোন ধর্মের যখন আলাদা এরকম সরকার-স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা নেই তখন হঠাৎ মুসলমানদেরই বা থাকবে কেন? রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্রছাত্রীরা কোন হিন্দু বা খ্রিস্টান শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে পড়াশোনা করে না, তারা রাজ্যের বা কেন্দ্রিয় কোন অধর্মীয় বোর্ডের সিলেবাসেই পড়াশোনা করে। তাহলে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের কোন পাপের জন্য তাদের মধ্যযুগীয় কারাগারে পাঠাতে তৃণমূল সিপিএম থেকে নকশালরাও একপায়ে খাড়া? এখানেই শুরু সমস্যার। এই মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয়? সাধারণ স্কুলের পাঠক্রম ছাড়া এতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আরবি ভাষা, ইসলাম পরিচয়, কোরান, হাদিস, আকায়িদ, ফিকাহ, ফারায়েজ, মুসলমান মনীষীদের কথা ইত্যাদি। এসব তারা পড়বে দশ বছর ধরে, একেবারে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত।১৬ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাদ্রাসা বোর্ডের ওয়েবসাইটে পাঠ্যক্রমের এই ইসলামি বিষয়গুলি দেওয়া নেই, এ এক ধরণের ভয়ানক কমুনিস্ট ভন্ডামী ও মিথ্যাচার। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যই একজনকে ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে শিক্ষিত করে পুরোপুরি মুসলমান তৈরী করা। সারা বিশ্বের ও প্রতিবেশী মুসলমান দেশগুলির উদাহরণ জানার পর এই মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে আমরা কি গণতন্ত্র, পরধর্মসহিষ্ণুতা, আশা করতে পারি? না, পারি না। বামপন্থী সরকারের মূলতঃ উচ্চবর্ণের নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইংরাজি শিখিয়ে দরিদ্র জনতাকে ইংরাজি ভুলিয়ে সমাজে যেমন দুটি স্তর তৈরী করছে – তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষা আরবি-জানা ও না-জানা দুধরণের বাঙালি তৈরি করছে। অথচ একজন বাঙলি মুসলমানের আরবি জানার কোন দরকার নেই, কারণ কোরান হাদিস সবই বাংলায় পাওয়া যায়।
এই ভয়াবহ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারণ ঘটেছে কলকাতায় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে যেখানে মাদ্রাসার মতন আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসলামি রীতি মেনে ছাত্রীদের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদেরও বোরখা পরার ফতোয়া জারী করেছে মাদ্রাসা ছাত্র সংগঠন। মুসলিম শিক্ষিকা শিরিন মিদ্যা তা মানতে অস্বীকার করায় তাঁকে ক্লাস নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এই সংবাদ প্রকাশের পরও আজ পর্যন্ত কোন নারী সংগঠন, প্রধান ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, রোজ টিভি-সংবাদপত্র আলো করা বুদ্ধিজীবি/বিদ্বজ্জন কোন আন্দোলন তো দূরের কথা –- এর প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নি। মাদ্রাসা শিক্ষিত এই সংখ্যালঘু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা।
নেতৃত্ব
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের এখনও কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল নেই। জনসংখ্যায় কেরালার মতন মুসলমানদের অনুপাত হলেও দেশভাগ, মুসলিম মধ্যবিত্তের অনুপস্থিতি ও ধনী বাঙলি মুসলমান গষ্ঠীর অভাবে এখানে মুসলিম লীগের মতন কোন দলের প্রভাবশালী উপস্থিতি এখনও নেই। এই অভাবটা মুসলমান ধর্মীয় নেতৃত্ব অবস্থা মতন কংগ্রেস ও সিপিআইএমের মধ্য দিয়ে মিটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কংগ্রেস ও সিপিআইএম (সব কমুনিস্টদেরও ধরা যেতে পারে) মুসলমান ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধিতায় কোন রকম সমাজ সংস্কারের চেষ্টাটুকুও করে নি। এর বড় কারণ অবশ্য ভোট। ফলে ৩২ বছরের কমুনিস্ট রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজ তার নিজস্ব ধর্মীয় আবহেই রয়েছে। পরিবর্তনের হাওয়ায় বঞ্চিত মুসলমান সমাজ এখন সিপিইএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে আর তার নেতৃত্ব দিচ্ছে কয়েকজন ইমাম। কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বা ফুরফুরা শরীফের ইমাম এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ইসলামি মুখ। এই ইমামরাই যখন তসলিমা নাসরিনের সব রকমের বেআইনী ফতোয়া জারী করেছিলেন তখন সিপিআইএম ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা তাঁদের নীরব সমর্থন করেছেন। তসলিমা সংক্রান্ত মামলা যখন কলকাতা উচ্চ আদালতে চলতো তখন একদল মাদ্রাসা ছাত্র আরবি পোষাক পড়ে বিক্ষোভ দেখাত। এই মুসলিম শক্তি তসলিমা নাসরিনকে মেদিনীপুরে কবিতা পাঠ করতে দেয় নি, শিলিগুড়িতে বইমেলা উদ্বোধন করতে দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের কবিকুল, বুদ্ধিজীবি (তখনও বিদ্বজ্জনেদের জন্ম হয় নি), নারী সংগঠনেরা মজা দেখেছেন। মনে রাখতে হবে আজকের পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের ঝড় প্রথম তোলেন মুসলিম ধর্মীয় দল জামাতে উলেমা হিন্দের জনাব সুদ্দিকুল্লা। সুঙ্গুরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ও মমতা দেবীর ২৬ দিনের অনশনের পরও কোন অগ্রগতি হয় নি। ২৯ শে ডিসেম্বর ২০০৬-এ ২৫ দিন পর যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে অনশন বন্ধ করেন তখনও পরিবর্তনের কথা শোনা যেত না। অনশন শেষের ৫ দিন পরে ৩ জানুয়ারি ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে জমি জরীপ করবার সরকারি দলের উপর আক্রমণ চালায় জামাতে উলেমা হিন্দের কর্মীরা। পুলিশের জীপে আগুন ধরানো হয়, রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। এই প্রথম জমি রক্ষার জন্য হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্দিকুল্লা। এই শুরু ঘুরে দাঁড়ানো, এতে পুলিশ কর্মী খুন হন, দলেদলে সিপিএম সমর্থকরা ঘরছাড়া হন। পরে এই আন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে চলে যায় যদিও এজন্য সিদ্দিকুল্লা সাহেব তাঁর দল নিয়ে এই আন্দোলনে পৃথক হয়ে যান। সবশেষে একদা কংগ্রেস বর্তমানে তৃণমূল নেতা ইদ্রিস আলির নেতৃত্বে ২১ নভেম্বর ২০০৭ সালে তসলিমা বিতাড়নের দাবীতে এই মুসলিম জনতার সারাদিন ধরে কলকাতায় তান্ডব সব রাজনৈতিক দল নীরবে সমর্থন করেছে ও এই মৌলবাদী দাবী মেনে সিপিআইএম তাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহিষ্কার করেছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি মৌলবাদী সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত, মাদ্রাসা শিক্ষা তাকে আরো দিনদিন জোরদার করবে। কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন একটি সাম্প্রদায়িক কেন্দ্র স্থাপনের পর কেরালার মতন একটি মুসলিম দল তৈরি হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের গতিপথ মধ্যপ্রাচ্যের পথেই। পরিবর্তনের পর এর আসল মেজাজ টের পাওয়া যাবে।
মুসলমান জনসংখ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব
১৯৪৭ সালে অ–মুসলিমপ্রধান রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরী হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার সমস্ত অ–মুসলিম সদস্যরা, এমনকি কমুনিষ্টরাও ভাঙাচোরা পশ্চিমবঙ্গের স্বপক্ষেই ছিলেন। অমুসলিমপ্রধান অঞ্চলের সদস্যরা ৫৮-২১ ভোটে বাংলাভাগের পক্ষে ও পাকিস্তানে যোগদানের বিপক্ষে ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠন সুনিশ্চিত করেন।১৭ কমিউনিষ্ট সদস্যদের একজন ছিলেন শ্রী জ্যোতি বসু। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের একটি প্রধান সর্ত অ–মুসলিম জনসংখ্যার প্রাধান্য। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ এই দশ বছর বাংলার মুসলমান গরিষ্ঠ জোট সরকারের শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও তিরিশ বছরে একের পর এক দাঙ্গা ও নোয়াখালীর বিভীষিকাময় গণহত্যা বাঙালী হিন্দুকে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করে দেয়।১৮ মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ কোন হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অ–মুসলিমপ্রধান রাজ্য হতে চায় নি, চেয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশের অংশ হতে। এই চাওয়াটি যে যথেষ্ট সঙ্গত হয়েছিল তা আমাদের প্রতিবেশী ও বিশ্বের মুসলমান প্রধান দেশগুলির উদাহরণ দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে আলোচনা একেবারেই নিষিদ্ধ। এর ফলে গত ষাট বছরে, বিশেষতঃ গত ত্রিশ বছরে যে পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জন-মানচিত্রটি দ্রুত বদলে গেছে ও বদলাচ্ছে তা নিয়ে কোন আলোচনা একাডেমিক মহলেও প্রায় হয় না। (এ নিয়ে বিশদ আলোচনা দেখুন – অনুপ্রবেশ, অস্বীকৃত উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত অস্তিত্ব – মোহিত রায়, অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০০৯)।১৯ পূর্ব পাকিস্তান / বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী ভারতে (পশ্চিমবঙ্গে সিংহভাগ) এলেও পাটিগণিতের হিসেব উল্টে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত বেড়ে চলেছে। একবার হিসেবটা দেখে নেওয়া যাক।
পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় জনসংখ্যা শতাংশে (%)
১৯৫১ ১৯৬১ ১৯৭১ ১৯৮১ ১৯৯১ ২০০১
হিন্দু
মুসলমান৭৮.৪৫
১৯.৮৫৭৮.৮০
২০.০০৭৮.১১
২০.৪৬৭৬.৯৬
২১.৫১৭৪.৭২
২৩.৬১৭২.৪৭
২৫.২৫
এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের জনমানচিত্রের ভবিষ্যৎ কি? কোন বক্তব্যে না গিয়ে সোজা অংকে চলে যাওয়া যাক। হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাসের বর্তমান হার বজায় থাকলে রেখ-চিত্রের মাধ্যমে আগামী দিনের সম্ভাব্য জনসংখ্যা পরিস্থিতির তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এই রেখচিত্র দেখাচ্ছে যে ২০৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার ৫০%-এর কম হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যা
সাল জনসংখ্যার %
১৯৭১ ৭৮.১১%
১৯৮১ ৭৬.৯৬%
১৯৯১ ৭৪.৭২%
২০০১ ৭২.৪৭%
পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাব্য হিন্দু জনসংখ্যা
সাল জনসংখ্যার %
২০১১ ৬৯.২৮
২০২১ ৬৫.৬৬
২০৫১ ৫১.৪৪
২০৫৩ ৪৯.৭৪
art
ঘটনাটি অবশ্য ২০৫৩-র অনেক আগেই ঘটবে কারণ ২০০১-এ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা যখন ২৫.২%, তখন তাঁদের শিশুদের (০-৬ বছর) সংখ্যা ৩৩.১৭%! ফলে নতুন প্রজন্মে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনামূলক হার আরো বেড়ে যাবে। এই হল আগামীদিনের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের চিত্র।
মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি রাজ্যে শুধু মুসলিম ভোটারই বৃদ্ধি করেনি, এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পুরস্কার হিসেবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নির্বাচনী কেন্দ্রেও বেড়ে গেছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে নতুন করে নির্বাচনী এলাকা ঠিক হওয়ার পর, কলকাতায় বিধানসভা কেন্দ্র কমে ২১ থেকে হয়েছে ১১। হিন্দু-অধ্যুষিত পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কমেছে দুটি করে কেন্দ্র, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম ও হুগলীতে একটি করে। আর বেড়েছে সীমান্তের মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে ৩টি, উত্তর দিনাজপুর ও নদীয়ায় ২টি করে আর মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুরে ১টি করে। খুব পরিষ্কার চিত্র – সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নির্বাচনী কেন্দ্র বেড়ে গেছে।
মুসলমান-প্রধান পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গ মুসলমান-প্রধান হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বেরই কোন প্রয়োজন থাকে না। যেমন কমুনিস্ট শাসন উঠে গেলে পূর্ব জার্মানির অস্তিত্বের আর প্রয়োজন থাকেনি বা কমুনিস্ট শাসন উঠে গেলে দুই কোরিয়া এক হয়ে যাবে একদিনেই। মুসলিম-প্রধান রাজ্য হলে কি হয় তার কিছু দেশীয় নিদর্শন আমাদের হাতের কাছেই আছে। মুসলমান-প্রধান পাকিস্তান থেকে প্রায় সব হিন্দুই বিতাড়িত। মুসলমান-প্রধান পূর্ব পাকিস্তান / বাংলাদেশ হিন্দু জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতে মুসলমান-প্রধান কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সব হিন্দু বিতাড়িত।
এ প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে-যাওয়া তফসিলি সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার অভিজ্ঞতা দেখা যাক। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন বাংলার তফসিলি জাতিদের প্রধান নেতা, যিনি তফসিলি জাতি ও মুসলমান ঐক্যে বিশ্বাসী ও প্রচারক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান গঠনের পক্ষে ছিলেন ও তফসিলি সমাজকে পাকিস্তানেই থাকতে বলেছিলেন। দিল্লিতে ৫ নভেম্বর ১৯৪৬এ এক জনসভায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন ‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত জীবন যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোন জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সহিত বাস করিতে তফসিলি জাতি বেশী পছন্দ করে’।২০ দেশভাগের পর তাঁকে সসম্মানে পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের পাকিস্তানে হিন্দুবিরোধী (তফসিলি-সহ) দাঙ্গার পর মুসলিম লিগের কাছের মানুষ এই মন্ত্রীমশাইকে তিন বছরের মধ্যেই কল্পিত স্বর্গরাজ্য ছেড়ে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ হিন্দুস্থানে পালাতে হয় এবং হিন্দুস্থানে থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। ১৯৫০ সালের ৮ই অক্টোবর, পাকিস্তানের লিয়াকত আলি খান সরকারের আইন ও শ্রম মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগ পত্রে যোগেনবাবু লেখেন –
‘আমার পক্ষে এটা বলা অন্যায্য নয় যে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিজভূমি পরবাসী’ করা হয়েছে, আর এটাই এখন হিন্দুদের কাছে পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করাটাই এদের একমাত্র অপরাধ। …….সুদীর্ঘ ও উদ্বেগময় সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত আমাকে একথাই বলতে হচ্ছে যে পাকিস্তান আর হিন্দুদের বাসযোগ্য নয়। তাঁদের ভবিষ্যতে প্রাণনাশ ও ধর্মান্তরকরণের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হিন্দু ও রাজনৈতিক সচেতন তফসিলি জাতির লোকেরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সমস্ত হিন্দুরা এই অভিশপ্ত দেশে অর্থাৎ পাকিস্তানে থেকে যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের মুসলমানে পরিণত করা হবে বা নিশ্চিহ্ন করা হবে’।২১
সাম্প্রতিক কালে উদ্বাস্তু মতুয়া সমাজের কথা পত্র পত্রিকায় আলোচিত হচ্ছে। তফসিলি সমাজের একটি বড় জনগোষ্ঠী এই ধর্মীয় সংঘের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের শ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত প্রথমরঞ্জন ঠাকুরকে (এঁনার স্ত্রী এখন বড়মা বলে পরিচিত) পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়ে বনগাঁর কাছে বর্তমান ঠাকুরনগরে বসবাস শুরু করেন। দেশ ছাড়ার আগে তিনি শেষ জনসভা করেন নড়াইলের জমিদারবাড়ীর প্রাঙ্গণে। সেখানে মতুয়া ভক্তবৃন্দদের বলেন – “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করায় দেশ খন্ডিত হবার পথে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে আবার আমাদের দাঙ্গার সম্মুখীন হতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন আমাদের কী করনীয়? নিঃসন্দেহে আমরা বিশাল হিন্দু সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই সংকটময় মুহূর্ত তফসিলিদের নিজেদের স্বার্থে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু সমাজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মূল কান্ড থেকে কোন শাখাকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে সেটি অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। স্বধর্মের কোটি কোটি হিন্দুর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে লীগের বন্ধুত্ব অচিরেই তফসিলি জাতির বিপদ ডেকে আনবে। আপাত উন্নতির মোহে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মিঃ জিন্নাহর মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন পরিণামে অপরিসীম ক্ষতি ডেকে আনবে।” ……
“কিছুদিনের মধ্যে দেশভাগ হয়ে যাবে। দেশভাগের ফলে আমাদের জন্মভূমি যদি পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে, আমরা যেন সকলে এক থাকি। ফেডারেশন ও লীগের কথায় না ভুলি। ভারতভূমিতে আমরা যেন সকলে এক সাথে চলে যেতে পারি। আমর অনুপস্থিতিতে আপনারা যেন সংঘবদ্ধ থাকেন এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করেন যা আমি আগেই আপনাদের বলেছি”।২২
যে সমাজের সর্বোচ্চ নেতাকে মুসলিমদের অত্যাচারের জন্য নিজের বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয় ও যিনি পরিষ্কারভাবে তার ভক্তদের প্রতি তার বক্তব্য রেখে গেছেন – আজ সেই মতুয়া সমাজের কিছু নেতা বাংলাদেশের ইসলামি অত্যাচার নিয়ে ন্যূনতম কথাও বলেন না, বরং সভা করে দলিত-মুসলিম ঐক্যের প্রচার চালান। আজকে যারা মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের উপর বামফ্রন্টের অত্যাচারের জন্য চেঁচামিচি করছেন তারা ভুলেও বলেন না যে এঁরা আদৌ উদ্বাস্তু কেন হলেন।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ধর্মীয় শাসনের বাঁধন বেশ প্রবল। মুর্শিদাবাদে শরিয়তী আদালত খুবই চালু। এখানে ইসলামি মেজাজ এতই প্রবল যে ২০০৮-এর জুলাই মাসে একটি শরিয়তী আদালত একটি হিন্দু যুবককে মৃত্যুদন্ড দেয় ও তার মাথা কেটে তা কার্যকরী করে। এই যুবকের সাথে স্থানীয় একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে মুম্বাইতে পরিচয় হয়। মুসলিম মেয়েটি মুম্বাইতে কাজে গিয়েছিল, তারা বিয়ে করে ও তাদের একটি পুত্রসন্তান আছে। যখন এই দম্পতি মেয়েটির গ্রামে বেড়াতে আসে তখন এই ছেলেটির ধর্মপরিচয় জেনে গ্রামের শরিয়তী আদালত তাকে হত্যা করে।২৩ এটা কোনও সৌদি আরব বা পাকিস্তানের ঘটনা নয়, প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা।
দেগঙ্গা – নীরবতাই পথ?
জনসংখ্যা, মাদ্রাসা, বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১ কোটি নাগরিকত্বহীন উদ্বাস্তু, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শিরিন মিদ্যা – এসব নিয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব ধরণের মিডিয়া, পত্রপত্রিকা, সদা-বিপ্লবী লিটল ম্যাগাজিনের এমনকি ভারত সেবাশ্রম, রামকৃষ্ণ মিশন, লোকনাথ আশ্রমসহ তাবৎ হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলিও। শুধু নীরবতা নয়, এ নিয়ে নীরবতা ভাঙার চেষ্টাও অপরাধ। ফলে সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে একেবারেই কিছু জানতে পারেন না। ফলে কখনও সাধারণ আড্ডায় এসব প্রসঙ্গ উঠলে নিত্য কালিঘাট যাওয়া ভক্ত বন্ধুও মনে করেন যে এসব দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা হিন্দুত্ববাদী অতিরঞ্জিত প্রচার। একেবারে একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলা যাক।
কলকাতা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে দেগঙ্গা, বারাসত থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার। ৬,৭,৮ সেপ্টেম্বর তিন দিন ধরে দফায় দফায় দাঙ্গা চলে দেগঙ্গা অঞ্চলে। ৮ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে ‘পুড়ল ৫০টি বাড়ি ও দোকান। …৩০০টি দোকান ও বাড়িতে চলল ভাঙচুর’।২৪ সেনাও নামান হল। ৮ সেপ্টেম্বর সেনা টহলের মধ্যে লুঠ চলে।,২৫, ২৬ এরপর থেকে চলল নীরবতা। কারা আক্রান্ত হলেন? কাদের বাড়ি-দোকান পুড়ল? না কোন বাংলা পত্রিকাতেই এনিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না। এতবড় ঘটনা, মিলিটারি নামলো, কলকাতার এত কাছে – না – কোন বিদ্বজ্জন / বুদ্ধিজীবি, আগুনঝরানো মানবাধিকার নেতা / এনজিও একটি শব্দও করেন নি। এমনকি টিভি-মিডিয়া যারা খবরের অভাবে প্রায় বাড়ির ভাইয়ে ভাইয়ে পারিবারিক ঝগড়ারও লাইভ কভারেজ করে তারাও কলকাতার এত কাছের সার সার ভাঙা বাড়ি পোড়া দোকানের বা আক্রান্তদের কোন ছবিই দেখাতে সাহস করলেন না। প্রায় একমাস পর ৫ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে যে ক্ষতিগ্রস্ত ১৬৭টি পরিবারের হাতে ১ কোটি টাকার অর্থ সাহায্য তুলে দিল সরকার।২৭ ১ কোটি টাকা! কারা পেলেন এত টাকা? না, তাও কাগজ জানায় নি। কেন এত নীরবতা? কারণ ক্ষতিগ্রস্তরা সবাই হিন্দু। আক্রমণকারীরা সবাই মুসলমান। দাঙ্গা নয়, পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতন দেগঙ্গায় হয়েছে একতরফা মুসলমানদের আক্রমণ। দেগঙ্গায় হিন্দুসমাজের মন্দির, মুর্তি, দোকানঘর, বাসগৃহের ওপর মুসলমান জনতার এসব আক্রমণের খবর কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার বাইরে থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ইংরাজি সংবাদপত্রে (যাদের দুএকটির কলকাতা সংস্করণ রয়েছে)। এমনকি দেগঙ্গার খবর এখন বিশ্বজুড়ে প্রচারিত কারণ ইন্টারনেটের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য অয়াইকিপিডিয়াতেও দেগঙ্গার দাঙ্গা নিয়ে আলাদা খবর রয়েছে।২৮ এরপর ঘটল আরো বড় ঘটনা, দেগঙ্গা অঞ্চলের ১৮টি দুর্গাপূজা কমিটি এবার পূজা করল না। পূজা হুজুকের পশ্চিমবঙ্গে কোথাও পূজা হচ্ছে না (বাংলাদেশে যা আকছার হয়) এতবড় একটা খবর কোন বাংলা কাগজ তা ছাপাল না, ছাপাল একমাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।২৯ (অন্য একটি খবর অনুযায়ী সংখ্যাটি ৩১)। ১৪ অক্টোবর খোদ কলকাতায় মেট্রো চ্যানেলে দেগঙ্গার পূজা কমিটিরা কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করলেন, তাও কোন কাগজে এল না। অর্থৎ, এখন পশ্চিমবাংলার খবরের জন্য নির্ভর করতে হবে পশ্চিমবাংলার বাইরের মিডিয়ার ওপর, একসময় যেমন সারা উপমহাদেশ নির্ভর করত ‘বিবিসি’র ওপর। ইসলামি পশ্চিমবঙ্গ আর সীমান্ত এলাকার গপ্পো নয়, খোদ কলকাতায় ২১ নভেম্বর ২০০৭-এ তসলিমা বিতাড়নের পর আবার কলকাতার কাছেই দেগঙ্গা জানিয়ে দিল কারা সংখ্যালঘু ও সংখ্যালঘুরা কিভাবে থাকবেন। মনে রাখতে হবে ১৯৯১-র জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী দেগঙ্গা ব্লকে ৬৭.৫% মুসলমান, ২০১০-এ সংখ্যাটা যে আরো বেশি তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
নীরবতা আর স্বর্ণালী নয়, নীরবতা মানে আগামী দিনের বিভীষিকাকে মুখ বুজে আমন্ত্রণ জানানো।
কি করবেন?
সুতরাং মুসলিম দুনিয়াকে অনুসরণ করে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ হয়ে উঠেছে আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গের চালিকা শক্তি। এখন পর্যন্ত সে শক্তির আদর্শগত উপাদান মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সংস্কার। স্রেফ সংখ্যাগত ও পেশী শক্তির জোরেই এই শক্তি এই পশ্চিমবঙ্গেরও দখল নিতে পারে অদূরভবিষ্যতে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পাঠক ঠিক করুন কি করবেন।
গিয়াসুদ্দিনের পক্ষে প্রকাশ্য সমর্থনে যাবেন না তাঁর বিরধীদের পক্ষেই থাকবেন?
শাহরিয়ার কবিরদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের কথা সবাইকে জানাবেন না নীরবতাই বজায় রাখবেন?
মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের জন্য আন্দোলন করবেন না বুদ্ধ-মমতার সঙ্গে আরো মাদ্রাসার দাবীতে সোচ্চার হবেন?
শিরিন মিদ্যার পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের বোরখার অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবেন না আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ধর্মীয় মৌলবাদের আখড়া হতে দেবেন?
তসলিমা নাসরিনকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনবার দাবী করবেন না পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-সাহিত্য সেন্সরের ভার ইমামদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাহিত্যচর্চায় মন দেবেন?
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ বজার রাখবার চাবিকাঠিটি এখনও আপনাদের কাছেই আছে, তা কি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন?
________________________
১ B.R. Ambedkar Pakistan or Partition of India, p 116, Babashaeb Ambedkar Writings and Speeches Vol8, Educaion Department, Government of Maharashtra, 1990.
২ ঐ পৃঃ 118
৩ http://en.wikipedia.org/wiki/Demographics of Iran
৪ http://en.wikipedia.org/wiki/Egypt
৫ http://en.wikipedia.org/wiki/Malaysia
৬ http.//www.indonesiamatters.com/326/religious-freedom-report/
৭ http.//en.wikipedia.org/wiki/Maldives
৮ Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh- Living with Vested Property, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008.
৯ Bangladesh Hindu Buddhist Christian Unity Council – Communal Discrimination in Bangladesh: Facts and Documents, pp 431-435, Dhaka 1993.
১০ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি – ১৫০০ দিনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিবরণ – শ্বেত পত্র, সম্পাদনা – শাহরিয়র কবির, ৩ খন্ড, ঢাকা, ২০০৫
১১ Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Munority in Bangladesh – Living with Vested Property, pp 66-68, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008.
১২ Mohammad Rafi, Can We Get Along, pp 201, Panjere Publications, Dhaka 2005
১৩ Wikepedia থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলি পাওয়া যাবে।
১৪ প শ্চিম বঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা আজ দেশের গর্ব – তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আগস্ট, ২০১০।
১৫ গিয়াসুদ্দিন – মাদ্রাসা শিক্ষার পশ্চাদ্গামিতা নয়, চাই মূলধারার আধুনিক উচ্চশিক্ষা – হিযাবঃ নারী দাসত্বের প্রতীক, পৃ-১২৭, – মার্চ, ২০১০, কলকাতা।
১৬ মাদ্রাসা দর্পণ, ষষ্ঠ বর্ষ, পাঠ্যসূচী সংখ্যা – পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ, আগস্ট ২০০৭।
১৭ (http://banglapedia.search.com.bd/HT/P_0101.htm)
১৮ Hiranmoy Karlekar, Bangladesh – The Next Afghanisthan, pp 38, Sage Publications 2005
১৯ অনুপ্রবেশ, অস্বীকৃত উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত অস্তিত্ব – মোহিত রায়, অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০০৯
২০ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ – জগদীশ মণ্ডল, ১ম খন্ড, পৃ ২২১ (উদ্ধৃত – ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, পৃ ১৫, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩)
২১ ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, পৃ ১২৭-৩২, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মূল ইংরাজীতে পদত্যাগপত্র ও তার বঙ্গানুবাদ পাওয়া যাবে শ্রীদেবজ্যোতি রায়ের লেখা ‘মুসলিম রাজনীতি ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ’ বইতে। প্রাপ্তিস্থান – বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, ৬ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩
২২ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ – সদানন্দ বিশ্বাস, পৃঃ ১৬০-১৬১, দীপালি বুক হাউস, কলকাতা ২০০৪
২৩ The Telegraph – Sunday, August 3, 2008
২৪ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০
২৫ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১০
২৬ Times of India, Kolkata, 9 September, 2010
২৭ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ অক্টবর ২০১০
২৮ http://en.wikipedia.org/wiki/2010_Deganga_riots
২৯ Indian Express, 10 October, 2010
https://paschimbangerjanya.wordpress.com/articles/minority_and_secularism/?blogsub=confirming#subscribe-blog

No comments:

Post a Comment