শুভ জন্মদিন
আল মাহমুদের কাব্য সৃষ্টির গরিমা
শহীদ ইকবাল
১১ জুলাই, ২০১৭
বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রখর প্রভাবিত, ভাটিবাংলার লোকায়ত প্রাণস্পন্দনের কবি আল মাহমুদ (জন্ম ১৯৩৬)। ‘তিতাস-ব্রহ্মপুত্র পারের জনজীবনকে উপলক্ষ করে সম্মোহনী লোকভাষা’ তাঁর কাব্যে স্থিতি পায়। তাঁর কবিতার বিষয় : লোকজ জীবনানুষঙ্গ, গ্রামীণ সংস্কার-মূল্যবোধ, মুসলিম ঐতিহ্য-পুরাণ। অসম্ভব আসঞ্জনমথিত ‘লোক লোকান্তর’ (১৩৭০)-এর কবিতাগুলো লেখা হয় ১৩৬১ থেকে ১৩৭০ সালের মধ্যে। এরপর ‘কালের কলস’ (১৩৭৩) ১৩৭০ থেকে ১৩৭৩ সালে।
এ দুটি কাব্যের জন্য কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে রচিত ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩), যেটি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রচিত। সোনালী কাবিন তাঁর সনেটগুচ্ছ। আল মাহমুদ এ তিনটি কাব্যেই বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সৃষ্টির গোড়া থেকে কবির দিব্যচেতনার শুলুকসন্ধানের প্রচেষ্টায় (তাঁর এগোনোর পথ, অনুকরণের পর্যায়, পাঠকনন্দিত হওয়ার ক্ষেত্র—অনুভাব্য ও অনুসরণীয় ক্ষেত্র। এবং অবশ্যই তা পরীক্ষণীয় ব্যাপারও।
আল মাহমুদ একটি দিব্যচেতনা নিয়ে ‘নদী’, ‘মেঘ’, ‘নারী’ রচনা করে চলেন। গ্রহণ করেন তাঁর ‘বন্দনা’র জগৎ। একই রূপে ‘ঝড়’, ‘অরণ্য’, ‘বৃষ্টি’, ‘রাত্রি’, ‘নৌকো’, ‘রক্ত’তে আরোপ করেন যৌনতা; তখন জীবনজয়ী রূপটি হয় চিহ্নিত, পরিবেশনায় আসে ভিন্নতা। কবিতা যাবতীয় বিষয়কে স্পর্শ করে। কবিস্বীকৃতিতে থাকে ‘কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল,/যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল’। নিত্যদিনের সময়সূত্রকে এভাবে কবি অর্পণ করেন অনিবার্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্ররোচনায়। এ ক্ষেত্রে কিছু আত্মমগ্নতা বা আত্মলীন অনুভবও স্মরণীয়তা পেতে পারে।
২.
আল মাহমুদ কালের কলস কাব্যে ‘কলস’কে প্রত্নপ্রতিমায়, পুরাণ রূপে প্রতিষ্ঠা দেন, পুরাবৃত্তটিতে আলো-অন্ধকার, জন্ম-মৃত্যুর পরিচর্যায় বিরাট ভূমিপুত্র রূপে জেগে ওঠেন। এখানে কবির ইঙ্গিতটি এতই গভীর ও নৃ-সংশ্লিষ্ট যে সেখানে শুধু জাগরণ নয়, সন্দেহ-বিশ্বাস-সংস্কার এক বীক্ষা লাভ করে। সেখানে ঐতিহ্যিক প্রবাহ, অভিজ্ঞতায় লালিত হলেও সর্বজনীন মুরতির স্বতঃপ্রবৃত্ত আকাঙ্ক্ষাটি কায়েমে আনেন।
আল মাহমুদ সোনালী কাবিনে অগ্রসর, আবেগ ঘনীভূত, চেতনায় স্বচ্ছ ও নিরঙ্কুশ। সদ্যঃস্বাধীন দেশে তাঁর কাব্যবিষয় ওই আবহাওয়া-জলবায়ুর পরিক্রমণে। সেখানেও সনেটে ফিরে আসে শৌর্য-বীর্যগাথা, পুরনো ইতিহাস, আবহমান আবেগসংখ্যার হিসাব। মৃত্তিকা-নারী-ভ্রূণাঙ্কুর, আর কুয়াশা-আলো-অন্ধকার, স্নেহ-মায়া-প্রেম-ভালোবাসা এ কাব্যে তীক্ষ�তর। তবে ‘সোনালী’ যৌবন কামার্ত বা জৈবিকতার আধার হয়ে আসে। লোকসংস্কৃতি-লোকসংস্কার, শারীরিক-সংসর্গ হয়ে ওঠে অভিন্ন দ্যোতনার সারথি। আল মাহমুদ সুন্দর নামে, চমৎকার কবিভাষ্যে আন্তর্ভৌম ও যৌক্তিক রূপটি সনেটের সীমায় অনুরুদ্ধ করেন।
কবির সনেটে এটি তুমুলমাত্রায় উত্তীর্ণ। সোনালী কাবিনে এ ছাড়াও পয়ারে বা মুক্তক প্রবর্তনার অনেক কিছু কায়েম হয়েছে। কিন্তু অনেক কবিতায় জৈবিকচেতনার পুনরাবৃত্তি আছে, সেটি ডিটেলে গেলে আর ওই পর্যায়ে থাকে না।
আমাদের চলমান জীবনপথের প্রতিবেশটি তখন অজ্ঞাতবাসে থাকে না। কবির সবচেয়ে আকর্ষণীয়, কবিতাধারায় অনুকরণ বা আনুকূল্যে নয় এমন উপাদানে যেমন তিনি পেয়েছেন উপকরণ, তেমনি আঙ্গিককেও নিয়েছেন স্বকীয়তায় মানিয়ে। বিশেষত, অবচেতন স্তরটিতে কবি পৌঁছেছেন আধুনিক প্রকৃত ও বাস্তবানুগ সিদ্ধিতে। আল মাহমুদের কবিতায় এ রীতি বেশিদিন বহাল থাকেনি। সেটাও কি তবে এক বাস্তবতার চাপ! এমন বড় কবি রূপে যিনি শিগগিরই স্বতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান—একটি একক কবিভাষার নির্মাণ গুণে; সেখানে তিনি কিভাবে ‘রমণীর প্রেম আর লাবণীসৌরভ’কে দ্বিতীয় করে তুললেন? অদ্বিতীয়, অখণ্ডে তো তাঁকে চায়-ই সবাই। তবে ‘খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি’র স্বপ্নটিকেও আমরা যেমন অস্বীকার করতে চাই না, তেমনি আগেরটিকেও না। আঙ্গিককে ভেঙে ছত্রখান করে কী লাভ! লোকায়ত পথিকৃৎ, যে স্বপ্নজাগর প্রহরের কবি, তাঁকে আরো—বানাতে বলতে চাই ‘কলসের সোনালী’ প্রতিকৃতি। বহুভাবে ও রকমে। এরূপ ধারাবাহিকতায় তাঁর অন্য কাব্য ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ (১৯৭৬), ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ (১৯৮০), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ (১৯৮৫), ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ (১৯৮৭), ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’ (১৯৮৮), ‘এক চক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯), ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ (১৯৯৩), ‘আমি, দূরগামী’ (১৯৯৪), ‘হৃদয়পুর’ (১৯৯৫), ‘দোয়েল ও দয়িতা’ (১৯৯৭), ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ (২০০০), ‘নদীর ভিতরে নদী’ (২০০১), ‘প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা’ (২০০৬), ‘তোমার রক্তে তোমার গন্ধে’ (২০১০), ‘সনেট সমগ্র’ (২০১৩) ও এমন আরো অনেক কাব্য ও কবিতা। তবে গল্প বা উপন্যাসে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ (১৯৭৫) বা ‘উপমহাদেশ’ (১৯৯৩) কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামগ্রিক শিল্পীসত্তার অভিবাদনে আল মাহমুদ কালোত্তরের পথিকৃৎ। তিনি চিরায়ুষ্মান হোন।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
shiqbal70@gmail.com
আল মাহমুদের কাব্য সৃষ্টির গরিমা
শহীদ ইকবাল
১১ জুলাই, ২০১৭
বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রখর প্রভাবিত, ভাটিবাংলার লোকায়ত প্রাণস্পন্দনের কবি আল মাহমুদ (জন্ম ১৯৩৬)। ‘তিতাস-ব্রহ্মপুত্র পারের জনজীবনকে উপলক্ষ করে সম্মোহনী লোকভাষা’ তাঁর কাব্যে স্থিতি পায়। তাঁর কবিতার বিষয় : লোকজ জীবনানুষঙ্গ, গ্রামীণ সংস্কার-মূল্যবোধ, মুসলিম ঐতিহ্য-পুরাণ। অসম্ভব আসঞ্জনমথিত ‘লোক লোকান্তর’ (১৩৭০)-এর কবিতাগুলো লেখা হয় ১৩৬১ থেকে ১৩৭০ সালের মধ্যে। এরপর ‘কালের কলস’ (১৩৭৩) ১৩৭০ থেকে ১৩৭৩ সালে।
এ দুটি কাব্যের জন্য কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে রচিত ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩), যেটি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রচিত। সোনালী কাবিন তাঁর সনেটগুচ্ছ। আল মাহমুদ এ তিনটি কাব্যেই বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সৃষ্টির গোড়া থেকে কবির দিব্যচেতনার শুলুকসন্ধানের প্রচেষ্টায় (তাঁর এগোনোর পথ, অনুকরণের পর্যায়, পাঠকনন্দিত হওয়ার ক্ষেত্র—অনুভাব্য ও অনুসরণীয় ক্ষেত্র। এবং অবশ্যই তা পরীক্ষণীয় ব্যাপারও।
আল মাহমুদ একটি দিব্যচেতনা নিয়ে ‘নদী’, ‘মেঘ’, ‘নারী’ রচনা করে চলেন। গ্রহণ করেন তাঁর ‘বন্দনা’র জগৎ। একই রূপে ‘ঝড়’, ‘অরণ্য’, ‘বৃষ্টি’, ‘রাত্রি’, ‘নৌকো’, ‘রক্ত’তে আরোপ করেন যৌনতা; তখন জীবনজয়ী রূপটি হয় চিহ্নিত, পরিবেশনায় আসে ভিন্নতা। কবিতা যাবতীয় বিষয়কে স্পর্শ করে। কবিস্বীকৃতিতে থাকে ‘কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল,/যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল’। নিত্যদিনের সময়সূত্রকে এভাবে কবি অর্পণ করেন অনিবার্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্ররোচনায়। এ ক্ষেত্রে কিছু আত্মমগ্নতা বা আত্মলীন অনুভবও স্মরণীয়তা পেতে পারে।
২.
আল মাহমুদ কালের কলস কাব্যে ‘কলস’কে প্রত্নপ্রতিমায়, পুরাণ রূপে প্রতিষ্ঠা দেন, পুরাবৃত্তটিতে আলো-অন্ধকার, জন্ম-মৃত্যুর পরিচর্যায় বিরাট ভূমিপুত্র রূপে জেগে ওঠেন। এখানে কবির ইঙ্গিতটি এতই গভীর ও নৃ-সংশ্লিষ্ট যে সেখানে শুধু জাগরণ নয়, সন্দেহ-বিশ্বাস-সংস্কার এক বীক্ষা লাভ করে। সেখানে ঐতিহ্যিক প্রবাহ, অভিজ্ঞতায় লালিত হলেও সর্বজনীন মুরতির স্বতঃপ্রবৃত্ত আকাঙ্ক্ষাটি কায়েমে আনেন।
আল মাহমুদ সোনালী কাবিনে অগ্রসর, আবেগ ঘনীভূত, চেতনায় স্বচ্ছ ও নিরঙ্কুশ। সদ্যঃস্বাধীন দেশে তাঁর কাব্যবিষয় ওই আবহাওয়া-জলবায়ুর পরিক্রমণে। সেখানেও সনেটে ফিরে আসে শৌর্য-বীর্যগাথা, পুরনো ইতিহাস, আবহমান আবেগসংখ্যার হিসাব। মৃত্তিকা-নারী-ভ্রূণাঙ্কুর, আর কুয়াশা-আলো-অন্ধকার, স্নেহ-মায়া-প্রেম-ভালোবাসা এ কাব্যে তীক্ষ�তর। তবে ‘সোনালী’ যৌবন কামার্ত বা জৈবিকতার আধার হয়ে আসে। লোকসংস্কৃতি-লোকসংস্কার, শারীরিক-সংসর্গ হয়ে ওঠে অভিন্ন দ্যোতনার সারথি। আল মাহমুদ সুন্দর নামে, চমৎকার কবিভাষ্যে আন্তর্ভৌম ও যৌক্তিক রূপটি সনেটের সীমায় অনুরুদ্ধ করেন।
কবির সনেটে এটি তুমুলমাত্রায় উত্তীর্ণ। সোনালী কাবিনে এ ছাড়াও পয়ারে বা মুক্তক প্রবর্তনার অনেক কিছু কায়েম হয়েছে। কিন্তু অনেক কবিতায় জৈবিকচেতনার পুনরাবৃত্তি আছে, সেটি ডিটেলে গেলে আর ওই পর্যায়ে থাকে না।
আমাদের চলমান জীবনপথের প্রতিবেশটি তখন অজ্ঞাতবাসে থাকে না। কবির সবচেয়ে আকর্ষণীয়, কবিতাধারায় অনুকরণ বা আনুকূল্যে নয় এমন উপাদানে যেমন তিনি পেয়েছেন উপকরণ, তেমনি আঙ্গিককেও নিয়েছেন স্বকীয়তায় মানিয়ে। বিশেষত, অবচেতন স্তরটিতে কবি পৌঁছেছেন আধুনিক প্রকৃত ও বাস্তবানুগ সিদ্ধিতে। আল মাহমুদের কবিতায় এ রীতি বেশিদিন বহাল থাকেনি। সেটাও কি তবে এক বাস্তবতার চাপ! এমন বড় কবি রূপে যিনি শিগগিরই স্বতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান—একটি একক কবিভাষার নির্মাণ গুণে; সেখানে তিনি কিভাবে ‘রমণীর প্রেম আর লাবণীসৌরভ’কে দ্বিতীয় করে তুললেন? অদ্বিতীয়, অখণ্ডে তো তাঁকে চায়-ই সবাই। তবে ‘খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি’র স্বপ্নটিকেও আমরা যেমন অস্বীকার করতে চাই না, তেমনি আগেরটিকেও না। আঙ্গিককে ভেঙে ছত্রখান করে কী লাভ! লোকায়ত পথিকৃৎ, যে স্বপ্নজাগর প্রহরের কবি, তাঁকে আরো—বানাতে বলতে চাই ‘কলসের সোনালী’ প্রতিকৃতি। বহুভাবে ও রকমে। এরূপ ধারাবাহিকতায় তাঁর অন্য কাব্য ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ (১৯৭৬), ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ (১৯৮০), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ (১৯৮৫), ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ (১৯৮৭), ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’ (১৯৮৮), ‘এক চক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯), ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ (১৯৯৩), ‘আমি, দূরগামী’ (১৯৯৪), ‘হৃদয়পুর’ (১৯৯৫), ‘দোয়েল ও দয়িতা’ (১৯৯৭), ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ (২০০০), ‘নদীর ভিতরে নদী’ (২০০১), ‘প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা’ (২০০৬), ‘তোমার রক্তে তোমার গন্ধে’ (২০১০), ‘সনেট সমগ্র’ (২০১৩) ও এমন আরো অনেক কাব্য ও কবিতা। তবে গল্প বা উপন্যাসে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ (১৯৭৫) বা ‘উপমহাদেশ’ (১৯৯৩) কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামগ্রিক শিল্পীসত্তার অভিবাদনে আল মাহমুদ কালোত্তরের পথিকৃৎ। তিনি চিরায়ুষ্মান হোন।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
shiqbal70@gmail.com
No comments:
Post a Comment