শেখ মুজিব হত্যায় জাসদ ও সর্বহারা পার্টির সম্পৃক্ততা।
[শেথ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সাথে জাসদসহ বামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা উঠে এসেছে জাসদের উন্থান পতন:অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে। ১৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ের ঘটনা বিবরন তুলে ধরা হলো ]
১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা শহরের অনেক অধিবাসীর ঘুম ভাঙে গোলাগুলির আওয়াজে। দিনটি ছিল ৩০ শ্রাবণ, শুক্রবার। রেডিওতে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিল : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সারা বিশ্বে কারফিউ জারি করা হয়েছে। উত্তেজনার বলে ডালিম ‘সারা বিশ্বে’ কারফিউ জারি করে দিলেন। তিনি ঘোষণা শেষ করলেন, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে। ঢাকা বেতারে প্রায় ৪৪ মাস পরে আবার ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা গেল।
দুপুরের মধ্যে নগরবাসী জেনে গেলেন শেখ মুজিব, তার ভগ্নিপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে সামরিক বাহিনী কিছু সদস্য ভোররাতে হামলা করেছে এবং যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেই শোকাহত, অনেকেই খুশিতে ডগমগ। রাস্তায় বেরিয়ে অনেকেই জটলা করছেন, এই ঘটনা নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। এর আগে কয়েক মাস ধরে ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এই স্লোগান দিয়ে বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য অনেকেই ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতার কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট ঢাকা শহরের রাস্তায় শেখ মুজিবের জন্য প্রকাশ্যে আফসোস করার মতো মানুষ তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিয়মিত রোজনামচা লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন শিক্ষক ছিলেন বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ। শেখ মুজিব সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল।
শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন হত্যা-লুণ্ঠনের বিভীষিকা মুজিবকে গণশত্রুতে পরিণতক করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থে সে সুযোগে তাকে হত্যা করায় সপরিবারে।
ধীরে ধীরে ১৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হতে থাকল। জানা গেল, সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। তাদের নেতা মেজর ফারুক রহমান ও মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন আরো কয়েকজন মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। তাদের কয়েকজন এর আগে সেনাবাহিনী থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন। এই দলের অন্যতম ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদ। পরে তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। হুদা ১৯৬৫-৬৭ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি ছাত্রলীগ করতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র থাকাকালে তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তার কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন ছিলেন আবদুল বাতেন চৌধুরী। বাতেন ছিলেন জাসদের ঢাকা নগর পার্টি ফোরামের সদস্য। তিনি মুহসীন হলের তিন নম্বর কক্ষে থাকতেন। হুদা বাতেনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বাতেন স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সদস্য এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তার স্মৃতিচারণ থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
পঁচাত্তরের ১৩ আগস্ট বিকেল ৩টায় সেনা গোয়েন্দা দফতরের (ডিএমআই) ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা অসামরিক পোশাকে মুহসীন হলে আমার কক্ষে এলো। সে ঢাকা শহরের দায়িত্বে ছিল। আমরা সূর্যসেন হলের ক্যানটিনে গিয়ে চা খেলাম এবং তারপর রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে একটি গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসলাম। তারপর শুরু হলো কথাবার্তা।
হুদা : তোরা যেভাবে চেষ্টা করছিস, তাতে কিছু হবে না। লেট আস ইউনাইট অ্যান্ড গিভ হিম আ ব্রো।
বাতেন : ইউনাইট হতে পারি, কিন্তু ব্রো দিতে পারব না। আমরা বিপ্লবে বিশ্বাস করি। তুমি যা বলছ, সে পথ আমাদের নয়।
এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সন্ধ্যা হয়ে এলো। তারা দু’জন বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খাবার খেলেন। হুদা চলে যাওয়ার সময় বাতেনকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘কাল-পরশু দুর্দিন হলে না থাকাই ভালো। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। নানা ধরনের চাপ থাকবে। রাতে বাইরে থাকিস।’ হুদা বাতেনকে যোগাযোগের জন্য একটা টেলিফোন নম্বর দিলেন।
বাতেন সে রাতে মুহসীন হলেই ছিলেন। ১৪ আগস্ট তিনি আজিমপুর কলোনিতে তার বোনের বাসায় যান এবং সেখানেই রাত কাটান।
১৫ আগস্ট সকালে ঘুম ভাঙতেই রেডিওতে তিনি অভ্যুত্থানের সংবাদ পান। তিনি হেঁটে হেঁটে নিউ মার্কেট-নীলক্ষেতের মোড়ে বিউটি রেস্টুরেন্টে যান এবং সেখানে নাশতা করেন। তারপর মুহসীন হলের দিকে রওনা হতেই দেখলেন, বেশ কয়েকজন ছাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত। বাতেন এদের মধ্যে ফকির গোলেদার রহমানকে দেখলেন। গোলেদার মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন নেতা গোছের ছিলেন। তার পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। গোলেদার বললেন, তিনি হলের গ্রিলবিহীন জানালা দিয়ে হল অফিসের একতলার ছাদে লাফিয়ে নেমেছেন এবং এখন যত দূরে সম্ভব চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বাতেনকে তিনি বললেন, ‘আমারে মাপ কইরা দিস।’
বাতেন মুহসীন হলে তার কক্ষে গেলেন। তিনি সেখানে জাহাঙ্গীর ও রুবেলকে পেলেন। ওরা দু’জনই সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগের কর্মী এবং ওই কক্ষেই থাকতেন। বাতেন বললেন, ‘তোরা আমার বোনের বাসায় চলে যা।’ তিনি নিজেই তাদের আজিমপুরে বোনের বাসায় নিয়ে এলেন।
বেলা ১১টার দিকে বজলুল হুদা বাতেনের বোনের বাসায় এসে হাজির হলেন। তিনি বাতেনকে নিয়ে বেরোলেন। তিনি নিজেই একটি জিপ চালাচ্ছিলেন। জিপের পেছনে একটা পিকআপে কয়েকজন সেপাই। হুদা বললেন, ‘জাসদের সাপোর্ট দরকার, এটার ব্যবস্থা করো।’ বাতেন বললেন, ‘জাসদ সাপোর্ট দেবে না। জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা করো। তাজউদ্দীনকে আনো, রাজ্জাককে আনো।’
হুদা বাতেনকে নিয়ে গণভবনের পেছনে একটা সেনাক্যাম্পে গেলেন। সেখানে একটা ক্যানটিনে তারা পরোটা-গোশত খেলেন। তারপর বাতেনকে আসাদ গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীনের বাসার দিকে রওনা হলেন। হুদা পরে তাজউদ্দীনের বাসায় তার অভিজ্ঞতার কথা বাতেনকে বলেছিলেন। তাজউদ্দীনকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’
বাতেনকে হুদা মুজিব হত্যার বিবরণ দিয়েছিলেন। তার ভাষ্য মতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে ওরা আক্রমণ চালায় মেজর (অব.) নূরের নেতৃত্বে। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বেরিয়ে আসেন। তিনি প্রথমে গুলি ছোড়েন। হুদা তৎক্ষণাৎ কামালকে গুলি করে হত্যা করেন। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ মুজিব ওপর থেকে চিৎকার করে তাদের গোলাগুলি থামাতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কোনো কিছু বলার থাকলে ওপরে এসে আমাকে বলো।’ হুদারা তখন দোতলায় ওঠেন। শেখ মুজিবকে দেখে হুদা স্যালুট দেন। রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি দেখে ভয়ে ও উত্তেজনায় তার পা কাঁপছিল। সাহস সঞ্চয় করে হুদা বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ শেখ মুজিব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কোথায় যাবো? কেন যাবো? না, আমি যাবো না।’ হুদা সাহস সঞ্চয় করে বলেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে।’ তিনি শেখ মুজিবের গলার কাছে রিভলবারের নল ঠেকালেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘ঠিক আছে,্ আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।’ তার পরনে লুঙ্গি। হুদা সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন ন া। বললেন, ‘এ পোশাকেও আপনি বঙ্গবন্ধু, চেঞ্জ করলেও বঙ্গবন্ধুই থাকবেন। পোশাক বদলানোর দরকার নেই।’ মুজিব তাদের সাথে যেতে রাজি হলেন। বললেন, ‘দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক নিয়ে আসি।’ এই বলে তিনি তার ঘরে গেলেন এবং পাইপ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে পেছন থেকে একজন একটা গামছা বের করে শেখ মুজিবের চোখ বাঁধতে যান।
শেখ মুজিব হাত দিয়ে এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেন। হাতের আঘাত থেকে বাঁচতে হুদা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন। তখন হুদার পেছন থেকে শেখ মুজিবের ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়। শেখ মুজিব ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অন্যরা এ সময় দোতলায় গিয়ে বাড়ির সবাইকে হত্যা করেন। ‘অপারেশন’ শেষ করে ফেরার সময় হুদা কামালের টয়োটা গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে আসেন এবং সেনানিবাসে তার মেসের সামনে রেখে দেন।
বাতেন হুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে?’ হুদা বলেছিলেন, ‘রেডিও স্টেশনে। সেখানে তাকে অ্যানাউন্সমেন্ট দিতে হতো, ‘বাকশাল বাতিল করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ হুদা আরো বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম না, তাকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা ছিল। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাকে ধরে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া।’ বাতেন জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমরা তো তাকে পেয়েছিলেই, অন্যদের মারতে গেলে কেন?’ হুদার জবাব ছিল, ‘শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার পর আমরা আর কোনো সাক্ষী রাখতে চাইনি।’
শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের আকস্মিকতায় অনেকেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে তেমন উত্তেজনা লক্ষ করা যায়নি। হুদা বাতেনকে বলেছিলেন, এরকম একটা ঘটনা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবার কাম্য ছিল। শুধু দুটো বিষয়ে তাদের অনেকের অজ্ঞতা ছিল। প্রথমত, ঘটনাটি কবে ঘটানো হবে এবং দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে কি না। রশিদ-ফারুকের পরিকল্পনায় এই অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা সবাই হত্যা পরিকল্পনার কথা জানতেন না। অপারেশনে কার কী ভূমিকা, তা রশিদ-ফারুক ঠিক করে দেন।
মেজর নূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সদস্য ছিলেন। পরে তিনি সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত হন। সিরাজ শিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। ১৫ আগস্টের কয়েক দিন পর সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি বাসায় সন্ধ্যাবেলা বৈঠক করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, আকা ফজলুল হক ও মহসীন আলী। তারা নূর ও ডালিমকে ডেকে পাঠান। নূর একাই এসেছিলেন। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর বলেন, ‘ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি।’ নূরের উদ্ধত আচরণে এবং নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে জিয়াউদ্দিন ক্ষুব্ধ হন।
১৫ আগস্টের পর ফারুক, রশিদ ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। অনেক দিন পর বনানী ডিওএইচএসে কর্নেল ফারুকের বাসায় ফারুক ও রশিদের সাথে আলাপ করার সময় আকা ফজলুল হককে রশিদ বলেছিলেন :
শেখ মুজিবকে রেখে ক্যু করা যাবে কি না, তা নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। দেখলাম তা সম্ভব নয়। রক্ষীবাহিনীর চিফ ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে আগেই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত হয়। মুজিব পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সিদ্ধান্তটি অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়েছিল।
মুজিব হত্যার পরিকল্পনায় বিমানবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তাদের বাদ দিয়েই এই অপারেশন চালানো হয়। এরকম একটা ‘অ্যাডভেঞ্চারে’ শরিক হতে না পেরে তারা মনোক্ষুণœ হয়েছিলেন। এর প্রকাশ ঘটেছিল নভেম্বরে। ১০
হুদার সাথে কথাবার্তায় বাতেনের মনে হয়েছিল, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সবাই সবটা জানেন না।যারা এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মতৈক্য ছিল। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাদের অনেকের ব্যক্তিগত ক্ষোভও ছিল। ১১
কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে এরকম একটি ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। কোটি টাকার প্রশ্ন ছিল, কবে, কখন? শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি তার ক্ষোভ ছিল অপরিসীম।
তাহের মনে করতেন, ‘মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষীবাহিনীর মতো একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় ভারতের সাথে করা গোপন চুক্তির ব্যাপারেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাহাত্তর সালের নভেম্বরেই এসব ঘটেছিল এবং এ কারণেই লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন ও তিনি যার যার রাজনৈতিক লাইন বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্য তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করতেন।’ বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাহেরের পর্যবেক্ষণ ছিল সোজাসাপটা : ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবারই জানা, কীভাবে একটির পর একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। আমাদের সব লালিত আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও মূল্যবোধ একের পর এক ধ্বংস করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়েছিল অত্যন্ত নোংরাভাবে। জনগণকে পদদলিত করে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র।’
ছিয়াত্তরে তাহের ও অন্যদের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দিতে তাহের এসব কথা উল্লেখ করেন। শেখ মুজিব সম্পর্কে তাহেরের মূল্যায়ন ছিল এরকম : ‘শেখ মুজিব জনগণের নেতা ছিলেন। অস্বীকার করার অর্থ হবে সত্যকে অস্বীকার করা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার জনগণের ওপরই বর্তায়। জনগণের জন্য সঠিক পথ হবে জেগে ওঠা এবং প্রতারণার দায়ে মুজিবকে উৎখাত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনগণ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে, তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে। জনগণ কাউকে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয়নি।’
আওয়ামী লীগ-বাকশালের বাইরে ওই সময় সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ছিল জাসদ। জাসদের প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খান তখন দেশে নেই। দলে একাধিক ‘কেন্দ্র’। গণবাহিনীর ইউনিটগুলো বিভিন্ন জেলায় মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিত, বিহ্বল। জাসদের মধ্যে যারা ষাটের দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন, ১৫ আগস্টের মতো একটা ঘটনা ঘটতে পারে, এটা তারা কখনো চিন্তা করেননি।
১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা নগর গণবাহিনীর সদস্য মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চুর সাথে তিতুমীর কলেজের সহসভাপতি কামালউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, ওয়াহিদুল ইসলাম সুটুল, নওশের ও রতন ধানমন্ডিতে তাজউদ্দীনের বাসায় যান। কামালের বাড়ি ঢাকার কাপাসিয়া থানায়। তার বড় ভাই নৌবাহিনীর সাবেক লিডিং সি-ম্যান সুলতানউদ্দিন আহমদ আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত এবং জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তাজউদ্দীনের সাথে তার আগে পরিচয় ছিল এবং একই এলাকায় বাড়ি বলে তাদের মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো।
তাজউদ্দীনের বাসায় গিয়ে তারা শুনলেন, তিনি গোসল করছেন। তারা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মিনিট দশেক পর তাজউদ্দীন এলেন। পরনে একটি পায়জামা, গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি। সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে দুই হাতের আঙুল দিয়ে ব্যাকব্রাশের মতো ভঙ্গিতে চুল থেকে পানি ঝরাচ্ছিলেন। পানির ঝাপটা কামালের চোখে-মুখে এসে লাগছিল।
তাজউদ্দীন উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকলেন, ‘বোকার দল লাল বাহিনী বানায়, নীল বাহিনী বানায়। কোনো বাহিনী তাকে বাঁচাতে পারল?’
বাচ্চু বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ তাজউদ্দীন বললেন, ‘কোথায় যাবো? কেন তোমাদের সঙ্গে যাবো?’ বাচ্চু বারবার বলছিলেন, ‘যেতেই হবে।’
তাজউদ্দীন কামালকে বললেন, ‘নান্নু, এটা কারা করল? রাইটিস্টরা না লেফটিস্টরা? ফেলটিস্টরা হলে আমাকে আর জীবিত রাখবে না।’ নান্নু কামালের ডাকনাম। তাজউদ্দীন তাকে এই নামেই ডাকতেন। লেফটিস্ট বলতে তিনি পিকিংপন্থীদের বোঝাচ্ছিলেন। বাচ্চুর কথার জবাবে তিনি বললেন, ‘সিরাজ কোথায়? ও যদি বলে তাহলে যেতে পারি। তাকে নিয়ে আসো।’ বাচ্চু বেরিয়ে গেলেন। আধা ঘণ্টা পর তিনি ফিরে এসে জানালেন, সিরাজুল আলম খান কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। বাচ্চু জানতেন না, তিনি দেশে নেই। অগত্যা তাজউদ্দীনকে ছাড়াই তারা ফিরে এলেন।
তাজউদ্দীনকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং কেন, এটা বাচ্চু ছাড়া তার অন্য সহযোগীরা জানতেন না। বাচ্চুর সাথে যাওয়ার সময় কামালের মনে হয়েছিল, তাজউদ্দীনকে বোধ হয় কোনো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হবে। ২৬ নভেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনে একটি অভিযানে বাচ্চু নিহত হলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এটা আর হয়তো কোনো দিনই জানা যাবে না যে কে বাচ্চুকে পাঠিয়েছিল এবং কী উদ্দেশ্যে।
১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ ঢাকা গণবাহিনীর উপপ্রধান আবুল হাসিব খানের কাছে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের একটি চিরকুট নিয়ে আসেন। চিরকুটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা হবে বলে উল্লেখ ছিল। সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘র মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।’১৪
লে. কর্নেল আবু তাহের গোপনে গণবাহিনী গড়ে তুলছিলেন। ডালিম ও নূর তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তাহের ও ডালিমের চিন্তাধারা ছিল একই রকম। তাহের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেননি। তবে ওই দিনই তিনি অভ্যুত্থানকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
লে. কর্নেল আবু তাহের মেজর রশিদের অনুরোধে সকাল ৯টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। সেখানে তিনি খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম ও মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখতে পান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার জন্য। তিনি খন্দকার মোশতাককে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো ছিল :
অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করতে হবে;
সারা দেশে সামরিক আইন জারি এবং এর প্রয়োগ করতে হবে;
দলনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে;
বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে;
অবিলম্বে একটি গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের জন্য সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের একান্ত নিজস্ব। এ বিষয়ে তিনি গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড কিংবা জাসদের পার্টি ফোরামের সাথে আলোচনা করেননি এবং এসব প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পার্টি তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই প্রস্তাব ছিল জাসদের মূলনীতির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে, সামরিক আইন জারির প্রস্তাবটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা যেকোনো সুস্থ রাজনৈতিক দলের জন্যই অপমানজনক এবং প্রগতিশীল রাজনীতির চেতনাবিরোধী। তাহের সব সময় শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিবাদী’ রাজনীতির বিরোধী ছিলেন এবং তার সরকারের উৎখাত চাইতেন। জাসদও একই দাবি করেছে। কিন্তু জাসদ কখনোই দেশে সামরিক শাসন চায়নি।
খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। মেজর রশিদ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহেরকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। তাহের যখন দুপুরে বঙ্গভবনে পৌঁছান, ততক্ষণে শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। তাহের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মেজর রশিদসহ সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন এবং সকালে খন্দকার মোশতাককে দেয়া তার প্রস্তাবগুলো আবার উল্লেখ করেন। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ডেকে নেন। সবাই তাহেরের প্রস্তাবগুলো সময়োচিত বলে একমত হন।১৭ দু’দিন পর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।
১৫ আগস্টের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।’
http://www.onnodiganta.com/article/detail/3544#.VF3d7mf5Pcc
[শেথ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সাথে জাসদসহ বামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা উঠে এসেছে জাসদের উন্থান পতন:অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে। ১৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ের ঘটনা বিবরন তুলে ধরা হলো ]
১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা শহরের অনেক অধিবাসীর ঘুম ভাঙে গোলাগুলির আওয়াজে। দিনটি ছিল ৩০ শ্রাবণ, শুক্রবার। রেডিওতে ঘোষণা শোনা যাচ্ছিল : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সারা বিশ্বে কারফিউ জারি করা হয়েছে। উত্তেজনার বলে ডালিম ‘সারা বিশ্বে’ কারফিউ জারি করে দিলেন। তিনি ঘোষণা শেষ করলেন, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে। ঢাকা বেতারে প্রায় ৪৪ মাস পরে আবার ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা গেল।
দুপুরের মধ্যে নগরবাসী জেনে গেলেন শেখ মুজিব, তার ভগ্নিপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে সামরিক বাহিনী কিছু সদস্য ভোররাতে হামলা করেছে এবং যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেই শোকাহত, অনেকেই খুশিতে ডগমগ। রাস্তায় বেরিয়ে অনেকেই জটলা করছেন, এই ঘটনা নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। এর আগে কয়েক মাস ধরে ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এই স্লোগান দিয়ে বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য অনেকেই ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতার কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট ঢাকা শহরের রাস্তায় শেখ মুজিবের জন্য প্রকাশ্যে আফসোস করার মতো মানুষ তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিয়মিত রোজনামচা লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন শিক্ষক ছিলেন বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ। শেখ মুজিব সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল।
শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন হত্যা-লুণ্ঠনের বিভীষিকা মুজিবকে গণশত্রুতে পরিণতক করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থে সে সুযোগে তাকে হত্যা করায় সপরিবারে।
ধীরে ধীরে ১৫ আগস্টের ঘটনার বিবরণ প্রকাশ হতে থাকল। জানা গেল, সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। তাদের নেতা মেজর ফারুক রহমান ও মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন আরো কয়েকজন মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট ও জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। তাদের কয়েকজন এর আগে সেনাবাহিনী থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন। এই দলের অন্যতম ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদ। পরে তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। হুদা ১৯৬৫-৬৭ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি ছাত্রলীগ করতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র থাকাকালে তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তার কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন ছিলেন আবদুল বাতেন চৌধুরী। বাতেন ছিলেন জাসদের ঢাকা নগর পার্টি ফোরামের সদস্য। তিনি মুহসীন হলের তিন নম্বর কক্ষে থাকতেন। হুদা বাতেনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বাতেন স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সদস্য এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তার স্মৃতিচারণ থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
পঁচাত্তরের ১৩ আগস্ট বিকেল ৩টায় সেনা গোয়েন্দা দফতরের (ডিএমআই) ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা অসামরিক পোশাকে মুহসীন হলে আমার কক্ষে এলো। সে ঢাকা শহরের দায়িত্বে ছিল। আমরা সূর্যসেন হলের ক্যানটিনে গিয়ে চা খেলাম এবং তারপর রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে একটি গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসলাম। তারপর শুরু হলো কথাবার্তা।
হুদা : তোরা যেভাবে চেষ্টা করছিস, তাতে কিছু হবে না। লেট আস ইউনাইট অ্যান্ড গিভ হিম আ ব্রো।
বাতেন : ইউনাইট হতে পারি, কিন্তু ব্রো দিতে পারব না। আমরা বিপ্লবে বিশ্বাস করি। তুমি যা বলছ, সে পথ আমাদের নয়।
এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সন্ধ্যা হয়ে এলো। তারা দু’জন বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খাবার খেলেন। হুদা চলে যাওয়ার সময় বাতেনকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘কাল-পরশু দুর্দিন হলে না থাকাই ভালো। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। নানা ধরনের চাপ থাকবে। রাতে বাইরে থাকিস।’ হুদা বাতেনকে যোগাযোগের জন্য একটা টেলিফোন নম্বর দিলেন।
বাতেন সে রাতে মুহসীন হলেই ছিলেন। ১৪ আগস্ট তিনি আজিমপুর কলোনিতে তার বোনের বাসায় যান এবং সেখানেই রাত কাটান।
১৫ আগস্ট সকালে ঘুম ভাঙতেই রেডিওতে তিনি অভ্যুত্থানের সংবাদ পান। তিনি হেঁটে হেঁটে নিউ মার্কেট-নীলক্ষেতের মোড়ে বিউটি রেস্টুরেন্টে যান এবং সেখানে নাশতা করেন। তারপর মুহসীন হলের দিকে রওনা হতেই দেখলেন, বেশ কয়েকজন ছাত্র ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। তারা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত। বাতেন এদের মধ্যে ফকির গোলেদার রহমানকে দেখলেন। গোলেদার মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন নেতা গোছের ছিলেন। তার পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। গোলেদার বললেন, তিনি হলের গ্রিলবিহীন জানালা দিয়ে হল অফিসের একতলার ছাদে লাফিয়ে নেমেছেন এবং এখন যত দূরে সম্ভব চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বাতেনকে তিনি বললেন, ‘আমারে মাপ কইরা দিস।’
বাতেন মুহসীন হলে তার কক্ষে গেলেন। তিনি সেখানে জাহাঙ্গীর ও রুবেলকে পেলেন। ওরা দু’জনই সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগের কর্মী এবং ওই কক্ষেই থাকতেন। বাতেন বললেন, ‘তোরা আমার বোনের বাসায় চলে যা।’ তিনি নিজেই তাদের আজিমপুরে বোনের বাসায় নিয়ে এলেন।
বেলা ১১টার দিকে বজলুল হুদা বাতেনের বোনের বাসায় এসে হাজির হলেন। তিনি বাতেনকে নিয়ে বেরোলেন। তিনি নিজেই একটি জিপ চালাচ্ছিলেন। জিপের পেছনে একটা পিকআপে কয়েকজন সেপাই। হুদা বললেন, ‘জাসদের সাপোর্ট দরকার, এটার ব্যবস্থা করো।’ বাতেন বললেন, ‘জাসদ সাপোর্ট দেবে না। জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা করো। তাজউদ্দীনকে আনো, রাজ্জাককে আনো।’
হুদা বাতেনকে নিয়ে গণভবনের পেছনে একটা সেনাক্যাম্পে গেলেন। সেখানে একটা ক্যানটিনে তারা পরোটা-গোশত খেলেন। তারপর বাতেনকে আসাদ গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীনের বাসার দিকে রওনা হলেন। হুদা পরে তাজউদ্দীনের বাসায় তার অভিজ্ঞতার কথা বাতেনকে বলেছিলেন। তাজউদ্দীনকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’
বাতেনকে হুদা মুজিব হত্যার বিবরণ দিয়েছিলেন। তার ভাষ্য মতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে ওরা আক্রমণ চালায় মেজর (অব.) নূরের নেতৃত্বে। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বেরিয়ে আসেন। তিনি প্রথমে গুলি ছোড়েন। হুদা তৎক্ষণাৎ কামালকে গুলি করে হত্যা করেন। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ মুজিব ওপর থেকে চিৎকার করে তাদের গোলাগুলি থামাতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কোনো কিছু বলার থাকলে ওপরে এসে আমাকে বলো।’ হুদারা তখন দোতলায় ওঠেন। শেখ মুজিবকে দেখে হুদা স্যালুট দেন। রাষ্ট্রপতিকে সামনাসামনি দেখে ভয়ে ও উত্তেজনায় তার পা কাঁপছিল। সাহস সঞ্চয় করে হুদা বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ শেখ মুজিব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কোথায় যাবো? কেন যাবো? না, আমি যাবো না।’ হুদা সাহস সঞ্চয় করে বলেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে।’ তিনি শেখ মুজিবের গলার কাছে রিভলবারের নল ঠেকালেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘ঠিক আছে,্ আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।’ তার পরনে লুঙ্গি। হুদা সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন ন া। বললেন, ‘এ পোশাকেও আপনি বঙ্গবন্ধু, চেঞ্জ করলেও বঙ্গবন্ধুই থাকবেন। পোশাক বদলানোর দরকার নেই।’ মুজিব তাদের সাথে যেতে রাজি হলেন। বললেন, ‘দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক নিয়ে আসি।’ এই বলে তিনি তার ঘরে গেলেন এবং পাইপ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে পেছন থেকে একজন একটা গামছা বের করে শেখ মুজিবের চোখ বাঁধতে যান।
শেখ মুজিব হাত দিয়ে এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেন। হাতের আঘাত থেকে বাঁচতে হুদা হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন। তখন হুদার পেছন থেকে শেখ মুজিবের ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়। শেখ মুজিব ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অন্যরা এ সময় দোতলায় গিয়ে বাড়ির সবাইকে হত্যা করেন। ‘অপারেশন’ শেষ করে ফেরার সময় হুদা কামালের টয়োটা গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে আসেন এবং সেনানিবাসে তার মেসের সামনে রেখে দেন।
বাতেন হুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে?’ হুদা বলেছিলেন, ‘রেডিও স্টেশনে। সেখানে তাকে অ্যানাউন্সমেন্ট দিতে হতো, ‘বাকশাল বাতিল করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ হুদা আরো বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম না, তাকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা ছিল। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাকে ধরে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া।’ বাতেন জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোমরা তো তাকে পেয়েছিলেই, অন্যদের মারতে গেলে কেন?’ হুদার জবাব ছিল, ‘শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার পর আমরা আর কোনো সাক্ষী রাখতে চাইনি।’
শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের আকস্মিকতায় অনেকেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে তেমন উত্তেজনা লক্ষ করা যায়নি। হুদা বাতেনকে বলেছিলেন, এরকম একটা ঘটনা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবার কাম্য ছিল। শুধু দুটো বিষয়ে তাদের অনেকের অজ্ঞতা ছিল। প্রথমত, ঘটনাটি কবে ঘটানো হবে এবং দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে কি না। রশিদ-ফারুকের পরিকল্পনায় এই অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা সবাই হত্যা পরিকল্পনার কথা জানতেন না। অপারেশনে কার কী ভূমিকা, তা রশিদ-ফারুক ঠিক করে দেন।
মেজর নূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সদস্য ছিলেন। পরে তিনি সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত হন। সিরাজ শিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। ১৫ আগস্টের কয়েক দিন পর সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি বাসায় সন্ধ্যাবেলা বৈঠক করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, আকা ফজলুল হক ও মহসীন আলী। তারা নূর ও ডালিমকে ডেকে পাঠান। নূর একাই এসেছিলেন। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর বলেন, ‘ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি।’ নূরের উদ্ধত আচরণে এবং নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে জিয়াউদ্দিন ক্ষুব্ধ হন।
১৫ আগস্টের পর ফারুক, রশিদ ও ডালিমকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। অনেক দিন পর বনানী ডিওএইচএসে কর্নেল ফারুকের বাসায় ফারুক ও রশিদের সাথে আলাপ করার সময় আকা ফজলুল হককে রশিদ বলেছিলেন :
শেখ মুজিবকে রেখে ক্যু করা যাবে কি না, তা নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। দেখলাম তা সম্ভব নয়। রক্ষীবাহিনীর চিফ ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে আগেই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত হয়। মুজিব পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সিদ্ধান্তটি অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়েছিল।
মুজিব হত্যার পরিকল্পনায় বিমানবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তাদের বাদ দিয়েই এই অপারেশন চালানো হয়। এরকম একটা ‘অ্যাডভেঞ্চারে’ শরিক হতে না পেরে তারা মনোক্ষুণœ হয়েছিলেন। এর প্রকাশ ঘটেছিল নভেম্বরে। ১০
হুদার সাথে কথাবার্তায় বাতেনের মনে হয়েছিল, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সবাই সবটা জানেন না।যারা এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মতৈক্য ছিল। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তাদের অনেকের ব্যক্তিগত ক্ষোভও ছিল। ১১
কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটিই অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে এরকম একটি ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তার অজানা থাকার কথা নয়। কোটি টাকার প্রশ্ন ছিল, কবে, কখন? শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি তার ক্ষোভ ছিল অপরিসীম।
তাহের মনে করতেন, ‘মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষীবাহিনীর মতো একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় ভারতের সাথে করা গোপন চুক্তির ব্যাপারেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাহাত্তর সালের নভেম্বরেই এসব ঘটেছিল এবং এ কারণেই লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন ও তিনি যার যার রাজনৈতিক লাইন বেছে নিয়েছিলেন। অবশ্য তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করতেন।’ বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাহেরের পর্যবেক্ষণ ছিল সোজাসাপটা : ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবারই জানা, কীভাবে একটির পর একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। আমাদের সব লালিত আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও মূল্যবোধ একের পর এক ধ্বংস করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়েছিল অত্যন্ত নোংরাভাবে। জনগণকে পদদলিত করে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র।’
ছিয়াত্তরে তাহের ও অন্যদের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দিতে তাহের এসব কথা উল্লেখ করেন। শেখ মুজিব সম্পর্কে তাহেরের মূল্যায়ন ছিল এরকম : ‘শেখ মুজিব জনগণের নেতা ছিলেন। অস্বীকার করার অর্থ হবে সত্যকে অস্বীকার করা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার জনগণের ওপরই বর্তায়। জনগণের জন্য সঠিক পথ হবে জেগে ওঠা এবং প্রতারণার দায়ে মুজিবকে উৎখাত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনগণ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে, তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে। জনগণ কাউকে ষড়যন্ত্র করার অধিকার দেয়নি।’
আওয়ামী লীগ-বাকশালের বাইরে ওই সময় সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ছিল জাসদ। জাসদের প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খান তখন দেশে নেই। দলে একাধিক ‘কেন্দ্র’। গণবাহিনীর ইউনিটগুলো বিভিন্ন জেলায় মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিত, বিহ্বল। জাসদের মধ্যে যারা ষাটের দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন, ১৫ আগস্টের মতো একটা ঘটনা ঘটতে পারে, এটা তারা কখনো চিন্তা করেননি।
১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা নগর গণবাহিনীর সদস্য মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চুর সাথে তিতুমীর কলেজের সহসভাপতি কামালউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, ওয়াহিদুল ইসলাম সুটুল, নওশের ও রতন ধানমন্ডিতে তাজউদ্দীনের বাসায় যান। কামালের বাড়ি ঢাকার কাপাসিয়া থানায়। তার বড় ভাই নৌবাহিনীর সাবেক লিডিং সি-ম্যান সুলতানউদ্দিন আহমদ আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত এবং জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তাজউদ্দীনের সাথে তার আগে পরিচয় ছিল এবং একই এলাকায় বাড়ি বলে তাদের মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো।
তাজউদ্দীনের বাসায় গিয়ে তারা শুনলেন, তিনি গোসল করছেন। তারা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মিনিট দশেক পর তাজউদ্দীন এলেন। পরনে একটি পায়জামা, গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি। সিলিং ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে দুই হাতের আঙুল দিয়ে ব্যাকব্রাশের মতো ভঙ্গিতে চুল থেকে পানি ঝরাচ্ছিলেন। পানির ঝাপটা কামালের চোখে-মুখে এসে লাগছিল।
তাজউদ্দীন উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকলেন, ‘বোকার দল লাল বাহিনী বানায়, নীল বাহিনী বানায়। কোনো বাহিনী তাকে বাঁচাতে পারল?’
বাচ্চু বললেন, ‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ তাজউদ্দীন বললেন, ‘কোথায় যাবো? কেন তোমাদের সঙ্গে যাবো?’ বাচ্চু বারবার বলছিলেন, ‘যেতেই হবে।’
তাজউদ্দীন কামালকে বললেন, ‘নান্নু, এটা কারা করল? রাইটিস্টরা না লেফটিস্টরা? ফেলটিস্টরা হলে আমাকে আর জীবিত রাখবে না।’ নান্নু কামালের ডাকনাম। তাজউদ্দীন তাকে এই নামেই ডাকতেন। লেফটিস্ট বলতে তিনি পিকিংপন্থীদের বোঝাচ্ছিলেন। বাচ্চুর কথার জবাবে তিনি বললেন, ‘সিরাজ কোথায়? ও যদি বলে তাহলে যেতে পারি। তাকে নিয়ে আসো।’ বাচ্চু বেরিয়ে গেলেন। আধা ঘণ্টা পর তিনি ফিরে এসে জানালেন, সিরাজুল আলম খান কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। বাচ্চু জানতেন না, তিনি দেশে নেই। অগত্যা তাজউদ্দীনকে ছাড়াই তারা ফিরে এলেন।
তাজউদ্দীনকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এবং কেন, এটা বাচ্চু ছাড়া তার অন্য সহযোগীরা জানতেন না। বাচ্চুর সাথে যাওয়ার সময় কামালের মনে হয়েছিল, তাজউদ্দীনকে বোধ হয় কোনো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হবে। ২৬ নভেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনে একটি অভিযানে বাচ্চু নিহত হলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। এটা আর হয়তো কোনো দিনই জানা যাবে না যে কে বাচ্চুকে পাঠিয়েছিল এবং কী উদ্দেশ্যে।
১৫ আগস্ট সকালে মুহসীন হলের ছাত্র নূর মোহাম্মদ ঢাকা গণবাহিনীর উপপ্রধান আবুল হাসিব খানের কাছে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের একটি চিরকুট নিয়ে আসেন। চিরকুটে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভা হবে বলে উল্লেখ ছিল। সভা শুরু হলে আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘র মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো, কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।’১৪
লে. কর্নেল আবু তাহের গোপনে গণবাহিনী গড়ে তুলছিলেন। ডালিম ও নূর তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তাহের ও ডালিমের চিন্তাধারা ছিল একই রকম। তাহের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেননি। তবে ওই দিনই তিনি অভ্যুত্থানকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
লে. কর্নেল আবু তাহের মেজর রশিদের অনুরোধে সকাল ৯টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। সেখানে তিনি খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম ও মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখতে পান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার জন্য। তিনি খন্দকার মোশতাককে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো ছিল :
অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করতে হবে;
সারা দেশে সামরিক আইন জারি এবং এর প্রয়োগ করতে হবে;
দলনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে;
বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে;
অবিলম্বে একটি গণপরিষদ তথা পার্লামেন্টের জন্য সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সামরিক শাসন জারির দাবি ছিল তাহেরের একান্ত নিজস্ব। এ বিষয়ে তিনি গণবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড কিংবা জাসদের পার্টি ফোরামের সাথে আলোচনা করেননি এবং এসব প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পার্টি তাকে কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই প্রস্তাব ছিল জাসদের মূলনীতির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। বিশেষ করে, সামরিক আইন জারির প্রস্তাবটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা যেকোনো সুস্থ রাজনৈতিক দলের জন্যই অপমানজনক এবং প্রগতিশীল রাজনীতির চেতনাবিরোধী। তাহের সব সময় শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিবাদী’ রাজনীতির বিরোধী ছিলেন এবং তার সরকারের উৎখাত চাইতেন। জাসদও একই দাবি করেছে। কিন্তু জাসদ কখনোই দেশে সামরিক শাসন চায়নি।
খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। মেজর রশিদ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহেরকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। তাহের যখন দুপুরে বঙ্গভবনে পৌঁছান, ততক্ষণে শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। তাহের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মেজর রশিদসহ সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন এবং সকালে খন্দকার মোশতাককে দেয়া তার প্রস্তাবগুলো আবার উল্লেখ করেন। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ডেকে নেন। সবাই তাহেরের প্রস্তাবগুলো সময়োচিত বলে একমত হন।১৭ দু’দিন পর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।
১৫ আগস্টের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।’
http://www.onnodiganta.com/article/detail/3544#.VF3d7mf5Pcc
No comments:
Post a Comment