দি লাস্ট মোগল
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
১৮৫৮ সালের জুন মাসে লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতা উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল দিল্লিতে আসেন। দিল্লি নগরী তখন ধ্বংসস্তূপ। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এ দেশীয় সিপাহিরা যে মহাবিদ্রোহ সঙ্ঘটিত করেছিল, তা দমন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বিদ্রোহ দমনের পর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দিল্লির পথে পথে তখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল মানুষের কঙ্কাল। মসজিদের মিনার ও গম্বুজ কামানের গোলায় ক্ষত। কিন্তু মোগলদের ঐশ্বর্য ও মহিমার সাক্ষী বিখ্যাত লালকেল্লা তখনো টিকে আছে উজ্জ্বলতা নিয়ে। হাওয়ার্ড রাসেল, যাকে যুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতার পিতা বলা হয়, তিনি তার ডায়েরিতে লিখেন, ‘এমন অনুপম একটি স্থাপত্য আমি আর দেখিনি। উজ্জ্বল লাল বেলেপাথরে গাঁথা প্রাচীরবেষ্টিত বিশাল স্থাপনাটি আমাকে বারবার উইন্ডসর ক্যাসেলের অতি মনোরম অংশটিকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।’ কিন্তু রাসেল যে অনুসন্ধানে এসেছিলেন, সেখানে পৌঁছার পথটি তত আকর্ষণীয় ছিল না। তাকে লালকেল্লার পেছন দিকে একটি অন্ধকার সরু গলি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এক প্রকোষ্ঠে, যেখানে ৮৩ বছর বয়স্ক ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের এক বৃদ্ধকে আটকে রাখা হয়েছে, যাকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের মূল নায়ক হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। এই বিদ্রোহ ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা এবং পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের যেকোনো স্থানে সঙ্ঘটিত সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্যে ভয়াবহতম।
রাসেল লিখেছেন, ‘ক্ষীণ দৃষ্টি সত্ত্বেও তার চোখে অনুসন্ধিৎসা, ঠোঁট ঝুলে পড়েছে, মাঢ়ি দাঁতশূন্য। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। দিন-রাত তিনি মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। যে পরিস্থিতিতে তিনি পতিত হয়েছেন, তাতে তিনি বিস্মিত, হতবাক। অতিবার্ধক্যে তার দৃষ্টি অস্পষ্ট, ঝাপসা। এক সময়ে অনেকে তার রচিত কবিতার আবৃত্তি শুনেছে। কাঠকয়লা দিয়ে কিছু কিছু কবিতা তিনি দেয়ালেও লিখেছেন।’
এই বন্দী ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, যিনি বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর নামেই অধিক পরিচিত। তিনি মোগল বংশের শেষ বাদশাহ। চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন, ‘প্রতিপালকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাকে বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সন্দেহ নেই যে, তিনি দুর্বল এবং নিষ্ঠুর এক বৃদ্ধ; কিন্তু এমন একজন লোককে অকৃতজ্ঞ বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত, যিনি দেখেছেন যে তার পূর্বপুরুষের সাম্রাজ্য কী করে ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করে তাকে শূন্যগর্ভ উপাধিসর্বস্ব অস্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে, ততোধিক শূন্য করা হয়েছে তার রাজকোষ এবং প্রাসাদ পরিপূর্ণ হয়েছে কপর্দকহীন অনেক শাহজাদায়।’
বাহাদুর শাহ জাফর ১৭৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন যখন ব্রিটিশরা প্রায় গুরুত্বহীন উপকূলীয় তিনটি স্থানÑ কলকাতা, মাদ্রাজ ও মুম্বাইতে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছেন, তার একসময়ের মহাপরাক্রমশালী রাজবংশ কেমন অপমানজনকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে আর ব্রিটিশরা কিভাবে একেবারে সাধারণ বণিকের অবস্থা থেকে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
বাহাদুর শাহ জাফর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তার বয়স ৬৪ পেরিয়ে গেছে। মোগলদের যে রাজনৈতিক অবক্ষয় তার পিতামহ সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের সময়ে শুরু হয়েছিল তা রোধ করে পরিস্থিতির উন্নতিসাধন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাকে ঘিরে দিল্লির কৃতী ও মেধাবী লোকদের একটি মহল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও তার বংশের মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী, সহনশীল ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার, সুফিবাদবিষয়ক রচনায় আগ্রহী, মোগল মিনিয়েচার চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক এবং উদ্যান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহী ব্যক্তি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সুফিকবি ছিলেন, যিনি শুধু উর্দু ও ফারসি ভাষায় নয়, পাঞ্জাবি ও ব্রজ ভাষায় অনেক কবিতা রচনা করেছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ রেনেসাঁ সঙ্ঘটিত হয় তার সময়ে। তার দরবারের সাথে জড়িত হয়েছিলেন উর্দু সাহিত্যের দুজন বিখ্যাত কবি মির্জা গালিব ও ইব্রাহিম জওক।
ব্রিটিশরা একে একে সম্রাটের ক্ষমতা ও এখতিয়ার খর্ব করতে শুরু করেছিল। তারা মুদ্রা থেকে মোগল সম্রাটের নাম বাদ দেয়, দিল্লির নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে তুলে নেয় এবং মোগল পরিবারকে লালকেল্লা থেকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে। বাহাদুর শাহের দরবার তখনো গজল চর্চা ও উর্দু কবিতার ছন্দ মেলানোর অবসাদে আচ্ছন্ন। অতএব ভারতের রাজনৈতিক গগন যখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ছেয়ে গেল, তখন মোগল দরবার হারিয়ে গিয়েছিল প্রমোদ উদ্যানে, বাইজিদের মুজরা ও কবিদের মুশায়রায়।
এমনই এক পরিস্থিতিতে ১৮৫৭ সালের মে মাসের এক সকালে মিরাট থেকে ৩০০ বিদ্রোহী সৈন্য দিল্লিতে আসে মিরাটে খ্রিষ্টান নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করে। বাহাদুর শাহ জাফরকে তারা তাদের নেতা ও সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। তারা ধ্বনি তোলে ‘খালক খোদা কি, মুলক বাদশাহ কা, হুকুম জাঁহাপনা কা’Ñ মানুষের মালিক আল্লাহ, দেশের মালিক বাদশাহ এবং আইন একজনের পৃথিবী যার আশ্রয়ে থাকে। বাহাদুর শাহ ব্রিটিশের মিত্র ছিলেন না কিন্তু বিদ্রোহের সূচনা থেকেই তিনি জানতেন যে তাকে যে নেতা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, এ উদ্যোগ ঠেকাতেও তিনি সক্ষম নন। বিদ্রোহীরা ছিল কোনো অধিনায়কহীন, তাদের অধিকাংশই কৃষকদের মধ্য থেকে বাছাই করা, যারা নিয়মিত বেতনও পেত না। তাদের পক্ষে তখনকার বিশ্বের সেরা সামরিক শক্তিকে মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না। বিদ্রোহীদের সাহায্য ও সমর্থন করার জন্য এগিয়ে আসার মতো কোনো বিদেশী বাহিনীও তৈরি ছিল না। তদুপরি বিদ্রোহী সিপাহিদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য রসদের সরবরাহ ছিল অপর্যাপ্ত।
এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা দিল্লি থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়ন করতে সক্ষম হলেও ব্রিটিশ বাহিনী অল্প কিছু দিনের মধ্যে অন্যান্য স্থানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর দিল্লি অবরোধ করে। মোগল রাজধানীর অবরোধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্টালিনগ্রাদ অবরোধের মতো। দুটি শক্তির মধ্যে মরণপণ যুদ্ধ চলে। কারো পক্ষে পশ্চাদপসরণ সম্ভব ছিল না। দিল্লির যুদ্ধে অকল্পনীয়সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং উভয় পক্ষে সৈনিকদের মোকাবেলা করতে চরম শারীরিক ও মানসিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ও তাদের অনুগত শিখ ও পাঠান সৈন্যরা বিদ্রোহীদের পর্যুদস্ত করে নগরী দখল করে অবাধে লুণ্ঠন চালায় ও ঠাণ্ডা মাথায় অগণিত বেসামরিক লোককে হত্যা করে। কাচা চেলা নামে একটি মহল্লাতেই হত্যা করা হয় ১৪০০ বেসামরিক নাগরিককে। ব্রিটিশ বাহিনীর উনিশ বছর বয়সী সৈনিক এডওয়ার্ড ভাইবার্ট তার বিবরণীতে লিখেছেন, ‘নির্দেশ দেয়া হয়েছিল প্রতিটি জীবিত মানুষকে হত্যা করতে। এ ছিল নিছক হত্যাকাণ্ডÑ আমি বহু রক্তক্ষয়ী ও অবর্ণনীয় হত্যার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু গতকালের দেখা দৃশ্যের পর আমি প্রার্থনা করেছি, যাতে এহেন ঘটনা আর দেখতে না হয়। হত্যাকাণ্ড থেকে মহিলাদের বাদ দেয়া হলেও তারা স্বামী ও পুত্রদের তাদেরই সামনে হত্যা করতে দেখে যেভাবে আর্তচিৎকার করছিল তা অতি বেদনাদায়ক। ঈশ্বর আমার সাক্ষী, আমি কোনো করুণা অনুভব করিনি, কিন্তু যখন পাকা দাড়িবিশিষ্ট কোনো বৃদ্ধকে যদি কারো চোখের সামনে গুলি করা হয় তখন কোনো কঠিন হৃদয়ের লোকের পক্ষেও নৈর্ব্যক্তিকভাবে তা পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব বলে আমার ধারণা।’
দিল্লিবাসীর অনেকে ব্রিটিশ প্রতিহিংসার শিকার হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে গ্রামে চলে যাওয়ায় নগরী জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ জাফরসহ মোগল রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্য শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও বাদশাহ’র ষোলপুত্রের অধিকাংশই বিচারের সম্মুখীন হয় এবং ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তিনজনকে নগ্ন করে হত্যা করে ক্যাপ্টেন হডসন নামে এক অফিসার। ঘটনার পরদিন হডসন তার বোনকে এক চিঠিতে লিখে, ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি তাতার উদ্ভূত তৈমুরের বংশের প্রধান সদস্যদের খতম করেছি। আমি নিষ্ঠুর নই, কিন্তু এ কথা স্বীকার করছি যে, এই দুষ্ট ক্ষতগুলোর কবল থেকে পৃথিবীকে রক্ষার সুযোগ আমি উপভোগ করেছি।’
বন্দী বাহাদুর শাহ জাফরকেও তারই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং তাকে নির্বাসনের শাস্তি দেয়া হয় বিচারের রায়ে। একটি গরুর গাড়িতে উঠে তিনি চিরদিনের জন্য ছেড়ে যান তার প্রিয় নগরী। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভগ্নহৃদয় শেষ মোগল সম্রাট ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর রেঙ্গুনে মৃত্যুবরণ করেন।
বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনকে কেন্দ্র করে মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও অবসানের ওপর ভিত্তি করে জনপ্রিয় স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ড্যালরিম্পেল রচনা করেছেন প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘দি লাস্ট মোগল : দি ফল অব এ ডাইন্যাস্টি-১৮৫৭’। এই ব্যতিক্রমী ও বিয়োগান্তক কাহিনীর উপকরণ সংগ্রহ করতে চার বছরের অধিক সময় ধরে তাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। বাহাদুর শাহের স্বহেস্ত লিখা চিঠি ও অন্যান্য দলিল ঘাঁটতে তাকে লন্ডন, লাহোর, দিল্লি ও ইয়াঙ্গুনের মহাফেজখানাগুলোতে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে তার স্বভাবসুলভ বর্ণনারীতি সিপাহি বিদ্রোহের সেই দুর্ভাগ্যজনক মাসগুলোকে পাঠকের সামনে জীবন্ত করে হাজির করেছে। বাহাদুর শাহের জীবনের শেষ দিনগুলোকে তিনি তুলে ধরেছেন সাহিত্যিক সৃজনশীলতা, পাণ্ডিত্য ও নতুন উপাদনের সমাবেশ ঘটিয়ে।
উইলিয়াম ড্যালরিম্পেলই সম্ভব প্রথমবারের মতো সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশ নৃশংসতা, বিশেষ করে দিল্লির পতনের পর নগরবাসীর ওপর তারা যে হিংস্রতায় প্রতিশোধ নিয়েছে, তাদের সর্বস্ব লুট করেছে তা তিনি তুলে ধরেছেন মানবিক আবেগ-অনুভূতি দিয়ে। বিদ্রোহের সূচনায় দিল্লিতে বসবাসরত ব্রিটিশ মহিলারা ধর্ষিত হয়েছিল বলে দীর্ঘকাল ধরে যে অপবাদ বিদ্রোহী সিপাহিদের ওপর আরোপ করা হয়েছিল ড্যারিলম্পেল তা ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপন করে খণ্ডন করেছেন। বাদশাহ জাফর বরং নগরীর ব্রিটিশ নারী-পুরুষ ও শিশুদের প্রাসাদে আশ্রয় দিয়ে বিদ্রোহীদের হুমকির মধ্যেও হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ, ইসলামের বিধান অনুসারে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করা গোটা মানবতাকে হত্যা করার শামিল। যুদ্ধ চলাকালেও সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা করা ইসলামের নির্দেশ। এমনকি পানির উৎস, খাদ্যশস্য ও ফসলের মাঠ ধ্বংস করতে নিষেধ করা হয়েছে ইসলামে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ জাফর তার আশ্রিতদের রক্ষা করতে পারেননি। দিল্লির পতনের পর তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রহসনের বিচার করে সেখানে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।
বাহাদুর শাহ জাফর হয়তো ইসলামের ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন যে মহান সালাহউদ্দিন খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের পরাজিত করে জেরুসালেম পুনর্দখল করার যুদ্ধে এবং নগরী পুনর্দখল করার পরও সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করেননি, বরং নগরীর খ্রিষ্টানদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। অথচ জেরুসালেম যখন ক্রুসেডারদের হাতে পড়েছিল তখন মুসলমানদের রক্তে নগরীর রাস্তা ভেসে গিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ বাহিনীও দিল্লিতে নজিরবিহীন হত্যালীলা চালিয়েছিল, যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে কমই আছে।
সন্দেহ নেই, মোগলদের অবক্ষয়ের অনিবার্য পরিণতি ছিল ব্রিটিশ কর্তৃক এ দেশকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করা। উইলিয়াম ড্যালরিম্পেলের গবেষণায় আরো একটি বিষয় গুরুত্ব পেরেছে, তখনকার মুসলিম সংস্কারকরা, বিশেষ করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাভী মোগল রাজপরিবার ও দরবারিদের নৈতিক অধঃপতনের নিন্দায় সোচ্চার ছিলেন।
সিপাহি বিদ্রোহের কারণ যে শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ছিল না, বরং ধর্মীয় কারণও বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছে ‘দি লাস্ট মোগল’-এ তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের অতি উৎসাহ এবং ভারতীয়দের খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার লক্ষ্য সিপাহি বিদ্রোহের একটি বড় কারণ ছিল।
একটি কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে মোগলদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার সুযোগে একের পর এক রাজ্য মোগল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং মোগলবিরোধী অধিকাংশ শাসকের সাথে ব্রিটিশরা মিত্রতা স্থাপন করে। মোগল নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত শুধু দিল্লিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং মোগল সম্রাটকে অতঃপর ব্রিটিশরা হিন্দুস্থানের মহান শাসক হিসেবে উল্লেখ না করে বলত ‘দিল্লির বাদশাহ’। অতএব, বাহাদুর শাহ জাফর আর কোনো সাম্রাজ্যের বাদশাহ ছিলেন না, তিনি ছিলেন নগরকেন্দ্রিক একজন শাসক এবং তার সে অস্তিত্বও ছিল যখন হিন্দুস্থানি ও ব্রিটিশদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
এই সহাবস্থানের কারণে ভারতে ব্রিটিশ ক্ষমতা একদিকে তুঙ্গে ওঠে, অপরদিকে খ্রিষ্টবাদও প্রসারিত হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের সব প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে মূর্ত করে ক্ষমতার ভারসাম্য নিজেদের অনুকূলে নিয়ে যায়। সে সময়ের ধর্মীয় পরিবর্তনের ফলে এ দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গিও গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত ব্রিটিশরা তাদের সম্পত্তির মালিকানাবিষয়ক দলিলে তাদের ভারতীয় বিবিদের নামে যে সম্পত্তি অর্পণ করতেন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে শেষ দিকের ব্রিটিশরা ভারতীয় বিবিদের আর সম্পত্তির মালিকানা দিতেন না।
মোগলদের সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা যখন পুরোপুরি লোপ পায় এবং ভূখণ্ডগত অভিলাষ পোষণের আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট ছিল না, তখন বাহাদুর শাহ জাফর ও তার সভাসদদের মধ্যে বিকল্প হিসেবে স্থান করে নেয় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। কবিতার স্বাদ নেমে আসে দিল্লির রাজপথে। ১৮৫৫ সালে দিল্লির উর্দু কবিদের একটি কবিতা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়, যাতে ৫৪০ জন কবির কবিতা স্থান পেয়েছিল এবং তাদের মধ্যে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর থেকে শুরু করে চাঁদনী চকের দরিদ্র ভিশতিওয়ালা, একজন তরুণ কুস্তিগির, এক বাইজি এবং একজন নাপিতও ছিলেন।
এ সময়ের লালকেল্লার রেকর্ডে দরবারের দিনলিপির উল্লেখ রয়েছে, যাতে বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্মের বিস্তারিত বিবরণ আছে। মোগল সম্রাট নেহাতই বৃদ্ধ লোক, প্রতিদিন তার পায়ে তেল মালিশ করা হচ্ছে ব্যথা নিরাময়ের জন্য, কখনো তিনি উদ্যান পরিদর্শনে যাচ্ছেন, কখনো শিকারে যাচ্ছেন অথবা মুশায়রার আয়োজন করছেন। বিকেলে তিনি তার হাতিগুলোর গোসল করানো প্রত্যক্ষ করেন। সান্ধ্য আকাশে চাঁদের পানে তাকিয়ে থাকেন, কখনো গজল শোনেন, সুমিষ্ট পাকা আম খান।
১৮৫০-এর দশকের প্রথমদিকে অনেক ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোগল দরবার পুরোপুরি বাতিল করে ভারতে শুধু ব্রিটিশ আইন ও ব্রিটিশ প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয়াই নয়, খ্রিষ্টধর্ম চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রও করতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়া ছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। তখনকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী বেঙ্গল আর্মির ১ লাখ ৩৯ হাজার সিপাহির মধ্যে ৭ হাজার ৭৯৬ জন ছাড়া অবশিষ্ট সবাই তাদের ব্রিটিশ প্রভুর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায়। ভারতের অনেক স্থানেই বিদ্রোহী সিপাহিদের সাথে যোগ দেয় সমগ্র জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাশকতা সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে।
বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিল দিল্লি। বিদ্রোহী সৈন্যরা উত্তর-ভারতের সব এলাকা থেকে দিল্লিতে প্রবেশ করতে শুরু করলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দিল্লি পুনর্দখল করতে না পারলে তাদের চিরদিনের জন্য ভারত সাম্রাজ্য হারাতে হবে। বিদ্রোহীরাও একইভাবে উপলব্ধি করেছিল যে তারা যদি দিল্লি হারায় তাহলে সবকিছুই হারাবে। অতএব, সম্ভাব্য প্রতিটি ব্রিটিশ সৈন্যকে দিল্লিতে পাঠানো হয় ভারতীয় গ্রীষ্মের সবচেয়ে উত্তপ্ত মাসগুলোতে। ব্রিটিশ কামানের গোলাবর্ষণে আতঙ্কিত নগরবাসী পালাতে শুরু করে এবং অনেকে নিহত হয়।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের মার্কসবাদী ইতিহাসবিদরা প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে বর্ণনা করলেও মূলত এটি ছিল ব্যাপক অর্থে একটি ধর্মযুদ্ধ। মিশনারি ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে এ দেশের মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছিল এটি এবং একই সাথে ছিল বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ। ১৮৫৭ সালের ১১ মে বিদ্রোহী সিপাহিরা বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে নিবেদন করেছে, ‘আমরা আমাদের ধর্ম ও আমাদের বিশ্বাসকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।’ এরপর তারা চাঁদনীচকে গিয়ে জনতাকে বলেছে, ‘আপনারা কি আমাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী?’ ব্রিটিশ নারী-পুরুষ, যারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল, বিদ্রোহীরা তাদের কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু যেসব ভারতীয় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল বিদ্রোহীরা তাদের পাওয়া মাত্র হত্যা করেছে।
আরো লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই ছিল হিন্দু। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা দিল্লির জুমা মসজিদে উত্তোলন করেছিল জিহাদের পতাকা এবং বহু সিপাহি জাতিধর্ম নির্বিশেষে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে মুজাহেদিন, গাজী ও জিহাদি বলে। দিল্লির পতন যখন আসন্ন তখন বহু সিপাহি খাদ্যাভাবে, বেতন লাভের অনিশ্চয়তায় ও মনোবল হারিয়ে পালিয়ে গেলেও নতুন নতুন সিপাহি এসে তাদের স্থান পূর্ণ করে এবং একটি বাহিনীর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণে বিরত থেকে আমৃত্যু লড়াইয়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নগরীর পতন ঘটে এবং দিল্লি পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। শুধু মোগল প্রাসাদ নয়, সাধারণ বাড়িঘর পর্যন্ত লুণ্ঠিত হয় এবং সেগুলো কামানের গোলায় অথবা বারুদে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। মোগল ঐশ্বর্যের গর্বিত প্রতীক হয়ে ওঠে বিষাদের প্রতিকৃতি। লালকেল্লাকে পরিণত করা হয় ব্যারাকে। স্থাপত্যকর্মের ধ্বংসসাধনের জন্য ভিক্টোরিয়া স্থাপত্যের চর্চাকারীরাও অতি ঘৃণ্য কাজ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস ফার্গুসন তার রচিত ‘হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা এই ভীতিকর বর্বরতা ও জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছে তারা একটিবারের জন্যও ভেবে দেখেনি যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই প্রাসাদটি সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।’ তখনকার ব্রিটিশ সামরিক প্রকৌশলীরা ভেবেছিল যে, প্রাসাদ ধ্বংস করে তারা তাদের ব্যারাকের চার পাশ ঘিরে বিনা ব্যয়ে একটি সুউচ্চ প্রাচীর পাবে এবং কোনো মাতাল সৈনিকও নজরদারির বাইরে থাকবে না। শুধু অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেই প্রাচীরটি রেখে দেয়া হয়। জেমস ফার্গুসন এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় অপ্রয়োজনীয় নাশকতা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
এখনো দিল্লির প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও অযতœ যেকোনো দর্শনার্থীকে হতবাক করে। মোগল দিল্লি অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল তখন নগরীর পরিবেশও ছিল বিষণœ। মাইলের পর মাইল জুড়ে ধসে পড়া ভবনের সারি, তাতে গাছপালার জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে, কোনোটি দস্যুরা দখল করেছে, কোনোটি আবার পুরনো মালিকানায় ফিরে এসেছে। কিন্তু অবহেলিত হয়েছে সবার দ্বারা। অতএব, শুধু পড়ে আছে ৬০০ বছরের প্রাচীন মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। অথচ দিল্লি ছিল তখন কন্সটান্টিনোপল ও ক্যান্টনের মধ্যবর্তী স্থানে সর্ব বৃহৎ নগরী। হাম্মামখানা, প্রাসাদ, উদ্যান, সহস্র স্তম্ভের মিলনায়তন, সুবিশাল গম্বুজ, শূন্য মসজিদ এবং অর্ধজনশূন্য সুফি মাজার-স্থাপনার যেন শেষ নেই। মোগল যুগের বিশিষ্ট কবি মীর সওদা দুঃখ প্রকাশ করেছেন , ‘আমি কী করে দিল্লির এই দুর্দশা বর্ণনা করব। এমন কোনো বাড়ি নেই যেখান থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায় না। এক সময়ের মনোরম উদ্যানে ভূপাতিত স্তম্ভের চার পাশে গজিয়ে উঠেছে কোমর সমান ঘাস। যেখানে একদিন ঝাড়বাতি উজ্জ্বল আলো ছড়াত, এখন সেখানে মাটির প্রদীপও জ্বলে না।’
১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসে; বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর রেঙ্গুনে শীতের আর্দ্রতার মধ্যে বিকেল ৪টায় কাফন পরানো একটি মৃতদেহ প্রহরা দিয়ে ছোট্ট একদল ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে গেল কারা বেষ্টনীর পেছন দিকে অজ্ঞাত এক কবরে দাফন করতে।
কারা প্রাচীরের ওপর দিয়ে রেঙ্গুন নদীর ঘোলা পানি এবং একটু ভাটির দিকে পাহাড়ি অবস্থানে দেখা যায় শেও ডাগন প্যাগোডার পেঁচানো চূড়া। কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বন্দরের নতুন সেনানিবাস। বন্দর ও প্যাগোডার জন্য খ্যাত নগরীটি ব্রিটিশ বাহিনী মাত্র ১০ বছর আগে দখল করেছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান জ্বালিয়ে দিয়েছে। যে মৃতদেহের উল্লেখ করা হয়েছে সেটি এক রাজবন্দীর এবং তার খাটিয়া অনুসরণ করছে তার দুই পুত্র এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধ মোল্লা। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কোনো মহিলার উপস্থিতি অনুমোদিত নয়। বাজারের কিছু লোক, যারা কোনোভাবে বন্দীর মৃত্যুর খবর পেয়েছে তারা এসে ভিড় করায় সশস্ত্র প্রহরীরা তাদেরকে একটু দূরে ঠেকিয়ে রেখেছে। তবুও দু-একজন লোক প্রহরীদের বেষ্টনী ডিঙিয়ে মৃতদেহ কবরে নামানোর আগে তা স্পর্শ করেছে। অনুষ্ঠানটি ছিল সংক্ষিপ্ত। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ কবরস্থ করার মধ্য দিয়ে শুধু নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল তা নয় বরং খাটিয়া ও মৃতদেহের দ্রুত ক্ষয় নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে চুনও সংগ্রহ করে রেখেছিল। সংক্ষিপ্ত জানাজা শেষে কোনো শোক প্রকাশ ও বিলাপ করার সুযোগ না দিয়ে কবরে চুনের আস্তরণের ওপর মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। এ ছাড়া ঘাসের চাপড়া বসানো হলো কবরের ওপর যাতে এক মাস বা আরো কিছু বেশি সময়ের মধ্যে কবরটির কোনো নিশানা মাত্র না থাকে। এক সপ্তাহ পর ব্রিটিশ কমিশনার ক্যাপ্টেন এইচ এন ডেভিস ঘটনার বিবরণ দিয়ে লন্ডনে রিপোর্ট পাঠান : ‘অবশিষ্ট রাষ্ট্রীয় বন্দীরা, এশীয় হারেমের মহিলারা ভালোভাবে আছে। শয্যাশায়ী বৃদ্ধ লোকটির মৃত্যুতে পরিবারটির মধ্যে কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। তার মৃত্যু স্পষ্টতই শারীরিক জরাজীর্ণতা ও গলার একটি অংশে পক্ষাঘাতজনিত কারণে হয়েছে। যে দিন তার শেষকৃত্য হয়। সে দিনই ভোর ৫টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সম্ভবত কিছু উগ্র ধর্মান্ধ, যারা শেষকৃত্যানুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে এবং ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করেছে তারা ছাড়া রেঙ্গুনের জনগোষ্ঠীর মুসলিম অংশের ওপর সাবেক বাদশাহর মৃত্যুর কোনো প্রভাব পড়েনি বলা যেতে পারে। কবর ঘিরে বেশ খানিকটা দূরে বাঁশের বেড়া তৈরি করা হয়েছে, যেটি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সময়ের মধ্যে কবরের জায়গাটির ওপর ঘাস গজিয়ে যাবে এবং মহান মোগলদের শেষ ব্যক্তিটির শেষ বিশ্রামস্থল শনাক্ত করার আর কোনো উপায় থাকবে না।’ ডেভিস যে রাজবন্দীর উল্লেখ করেছেন, তিনি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, যার জনপ্রিয় নাম ছিল জাফর অর্থাৎ বিজয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮৫৮ সালে তাকে দিল্লি থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল সুদূর বার্মায়।
বাহাদুর শাহ জাফর ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ব্রিটিশের সাথে লড়াই করে সাফল্য লাভের আশা ক্ষীণ। সে কারণে এক পর্যায়ে তিনি পরিস্থিতির সাথে সমঝোতা করার কথাও ভেবেছিলেন এবং তার গুণাবলির অন্যতম দিক ছিল বাস্তবতার উপলব্ধি ও তা গ্রহণ করার ক্ষমতা। জীবনের সব দুঃখজনক ঘটনার মধ্যেও তিনি দেখতেন যে পৃথিবীর পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে এবং জীবনের গতিও থেমে যাবে না। ব্রিটিশের হাতে বন্দী হওয়ার পরপরই তিনি একটি কবিতায় উল্লেখ করেন।
‘এক সময় দিল্লি ছিল বেহেশত
যেখানে শাসন ছিল প্রেমের
এখন সেই সৌন্দর্য বিধ্বস্ত এবং
শুধু ধ্বংসস্তূপই টিকে আছে।
গণকবরে কাফনহীন মৃতদের দাফনের
সময়
No comments:
Post a Comment