আল মাহমুদের দেশজননী : ড. ফজলুল হক তুহিন
শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০১৬
১৯৬৩ সালে আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশের মাধ্যমে স্বকীয় কণ্ঠস্বর পাঠকসমাজে সহজে গৃহীত হয়। মৌলিক ভাবনাপুঞ্জ, নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ এবং দৈশিক ও বৈশ্বিক সমাজের রূপান্তরশীল চৈতন্য অনুভবের মাধ্যমে কবি আপন কাব্যজগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ পাঁচ দশকব্যাপী কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিত্বশীল ও শক্তিমান কবি। তার কবিতার প্রধান বিষয় নারী।
নারী ও পুরুষ মানবজাতির আদি উৎস। এই উৎসধারায় পৃথিবীতে মানুষের ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিস্তার ঘটেছে। এই প্রবাহের ধারাবাহিকতায় মানব সভ্যতারও সৃষ্টি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় অঙ্কিত নারীচরিত্রের রূপ ও প্রকৃতি আল মাহমুদের নারীচরিত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে মধ্যযুগের কবিতায় নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব অধিকাংশ স্বীকৃত নয়। নারী পুরুষের কামের সঙ্গি হয়েছে, সৌন্দর্য পিপাসা বা কামতৃষ্ণা মিটিয়েছে। তাকে কখনো দেবী, কখনো দাসী করা হয়েছে। তবে লোকসাহিত্যে নারীর মর্যাদা বা নারীর স্বাধীন সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের ধারায় আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এসে নারী ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত। তাই কবিতায় নারীর অবস্থানের বদল ঘটেছে।
সেই সঙ্গে আল মাহমুদের কবিতার রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নারীচরিত্রেরও বারবার পরিবর্তন ঘটেছে। বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসের নারী আল মাহমুদের কবিতায় প্রধানরূপে বিবেচিত, তবে তাঁর নারী ভাবনার ক্রমপরিবর্তন লক্ষণীয়। স্পষ্টত কয়েকটি দিক থেকে তিনি নারীকে দেখেছেন- প্রথমত, গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনসঙ্গি; দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির প্রতীকে; তৃতীয়ত, বোনের দৃষ্টিতে; চতুর্থত, স্বর্গচ্যুত হাওয়া বা ঈভের রূপকে; পঞ্চমত, স্নেহ-মততাময়ী জননী ও দেশজননীর সামগ্রিক রূপকল্পে; ষষ্ঠত, শুধুমাত্র নারীরূপে। তবে দেশজননীর রূপকল্প তার কবিতায় এক অনন্য মর্যাদায় উজ্জ্বল।
একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে কবির ভাবনায় পরিবর্তন কবিতার ইতিহাসে সাধারণ ঘটনা। আল মাহমুদের নারীরূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে। এ ক্ষেত্রে তার কবিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অভিন্ন হয়ে গেছে। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে কবি নারীকে পরিপূর্ণ ‘জননী’, ‘দেশমাতৃকা’ এবং ‘বঙ্গজননী’/‘দেশজননী’রূপে চিত্রিত করেন। যৌবনে কবির কাছে নারী ছিল দেহজ ও কামজ সত্তার আধার। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে কবি সেই সত্তাকে এড়িয়ে যান। নারীকে ‘মা’ ভেবে তার কাছে ‘দয়া ও শুশ্রƒষা’ চান। আদিম প্রেমকে কবি ভয় পান। কারণ-
আসঙ্গলিপ্সা কবিকে অর্ধেক নারীত্বে নিমজ্জিত করে
এখন আমার নারীর কাছে একমাত্র কাম্য দয়া আর শুশ্রƒষা
শিশুরা যেমন ক্ষুধার্ত হলে মাতৃস্তনের জন্য কেঁদে ওঠে, আমিও
মায়া ও মমতার জন্যে আমার দেশমাতৃকার নগ্ন ব-দ্বীপে
একাকী রোদন করি। আমার সাথে প্রকৃতি, পাখ-পাখালি
কীট-পতঙ্গ এবং শূন্য মাঠ মা মা করে কেঁদে ওঠে। [মেঘ থেকে মাটি পর্যন্ত/ না কোনো শূন্যতা মানি না]
কবির কাছে পূর্বতন প্রেমের ধারণা বদলে গেছে। কবি যৌবনে ‘সোনালি কাবিনে’র মাধ্যমে যে নারীর সাথে বন্ধনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে শরীরী স্বাদ উপভোগ করেছিলেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তার কাছেই ‘মাতৃহারা বালকের মতো’ সেবা-শুশ্রƒষা চেয়েছেন। অর্থাৎ সেই নারীকে এখন তিনি ‘মা’ হিসেবে আর তার সেবা-যতœকে ‘প্রেম’ বলে ঘোষণা করছেন। কবির কাছে এ এক নতুন উক্তি ও উপলব্ধি। তবে কবির মাঝে মায়ের প্রতি টান বা কৃতজ্ঞতাবোধ আগে থেকেই ছিল। যেমন-
জন্মের জটিল তত্ত্ব যাকে লোকে মাতৃঋণ বলে,
অন্তত মায়ের বুক আমাদের কাব্যে লেখা হোক-
বলা হোক, কুসুমের কুটিল কাঁটায় পরাজয়
যদিও মেনেছি সত্য তবু এই গৌরব ভুলিনি
আমারও উদ্ভব মানি প্রেমময় নারীরই উদরে। [কবিরা, বাঁচাও/ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না]
কবি ‘মাতৃঋণে’র কথা স্মরণ করে গৌরব অনুভব এবং আমাদের কাব্যে মায়ের অবদানের বিষয় লেখার প্রত্যাশা করেন। কেননা প্রেমময় এই নারীর গর্ভেই কবির জন্ম। একইভাবে কবি হাসান হাফিজুর রহমানও ‘বিমুখ প্রান্তরে’ (১৯৬ ‘দেশজননী’র ঋণশোধের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। আল মাহমুদ নারীকে প্রথমে ‘জননী’, তারপরে ‘দেশজননী’ বা ‘বঙ্গজননী’ হিসেবে রূপান্তরিত করেন- যার উপমা পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথেই তিনি দিতে চান না। দেশের নিসর্গ-নদী-শস্যক্ষেত্র এবং কিষাণ-কিষাণীর ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যে কবি উদ্বিগ্ন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই দেশমাতার প্রতি কবির উচ্চারণ-
তুমি তো জানো তোমার সাথে তুলনা দিই এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।
চির দুঃখিনী মা আমার
তোমার ঐশ্বর্যই তোমার শত্রু। যেমন আপন মাংসে
হরিণী বৈরী। [দেশ মাতৃকার জন্য/ দ্বিতীয় ভাঙন]
উপমাহীন দেশকে ঐশ্বর্যময়ী অথচ চিরদুখিনী জননী ভেবে কবি প্রবাদময় সত্যে পৌঁছিয়েছেন। কেননা এ দেশ বা এ মায়ের শত্রু তার সম্পদই। একথা সত্য যে, পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির মাঝেই তার সর্বনাশ সংগুপ্ত। ‘চর্যাপদে’র কবি ভুসুকু বাংলা কাব্যে সর্বপ্রথম এ সত্য ব্যক্ত করেন। ‘চর্যাপদে’র সময় ও সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে কবি দেশমাতৃকার বর্তমান রূপের সাদৃশ্য সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে হাজার বছরের ঐতিহ্যময় দেশ ও জননী কবির কাছে অঙ্গাঙ্গীরূপে গৃহীত। এর মধ্য দিয়ে কবি মূলত সমকাল ও প্রাচীনকে এবং ব্যক্তিক মা ও সামষ্টিক মা-কে একই সমান্তরালে নিয়ে আসেন।
সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে রচিত ‘জন্মদিনের কবিতা’য় কবি নারীর মাতৃরূপকে গভীর ব্যঞ্জনায় উপনীত করেন। কবি একদিন গভীর রাতে হঠাৎ বালক হয়ে যান, তখন শৈশবের পছন্দের খাদ্য ‘বুনো ওল আর কাঁচা তেঁতুলের রান্নার স্বাদ কবিকে বুভুক্ষু করে তোলে। তার অন্তর্গত ক্ষুধার্ত বালক ‘মা মা’ বলে চিৎকার করে ওঠে-
খেতে দে শিদলের স্বাদ, টাকি মাছের
মাথা ভেঙে সেই অদ্ভুত ঘেট, যা একদা
আমার অতি অনার্য পূর্বপুরুষেরা
মাটির সানকিতে পরমান্ন হিসেবে সাজিয়ে দিতেন।
অন্নপূর্ণা মা আমার, শাকন্তরি মা আমার
শত উদ্ভিদের, ঔষধের এবং কবিরাজ পত্রপল্লবের
রাঁধুনী তুই। এই শতাব্দীতে
আমার ক্ষিদে মেটাবার খাদ্য কে রাঁধবে
ত্ইু ছাড়া জননী আমার। [জন্মদিনের কবিতা/বারুদগন্ধী মানুষের দেশ]
কবি এখানে ব্যক্তিগত জননীকে ‘অন্নপূর্ণা’য় রূপান্তরিত করে নারীরূপকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেন। কেননা হিন্দুধর্ম মতে ও পুরাণে দুর্গা বা অন্নপূর্ণা হলো মানুষের অন্নদায়িনী, আহার্যে পরিপূর্ণ দেবী, যার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় অন্নের ভাণ্ডার মজুদ। মা যেমন সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয়, অন্নপূর্ণা দেবীও তেমনি পৃথিবীবাসীকে আহার্য যোগায়। এ কারণে অন্নপূর্ণাকে ‘মা’ বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, আদিতে কৃষিকার্য আবিষ্কারের সময় দুর্গা, যার অপর নাম শাকম্ভরী, তিনি ছিলেন শস্যদেবী; এবং শাকম্ভরী বলেই দুর্গা হলেন অন্নদা বা অন্নপূর্ণা। কবি সনাতন এই বিশ্বাসকে ধারণা করেন নারীর ‘জননী’ পরিচয়কে ব্যাপকতা দানের উদ্দেশে। রক্তাক্ত সমকালে ক্ষুধার্ত বালক ‘স্বপ্নের খাদ্য’ চেয়েছেন ‘পৃথিবীর শেষ অন্নপূর্ণা’র কাছে।
এক্ষেত্রে কবি ব্যক্তিক মা-কে সামষ্টিক মা-এ রূপান্তরিত এবং ব্যক্তিগত ক্ষুধাকে সবার খিদেয় পরিণত করেন। অর্থাৎ যে নারীকে এক সময় তিনি ঘরের মধ্যে একান্ত সান্নিধ্যে দেখতে পছন্দ করতেন, এ পর্যায়ে এসে সেই নারী ঘরের ও বাইরের সকলের নারী অর্থাৎ জননী হয়ে যান। ভিন্নার্থে দেশ-মাতৃকার প্রতি কবির আত্মদানের অভিপ্রায়ও এ কবিতায় পরিস্ফুট। আধুনিক জীবনের প্রেক্ষিত থেকে কবি ঐতিহ্যকে নির্বাসন দিতে চাননি। মা তাই বাংলার লোকজ খাদ্য ‘শত উদ্ভিদের, ঔষধির এবং কবিরাজ পত্রপল্লবের রাঁধুনি’। অর্থাৎ এই মা-রূপী নারীই ‘বঙ্গজননী’র পরিচয় বহন করে। উল্লেখ্য, কবি যৌবনে মায়ের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে গিয়ে নারীকে চিরদুঃখী জননীরূপে চিত্রিত করেন। এই দুঃখিনী জননী কবির ঘরের দেয়ালের ফ্রেমে টাঙানো, তাকে দেখে কবির মনে হয়েছে অভাবের আভায় দলিত ‘বাংলার মানচিত্র’ [ফেরার পিপাসা/ কালের কলস]। কাজেই ‘বঙ্গজননী’র ধারণা কবির মাঝে কাব্যচর্চার সূচনাকাল থেকেই সংগুপ্ত ছিল। একদিকে ‘বঙ্গজননী’, অন্যদিকে ‘অনার্য পূর্ব-পুরুষ’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কবি ঐতিহ্যলগ্ন এবং উত্তরাধিকারে আত্মস্থ হয়েছেন। এখানেই কবির দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃষ্টির নতুনত্ব।
আল মাহমুদ নারী-চরিত্র সৃষ্টিতে আধুনিক বাংলা কবিতায় কারো প্রতিধ্বনি নন, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আঙ্গিকে তা প্রকাশিত। তবে তার নারীরূপ এক জায়গায় স্থির থাকেনি, বারবার বদলে গেছে। গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনতৃপ্তির আধার থেকে প্রকৃতি; প্রকৃতি থেকে বোন, স্বর্গচ্যুত ঈভ, জননী ও দেশজননী বা বঙ্গজননী এবং শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র নারীতে কবি রূপান্তরিত করেন। কবি অন্য কোনো মৌলিক বিষয়ও সন্ধান করেন না। কবি তাই নারীকে ‘শুদ্ধতম শিল্প’রূপে অভিহিত করেন। শেষ পর্যন্ত দেশজননীর প্রতীক নির্মাণে মা ও মাটির প্রতি কবির শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দেশের সামগ্রিক চিত্রকল্প ভাবনা কাজ করেছে। কবি আল মাহমুদের এই কবিকৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের কবিতায় এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে।http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/07/15/97629.php
শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০১৬
১৯৬৩ সালে আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশের মাধ্যমে স্বকীয় কণ্ঠস্বর পাঠকসমাজে সহজে গৃহীত হয়। মৌলিক ভাবনাপুঞ্জ, নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ এবং দৈশিক ও বৈশ্বিক সমাজের রূপান্তরশীল চৈতন্য অনুভবের মাধ্যমে কবি আপন কাব্যজগৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ পাঁচ দশকব্যাপী কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিত্বশীল ও শক্তিমান কবি। তার কবিতার প্রধান বিষয় নারী।
নারী ও পুরুষ মানবজাতির আদি উৎস। এই উৎসধারায় পৃথিবীতে মানুষের ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিস্তার ঘটেছে। এই প্রবাহের ধারাবাহিকতায় মানব সভ্যতারও সৃষ্টি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় অঙ্কিত নারীচরিত্রের রূপ ও প্রকৃতি আল মাহমুদের নারীচরিত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে মধ্যযুগের কবিতায় নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব অধিকাংশ স্বীকৃত নয়। নারী পুরুষের কামের সঙ্গি হয়েছে, সৌন্দর্য পিপাসা বা কামতৃষ্ণা মিটিয়েছে। তাকে কখনো দেবী, কখনো দাসী করা হয়েছে। তবে লোকসাহিত্যে নারীর মর্যাদা বা নারীর স্বাধীন সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের ধারায় আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এসে নারী ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত। তাই কবিতায় নারীর অবস্থানের বদল ঘটেছে।
সেই সঙ্গে আল মাহমুদের কবিতার রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নারীচরিত্রেরও বারবার পরিবর্তন ঘটেছে। বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসের নারী আল মাহমুদের কবিতায় প্রধানরূপে বিবেচিত, তবে তাঁর নারী ভাবনার ক্রমপরিবর্তন লক্ষণীয়। স্পষ্টত কয়েকটি দিক থেকে তিনি নারীকে দেখেছেন- প্রথমত, গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনসঙ্গি; দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির প্রতীকে; তৃতীয়ত, বোনের দৃষ্টিতে; চতুর্থত, স্বর্গচ্যুত হাওয়া বা ঈভের রূপকে; পঞ্চমত, স্নেহ-মততাময়ী জননী ও দেশজননীর সামগ্রিক রূপকল্পে; ষষ্ঠত, শুধুমাত্র নারীরূপে। তবে দেশজননীর রূপকল্প তার কবিতায় এক অনন্য মর্যাদায় উজ্জ্বল।
একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে কবির ভাবনায় পরিবর্তন কবিতার ইতিহাসে সাধারণ ঘটনা। আল মাহমুদের নারীরূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে। এ ক্ষেত্রে তার কবিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, অভিন্ন হয়ে গেছে। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে কবি নারীকে পরিপূর্ণ ‘জননী’, ‘দেশমাতৃকা’ এবং ‘বঙ্গজননী’/‘দেশজননী’রূপে চিত্রিত করেন। যৌবনে কবির কাছে নারী ছিল দেহজ ও কামজ সত্তার আধার। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে কবি সেই সত্তাকে এড়িয়ে যান। নারীকে ‘মা’ ভেবে তার কাছে ‘দয়া ও শুশ্রƒষা’ চান। আদিম প্রেমকে কবি ভয় পান। কারণ-
আসঙ্গলিপ্সা কবিকে অর্ধেক নারীত্বে নিমজ্জিত করে
এখন আমার নারীর কাছে একমাত্র কাম্য দয়া আর শুশ্রƒষা
শিশুরা যেমন ক্ষুধার্ত হলে মাতৃস্তনের জন্য কেঁদে ওঠে, আমিও
মায়া ও মমতার জন্যে আমার দেশমাতৃকার নগ্ন ব-দ্বীপে
একাকী রোদন করি। আমার সাথে প্রকৃতি, পাখ-পাখালি
কীট-পতঙ্গ এবং শূন্য মাঠ মা মা করে কেঁদে ওঠে। [মেঘ থেকে মাটি পর্যন্ত/ না কোনো শূন্যতা মানি না]
কবির কাছে পূর্বতন প্রেমের ধারণা বদলে গেছে। কবি যৌবনে ‘সোনালি কাবিনে’র মাধ্যমে যে নারীর সাথে বন্ধনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে শরীরী স্বাদ উপভোগ করেছিলেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তার কাছেই ‘মাতৃহারা বালকের মতো’ সেবা-শুশ্রƒষা চেয়েছেন। অর্থাৎ সেই নারীকে এখন তিনি ‘মা’ হিসেবে আর তার সেবা-যতœকে ‘প্রেম’ বলে ঘোষণা করছেন। কবির কাছে এ এক নতুন উক্তি ও উপলব্ধি। তবে কবির মাঝে মায়ের প্রতি টান বা কৃতজ্ঞতাবোধ আগে থেকেই ছিল। যেমন-
জন্মের জটিল তত্ত্ব যাকে লোকে মাতৃঋণ বলে,
অন্তত মায়ের বুক আমাদের কাব্যে লেখা হোক-
বলা হোক, কুসুমের কুটিল কাঁটায় পরাজয়
যদিও মেনেছি সত্য তবু এই গৌরব ভুলিনি
আমারও উদ্ভব মানি প্রেমময় নারীরই উদরে। [কবিরা, বাঁচাও/ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না]
কবি ‘মাতৃঋণে’র কথা স্মরণ করে গৌরব অনুভব এবং আমাদের কাব্যে মায়ের অবদানের বিষয় লেখার প্রত্যাশা করেন। কেননা প্রেমময় এই নারীর গর্ভেই কবির জন্ম। একইভাবে কবি হাসান হাফিজুর রহমানও ‘বিমুখ প্রান্তরে’ (১৯৬ ‘দেশজননী’র ঋণশোধের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। আল মাহমুদ নারীকে প্রথমে ‘জননী’, তারপরে ‘দেশজননী’ বা ‘বঙ্গজননী’ হিসেবে রূপান্তরিত করেন- যার উপমা পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথেই তিনি দিতে চান না। দেশের নিসর্গ-নদী-শস্যক্ষেত্র এবং কিষাণ-কিষাণীর ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যে কবি উদ্বিগ্ন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই দেশমাতার প্রতি কবির উচ্চারণ-
তুমি তো জানো তোমার সাথে তুলনা দিই এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।
চির দুঃখিনী মা আমার
তোমার ঐশ্বর্যই তোমার শত্রু। যেমন আপন মাংসে
হরিণী বৈরী। [দেশ মাতৃকার জন্য/ দ্বিতীয় ভাঙন]
উপমাহীন দেশকে ঐশ্বর্যময়ী অথচ চিরদুখিনী জননী ভেবে কবি প্রবাদময় সত্যে পৌঁছিয়েছেন। কেননা এ দেশ বা এ মায়ের শত্রু তার সম্পদই। একথা সত্য যে, পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির মাঝেই তার সর্বনাশ সংগুপ্ত। ‘চর্যাপদে’র কবি ভুসুকু বাংলা কাব্যে সর্বপ্রথম এ সত্য ব্যক্ত করেন। ‘চর্যাপদে’র সময় ও সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে কবি দেশমাতৃকার বর্তমান রূপের সাদৃশ্য সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে হাজার বছরের ঐতিহ্যময় দেশ ও জননী কবির কাছে অঙ্গাঙ্গীরূপে গৃহীত। এর মধ্য দিয়ে কবি মূলত সমকাল ও প্রাচীনকে এবং ব্যক্তিক মা ও সামষ্টিক মা-কে একই সমান্তরালে নিয়ে আসেন।
সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে রচিত ‘জন্মদিনের কবিতা’য় কবি নারীর মাতৃরূপকে গভীর ব্যঞ্জনায় উপনীত করেন। কবি একদিন গভীর রাতে হঠাৎ বালক হয়ে যান, তখন শৈশবের পছন্দের খাদ্য ‘বুনো ওল আর কাঁচা তেঁতুলের রান্নার স্বাদ কবিকে বুভুক্ষু করে তোলে। তার অন্তর্গত ক্ষুধার্ত বালক ‘মা মা’ বলে চিৎকার করে ওঠে-
খেতে দে শিদলের স্বাদ, টাকি মাছের
মাথা ভেঙে সেই অদ্ভুত ঘেট, যা একদা
আমার অতি অনার্য পূর্বপুরুষেরা
মাটির সানকিতে পরমান্ন হিসেবে সাজিয়ে দিতেন।
অন্নপূর্ণা মা আমার, শাকন্তরি মা আমার
শত উদ্ভিদের, ঔষধের এবং কবিরাজ পত্রপল্লবের
রাঁধুনী তুই। এই শতাব্দীতে
আমার ক্ষিদে মেটাবার খাদ্য কে রাঁধবে
ত্ইু ছাড়া জননী আমার। [জন্মদিনের কবিতা/বারুদগন্ধী মানুষের দেশ]
কবি এখানে ব্যক্তিগত জননীকে ‘অন্নপূর্ণা’য় রূপান্তরিত করে নারীরূপকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেন। কেননা হিন্দুধর্ম মতে ও পুরাণে দুর্গা বা অন্নপূর্ণা হলো মানুষের অন্নদায়িনী, আহার্যে পরিপূর্ণ দেবী, যার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় অন্নের ভাণ্ডার মজুদ। মা যেমন সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয়, অন্নপূর্ণা দেবীও তেমনি পৃথিবীবাসীকে আহার্য যোগায়। এ কারণে অন্নপূর্ণাকে ‘মা’ বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, আদিতে কৃষিকার্য আবিষ্কারের সময় দুর্গা, যার অপর নাম শাকম্ভরী, তিনি ছিলেন শস্যদেবী; এবং শাকম্ভরী বলেই দুর্গা হলেন অন্নদা বা অন্নপূর্ণা। কবি সনাতন এই বিশ্বাসকে ধারণা করেন নারীর ‘জননী’ পরিচয়কে ব্যাপকতা দানের উদ্দেশে। রক্তাক্ত সমকালে ক্ষুধার্ত বালক ‘স্বপ্নের খাদ্য’ চেয়েছেন ‘পৃথিবীর শেষ অন্নপূর্ণা’র কাছে।
এক্ষেত্রে কবি ব্যক্তিক মা-কে সামষ্টিক মা-এ রূপান্তরিত এবং ব্যক্তিগত ক্ষুধাকে সবার খিদেয় পরিণত করেন। অর্থাৎ যে নারীকে এক সময় তিনি ঘরের মধ্যে একান্ত সান্নিধ্যে দেখতে পছন্দ করতেন, এ পর্যায়ে এসে সেই নারী ঘরের ও বাইরের সকলের নারী অর্থাৎ জননী হয়ে যান। ভিন্নার্থে দেশ-মাতৃকার প্রতি কবির আত্মদানের অভিপ্রায়ও এ কবিতায় পরিস্ফুট। আধুনিক জীবনের প্রেক্ষিত থেকে কবি ঐতিহ্যকে নির্বাসন দিতে চাননি। মা তাই বাংলার লোকজ খাদ্য ‘শত উদ্ভিদের, ঔষধির এবং কবিরাজ পত্রপল্লবের রাঁধুনি’। অর্থাৎ এই মা-রূপী নারীই ‘বঙ্গজননী’র পরিচয় বহন করে। উল্লেখ্য, কবি যৌবনে মায়ের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে গিয়ে নারীকে চিরদুঃখী জননীরূপে চিত্রিত করেন। এই দুঃখিনী জননী কবির ঘরের দেয়ালের ফ্রেমে টাঙানো, তাকে দেখে কবির মনে হয়েছে অভাবের আভায় দলিত ‘বাংলার মানচিত্র’ [ফেরার পিপাসা/ কালের কলস]। কাজেই ‘বঙ্গজননী’র ধারণা কবির মাঝে কাব্যচর্চার সূচনাকাল থেকেই সংগুপ্ত ছিল। একদিকে ‘বঙ্গজননী’, অন্যদিকে ‘অনার্য পূর্ব-পুরুষ’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কবি ঐতিহ্যলগ্ন এবং উত্তরাধিকারে আত্মস্থ হয়েছেন। এখানেই কবির দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃষ্টির নতুনত্ব।
আল মাহমুদ নারী-চরিত্র সৃষ্টিতে আধুনিক বাংলা কবিতায় কারো প্রতিধ্বনি নন, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আঙ্গিকে তা প্রকাশিত। তবে তার নারীরূপ এক জায়গায় স্থির থাকেনি, বারবার বদলে গেছে। গার্হস্থ্য প্রেম ও যৌনতৃপ্তির আধার থেকে প্রকৃতি; প্রকৃতি থেকে বোন, স্বর্গচ্যুত ঈভ, জননী ও দেশজননী বা বঙ্গজননী এবং শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র নারীতে কবি রূপান্তরিত করেন। কবি অন্য কোনো মৌলিক বিষয়ও সন্ধান করেন না। কবি তাই নারীকে ‘শুদ্ধতম শিল্প’রূপে অভিহিত করেন। শেষ পর্যন্ত দেশজননীর প্রতীক নির্মাণে মা ও মাটির প্রতি কবির শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দেশের সামগ্রিক চিত্রকল্প ভাবনা কাজ করেছে। কবি আল মাহমুদের এই কবিকৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের কবিতায় এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে।http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/07/15/97629.php
No comments:
Post a Comment