Saturday 15 July 2017

বসনিয়া যুদ্ধের কারণে অবশেষে ক্ষমা চাইলো ক্রোয়েশিয়া।



বসনিয়া যুদ্ধের কারণে অবশেষে ক্ষমা চাইলো ক্রোয়েশিয়া।

রিয়াজুল ইসলাম
   
ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো ইয়োসিপোভিচ বসনিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কারণ বসনিয়া যুদ্ধে তার দেশ যে নৃশংস ভূমিকা রেখেছিল সেজন্য। গত ১৪ এপ্রিল বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে সেদেশের সংসদে সংসদ সদস্যদের সামনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এসময় বসনিয়া যুদ্ধকালীন সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াসিপোভিচ বলেন, ক্রোয়েশিয়ার রাজনীতি ওই সময় মানুষের অশেষ ভোগান্তির পেছনে কাজ করেছিল, সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাদের নব্বই দশকের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। নতুন রাজনীতিকে গ্রহণ করতে হবে।

বসনিয়ার যুদ্ধকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ হিসেবে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের এই একতরফা যুদ্ধের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলি হয়েছিলেন বসনিয়ার লাখ লাখ মুসলমান। কম্যুনিস্ট শাসিত সাবেক ইউগোস্লাভিয়া থেকে ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়ার দুই বছরের মাথায় এই যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে সার্ব ও ক্রোয়েট বাহিনী নির্মমতার যে উদাহরণ তৈরি করে তা বিরল।

এবং এর পেছনে মদত দিয়েছিল বসনিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া। বিশেষ করে সার্বিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসোভিচ এবং বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদিচ বসনিয়ার লাখ লাখ মুসলিম নরনারী হত্যার জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবেন। বলকানের কসাই খ্যাত মিলোসোভিচ মৃত্যুবরণ করলেও বিচারের হাত থেকে পালাতে পারেননি রাদোভান কারাদিচ। যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে বর্তমানে তার বিচার চলছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালতে। বসনিয়া যুদ্ধ চলাকালে সেদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে চালানো হয় একের পর এক গণহত্যা।

১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সেব্রেনিৎসায় আট হাজারেরও বেশি বসনিয় পুরুষ ও বালককে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে সার্ব বাহিনী। সেব্রেনিৎসার বধ্যভূমির সেই ভয়াবহ চিত্র এখনও মানুষের মনে শিহরণ জাগায়। ওই সময় জাতিগত হিংসার কারণে সার্ব বাহিনী এক লাখের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তাদের সেনা ও পুলিশের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার বসনিয় নারী ও কিশোরী। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ক্রোয়েট বাহিনী বসনিয়ার আমিচি নামে একটি গ্রামে হামলা চালায়। বেছে বেছে ১১৬ জন মুসলিম পুরুষকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে।

কোন ধরণের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই বসনিয়ার সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের সময় অসহায়ের মত নামকাওয়াস্তে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিকতা না থাকায় সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার নির্মমতা তাদের সইতে হয়েছে টানা সাড়ে তিনটি বছর। অবশেষে সেব্রেনিৎসার গণহত্যার পর টনক নড়ে জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মহলের। দখলদার বাহিনীর ওপর বিমান হামলা শুরু করে ন্যাটো। এরপরই পিছু হটতে বাধ্য হয় দখলদার সার্বিয়রা। দেশ ছেড়ে পালান বসনিয়ার কুখ্যাত সার্ব নেতা রাদোভান কারাদিচ।

বসনিয়া যুদ্ধের দীর্ঘ ১৫ বছর পর সার্বিয়ার সঙ্গে বসনিয়ার সম্পর্ক এখনও আদায় কাঁচকলায়। তবে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। আর এর অংশ হিসেবেই বসনিয়ার জনগণের কাছে ক্রোয়েট প্রেসিডেন্ট ইভো ইয়াসিপোভিচের ক্ষমা প্রার্থনা। তবে কেবল অনুশোচনা নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার জন্য অনেকদিন ধরেই আগ্রহী ক্রোয়েশিয়া। তাই নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে পুরনো বিরোধ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে বসনিয়া যুদ্ধের কারণে যে কলংকের দাগ লেগেছে তাদের গায়ে তাও মুছে ফেলতে চাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া।

লেখকঃ সাংবাদিক

মূল লিঙ্কঃ http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=2519

No comments:

Post a Comment