আল মাহমুদের কবিতা কার প্রেমে, কার সান্নিধ্যে
মনসুর আজিজ।।
আল মাহমুদ প্রেমিক কবি।
কালো পাথরের প্রতি তার প্রেম। চুম্বনের প্রত্যাশায় ঠোঁট দুটো ব্যাকুল থাকে সারাক্ষণ। কালো পাথরের চাদরের প্রতি তার প্রেম আরো অধিক। চাদরের মাঝখানে অলৌকিক পাথর। পৃথিবীর প্রেমিককুল ব্যাকুল থাকে কালো পাথরে চুম্বনের প্রত্যাশায়। যাঁর সৌম্যকান্তিতে চাদরটি জড়ানো থাকে মাহমুদের প্রেম তার প্রতি আরো বেশি। মাহমুদ তার প্রেম উজাড় করে দেন আলোকিত মানুষের মালিকের প্রতি। তার তাবৎ প্রেম পুঞ্জিভূত হয় সেখানে। নারীর প্রতি প্রেম চূড়ান্ত প্রেমের খসড়ামাত্র। নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা অগোছালো পাণ্ডুলিপি।
প্রেমের প্রচ্ছদের দু-একটি স্কেচ মাত্র। কালো পাথরের মালিকের প্রতি প্রেম নিবেদনের প্রস্তুতি পর্ব। নারী যাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাই নারীর প্রতি প্রেম নিবেদন করে মাহমুদ প্রস্তুত হয়েছেন একটি চুম্বনের প্রার্থনায়। বিস্তৃত এক সৌন্দর্যভূমি নির্মাণের। সেজন্য মাহমুদ নদী, নারী, মানুষ, নিসর্গ ছেড়ে চলে যান অন্যগ্রহে। ‘আমার পথ এখন মাটি থেকে আকাশের দিকে মোড় নিয়েছে। / ঐ তো মেঘ, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ চমকের মহড়া দেখছি। দেখছি ধূসর নি®প্রাণ চন্দ্রমণ্ডল।... দেখছি পরম নিশ্চিত শূন্যতার ধারণার ভেতর জ্বলে ওঠা এক রশ্মির আভাস।’ (পথের কথা / নদীর ভেতরে নদী) কিংবা আল মাহমুদ যখন বিগলিত হন দেশ মাতৃকার মায়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার জন্যÑ ‘ছেড়ে দাও আমার হাত। আমি দেশহীন শেষ দশার কবির মতো আকাশের দিকে আজান হেকে বাতাসে বিলীন হয়ে যাই।’ (যাব না তোমার সাথে হে দেশ জননী / দ্বিতীয় ভাঙন) দেশের কথা চিন্তা করে নিজের কাজের সমাপ্তি টেনে কবি বিলীন হয়ে যেতে চান।
সেখানে আর কবির কোনো দেশ থাকে না, দেশ-মাতৃকা থাকে না। অলৌকিক এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কবি। উৎসই তার গন্তব্য। যেখানে ছিল আত্মার অনুরণন। স্মৃতির সুরক্ষিত প্রাসাদ। নারীর সাথেই বাগানে পথচলা। নারীর সাথেই পৃথিবীতে মানুষের চাষবাস। নারীর সাথেই শুরু হবে অনন্ত জীবনের পর্যটন। যে নারীর সাথে পার্থিব জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তার সান্নিধ্য কবি আর চান না। ‘ব্রাকের আপার মতো ঠাট’ তিনি আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন না। ‘শঙ্খমাজা স্তন’ ‘বর্তুল শঙ্খের মাঝে নাক ডুবিয়ে’ তিনি আর ঘ্রাণ শুকতে চান না। ‘দুটি গোশতে গোলাপ থেকে নুনের হালকা গন্ধে’ তিনি আর ব্যাকুল নন। ‘পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী’ এড়িয়ে যায় কবির দৃষ্টি। একদা নারীর প্রতি নিবেদন ছিলÑ ‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ / উগল মাছের গোশত তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়।’ (সনেট-৩/ সোনালি কাবিন) কিংবা ‘নটির মুদ্রার মতো মন আর স্তন/ অশ্লীল আরদ্ধ বিষ তুলেছে ফণায়,/ সাহসে আঘাতে স্পর্শে তোমার রমণ/ শেষ করো।
ঘামে কামে পরিতৃপ্ততায়।’ মাহমুদ ডুবে ছিলেন নারীতে। নারীর রূপ জৌলুসের বোতাম খুলে ছিলেন দু’হাতে। বোদলেয়ার নারীর এই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেÑ ‘নিলো সে আমার কামঃ তারপর, পালঙ্কবিতানে এলিয়ে, ইষৎ হেসে, তাকালো সে অলস নয়না।’ ‘অলঙ্কার’ কবিতায় বোদলেয়ার রমণক্রিয়ার পরিসমাপ্তি টানেনÑ ‘নিবে গেলো মুমূর্ষু বাতির শিখা।
কোমল নিস্বন অগ্নিকুণ্ড একা জ্বলে অন্ধকার, স্তব্ধ নিরালায় যতবার দীর্ঘশ্বাসে নীলিমার উদ্ভাস জ্বালায় শোনিতে প্লাবিত করে গাত্র তার অম্বরবরণ। (বোদলেয়ার ও তার কবিতা ঃ অনুবাদ বুদ্ধদেব বসু পৃ-৫০) আবারÑ ‘দূরাগত সুবাস’ কবিতায় বলেনÑ ক্ষীনাঙ্গে ক্ষমতাময় পুরুষের সুঠাম শরীর অপরূপ সরলতা মেয়েদের চোখের তারায়। (ঐ, পৃ-৫২) আল মাহমুদের সাথে বোদলেয়ারের নারী সৌন্দর্যের পার্থক্য স্পষ্ট।
মাহমুদের নারী পোয়াতি মাছের মতো সঞ্চরলশীল, কর্মঠ, সুঠাম পেশীর অধিকারিনী। ভাটি বাংলার মৃত্তিকায় বেড়ে ওঠা নতুন চরের মতো পলি ভরা মাহমুদের নারী। নারীর প্রতি মাহমুদের প্রেম আছে, আছে সম্মান। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে গাঁথেন বাঙালি রমণীর রূপমাদুলি। চুল খোলা আয়শা আক্তার থেকে রাবেয়াকে তুলে এনেছেন সুমহান মর্যাদায়। মা হাওয়াকে তুলেছেন মহীমায়, মমতায়, মর্যাদার প্রতীকরূপে। কিন্তু প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা, প্রেম, প্রণয়, পরিণয়Ñ সেখানে আল মাহমুদ আরো তীর্যক; আরো খোলামেলা। উপস্থাপনায় আধুনিক, বাঙালি কবির জৌলুস ঢেলেছেন পরম পারঙ্গমে। সমসাময়িক কবিরা যখন বিদেশী নারীর রূপ জৌলুসের মোড়ক উম্মোচনে ব্যস্ত, মাহমুদ সেখানে নারীর সৌন্দর্য খোঁজেন ব্রাকের আপার; যে কিনা রোদ বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। সুঠামদেহী গ্রাম্য রমণীর কর্মব্যস্ত চলচ্চিত্র তুলে ধরেন পঙক্তির স্যালুলয়েডে। এক সময় তিনি হারিয়ে যেতে চাইতেনÑ ‘ঐ তো সে।
মেঘনায় লাফিয়ে ওঠা কালো রুই গোধুলিতে ঘরফিরতি রাখালের হাকডাকের মতো খুশিতে উপচানো। পড়ন্তবেলায় লুকিয়ে পড়া অজস্র শালিক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর মতো দেহ তার। চোখ যেন রাজা মহীপালের দীঘি। আর বুক দুটি মিথুনরত কবুতর।
তার নাভীরন্ধ্রের ভেতর একটি ভরতপাখির মতো আমি অনন্তে হারিয়ে গেলাম। (অস্পষ্ট স্টেশন/ আরব্য রজনীর রাজহাঁস) একসময় কালো রুইয়ের মতো নারীর নাভীমূলে ভরতপাখির মতো হারিয়ে যাওয়াই ছিল মাহমুদের সুখ। আর এখন তিনি আকাশের দিকে আজান হেঁকে বাতাসে বিলীন হয়ে যেতে চান। আল মাহমুদ যখন নিজেই বয়ান করেন তখন আর সংশয় থাকে না কারোÑ ‘প্রেম প্রকৃতি স্বদেশভূমিই আমার রচনার বিষয়বস্তু বলে ভাবতে আমার ভালো লাগতো। যেমন ভাবতাম পুরুষ অর্থাৎ কবির কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর দৃশ্যমান জগতে আর কী আছে। আর কি কি আছে খুঁজতে খুঁজতে আমি সারা নিসর্গমণ্ডলকেই এলোমেলো করে ফেলেছি।’(ভূমিকা/ আল মাহমুদের কবিতা)। নারীতো স্রষ্টারই এক অপরূপ সৃষ্টি, পুরুষের নিত্যসঙ্গী। শুধু দুনিয়াতে কেনো, বেহেশতে নারীর উপস্থিতি পুরুষকে অনন্ত জীবনে কিস্তি ভাসাতে সাহস যোগাবে। সেখানে নারীর বন্দনাতেই কবি রচনা করবেন আরেক মহাকাব্য। সেজন্যে এক অলৌকিক ইস্টিমারে সওয়ার হয়েছেন মাহমুদ। সেখানে নারীর প্রতি প্রেম ভালোবাসা প্রসারিত হয়েছে নারীর স্রষ্টার প্রতি। কবির স্রষ্টার প্রতি। ‘সবাই উষ্ণতা খোঁজে।
আমি খুঁজি প্রশান্তি তোমার আনন্দের উপাসক চারিভিতে আমি শুধু সৌন্দর্য পিয়াসী আলোর আহ্বানে পোড়ে পতঙ্গেরা, আমার আঁধার ছড়ায় ঘুমের বীজ। আমি সেই স্তব্ধতার চাষী।’ (স্তব্ধতার চাষী / নদীর ভিতরে নদী) মাহমুদ এখানে আর নারীর উষ্ণতা খোঁজেন না। এখানে স্রষ্টার উষ্ণতায় একজন কবির প্রশান্তি কামনা। তার কাছে সবকিছু সপে দেয়া। স্রষ্টার সৌন্দর্যের পিয়াসী তিনি। রুমী, হাফিজ, ইকবালের অনুগামী আরেক মাহমুদের সন্ধান পাওয়া যায় এখানে। গভীর ধ্যানে নিমগ্ন সাধক আল মাহমুদকে আমরা পাই অন্য এক কবিপুরুষ হিসেবে। কাব্যভাষার নতুন এক বয়নশিল্পীর নিপুন গাঁথুনী মুগ্ধ করে পাঠককে। যে ভাষার সাথে সিরাজী, নজরুল কিংবা ফররুখের কাব্যভাষার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে নয়া এক তরিকার মুর্শিদ তিনি।
আর আমরা মুরিদ হয়ে শুনে যাই নতুন এক কবিতা বয়ান। সুরা যিলযালের মহাপ্রলয়কে তুলে ধরের ‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’ কবিতায়। ‘যেন সেই মহা শিঙ্গাধ্বনির পর চেতনা বিহ্বল এক স্তব্ধতায় নিশ্চল তিনি। একটি ভেঙ্গে পড়া নক্ষত্রের ভাঙা টুকরোয় ঠেস দিয়ে মহা বিনাশের ঘোরলাগা নয়ন দুটি মেলে আছেন। তার দৃষ্টির উদাসীনতার মধ্যেই স্তম্ভিত হয়ে আছে সুর্য।’ ইস্রাফিলের মহা শিঙ্গাধ্বনির পরে পৃথিবী হবে চূর্ণ বিচূর্ণ। ধুলিকণার মতো হয়ে যাবে গ্রহ-নক্ষত্র। এরপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সাথে সাথে শান্ত, স্থির হবে সবকিছু। পুনরুত্থান ঘটবে মানুষের। হাশরের ময়দানে দাঁড়াবে সবাই। মাহমুদের বাকভঙ্গিতে তার উপস্থাপনÑ ‘কাঁপতে লাগলো সূর্য। সহসা তেজপুঞ্জ সঞ্চারিত হওয়া মাত্র শুরু হলো জ্যোতি ও গলিত ধাতুসমূহের উৎক্ষেপণ ও আলোড়ন। গামারশ্মির ছটায় ভরে যেতে লাগলো সমস্ত কক্ষপথ।
নোঙ্গরতোলা অর্ণবপোতের মতো চাঁদ ভেসে গেলো তার নিজের নিয়মে। গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ফিরে পেলো যার যার গতিপথ। শিঙ্গার ঊর্ধ্বমুখী নল থেকে নিসৃত হতে লাগলো একই সাথে ধ্বনি, ধুকপুক, সময়, শিহরণ।’ (পুনরুত্থানের ফুৎকার/ নদীর ভিতর নদী) এলিয়টের ‘জার্নি অব দ্যা ম্যাজাই’ যেখানে এই জন্মমৃত্যুর কাহিনী বর্র্ণিত হয়েছে খ্রিস্টীয় চিন্তাধারায় সেখানে ‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’ দীর্ঘ কবিতায় মাহমুদের চিন্তার গভীর ব্যাপ্তি ও বিশ্বাস ফুটে উঠেছে পবিত্র কুরআনের নির্যাসে। যার পরিসমাপ্তিতে তিনি বলেছেনÑ ‘যেন মৃতেরা তাদের আঙ্গুলের নখগুলো পর্যন্ত নিখুঁত পেয়ে, যার যার কবর থেকে বেরুবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে।’ তখন আর মৃত্যুভয় কারো ভিতর থাকে না।
জীবনের নতুন এক আশায় আবার তাদের প্রাণ সঞ্চরণশীল হয়। মৃত্যু বিষয়ক বোদলেয়ারের একটি দীর্ঘ কবিতা আছে।
শিরোনাম ‘ভ্রমণ’ যার ভিতর হতাশা আর জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াবার ব্যাকুলতা আছে। বোদলেয়ারের এই কবিতার সাথে হাইনের ‘বিমিনি ও র্যাবোর ‘মাতাল তরণী’র অনেক সাদৃশ্য আছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়Ñএই কবিতার পূর্বপুরুষ হাইনের ‘বিমিনি’; র্যাঁবোর ‘মাতাল তরণী’ এর সন্তান। ‘বিমিনি’ বা ‘শয্যাকবর’ একটি দীর্ঘ কবিতা। ব্যালাড ছন্দে লেখা। স্পেনীয় নাবিক ও যোদ্ধা হুয়ান পন্থে দে লেঅন যার নায়ক। ১৪৯৩ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের সময় লেঅন ছিলেন তার সহকর্মী। লেঅন বৃদ্ধ বয়সে কিউবার সৈকতে দাঁড়িয়ে যৌবনকে স্মরণ করছেন আর বলছেনÑ ‘দিয়ে দিতে পারি ধনরতœ, রাজি আছি মূর্খ ও দীন হতে, যদি ফিরে পাই যৌবন।’ তিনি শুনেছেন ‘বিমিনি’ নামক এক দ্বীপে কালো পানির একটি নদী আছে। ‘লিথি’ তার নাম। তার পানি পান করলে চির যৌবন লাভ করা যায়।
জীবনের ক্লেদ ও রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আশি জন পুরুষ ও একজন নারী নিয়ে লেঅন তরী ভাসালেন সেই আশ্চর্য দ্বীপের সন্ধানে। এই ভ্রমণে লেঅন আরো বেশি কৃশ, লোলচর্ম ও আরো ব্যধিগ্রস্ত হন। হাইনে কবিতাটি শেষ করেছেন মৃত্যুতে। যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াবার জন্য এত আয়োজন সেই মৃত্যুই তার পরিসমাপ্তি।
আর বোদলেয়ার মৃত্যুকে করেছেন তার ‘ভ্রমণ’কবিতার কাণ্ডারি। ৮ম স্তবকে বোদলেয়ার বলেনÑ ‘হে মৃত্যু সময় হলো! এই দেশ নির্বেদে বিধুর। এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন। কাণ্ডারী, তুমি তো জানো অন্ধকার অম্বর, সিন্দুর অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের পুলিন। ঢালো সে- গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা! জ্বালো সে অনল, যাতে অতলান্ত খুঁজি নিমজ্জন! হোক স্বর্গ, অথবা নরক, তাকে এসে যায় কী-বা, যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন নূতন।’ বোদলেয়ার ‘ভ্রমণ’ কবিতায় গতিহীন দিশাহীন ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন কিন্তু মাহমুদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন হাসিমুখে, পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রভুর সান্নিধ্যে পাওয়াই তর জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। মৃত্যু হলো প্রভুর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। মৃত্যু থেকে পালিয়ে নয় বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গনই জীবনের পূর্ণতা। নজরুলের ‘খেয়াপারের তরণী’ আর ফররুখের ‘সাত সাগরের মাঝি’র ভেতরেও আছে মৃত্যু ও আশা। জীবনানন্দ দাস ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় তার সংশয় তুলে ধরেছেন- ‘হয়তো বা মানুষ নয় শঙ্খ চিল শালিকের বেশে’ বলে। আল মাহমুদের ভিতর এই সংশয় নেই।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কবি তার গন্তব্যে এসে উপনীত হয়েছেন। সৃষ্টি রহস্যের গিট খুলে তিনি পৌঁছে যান গন্তব্যেÑ ‘ইস্রাফিলের অবিশ্রান্ত ফুঁয়ের মধ্যেই শুনতে পেলেন দূরাগত ফেরেশতাদের কলরব।
তাদের ডানার শব্দে বুঝি এক্ষুণি উন্মোচিত হবে নিঃসীম নীলিমার পর্দা। এই নিঃসীম নীলিমার পর্দা উন্মোচিত হলে তিনি দেখেন এক মহা আননের সীমাহীন আভাসÑ ‘আমি চলে এসেছি ষাটটি বালুচর পেরিয়ে। ঐ তো সামনে নদী। চখাচখি উড়ছে। এর বেশি আমি আর কোথায় যাবো? অথচ গন্তব্যের একটি চিত্রকে আমার হৃদয়ের উপর রক্তের শিরার মতো লিখে দিয়েছে। আর সেই মানচিত্রের আছে কেবল এক মহা আননের সীমাহীন আভাস।’ (মুখ ও মুখোশ থেকে বেরিয়ে/দ্বিতীয় ভাঙ্গন) এ যেন কবিরই আত্মজিজ্ঞাসার জবাব। যে প্রশ্ন একসময় তাকে তাড়িত করতোÑ ‘যে সব অপরূপ উপত্যকায় কবি বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতেন সেখানে সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিমালা বর্ণ ও তেজ হারিয়ে নিভে যায়। নিঃসঙ্গ কবির মনে প্রশ্ন জাগে। আমি তবে কোথায় যাবো। (ভূমিকা / আল মাহমুদের কবিতা); এ যেন তারই তরজমা। সমকালীন বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ্ব কবিতার তিনি একজন মহানায়ক।
সঞ্চরলশীল মাছের মতো এখনো তার কলম পোনা ছাড়ে। কলমের কালিতে ফুটে ওঠে আশা জাগানিয়া কবিতা। ধ্যানি মাছরাঙার মতো এখনো তিনি ব্যাকুল থাকেন কবিতা রচনায়। যদিও তার কবিতার পথ পরিক্রমা জানা হয়ে গেছে আমাদের। এখন তিনি কেবল সে রাজপথের আলোকসজ্জা করে যাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। নারীর প্রেমে তিনি ছিলেন ব্যাকুল, স্রষ্টার সান্নিধ্যই তার আরাধ্য। লেখক : কবি। http://www.weeklysonarbangla.net/news_details.php?newsid=16483
মনসুর আজিজ।।
আল মাহমুদ প্রেমিক কবি।
কালো পাথরের প্রতি তার প্রেম। চুম্বনের প্রত্যাশায় ঠোঁট দুটো ব্যাকুল থাকে সারাক্ষণ। কালো পাথরের চাদরের প্রতি তার প্রেম আরো অধিক। চাদরের মাঝখানে অলৌকিক পাথর। পৃথিবীর প্রেমিককুল ব্যাকুল থাকে কালো পাথরে চুম্বনের প্রত্যাশায়। যাঁর সৌম্যকান্তিতে চাদরটি জড়ানো থাকে মাহমুদের প্রেম তার প্রতি আরো বেশি। মাহমুদ তার প্রেম উজাড় করে দেন আলোকিত মানুষের মালিকের প্রতি। তার তাবৎ প্রেম পুঞ্জিভূত হয় সেখানে। নারীর প্রতি প্রেম চূড়ান্ত প্রেমের খসড়ামাত্র। নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা অগোছালো পাণ্ডুলিপি।
প্রেমের প্রচ্ছদের দু-একটি স্কেচ মাত্র। কালো পাথরের মালিকের প্রতি প্রেম নিবেদনের প্রস্তুতি পর্ব। নারী যাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাই নারীর প্রতি প্রেম নিবেদন করে মাহমুদ প্রস্তুত হয়েছেন একটি চুম্বনের প্রার্থনায়। বিস্তৃত এক সৌন্দর্যভূমি নির্মাণের। সেজন্য মাহমুদ নদী, নারী, মানুষ, নিসর্গ ছেড়ে চলে যান অন্যগ্রহে। ‘আমার পথ এখন মাটি থেকে আকাশের দিকে মোড় নিয়েছে। / ঐ তো মেঘ, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ চমকের মহড়া দেখছি। দেখছি ধূসর নি®প্রাণ চন্দ্রমণ্ডল।... দেখছি পরম নিশ্চিত শূন্যতার ধারণার ভেতর জ্বলে ওঠা এক রশ্মির আভাস।’ (পথের কথা / নদীর ভেতরে নদী) কিংবা আল মাহমুদ যখন বিগলিত হন দেশ মাতৃকার মায়া ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার জন্যÑ ‘ছেড়ে দাও আমার হাত। আমি দেশহীন শেষ দশার কবির মতো আকাশের দিকে আজান হেকে বাতাসে বিলীন হয়ে যাই।’ (যাব না তোমার সাথে হে দেশ জননী / দ্বিতীয় ভাঙন) দেশের কথা চিন্তা করে নিজের কাজের সমাপ্তি টেনে কবি বিলীন হয়ে যেতে চান।
সেখানে আর কবির কোনো দেশ থাকে না, দেশ-মাতৃকা থাকে না। অলৌকিক এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কবি। উৎসই তার গন্তব্য। যেখানে ছিল আত্মার অনুরণন। স্মৃতির সুরক্ষিত প্রাসাদ। নারীর সাথেই বাগানে পথচলা। নারীর সাথেই পৃথিবীতে মানুষের চাষবাস। নারীর সাথেই শুরু হবে অনন্ত জীবনের পর্যটন। যে নারীর সাথে পার্থিব জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তার সান্নিধ্য কবি আর চান না। ‘ব্রাকের আপার মতো ঠাট’ তিনি আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন না। ‘শঙ্খমাজা স্তন’ ‘বর্তুল শঙ্খের মাঝে নাক ডুবিয়ে’ তিনি আর ঘ্রাণ শুকতে চান না। ‘দুটি গোশতে গোলাপ থেকে নুনের হালকা গন্ধে’ তিনি আর ব্যাকুল নন। ‘পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী’ এড়িয়ে যায় কবির দৃষ্টি। একদা নারীর প্রতি নিবেদন ছিলÑ ‘চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ / উগল মাছের গোশত তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়।’ (সনেট-৩/ সোনালি কাবিন) কিংবা ‘নটির মুদ্রার মতো মন আর স্তন/ অশ্লীল আরদ্ধ বিষ তুলেছে ফণায়,/ সাহসে আঘাতে স্পর্শে তোমার রমণ/ শেষ করো।
ঘামে কামে পরিতৃপ্ততায়।’ মাহমুদ ডুবে ছিলেন নারীতে। নারীর রূপ জৌলুসের বোতাম খুলে ছিলেন দু’হাতে। বোদলেয়ার নারীর এই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেÑ ‘নিলো সে আমার কামঃ তারপর, পালঙ্কবিতানে এলিয়ে, ইষৎ হেসে, তাকালো সে অলস নয়না।’ ‘অলঙ্কার’ কবিতায় বোদলেয়ার রমণক্রিয়ার পরিসমাপ্তি টানেনÑ ‘নিবে গেলো মুমূর্ষু বাতির শিখা।
কোমল নিস্বন অগ্নিকুণ্ড একা জ্বলে অন্ধকার, স্তব্ধ নিরালায় যতবার দীর্ঘশ্বাসে নীলিমার উদ্ভাস জ্বালায় শোনিতে প্লাবিত করে গাত্র তার অম্বরবরণ। (বোদলেয়ার ও তার কবিতা ঃ অনুবাদ বুদ্ধদেব বসু পৃ-৫০) আবারÑ ‘দূরাগত সুবাস’ কবিতায় বলেনÑ ক্ষীনাঙ্গে ক্ষমতাময় পুরুষের সুঠাম শরীর অপরূপ সরলতা মেয়েদের চোখের তারায়। (ঐ, পৃ-৫২) আল মাহমুদের সাথে বোদলেয়ারের নারী সৌন্দর্যের পার্থক্য স্পষ্ট।
মাহমুদের নারী পোয়াতি মাছের মতো সঞ্চরলশীল, কর্মঠ, সুঠাম পেশীর অধিকারিনী। ভাটি বাংলার মৃত্তিকায় বেড়ে ওঠা নতুন চরের মতো পলি ভরা মাহমুদের নারী। নারীর প্রতি মাহমুদের প্রেম আছে, আছে সম্মান। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে গাঁথেন বাঙালি রমণীর রূপমাদুলি। চুল খোলা আয়শা আক্তার থেকে রাবেয়াকে তুলে এনেছেন সুমহান মর্যাদায়। মা হাওয়াকে তুলেছেন মহীমায়, মমতায়, মর্যাদার প্রতীকরূপে। কিন্তু প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা, প্রেম, প্রণয়, পরিণয়Ñ সেখানে আল মাহমুদ আরো তীর্যক; আরো খোলামেলা। উপস্থাপনায় আধুনিক, বাঙালি কবির জৌলুস ঢেলেছেন পরম পারঙ্গমে। সমসাময়িক কবিরা যখন বিদেশী নারীর রূপ জৌলুসের মোড়ক উম্মোচনে ব্যস্ত, মাহমুদ সেখানে নারীর সৌন্দর্য খোঁজেন ব্রাকের আপার; যে কিনা রোদ বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। সুঠামদেহী গ্রাম্য রমণীর কর্মব্যস্ত চলচ্চিত্র তুলে ধরেন পঙক্তির স্যালুলয়েডে। এক সময় তিনি হারিয়ে যেতে চাইতেনÑ ‘ঐ তো সে।
মেঘনায় লাফিয়ে ওঠা কালো রুই গোধুলিতে ঘরফিরতি রাখালের হাকডাকের মতো খুশিতে উপচানো। পড়ন্তবেলায় লুকিয়ে পড়া অজস্র শালিক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারুর মতো দেহ তার। চোখ যেন রাজা মহীপালের দীঘি। আর বুক দুটি মিথুনরত কবুতর।
তার নাভীরন্ধ্রের ভেতর একটি ভরতপাখির মতো আমি অনন্তে হারিয়ে গেলাম। (অস্পষ্ট স্টেশন/ আরব্য রজনীর রাজহাঁস) একসময় কালো রুইয়ের মতো নারীর নাভীমূলে ভরতপাখির মতো হারিয়ে যাওয়াই ছিল মাহমুদের সুখ। আর এখন তিনি আকাশের দিকে আজান হেঁকে বাতাসে বিলীন হয়ে যেতে চান। আল মাহমুদ যখন নিজেই বয়ান করেন তখন আর সংশয় থাকে না কারোÑ ‘প্রেম প্রকৃতি স্বদেশভূমিই আমার রচনার বিষয়বস্তু বলে ভাবতে আমার ভালো লাগতো। যেমন ভাবতাম পুরুষ অর্থাৎ কবির কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর দৃশ্যমান জগতে আর কী আছে। আর কি কি আছে খুঁজতে খুঁজতে আমি সারা নিসর্গমণ্ডলকেই এলোমেলো করে ফেলেছি।’(ভূমিকা/ আল মাহমুদের কবিতা)। নারীতো স্রষ্টারই এক অপরূপ সৃষ্টি, পুরুষের নিত্যসঙ্গী। শুধু দুনিয়াতে কেনো, বেহেশতে নারীর উপস্থিতি পুরুষকে অনন্ত জীবনে কিস্তি ভাসাতে সাহস যোগাবে। সেখানে নারীর বন্দনাতেই কবি রচনা করবেন আরেক মহাকাব্য। সেজন্যে এক অলৌকিক ইস্টিমারে সওয়ার হয়েছেন মাহমুদ। সেখানে নারীর প্রতি প্রেম ভালোবাসা প্রসারিত হয়েছে নারীর স্রষ্টার প্রতি। কবির স্রষ্টার প্রতি। ‘সবাই উষ্ণতা খোঁজে।
আমি খুঁজি প্রশান্তি তোমার আনন্দের উপাসক চারিভিতে আমি শুধু সৌন্দর্য পিয়াসী আলোর আহ্বানে পোড়ে পতঙ্গেরা, আমার আঁধার ছড়ায় ঘুমের বীজ। আমি সেই স্তব্ধতার চাষী।’ (স্তব্ধতার চাষী / নদীর ভিতরে নদী) মাহমুদ এখানে আর নারীর উষ্ণতা খোঁজেন না। এখানে স্রষ্টার উষ্ণতায় একজন কবির প্রশান্তি কামনা। তার কাছে সবকিছু সপে দেয়া। স্রষ্টার সৌন্দর্যের পিয়াসী তিনি। রুমী, হাফিজ, ইকবালের অনুগামী আরেক মাহমুদের সন্ধান পাওয়া যায় এখানে। গভীর ধ্যানে নিমগ্ন সাধক আল মাহমুদকে আমরা পাই অন্য এক কবিপুরুষ হিসেবে। কাব্যভাষার নতুন এক বয়নশিল্পীর নিপুন গাঁথুনী মুগ্ধ করে পাঠককে। যে ভাষার সাথে সিরাজী, নজরুল কিংবা ফররুখের কাব্যভাষার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে নয়া এক তরিকার মুর্শিদ তিনি।
আর আমরা মুরিদ হয়ে শুনে যাই নতুন এক কবিতা বয়ান। সুরা যিলযালের মহাপ্রলয়কে তুলে ধরের ‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’ কবিতায়। ‘যেন সেই মহা শিঙ্গাধ্বনির পর চেতনা বিহ্বল এক স্তব্ধতায় নিশ্চল তিনি। একটি ভেঙ্গে পড়া নক্ষত্রের ভাঙা টুকরোয় ঠেস দিয়ে মহা বিনাশের ঘোরলাগা নয়ন দুটি মেলে আছেন। তার দৃষ্টির উদাসীনতার মধ্যেই স্তম্ভিত হয়ে আছে সুর্য।’ ইস্রাফিলের মহা শিঙ্গাধ্বনির পরে পৃথিবী হবে চূর্ণ বিচূর্ণ। ধুলিকণার মতো হয়ে যাবে গ্রহ-নক্ষত্র। এরপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সাথে সাথে শান্ত, স্থির হবে সবকিছু। পুনরুত্থান ঘটবে মানুষের। হাশরের ময়দানে দাঁড়াবে সবাই। মাহমুদের বাকভঙ্গিতে তার উপস্থাপনÑ ‘কাঁপতে লাগলো সূর্য। সহসা তেজপুঞ্জ সঞ্চারিত হওয়া মাত্র শুরু হলো জ্যোতি ও গলিত ধাতুসমূহের উৎক্ষেপণ ও আলোড়ন। গামারশ্মির ছটায় ভরে যেতে লাগলো সমস্ত কক্ষপথ।
নোঙ্গরতোলা অর্ণবপোতের মতো চাঁদ ভেসে গেলো তার নিজের নিয়মে। গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ফিরে পেলো যার যার গতিপথ। শিঙ্গার ঊর্ধ্বমুখী নল থেকে নিসৃত হতে লাগলো একই সাথে ধ্বনি, ধুকপুক, সময়, শিহরণ।’ (পুনরুত্থানের ফুৎকার/ নদীর ভিতর নদী) এলিয়টের ‘জার্নি অব দ্যা ম্যাজাই’ যেখানে এই জন্মমৃত্যুর কাহিনী বর্র্ণিত হয়েছে খ্রিস্টীয় চিন্তাধারায় সেখানে ‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’ দীর্ঘ কবিতায় মাহমুদের চিন্তার গভীর ব্যাপ্তি ও বিশ্বাস ফুটে উঠেছে পবিত্র কুরআনের নির্যাসে। যার পরিসমাপ্তিতে তিনি বলেছেনÑ ‘যেন মৃতেরা তাদের আঙ্গুলের নখগুলো পর্যন্ত নিখুঁত পেয়ে, যার যার কবর থেকে বেরুবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে।’ তখন আর মৃত্যুভয় কারো ভিতর থাকে না।
জীবনের নতুন এক আশায় আবার তাদের প্রাণ সঞ্চরণশীল হয়। মৃত্যু বিষয়ক বোদলেয়ারের একটি দীর্ঘ কবিতা আছে।
শিরোনাম ‘ভ্রমণ’ যার ভিতর হতাশা আর জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াবার ব্যাকুলতা আছে। বোদলেয়ারের এই কবিতার সাথে হাইনের ‘বিমিনি ও র্যাবোর ‘মাতাল তরণী’র অনেক সাদৃশ্য আছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়Ñএই কবিতার পূর্বপুরুষ হাইনের ‘বিমিনি’; র্যাঁবোর ‘মাতাল তরণী’ এর সন্তান। ‘বিমিনি’ বা ‘শয্যাকবর’ একটি দীর্ঘ কবিতা। ব্যালাড ছন্দে লেখা। স্পেনীয় নাবিক ও যোদ্ধা হুয়ান পন্থে দে লেঅন যার নায়ক। ১৪৯৩ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের সময় লেঅন ছিলেন তার সহকর্মী। লেঅন বৃদ্ধ বয়সে কিউবার সৈকতে দাঁড়িয়ে যৌবনকে স্মরণ করছেন আর বলছেনÑ ‘দিয়ে দিতে পারি ধনরতœ, রাজি আছি মূর্খ ও দীন হতে, যদি ফিরে পাই যৌবন।’ তিনি শুনেছেন ‘বিমিনি’ নামক এক দ্বীপে কালো পানির একটি নদী আছে। ‘লিথি’ তার নাম। তার পানি পান করলে চির যৌবন লাভ করা যায়।
জীবনের ক্লেদ ও রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আশি জন পুরুষ ও একজন নারী নিয়ে লেঅন তরী ভাসালেন সেই আশ্চর্য দ্বীপের সন্ধানে। এই ভ্রমণে লেঅন আরো বেশি কৃশ, লোলচর্ম ও আরো ব্যধিগ্রস্ত হন। হাইনে কবিতাটি শেষ করেছেন মৃত্যুতে। যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াবার জন্য এত আয়োজন সেই মৃত্যুই তার পরিসমাপ্তি।
আর বোদলেয়ার মৃত্যুকে করেছেন তার ‘ভ্রমণ’কবিতার কাণ্ডারি। ৮ম স্তবকে বোদলেয়ার বলেনÑ ‘হে মৃত্যু সময় হলো! এই দেশ নির্বেদে বিধুর। এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন। কাণ্ডারী, তুমি তো জানো অন্ধকার অম্বর, সিন্দুর অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের পুলিন। ঢালো সে- গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা! জ্বালো সে অনল, যাতে অতলান্ত খুঁজি নিমজ্জন! হোক স্বর্গ, অথবা নরক, তাকে এসে যায় কী-বা, যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন নূতন।’ বোদলেয়ার ‘ভ্রমণ’ কবিতায় গতিহীন দিশাহীন ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন কিন্তু মাহমুদ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন হাসিমুখে, পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে। প্রভুর সান্নিধ্যে পাওয়াই তর জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। মৃত্যু হলো প্রভুর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম। মৃত্যু থেকে পালিয়ে নয় বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গনই জীবনের পূর্ণতা। নজরুলের ‘খেয়াপারের তরণী’ আর ফররুখের ‘সাত সাগরের মাঝি’র ভেতরেও আছে মৃত্যু ও আশা। জীবনানন্দ দাস ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় তার সংশয় তুলে ধরেছেন- ‘হয়তো বা মানুষ নয় শঙ্খ চিল শালিকের বেশে’ বলে। আল মাহমুদের ভিতর এই সংশয় নেই।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কবি তার গন্তব্যে এসে উপনীত হয়েছেন। সৃষ্টি রহস্যের গিট খুলে তিনি পৌঁছে যান গন্তব্যেÑ ‘ইস্রাফিলের অবিশ্রান্ত ফুঁয়ের মধ্যেই শুনতে পেলেন দূরাগত ফেরেশতাদের কলরব।
তাদের ডানার শব্দে বুঝি এক্ষুণি উন্মোচিত হবে নিঃসীম নীলিমার পর্দা। এই নিঃসীম নীলিমার পর্দা উন্মোচিত হলে তিনি দেখেন এক মহা আননের সীমাহীন আভাসÑ ‘আমি চলে এসেছি ষাটটি বালুচর পেরিয়ে। ঐ তো সামনে নদী। চখাচখি উড়ছে। এর বেশি আমি আর কোথায় যাবো? অথচ গন্তব্যের একটি চিত্রকে আমার হৃদয়ের উপর রক্তের শিরার মতো লিখে দিয়েছে। আর সেই মানচিত্রের আছে কেবল এক মহা আননের সীমাহীন আভাস।’ (মুখ ও মুখোশ থেকে বেরিয়ে/দ্বিতীয় ভাঙ্গন) এ যেন কবিরই আত্মজিজ্ঞাসার জবাব। যে প্রশ্ন একসময় তাকে তাড়িত করতোÑ ‘যে সব অপরূপ উপত্যকায় কবি বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতেন সেখানে সূর্যাস্তের শেষ রশ্মিমালা বর্ণ ও তেজ হারিয়ে নিভে যায়। নিঃসঙ্গ কবির মনে প্রশ্ন জাগে। আমি তবে কোথায় যাবো। (ভূমিকা / আল মাহমুদের কবিতা); এ যেন তারই তরজমা। সমকালীন বাংলা কবিতার পাশাপাশি বিশ্ব কবিতার তিনি একজন মহানায়ক।
সঞ্চরলশীল মাছের মতো এখনো তার কলম পোনা ছাড়ে। কলমের কালিতে ফুটে ওঠে আশা জাগানিয়া কবিতা। ধ্যানি মাছরাঙার মতো এখনো তিনি ব্যাকুল থাকেন কবিতা রচনায়। যদিও তার কবিতার পথ পরিক্রমা জানা হয়ে গেছে আমাদের। এখন তিনি কেবল সে রাজপথের আলোকসজ্জা করে যাবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। নারীর প্রেমে তিনি ছিলেন ব্যাকুল, স্রষ্টার সান্নিধ্যই তার আরাধ্য। লেখক : কবি। http://www.weeklysonarbangla.net/news_details.php?newsid=16483
No comments:
Post a Comment