Tuesday 18 July 2017

সংখ্যালঘু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ।

সংখ্যালঘু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ।


মোহিত রায়
শিরোনামটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় একেবারেই অচ্ছুৎ জেনেও সরাসরি সমস্যার পরিচয়ে যাওয়ার জন্য এই উসকানি। না বললেও চলে যে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু বলতে মুসলমান জনগোষ্ঠীকেই বোঝায়, ও তার চাপে অন্যান্য ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের এখানে কোন সংখ্যালঘু পরিচয় গড়েই ওঠেনি। অর্থাৎ সাঁওতাল সংখ্যালঘু বা নেপালি সংখ্যালঘু কথাটি বাংলায় অচল। পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সবচেয়ে বড় সমস্যা যে এই জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ প্রবল দারিদ্রের মধ্যে রয়েছেন এবং তার সঙ্গে এই জনগোষ্ঠী দিনে দিনে ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। এই নিবন্ধ সংখ্যালঘু মুসলমানদের এই সমস্যার আলোচনায় যাবে না যদিও তা অবশ্যই জরুরী। তবে এই সমস্যা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এই নিবন্ধ প্রশ্ন করবে যে এই সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের জন্য একটি সমস্যা হয়ে উঠছে কিনা এবং কেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কি বিশেষ সংখ্যালঘু ?
যদি প্রশ্ন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সত্যিই সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া যায় কিনা তবে হয়ত লেখকের পাটিগণিতের জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। কিন্তু এটা বোঝা উচিত যে সংখ্যায় কম হলেই তাকে সংখ্যালঘুর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় না। সমাজের চোর, ডাকাত বা ব্রাহ্মণরাও সংখ্যায় কম কিন্তু তা বলে তাদের সংখ্যালঘু বলা হয় না, পাড়ার মাস্তানকে আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গরা, ইরাকে সুন্নি মুসলিমরা বা ভারতের একটা বড় অংশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়েও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তখন তাঁদের আমরা সংখ্যালঘুর মর্যাদা দিই না। সুতরাং জনসমাজে সেই অংশকেই সংখ্যালঘুর মর্যাদা দেওয়া হয় যারা সংখ্যায় কম হওয়ার ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র দ্বারা দীর্ঘদিন নিপীড়িত, সে নিপীড়ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত হতে পারে।
১৯৪০ সালে, দেশভাগ হবার অনেক বছর আগে বাবাসাহেব আম্বেদকার পাকিস্তান প্রস্তাব সর্ম্পকে আলোচনায় বলেছিলেন ‘সংখ্যালঘু বিনিময়ই নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান’।১ তিনি আরো বলেছিলেন যে ‘পাকিস্তান না হলে দেশে সাম্প্রদায়িক গোলমালে জড়িত থাকবে সাড়ে ছ কোটি মুসলমান আর পাকিস্তান হয়ে গেলে পড়ে থাকবে দুকোটি মুসলমান। ….আমার মনে হয় পাকিস্তান হিন্দুস্তানের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান করবে না কিন্তু তা যথেষ্ট পরিমাণে ক্মাবে’।২ পাঞ্জাবে দেশভাগের সময় কার্যতঃ জনবিনিময় ঘটে, ফলে পূর্ব পাঞ্জাবে (ভারতের পাঞ্জাব) মুসলমান জনসংখ্যা ৩৩.১% থেকে কমে দাঁড়ায় ১.৮%। ফলে আম্বেদকারের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী পাঞ্জাবে গত ৬০ বছরে হিন্দু-মুসলমান বা শিখ-মুসলমান সমস্যা আর ঘটে নি, পাকিস্তান থেকে নিয়মিত উদ্বাস্তু আগমনও আর হয়নি। বাবাসাহেবের এই উপদেশ পশ্চিমবঙ্গ শোনেনি, তাই উদ্বাস্তু সমস্যার শেষ আজও হল না, হল না ‘সাম্প্রদায়িক’ সমস্যার সমাধানও। ফলে ১৯৫১ সালের ১৯ শতাংশ সংখ্যালঘু এখন বেড়ে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অর্থনৈতিক পশ্চাদপরতার জন্য কতটা রাষ্ট্র দায়ী আর কতটা মুসলমান সমাজের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী দায়ী তা বিতর্কিত। বামফ্রন্ট সরকার সার্বিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের দারিদ্র দূরীকরণে একেবারে ব্যর্থ, তার প্রভাব দরিদ্র মুসলমান সমাজসহ সব দরিদ্রকে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এজন্য দারিদ্রকে মাপকাঠি করে যে উন্নয়নের কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন তা ধর্মনির্বিশেষে কারও জন্যই নেওয়া হয়নি। ফলে মুসলমান সমাজ যে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। যথেষ্ট সুযোগসুবিধা থাকা সত্বেও ঠিক একই অবস্থা ঘটেছে আদিবাসী ও অন্যান্য হিন্দু দরিদ্রতম মানুষদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মুসলমান সমাজের এই পশ্চাদপরতার জন্য মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বার্থবিরোধী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে এই সংখ্যালঘু মুসলমানরাই কিন্তু ভারতে ও বাংলায় কয়েকশ বছর রাজত্ব করেছেন, ফলে এদেশে চিরকাল সংখ্যালঘুর দুরাবস্থা তাঁদের কখনোই ছিল না। এর পর দু’শ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বেও মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসনে ছিলেন না। বরং যুক্ত বাংলায় স্বাধীনতার পূর্বে মুসলিম লীগই ছিল প্রধান শাসক দল। সেজন্যই একদা-শাসক সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুসমাজের চিরকাল নিপীড়িত তফসিলি সমাজের পশ্চাদপরতার তুলনা করা চলে না। স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা ভাষাগত ক্ষেত্রে কোন সরকারি বিশেষ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। দীর্ঘকালীন অবিশ্বাসের জন্য বাড়িভাড়া থেকে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে অনেক অসুবিধায় ভুগতে হয় তা অনস্বীকার্য। কিন্তু মুসলমান সমাজের উপর শারীরিক অত্যাচার, নারীদের উপর অত্যাচার, সম্পত্তির লুণ্ঠন বা বিতাড়ন- এধরণের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে বিরল যা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ অভিঞ্জতা। এর জন্য (পরে আরো বিশদে আলোচনা করা হয়েছে) দেশভাগের প্রাথমিক ধাক্কার পর নিরাপদ পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা চলে এসেছেন ও আসছেন।
ফলে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ তার দরিদ্র অংশের অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতি তেমন না ঘটাতে পারলেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দাপটে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই দাপটে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবস্থানকে ইতিমধ্যেই পাল্টাতে শুরু করেছেন। এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাসিত হয়েছেন সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন, এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যাতে আরবি ভাষা ও ইসলামি বিষয় পড়া বাধ্যতামূলক। এর ছাত্রী ও অধ্যাপিকাদের বোরখা পরাও বেসরকারিভাবে বাধ্যতামূলক। এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে ক্রমশঃ পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের শিক্ষা হয়ে উঠছে ধর্মীয় মাদ্রাসা ভিত্তিক, অন্য কোন ধর্মের এরকম আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে নেই। সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলতে উলেমা ইমামদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মুসলমান সমাজকে। সুতরাং এই ‘সংখ্যালঘু’দের দাপটে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বহুমাত্রিক পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজের ধ্বংসের কাজ কম্যুনিস্ট, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের কল্যাণে শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটি ‘বিশেষ’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বললে হয়ত ভুল হবে না।
সংখ্যালঘু যেখানে সংখ্যাগুরু বিশ্বে
মনে রাখতে হবে মুসলমান সমাজের একটি আদর্শগত বিশ্ব ঐক্য রয়েছে। তার ধর্মীয় মানসে (যা মাদ্রাসা শিক্ষার ফলে আরো নিয়ত জোরদার হয়) একটি ‘উন্মা’-র ধারণা রয়েছে – – যার অর্থ একটি বিশ্ব মুসলিম সমাজ। এরকম একটি বিশ্বজোড়া ধর্মীয় সমাজের ধারণা অন্য কোন প্রধান ধর্মে নেই। ইসলামে খুব গুরুত্ব দিয়ে মানবজাতির মধ্যে মুসলমানদেরই শ্রেষ্ঠ বলে বলা হয়েছে। জনসংখ্যা অনু্যায়ী ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী, অর্থবলেও ইসলামি অনেক দেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ভারতীয় বা আমেরিকান মুসলমানকে তাঁর ধর্মের জন্য সুদূর আরবে তীর্থ করতে যেতে হয়। সৌদি আরবে হজ করতে যাওয়ার সুবাদে সাধারণ মুসলমানেরও এই আন্তর্জাতিক যোগাযোগটি ঘটে। ফলতঃ একটি অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হলেও স্থানীয় মুসলিম সমাজের একটি বৃহত্তম মুসলিম সমাজের অংশ হিসেবেও অস্তিত্ব থাকে। যেমন আমরা দেখেছি যে ইসলামের খলিফার শাসন রক্ষার জন্য ভারতের মুসলমানরা বিখ্যাত খিলাফত আন্দোলন করেছিলেন এবং তার অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিলেন মোহনদাস গান্ধী। যদিও খলিফা শাসনের মূল কেন্দ্র তুরস্কেই তখন প্রগতিশীলরা সেই শাসন তুলে দেবার জন্য লড়াই করেছিলেন।
আজকের মুসলিম বিশ্ব পূর্বে এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিমে আফ্রিকার আলজিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, মাঝখানে একমাত্র ভারত একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের এই বৃহত্তর মুসলিম সমাজে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অত্যন্ত দুর্বল বরং ইসলামি শরিযতী শাসনের প্রভাব মুখ্য। তুরস্কের মতন প্রায়-ইউরোপিয় ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এখন ইসলামি শাসনের দিকে এগোচ্ছে। সাধারণতঃ পৃথিবীর সব জায়গাতেই সংখ্যালঘু সমাজ কিছুটা রক্ষণশীল হয়, মনে করে স্থানীয় সংখ্যাগুরুরা তাদের বিশেষত্বকে খর্ব করতে চায়। সেজন্য তারা সামাজিক আদর্শের জন্য চেয়ে থাকে অন্যত্র তাদের সংখ্যাগুরু সমাজের উপর। গত তিন দশকে (ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে একটা শুরু ধরা যেতে পারে) বিশ্ব ইসলামি দুনিয়া ক্রমশঃ পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে। ঘরের পাশে পাকিস্তান বা বাংলাদেশও কোন প্রগতিশীল দিশা দেখাতে পারেনি। ফলে ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগও ভয়ানক সংকুচিত। এর সামগ্রিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজেও প্রবলভাবে রয়েছে ও এই সমাজও ধর্মীয় গোঁড়ামিই পছন্দ করছে।
মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা দেখা যাক। ইরানে ইসলামি বিপ্লব হবার পর গত ত্রিশ বছরে সেখানের ইহুদী, খ্রিষ্টান বা জরথ্রুস্তপন্থী সংখ্যালঘুরা ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন হয়ে এসেছেন।৩ মিশরের সংখ্যালঘু কপটিক খ্রিস্টানদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও (১০%) তাঁদের জনসংখ্যার সঠিক হিসেব পাওয়া দুষ্কর। বিশেষতঃ গত ৫০ বছর ধরে সেখানের ইসলামি রাষ্ট্রের কোপে পড়ে এই খ্রিষ্টান জনসমাজের ধর্মীয় মন্দির নির্মাণ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমে রয়েছে অনেক নিষেধাজ্ঞা, বারবার হয়েছে তাদের উপর আক্রমণ। ফলে খিস্টান সম্প্রদায় নিঃশব্দে দেশ ছাড়ছেন। আর আব্রাহামি ধর্ম (ইহুদী, খ্রিস্টান, ইসলাম) ছাড়া অন্য কোন ধর্মকে মিশর স্বীকার করে না ফলে মিশরের নাগরিকত্ব পেতে হলে হয় আব্রাহামি ধর্মের হতে হবে অথবা ধর্মকে উহ্য রাখতে হবে।৪ ইলসামি ধর্মান্ধতার মূল উৎস সৌদি আরবে তো ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রের সব আইনকানুন শরিয়ত মেনে চলে। মন্দির গির্জা গড়া যাবে না। এ অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের আরবশাহীর প্রায় সব দেশেই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবৈষম্যের দায়ে একসময় সারা পৃথিবী একঘরে করে রেখেছিল, ধর্মবৈষম্যের জন্য কেন যে ইসলামের পীঠস্থানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রীরা ভুলে গেলেন তা এক সপ্তম আশ্চর্য। কামাল আতাতুরক প্রভাবিত ধর্মনিরপেক্ষ সামরিকবাহিনী ও মধ্যবিত্তশ্রেণির চেষ্টায় তুরস্ক দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক না হয়েও ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখছিল, কিন্তু সম্প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে একটি ইসলামি দল তুরস্ককে ধর্মীয় সংকীর্ণতার দিকে নিয়ে চলেছে।
এই ইসলামি অভ্যুদয়ের দাপটে পশ্চিম ইউরোপে যেখানে সংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানরা বেশ কম (ব্রিটেনে ৩%, ফ্রান্সে ৮%) সেখানের সমাজও ইসলাম আতঙ্কে ভুগছে। লন্ডনের ভূগর্ভস্থ রেল, স্পেনের রেল, হল্যান্ডের চিত্রনির্মাতা (থিও ভ্যান গগ) বা লেখিকা (হিরসি আলি) সবাই আক্রান্ত। এই উন্মার এমনই মাহাত্ম্য যে আমেরিকায় একটি কোরান পোড়াবার কথা হয়েছিল, তাতেই দাঙ্গায় সুদূর আফগানিস্তানে, কাশ্মীরে বেশ কিছু লোক হতাহত, এমনকি ভারতীয় পাঞ্জাবে যেখানে মুসলমান সংখ্যা অত্যন্ত কম সেখানেও মুসলমানরা একটি চার্চ পুড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিগুলি ধ্বংসের পর কোন বৌদ্ধ প্রধান দেশে বা অঞ্চলে কোন মুসলমান আক্রান্ত হন নি, বা গুজরাতে অক্ষরধাম মন্দির আক্রান্ত হলে তামিলনাডু বা পশ্চিমবঙ্গে কোন মসজিদ আক্রান্ত হয় নি।
এবার আমরা প্রাচ্যের দুটি দ্রুত উন্নয়নশীল মুসলিম দেশের দিকে নজর ঘোরাতে পারি যদিও মুসলমান ভাবজগতে এদের কোন প্রভাব নেই। মুসলিম ভাবনা যেহেতু এখনও আরবদুনিয়া-কেন্দ্রিক, এজন্য ইসলামি উম্মাকে অনেকে আরব সাম্রাজ্যবাদ বলেন। মালয়েশিয়া তিন দশক আগেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছিল না, এখন মুসলমানরা জনসংখ্যায় ৬০ শতাংশ। ৪০% মানুষ অমুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। শুধু তাই নয় মালয়েশিয়ার সংবিধানের ১৬০ ধারা অনুযায়ী সব মালয় জনগোষ্ঠীর লোককে মুসলমান হতেই হবে এবং তাদের বিচারব্যবস্থা চলবে শরিয়তি আইন মেনে। অন্য ধর্মগুলি কোন মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না কিন্তু মুসলমানরা তা পারবে।৫ দিনে দিনে তাই সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা পারলে দেশ ছাড়ছেন। ৯০% মুসলিম ইন্দোনেশিয়া অনেকটা গণতন্ত্রী তবে বালি দ্বীপে থাকা মাত্র ৩% একেবারে নীরব হিন্দুদের মন্দিরের উপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে আক্রমণ হয়েছে কয়েকবার।৬ ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন ব্যবসার মূল আকর্ষণ বালি দ্বীপের উজ্জ্বল সংস্কৃতি যেখানে এখনো ভারতীয় তথা হিন্দু প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে এবং সেই সুবাদে বালির হিন্দুদের অস্তিত্ব এখনও রয়ে গেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় যে ইসলামের বিশ্ব সমাজে মুক্ত বহুত্বমুখী গণতান্ত্রিক চিন্তার কোন দিশা কোথাও আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না। বরং আমেরিকা-ইউরোপে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা বজায় রাখার নাম করে ইসলামি গোঁড়ামি আরো জাঁকিয়ে বসেছে আর তাকে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের নামে সবচেয়ে সমর্থন জানাচ্ছেন বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রীরা। যাঁরা জেসাস খ্রাইস্ট সুপারস্টার নাটক চালিয়ে যায় বছরের পর বছর, নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগো লেখেন গসপেল এর্কডিং টু জেসাস খ্রাইস্ট-এর মতন উপন্যাস, সেই সমাজের বুদ্ধিজীবিরা হজরত মহম্মদ নিয়ে বিন্দুমাত্র ঠাট্টা-তামাসার বিরোধী, সেখানে ইসলামের সমালোচনা করে চিত্রনির্মাতা খুন হলেও তেমন প্রতিবাদ চোখে পড়ে না।
প্রতিবেশী
এবার দেখা যাক আমাদের একেবারে কাছের প্রতিবেশী দেশগুলির অবস্থা। আমাদের প্রতিবেশী বলতে এখন সার্ক-ভুক্ত (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন) ৮টি দেশকে ধরা যেতে পারে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান, আফগানিস্তান। এর মধ্যে ৪টি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক।
আফগানিস্তান সরকারিভাবেই একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র, এর আইন কানুন চলে কট্টর ইসলামি রীতিনীতি মেনেই। একদা বৌদ্ধ দেশে এখন ৯৯% মানুষ মুসলমান। তবু হাতে গোনা কয়েকটি শিখ পরিবার অত্যাচার থেকে বাঁচে না, বাঁচে না পাথরের বুদ্ধমূর্তিও। দেশের অনেকাংশ ইসলামি তালিবানদের অধীনে।
পর্যটকদের প্রিয় মালদ্বীপ সম্পূর্ণ ইসলামি দেশ। এখানে অন্য কোন ধর্মচর্চা নিষেধ। এমনকি মালদ্বীপের কোন নাগরিক অন্য কোন ধর্ম গ্রহণও করতে পারেন না। এবছর, ২০১০ সালে, ইসমাইল মহম্মদ দিদি নামক একজন মালদ্বীপের নাগরিক নাস্তিক জানতে পেরে সরকার তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। সে বেচারা প্রথমে লন্ডনে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চায় ও পরে আত্মহত্যা করে।৭
পাকিস্তান একটি ঘোষিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পাকিস্তানের ভিত্তিই হল ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব দেশের স্থাপনা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৯৬% মুসলমান, ১.৫% খ্রিস্টান ও ১% হিন্দু। জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানকে আরো ইসলামিকরণের পথে নিয়ে যান। হুদুদ অর্ডিনান্স জারী করে মুসলিম সম্প্রদায়কে শরিয়তি আইনের অন্তর্গত করেন। এর কিছু ধারায় অমুসলমানরাও অন্তর্গত হয়। ১৯৮০ সালে জারী হয় ব্লাসফেমি আইন যার দ্বারা হজরত মহম্মদ বা ইসলাম সম্পর্কে কোনরকম অবমাননা নিষেধ করা হয়। এছাড়া ইসলাম প্রচার-প্রসারে রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকে। এর ফলে পাকিস্তান এখন বিশ্ব ইসলামি সন্ত্রাসবাদের অন্যতম কেন্দ্র বলে গণ্য করা হয়। এই সর্বব্যপী ইসলামি প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র খ্রিস্টান ও প্রায় নিঃশেষিত হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি সৌধ ধ্বংসের পর পাকিস্তানে হাতে-গোনা কয়েকটি রয়ে-যাওয়া হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হয়।
আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র কিন্তু তার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মুসলমান ৯০%, হিন্দু ৯%। বাংলাদেশ বারবার সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেলেও এর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বারবার ফিরে এসেছে। সরাসরি সংখ্যালঘু বিরোধী আইন না থাকলেও পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও অর্থনীতিকে ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ হবার পর এই আইন নাম বদলে হয় ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ (Vested Property Act) এবং এই আইনে একই ভাবে হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল চলে। এই আইনের ফলে বিপুল হিন্দু জমি ও সম্পত্তি দখল হয়। এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক আবুল বরকত এবং এই অসাধারণ গবেষণার জন্য তিনি এখন বিশ্বখ্যাত।৮ এছাড়া পূর্ব-পাকিস্তান আমলের মতন ধারাবাহিক হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর শারীরিক আক্রমণ, ধর্মস্থান ধ্বংস, নারীদের লাঞ্ছনা, জমি ও সম্পত্তি লুণ্ঠন অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ আক্রান্ত হওয়ার পর (সে সময় ধ্বংস হয়নি, কয়েকশো লোক তার ওপর চড়ে বসে) সারা বাংলাদেশ জুড়ে দাঙ্গা হয়। বাঙ্গালী মুসলমানেরা হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেই ক্ষান্ত থাকেনি, হিন্দুদের দোকান-বাড়ি-ঘর লুট করা, এমনকি ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম ভাঙচুর ও তছনছ করে। ১৯৯২-এ ভারতে (মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গের কোন মসজিদ ভাঙার জন্য নয়) বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যে ভয়ঙ্কর তান্ডব চলে তাতে ২৮,০০০ বাড়ি-ঘর, ৩,৬০০ মন্দির, ২,৫০০ দোকান-বাজার ধ্বংস হয়। খুন হন ১৩ জন।৯ ২০০১-এ বেগম জিয়ার নির্বাচনের পর থেকে শুরু হয় ধারাবাহিক সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন।১০ এর ফলে ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ, ১৯৭৪-এ ১৩.৫% ও ২০০১ সালে ৯.২ শতাংশ নেমে এসেছে, ২০১১-র জনগণনায় সম্ভবতঃ তা নেমে দাঁড়াবে ৭-৮ শতাংশে। অধ্যাপক বরকত তাঁর বইয়ে হিসাব করে বলেছেন যে ১৯৭১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ৬৩ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে উধাও হয়ে গেছেন। ‘১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ এ এই নিখোঁজ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৭০৫ জন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ তে প্রতিদিন গড়ে ৫২১ জন ১৯৮১-১৯৯১ এ প্রতিদিন গড়ে ৪৩৮ জন এবং এই সংখ্যাটি অনেক বেড়ে ১৯৯১ থেকে ২০০১ এ দাঁড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭৬৭ জন।১১ এই উদ্বাস্তু আগমন এখনও রোজ চলছে। বাংলাদেশের আরেকজন গবেষকের অধ্যয়নে বিষয়টিকে এ ভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে যে ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।১২
এবার দেখা যাক প্রতিবেশী চারটি অ–মুসলমান দেশগুলিতে সংখ্যালঘুদের কি অবস্থা।১৩
শ্রীলঙ্কা একটি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানের ৭০% বৌদ্ধ, ১৫% হিন্দু ও ৮% মুসলমান। এখানে কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই। সব সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন (বিবাহ, সম্পত্তি) ছাড়া আইনে ধর্মের কোন স্বীকৃতি নেই। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
নেপাল একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র। এর কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানের ৮০% হিন্দু, ১১% বৌদ্ধ, ও ৭% মুসলমান। এখানে কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই। নেপালের সংবিধানের ২৩ তম ধারায় সব ধর্মাচারণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু যে কোন ধর্মান্তরকরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
ভুটান একটি রাজতন্ত্র যদিও তা গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরী ও নির্বাচনের জন্য অনেকগুলি পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে ৯০% বৌদ্ধ ও ১০% হিন্দু। ভুটানে কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই ও সব ধর্মের সমানাধিকার রয়েছে। তবে ভুটান সরকার ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিচ্ছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
ভারত তার সংবিধান অনুযায়ী একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। এখানে কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। ২০০১-এ জনসংখ্যার ৮০.৬% হিন্দু ও ১৩.৪% মুসলমান। আইনগতভাবে এখানে কোন ধর্মাচরণে কোন বাধা নেই। ভারতে জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুপাত ১৯৫১ সালে ১০.৪% থেকে বেড়ে ২০০১ সালে ১৩.৪% হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই বৃদ্ধি আরো অনেক বেশী। বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুন্নত অংশের জন্য সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন না।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ভারতকে নিয়ে প্রতিবেশী ৮টি দেশের ৪টি মুসলমানপ্রধান দেশেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সে সব দেশেই ইসলামি ধর্মীয় আইনের কড়াকড়ি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি ২টি হিন্দুপ্রধান ও ২টি বৌদ্ধপ্রধান দেশের সরকারি ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব অনুপস্থিত। মুসলমান প্রধান ও অপ্রধান দেশের পার্থক্য এখন নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত।
মুসলিম সংখ্যাসগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ
দেশ রাষ্ট্রধর্ম আইনী বিধিনিষেধ বিশেষ ব্যবস্থা
আফগানিস্তান ইসলাম ইসলামি মতে আইন অন্য ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই
মালদ্বীপ ইসলাম শরিয়তি আইন মালদ্বীপের নাগরিক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মও গ্রহণ করতে পারেন না।
পাকিস্তান ইসলাম হুদুদ অর্ডিন্যান্সের দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায় শরিয়তি আইনের অন্তর্গত ব্লাসফেমি আইন যার দ্বারা হজরত মহম্মদ বা ইসলাম সম্পর্কে কোনরকম অবমাননা নিষিদ্ধ
বাংলাদেশ ইসলাম অর্পিত সম্পত্তি আইনে হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল ধর্মীয় অত্যাচার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্রুত হ্রাস
অ-মুসলিম সংখ্যাসগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ
দেশ রাষ্ট্রধর্ম আইনী বিধিনিষেধ বিশেষ ব্যবস্থা
শ্রীলংকা
নেই
কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্বমূলক বা বিরোধী কোন আইন নেই
ভারত
নেপাল ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ
ভুটান ধর্মান্তরকরণ নিষিদ্ধ
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ
ইসলামি বিশ্বে বা প্রতিবেশী মুসলমানপ্রধান দেশে যে সম্প্রদায়ের কোন ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র খুঁজে পাওয়া ভার, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেই সমাজের মূলধারার কাছে অন্য কোন ভাবনা আশা করার কোন কারণ থাকতে পারে না। মুসলমান সমাজের এই বিশ্ব ও প্রতিবেশী অবস্থানকে মনে রেখে আমরা এবার পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থানের পর্যালোচনা শুরু করতে পারি।
শিক্ষা
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানের সামগ্রিক পশ্চাদপরতা এবং তার উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা নিয়ে এই লেখকের কোন দ্বিমত নেই। একজন হিন্দু বা খ্রিস্টানের ক্ষেত্রে এরকম অবস্থায় যেসব কর্মকান্ডের প্রয়োজন একজন মুসলমানের ক্ষেত্রে তা অন্যরকম হবার কোন কারণ নেই। একটি সমাজের পশ্চাদপরতার অন্যতম কারণ শিক্ষা। শিক্ষার অগ্রসরতার জন্য প্রয়োজন অনেক বিদ্যালয়। কিন্তু সব ধর্মের শিশুদের জন্য বিদ্যালয় দরকার হলেও সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য নাকি চাই মাদ্রাসা। আমাদের আগমার্কা কমুনিস্ট সরকারের এটা গর্বের বিষয়। তাদের সর্বশেষ পুস্তিকায় এই সাফল্যের কথা বিস্তারিত জানানো হয়েছে – ১৯৭৭ সালে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ৪৩৮৮, তা ২০১০-এ বেড়ে হয়েছে ৪,৫০,০০০, ১০০গুণ বৃদ্ধি! টাকা খরচ বেড়েছে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার থেকে ৬১০ কোটি!১৪ এই মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কতিপয় মুক্তমনা মুসলমান যেমন গিয়াসুদ্দিন (ধর্মমুক্ত মানবতাবাদী সংগঠন) লেখেন ‘মুসলিম সমাজ আজ যে সবচেয়ে বেশী পশ্চাৎপদ তার অনেকাংশে দায়ী এই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এবং মুসলিম সমাজের মাদ্রাসা সংস্কৃতি’।১৫ আর মাদ্রাসার পক্ষে থাকে সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস থেকে তাবৎ নকশাল বা এপিডিআর-এনজিওরা এবং নীরব সমর্থক বুদ্ধিজীবি/বিদ্বজ্জনেরা। এখন তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সিপিএমের মধ্যে মাদ্রাসা স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলেছে অথচ বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মুক্তমনা মানুষেরা সবাই এর বিরুদ্ধে।
মাদ্রাসায় আপত্তি কিসের? অন্য কোন ধর্মের যখন আলাদা এরকম সরকার-স্বীকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা নেই তখন হঠাৎ মুসলমানদেরই বা থাকবে কেন? রামকৃষ্ণ মিশন বা সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্রছাত্রীরা কোন হিন্দু বা খ্রিস্টান শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে পড়াশোনা করে না, তারা রাজ্যের বা কেন্দ্রিয় কোন অধর্মীয় বোর্ডের সিলেবাসেই পড়াশোনা করে। তাহলে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের কোন পাপের জন্য তাদের মধ্যযুগীয় কারাগারে পাঠাতে তৃণমূল সিপিএম থেকে নকশালরাও একপায়ে খাড়া? এখানেই শুরু সমস্যার। এই মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয়? সাধারণ স্কুলের পাঠক্রম ছাড়া এতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আরবি ভাষা, ইসলাম পরিচয়, কোরান, হাদিস, আকায়িদ, ফিকাহ, ফারায়েজ, মুসলমান মনীষীদের কথা ইত্যাদি। এসব তারা পড়বে দশ বছর ধরে, একেবারে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত।১৬ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাদ্রাসা বোর্ডের ওয়েবসাইটে পাঠ্যক্রমের এই ইসলামি বিষয়গুলি দেওয়া নেই, এ এক ধরণের ভয়ানক কমুনিস্ট ভন্ডামী ও মিথ্যাচার। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যই একজনকে ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে শিক্ষিত করে পুরোপুরি মুসলমান তৈরী করা। সারা বিশ্বের ও প্রতিবেশী মুসলমান দেশগুলির উদাহরণ জানার পর এই মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে আমরা কি গণতন্ত্র, পরধর্মসহিষ্ণুতা, আশা করতে পারি? না, পারি না। বামপন্থী সরকারের মূলতঃ উচ্চবর্ণের নেতারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইংরাজি শিখিয়ে দরিদ্র জনতাকে ইংরাজি ভুলিয়ে সমাজে যেমন দুটি স্তর তৈরী করছে – তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষা আরবি-জানা ও না-জানা দুধরণের বাঙালি তৈরি করছে। অথচ একজন বাঙলি মুসলমানের আরবি জানার কোন দরকার নেই, কারণ কোরান হাদিস সবই বাংলায় পাওয়া যায়।
এই ভয়াবহ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারণ ঘটেছে কলকাতায় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে যেখানে মাদ্রাসার মতন আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসলামি রীতি মেনে ছাত্রীদের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদেরও বোরখা পরার ফতোয়া জারী করেছে মাদ্রাসা ছাত্র সংগঠন। মুসলিম শিক্ষিকা শিরিন মিদ্যা তা মানতে অস্বীকার করায় তাঁকে ক্লাস নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এই সংবাদ প্রকাশের পরও আজ পর্যন্ত কোন নারী সংগঠন, প্রধান ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, রোজ টিভি-সংবাদপত্র আলো করা বুদ্ধিজীবি/বিদ্বজ্জন কোন আন্দোলন তো দূরের কথা –- এর প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নি। মাদ্রাসা শিক্ষিত এই সংখ্যালঘু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা।
নেতৃত্ব
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের এখনও কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল নেই। জনসংখ্যায় কেরালার মতন মুসলমানদের অনুপাত হলেও দেশভাগ, মুসলিম মধ্যবিত্তের অনুপস্থিতি ও ধনী বাঙলি মুসলমান গষ্ঠীর অভাবে এখানে মুসলিম লীগের মতন কোন দলের প্রভাবশালী উপস্থিতি এখনও নেই। এই অভাবটা মুসলমান ধর্মীয় নেতৃত্ব অবস্থা মতন কংগ্রেস ও সিপিআইএমের মধ্য দিয়ে মিটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কংগ্রেস ও সিপিআইএম (সব কমুনিস্টদেরও ধরা যেতে পারে) মুসলমান ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরোধিতায় কোন রকম সমাজ সংস্কারের চেষ্টাটুকুও করে নি। এর বড় কারণ অবশ্য ভোট। ফলে ৩২ বছরের কমুনিস্ট রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজ তার নিজস্ব ধর্মীয় আবহেই রয়েছে। পরিবর্তনের হাওয়ায় বঞ্চিত মুসলমান সমাজ এখন সিপিইএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে আর তার নেতৃত্ব দিচ্ছে কয়েকজন ইমাম। কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বা ফুরফুরা শরীফের ইমাম এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ইসলামি মুখ। এই ইমামরাই যখন তসলিমা নাসরিনের সব রকমের বেআইনী ফতোয়া জারী করেছিলেন তখন সিপিআইএম ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা তাঁদের নীরব সমর্থন করেছেন। তসলিমা সংক্রান্ত মামলা যখন কলকাতা উচ্চ আদালতে চলতো তখন একদল মাদ্রাসা ছাত্র আরবি পোষাক পড়ে বিক্ষোভ দেখাত। এই মুসলিম শক্তি তসলিমা নাসরিনকে মেদিনীপুরে কবিতা পাঠ করতে দেয় নি, শিলিগুড়িতে বইমেলা উদ্বোধন করতে দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গের কবিকুল, বুদ্ধিজীবি (তখনও বিদ্বজ্জনেদের জন্ম হয় নি), নারী সংগঠনেরা মজা দেখেছেন। মনে রাখতে হবে আজকের পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের ঝড় প্রথম তোলেন মুসলিম ধর্মীয় দল জামাতে উলেমা হিন্দের জনাব সুদ্দিকুল্লা। সুঙ্গুরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ও মমতা দেবীর ২৬ দিনের অনশনের পরও কোন অগ্রগতি হয় নি। ২৯ শে ডিসেম্বর ২০০৬-এ ২৫ দিন পর যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে অনশন বন্ধ করেন তখনও পরিবর্তনের কথা শোনা যেত না। অনশন শেষের ৫ দিন পরে ৩ জানুয়ারি ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে জমি জরীপ করবার সরকারি দলের উপর আক্রমণ চালায় জামাতে উলেমা হিন্দের কর্মীরা। পুলিশের জীপে আগুন ধরানো হয়, রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। এই প্রথম জমি রক্ষার জন্য হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সিদ্দিকুল্লা। এই শুরু ঘুরে দাঁড়ানো, এতে পুলিশ কর্মী খুন হন, দলেদলে সিপিএম সমর্থকরা ঘরছাড়া হন। পরে এই আন্দোলন তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে চলে যায় যদিও এজন্য সিদ্দিকুল্লা সাহেব তাঁর দল নিয়ে এই আন্দোলনে পৃথক হয়ে যান। সবশেষে একদা কংগ্রেস বর্তমানে তৃণমূল নেতা ইদ্রিস আলির নেতৃত্বে ২১ নভেম্বর ২০০৭ সালে তসলিমা বিতাড়নের দাবীতে এই মুসলিম জনতার সারাদিন ধরে কলকাতায় তান্ডব সব রাজনৈতিক দল নীরবে সমর্থন করেছে ও এই মৌলবাদী দাবী মেনে সিপিআইএম তাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহিষ্কার করেছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি মৌলবাদী সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত, মাদ্রাসা শিক্ষা তাকে আরো দিনদিন জোরদার করবে। কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন একটি সাম্প্রদায়িক কেন্দ্র স্থাপনের পর কেরালার মতন একটি মুসলিম দল তৈরি হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের গতিপথ মধ্যপ্রাচ্যের পথেই। পরিবর্তনের পর এর আসল মেজাজ টের পাওয়া যাবে।
মুসলমান জনসংখ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব
১৯৪৭ সালে অ–মুসলিমপ্রধান রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরী হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। পশ্চিমবঙ্গ আইনসভার সমস্ত অ–মুসলিম সদস্যরা, এমনকি কমুনিষ্টরাও ভাঙাচোরা পশ্চিমবঙ্গের স্বপক্ষেই ছিলেন। অমুসলিমপ্রধান অঞ্চলের সদস্যরা ৫৮-২১ ভোটে বাংলাভাগের পক্ষে ও পাকিস্তানে যোগদানের বিপক্ষে ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠন সুনিশ্চিত করেন।১৭ কমিউনিষ্ট সদস্যদের একজন ছিলেন শ্রী জ্যোতি বসু। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের একটি প্রধান সর্ত অ–মুসলিম জনসংখ্যার প্রাধান্য। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ এই দশ বছর বাংলার মুসলমান গরিষ্ঠ জোট সরকারের শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও তিরিশ বছরে একের পর এক দাঙ্গা ও নোয়াখালীর বিভীষিকাময় গণহত্যা বাঙালী হিন্দুকে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহী করে দেয়।১৮ মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গ কোন হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অ–মুসলিমপ্রধান রাজ্য হতে চায় নি, চেয়েছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশের অংশ হতে। এই চাওয়াটি যে যথেষ্ট সঙ্গত হয়েছিল তা আমাদের প্রতিবেশী ও বিশ্বের মুসলমান প্রধান দেশগুলির উদাহরণ দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে আলোচনা একেবারেই নিষিদ্ধ। এর ফলে গত ষাট বছরে, বিশেষতঃ গত ত্রিশ বছরে যে পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় জন-মানচিত্রটি দ্রুত বদলে গেছে ও বদলাচ্ছে তা নিয়ে কোন আলোচনা একাডেমিক মহলেও প্রায় হয় না। (এ নিয়ে বিশদ আলোচনা দেখুন – অনুপ্রবেশ, অস্বীকৃত উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত অস্তিত্ব – মোহিত রায়, অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০০৯)।১৯ পূর্ব পাকিস্তান / বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী ভারতে (পশ্চিমবঙ্গে সিংহভাগ) এলেও পাটিগণিতের হিসেব উল্টে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত বেড়ে চলেছে। একবার হিসেবটা দেখে নেওয়া যাক।
পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় জনসংখ্যা শতাংশে (%)
১৯৫১ ১৯৬১ ১৯৭১ ১৯৮১ ১৯৯১ ২০০১
হিন্দু
মুসলমান৭৮.৪৫
১৯.৮৫৭৮.৮০
২০.০০৭৮.১১
২০.৪৬৭৬.৯৬
২১.৫১৭৪.৭২
২৩.৬১৭২.৪৭
২৫.২৫
এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের জনমানচিত্রের ভবিষ্যৎ কি? কোন বক্তব্যে না গিয়ে সোজা অংকে চলে যাওয়া যাক। হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাসের বর্তমান হার বজায় থাকলে রেখ-চিত্রের মাধ্যমে আগামী দিনের সম্ভাব্য জনসংখ্যা পরিস্থিতির তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এই রেখচিত্র দেখাচ্ছে যে ২০৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যার ৫০%-এর কম হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জনসংখ্যা
সাল জনসংখ্যার %
১৯৭১ ৭৮.১১%
১৯৮১ ৭৬.৯৬%
১৯৯১ ৭৪.৭২%
২০০১ ৭২.৪৭%
পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাব্য হিন্দু জনসংখ্যা
সাল জনসংখ্যার %
২০১১ ৬৯.২৮
২০২১ ৬৫.৬৬
২০৫১ ৫১.৪৪
২০৫৩ ৪৯.৭৪
art
ঘটনাটি অবশ্য ২০৫৩-র অনেক আগেই ঘটবে কারণ ২০০১-এ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা যখন ২৫.২%, তখন তাঁদের শিশুদের (০-৬ বছর) সংখ্যা ৩৩.১৭%! ফলে নতুন প্রজন্মে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনামূলক হার আরো বেড়ে যাবে। এই হল আগামীদিনের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের চিত্র।
মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি রাজ্যে শুধু মুসলিম ভোটারই বৃদ্ধি করেনি, এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পুরস্কার হিসেবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নির্বাচনী কেন্দ্রেও বেড়ে গেছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে নতুন করে নির্বাচনী এলাকা ঠিক হওয়ার পর, কলকাতায় বিধানসভা কেন্দ্র কমে ২১ থেকে হয়েছে ১১। হিন্দু-অধ্যুষিত পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কমেছে দুটি করে কেন্দ্র, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম ও হুগলীতে একটি করে। আর বেড়েছে সীমান্তের মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে ৩টি, উত্তর দিনাজপুর ও নদীয়ায় ২টি করে আর মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুরে ১টি করে। খুব পরিষ্কার চিত্র – সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নির্বাচনী কেন্দ্র বেড়ে গেছে।
মুসলমান-প্রধান পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গ মুসলমান-প্রধান হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বেরই কোন প্রয়োজন থাকে না। যেমন কমুনিস্ট শাসন উঠে গেলে পূর্ব জার্মানির অস্তিত্বের আর প্রয়োজন থাকেনি বা কমুনিস্ট শাসন উঠে গেলে দুই কোরিয়া এক হয়ে যাবে একদিনেই। মুসলিম-প্রধান রাজ্য হলে কি হয় তার কিছু দেশীয় নিদর্শন আমাদের হাতের কাছেই আছে। মুসলমান-প্রধান পাকিস্তান থেকে প্রায় সব হিন্দুই বিতাড়িত। মুসলমান-প্রধান পূর্ব পাকিস্তান / বাংলাদেশ হিন্দু জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতে মুসলমান-প্রধান কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সব হিন্দু বিতাড়িত।
এ প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে-যাওয়া তফসিলি সমাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার অভিজ্ঞতা দেখা যাক। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন বাংলার তফসিলি জাতিদের প্রধান নেতা, যিনি তফসিলি জাতি ও মুসলমান ঐক্যে বিশ্বাসী ও প্রচারক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান গঠনের পক্ষে ছিলেন ও তফসিলি সমাজকে পাকিস্তানেই থাকতে বলেছিলেন। দিল্লিতে ৫ নভেম্বর ১৯৪৬এ এক জনসভায় যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন ‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত জীবন যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোন জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সহিত বাস করিতে তফসিলি জাতি বেশী পছন্দ করে’।২০ দেশভাগের পর তাঁকে সসম্মানে পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় স্থান দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের পাকিস্তানে হিন্দুবিরোধী (তফসিলি-সহ) দাঙ্গার পর মুসলিম লিগের কাছের মানুষ এই মন্ত্রীমশাইকে তিন বছরের মধ্যেই কল্পিত স্বর্গরাজ্য ছেড়ে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ হিন্দুস্থানে পালাতে হয় এবং হিন্দুস্থানে থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। ১৯৫০ সালের ৮ই অক্টোবর, পাকিস্তানের লিয়াকত আলি খান সরকারের আইন ও শ্রম মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগ পত্রে যোগেনবাবু লেখেন –
‘আমার পক্ষে এটা বলা অন্যায্য নয় যে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিজভূমি পরবাসী’ করা হয়েছে, আর এটাই এখন হিন্দুদের কাছে পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করাটাই এদের একমাত্র অপরাধ। …….সুদীর্ঘ ও উদ্বেগময় সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত আমাকে একথাই বলতে হচ্ছে যে পাকিস্তান আর হিন্দুদের বাসযোগ্য নয়। তাঁদের ভবিষ্যতে প্রাণনাশ ও ধর্মান্তরকরণের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হিন্দু ও রাজনৈতিক সচেতন তফসিলি জাতির লোকেরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সমস্ত হিন্দুরা এই অভিশপ্ত দেশে অর্থাৎ পাকিস্তানে থেকে যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের মুসলমানে পরিণত করা হবে বা নিশ্চিহ্ন করা হবে’।২১
সাম্প্রতিক কালে উদ্বাস্তু মতুয়া সমাজের কথা পত্র পত্রিকায় আলোচিত হচ্ছে। তফসিলি সমাজের একটি বড় জনগোষ্ঠী এই ধর্মীয় সংঘের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের শ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত প্রথমরঞ্জন ঠাকুরকে (এঁনার স্ত্রী এখন বড়মা বলে পরিচিত) পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়ে বনগাঁর কাছে বর্তমান ঠাকুরনগরে বসবাস শুরু করেন। দেশ ছাড়ার আগে তিনি শেষ জনসভা করেন নড়াইলের জমিদারবাড়ীর প্রাঙ্গণে। সেখানে মতুয়া ভক্তবৃন্দদের বলেন – “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করায় দেশ খন্ডিত হবার পথে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে আবার আমাদের দাঙ্গার সম্মুখীন হতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন আমাদের কী করনীয়? নিঃসন্দেহে আমরা বিশাল হিন্দু সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই সংকটময় মুহূর্ত তফসিলিদের নিজেদের স্বার্থে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু সমাজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মূল কান্ড থেকে কোন শাখাকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে সেটি অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। স্বধর্মের কোটি কোটি হিন্দুর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে লীগের বন্ধুত্ব অচিরেই তফসিলি জাতির বিপদ ডেকে আনবে। আপাত উন্নতির মোহে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মিঃ জিন্নাহর মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন পরিণামে অপরিসীম ক্ষতি ডেকে আনবে।” ……
“কিছুদিনের মধ্যে দেশভাগ হয়ে যাবে। দেশভাগের ফলে আমাদের জন্মভূমি যদি পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে, আমরা যেন সকলে এক থাকি। ফেডারেশন ও লীগের কথায় না ভুলি। ভারতভূমিতে আমরা যেন সকলে এক সাথে চলে যেতে পারি। আমর অনুপস্থিতিতে আপনারা যেন সংঘবদ্ধ থাকেন এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করেন যা আমি আগেই আপনাদের বলেছি”।২২
যে সমাজের সর্বোচ্চ নেতাকে মুসলিমদের অত্যাচারের জন্য নিজের বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয় ও যিনি পরিষ্কারভাবে তার ভক্তদের প্রতি তার বক্তব্য রেখে গেছেন – আজ সেই মতুয়া সমাজের কিছু নেতা বাংলাদেশের ইসলামি অত্যাচার নিয়ে ন্যূনতম কথাও বলেন না, বরং সভা করে দলিত-মুসলিম ঐক্যের প্রচার চালান। আজকে যারা মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের উপর বামফ্রন্টের অত্যাচারের জন্য চেঁচামিচি করছেন তারা ভুলেও বলেন না যে এঁরা আদৌ উদ্বাস্তু কেন হলেন।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ধর্মীয় শাসনের বাঁধন বেশ প্রবল। মুর্শিদাবাদে শরিয়তী আদালত খুবই চালু। এখানে ইসলামি মেজাজ এতই প্রবল যে ২০০৮-এর জুলাই মাসে একটি শরিয়তী আদালত একটি হিন্দু যুবককে মৃত্যুদন্ড দেয় ও তার মাথা কেটে তা কার্যকরী করে। এই যুবকের সাথে স্থানীয় একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে মুম্বাইতে পরিচয় হয়। মুসলিম মেয়েটি মুম্বাইতে কাজে গিয়েছিল, তারা বিয়ে করে ও তাদের একটি পুত্রসন্তান আছে। যখন এই দম্পতি মেয়েটির গ্রামে বেড়াতে আসে তখন এই ছেলেটির ধর্মপরিচয় জেনে গ্রামের শরিয়তী আদালত তাকে হত্যা করে।২৩ এটা কোনও সৌদি আরব বা পাকিস্তানের ঘটনা নয়, প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা।
দেগঙ্গা – নীরবতাই পথ?
জনসংখ্যা, মাদ্রাসা, বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১ কোটি নাগরিকত্বহীন উদ্বাস্তু, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শিরিন মিদ্যা – এসব নিয়ে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব ধরণের মিডিয়া, পত্রপত্রিকা, সদা-বিপ্লবী লিটল ম্যাগাজিনের এমনকি ভারত সেবাশ্রম, রামকৃষ্ণ মিশন, লোকনাথ আশ্রমসহ তাবৎ হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলিও। শুধু নীরবতা নয়, এ নিয়ে নীরবতা ভাঙার চেষ্টাও অপরাধ। ফলে সাধারণ মানুষ এসব নিয়ে একেবারেই কিছু জানতে পারেন না। ফলে কখনও সাধারণ আড্ডায় এসব প্রসঙ্গ উঠলে নিত্য কালিঘাট যাওয়া ভক্ত বন্ধুও মনে করেন যে এসব দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা হিন্দুত্ববাদী অতিরঞ্জিত প্রচার। একেবারে একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলা যাক।
কলকাতা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে দেগঙ্গা, বারাসত থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার। ৬,৭,৮ সেপ্টেম্বর তিন দিন ধরে দফায় দফায় দাঙ্গা চলে দেগঙ্গা অঞ্চলে। ৮ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে ‘পুড়ল ৫০টি বাড়ি ও দোকান। …৩০০টি দোকান ও বাড়িতে চলল ভাঙচুর’।২৪ সেনাও নামান হল। ৮ সেপ্টেম্বর সেনা টহলের মধ্যে লুঠ চলে।,২৫, ২৬ এরপর থেকে চলল নীরবতা। কারা আক্রান্ত হলেন? কাদের বাড়ি-দোকান পুড়ল? না কোন বাংলা পত্রিকাতেই এনিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না। এতবড় ঘটনা, মিলিটারি নামলো, কলকাতার এত কাছে – না – কোন বিদ্বজ্জন / বুদ্ধিজীবি, আগুনঝরানো মানবাধিকার নেতা / এনজিও একটি শব্দও করেন নি। এমনকি টিভি-মিডিয়া যারা খবরের অভাবে প্রায় বাড়ির ভাইয়ে ভাইয়ে পারিবারিক ঝগড়ারও লাইভ কভারেজ করে তারাও কলকাতার এত কাছের সার সার ভাঙা বাড়ি পোড়া দোকানের বা আক্রান্তদের কোন ছবিই দেখাতে সাহস করলেন না। প্রায় একমাস পর ৫ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে যে ক্ষতিগ্রস্ত ১৬৭টি পরিবারের হাতে ১ কোটি টাকার অর্থ সাহায্য তুলে দিল সরকার।২৭ ১ কোটি টাকা! কারা পেলেন এত টাকা? না, তাও কাগজ জানায় নি। কেন এত নীরবতা? কারণ ক্ষতিগ্রস্তরা সবাই হিন্দু। আক্রমণকারীরা সবাই মুসলমান। দাঙ্গা নয়, পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতন দেগঙ্গায় হয়েছে একতরফা মুসলমানদের আক্রমণ। দেগঙ্গায় হিন্দুসমাজের মন্দির, মুর্তি, দোকানঘর, বাসগৃহের ওপর মুসলমান জনতার এসব আক্রমণের খবর কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার বাইরে থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ইংরাজি সংবাদপত্রে (যাদের দুএকটির কলকাতা সংস্করণ রয়েছে)। এমনকি দেগঙ্গার খবর এখন বিশ্বজুড়ে প্রচারিত কারণ ইন্টারনেটের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য অয়াইকিপিডিয়াতেও দেগঙ্গার দাঙ্গা নিয়ে আলাদা খবর রয়েছে।২৮ এরপর ঘটল আরো বড় ঘটনা, দেগঙ্গা অঞ্চলের ১৮টি দুর্গাপূজা কমিটি এবার পূজা করল না। পূজা হুজুকের পশ্চিমবঙ্গে কোথাও পূজা হচ্ছে না (বাংলাদেশে যা আকছার হয়) এতবড় একটা খবর কোন বাংলা কাগজ তা ছাপাল না, ছাপাল একমাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।২৯ (অন্য একটি খবর অনুযায়ী সংখ্যাটি ৩১)। ১৪ অক্টোবর খোদ কলকাতায় মেট্রো চ্যানেলে দেগঙ্গার পূজা কমিটিরা কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করলেন, তাও কোন কাগজে এল না। অর্থৎ, এখন পশ্চিমবাংলার খবরের জন্য নির্ভর করতে হবে পশ্চিমবাংলার বাইরের মিডিয়ার ওপর, একসময় যেমন সারা উপমহাদেশ নির্ভর করত ‘বিবিসি’র ওপর। ইসলামি পশ্চিমবঙ্গ আর সীমান্ত এলাকার গপ্পো নয়, খোদ কলকাতায় ২১ নভেম্বর ২০০৭-এ তসলিমা বিতাড়নের পর আবার কলকাতার কাছেই দেগঙ্গা জানিয়ে দিল কারা সংখ্যালঘু ও সংখ্যালঘুরা কিভাবে থাকবেন। মনে রাখতে হবে ১৯৯১-র জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী দেগঙ্গা ব্লকে ৬৭.৫% মুসলমান, ২০১০-এ সংখ্যাটা যে আরো বেশি তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
নীরবতা আর স্বর্ণালী নয়, নীরবতা মানে আগামী দিনের বিভীষিকাকে মুখ বুজে আমন্ত্রণ জানানো।
কি করবেন?
সুতরাং মুসলিম দুনিয়াকে অনুসরণ করে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ হয়ে উঠেছে আগামী দিনের পশ্চিমবঙ্গের চালিকা শক্তি। এখন পর্যন্ত সে শক্তির আদর্শগত উপাদান মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সংস্কার। স্রেফ সংখ্যাগত ও পেশী শক্তির জোরেই এই শক্তি এই পশ্চিমবঙ্গেরও দখল নিতে পারে অদূরভবিষ্যতে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পাঠক ঠিক করুন কি করবেন।
গিয়াসুদ্দিনের পক্ষে প্রকাশ্য সমর্থনে যাবেন না তাঁর বিরধীদের পক্ষেই থাকবেন?
শাহরিয়ার কবিরদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের কথা সবাইকে জানাবেন না নীরবতাই বজায় রাখবেন?
মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের জন্য আন্দোলন করবেন না বুদ্ধ-মমতার সঙ্গে আরো মাদ্রাসার দাবীতে সোচ্চার হবেন?
শিরিন মিদ্যার পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের বোরখার অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবেন না আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ধর্মীয় মৌলবাদের আখড়া হতে দেবেন?
তসলিমা নাসরিনকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনবার দাবী করবেন না পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-সাহিত্য সেন্সরের ভার ইমামদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সাহিত্যচর্চায় মন দেবেন?
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ বজার রাখবার চাবিকাঠিটি এখনও আপনাদের কাছেই আছে, তা কি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন?
________________________
১ B.R. Ambedkar Pakistan or Partition of India, p 116, Babashaeb Ambedkar Writings and Speeches Vol8, Educaion Department, Government of Maharashtra, 1990.
২ ঐ পৃঃ 118
৩ http://en.wikipedia.org/wiki/Demographics of Iran
৪ http://en.wikipedia.org/wiki/Egypt
৫ http://en.wikipedia.org/wiki/Malaysia
৬ http.//www.indonesiamatters.com/326/religious-freedom-report/
৭ http.//en.wikipedia.org/wiki/Maldives
৮ Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh- Living with Vested Property, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008.
৯ Bangladesh Hindu Buddhist Christian Unity Council – Communal Discrimination in Bangladesh: Facts and Documents, pp 431-435, Dhaka 1993.
১০ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি – ১৫০০ দিনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিবরণ – শ্বেত পত্র, সম্পাদনা – শাহরিয়র কবির, ৩ খন্ড, ঢাকা, ২০০৫
১১ Abdul Barkat et al – Deprivation of Hindu Munority in Bangladesh – Living with Vested Property, pp 66-68, Pathak Samabesh, Dhaka, 2008.
১২ Mohammad Rafi, Can We Get Along, pp 201, Panjere Publications, Dhaka 2005
১৩ Wikepedia থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলি পাওয়া যাবে।
১৪ প শ্চিম বঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা আজ দেশের গর্ব – তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আগস্ট, ২০১০।
১৫ গিয়াসুদ্দিন – মাদ্রাসা শিক্ষার পশ্চাদ্গামিতা নয়, চাই মূলধারার আধুনিক উচ্চশিক্ষা – হিযাবঃ নারী দাসত্বের প্রতীক, পৃ-১২৭, – মার্চ, ২০১০, কলকাতা।
১৬ মাদ্রাসা দর্পণ, ষষ্ঠ বর্ষ, পাঠ্যসূচী সংখ্যা – পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ, আগস্ট ২০০৭।
১৭ (http://banglapedia.search.com.bd/HT/P_0101.htm)
১৮ Hiranmoy Karlekar, Bangladesh – The Next Afghanisthan, pp 38, Sage Publications 2005
১৯ অনুপ্রবেশ, অস্বীকৃত উদ্বাস্তু ও পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত অস্তিত্ব – মোহিত রায়, অনুষ্টুপ, শারদীয় ২০০৯
২০ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ – জগদীশ মণ্ডল, ১ম খন্ড, পৃ ২২১ (উদ্ধৃত – ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, পৃ ১৫, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩)
২১ ভারত বিভাজন যোগেন্দ্রনাথ ও আম্বেদকর – শ্রীবিপদভঞ্জন বিশ্বাস, পৃ ১২৭-৩২, বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, কলকাতা, ২০০৩। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের মূল ইংরাজীতে পদত্যাগপত্র ও তার বঙ্গানুবাদ পাওয়া যাবে শ্রীদেবজ্যোতি রায়ের লেখা ‘মুসলিম রাজনীতি ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ’ বইতে। প্রাপ্তিস্থান – বিবেকানন্দ সাহিত্য কেন্দ্র, ৬ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩
২২ মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ – সদানন্দ বিশ্বাস, পৃঃ ১৬০-১৬১, দীপালি বুক হাউস, কলকাতা ২০০৪
২৩ The Telegraph – Sunday, August 3, 2008
২৪ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০
২৫ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১০
২৬ Times of India, Kolkata, 9 September, 2010
২৭ আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ অক্টবর ২০১০
২৮ http://en.wikipedia.org/wiki/2010_Deganga_riots
২৯ Indian Express, 10 October, 2010
https://paschimbangerjanya.wordpress.com/articles/minority_and_secularism/?blogsub=confirming#subscribe-blog

Monday 17 July 2017

৮২ এ সোনালি কাবিনের নায়ক।

FB_IMG_1500338325778
৮২ এ সোনালি কাবিনের নায়ক।
আবু সাঈদ হাননান
১১ জুলাই কবি আল মাহমুদের জন্মদিন। এই শালপ্রাংশু ব্যক্তি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে ও প্রায় প্রত্যেক সৃষ্টিশীল কন্দরে অত্যুজ্জ্বোল ছাপ রেখেছেন স্বীয় প্রতিভায়। ছয় দশক জুড়ে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রয়াসে সমৃদ্ব হয়েছে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। সৃষ্টির প্রাণপ্রাচুর্যে স্বদেশ, স্বকীয়তায় হৃদয়ের গহীন অনুভবের বর্ণনায় এমন সচল ও একক হতে কারো ছায়া অনুভুত হয়না আল মাহমুদের মত। তাঁর অলোকসামান্য সৃজন প্রবাহে ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের শিরা উপশিরা।
বাংলা ভেজা মাটির গন্ধ আর সোঁদা মেটেল আবহ তার কবিতা ও গদ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। বাংলদেশের জলজ মাটির গন্ধ গায়ে মেখে আল মাহমুদ লিখে গেছেন মানবিকতার জয়কথা।
“ দ্যাখো জয়নুলের ছবির মত ঘরবাড়ি,নারী
উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ী ;
গতর উদোম করে হাতে লেঙ্গা মাটির চত্বরে
লাঞ্চিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে অনাদরে”
(প্রত্যাবর্তন: কালের কলস )
আল মাহমুদের এই চিত্রকল্পে পুরো বাংলাদেশ বাঙময় , এখানে জয়নুলের ছবি, উঠোনে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি, হাতে লেখা মাটির চত্বর সবই বাংলার নদী আর ধানের মতই বাস্তব । এখানে বাস্তবের বাস্তুভিটার অনাদর আর লাঞ্চনার ইতিহাসও উজ্জল।
আল মাহমুদের অনুভবের বিভা শতরঙ্গা। লোকজ অনুভবের নিবিড়তা তাঁর কাব্যসমুহের অর্থমাত্রায় ব্যঞ্জনার নানামাত্রিক গভীরতা দান করেছে। তার কাব্যিক অবিজ্ঞান অভ্রংলেহী। তাঁর চিত্তসন্নত , ভাবনা সুউন্নত এবং সম্ভ্রম জাগানিয়া । তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ সৃষ্টি-সুষমায়-ভাবনায় লাবন্যে ,ছন্দ-সৌন্দর্যে ঈর্ষণীয় ।
আল মাহমুদের সমসাময়িক যাঁরা তাঁর বিরূদ্ধে অবস্থান করেন তারা মূলত রাজনৈতিক হিংসাকে লালন করেন । শুধুমাত্র রাজনীতির ক্ষুদ্র মানসিকতার দরূন একজন কবির অবদানকে খন্ডিত কিংবা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা নি:সন্দেহে রাজনৈতিক আচরণ।
একথাও স্বীকার্য যে- রক্তে মাংসের আল মাহমুদ ক্ষুধা,কাম,লোভ,হিংসা আর রাজনৈতিক আদর্শ লালনে কাতর একজন মানুষ । তারপরেও এ ময়ুখ কবির দেবদারুর মত সুকঠিন ভিত আর সুউচ্চ প্রতিভা মানবীয় সকল চাওয়া পাওয়ার সংকীর্ণতাকে মুছে দেয় আপন মহিমায়।
আল মাহমুদকে যারা এডিয়ে যাবার চেষ্টা করেন, তাদের একটি বিষয় জানা থাকা দরকার- বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় প্রথমবার আল মাহমুদের একটি কবিতা ছাপালেন, এরপর বুদ্ধদেবের কাছে আসতে থাকে বক্র আর ঋজু বানের লেখা হরেক রকম চিঠি । বুদ্ধদেব তার পরবর্তী সংখ্যা কবিতা পত্রিকা শুধুমাত্র আল মাহমুদের কবিতা দিয়ে প্রকাশ করলেন । নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে আল মাহমুদ জানান দিলেন তার মহাকবি হওয়ার অমিত সম্ভাবনা, আল মাহমুদ এ রকম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছেন বহু বাঁকে । কবি চট্রগ্রামে থাকা অবস্থায় একবার চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এলেন। দাওয়াতটি পেয়েছিলেন প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের মাধ্যমে । অনুষ্ঠানে কবির জন্য রক্ষিত চেয়ারটি দখল করে বসে রইলেন বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক। অধ্যাপকের দম্ভ হল কোথাকার কোন আল মাহমুদ, আন্ডার মেট্টিক, তার জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পাশের চেয়ার ? বেছারা আল মাহমুদ নিরুপায় হয়ে অন্য একটি চেয়ারে বসলেন ।
কিন্তু বক্তৃতাপর্বে আল মাহমুদ যে বক্তৃতা রাখলেন তাতে ঐ অধ্যাপক লাজ্জিত হয়ে আল মাহমুদের কাছে ক্ষমা চাইলেন ।
আল মাহমুদের সোনালী কাবিন সত্যিকার অর্থে বাংলা সাহিত্যের অমুল্য সম্পদ। সোনালী কাবিনের সনেটগুলো অতীত মহিমায় গঠিত, বর্তমান ক্রুদ্ধ ও ভবিষ্যতের সংকল্পে উদ্দীপ্ত। এ প্রসঙ্গে জ্ঞান তাপস প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন সোনালী কাবিনের কবিতা হচ্ছে কবি উপমা রুপকের অভিচর্চার যে নিদর্শন রেখেছেন আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জল।
আল মাহমুদ মুলত মাথার চুল পেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নির্মেদ কবি
আল মাহমুদের কবিতা ত্রিকাল বিহারী । অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত-এক কথায় লোক-লোকান্তর কবির কাব্যে উম্মোখ হয়েছে। যে কারণে দশটি কাব্য গ্রন্থের বিচ্ছিন্ন আলোচনায় ও তাঁর কবিতার বিজয়ের গান ধ্বনিত । বিজ্ঞ পাঠকের মন্তব্য; “কলিকাতার কাব্য পাঠকেরা কিন্তু এখানো আপনাকেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকার করে। কবিতা লেখার ব্যাপারে আপনা সহৃদয় আলস্য । আরো কবিতা লিখুন । না লিখলে আমরা এতিম। ( দাউদ হাইদার ২৯-০৪-৮৩ কলকাতা থেকে )। সোনালী কাবিন সম্পর্কে অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী বলেন – আমি আল মাহমুদের সোনালী কাবিনটা বারবার পড়ি । (প্রাক্তন অধ্যাপক বিশ্ব ভারতী ) । “আল মাহমুদের সোনালী কাবিনটা খুব বিশিষ্ট বই বলে মনে করি । উভয় বঙ্গের কাব্যকীতির্, সব কবিদের কাব্যকীর্তি পরীক্ষা করলে আল মাহমুদকে একজন শ্রেষ্ঠকবি আখ্যা দিতে হয়।” (সৈয়দ আলী আহসান ) । বাংলাদেশের অসংখ্য পাঠক আল মাহমুদের কবিতা পড়ে তৃপ্তহন এবং আল মাহমুদ জনপ্রিয়তার জন্য কিছুমাত্র চিন্তিত না হয়েও জনপ্রিয় হয়েছেন (ড: আনিসুজ্জামান ) । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরাত্তর কবিতার দ্রাঘিমা সনাক্ত করতে হলে যে সকল বিরল গ্রন্থেও কাছে বারবার ফিরে যেতে হবে লোক লোকান্তর তার অন্যতম (শহীদ কাদরী)। “তিরিশি কবিদেও মধ্যে শ্রেষ্ঠ তথা আধুনিক বাংলা কবিতার জনকপরুষ কবি জীবনানন্দ দাশের পরে মৌলিকতার ও সাফল্যের দিক খেকে আল মাহমদের কীর্তি সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয় । ( উৎপল ভট্টচার্য -সম্পাদক কবিতীর্থ, কলকাতা ) । “মিথ্যাবাদী রাখাল” কাব্য গ্রন্থে বেজে উঠেছে সেই দুর্মর কবিকন্ঠ-পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতায় যা আমরা খুযে পাই। সম্ভবত এই কাব্যগ্রন্থে তিনি অতিক্রম করেছেন তাঁর সম-সাময়ি দের। (আবিদ আজাদ ব্যাক প্রচ্ছদ- মিথ্যাবাদী রাখাল )
আল মাহমুদ শাসন-শোষণ-ত্রাসনে নিষ্পিষ্ট স্বদেশের কণ্টকাকীর্ণ পথচলায় নিজেকে জড়িয়েছেন শুধুমাত্র প্রকৃত কবিআত্বার অন্তর্গত তাড়নায়। এরপরেও যখন শুধুমাত্র বিশ্বকে ভিত্তি করে তাঁর কবিতা আর কবি সত্ত্বার অবমূল্যায়ন দেখি তখন তাকে সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া আর কী বলতে পারি।
কবি’র ৮২ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা তর্পন
আল মাহমুদ আপনি শতবর্ষী হউন। আপনার কর্নিয়াহীন চোখ, আপনার উল্টানো চোখ আামাদের অসঙ্গিতি দেখুক আর আপনার হাত তা লিখে দিক অবলীলায়।

আমার দৃষ্টিতে আল মাহমুদ

FB_IMG_1500338325778

আমার দৃষ্টিতে আল মাহমুদ
শুক্রবার ০৮ জুলাই ২০১১ | প্রিন্ট সংস্করণ । দৈনিক সংগ্রাম
ড. মাহফুজ পারভেজ : একজন কবিকে, একজন সাহিত্যিককে, এমন কি, একটি গ্রন্থকে (সৃজনশীল কিংবা মননশীল) দুই রকমভাবে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, কাব্য বা সাহিত্যগত তুল্যমূল্য স্বরূপে; এবং দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক তত্ত্ব আবিষ্কারের উপায় স্বরূপে। প্রথমোক্ত পন্থা অবলম্বন করা হলে আমরা কেবলমাত্র গ্রন্থ বা গ্রন্থকারের দেশকাল-নিরপেক্ষ কাব্য বা সাহিত্য কৃতিত্বের দোষ-গুণ বিচারে সমর্থ হই। দ্বিতীয় প্রথা অবলম্বন করা হলে আমরা তা যে নির্দিষ্ট সময়ে যে দেশে বা যেরূপ বিশ্বব্যবস্থায় রচিত, সে দেশ ও বিশ্বব্যবস্থার তৎসাময়িক অবস্থাসমূহের আলোচনা দ্বারা এবং তৎকালীন অন্যান্য সাহিত্য-কাব্যকর্মের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রচনাটি বা রচয়িতার দোষ ও গুণ, সাফল্য ও ব্যর্থতার কার্যকারণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি।

সাহিত্যতত্ত্বে কাব্যের দোষ-গুণ বিচার করাই সমালোচনা-আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক প্রথায় আলোচনা উক্ত বিচারের সহায়তাসাধন করে মাত্র। কিন্তু এই উভয় পদ্ধতির মিলিত সাহায্যেই যথার্থ সমালোচনা করা যায়। বর্তমান বাংলাদেশে এবং ব্যাপকার্থে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের নিরিখে সমকালের অন্যতম প্রধান কবি ও বহুমাত্রিক সাহিত্য-প্রতিভা আল মাহমুদকে বীক্ষণের জন্যেও প্রয়োজন একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণী কাঠামোর সাহায্য নেয়া। ২. পঞ্চাশের দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকমুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের ঢাকায় একসঙ্গে জীবন শুরু করেন কয়েকজন তরুণ---বাচ্চু (শামসুর রাহমান), হুমায়ুন (ফজল শাহাবুদ্দীন), শহীদ কাদরী। এদের সঙ্গে এসে যুক্ত হন মফস্বলের আরেকজন, আল মাহমুদ। সেই পঞ্চাশে, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-কবিতার নানা ক্ষেত্রে প্রথম যৌবনের উত্তাপে কর্মপ্রবণ ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, কায়সুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং আরও অনেকেই। বস্তুত এদের হাতেই আধুনিক বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের সাহিত্য সৃজিত হয়। কারণ, এদের অগ্রবর্তীরা, যেমন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবীব, শওকত ওসমান, আবুল হোসেনরা এসেছিলেন কলকাতার খানিকটা অভিজ্ঞতা নিয়ে।

ঢাকায় বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উত্থান ও বিকাশের ধারায় পঞ্চাশ দশকের কবি ও লেখকগণ সব দিক থেকেই স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট এবং ভিত্তি স্থাপনকারী। পঞ্চাশের কবি ও লেখকগণ শুরুটা একই সঙ্গে করলেও ক্রমেই তাদের বিশিষ্টতা ও স্বাতন্ত্রকিতা সুস্পষ্ট হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘরানায় পর্যবসিত হয়। এই পার্থক্য কেবল শৈলী বা স্টাইলে নয়; চিন্তা, চেতনা এবং বিশ্বাসেরও। আল মাহমুদের সামগ্রিক প্রবণতার মধ্যেও আলাদা একটি অভিব্যক্তি সমকালের আর সকলের চেয়ে তাঁকে পার্থক্যপূর্ণ করেছে। সোনালী কাবিন কিংবা মায়াবী পর্দা দোলে ওঠে থেকে যে আল মাহমুদের যাত্রা, সেটা বখতিয়ারের ঘোড়া, প্রহরান্তে পাশ ফেরা, কাবিলের বোন ইত্যাদি হয়ে বার বার তাঁর সম্পর্কে জানাচ্ছে যে, আমি দূরগামী। এ কারণেই ঢাকা এবং কলকাতা মিলিয়ে অখন্ড বাংলা সাহিত্যের বিবেচনায় কবিতার প্রসঙ্গ এলেই পঞ্চাশের কবিদের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় আল মাহমুদকে।

 তাঁর ‘গাঙের ঢেউ-এর মতো বলো কন্যা কবুল কবুল' লাইনটি থেকে ‘ঘুমের মধ্যে জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠি' ধরনের পংক্তিগুলো বাংলা কবিতায় মিথ হয়ে আছে। যারা তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ যেভাবে বেড়ে ওঠি পড়েছেন, তারা জানেন, কবিতা ও কাব্যচর্চার মতোই জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাতেও আল মাহমুদ একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। বোহেমিয়ান-সৃষ্টিছাড়া তারুণ্য-যৌবন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের রোমান্টিক উন্মাতালতা, গণতন্ত্র ও শুভতার সংগ্রাম এবং সর্বপরি আস্তিক-দার্শনিকতার মাধ্যমে একটি বিশ্বাসী আবহে পৌঁছার প্রয়াসে আত্মার মুক্তির অন্বেষণ আল মাহমুদের জীবন ও কবিতার অভিমুখকে একটি যৌক্তিক পথরেখায় নিয়ে এসেছে।
এই মনোদার্শনিক গতিপথ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকার কারণে তিনি গোড়া থেকেই বলতে পারেন যে, ঢাকা হবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, কবিতা ও কীর্তির কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র; বৈশ্বিক রাজধানী। এবং তাঁর কবিতায় ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের প্রকৃতি, প্রেম, সংগ্রাম, সংক্ষোভ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, জীবনবোধ সুললিত কাব্যভাষায় উচ্চারিত হয়। তাবৎ বাংলাদেশ ও এর মানবমন্ডলীকে ঘিরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যাবতীয় প্রপঞ্চকে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বিশ্বাসের নিরিখে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জারিত করে চিরায়ত বাংলার মানবকণ্ঠে কথা বলার ইতিহাসই আল মাহমুদের জীবনেতিহাস।

৩. আল মাহমুদের সাহিত্যজগত এবং কাব্যবোধ তাঁর বিশ্বাস ও মৃত্তিকার পাটাতনে দৃঢ়মূলপ্রবিষ্ট। তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা রোমান্টিক, বোহেমিয়ান চরিত্রটি নিজের বিশ্বাসনির্ভর দার্শনিকতায় বেগবান হয়ে স্বপ্ন ও কল্পনার পথে যেমন বিচরণ করে, তেমনি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথেও প্রদক্ষিণ করে। তাঁর কবিতার মূল সুর ভালোবাসা, দেহগত কিংবা আত্মাগত। ছন্দের হাত তাঁর অসাধারণ। ( পাঠক মনে করতে পারেন, আমার মায়ের সোনার নোলক...এর কথা।) তাঁর কবিতায় রয়েছে দেশজ শব্দের ছড়াছড়ি, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের ভাষাবৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ কবিতায়, সনেটে, বিষয়ভিত্তিক কবিতায় তিনি অনায়াস। ধারাবাহিক ফিচার, কলাম, প্রবন্ধেও তিনি সফল। উপন্যাস বা ছোটগল্পে তাঁর তীক্ষ্ণ মানবিকবোধ, গভীর পর্যবেক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সচেতন পারঙ্গমতা অলক্ষ্যণীয় নয়। সমগ্র আল মাহমুদকে সামনে রেখে পঞ্চাশের অন্য সবার রচনাবলিকে তুলনামূলক বিবেচনা করা হলে, তাঁর চিন্তা, বিশ্বাস, শৈলী, কাঠামো ইত্যাদির অন্তর্নিহিত পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং এ কারণে তাঁকে কেবল তুলনা করা যায় তাঁরই সঙ্গে।

ব্যক্তিসত্তা এবং লেখকসত্তায় আল মাহমুদ স্বাতন্ত্রিকতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন সব সময়ই। ছোট-খাট, সাধারণ দর্শনের অবয়বকে তিনি দ্রোহ ও সাহসের উচ্চতর জায়গায় নিয়ে গেছেন আপস ও আত্মসমর্পণ না করার ঐতিহ্যে। যা তিনি বিশ্বাস করেন, শত বিরূপতাতেও সেটা বলতে দ্বিধা করেন না তিনি। প্রবল প্রতিপক্ষকে সামনে রেখেও স্বমত প্রকাশ ও প্রচারে তিনি অকুতোভয়। ফলে এই খর্বাকায় মানুষটি পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের সামনে মহীরুহের আকার ও আয়তন অর্জন করেন। তীব্র সংগ্রাম, অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য, গন্তব্যহীনতার মধ্যে দিয়ে মধ্যবিত্তের যাপিত-জীবনের এক-একটি পর্যায় অতিক্রম করে আল মাহমুদ নিজের বিশ্বাসের তরীটিকে ভাসিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন কাঙ্ক্ষিত মোহনায়। জীবনের শেষ পর্যন্ত টেনে এনেছেন নিজের চিন্তা ও আস্থার যাবতীয় অনুসঙ্গ। এনেছেন নান্দনিক সুষমায়।

মননশীলতার স্নিগ্ধতায়। তাঁর সঙ্গে মিল বা অমিলের পরেও কেউ তাঁকে এড়িয়ে যেতে বা অবজ্ঞা করে আধুনিক বাংলা কবিতা ও সাহিত্য আলোচনা-পর্যালোচনা করতে সক্ষম হয়নি। তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র সাযুজ্য নেই, এমন পক্ষও তাঁকে মান্য করতে বাধ্য হয়েছে তাঁর বিশ্বাসজাত-প্রকাশের সততার জন্য; তাঁর কাব্যশক্তির জন্যে। ব্যক্তি ও কবি হিসেবে আল মাহমুদ সকল আলোচনা-সমালোচনার পরেও নিবিষ্ট-কর্মের নৈপূণ্যে সফলতার ঠিকানাটি খুঁজে পেয়েছেন। যা তাঁর সমকালের সহযাত্রীদের অনেকেই পাননি। কারণ, তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন না; ছিলেন নিজ বিশ্বাসে বলীয়ান।
এবং তাঁর বিশ্বাস ও বক্তব্য এমন একটি সার্বজনীনতা লাভ করেছে যে, তিনি কবি ও দার্শনিকরূপে পৌঁছে গেছেন বৃহতায়ন মানবসমাজের মর্মমূলে। মূলত তিনি মানুষের শাশ্বত বিশ্বাসকে কবিতার ভাষায় গেয়ে গেয়ে কাল-কালান্তরে জাগরুক রেখেছেন। একজন কবি যখন নিজের এবং অপরাপর ব্যক্তিগণের কথা বলতে বলতে জাতির কণ্ঠস্বরে পরিণত হন, তখন তিনি তাঁর সফলতার শীর্ষ বিন্দুটিকে স্পর্শ করার অমীয় আনন্দ উপভোগ করেন। ইতিহাসে খুব কম কবিই এমন অপার আনন্দের সন্ধান পেয়েছেন। ৪. ব্যক্তিগতভাবে পঞ্চাশের কবিগণের মধ্যে ফজল শাহাবুদ্দীন এবং আলাউদ্দিন আল আজাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ও সংশ্লেষ সবচেয়ে বেশি। ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা একটি ঘোরের মতো আত্মমগ্ন জগতকে উন্মোচিত করে। তাঁর ব্যক্তিত্ব নানা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার পরেও অনেককেই আকৃষ্ট করে। তুলনায় আলাউদ্দিন আল আজাদ মৃদুকণ্ঠী, নীরব ও নিভৃতচারী। আমাদের কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যখন জীবনের শেষ বছরগুলোতে অধ্যাপনা-গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন, তখন ঢাকার পূর্ব-যোগাযোগের নিরিখে আমি বহু বহু বার দীর্ঘ আড্ডা ও আলোচনায় লিপ্ত হয়েছি তাঁর সঙ্গে। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ লেখালেখির নানা প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় তৎকালের বাংলা বিভাগের কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী আমাদের অনুসরণ করেছে; যারা এখন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ওপর যে মূল্যায়নধর্মী গ্রন্থ ‘গতিধারা প্রকাশনী' থেকে বের হয়েছে, তাতে আমার একাধিক রচনা রয়েছে এবং তাঁর ওপর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচুর লেখারও সুযোগ ঘটেছে। পঞ্চাশের আরেক অন্যতম কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল, বলা যাবে না। মাত্র একবার তাঁর সঙ্গে আমার চাক্ষুষ দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। আইয়ুব হোসেন ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ'-এর একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানে আমরা আলোচক ছিলাম। আরও ছিলেন আহমদ শরীফ এবং বশীর আল হেলাল। বলতে দ্বিধা নেই, মানুষ হিসেবে, আচরণে ও ব্যবহারে, শামসুর রাহমান অতুলনীয় শিষ্টাচারের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ও বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়েও তাঁর সঙ্গে চমৎকার সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখা যায়, যেটা স্বমতের অনেকের সঙ্গেই, অনেক সময় রাখা সম্ভব হয় না। আল মাহমুদের সঙ্গে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক খুবই আনুষ্ঠানিক।

প্রথম তাঁকে দেখি ১৯৮৩ সালে কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে, যেখানে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একজন কর্মকর্তারূপে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে সম্ভবত ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে আমার অনুজপ্রতীম তরুণ কবি ইশারফ হোসেন তার ‘সকাল সাহিত্য গোষ্ঠী'-এর পক্ষ থেকে জাতীয় জাদুঘরে আল মাহমুদের একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে, যাতে আমি সম্মাননাপত্র পাঠ করে সেটা কবিকে উপস্থাপন করি। প্রসঙ্গত, সেই অনুষ্ঠানে আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে ঢাকা হবে বাংলা ভাষার রাজধানী'। তাঁর বক্তব্যের আলোকে দৈনিক সংগ্রাম-এর জন্য অনুষ্ঠানের নিউজটিও কভার করেছিলাম আমি, যা প্রথম পাতার অষ্টম কলামের শীর্ষদেশে ছাপা হয়। তারপর মূলত পল্টনে ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিকণ্ঠ কার্যালয়ে আল মাহমুদের সঙ্গে একাধিকবার দেখা, সাক্ষাৎ, বাক্যবিনিময় হয়েছে। আরেকটি বিচিত্র যোগযোগ তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠে সাপ্তাহিক রোববার-এর মাধ্যমে। আমি তখন মোটামুটিভাবে পত্রিকাটির দেখাশোনা করি। সহকর্মী-সাংবাদিক সৈয়দ কাজিম রেজা একদিন আল মাহমুদের একটি দীর্ঘ কবিতা নিয়ে আসেন। কিন্তু কোনও আর্টিস্টকে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কোলাজধর্মী অলঙ্করণের মাধ্যমে আমি নিজেই এক পৃষ্ঠায় আল মাহমুদের কবিতাটি সজ্জিত করি। সবাই তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে অলঙ্করণে আমার নাম ছাপিয়ে দিয়েছিলেন।
এসব তথ্য বলার উদ্দেশ্য হলো, আল মাহমুদ আমার আগ্রহ ও জ্ঞাত জগতের বাইরে ছিলেন না; যেমন ছিল না তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলি। এটাও বলে রাখা ভালো যে, আমি ও আমার বন্ধুবর্গ, যারা আশি দশকের কবি-লেখক নামে পরিচিত, তারা মূলত বহুমাত্রিক পাঠের অভিজ্ঞতার মধ্য নিয়ে অতীতকে মন্থন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে প্রয়াসী ছিলাম বা আছি। এই তথ্যটিও জানানোর প্রয়োজনবোধ করেছি একটি বিশেষ কারণে। কারণটি হলো, অতি সম্প্রতি কবি ও সম্পাদক ফারুক মাহমুদ, আমাদের উভয়েরই অতিপ্রিয় ও স্নেহধন্য, নববই দশকের একজন তরুণ কবির একটি মন্তব্য আমাকে জানালেন। সে বলেছে, ‘আজকাল আর রবীন্দ্রনাথ পড়া যায় না।' মানে তার কাছে রবীন্দ্রনাথ পাঠের অযোগ্য! কবিতার পাশাপাশি সে টিভি ও মিডিয়াতে যথেষ্ট নামডাক করেছে। অতএব তার নামটি উল্লেখ করে বেচারাকে বিব্রত করছি না। শুধু এটুকুই জানাচ্ছি যে, আমরা আমাদের সময় ও অভিজ্ঞতাকে ঋপদী ও সমকালীন সাহিত্য ও কাব্যের পাঠের মাধ্যমে ঋদ্ধ ও পূর্ণ করেছি। অন্যান্যের মধ্যে আল মাহমুদও সে পাঠতালিকায় ছিলেন। কিন্তু যখন শুনতে হয় যে, ‘আজকাল আর রবীন্দ্রনাথ পড়া যায় না;' তখন অন্যান্যরা অনাগতকালে কতটুকু পঠিত হবেন, সেই প্রশ্ন ও সংশয় অবশ্যই তো থাকে! লেখকের মান নেমে যাওয়া কিংবা পাঠকের মান নেমে যাওয়ার উভয়বিধ ঝুঁকির মধ্য দিয়েই তো সাহিত্য এগিয়ে এসেছে এতোটুকু দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ। বাংলা সাহিত্যের সেই পথে কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, তিনজনকে কখনওই বাদ দেয়া যাবে না---মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল।
এই তিনজনকে স্তম্ভের মতো ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাবৎ বাংলা সাহিত্য। এই তিনটি মহাসূর্যকে ঘিরে রয়েছে শত-সহস্র তারার মেলা। সেই আলোকিত মন্ডলে আল মাহমুদের অবস্থান কোথায় হবে? মহাকালে দখলে থাকা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার অধিকার আমার নেই। আমি যা বলতে পারি তা হলো, আল মাহমুদ শত-সাধারণের মধ্যে মিশে থাকবেন না; অবশ্যই থাকবেন স্বতন্ত্র আলোর ঔজ্জ্বল্যে; স্বনির্মিত একটি বিশেষ ও দৃষ্টিগ্রাহ্য অবস্থানে। কারণ, আল মাহমুদের কবিতা ও সাহিত্যকর্মে যে সমাজ ও মানুষগুলো উঁকি মারে, তা একান্তভাবেই বাংলার নিজস্ব প্রাণের প্রকাশ। বাংলার নিজস্ব প্রাণের প্রকাশের মাধ্যমে আল মাহমুদ যে সাহিত্যজগত সৃজন করেছেন; যে ভাবসম্পদ গড়ে তুলেছেন; তা আবশ্যিকভাবেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম অর্জনসমূহের অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিজের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকার দায়বদ্ধতায় আল মাহমুদের এমন স্বর্ণালি সাফল্যকে স্বীকার না করে কীভাবে পারবে?

কথাশিল্পী আল মাহমুদ |

FB_IMG_1500338325778
আল মাহমুদের জন্মদিনে
কথাশিল্পী আল মাহমুদ | ফজলুল হক সৈকত।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আমি গল্প-উপন্যাস লিখি। সেটা আগে থেকেই। আমার একটা ধারণা হয়েছে যে, উপন্যাস লিখলেই যে সেটা তিনশ’ পৃষ্ঠা হতে হবে, এর কোনো তাৎপর্য নেই। অনেকে পড়তেও চায় না। আমি ছোট উপন্যাস লেখা শুরু করেছি।
আমি গল্প-উপন্যাস লিখি। সেটা আগে থেকেই। আমার একটা ধারণা হয়েছে যে, উপন্যাস লিখলেই যে সেটা তিনশ’ পৃষ্ঠা হতে হবে, এর কোনো তাৎপর্য নেই। অনেকে পড়তেও চায় না। আমি ছোট উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলোকে বড় গল্প মনে হলেও তাতে উপন্যাসের বিভঙ্গ আছে; প্রেম-প্রীতি, আনন্দ-বেদনা আছে। অনেকে এ ধরনের উপন্যাসকে মাইক্রো উপন্যাস বলে। তবে সব মিলিয়ে আমার যে কাজ সেটা একজন কবিরই কাজ। (সূত্র: আহমদ বাসির, ‘আল মাহমুদের মুখোমুখি’, প্রেক্ষণ, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৭, ১২৮)—এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের কথাসাহিত্য-ভাবনা সম্বন্ধে বলছিলেন আল মাহমুদ। ‘সোনালী কাবিন’খ্যাত কবি আল মাহমুদ (জন্ম: ১১ জুলাই ১৯৩৬, মৌড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) গদ্যসাহিত্যেও বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
নিরন্তর এই লেখক আজও তারুণ্য, রহস্য, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, প্রকৃতির সাথে মানুষের কাজ ও কলার সাদৃশ্য ও সান্নিধ্য, প্রেম-বিচ্ছেদ, আনন্দ-যন্ত্রণার বর্ণনাকারী হিসেবে বর্তমান,—বয়সের ভার, দারিদ্র্য কিংবা সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-পেশাগত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শিখরে। উপন্যাস কিংবা গল্পের কাঠামোকেও তিনি প্রদান করে চলেছেন কাব্যের সৌকর্য ও শোভা। জীবনানন্দের মতো কবিতা এবং কথাসাহিত্য—উভয় ধারাতেই শক্তিশালী এই প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বিরাট অহংকার। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগে—১৯৬৭ সালের জুলাই কিংবা আগস্টের কোনো এক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে কবি জসীমউদ্‌দীনকে তিনি এক পত্রে লিখেছিলেন:
আমার গদ্য আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হয়েছি। এদিকটা প্রসারিত করার জন্য আপনার উপদেশ আমাকে দারুণভাবে প্রাণিত করেছে, আমারও বিশ্বাস, আমরা যারা শুধু কবিতা নিয়ে আছি তারা অল্পাধিক গদ্য রচনা করলে এ দেশে গদ্য সাহিত্যের এমন দুর্গতি হতো না। অন্তত প্রত্যেক কবি একটি বা দুটি উপন্যাস অথবা প্রবন্ধ বই রচনা করলে আমাদের সাহিত্যের চেহারা পাল্টে যেত। অধ্যাপকদের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে কবিদেরই এগিয়ে আসা উচিত। একথা একদিন আমি শামসুর রাহমানকেও বলেছিলাম। (চাঁড়ুলিয়া, ওমর বিশ্বাস সম্পাদিত, ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০০১, ২৪৬)
চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক ও ‘সবুজপত্র’ সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীও তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে সাহিত্যের অধ্যাপকদের সম্বন্ধে কিছুটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। অধ্যাপকদের বিষয়ে আল মাহমুদের অভিযোগ কী, তার দিকে আপাতত বেশি মনোযোগ স্থাপন না করেই বলছি, আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি তিনি কথাসাহিত্য নিয়ে বেশ নিরীক্ষা-প্রবণতার পরিচয় রেখেছেন।
দুই
পঞ্চাশের দশকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি আল মাহমুদ। সোনালী কাবিন (প্রকাশকাল: ১৯৭৩) তাঁর সর্বাধিক উচ্চারিত রচনা। প্রায় ৬ দশক ধরে বিরতিহীন লিখে চলেছেন তিনি। গ্রন্থ-সাময়িকপত্র-সভা-সেমিনার-অনুষ্ঠান-বেতার-টেলিভিশন—সর্বত্র তাঁর অবাধ-সাবলীল বিচরণ আজও আমাদেরকে প্রেরণা যোগায়। কবি-কথাশিল্পী—বাঙালির সরব ভাষ্যকার আল মাহমুদ। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন। সাংবাদিকতার সাথে জড়িত হন ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরে। তখন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। কবিতা রচনা ছাড়াও আল মাহমুদ প্রায় নিয়মিত লিখছেন উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কলাম-শিশুতোষ রচনা। বাংলাদেশের রাজনীতি-সংস্কৃতি আর সামাজিক বিকাশধারার অন্যতম নিবিড় ভাষ্যকার তিনি।

ঐতিহ্য আর মানবিক-প্রবণতা বিবৃতিতে তাঁর খ্যাতি অসামান্য। গ্রামীণ জীবনের মাহাত্ম্য আর নগরজীবনের বহুবিধ জটিলতা তাঁর রচনাবলিতে অনায়াসে পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে চলেছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সত্যযুগ পত্রিকায় তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ কি ৫৫ সালে। প্রখ্যাত সম্পাদক তাঁকে তখন গদ্য লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সত্যযুগ-এ তখন মাহমুদের একটি কবিতাও ছাপা হয়েছিল। পরে, ১৯৫৫ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকায় আল মাহমুদের তিনটি কবিতা—‘প্রবোধ’, ‘একদিন অন্ধকারে’ ও ‘সিম্ফনি’ প্রকাশ করেন। সেই থেকে অবিরাম প্রায় ৬০ বছর ধরে লিখে চলেছেন কথাকারিগর আল মাহমুদ।
মানব জাতির ইতিহাস, প্রেম ও স্বজাত্যবোধ, মাটি ও মানুষের নিবিড়তা, সত্য ও মিথ্যার মোড়ক, চাতুরি ও স্পষ্টতা বিশেষ প্রহরে আল মাহমুদের কথাশিল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আর কাঠামোতে থাকে পর্যবেক্ষণ-পরিবর্তন প্রবণতা এবং প্রাতিস্বিকতা প্রতিষ্ঠার বলয়। হাল আমলে তাঁর রচিত একটি উপন্যাসের বিষয়চিন্তা ও কাঠামোশৈলীর দিকে আমরা খানিটা নজর দিতে পারি। পোড়ামাটির জোড়া হাঁস (প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০১৩, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড) উপন্যাসটিতে আল মাহমুদ হাজার বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাস আর মানুষের অগ্রগমণকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রেমকে। জীবনানন্দের বহুল পঠিত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর মতো করে মানব-সভ্যতার দেয়ালে খানিকটা গাঁ ঘেঁষে আল মাহমুদ কাহিনী-বয়নের শুরুতে বলছেন: ‘হাজার হাজার বছর ধরে...’। বিস্ময়ের ব্যাপার এখানেও রয়েছে বনলতা সেন। আর আছে আরেক নারী পল্লবী। আছে পুরুষ চরিত্র আনন্দ। উপন্যাসটির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়—নারীর প্রাকৃতিক প্রেম ও পুরুষের হৃদয়লীলা। অন্তহীন নারী পল্লবী এবং সম্ভাবনাময় পুরুষ আনন্দের মানসিক দ্বন্দ্ব আছে এখানে। উর্বরা জমির মতো ভরাট গতর আর কামকাতর কৃষককন্যা বনলতার রহস্য হয়ত আটকে থাকে মানুষের অনাদিকালের স্বপ্নভরা ফসলের মায়াবী মাঠের প্রান্তে।

বনলতার মাতৃত্ব, পল্লবীর সখিত্ব আর আনন্দের নারীমগ্নতা—সব মিলিয়ে সরল কাহিনীতে মানব-মানবীর সনাতন প্রেমের গল্পই পরিবেশিত হয়েছে। আর কাহিনীর কারিগর কৌশলে তাঁর পাঠককে হাজির করেছেন ধর্মতত্ত্বের সৃজনরহস্যে। উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র কাব্যময়তা কিংবা প্রেমের দ্বান্দ্বিকতা ও রহস্যের উত্তরণ-পর্ব কি-না, তা হয়ত পরবর্তীকালে গবেষকগণ বিবেচনা করে দেখবেন। তবে, এখানে পোড়ামাটিতে তৈরি আদি মানুষ—আদম ও হাওয়ার প্রেম—অতঃপর জগতের সকল রহস্য ও জটিলতার ব্যাপ্তিকে তিনি ধরতে চেষ্টা করেছেন বিশেষ, নির্বিশেষ ও রূপকের অন্তরালে। উপন্যাসটির শেষাংশের পাঠ নেওয়া যাক:
সব প্রেমেরই ঘটনা থাকে। কিন্তু সেই ঘটনাকে কেউ ইতিহাসের মর্যাদা দেয় না। লোকে বলে প্রেমে অন্ধ হয়ে যাওয়া একটা অবস্থার কথা। যে অবস্থা এখন আনন্দের। সে কেবল দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে এবং মুখে বিড়বিড় করে কাব্যের পঙক্তিটি উচ্চারণ করে। তার মধ্যে প্রকৃত কবিত্বশক্তি লুকায়িত আছে বলে সবারই মনে হতে থাকে। আনন্দ নিজের ওপর আস্থা হারায় না। সে কবিতাকে মনে হয় খানিকটা নিজের আয়ত্বে এনে তারই চর্চা করে এগিয়ে যাচ্ছে।
বনলতা মাঝে মাঝে বিনয় প্রকাশ করে সমঝোতার চেষ্টা করতে চায়। কারণ তার আছে গর্ভে সন্তান। এ জন্য তার মধ্যে নারীসুলভ হিংস্রতা খানিকটা চাপা পড়ে থাকে। তার বদলে তার ভেতরে মাতৃত্ব প্রবল হয়ে উঠেছে। যেখানে তার সন্তান আসছে। সেই সন্তানের জন্য যে ব্যাকুল-বিহ্বল হয়ে অপেক্ষা করছে। অন্য দিকে পল্লবী তার দেহবল্লরী সবার সামনে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে পুলকে, শিহরণে কাঁপছে। সবকিছুই মোটামুটি আনন্দঘন এক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে।
অন্য দিকে এই কাহিনীর রচনাকারী এখন সমাপ্তিতে পৌঁছতে চায়। যদিও গায়ের জোরে সমাপ্তিতে পৌঁছা যায় না। তবে অবস্থা যে রকম আছে, সেভাবেই সমাপ্ত করার নামই হলো শেষ। তামাম শোধ।
শেষের আলোয় এই কাহিনীর সমস্ত চরিত্রই উদগ্রীব এবং ঘটনার পারম্পর্য পরিসমাপ্তিতে না পৌঁছালেও এই কাহিনীর বর্ণনাকারী যেহেতু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বলতে চান—আর কিছু নেই। এ কথাই এখন প্রাধান্য লাভ করেছে। শেষ মানে আর বলার-চলার কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। এখানেই তবে শেষ হোক। সমস্ত চরিত্রের অন্তর্জালা ও স্বপ্নকল্পনা।
‘অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নায়ক ও নায়িকা মিলে গেল’ কিংবা ‘নটে গাছটি মুড়োলো আমার গল্প ফুরোলো’ ধরনের বাংলা সিনেমার মতো অথবা বাঙালির রূপকথার মতো ঐতিহ্যিক সুর হয়ত আমরা এখানে পেয়ে যাই। কিন্তু আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্য কথা—পৃথিবীর কাহিনী যে চলমান, প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে ইতিহাসের উপাদান—সভ্যতা যে স্থির নয়, এর যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, অতএব মানুষের গল্পের ও বিকাশেরও যে কোনো পরিসমাপ্তি থাকতে পারে না; আর এসবের ভেতরেই থাকে মানুষের স্বপ্ন ও তৃপ্তি—সেই আখ্যানই বোধ করি কথাকার সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এই কাঠামো ও কৌশল অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ও বিশেষভাবে চিন্তা-জাগানিয়া।
আল মাহমুদ কোনো উপন্যাস লেখা শেষ করে তারপর ছাপতে দিয়েছেন এমন নজির নেই। সবগুলোই কোনো-না-কোনো সাহিত্যপাতা বা সাময়িকীর জন্য ধারাবাহিকভাবে বা আংশিকভাবে রচিত; পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। তিনি একটানা উপন্যাস লেখাটাকে কঠিন কাজ ভেবেছেন। ধীরে ধীরে লেখা শেষ করার কারণে তাঁর কাহিনীতে কিংবা কোনো পরিচ্ছেদের পরিসমাপ্তিতে প্রায়শই নাটকীয়তার আভাস মেলে। প্রথম উপন্যাস ডাহুকী ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও গল্প লিখছেন বেশ আগে থেকেই। গল্প লিখে হাত পাকিয়ে, সাংবাদিক আল মাহমুদ, কবিতার পাশাপাশি গদ্যের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বোধকরি। তো ডাহুকীতে কী আছে?—আছে প্রধান নারী চরিত্র আতেকার গ্রামে ছুটে যাওয়ার ঘটনা। বাঙালি মুসলমান ও নগরে বসবাসকারী এক নারীর ভেতরে টানাপোড়েন, শহর ছেড়ে শেকড়ের সন্ধানে ছুটেচলার যে প্রাণান্ত আবেগ—সে সব তিনি জানাতে চেষ্টা করেছেন।
আর আস্তিকতা যে মানুষের প্রকৃত পরিচয়, নাস্তিকতার ভেতরেও যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক প্রকারের আস্তিকতা, তাও প্রকাশ করেছেন তিনি ডাহুকীতে। ৩৮ বছরে পদার্পণ-করা আতেকার কৈশোরকাল বর্তমান কাহিনীর ক্যানভাস। স্কুলে যাওয়ার সাথী কেরামতকে ভুলতে পারেনি আতেকা। গল্পের পরিসরে চত্রির হিসেবে প্রবেশ করেছে আতেকার স্বামী অধ্যাপক শাহেদ, কেরামতের স্ত্রী সুফিয়া বানু, দর্শনের অধ্যাপক ফিরোজা বেগম প্রমুখ। অতৃপ্ত দাম্পত্য মূল সুর হলেও উপকাহিনীরূপে স্থান পেয়েছে শাহেদের কৈশোরকালে বেশ্যাপাড়ায় কোনো এক নারীর পরম মমতার স্পর্শ-কথা। আতেকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। শাহেদ-আতেকা দম্পতি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ালেও সংসারে তাদের সুখ আসেনি। এক পর্যায়ে আতেকার বান্ধবী ফিরোজার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে শাহেদ। নানান ঘাত-প্রতিঘাত, মনোবাস্তবিক সামাজিক স্তর পেরিয়ে গল্পটির ক্যানভাসে আতেকার মানসিক পরিবর্তনের ছায়া প্রতিফলিত হয়। আতেকার প্রথম শিক্ষক ইমাম সাহেবের সান্নিধ্য ও পরামর্শ লক্ষ্যণীয়:
‘আল্লাহ তোমার মতি সুস্থির করবেন। মনে রাইখো, হুদাই ভোগের মইধ্যে সুখ নাই আল্লারে যত বেশি ইয়াদ করবা, আল্লাহ তত বেশি তোমার ইয়াদ করব।’ (আল মাহমুদ রচনাবলী-২, ঐতিহ্য, ২০০২, ৩০৬)
উপন্যাসটির সংলাপে একটা বিশেষ গ্রাম্য-ঢঙ আছে। আতেকা এবং তার কিশোরবেলার সাথী কামরুন-এর মধ্যকার একটি কথোপকথনের বর্ণনার দিকে দৃষ্টি রাখা যাক:
— এই কামরুনী গাইয়ের নিচে কী দেখছ?...
— আমি গাইয়ের নিচে বইসা তর হাইরে দেখি।
— বেশি দেখিস না। তাইলে কইলাম কেরামত ভাই গাই ছাইড়া তর উলান ধইরা দোয়াইব। তাড়াতাড়ি বাইর অইয়া যা।
— তর মতন গাই থুইয়া তর বাপের বান্ধা রাখাইল্যা আমার ওলান ধরব ক্যান লো বান্দরনি। তরটা চুইষ্যাইত কেরামত মিঞার চিকনা বাড়তাছে।’ (আল মাহমুদ রচনাবলী-২, ঐতিহ্য, ২০০২, ১৬৮)
বাংলাদশের অভ্যুয়ের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, স্বাধীনতা ও নেতৃত্ব বিষয়ে নানান মতান্তর প্রভৃতির প্রত্যক্ষ ছায়া পড়েছে আল মাহমুদের কাবিলের বোন (১৯৯৩) ও উপমহাদেশ (১৯৯৩) উপন্যাসদ্বয়ে। ভিন্ন নাম হলেও আসলে বই যে একটি তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী-বর্ণনাকারী তিনি। ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ইতিহাসলগ্নতা বোধকরি এমনই। যেমন ২০১৪ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো সারা-প্রচেষ্টা জুড়ে প্রকাশ করে চলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস—তার প্রতিটি বই যেন ধারাবাহিক রচনা কিংবা পরেরটি আগেরটির নতুন সংস্করণ (নোবেলপ্রাপ্তির পর এক সাক্ষাৎকারে লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী)। সমাজচিন্তক আল মাহমুদ অভিজ্ঞতা থেকে অনুভূতি ও ধারণাগুলোকে সাজিয়েছেন কথা-কাহিনীর স্তরে স্তরে। কখনো বানিয়ে বা আরোপ করে কিছু লিখতে চেষ্টা করেননি। বিশ্বাস এবং অনুভবে তিনি স্থির কথানির্মাতা। কাবিলের বোন-এ বাংলা-উর্দু-ফারসি ভাষার মিশ্রণ আছে।
এটি বাঙালি কথানির্মাতা ও কবি মাহমুদের নিজের ভাষা—বানানো নয়। তিনি বড় হয়েছেন কনজারভেটিভ মুসলিম পরিবারে। সেখানে ছিলেন মাদ্রাসা-পড়ুয়া ব্যক্তি, শিক্ষক-ব্যবসায়ী, মাওলানা। কাজেই একটি মিশ্র-সংস্কৃতি ও ভাষাবোধ তাঁর চেতনায় ছিল। উপমহাদেশ-এ মুসলমান পুরুষ কবি মীর হাদী এবং হিন্দু নারী নন্দিনীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তিনি সমকালীন সামাজিক অবস্থা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারত-পাকিস্তান ও স্বপ্নে-জাগা বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
কবি ও কোলাহল (১৯৯৩) উপন্যাসে রবীন্দ্র-বিরোধীতার প্রসঙ্গ আছে—আছে রবীন্দ্রনাথের অনতিক্রম্য প্রাসঙ্গিকতার কথাও। এছাড়া, এখানে প্রতিফলিত হয়েছে কমিউজম সম্বন্ধে মত-বিরোধ ও চিন্তার বৈশাদৃশ্য এবং স্বপ্নময়তা ও বাস্তবতা-বিরোধিতার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার চিত্রাবলী। প্রকৃত পক্ষে লেখক বাস্তবকে, সমকালীনতা ও স্বপ্নময় সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। পাঠককেও সে ধারণার সাথে পরিচিত করে তুলতে চেয়েছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলন, মানবিকতা, যৌনতার স্বাভাবিকতার কাহিনী তাঁর নিশিন্দা নারী (১৯৯৫)। এখানে জাদুময়তা আছে, অনর্গল গল্প বলার ভঙ্গি আছে। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের একবসায়—একরাতে লেখা উপন্যাস রক্তগোলাপ (১৯৬৪)।
আল মাহমুদ তাঁর যেভাবে বেড়ে উঠি (১৯৮৬) আত্মজীবনীমূলক রচনাকে উপন্যাস বলতে চেয়েছেন—এটিকে তিনি নিজের জীবনের ঘটনার আবর্তে গড়ে ওঠা ‘ফিকশন’ বলতে চান। কহিনীটিতে নায়কের অস্থিরচিত্ততা এবং অল্পবয়সী বালকের জীবন-উপলব্ধি জীবনশিল্পী আল মাহমুদের দর্শনেরই প্রতিফলন মাত্র। জীবনসত্যের, শিল্পসত্যের এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ হতে পারে বইটি। নারী ও নারীর দ্বন্দ্ব যে আমাদের ভারতীয় পরিবারের ঐতিহ্য ও স্বাভাবিক ছবি—তার গল্প পাওয়া যায় মাহমুদের পুত্র উপন্যাসে। ছেলে বিয়ে করলে পর হয়ে যায় কি-না, সে শ্বশুরবাড়ির লোক হয়ে পড়ে কি-না—এসব জিজ্ঞাসার সমাধান পাওয়া যেতে পারে গ্রন্থটিতে। আগুনের মেয়ে (১৯৯৫) অসাধারণ এবং এবং বিশেষ উপন্যাস। আমাদের লৌকিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ঐশ্বরিক ভাবনার দ্বন্দ্ব ও মীমাংসা, জ্বীন ও ইনসানের মধ্যকার সম্বন্ধ, ধর্মীয় ও সামাজিক উপলব্ধি, দার্শনিকতা নানান বিষয়ের সমাবেশ আল মাহমুদের এই উপন্যাসখানি। আকারে ছোট এই গ্রন্থটিকে একটি সার্থক সৃষ্টি বলে দাবি করেন লেখক। আগুনের মেয়ে সম্বন্ধে আল মাহমুদের একটি বক্তব্য এখানে তুলে দেওয়া হলো:
আমি বইটা লিখছিলাম এই কারণেই যে, আমাদের সব সমাজের অভ্যন্তরে, আমরা যেহেতু মুসলমান, আমরা যেহেতু কোরআন পাঠ করি আমরা জ্বিনের ওপর বিশ্বাস করি। আরেকটি কথা—পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যে উপন্যাস তার নাম হলো এরাবিয়ান নাইটস। এরপর এর তুলনায় আর কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি। এই উপন্যাসের একটা বড় উপাদান হলো জ্বিন চরিত্র। তাহলে আমরা জ্বিনকে কেন ব্যবহার করব না? এই জন্যে একটা পরীক্ষামূলক গল্প আমি লিখলাম। আমি এই উপন্যাস দিয়ে আমাদের সবচেয়ে যারা আধুনিক লেখক তাদের একদম নাড়িয়ে দিয়েছি।
আমরা কল্পস্টোরি করি। আমরা জ্বিনে বিশ্বাস করি; জ্বিন আছে, কিন্তু তা আমাদের গল্পে নেই। আগের দিনের লেখকরা এরাবিয়ান নাইটস যারা লিখেছেন, তৈরি করেছেন, তারা এটাকে জাদু হিসেবে নিয়েছেন। হিন্দু শাস্ত্রেও কিন্তু জ্বিনের কথা আছে। গন্ধম চরিত্র আছে। এসবই কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু আগুনের মেয়ে আমি লিখেছি আমার গভীর বিশ্বাস থেকে। (‘উপন্যাসের জন্য আমাকে এক সময় স্মরণ করা হবে’, সাক্ষাৎকার, চাড়ুলিয়া, পূর্বোক্ত, ১৪৫)
আল মাহমুদের পুরুষ সুন্দর (১৯৯৪) উপন্যাসটি নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। আছে প্রবল নিন্দা। অনেকে মনে করেন এটি অশ্লীল—এমনটা না লিখলেও পারতেন তিনি। অবশ্য এর বিচার এখন সময়ের কাছে। যে পারো ভুলিয়ে দাও (১৯৯৬) গ্রন্থটি সম্ভবত তাঁর একটি বৃহৎ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। যদিও বইতে তা উল্লেখ নেই। তবে কাহিনীর হঠাৎ থেমে যাওয়া আর লেখকের আলাপচারিতা থেকে বিষয়টি ধারণা করা যায়। গ্রন্থটির গল্প-পরিসর লেখকের নানার বাড়ি। মামাদের কাহিনী আর চরিত্রের ভালোমন্দ নিয়ে গড়ে উঠেছে গল্পের ক্যানভাস। ঘটনা বিবরণে তিনি সত্যনিষ্ঠ। কোনো কথা আরোপ করেননি, বানিয়ে লেখেননি। কেবল ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে গেছেন।
আর চেহারার চতুরঙ্গ (২০০১) উপন্যাসটির বিষয় হলো মিডিয়ায় নারীর পণ্য হিসেবে উপস্থাপন এবং ফটোগ্রাফির নানান কৌশল ও কলা। তিনি সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন এই গ্রন্থের বয়নের সময়। দায়িত্বশীল সাংবাদিক আল মাহমুদ কাহিনীর মধ্য দিয়ে শুধু সত্য সংবাদই প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন এখানে। চারপাশে দেখা সমাজের শ্লীলতা-অশ্লীলতার চেহারা পাওয়া যাবে হরিৎ খোলস উপন্যাসে। কবি আল মাহমুদ জাত কথাশিল্পী। এই প্রসঙ্গে তাঁর সাক্ষ্য:
যদি আমি কবিতা না লিখতাম তাহলে গদ্যশিল্পই তৈরি করতাম। আমার কিন্তু সমস্ত ঝোঁক ছিল কথাসাহিত্যের দিকে। বাইচান্স কবিতা লেখা শুরু করি, সেই চলা শুরু।’ (চাড়ুলিয়া, ওই, ১৪৬)
তিন
কবিতার পাশপাশি কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের আবির্ভাব এদেশের গদ্যসাহিত্যের অভিযাত্রায় এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি যখন গল্প-কাঠামো নির্মাণ করেন, তখন যেন খুব সাবধানে তৈরি করেন বাংলাদেশের বুক। আল মাহমুদ গল্প লিখেছেন ধীরে-সুস্থে; খ্যাতি ও প্রশংসার আকর্ষণ তাঁকে টলাতে পারেনি। তাঁর গল্প-পরিকল্পনায় এবং পরিবেশনশৈলীতে রয়েছে নিবিড়চিন্তার ছাপ। প্রখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদ মন্তব্য করেছেন:
‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এত কয়টা ভালো গল্প বেড়িয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্বে ঈর্ষণীয় মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’ (প্রেক্ষণ, খন্দকার আবদুল মোমেন সম্পাদিত, আল মাহমুদ সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৭, ১৫০)
মানুষ-জীবন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি আল মাহমুদের গল্পের মূল ক্যানভাস। নারী—তার রূপের বর্ণনা, প্রকৃতির সাথে নারীর তুলনা, পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান এবং নিয়তির অমোঘতা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পে চিত্রিত হয়েছে আল মাহমুদের গভীর গ্রামপ্রীতি। গল্পকথক গল্পটির প্রারম্ভেই প্রকৃতির বিচিত্র রঙ আর শোভার সাথে ভালোলাগার মানুষকে মিলিয়ে অনুভব করেন। পানকৌড়ির আভরণ-সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি; মনে পড়ে যায় সদ্য পরিণীতা স্ত্রীর মুখ-আদল। রোদে গায়ের পানি শুকাতে-থাকা পানকৌড়ির মাঝে তিনি যেন কেবলই দেখতে পান চুল-শুকাতে-থাকা স্ত্রী নাদিরার কোমল মুখ।
গল্পকার ভালোবাসেন দেশকে আর প্রিয় মানুষকে। তাই দেশের, প্রকৃতির নির্মলতায় বারবার খুঁজে ফেরেন প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পের প্রতীকী তাৎপর্য স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এসেছে। নববিবাহিতা স্ত্রী তার প্রথম রক্তের অসুবিধার দরুন স্বামীর রতিক্রিয়ার খায়েশকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলে স্বামীকে আদর করে রাগ করতে বারণ করে। স্বামী সেখানে সফল হতে না পেরে শিকারে গিয়ে সমতুল্য এক উত্তেজনা অনুভব করতে চায়। বিলের বর্ণনা লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় বহন করে। লেখক কাদাকেও জীবন্ত করে তুলতে পারেন। তবে পানকৌড়িই আসল। তার বুক, পুচ্ছ ও পাখনায় যুবকটি তার স্ত্রীর দেহের পেলব কৃষ্ণ শোভা ও কমনীয়তা দেখতে পায়। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু যুবকের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা পানকৌড়ির পড়ন্ত দেহে রক্তের ছোপ এঁকে দেয়। যেন স্ত্রীর প্রথম রক্তের বাধা পেরিয়ে সেখানে নতুন এক রক্ত সাগরের সম্ভাবনা দেখা দেয়। পানকৌড়ি মরে গেল। স্ত্রীরও কুমারিত্ব ঘুচল। যেটা নারীর জীবনে একই সাথে পুরনো সত্তার মৃত্যু ও নুতন জীবনের শুরু।
‘ভেজা কাফন’ গল্পে এক সাধারণ নারী নূরীর জীবনে ঘটে-যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনার সমাবেশ আমাদের চোখে পড়ে। নূরী অসুস্থ; হৃদরোগে ভুগছে। তার লেখা চিঠিতে আমরা পাই মৃত্যুভয় আর ক্ষমা-প্রার্থনার আকুলতা। সে লিখেছে: ‘আমি বাঁচব না। আমাকে মাফ করে দিও।’ ডাক্তারের মতে নূরী আর মাত্র ছয় মাস বাঁচবে। মা-বাবা হারা নূরী ভাইয়ের সহযোগিতায় চিকিৎসা চালাতে থাকে। স্বামী সাজ্জাদের প্রতিও তার বেশ আস্থা। মৃত্যুপথযাত্রী নূরী তার পুরনো বন্ধুদেরকে যে-সব লম্বা-লম্বা চিঠি লিখত সেগুলো ডাকে পাঠাত সাজ্জাদের হাতে। একদিন সত্যি সত্যি সব ছেড়ে পরপারের পথে পাড়ি দিল জীবনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণ-প্রত্যাশায় নিমগ্ন নূরী। সাদা কাফন-মোড়ানো দেহ তার চারপাশের আপনজনের কান্নার ভারে আর বৃষ্টি-উত্তর প্রবল বাতাসে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছিল যেন। নাকফুলছাড়া নূরীর মুখ বড় অচেনা হয়ে পড়ে সাজ্জাদের কাছে; লাল শাপলার গুচ্ছ তুলে-ফেলা পুকুরের টলটলে জলের মতো মনে হয় নূরীর ভেজা কাফনমোড়া মুখ। প্রকৃতির সন্তান নূরী যেন প্রকৃতিরই অকৃত্রিম স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় স্বামীর স্মৃতিনিবিড় ভাবনাবলয়ে। নিয়তি যেন কিছুতেই আমাদেরকে সহজ-পথে হাঁটতে দিতে চায় না—গল্পকার বোধহয় এই অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন এ গল্পে।
সাংসারিক-পারিবারিক জীবনের নৈমিত্তিক ঘটনা আর দাম্পত্য-জটিলতার ভাষাচিত্র আল মাহমুদের ‘পাতার শিহরণ’ গল্পটি। স্বামীকে হারাতে না-চাওয়া এক ঘরমুখো স্ত্রীর মানসিক দোলাচল, অনাস্থা, সিদ্ধান্তহীনতা আর শেষত নিশ্চলতা এই গল্পের মূল আভাসকেন্দ্র। নতুন চাকুরিতে যোগ দিতে যাবার জন্য অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েও যুবতী কাজের মেয়ে ঘরে রেখে যেতে সাহস পায় না মধ্যবিত্তস্বভাবের বাঙালি নারী পাতা। বাঙালি নারীর স্বামী-নির্ভরতা কিংবা স্বামীর প্রতি অবিচল আকর্ষণ চিত্রণে বর্তমান গল্পে লেখক বেশ আন্তরিক; পাতার সন্দেহ-বাতিকতা প্রকাশে প্রকারান্তরে তার ভালোবাসার অকৃত্রিমতাই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন গল্পকার। দাম্পত্য-দলিল পরিবেশনের পাশাপাশি গল্পটিতে কথাশিল্পী চাকুরির নির্বাচনী বোর্ড, শহর ও গ্রামের পরিবেশগত ভিন্নতা—বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষের শহরপ্রীতি প্রভৃতি প্রসঙ্গের বিশ্বাসযোগ্য কিছু বিবরণও উপস্থাপন করেছেন সামাজিকের দায় থেকে। জীবন চলার পথে গল্পকার দেখা-শোনা-জানা বিষয়গুলোকে গল্পের পাতায় পাতায় সাজিয়েছেন অভিজ্ঞ শিল্পীর দিকজয়ী তুলির জাদুময়ী স্পর্শে।
‘তৃষিত জলধি’ গল্পটি ভ্রমণ-বিষয়ক বাস্তব ঘটনার বিবরণ। গল্পকথক তার জবানিতে জানাচ্ছেন বিচিত্র পেশার মানুষের চরিত্র-প্রবণতা আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির আভাসচিত্র। গল্পটির শুরুতে কথক পাঠককে বলছেন তার ভ্রমণ-অনুষঙ্গ: ‘বঙ্গোপসাগরে প্রমোদ-ভ্রমণে এসে সারাদিনের ক্লান্তিকর ছোটাছুটি আর হৈ-হুল্লোড় ছাড়া আমার জন্য জাহাজটির মধ্যে তেমন পরিতৃপ্তিকর কোনো অবকাশ ছিল না।’ একটি প্রমোদ-তরীতে রাষ্ট্রপতির সাথে ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-নিরাপত্তাকর্মী-শিক্ষার্থী। এই প্রতীকি গল্পে কথাশিল্পী আল মাহমুদ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহ নির্মাণ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা আর ঠক-প্রবণতা গল্পটির ক্যানভাস। গল্পে বর্ণিত রাষ্ট্রপতিকে একদিন রাতে জাহাজের ছাদে বসে থাকতে দেখা যায়—একাকী; তখন তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা ঘুমরত। আমাদের ভূমি-অধিকর্তা-চারপাশ যে গভীর অনিশ্চয়তা আর গন্তব্যহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত—তারই চিত্রাভাস বর্তমান গল্পটিতে উপস্থাপিত।
মফস্বলের কলেজশিক্ষকদের প্রাত্যহিক সংকট আর প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্কের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গন্ধের উৎস’ গল্পে। জিহান নামক এক কলেজ শিক্ষকের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন নবাগত ইংরেজি শিক্ষক রব; আলাপ-প্রেম-বিয়ে-সংসারে গড়ায় তাদের সম্পর্ক। কিছুকাল পরে দূরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায় জিহান। তার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না স্বামী রব। চারপাশে সে যেন কেবলই অনুভব করে জিহানের গায়ের গন্ধ। এ গল্পে পারিবারিক টানাপড়েন, স্মৃতিলগ্নতা, ইন্দ্রিয়চেতনার প্রখরতা বিবৃত হয়েছে একজন সমাজবিজ্ঞানির দৃষ্টিতে।
‘জলবেশ্যা’র প্রস্তুতিপর্ব দীর্ঘ হলেও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে সমস্ত পরিমণ্ডলটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং তা শেষের অভিযানটাকে প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য করে তুলেছে। তবে মিলনের অবস্থানে সাপের ঝুঁড়িতে পা-দেওয়া জলবেশ্যার পক্ষে এত অভ্যস্ত জিনিস না আকস্মিক এর দুর্ঘটনা? যে নির্লিপ্ততার সঙ্গে মিলনকাঙ্ক্ষী পুরুষটার সাপের ছোবল খাওয়া অচৈতন্য দেহকে জলবেশ্যা নিজের হাতে ও কাঁধে তুলে পুরুষটার নৌকাতে ফেলে দিল তাতে বস্তুতই মেয়েটার চারিত্রায়নে নতুন এক মাত্রা যুক্ত হলো। সমস্ত বিবরণটাই যথাযথভাবে কল্পনাসমৃদ্ধ। ‘মীর বাড়ির কুরসীনামা’য় লেখকের খুঁটিনাটির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি ও গ্রামীণ মুসলিম জীবনের পরিমণ্ডল রচনায় অভ্রান্ত কৌশল রাতটার যৌন-নৈপুণ্য ও তা অবলোকন করে এক অতৃপ্ত স্ত্রীর আফসোস ও কামনাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত করে তুলেছে। লেখকের মাস্টারি হাত এই দুই ধরনের যৌনতার উন্মোচনকে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক ও বিশ্বসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
‘পশুর নদীর গাংচিল’ গল্পে সুন্দরবন, ও পাশে নদী আর গাছ-গাছালির কোলে বেড়ে ওঠা চৌদ্দ বছরের কিশোরী ‘কর্পূর’ ও পনেরো-ষোল বছরের ‘রতনের’ জীবন-জীবিকার এমন একটি খণ্ডচিত্র চিত্রিত হয়েছে যা ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে ধারণা দানে যথেষ্ট। গল্পে জানা যায়, ‘গাঙ পাহারাওলা আর বাদাবনের জানোয়ার দুটোই তো এক জাতের।’ আরো এক শ্রেণীর মানুষ জানোয়ার হয়ে ওঠে। যারা জাহাজ ভিড়িয়ে কর্পুরের ছাগল তুলে নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চায় না। গল্পটি এখানে এসে মোড় নেয়। পরে কর্পুর ছাগলের দাম বাবদ প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছয়টি নতুন কম্বল নিয়ে নেমে আসে। কর্পুরের এই জাহাজে ওঠা এবং নামা নিয়ে আল মাহমুদ যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বস্তবগ্রাহ্য।
‘পাতার শিহরণ’ এবং ‘নিশি বিড়ালের আর্তস্বর’ গল্পে নারীর নারীত্ব ও মাতৃত্ব যুগপৎ প্রকাশিত। গল্পের সাধারণ কাহিনী অসাধারণ হয়ে উঠেছে আল মাহমুদের হাতে। বিশেষত নারীর চরিত্র ও মনস্তত্ব খননে কোনো ইঙ্গিত নয়, ডিটেলসের আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত বাস্তবতাকে মূর্ত করেছেন আল মাহমুদ। ‘নিশি বিড়ালীর আর্তস্বর’ গল্পে মা হোমায়রা অকস্মাৎ ঘুম ভেঙ্গে বেড়ালের বাচ্চার যে মিহি ডাক টের পান তার ক্রমশ বিস্তার ধরে গল্প এগিয়ে যায়। এবং পাঠকও এগিয়ে যান। শেষে মধ্যরাতে ড্রেনের ময়লা স্রোত থেকে মা মেয়ে দু’জনে বেড়ালের বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে। সকালের দিকে মেয়ে সেতু যখন বেড়ালের বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছে তখন তার ডাকে মা হোমায়রার ঘুম ভাঙ্গে না। এ-যেন সন্তান ফিরে পেয়ে এক মায়ের নিবিড় প্রশান্ত ঘুম।
উত্তম পুরুষে লেখা গল্প ‘গন্ধবণিক’ লেখকের আত্মজৈবনিক লেখা। কিন্তু আল মাহমুদ নিজে প্রকৃত শিল্পীর মতো শেষবধি নিজের লেখা থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যান এবং একটি দার্শনিক ধারণা মূল বিষয় হয়ে প্রতিষ্ঠা পায়। গন্ধবণিক লেখকের বাড়ি লাগোয়া নানা সম্পর্কের একজন প্রবীণ আতর বিক্রেতা। তিনি এক সময় সুখী, সম্ভ্রান্ত ও বিলাসী মানুষ ছিলেন। তাঁর সদালাপে মুগ্ধ ছিল মানুষজন। সুগন্ধ বিক্রয়ের সুবাদে তাঁর বন্ধুত্ব দাবি করতেন অনেকে। লেখকের মতে,
তার সুন্দর পকেট ঘড়িটা, আইভরির কলমদানী, স্ফটিকের ফুলদানী, হরিণের চামড়ার চশমার খাপ, কষ্টি পাথরের পেপারওয়েট, মৃগনাভি রাখার চন্দন কাঠের বকসো, রুপোর তৈরি জর্দার কৌটা আর সুগন্ধি চুরুটের মুখ কাটার চাকুটা হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে মহা আনন্দ পেতাম। (পৃষ্ঠা ৩৫)
গন্ধবণিকের বিষয় ও রুচির যে বর্ণনা আছে তাতে তিনি একজন বড় ধরণের মানুষ হয়ে ওঠেন পাঠকের কাছে। লেখক সে আয়োজন করেন গল্পে। এই গন্ধবণিক মারা যান যেদিন মাসিক বেতন পেয়ে লেখক নিজের বাড়িতে আসেন। স্মৃতিকাতর, ব্যথিত-দুঃখিত লেখক ওই গভীর রাতে স্ত্রীকে নিয়ে গন্ধবণিকের লাশ দেখতে যান। কী হলো সেখানে? কিছু হওয়ার চেয়ে হুইপ চালিয়ে পাঠকের মনে নতুন এক উপলব্ধি কেটে বসিয়ে দেন আল মাহমুদ।
মন্তু নানার মুখের দিকে ফিরে আঙ্গুল দিয়ে তার চোখের পাতি দুটি বন্ধ করতে একটু ঝুঁকতেই একটা উৎকট দুর্গন্ধের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়লো আমার নাকে। নাসারন্ধ্র দিয়ে বুকের ভেতর কুৎসিত গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। আমার নাভি মণ্ডলে অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে একটা বমির ভাব ছড়িয়ে পড়ল জিভে। মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার সর্বসত্তা অস্তিত্ব অসুস্থ, মুহ্যমান ও বিবমিষায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। (পৃষ্ঠা ৪২)
নিখুঁত এই অনুভূতি। মৃত মানুষ যে জীবিত মানুষের মতো আর মূল্য রাখে না—এই প্রভেদ গল্পে নৈপুণ্যের সাথে আল মাহমুদ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁর এ পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোর মধ্যে ‘গন্ধবণিক’ একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হিসেবে বিবেচিত হবে।
চার
আল মাহমুদের কথাসাহিত্যে কাব্যিক আবহ আছে; রয়েছে সৌন্দর্য আর প্রকৃতিনিবিড়তার ঘনিষ্ঠ ছবি। সমাজ—তার সমূহ উত্থান-পতন, মানুষের স্বপ্ন-আশাভঙ্গ আর প্রত্যাশার জাল তিনি তৈরি করেন দারুণ মমতায়। বর্ণনাকৌশলে তাঁর কাহিনী-কাঠামো পরিবার-কাঠামোরই এক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় যেন।

জীবনবোধের আধুনিক কবি

FB_IMG_1500338325778
জীবনবোধের আধুনিক কবি
ইমরান মাহফুজ |
‘‘আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনো দিনই বিহবল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!’’
পাঠাভিজ্ঞতায় দেখা যায় রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ। উপরে উল্লেখিত সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে সময় কালের বাংলাভাষার প্রধান কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শংকা।
এ ছাড়া যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়িত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায় কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকুলতা নির্মাণে তিনি নিঃশংসয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অন্যতম প্রধান কবি।
‘পঞ্চাশ দশকের আরো দুই উল্লেখযোগ্য কবি হচ্ছেন শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী। আল মাহমুদসহ এরা তিনজনই পৃথক, তবে ছন্দ প্রকরণে কেউ’ই তিরিশের ধারাকে অতিক্রম করতে পারেননি বা ভাঙতে পারেননি। এরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা কাব্যভাষা নিমার্ণ করেছেন। শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী শহুরে ভাষাকে কাব্যে প্রধান করেছেন। আল মাহমুদ এক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি লোকায়েত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামের চিত্র, পল্লীর সবুজ প্রকৃতি, বহতা নদীর উচ্ছ্বলতা, পাখির কলতান ও নারীর সৌন্দর্য তিনি চিরায়িত করে তুলছেন। এক্ষেত্রে তিনি জসীমউদ্দীন থেকে আলাদা। জসীমউদ্দীন যেখানে গ্রাম বাংলার বহু বিচিত্র রূপ ও জীবন যাত্রাকে বিপুলভাবে তুলে ধরেছেন আল মাহমুদ সেখানে আধুনিক জীবন যাত্রার বর্ণনাস্থলে পল্লী সৌন্দর্যেও নিখাত চিত্রকে প্রতীক হিসেবে তুলনাবাচক বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন।’
(আল মাহমুদের চিত্রকল্প: একটি প্রধান বিষয়/ হাসান আলীম)
আমরা দেখি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, “সমকালীন যে দুজন বাঙালী কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্রোপাধ্যায়।”
অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি। সমালোচকরা তার মৌলিকত্ব এবং নতুনত্ব দেখেছেন আল মাহমুদের ‘গাঁয়ে ফেরার পিপাসায়’ এবং ‘অনিবার্য শব্দ, উপমা, চিত্রকল্পে সে পিপাসার প্রকাশে’। পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং প্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন: এখন কোথায় যাওয়া যায়?/ শহীদ এখন টেলিভিশনে।/ শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।/ হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা/ আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।/ অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা:/ আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)
আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ন ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারো প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন :
“আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষীর বিষয়/ চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর/ কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন/ সীমাহীন মাঠ।/চাষীর বিষয় নারী।/ উঠৌনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।/পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।” (কবির বিষয়)
স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন‘ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন ‘সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।
“সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিনী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।”
আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থ-বিত্ত বা দেন মোহর কোনো কিছুই গুরুত্ব বহন করে না ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পংক্তিতে বিনয়ের উদার বটপাতায় ভেসে উঠেছে ভালোবাসার চিত্র। ‘সোনালী কাবিন‘ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষানীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙখার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র। এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে :
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল/ পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবেনা/ তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল/ জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা (সোনালী কাবিন)
কবি অতিত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়ণের সাথে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।
আল মাহমুদ নারী স্তনের সৌন্দর্য যেভাবে কল্পনা করেন : ‘শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি।’ তার পরেই আবার বলেন : ‘তোমার চোখ যেন/ রাজা মহীপালের দিঘী।/ আর বুক দুটি মিথুনরত কবুতর।’ অন্য কবিতায় একই বিষয়েকে কবি উল্লেখ করেন : ‘ইস্পাহানের হলুদ আপেল বাগান আমার হাতে দুলে দিয়েছে। তার সুপক্ক দুটি সোনালি ফল।/ তোমার ব্লাউজের বোতাম খোলো’
আল মাহমুদ এখানে স্তনের সৌন্দর্য উপমার চিত্র কল্পনা করেছেন : শঙ্খমাজা শ্বেতপদ্ম কলি, মাংসের গোলাপ, মিথুনরত কবুতর, সোনালি ফল ইত্যাদির সাথে। ফুটে উঠেছে শহরের আবহে লোকজ ঐতিহ্য। যেন কবি নগরের বুকে গ্রামীণ বাউল। অন্যদিকে নারী দেহের স্তনের বর্ণনা দিতে বিদ্যাপতি রাধিকার স্তনকে বলেছিলেন : “হেম কমলন জনি অরুণিত চঞ্চল।”
ঈশ্বরের সৃষ্টিতে নারী দেহের প্রধান সৌন্দর্য অঙ্গ তার যোনী। মধ্যযুগের অনেক কবি যোনীকে পুস্পের সাথে তুলনা করেছেন। আধুনিক কবি সৈয়দ আলী আহসান যোনীকে দ্বিদল ফুলের সাথে তুলনা করেছেন : ‘প্রাচ্নী কাব্যে উরু সংযোগ/ যেনবা অমোঘ দ্বিদল ফুল।’ সেই উপমায় কবিতা লিখা থেকে বাদ যায়নি আল মাহমুদও। তিনিও রমনী দেহের যোনীকেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন উপমায় শোভিত করেছেন। যেমন: ‘আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন/ লুকানো যায়না তবু অনিবার্য যৌবনের ফুলপ্রতীকের মত যেন জেগে থাকে তোমার জঘন।’
এ কবির কিছু ইসলামি ছাড়া প্রায় সব কবিতায় নারী দেহের সৌন্দর্য, উপমা ও যৌনতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নারী নিসর্গ প্রেম ভালবাসায় নিমার্ণ করেছেন নিজস্ব সৌধ। যেখানে তার উপমার তার সাথে চলে। আলোচকরা কবির কাব্য বিশ্লেষণে বের করে আনেন যে, মার্ক্সিস্ট থেকে ইসলামের বিশ্বাসী হয়েছেন আল মাহমুদ কিন্তু তারপরও তার কবিতায় দেখছি মাংসের গোলাপ, মিথুনরত কবুতর, ত্রিকোন কর্দম কারণ তিনি প্রথমত কবি শেষত ঐ কবিই। ষাটের মান্নান সৈয়দকে আমরা দেখেছি নারী নগ্নতার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবাতা ও আধ্যাত্মার কথা বলতে। একই দশকের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুনের কাম বিষয়ক কবিতার সমগ্রও পাঠকের নজরে এসেছে।
নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা, রম্যতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা অতি বাস্তব। এই বাস্তবতাকে উপমা-চিত্রকল্পে যথার্থ করা-শব্দের এবং চিত্রের অর্থ্ময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রনে সে তত বড় কবি।
কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ সাহিত্যের যে কোনো শাখায় নর-নারীর মিলনকে অস্বীকার করা যায় না। প্রসঙ্গে হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের প্রকাশ দেখে আমরা তাই আতঙ্কিত হলেও খুব্ধ হইনা :
It is I, you WOMEN, I make my way
I am stern acrid, undissubl, but I have you
I do not hurt you any more than is necessary for you
I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states
I press with slow rude muscle
I brace myself effectually. I listen to no entreaties
I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.
তখন আমরা মুগ্ধ হই এই ভেবে যে, মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে কবি বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন। আল মাহমুদ ‘সোনালী কাবিন‘ কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপুর্ব চিত্রায়ন পুর্বক আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে প্রজ্জ্বল করেছেন :
“তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী/ খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ/ শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি/তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।”
আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি তা আগেই বলা হয়েছে। একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হৃদয় সর্বদা সুন্দরের পুজারী। তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মান করেছেন।
তার উল্লেখিত রচনায় দেখি কবি করেছেন নারী সৌন্দর্য বন্দনা। আর আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্যময়। এক্ষেত্রে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্যাটি যথার্থ : “তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী। কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন।” (একজন খাটি কবি)
অন্যদিকে সাহিত্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে সহজ হলে আমাদের আল মাহমুদের সংসাওে প্রবেশ করতেই হবে
“ কবিতা কি?
কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি
কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’’
শুধু তাই নয়, কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাস। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কথাও স্মরণ করেছেন, আর সেই মৃত্যুচিন্তার অনুভূতিগুলো ফুটে উঠেছে বিদগ্ধ শব্দচয়নে।
“স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক/ অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপি-, আমার কি ভয়ের অসুখ?/ নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়! আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/ যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।”
কবির ৮০তম জন্মদিন ১১ জুলাই। দীর্ঘ অতীত পেরিয়ে কবি কি পেলেন আর কি হারালেন অথবা সময়ের বুকে কোন ভাবনায় দোল খাচ্ছেন? জানি তার কবিতা থেকে। কাব্য লেখায় নব্য আমি আর কিছুকাল/ আমার গেল ছেলেখেলায় সন্ধ্যা-সকাল এখন হাতের মুঠো খুলে দেখছি রে ভাই/ কেবল আছে আয়ুরেখা আর কিছু নাই।
ইমরান মাহফুজ : কবি ও সম্পাদক, কালের ধ্বনি। কো-অর্ডিনেটর অব দি ডেইলি স্টার বুকস।
http://m.poriborton.com/prints/9546

আল মাহমুদের কাব্য সৃষ্টির গরিমা

শুভ জন্মদিন
আল মাহমুদের কাব্য সৃষ্টির গরিমাFB_IMG_1500338325778
শহীদ ইকবাল
১১ জুলাই, ২০১৭
বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রখর প্রভাবিত, ভাটিবাংলার লোকায়ত প্রাণস্পন্দনের কবি আল মাহমুদ (জন্ম ১৯৩৬)। ‘তিতাস-ব্রহ্মপুত্র পারের জনজীবনকে উপলক্ষ করে সম্মোহনী লোকভাষা’ তাঁর কাব্যে স্থিতি পায়। তাঁর কবিতার বিষয় : লোকজ জীবনানুষঙ্গ, গ্রামীণ সংস্কার-মূল্যবোধ, মুসলিম ঐতিহ্য-পুরাণ। অসম্ভব আসঞ্জনমথিত ‘লোক লোকান্তর’ (১৩৭০)-এর কবিতাগুলো লেখা হয় ১৩৬১ থেকে ১৩৭০ সালের মধ্যে। এরপর ‘কালের কলস’ (১৩৭৩) ১৩৭০ থেকে ১৩৭৩ সালে।

এ দুটি কাব্যের জন্য কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে রচিত ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩), যেটি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রচিত। সোনালী কাবিন তাঁর সনেটগুচ্ছ। আল মাহমুদ এ তিনটি কাব্যেই বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সৃষ্টির গোড়া থেকে কবির দিব্যচেতনার শুলুকসন্ধানের প্রচেষ্টায় (তাঁর এগোনোর পথ, অনুকরণের পর্যায়, পাঠকনন্দিত হওয়ার ক্ষেত্র—অনুভাব্য ও অনুসরণীয় ক্ষেত্র। এবং অবশ্যই তা পরীক্ষণীয় ব্যাপারও।


আল মাহমুদ একটি দিব্যচেতনা নিয়ে ‘নদী’, ‘মেঘ’, ‘নারী’ রচনা করে চলেন। গ্রহণ করেন তাঁর ‘বন্দনা’র জগৎ। একই রূপে ‘ঝড়’, ‘অরণ্য’, ‘বৃষ্টি’, ‘রাত্রি’, ‘নৌকো’, ‘রক্ত’তে আরোপ করেন যৌনতা; তখন জীবনজয়ী রূপটি হয় চিহ্নিত, পরিবেশনায় আসে ভিন্নতা। কবিতা যাবতীয় বিষয়কে স্পর্শ করে। কবিস্বীকৃতিতে থাকে ‘কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল,/যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল’। নিত্যদিনের সময়সূত্রকে এভাবে কবি অর্পণ করেন অনিবার্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্ররোচনায়। এ ক্ষেত্রে কিছু আত্মমগ্নতা বা আত্মলীন অনুভবও স্মরণীয়তা পেতে পারে।
২.
আল মাহমুদ কালের কলস কাব্যে ‘কলস’কে প্রত্নপ্রতিমায়, পুরাণ রূপে প্রতিষ্ঠা দেন, পুরাবৃত্তটিতে আলো-অন্ধকার, জন্ম-মৃত্যুর পরিচর্যায় বিরাট ভূমিপুত্র রূপে জেগে ওঠেন। এখানে কবির ইঙ্গিতটি এতই গভীর ও নৃ-সংশ্লিষ্ট যে সেখানে শুধু জাগরণ নয়, সন্দেহ-বিশ্বাস-সংস্কার এক বীক্ষা লাভ করে। সেখানে ঐতিহ্যিক প্রবাহ, অভিজ্ঞতায় লালিত হলেও সর্বজনীন মুরতির স্বতঃপ্রবৃত্ত আকাঙ্ক্ষাটি কায়েমে আনেন।
আল মাহমুদ সোনালী কাবিনে অগ্রসর, আবেগ ঘনীভূত, চেতনায় স্বচ্ছ ও নিরঙ্কুশ। সদ্যঃস্বাধীন দেশে তাঁর কাব্যবিষয় ওই আবহাওয়া-জলবায়ুর পরিক্রমণে। সেখানেও সনেটে ফিরে আসে শৌর্য-বীর্যগাথা, পুরনো ইতিহাস, আবহমান আবেগসংখ্যার হিসাব। মৃত্তিকা-নারী-ভ্রূণাঙ্কুর, আর কুয়াশা-আলো-অন্ধকার, স্নেহ-মায়া-প্রেম-ভালোবাসা এ কাব্যে তীক্ষ�তর। তবে ‘সোনালী’ যৌবন কামার্ত বা জৈবিকতার আধার হয়ে আসে। লোকসংস্কৃতি-লোকসংস্কার, শারীরিক-সংসর্গ হয়ে ওঠে অভিন্ন দ্যোতনার সারথি। আল মাহমুদ সুন্দর নামে, চমৎকার কবিভাষ্যে আন্তর্ভৌম ও যৌক্তিক রূপটি সনেটের সীমায় অনুরুদ্ধ করেন।


কবির সনেটে এটি তুমুলমাত্রায় উত্তীর্ণ। সোনালী কাবিনে এ ছাড়াও পয়ারে বা মুক্তক প্রবর্তনার অনেক কিছু কায়েম হয়েছে। কিন্তু অনেক কবিতায় জৈবিকচেতনার পুনরাবৃত্তি আছে, সেটি ডিটেলে গেলে আর ওই পর্যায়ে থাকে না।


আমাদের চলমান জীবনপথের প্রতিবেশটি তখন অজ্ঞাতবাসে থাকে না। কবির সবচেয়ে আকর্ষণীয়, কবিতাধারায় অনুকরণ বা আনুকূল্যে নয় এমন উপাদানে যেমন তিনি পেয়েছেন উপকরণ, তেমনি আঙ্গিককেও নিয়েছেন স্বকীয়তায় মানিয়ে। বিশেষত, অবচেতন স্তরটিতে কবি পৌঁছেছেন আধুনিক প্রকৃত ও বাস্তবানুগ সিদ্ধিতে। আল মাহমুদের কবিতায় এ রীতি বেশিদিন বহাল থাকেনি। সেটাও কি তবে এক বাস্তবতার চাপ! এমন বড় কবি রূপে যিনি শিগগিরই স্বতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান—একটি একক কবিভাষার নির্মাণ গুণে; সেখানে তিনি কিভাবে ‘রমণীর প্রেম আর লাবণীসৌরভ’কে দ্বিতীয় করে তুললেন? অদ্বিতীয়, অখণ্ডে তো তাঁকে চায়-ই সবাই। তবে ‘খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি’র স্বপ্নটিকেও আমরা যেমন অস্বীকার করতে চাই না, তেমনি আগেরটিকেও না। আঙ্গিককে ভেঙে ছত্রখান করে কী লাভ! লোকায়ত পথিকৃৎ, যে স্বপ্নজাগর প্রহরের কবি, তাঁকে আরো—বানাতে বলতে চাই ‘কলসের সোনালী’ প্রতিকৃতি। বহুভাবে ও রকমে। এরূপ ধারাবাহিকতায় তাঁর অন্য কাব্য ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ (১৯৭৬), ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ (১৯৮০), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ (১৯৮৫), ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ (১৯৮৭), ‘প্রহরান্তের পাশফেরা’ (১৯৮৮), ‘এক চক্ষু হরিণ’ (১৯৮৯), ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ (১৯৯৩), ‘আমি, দূরগামী’ (১৯৯৪), ‘হৃদয়পুর’ (১৯৯৫), ‘দোয়েল ও দয়িতা’ (১৯৯৭), ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ (২০০০), ‘নদীর ভিতরে নদী’ (২০০১), ‘প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা’ (২০০৬), ‘তোমার রক্তে তোমার গন্ধে’ (২০১০), ‘সনেট সমগ্র’ (২০১৩) ও এমন আরো অনেক কাব্য ও কবিতা। তবে গল্প বা উপন্যাসে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ (১৯৭৫) বা ‘উপমহাদেশ’ (১৯৯৩) কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামগ্রিক শিল্পীসত্তার অভিবাদনে আল মাহমুদ কালোত্তরের পথিকৃৎ। তিনি চিরায়ুষ্মান হোন।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
shiqbal70@gmail.com

কবিতায় আল মাহমুদের মিথভাবনা


FB_IMG_1500338325778
কবিতায় আল মাহমুদের মিথভাবনা
কমরুদ্দিন আহমদ
বাংলা অভিধানে ‘পুরাণ’ শব্দটি ইংরেজি ‘myth’ অর্থে ব্যবহৃত। পুরাণ বা মিথ হলো -প্রাচীনকাল থেকে পুরম্নষানুক্রমে প্রবহমান কাহিনি। বিশেষ কোনো জাতির আদি ইতিহাস-সম্পৃক্ত বিশ্বাস, ধারণা ও নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা, অতিকথা, কল্পকথাকেই মিথ বা পুরাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাশ্চাত্যে গ্রিক সাহিত্যে এবং প্রাচ্যের সংস্কৃত সাহিত্যে মিথের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। গ্রিক ও হিন্দু পুরাণ মিথের সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। লৌকিক ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও নৈতিক কল্পকাহিনি মিথের অমত্মর্ভুক্ত। ইসলাম ধর্মে মিথের কোনো স্থান নেই। ইসলাম ধর্মের মৌলিক ভিত্তি পবিত্রমহাগ্রন্থ আল কোরান ও মহানবীর (দ.) হাদিস। পবিত্র কোরানে বর্ণিত নবী-রসুলের ঐতিহাসিক কাহিনি ও নৈতিকতার উদ্বোধক ঘটনার বর্ণনা মুসলমানদের পুরাণ ও মিথের অভাব পূর্ণ করেছে। আল মাহমুদের কাব্যে প্রাচীন ইতিহাস, গ্রিক ও হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনি, শ্রমজীবী কৌমসমাজের আদিম বিশ্বাস এবং পবিত্র কোরান-হাদিসের নৈতিক শিক্ষাবিষয়ক বর্ণনা মিথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে গ্রিক পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, বাংলা সাহিত্যের লৌকিক দেব-দেবীর কাহিনি এবং কোরান-হাদিসের নানা প্রসঙ্গ মিথ হিসেবে ব্যবহার করে আল মাহমুদ কাব্যবোধে নতুনত্ব আনয়ন করতে সমর্থ হয়েছেন।
বাঙালি শ্রমজীবী কৌমজীবনের প্রতীক হিসেবে মিথ আল মাহমুদের প্রথম পর্বের কাব্যগ্রন্থগুলোতে স্থান পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পু-্র, পুরীর গৌরব, গৌতম বুদ্ধ, শ্রীজ্ঞান, নচিকেতা, ঋত্বিক, মহাস্থানগড়, মহালিঙ্গ শীলভদ্র ইত্যাদির উত্তরাধিকার নিয়ে বহমান ইতিহাসের অস্তিত্বে তিনি কবিতাকে স্থাপিত করেছেন। কৌমজীবনের সমষ্টিবাচকতার মধ্যে জনচেতনার যথার্থ সৌন্দর্যকে প্রকট রূপে দেখেছেন আল মাহমুদ। যূথবদ্ধ জীবনচারিতা, নারীর অলংকার ও দেহনিঃসৃত বৈভবসত্তা তাঁর মিথিক্যাল উপজীব্য গড়ে তুলেছে। মিথের তাবৎ বিষয়কে কবি আধুনিক জীবনচৈতন্যে গ্রহণ করেছেন। নুহ নবীর কালে মহাপস্নাবনে সমসত্ম পৃথিবী জলের উৎসবে তলিয়ে গেলে মহাপস্নাবনের শেষে নুহ নবী একটি কপোত উড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য। তখন পুণ্যবান পুরম্নষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো -
পৃথিবীর চিহ্ন নিয়ে যদি ফেরে আশার কপোত
গভীর আদরে আমি তুলে নেবো ফসলের বীজ,
আলস্নাহর আক্রোশ থেকে যা এনেছি বাঁচিয়ে যতনে
আবার বুনবো তা-ই পুণ্যসিক্ত নতুন মাটিতে।
(লোক লোকামত্মর, ‘নুহের প্রার্থনা’)
এখানে জীবনজগতের আশাবাদী আধুনিক জীবনচৈতন্য অসাধারণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন কবি।
আল মাহমুদ ঐতিহ্যশাসিত বৃহত্তর গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতির আধুনিক রূপকার। তিনি কবিতায় মিথ ব্যবহারে একদিকে বৃহত্তর জীবনের শাশ্বত অংশের মুখের ভাষাকে মান ভাষার সঙ্গে ব্যাপক মুন্শিয়ানায় ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে সাহিত্যিক ঐতিহ্য পরিগ্রহণ করে অগ্রসর হয়েছেন, যা লোক লোকামত্মর থেকে সোনালী কাবিন পর্যমত্ম বিসত্মৃত।
আল মাহমুদ সোনালী কাবিনের পর কবিতায় দার্শনিকতার ক্ষেত্রে নিজস্ব জীবন ও ধর্মসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। সব মহৎ কবিই তা করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল সেই নতুন জীবন-চেতনার কাব্য। পরবর্তীকালে যা আরো সম্প্রসারিত হয়ে তাঁর কাব্যজীবনকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। এ-দেশ ও জনপদের হাজার বছরের ভারসাম্যের ইসলাম ও মুসলিম জীবনধারা, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য পরম্পরাবোধ এবং বিশ্বশিল্প রীতির সন্নিপাত ঘটেছে তার সোনালী কাবিন-পরবর্তী কাব্যধারায়। এ-পর্বে এসে কবি অনেক পরিমাণ ইসলামি মূল্যবোধ ও লোকপ্রতীক কথকতায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন। অথচ তাঁর কাব্য আবহ এ-পর্বে অধিক পরিমাণে দেশমৃত্তিকা-সংলগ্ন হয়ে উঠেছে। এসব সত্ত্বেও গ্রিক, রোমান পুরাণ থেকে শুরম্ন করে ‘ইশপের গল্প’ এবং ‘কত ধানে কত চাল’ ইত্যাদি লোকগল্প ও লোকশ্রম্নতি অকপট ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে প্রচুর সাহিত্যিক উপাদানও তিনি ব্যবহার করেছেন। মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কাব্যগ্রন্থের ‘সক্রেটিসের মোরগ সোনা’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ।
ইহুদীরা হাসুক,
তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।
ইহুদীরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর
মানুষ মানুষের ভাই।
(ইহুদিরা, অ.বা.রা.বা)
সম্পদের সুষম বণ্টন এখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নয়। এ-ব্যবস্থা ইসলাম ধর্মের সুষম বণ্টন, যা জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এ-প্রসঙ্গে ‘গিফারীর শেষ দিন’ কবিতাটি উলেস্নখযোগ্য :
আমি কৃষণ ছায়া সঙ্গিনী তোমার, হে গিফারী। সেই কালো খাপ, যাতে প্রবিষ্ট ছিলে ঈমানের তীক্ষন তরবারি তুমি। সোনা ও চাঁদির পাহাড় নির্মাণকারীদের বিরম্নদ্ধে তুমি ছিলে পবিত্র কোরআনের তুফান। আমি বাতাসের বেগ নিয়ে তোমার ঝড়কে চুম্বন করি প্রিয়তম।
উমাইয়াদের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরম্নদ্ধে প্রচ- প্রতিবাদকারী আবুজর গিফারীর অমত্মরের ঘৃণা নিয়ে কবি দাঁড়াতে চান ইহুদি পুঁজির বিরম্নদ্ধে।
আল মাহমুদের ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘নীল মসজিদের ইমাম’, ‘গিফারীর শেষ দিন’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘ইশপের কাছিম’, ‘জুলেখার আহবান,’ ‘ইউসুফের উত্তর’, ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘খনার বর্ণনা-সনেট পঞ্চক’, ‘তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’ ইত্যাদি কবিতা কবিদের নতুন করে বিশ্বাস, মিথ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ভাবার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। উলেস্নখ্য, কবিতাসমূহে কবি আল মাহমুদ পুরনো মূল্যবোধকে নতুন করে গড়ার চিমত্মায় শৈল্পিক প্রপঞ্চ তৈরি করতে চেয়েছেন। ‘ইউসুফের উত্তর’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ইত্যাদি কবিতায় পুরনো লেজেন্ড ভেঙে নতুন লেজেন্ড তৈরি করেছেন, যা সমসাময়িক কবিদের চিমত্মার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। মিথ্যাবাদী রাখালের বাঘ-বাঘ বলে চিৎকারে ‘মৃত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী - হুঁশিয়ার’। - এমন মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অসাধারণ দর্শন এবং জুলেখার আহবানের বিপরীতে ইউসুফের উত্তরে : ‘কাম যুক্তিহীন বটে কিন্তু জেনো পুণ্যের সাধনা কারো, সেও যুক্তিহীন। কোনদিন মানেনি নিয়ম - আমিও মানব না।’ - ইউসুফের এমনি চারিত্রিক দৃঢ়তার পর ইউসুফ যখন বলেন - ‘সিন্দুকের তালা কি কোনদিন খেয়ে ফেলে সংরক্ষেত সোনার দিনার?’ তখন ইউসুফের চরিত্র ও আমানতদারির যুক্তির কাছে পৃথিবীর সকল রূপ ও লালসার আগুন নিভে যায়।
কবি কোরান-হাদিস ও ইসলামি আদর্শের কথা বললেও তা কখনো মানবজীবনের বাসত্মবতা এবং লোকজীবনের আদর্শবাদিতাকে অস্বীকার করেনি, বরং বাসত্মববাদিতা ও লোকজীবনকে অবলম্বন করেছে। সোনালী কাবিন-পরবর্তী কবির মিথিক্যাল চিমত্মা এভাবে নিজস্ব ও দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর শ্রেয় বিশ্বাস ও নৈতিকতাকে ধারণ করেছে।
আল মাহমুদ জীবনের ও প্রকৃতির উপত্যকা পরিভ্রমণ শেষে বস্ত্তভারপীড়িত প্রতিকারসম্ভব প্রকল্পনায় নিঃসঙ্গের অভিযাত্রিক কবিসত্তার শেষ গমত্মব্য নির্ধারণ করেছেন আধ্যাত্মিকতায়। সোনালী কাবিনের পর পরিবর্তিত চৈতন্যে তিনি এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে কাব্যামত্মর্গত করেছেন। এতে পূর্বতন সমষ্টিবাচকতা নতুন মাত্রায় পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর আধ্যাত্মিকতার মিথ অ্যালিগরির বৈশিষ্ট্য নিয়েও একামত্ম প্রাতিস্বিক নিজস্ব দৃষ্টিকোণের মাত্রা দ্বারা উদ্বোধিত হলেও বিশাল এক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের মুগ্ধতার চারপাশে সকল মানুষের ঐকতাকে প্রকাশ করেছে।
মিথ বা পৌরাণিক প্রসঙ্গ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের সামগ্রী কবিতার শিল্পগুণকে বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকপুরাণ, ধর্মীয় পুরাণ, ধর্মীয় নৈতিক কাহিনি, পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে নতুন মূল্যবোধ তৈরিতে কবি আল মাহমুদ অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
আমরা ‘আবহমান বাংলাকাব্যে আল মাহমুদ’ প্রবন্ধে কবির কাব্যগ্রন্থগুলোর একটি দীর্ঘ বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করেছি। তিনি সেই কবি যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে কবিতায় উন্মুখ করে তুলেছেন। কৌমসমাজের আধি সাম্যবাদী চেতনা ও নারীর মাহাত্ম্য দিয়ে শুরম্ন করলেও ধীরে-ধীরে তিনি পরিপূর্ণ ও মহৎ কবি হয়ে উঠেছেন। একজন মহৎ কবি হতে কবিতায় যে ধরনের মেধা, শ্রম ও প্রকরণের নতুনত্ব দিয়ে নিজেকে অপরিহার্য কবি হিসেবে উপস্থাপন করতে হয় - তা তিনি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
সহায়কগ্রন্থ
১. সাহিত্য সন্দর্শন, শ্রী শ্রীশচন্দ্র দাশ।
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, মুহাম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান।
৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম।
৪. কবিতা সমগ্র, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।
৫. শ্রেষ্ঠ গল্প, আল মাহমুদ, আদর্শ প্রকাশন।
৬. শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।
৭. প্রবন্ধ সমগ্র, আল মাহমুদ, নিউ শিখা প্রকাশনী।
৮. কবির আত্মবিশ্বাস, আল মাহমুদ, অনন্যা প্রকাশন।
৯. উপমা, আল মাহমুদ সংখ্যা, সম্পাদনায় মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন ।
১০. পুবাকাশ, পয়োটিক্স, চট্টগ্রাম, সম্পাদনায় মীজান রহমান ও মাঈন উদ্দিন জাহেদ।
১১. বাংলাদেশের কবিতা : লোকসংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব, অনু হোসেন।
১২. বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব, মাসুদুল হক।
১৩. বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প, সরকার আমিন।
১৪. আধুনিক কবিতা : প্রাসঙ্গিক বিবেচনা, কমরম্নদ্দিন আহমদ।
১৫. আল মাহমুদের কবিতা : বিষয় ও শিল্পরূপ, ড. ফজলুল হক তুহিন।
কালি ও কলম | সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা http://www.kaliokalam.com/কবিতায়-আল-মাহমুদের-মিথভা/