বসন্তকালীন দুর্গাপূজোকে বর্ণ হিন্দুরা পিছিয়ে এনে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দূর্গাপূজার প্রচলনের মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন।
দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস হিসেবে পালন করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা ।
পলাশীর পর মুসলমানদের সম্পত্তি লুন্ঠন করে ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ ।
সূফি বরষণ
মুসলমানদেরকে ষড়যন্ত্র মূলক ভাবে পরাজয়ের পর মুর্শিদাবাদ থেকে শাসনকেন্দ্র কলকাতায় স্থানান্তর হয় ১৭৬৮ সালে। ১৭৭৩ সালে দ্বৈত শাসন অবসানের সাথে সাথে কলকাতা ইংরেজদের ভারত-রাজত্বের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৭৭৪ সালে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধন করেন। এ সময়ই তিনি কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। তখনো কলকাতা ছিল গঞ্জ। তারপর কলকাতা হলো বন্দর। ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচারের সদরঘাট ছিল এই কলকাতা বন্দর। বন্দর থেকে ক্রমে বিকশিত হলো বন্দরনগরী। এভাবেই সারা বাংলা সম্পদ শোষণ করে বেড়ে উঠল কলকাতা মহানগরী।
এই হাঠাৎ বেড়ে ওঠা কলকাতার অতীত সম্পর্কে স্বরূপচন্দ্র দাস লিখেছেনঃ “পূর্বকালে ও নগর নবদ্বীপাধীন এক ক্ষুদ্র গ্রামমাত্র ছিল। তাতে অনেক দূর পর্যন্ত ছিল বন-জঙ্গল। এই স্থানে ১০ কিংবা ১২ ঘর কৃষিজীবী গৃহস্থ বাস করত”। (দি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৯)
নিশীথরঞ্জন রায় জানাচ্ছেনঃ “জলাজঙ্গল সমাকীর্ণ অঞ্চলের আদি অধিবাসী ছিল জেলে, শিকারি, শবর প্রভৃতি তথাকথিত জাতির নর-নারী”। (ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭৭)
এই গ্রাম-কলকাতার পাশে গোবিন্দপুর গ্রামের পত্তন করেছিল চারটি বসাক ও একটি শেঠ পরিবার। তার পাশেই সূতা ও কাপড়েরন বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুতানুটি। এই গোবিন্দুপুর-ডিহি কলকাতার-সুতানুটি গ্রাম তিনটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে ১৬৯৮ সালে সাবর্ন চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল। তারপর পাঁচ বছর ধরে সেখানে উইলিয়াম দুর্গ তৈরি করেছিল। (ভারতকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২০৯)।
পলাশীর পতনে তাৎক্ষণিকভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ-চেতনা শাণিত হয়ে উঠতে বিলম্ব হয়নি। ১৭৬৩ সালেই শাসক মীর কাসিম জাতির সর্বনাম সম্পর্কে সম্বিত ফিরে পেয়ে তলোয়া র কোষমুক্ত করেছিলেন। আর একই সময়ে জনতার কাতার থেকে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছিলেন কৃষক বিদ্রোহের অমর নায়ক ফকীর মজনু শাহ। ইংরেজরা বাংলার সাবেক শাসক জাতির ব্যাপারে একদিনের জন্যও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। লর্ড ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মুসলমানরা সব সময়ই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। সাফল্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে জানলেই তারা সাথে সাথে তা সংঘটিত করবে”। (Selections from Unpublished Reords of Govt……1784-67; James Long, 1973, P-202)
কলকাতার পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদী অভ্যন্তরীন ও বহির্বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। তার চাইতেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কলকাতার গুরুত্ব ছিল এ দেশের শাসকদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করার চমৎকার আশ্রয়কেন্দ্ররূপে। জোব চার্ণক হুগলি থেকে পালিয়ে গিয়ে এই স্যাঁতস্যাতে মাটি ও জঙ্গলাকীর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নদীপথে সাগরে পালিয়ে গিয়ে জান বাঁচানোর জন্যও এই কলকাতা ছিল তুলনাহীন। শক্তিশালী সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা তাদের চার পাশে দাঁওবাজ দালালশ্রেণীর দ্বারা গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য ‘মানব বন্ধনী;। ইংরেজদেরকে অবলম্বন করে কলকাতাকে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিরূপে অবিশ্বাস্য রকম দ্রতগতিতে বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রণীর বিকাশ ঘটেছিল। বস্তুত দেড় শতাধিক বছর ধরে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বর্ণহিন্দুরা শোষণ-সাফল্যের একেকটি স্তর উতরিয়ে উঠে গেছে একবারে শীর্ষদেশে, আর তাদের উত্থান-আরোহণের কার্যকরণরূপে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার গরিষ্ঠ মুসলমান প্রজাসাধারণ পতনের একটি পর একটি ধাপ গড়িয়ে নেমে গেছে অধঃপাতের অতল গভীরে। একদিকে শোষক-ধনিক-জমিদার বর্ণহিন্দুদের উত্থান, অন্যদিকে বাংলার কৃষক-প্রজা মুসলমানদের পতন, এই দু’য়েরই মধ্য-বিন্দুতে কলকাতা।
কলকাতার লেখক ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ইংরেজদের সাথে সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর লড়াইকে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়গণ হানাদার আর্যদের আগ্রাসন দীর্ঘদিন পর্যন্ত রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের মুখে বারবার পর্যদস্ত হয়েই আর্যরা এ এলাকার দ্রাবিড় জনগোষ্ঠকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করেছিল। আর্যরা ‘দেবতা’ আর দ্রাবিড়রা ‘অসুর’। এই ‘অসুর’ পরিচয়েই আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ দীর্ঘদিন আর্যদের কাছে পরিচিত হয়েছেন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই প্রাচীন আর্যদের অধস্তন পুরুষ ভবানী চরণ বাংলার নতুন যুগের প্রতিরোধ সংগ্রামের বীর নায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ‘অসুর’ আখ্যায়িত করেছেন। তাদের চোখে পলাশীর ‘দেবতা’ হলো ইংরেজরা।
ভবানীচরণরা সিরাজকে ‘অসুর’ আর ইংরেজকে ‘দেবতা’ বলেই থেমে যাননি। মুখের কথার সাথে বাস্তব কাজের নমুনাও পেশ করেছেন। পলাশী যুদ্ধের ক’দিন পরই তারা পলাশীর দেবাসুর সংগ্রামের উপজীব্য করে বাংলায় শারদীয় দূর্গাপুজা প্রথম চালূ করেন। এর আগে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। শ্রীরাধারমন রায় ‘কলকাতার দুর্গোৎসব’ নামক এই প্রবন্ধে লিখেছেন, দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস’। ‘পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎসব’ হিসেবেই এই পূজা ১৭৫৭ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নদিয়া ও কলকাতায়। এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘পলাশী বিজয়ী’ লর্ড ক্লাইভের সংবর্ধনা।
রাধারমণ রায় লিখেছেনঃ “১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুন ইংরেজ ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যাঁরা উল্লাসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তাঁরা হিন্দুদের জয় বলে মনে করলেন। ধুর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেরকমই বোঝালেন। ক্লাইভের পরামর্শেই তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়োজন করলেন। বসন্তকালীন দুর্গাপূজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে- ১৭৫৭ সালেই তাঁরা বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দূর্গাপূজার মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপর ফি বছর শরৎকালে দুর্গাপূজো করে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন। …… শোনা যায়, শরৎকালীন দুর্গোপূজো যে-বছর প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দু’জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচা করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। …… আগে এদেশে বসন্তকালে চালূ ছিল দুর্গাপূজো আর শরৎকালে চালূ ছিল নবপত্রিকাপূজো।
দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মুর্তির ব্যাপার, আর পবপত্রিকা পূজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নটি উদ্ভিদের ব্যাপার। পরে এই দু’টি ব্যাপারকে গুলিয়ে একাকার করে ফেলা হয়েছে। ১৭৫৭ সাল থেকে নবপত্রিকা হয়েছেন দুর্গা। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজার বোধনের দরকার হয়। আর আগে নবপত্রিকা পূজো করে পুরো দুর্গাপূজো করতে হয়। …… তাহলে দাঁড়ালো এই : ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করার জন্য বসন্তকালের দুর্গাপূজোকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকাপূজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাঁদের উৎসাহিত করেছিলেন ক্লাইভ। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলেন, তার প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজো অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপরিষদ উপস্থিত। ………. নবকৃষ্ণের পুরনো বাড়ির ঠাকুর দালানটি তৈরি হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। খুবই তড়িঘড়ি করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। … দুর্গাপূজোর চাইতেও ক্লাইভকে তুষ্ট করা ছিল নবকৃষ্ণের কাছে বড় কাজ। …. তিনি ভালো করেই জানতের, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রিস্টান, মনে মনে মূর্তি পূজোর ঘোর বিরোধী। অতএব স্রেফ দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে ক্লাইভের মন ভরানো যাবে না, এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভে জন্যে বাঈ নাচের, মদ-মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই একই সময়ে একই উঠানের একপ্রান্তে তৈরি করেছিলেন ঠাকুরদালান, আকে প্রান্তে তৈরি করিয়াছিলেন নাচ ঘর।…. নবকৃষ্ণর কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ, ক্লাইভ-ঠাকুরই ছিলেন আসল লক্ষ্য। দুর্গাপূজোর নামে তিনি ক্লাইভ পূজো করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় শরৎকালীন দুর্গোৎব প্রবর্তনের সময় নবকৃষ্ণ সাহেবপূজোর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পরে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপূজো উপলক্ষে সাহেব পূজো নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা আরস্ভ হওয়ায়”। (রাধারমণ রায় : কলকাতা বিচিত্র, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৮; দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২১ ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা)
পলাশীতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে এই উৎসব কেন? এ বিজয় কার বিজয়? তার জবান ভবানীচরণের জনানীতেই পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়, পলাশীর লড়াইয়ের ফলে উঠে এসেছে ‘হর্ষের অমৃত’ আর ‘বিষাদের হলাহল’। ‘হর্ষের অমৃত’ পান করে কলকাতা হয়েছে ‘নিরুপমা ও সর্ব্বদেশখ্যাতা’। কিন্তু ‘বিষাদের হলাহল’ কাদের ভাগ্যে জুটল, সে কথা কিছুই বলেননি ভবানীচরণ। ‘দেবাসুর’ সংগ্রামের ‘বিষাদের হলাহল’ গিলতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদ আর ঢাকা শহরকে।
ভবানীচরণ লিখেছেনঃ “ধার্ম্মিক, ধর্ম্মাবতার, ধর্ম্ম-প্রবর্তক, দুষ্ট নিবারক, সৎ প্রজাপালক, সদ্বিবেচক ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর” এই দেশের লোকদের “অধিক ধনী হওনের অনেক পন্হা’ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ইংরেজ তাই দেবতা। ক্লাইভ ‘মা দুর্গার প্রতীক’। এই দেবতার পূজা করেই পলাশী-উত্তর কলাকাতাকে কেন্দ্র করে রাতারাতি একটি লুটেরা শ্রেণী রাজা-মহারাজায় পরিণত হয়েছিল। ভারত সরকারের জাতীয় মহাফেজখানার ১৮৩৯ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে গবেষক বিনয় ঘোষ সেকালের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবানদের একটি তালিকা সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ তুলে দিয়েছেন ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ নামক বইতে। এই পরিবারগুলো শহর কলকাতার ‘প্রাতঃকালীন গাত্রোত্থানের’ সাথে যুক্ত। তাদের কয়েকজন হলেনঃ
১. মীর জাফরের নবাবী আমলের ক্লাইভের দেওয়ান নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাপা রামকৃষ্ণ বাহাদুর, ২. নবকৃষ্ণের ভাতিজা বাবু গোপীমোহন দেব, ৩. কর্ণেল ক্লাইভের বেনিয়ান লক্ষীকান্ত ধরের উত্তর পুরুস রাজা রামচন্দ্র রায়, ৪. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন-বৃত্তির কুখ্যাত সহযোগী মল্লিক পরিবার, ৫. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর রাজস্ব বোর্ডের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের নাতি বাবু শ্রীনারায়ণ সিংহ, ৬, গভর্নর ভান্সিটর্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ান রামচরণ রায়ের উত্তর পুরুষ আন্দুলের রায় বংশ, ৭. ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ান ও পরে সন্দীপের জমিদার গোকুল চন্দ্র ঘোষালের প্রতিষ্ঠিত খিদিরপুরের গোকুল পরিবার, ৮. হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর পরিবার, ৯, ঠাকুর পরিবারের ‘জুনিয়র ব্রাঞ্চ’ বা ‘নবীন’ শাখা নামে পরিচিত এবং কোম্পানি সরকারের এজেন্ট,পরে ২৪ পরগনার কালেক্টর ও নিমক এজেন্টের সেরেস্তাদার থেকে নিমক মহলের দেওয়ান ও স্বল্পাকালীন কাস্টমস-সল্ট-ওপিয়াম বোর্ডের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের (জন্ম ১৭৯৪) পরিবার। ‘কার ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা দ্বারাকানাথের প্রভাব প্রতিপত্তির কোন প্রতিদ্বন্দী তাঁর সমসাময়িককালে ছিল না। দ্বারকানাথে ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই আমলের অন্যান্য অভিজাত পরিবার হলো- ১০. সুতানুটি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ পরিবার,
১১. মেসার্স ফেয়ারলি এন্ড কোং-এর দেওয়ান রামদুলাল দে, ১২. ভুলুয়া (নোয়াখালি) ও চট্টগ্রামের নিমক মহলের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস, ১৩. পাটনার চিফ মি. মিডলটন ও স্যার টমাস রামবোল্ড সাহেবের দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, ১৪. কোম্পানির আমলের কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরামের পরিবার, ১৫. কুমারটুলির মিত্র পরিবার, ১৬. কোম্পানির ঠিকাদার গোকুল মিত্রের পরিবার, ১৭. পামার কোম্পানির সরকার গঙ্গা নারায়ণ, ১৮. পাল চৌধুরীর পরিবার, ১৯. কুলীন ব্রাহ্মণ ব্যানার্জী পরিবার, ২০. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সরকার রামলোচনের প্রতিষ্ঠিত পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবার, ২১. ক্লাইভের দেওয়ান কাশীনাথের পরিবার, ২২. কোম্পানির হুগলীর দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবার, ২৩. কোম্পানি সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ঠিকাদার ও কয়েকজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর বেনিয়ান এবং মেসার্স মুর হিকি এন্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীলের প্রতিষ্ঠিত কলুটোলার শীল পরিবার, ২৪. এককালের লবণের গোলার মুহুরূ বিশ্বনাথ মতিলালের পরিবার, ২৫. ঠনঠনিয়ার ঘোষ পরিবার, ২৬. মেসার্স ভেভিডসন এন্ড কোম্পানির এককালের কেরানী রসময় দত্তের প্রতিষ্ঠিত রামবাগানের দত্ত পরিবার, ২৭. পাটনার কমার্শিয়াল রেসিডেন্টের দেওয়ান বনমালি সরকারের প্রতিষ্টিত কুমারটুলীর সরকার পরিবার, ২৮. আফিমের এজেন্ট হ্যারিসনের দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত বাগবাজারের মুখার্জী পরিবার, ২৯. বেনিয়ান রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার, ৩০. বিভিন্ন বিলাতি কোম্পানির সাথে যুক্ত গঙ্গাধর মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নিমতলার মিত্র পরিবার”। (টাউন কলকাতার কড়চা, পৃষ্ঠা ৭৭-৮৮)
এই অভিজাত পরিবারগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেন,
“কেউ বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়ে, কেউ সর্দারী-পোদ্দারী করে, কেউ দাদানী বণিক ও দালাল হয়ে, কেউ বেনিয়ানী করে, কেউ বা ঠিকাদারি করে, কেউ বা ঠিকাদারি ও স্বাধীন ব্যব্সা-বাণিজ্য করে, কলকাকাতার নতুন শহুরে সমাজে নতুন বড় লোক হয়েছিলেন। সেকালের নবাবী আমলের বড়লোকরা নবযুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে একেবারে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। কোম্পানির আমলে যাঁরা নতুন বড়লোক হলেন তাঁদেরকে এক পুরুষের বড় লোক বললে ভূল হয় না”। (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১০৩)
উপরের তালিকার ‘এক পুরুষের বড় লোক’ ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি হিন্দু। তাদের অধিকাংশই উচ্চ-বর্ণজাত। মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পরের এ তালিকা! অথচ এতে একটিও মুসলিম পরিবারের নাম নেই। এখানেও ‘চিরায়ত ঐতি্যের বিব্রতকর অনুশীলন! পাল, সেন, তুর্কী, পাঠান, মোগল শাসনামলে সকল উত্থান-পতনের রাজনৈতিক বিবর্তনে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-উচ্চবর্ণ হিন্দুর এই সম্মিলিত শক্তিই শাসন-যন্ত্রের ছত্র-ছায়ায় সমাজে একটানা প্রাধান্য বজায় রেখেছে। ইংরেজ শাসনেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না।
কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীকে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানর কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।
সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিল, তাহারা এবং মার্ক্সের ভাষায় ‘শহরের চুতর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে….. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি…. এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরের অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়। দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য।….. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন ……. (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)
এই লুটেরা শ্রেণীর হাতে পলাশী-উত্তরকালে তাদেরই রুচি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল কলকাতা। সে কারণেই স্বাধীন মেজাজে মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সোনারগাঁও, গৌড়, ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদের সাথে কলকাতার কোন মিল ছিল না। একদিকে ইংরেজ কোম্পানির রাইটার-ফ্যাক্টর-সেমি মার্চেন্ট প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর ইংরেজ কর্মচারী, অন্যদিকে তাদের লুণ্ঠন-সহচর দালাল শ্রেণী। তাদের হাতে বেড়ে ওঠা কলকাতায় জন্ম নিল এক নতুন সংস্কৃতি, যার নাম বাবু কালচার।
কলকাতার ‘বাবু’ সম্পর্কে জে. এইচ ব্রুমফিল্ড তাঁর গ্রন্হ ‘এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ প্লুরাল সোসাইটি’-তে লিখেছেন:
“Babu : In Bengali a title of respect for an English speaking Hindu. Applied derogatorily by the British to semi educated Bhadralok and by extension to any Bhadralok”.
‘বাবু’ শব্দটি কোম্পানির শাসনের জন্ম-স্থিতি-বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করে আবুল কাশেম চৌধুরী লিখেছেনঃ
“ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে যখন স্বাধীনতা দ্রুত অপসৃয়মান, বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ কুটীর শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও বহির্বাণিজ্য, তখনই এই সামাজিক বিকলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এই বাবু সমাজ ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আনুকূ্ল্যে।,,,,, কালো পথে উপর্জিত বাবুদের অঢেল টাকা শেষ পর্যন্ত গাতানুগতিক ভূমিমুখীন অর্থনীতিতে আটকা পড়ে এবং তার কারণে সমাজকে বিসর্জন দিতে হয় সম্ভাব্য গতিশীলতা”। (বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নকশা, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা : ৭২)
এরূপ অনেক ‘ব্ল্যাক জেমিনদার’ বা ‘ক্যালকাটা বাবু’ দুই, চার, পাঁচ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে সে যুগের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিল। রাম দুলাল দে পাঁচ টাকা বেতনের সরকার হিসেবে জীবন শুরু করেন। ১৮২৫ সালে মৃত্যুর সময় কলকাতা শহরে তিনি রেখে গেছের উনিশটি বিশাল বাড়ি, আর সে আমলের পৌনে সাত লক্ষাধিক টাকার সম্পদ। কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটু বাবুরা ছিলেন তারই সন্তান। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল পুরাতন শিশি-বোতলের কারবার দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। আট টাকা বেতনের চাকরি শুরু করে রামকমল সেন মৃত্যুর সময় নগদ রেখে যান দশ লাখ টাকা। হেস্টিংস-এর মুৎসুদ্দীগিরি করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাসিমবাজারের রাজপরিবার, যার বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ টাকা। (সিরাজুল ইসলাম, সূর্যাস্ত আইনের সামাজিক তাৎপর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, আষাঢ়, ১৩৮৫)
এই কালো টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ‘চতুর ও বুদ্ধিমান’, শঠ ও প্রবঞ্চক’, এবং ‘হাজার রকম প্রতারণা-কৌশলের উদ্ভাবক’ রূপে। টাকা-পয়সা উপার্জনে তারা যে অভিনব ব্যবসায়িক কৌশলের অবলম্বন করত তা প্রকাশ্য দস্যুতার শামিল। অন্যদিকে সেই লুণ্ঠিত সম্পদ খরচ করার ব্যাপারেও তারা ছিল বেহিসাবী। নানা প্রকার ‘বাবু বিলাস’ তখনকার কলকাতায় চালূ হয়েছিল। বাইজী-চার্চ থেকে শুরু করে বুলবুলির লড়াই, টিকটিকির নাচ পর্যন্ত অনেক কিছুই ছিল তাদের বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের উপাদন। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ এমনকি গৃহ প্রবেমের মতো মামুলি উপলক্ষকে অবলম্বন করে তারা আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ তার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে সে যুগের প্রায় কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছিল। তার নাতি লালা বাবুর ‘অন্নপ্রাশন’ উপলক্ষে সোনার পাতে দাওয়াত ছেপে বিলি করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে তার ঘরে ‘পুরাণ’ পাঠ করে গঙ্গাধর শ্রীমানী নামক জনৈক ব্রাহ্মণ পারিতোষিক পেয়েছিল হাতী, ঘোড়া ও সুসজ্জিত পাল্কি। আশুতোষ দেবের মায়ের শ্রাদ্ধ আর দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাপের শ্রাদ্ধ সেকালের কলকাতার বাবু-বিলাসের একেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সারা বাংলায় তখন চলছিল ইংরেজ ও তাদের দোসর এই কলকাতা-বাবুদের লুণ্ঠন-শোষণ। ইজারা চুক্তি, সূর্যাক্ত আইন, ব্যবসায়ের নামে লুটপাট প্রভৃতির ফলে একদা-সমৃদ্দ পল্লীবাংলায় দোজখের আগুন জ্বলছিল। উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষে পল্লী বাংলার প্রতি ষোল জনে পাঁচ জন লোক মারা গিয়েছিল। বাংলার পুরনো শহরগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষের গোশত খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছিল। দেশের শিল্প-অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্বাস নিংড়ে নিয়ে কোটি মানুষের রক্ত পান করে কলকাতায় তখন চলছিল এই প্রমত্ত বাবু-বিলাস।
এভাবেই কলকাতা বেড়ে উঠল। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণ-হিন্দুরা লুণ্ঠন-শোষণের বর্ণনাতীত নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল এবং এভাবেই উনিশ শতকের আশির দশকের মধ্যে তারা ‘সবকিছু উজাড়ভাবে আত্মসাৎ করে’ নিজেদের মধ্যে ‘নব জাগরণ’ সৃষ্টি করল।
কলকাতার এই নবশক্তির উত্থান সম্পর্কে স্বপন বসু লিখেছেনঃ ‘উনিশ শতকে বাংলায় শ্রেণীবিশেষের মধ্যে যে সব চেতনা জাগ্রত হয়েছিল তার প্রায় সবটাই সীমাবদ্ধ ছিল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলমান সমাজে এ-নব চেতনার ছোঁয়া লাগল না কেন?” (বাংলায় নব চেতনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২০৭)
স্বপন বসুর বক্তব্যেই এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ
“মুসলমান নবাবের হাত থেকে ইংরেজ যেদিন বাংলা অধিকার করে নিল, মুসলমান সমাজের অবনতির সূচনা তখন থেকেই। নবাব পরিবার এবং তাকে কেন্দ্র করে মর্শিদাবাদের যে মুসলমান অভিজাত-মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল ইংরেজ রাজত্বে তাদের প্রতিপত্তির অবসান ঘটল। সম্ভ্রম বজায় রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে তারা পাড়ি জমালেন দিল্লী বা পারস্যে। …. রাজধানীও মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানন্তরিত হলো কলকাতায়- ফলে মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ১৫% হ্রাস পেল। নবাবী আমলে অধিকাংশ উচ্চ পদই ছিল মুসলমানের অধিকারে, ইংরেজ আসার পর শাসন-ব্যবস্থা পুরো পাল্টে গেল। মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজ রাজ্য অধিকার করেছিলেন, সেই কারণে মুসলমাদের ইংরেজরা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। এদেশে আসার অল্পদিন পরেই রবার্ট ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে বিন্দুমাত্র সম্বাবনা আছে জানলেই তারা তা করবে। … সামরিক বাহিনীতে যেসব মুসলামান উচ্চ পদে বহাল ছিলেন সহসা তারা অনুভব করলেন, তাদের দিন শেষ হয়েছে। সামরিক বিভাগের উচ্চ পদগুলো ইংরেজদের করতলগত হলো। অন্যান্য দায়িত্বশীল পদে যেসব মুসলমান ছিলেন তাদের প্রভাব দ্রুত কমতে লাগল। ১৭৮১-তে মাগল ফৌজদারদের পদগুলোতে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলো”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৮)
সাধারণভাবে পল্লী বাংলার মানুষ, আর বিশেষভাবে বাংলার মুসলমান জনগণ যখন লুণ্ঠন-শোষণের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন ‘হর্যের অমৃত’ পান করে জেগে উঠছিল কলকাতা। কলকাতার এই জাগরণ বাংলার রেনেসাঁ বা বাংলার নব জাগৃতি নয়। এটাকে বড় জোর কলকাতার বাবু জাগরণ বলা জেতে পারে। কিন্তু ভবানীচরণের মতো সাধারণ লেখক থেকে শুরু করে যদুনাথ সরকারের মতো পণ্ডিত ঐতিহাসিকরা সকলে মিলে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বাবুজাগরণকেই বাংলার জাগরণরূপে প্রচার করেছেন। ভেদবুদ্ধি প্রসূত মোহাচ্ছন্নতায় এদের মধ্যে কোন ফারক নেই। ভবানীচরণ পলাশীর যুদ্ধকে বলেছেন. ‘দেবাসুর সংগ্রাম’, আর যদুনাথ সরকারে ভাষায়, তা ‘এক যুগান্তকারী ঘটনা’। ভবানীচরণ পলাশী যুদ্ধের ফলে মধ্যযুগের অবসান হয়ে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল’ এবং পলাশীতে ইংরেজ বিজয়ের ফলে ‘মধ্য যুগীয় ধর্মীয় স্বৈরাচারী শাসনের’ অবসান হয়েছিল। যদুনাথের মতে, ইংরেজ আমলে পশ্চিমা সভ্যতার পরশে শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিতে জড়তা দূর হয়ে শুরু হয় নব জীবনের স্পন্দন। ‘ভগবানের দান এক যাদুকরের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায়’ যেন স্থবির প্রাচ্য সমাজে সঞ্চার হয় রেনেসাঁ বা নব জাগৃতি। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়েছিল, পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলার রেনেসাঁ তার চাইতেও ‘ব্যাপক, গভীর ও বৈপ্লবিক”। (হিস্টি অব বেঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪৯৭-৯৮)
যদুনাথ সরকার-এর এই পর্যবেক্ষণ ও মতামত সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ডক্টর সিরাজুল ইসলাম লিখেছেনঃ
………. পলাশীর পরাজয়ের মধ্যে তিনি (যদুনাথ সরকার) যে যুগান্তকারী সুফল লক্ষ্য করেছেন তা হচ্ছে নেহাতই একজন মস্তিষ্কস্নাত রাজভক্ত ঔপনিবেশিক ঐতিকাহাসিকের তথ্যশূন্য ভাবোদগার ও মনগড়া কল্পনা মাত্র। ঊনবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে সর্বপ্রথম কোম্পানির সরকার দেশীয়দের ইংরেজি শিক্ষাদানের নামে একটি মাত্র শিক্ষানীতি গ্রহণ করে। এর পূর্বে পৌনে একশত বৎসর যাবত শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকাতার অভাবে হাজার হাজার মোগলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা বন্ধ প্রায় হয়ে যায়। ফলে দেশ নিপতিত হয় অশিক্ষা ও অজ্ঞতার মহা তিমিরে। এটা কি রেনেসাঁ? ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে এসে দেশীয়দের সর্বপ্রথম দায়িত্বশীল উচ্চপদ লাভের বাধা উত্তোলন করা হয়। এর পূর্বে শত বৎসর যাবৎ সমস্ত দায়িত্বশীল উচ্চ বেতনের সরকারি চাকরি ছিল একচেটিয়া ইউরোপীয়দের জন্য রিজার্ভ। চাকরিহারা দেশের অগণিত পেশাদার পরিবার বেকার হয়ে নিঃস্ব নিস্তেজ সামাজিক বোঝায় পরিণত হয়। উত্তরোত্তর জনবহুল শহর, বন্দর, আর লয়প্রাপ্ত হয়ে পুঁতিগন্ধময় নোংরা জঞ্জালে পরিণত হয়। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি মহামারীতে মৃত্যু ও পলায়নের ফলে নাগরিক লোকসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ইহা কি রেনেসা? বাংলার যে বস্ত্র ও রেশম-শিল্ল ছিল একদা বিশ্বনন্দিত সে শিল্পের পতন ঘটে পলাশীর যুদ্ধের পর। বাংলাদেশ পরিণত হয় গ্লাসগো-ম্যানচেস্টারের বন্দীবাজারে (captive market)। ইহা কি রেনেসাঁ? কোম্পানির ভূমি-রাজস্বনীতির ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনার্জিত আয় ভক্ষণকারী উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন একটি সুবিধাভোগী জমিদার ও মধ্যস্বত্ব শ্রেণী। রায়ত ভূমিতে চিরাচরিত অধিকার হারিয়ে পরিণত হয় জমিদারের করুণাপ্রার্থী প্রজায়। ইহা কি রেনেসাঁ? এসবই পলাশী যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের সুদূর প্রসারী ফল”। (বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৩০-৩২)
একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্য এটি অবশ্যই রেনেসাঁ ছিল। শ্রেণী পরিচয়ে তারা সামন্ত, ব্যবহারিক পরিচয়ে জমিদার, আর আভিজাত্যের কল্যাণে কলকাতার মানসপটে এর ছিল বাবু নামে পরিচিত। রাজনীতিতে এরা ইংরেজদের বংশবদ দালাল, কিন্তু জনগণের আর্থ-সামাজিক জীবনের তারাই ছিল প্রকৃত নিয়ন্তা। পলাশীর প্রানতরে বাংলার নবাব মসনদ হারিয়েছিলেন আর এই নবোত্থিত বর্ণহিন্দুরা পেয়েছিল অনেক শ্বেতাঙ্গ নবাব। তাদরে জন্যই পলাশীর পরাজয় এনেছিল নব জাগৃতি বা রেনেসাঁ। এই জাগৃতি বাংলার জাগরণ নয়, এটি নিতান্তই ছিল কলকাতার ‘বাবু জাগরণ’।
সহায়ক গ্রন্থ
সুপ্রকাশ রায়_ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯।
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867
দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ।
আমাদের জাতিসত্ত্বার বিকাশধারা ।
যদুনাথ সরকার _ বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯।
দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস হিসেবে পালন করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা ।
পলাশীর পর মুসলমানদের সম্পত্তি লুন্ঠন করে ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ ।
সূফি বরষণ
মুসলমানদেরকে ষড়যন্ত্র মূলক ভাবে পরাজয়ের পর মুর্শিদাবাদ থেকে শাসনকেন্দ্র কলকাতায় স্থানান্তর হয় ১৭৬৮ সালে। ১৭৭৩ সালে দ্বৈত শাসন অবসানের সাথে সাথে কলকাতা ইংরেজদের ভারত-রাজত্বের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৭৭৪ সালে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধন করেন। এ সময়ই তিনি কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। তখনো কলকাতা ছিল গঞ্জ। তারপর কলকাতা হলো বন্দর। ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচারের সদরঘাট ছিল এই কলকাতা বন্দর। বন্দর থেকে ক্রমে বিকশিত হলো বন্দরনগরী। এভাবেই সারা বাংলা সম্পদ শোষণ করে বেড়ে উঠল কলকাতা মহানগরী।
এই হাঠাৎ বেড়ে ওঠা কলকাতার অতীত সম্পর্কে স্বরূপচন্দ্র দাস লিখেছেনঃ “পূর্বকালে ও নগর নবদ্বীপাধীন এক ক্ষুদ্র গ্রামমাত্র ছিল। তাতে অনেক দূর পর্যন্ত ছিল বন-জঙ্গল। এই স্থানে ১০ কিংবা ১২ ঘর কৃষিজীবী গৃহস্থ বাস করত”। (দি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৯)
নিশীথরঞ্জন রায় জানাচ্ছেনঃ “জলাজঙ্গল সমাকীর্ণ অঞ্চলের আদি অধিবাসী ছিল জেলে, শিকারি, শবর প্রভৃতি তথাকথিত জাতির নর-নারী”। (ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭৭)
এই গ্রাম-কলকাতার পাশে গোবিন্দপুর গ্রামের পত্তন করেছিল চারটি বসাক ও একটি শেঠ পরিবার। তার পাশেই সূতা ও কাপড়েরন বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুতানুটি। এই গোবিন্দুপুর-ডিহি কলকাতার-সুতানুটি গ্রাম তিনটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে ১৬৯৮ সালে সাবর্ন চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল। তারপর পাঁচ বছর ধরে সেখানে উইলিয়াম দুর্গ তৈরি করেছিল। (ভারতকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২০৯)।
পলাশীর পতনে তাৎক্ষণিকভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ-চেতনা শাণিত হয়ে উঠতে বিলম্ব হয়নি। ১৭৬৩ সালেই শাসক মীর কাসিম জাতির সর্বনাম সম্পর্কে সম্বিত ফিরে পেয়ে তলোয়া র কোষমুক্ত করেছিলেন। আর একই সময়ে জনতার কাতার থেকে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছিলেন কৃষক বিদ্রোহের অমর নায়ক ফকীর মজনু শাহ। ইংরেজরা বাংলার সাবেক শাসক জাতির ব্যাপারে একদিনের জন্যও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। লর্ড ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মুসলমানরা সব সময়ই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। সাফল্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে জানলেই তারা সাথে সাথে তা সংঘটিত করবে”। (Selections from Unpublished Reords of Govt……1784-67; James Long, 1973, P-202)
কলকাতার পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদী অভ্যন্তরীন ও বহির্বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। তার চাইতেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কলকাতার গুরুত্ব ছিল এ দেশের শাসকদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করার চমৎকার আশ্রয়কেন্দ্ররূপে। জোব চার্ণক হুগলি থেকে পালিয়ে গিয়ে এই স্যাঁতস্যাতে মাটি ও জঙ্গলাকীর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নদীপথে সাগরে পালিয়ে গিয়ে জান বাঁচানোর জন্যও এই কলকাতা ছিল তুলনাহীন। শক্তিশালী সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা তাদের চার পাশে দাঁওবাজ দালালশ্রেণীর দ্বারা গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য ‘মানব বন্ধনী;। ইংরেজদেরকে অবলম্বন করে কলকাতাকে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিরূপে অবিশ্বাস্য রকম দ্রতগতিতে বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রণীর বিকাশ ঘটেছিল। বস্তুত দেড় শতাধিক বছর ধরে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বর্ণহিন্দুরা শোষণ-সাফল্যের একেকটি স্তর উতরিয়ে উঠে গেছে একবারে শীর্ষদেশে, আর তাদের উত্থান-আরোহণের কার্যকরণরূপে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার গরিষ্ঠ মুসলমান প্রজাসাধারণ পতনের একটি পর একটি ধাপ গড়িয়ে নেমে গেছে অধঃপাতের অতল গভীরে। একদিকে শোষক-ধনিক-জমিদার বর্ণহিন্দুদের উত্থান, অন্যদিকে বাংলার কৃষক-প্রজা মুসলমানদের পতন, এই দু’য়েরই মধ্য-বিন্দুতে কলকাতা।
কলকাতার লেখক ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ইংরেজদের সাথে সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর লড়াইকে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়গণ হানাদার আর্যদের আগ্রাসন দীর্ঘদিন পর্যন্ত রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের মুখে বারবার পর্যদস্ত হয়েই আর্যরা এ এলাকার দ্রাবিড় জনগোষ্ঠকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করেছিল। আর্যরা ‘দেবতা’ আর দ্রাবিড়রা ‘অসুর’। এই ‘অসুর’ পরিচয়েই আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ দীর্ঘদিন আর্যদের কাছে পরিচিত হয়েছেন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই প্রাচীন আর্যদের অধস্তন পুরুষ ভবানী চরণ বাংলার নতুন যুগের প্রতিরোধ সংগ্রামের বীর নায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ‘অসুর’ আখ্যায়িত করেছেন। তাদের চোখে পলাশীর ‘দেবতা’ হলো ইংরেজরা।
ভবানীচরণরা সিরাজকে ‘অসুর’ আর ইংরেজকে ‘দেবতা’ বলেই থেমে যাননি। মুখের কথার সাথে বাস্তব কাজের নমুনাও পেশ করেছেন। পলাশী যুদ্ধের ক’দিন পরই তারা পলাশীর দেবাসুর সংগ্রামের উপজীব্য করে বাংলায় শারদীয় দূর্গাপুজা প্রথম চালূ করেন। এর আগে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। শ্রীরাধারমন রায় ‘কলকাতার দুর্গোৎসব’ নামক এই প্রবন্ধে লিখেছেন, দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস’। ‘পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎসব’ হিসেবেই এই পূজা ১৭৫৭ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নদিয়া ও কলকাতায়। এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘পলাশী বিজয়ী’ লর্ড ক্লাইভের সংবর্ধনা।
রাধারমণ রায় লিখেছেনঃ “১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুন ইংরেজ ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যাঁরা উল্লাসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তাঁরা হিন্দুদের জয় বলে মনে করলেন। ধুর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেরকমই বোঝালেন। ক্লাইভের পরামর্শেই তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়োজন করলেন। বসন্তকালীন দুর্গাপূজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে- ১৭৫৭ সালেই তাঁরা বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দূর্গাপূজার মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপর ফি বছর শরৎকালে দুর্গাপূজো করে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন। …… শোনা যায়, শরৎকালীন দুর্গোপূজো যে-বছর প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দু’জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচা করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। …… আগে এদেশে বসন্তকালে চালূ ছিল দুর্গাপূজো আর শরৎকালে চালূ ছিল নবপত্রিকাপূজো।
দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মুর্তির ব্যাপার, আর পবপত্রিকা পূজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নটি উদ্ভিদের ব্যাপার। পরে এই দু’টি ব্যাপারকে গুলিয়ে একাকার করে ফেলা হয়েছে। ১৭৫৭ সাল থেকে নবপত্রিকা হয়েছেন দুর্গা। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজার বোধনের দরকার হয়। আর আগে নবপত্রিকা পূজো করে পুরো দুর্গাপূজো করতে হয়। …… তাহলে দাঁড়ালো এই : ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করার জন্য বসন্তকালের দুর্গাপূজোকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকাপূজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাঁদের উৎসাহিত করেছিলেন ক্লাইভ। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলেন, তার প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজো অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপরিষদ উপস্থিত। ………. নবকৃষ্ণের পুরনো বাড়ির ঠাকুর দালানটি তৈরি হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। খুবই তড়িঘড়ি করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। … দুর্গাপূজোর চাইতেও ক্লাইভকে তুষ্ট করা ছিল নবকৃষ্ণের কাছে বড় কাজ। …. তিনি ভালো করেই জানতের, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রিস্টান, মনে মনে মূর্তি পূজোর ঘোর বিরোধী। অতএব স্রেফ দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে ক্লাইভের মন ভরানো যাবে না, এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভে জন্যে বাঈ নাচের, মদ-মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই একই সময়ে একই উঠানের একপ্রান্তে তৈরি করেছিলেন ঠাকুরদালান, আকে প্রান্তে তৈরি করিয়াছিলেন নাচ ঘর।…. নবকৃষ্ণর কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ, ক্লাইভ-ঠাকুরই ছিলেন আসল লক্ষ্য। দুর্গাপূজোর নামে তিনি ক্লাইভ পূজো করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় শরৎকালীন দুর্গোৎব প্রবর্তনের সময় নবকৃষ্ণ সাহেবপূজোর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পরে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপূজো উপলক্ষে সাহেব পূজো নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা আরস্ভ হওয়ায়”। (রাধারমণ রায় : কলকাতা বিচিত্র, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৮; দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২১ ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা)
পলাশীতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে এই উৎসব কেন? এ বিজয় কার বিজয়? তার জবান ভবানীচরণের জনানীতেই পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়, পলাশীর লড়াইয়ের ফলে উঠে এসেছে ‘হর্ষের অমৃত’ আর ‘বিষাদের হলাহল’। ‘হর্ষের অমৃত’ পান করে কলকাতা হয়েছে ‘নিরুপমা ও সর্ব্বদেশখ্যাতা’। কিন্তু ‘বিষাদের হলাহল’ কাদের ভাগ্যে জুটল, সে কথা কিছুই বলেননি ভবানীচরণ। ‘দেবাসুর’ সংগ্রামের ‘বিষাদের হলাহল’ গিলতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদ আর ঢাকা শহরকে।
ভবানীচরণ লিখেছেনঃ “ধার্ম্মিক, ধর্ম্মাবতার, ধর্ম্ম-প্রবর্তক, দুষ্ট নিবারক, সৎ প্রজাপালক, সদ্বিবেচক ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর” এই দেশের লোকদের “অধিক ধনী হওনের অনেক পন্হা’ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ইংরেজ তাই দেবতা। ক্লাইভ ‘মা দুর্গার প্রতীক’। এই দেবতার পূজা করেই পলাশী-উত্তর কলাকাতাকে কেন্দ্র করে রাতারাতি একটি লুটেরা শ্রেণী রাজা-মহারাজায় পরিণত হয়েছিল। ভারত সরকারের জাতীয় মহাফেজখানার ১৮৩৯ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে গবেষক বিনয় ঘোষ সেকালের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবানদের একটি তালিকা সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ তুলে দিয়েছেন ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ নামক বইতে। এই পরিবারগুলো শহর কলকাতার ‘প্রাতঃকালীন গাত্রোত্থানের’ সাথে যুক্ত। তাদের কয়েকজন হলেনঃ
১. মীর জাফরের নবাবী আমলের ক্লাইভের দেওয়ান নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাপা রামকৃষ্ণ বাহাদুর, ২. নবকৃষ্ণের ভাতিজা বাবু গোপীমোহন দেব, ৩. কর্ণেল ক্লাইভের বেনিয়ান লক্ষীকান্ত ধরের উত্তর পুরুস রাজা রামচন্দ্র রায়, ৪. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন-বৃত্তির কুখ্যাত সহযোগী মল্লিক পরিবার, ৫. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর রাজস্ব বোর্ডের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের নাতি বাবু শ্রীনারায়ণ সিংহ, ৬, গভর্নর ভান্সিটর্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ান রামচরণ রায়ের উত্তর পুরুষ আন্দুলের রায় বংশ, ৭. ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ান ও পরে সন্দীপের জমিদার গোকুল চন্দ্র ঘোষালের প্রতিষ্ঠিত খিদিরপুরের গোকুল পরিবার, ৮. হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর পরিবার, ৯, ঠাকুর পরিবারের ‘জুনিয়র ব্রাঞ্চ’ বা ‘নবীন’ শাখা নামে পরিচিত এবং কোম্পানি সরকারের এজেন্ট,পরে ২৪ পরগনার কালেক্টর ও নিমক এজেন্টের সেরেস্তাদার থেকে নিমক মহলের দেওয়ান ও স্বল্পাকালীন কাস্টমস-সল্ট-ওপিয়াম বোর্ডের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের (জন্ম ১৭৯৪) পরিবার। ‘কার ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা দ্বারাকানাথের প্রভাব প্রতিপত্তির কোন প্রতিদ্বন্দী তাঁর সমসাময়িককালে ছিল না। দ্বারকানাথে ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই আমলের অন্যান্য অভিজাত পরিবার হলো- ১০. সুতানুটি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ পরিবার,
১১. মেসার্স ফেয়ারলি এন্ড কোং-এর দেওয়ান রামদুলাল দে, ১২. ভুলুয়া (নোয়াখালি) ও চট্টগ্রামের নিমক মহলের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস, ১৩. পাটনার চিফ মি. মিডলটন ও স্যার টমাস রামবোল্ড সাহেবের দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, ১৪. কোম্পানির আমলের কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরামের পরিবার, ১৫. কুমারটুলির মিত্র পরিবার, ১৬. কোম্পানির ঠিকাদার গোকুল মিত্রের পরিবার, ১৭. পামার কোম্পানির সরকার গঙ্গা নারায়ণ, ১৮. পাল চৌধুরীর পরিবার, ১৯. কুলীন ব্রাহ্মণ ব্যানার্জী পরিবার, ২০. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সরকার রামলোচনের প্রতিষ্ঠিত পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবার, ২১. ক্লাইভের দেওয়ান কাশীনাথের পরিবার, ২২. কোম্পানির হুগলীর দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবার, ২৩. কোম্পানি সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ঠিকাদার ও কয়েকজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর বেনিয়ান এবং মেসার্স মুর হিকি এন্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীলের প্রতিষ্ঠিত কলুটোলার শীল পরিবার, ২৪. এককালের লবণের গোলার মুহুরূ বিশ্বনাথ মতিলালের পরিবার, ২৫. ঠনঠনিয়ার ঘোষ পরিবার, ২৬. মেসার্স ভেভিডসন এন্ড কোম্পানির এককালের কেরানী রসময় দত্তের প্রতিষ্ঠিত রামবাগানের দত্ত পরিবার, ২৭. পাটনার কমার্শিয়াল রেসিডেন্টের দেওয়ান বনমালি সরকারের প্রতিষ্টিত কুমারটুলীর সরকার পরিবার, ২৮. আফিমের এজেন্ট হ্যারিসনের দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত বাগবাজারের মুখার্জী পরিবার, ২৯. বেনিয়ান রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার, ৩০. বিভিন্ন বিলাতি কোম্পানির সাথে যুক্ত গঙ্গাধর মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নিমতলার মিত্র পরিবার”। (টাউন কলকাতার কড়চা, পৃষ্ঠা ৭৭-৮৮)
এই অভিজাত পরিবারগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেন,
“কেউ বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়ে, কেউ সর্দারী-পোদ্দারী করে, কেউ দাদানী বণিক ও দালাল হয়ে, কেউ বেনিয়ানী করে, কেউ বা ঠিকাদারি করে, কেউ বা ঠিকাদারি ও স্বাধীন ব্যব্সা-বাণিজ্য করে, কলকাকাতার নতুন শহুরে সমাজে নতুন বড় লোক হয়েছিলেন। সেকালের নবাবী আমলের বড়লোকরা নবযুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে একেবারে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। কোম্পানির আমলে যাঁরা নতুন বড়লোক হলেন তাঁদেরকে এক পুরুষের বড় লোক বললে ভূল হয় না”। (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১০৩)
উপরের তালিকার ‘এক পুরুষের বড় লোক’ ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি হিন্দু। তাদের অধিকাংশই উচ্চ-বর্ণজাত। মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পরের এ তালিকা! অথচ এতে একটিও মুসলিম পরিবারের নাম নেই। এখানেও ‘চিরায়ত ঐতি্যের বিব্রতকর অনুশীলন! পাল, সেন, তুর্কী, পাঠান, মোগল শাসনামলে সকল উত্থান-পতনের রাজনৈতিক বিবর্তনে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-উচ্চবর্ণ হিন্দুর এই সম্মিলিত শক্তিই শাসন-যন্ত্রের ছত্র-ছায়ায় সমাজে একটানা প্রাধান্য বজায় রেখেছে। ইংরেজ শাসনেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না।
কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীকে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানর কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।
সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিল, তাহারা এবং মার্ক্সের ভাষায় ‘শহরের চুতর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে….. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি…. এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরের অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়। দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য।….. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন ……. (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)
এই লুটেরা শ্রেণীর হাতে পলাশী-উত্তরকালে তাদেরই রুচি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল কলকাতা। সে কারণেই স্বাধীন মেজাজে মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সোনারগাঁও, গৌড়, ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদের সাথে কলকাতার কোন মিল ছিল না। একদিকে ইংরেজ কোম্পানির রাইটার-ফ্যাক্টর-সেমি মার্চেন্ট প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর ইংরেজ কর্মচারী, অন্যদিকে তাদের লুণ্ঠন-সহচর দালাল শ্রেণী। তাদের হাতে বেড়ে ওঠা কলকাতায় জন্ম নিল এক নতুন সংস্কৃতি, যার নাম বাবু কালচার।
কলকাতার ‘বাবু’ সম্পর্কে জে. এইচ ব্রুমফিল্ড তাঁর গ্রন্হ ‘এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ প্লুরাল সোসাইটি’-তে লিখেছেন:
“Babu : In Bengali a title of respect for an English speaking Hindu. Applied derogatorily by the British to semi educated Bhadralok and by extension to any Bhadralok”.
‘বাবু’ শব্দটি কোম্পানির শাসনের জন্ম-স্থিতি-বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করে আবুল কাশেম চৌধুরী লিখেছেনঃ
“ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে যখন স্বাধীনতা দ্রুত অপসৃয়মান, বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ কুটীর শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও বহির্বাণিজ্য, তখনই এই সামাজিক বিকলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এই বাবু সমাজ ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আনুকূ্ল্যে।,,,,, কালো পথে উপর্জিত বাবুদের অঢেল টাকা শেষ পর্যন্ত গাতানুগতিক ভূমিমুখীন অর্থনীতিতে আটকা পড়ে এবং তার কারণে সমাজকে বিসর্জন দিতে হয় সম্ভাব্য গতিশীলতা”। (বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নকশা, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা : ৭২)
এরূপ অনেক ‘ব্ল্যাক জেমিনদার’ বা ‘ক্যালকাটা বাবু’ দুই, চার, পাঁচ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে সে যুগের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিল। রাম দুলাল দে পাঁচ টাকা বেতনের সরকার হিসেবে জীবন শুরু করেন। ১৮২৫ সালে মৃত্যুর সময় কলকাতা শহরে তিনি রেখে গেছের উনিশটি বিশাল বাড়ি, আর সে আমলের পৌনে সাত লক্ষাধিক টাকার সম্পদ। কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটু বাবুরা ছিলেন তারই সন্তান। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল পুরাতন শিশি-বোতলের কারবার দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। আট টাকা বেতনের চাকরি শুরু করে রামকমল সেন মৃত্যুর সময় নগদ রেখে যান দশ লাখ টাকা। হেস্টিংস-এর মুৎসুদ্দীগিরি করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাসিমবাজারের রাজপরিবার, যার বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ টাকা। (সিরাজুল ইসলাম, সূর্যাস্ত আইনের সামাজিক তাৎপর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, আষাঢ়, ১৩৮৫)
এই কালো টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ‘চতুর ও বুদ্ধিমান’, শঠ ও প্রবঞ্চক’, এবং ‘হাজার রকম প্রতারণা-কৌশলের উদ্ভাবক’ রূপে। টাকা-পয়সা উপার্জনে তারা যে অভিনব ব্যবসায়িক কৌশলের অবলম্বন করত তা প্রকাশ্য দস্যুতার শামিল। অন্যদিকে সেই লুণ্ঠিত সম্পদ খরচ করার ব্যাপারেও তারা ছিল বেহিসাবী। নানা প্রকার ‘বাবু বিলাস’ তখনকার কলকাতায় চালূ হয়েছিল। বাইজী-চার্চ থেকে শুরু করে বুলবুলির লড়াই, টিকটিকির নাচ পর্যন্ত অনেক কিছুই ছিল তাদের বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের উপাদন। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ এমনকি গৃহ প্রবেমের মতো মামুলি উপলক্ষকে অবলম্বন করে তারা আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ তার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে সে যুগের প্রায় কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছিল। তার নাতি লালা বাবুর ‘অন্নপ্রাশন’ উপলক্ষে সোনার পাতে দাওয়াত ছেপে বিলি করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে তার ঘরে ‘পুরাণ’ পাঠ করে গঙ্গাধর শ্রীমানী নামক জনৈক ব্রাহ্মণ পারিতোষিক পেয়েছিল হাতী, ঘোড়া ও সুসজ্জিত পাল্কি। আশুতোষ দেবের মায়ের শ্রাদ্ধ আর দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাপের শ্রাদ্ধ সেকালের কলকাতার বাবু-বিলাসের একেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সারা বাংলায় তখন চলছিল ইংরেজ ও তাদের দোসর এই কলকাতা-বাবুদের লুণ্ঠন-শোষণ। ইজারা চুক্তি, সূর্যাক্ত আইন, ব্যবসায়ের নামে লুটপাট প্রভৃতির ফলে একদা-সমৃদ্দ পল্লীবাংলায় দোজখের আগুন জ্বলছিল। উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষে পল্লী বাংলার প্রতি ষোল জনে পাঁচ জন লোক মারা গিয়েছিল। বাংলার পুরনো শহরগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষের গোশত খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছিল। দেশের শিল্প-অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্বাস নিংড়ে নিয়ে কোটি মানুষের রক্ত পান করে কলকাতায় তখন চলছিল এই প্রমত্ত বাবু-বিলাস।
এভাবেই কলকাতা বেড়ে উঠল। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণ-হিন্দুরা লুণ্ঠন-শোষণের বর্ণনাতীত নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল এবং এভাবেই উনিশ শতকের আশির দশকের মধ্যে তারা ‘সবকিছু উজাড়ভাবে আত্মসাৎ করে’ নিজেদের মধ্যে ‘নব জাগরণ’ সৃষ্টি করল।
কলকাতার এই নবশক্তির উত্থান সম্পর্কে স্বপন বসু লিখেছেনঃ ‘উনিশ শতকে বাংলায় শ্রেণীবিশেষের মধ্যে যে সব চেতনা জাগ্রত হয়েছিল তার প্রায় সবটাই সীমাবদ্ধ ছিল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলমান সমাজে এ-নব চেতনার ছোঁয়া লাগল না কেন?” (বাংলায় নব চেতনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২০৭)
স্বপন বসুর বক্তব্যেই এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ
“মুসলমান নবাবের হাত থেকে ইংরেজ যেদিন বাংলা অধিকার করে নিল, মুসলমান সমাজের অবনতির সূচনা তখন থেকেই। নবাব পরিবার এবং তাকে কেন্দ্র করে মর্শিদাবাদের যে মুসলমান অভিজাত-মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল ইংরেজ রাজত্বে তাদের প্রতিপত্তির অবসান ঘটল। সম্ভ্রম বজায় রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে তারা পাড়ি জমালেন দিল্লী বা পারস্যে। …. রাজধানীও মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানন্তরিত হলো কলকাতায়- ফলে মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ১৫% হ্রাস পেল। নবাবী আমলে অধিকাংশ উচ্চ পদই ছিল মুসলমানের অধিকারে, ইংরেজ আসার পর শাসন-ব্যবস্থা পুরো পাল্টে গেল। মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজ রাজ্য অধিকার করেছিলেন, সেই কারণে মুসলমাদের ইংরেজরা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। এদেশে আসার অল্পদিন পরেই রবার্ট ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে বিন্দুমাত্র সম্বাবনা আছে জানলেই তারা তা করবে। … সামরিক বাহিনীতে যেসব মুসলামান উচ্চ পদে বহাল ছিলেন সহসা তারা অনুভব করলেন, তাদের দিন শেষ হয়েছে। সামরিক বিভাগের উচ্চ পদগুলো ইংরেজদের করতলগত হলো। অন্যান্য দায়িত্বশীল পদে যেসব মুসলমান ছিলেন তাদের প্রভাব দ্রুত কমতে লাগল। ১৭৮১-তে মাগল ফৌজদারদের পদগুলোতে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলো”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৮)
সাধারণভাবে পল্লী বাংলার মানুষ, আর বিশেষভাবে বাংলার মুসলমান জনগণ যখন লুণ্ঠন-শোষণের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন ‘হর্যের অমৃত’ পান করে জেগে উঠছিল কলকাতা। কলকাতার এই জাগরণ বাংলার রেনেসাঁ বা বাংলার নব জাগৃতি নয়। এটাকে বড় জোর কলকাতার বাবু জাগরণ বলা জেতে পারে। কিন্তু ভবানীচরণের মতো সাধারণ লেখক থেকে শুরু করে যদুনাথ সরকারের মতো পণ্ডিত ঐতিহাসিকরা সকলে মিলে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বাবুজাগরণকেই বাংলার জাগরণরূপে প্রচার করেছেন। ভেদবুদ্ধি প্রসূত মোহাচ্ছন্নতায় এদের মধ্যে কোন ফারক নেই। ভবানীচরণ পলাশীর যুদ্ধকে বলেছেন. ‘দেবাসুর সংগ্রাম’, আর যদুনাথ সরকারে ভাষায়, তা ‘এক যুগান্তকারী ঘটনা’। ভবানীচরণ পলাশী যুদ্ধের ফলে মধ্যযুগের অবসান হয়ে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল’ এবং পলাশীতে ইংরেজ বিজয়ের ফলে ‘মধ্য যুগীয় ধর্মীয় স্বৈরাচারী শাসনের’ অবসান হয়েছিল। যদুনাথের মতে, ইংরেজ আমলে পশ্চিমা সভ্যতার পরশে শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিতে জড়তা দূর হয়ে শুরু হয় নব জীবনের স্পন্দন। ‘ভগবানের দান এক যাদুকরের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায়’ যেন স্থবির প্রাচ্য সমাজে সঞ্চার হয় রেনেসাঁ বা নব জাগৃতি। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়েছিল, পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলার রেনেসাঁ তার চাইতেও ‘ব্যাপক, গভীর ও বৈপ্লবিক”। (হিস্টি অব বেঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪৯৭-৯৮)
যদুনাথ সরকার-এর এই পর্যবেক্ষণ ও মতামত সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ডক্টর সিরাজুল ইসলাম লিখেছেনঃ
………. পলাশীর পরাজয়ের মধ্যে তিনি (যদুনাথ সরকার) যে যুগান্তকারী সুফল লক্ষ্য করেছেন তা হচ্ছে নেহাতই একজন মস্তিষ্কস্নাত রাজভক্ত ঔপনিবেশিক ঐতিকাহাসিকের তথ্যশূন্য ভাবোদগার ও মনগড়া কল্পনা মাত্র। ঊনবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে সর্বপ্রথম কোম্পানির সরকার দেশীয়দের ইংরেজি শিক্ষাদানের নামে একটি মাত্র শিক্ষানীতি গ্রহণ করে। এর পূর্বে পৌনে একশত বৎসর যাবত শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকাতার অভাবে হাজার হাজার মোগলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা বন্ধ প্রায় হয়ে যায়। ফলে দেশ নিপতিত হয় অশিক্ষা ও অজ্ঞতার মহা তিমিরে। এটা কি রেনেসাঁ? ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে এসে দেশীয়দের সর্বপ্রথম দায়িত্বশীল উচ্চপদ লাভের বাধা উত্তোলন করা হয়। এর পূর্বে শত বৎসর যাবৎ সমস্ত দায়িত্বশীল উচ্চ বেতনের সরকারি চাকরি ছিল একচেটিয়া ইউরোপীয়দের জন্য রিজার্ভ। চাকরিহারা দেশের অগণিত পেশাদার পরিবার বেকার হয়ে নিঃস্ব নিস্তেজ সামাজিক বোঝায় পরিণত হয়। উত্তরোত্তর জনবহুল শহর, বন্দর, আর লয়প্রাপ্ত হয়ে পুঁতিগন্ধময় নোংরা জঞ্জালে পরিণত হয়। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি মহামারীতে মৃত্যু ও পলায়নের ফলে নাগরিক লোকসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ইহা কি রেনেসা? বাংলার যে বস্ত্র ও রেশম-শিল্ল ছিল একদা বিশ্বনন্দিত সে শিল্পের পতন ঘটে পলাশীর যুদ্ধের পর। বাংলাদেশ পরিণত হয় গ্লাসগো-ম্যানচেস্টারের বন্দীবাজারে (captive market)। ইহা কি রেনেসাঁ? কোম্পানির ভূমি-রাজস্বনীতির ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনার্জিত আয় ভক্ষণকারী উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন একটি সুবিধাভোগী জমিদার ও মধ্যস্বত্ব শ্রেণী। রায়ত ভূমিতে চিরাচরিত অধিকার হারিয়ে পরিণত হয় জমিদারের করুণাপ্রার্থী প্রজায়। ইহা কি রেনেসাঁ? এসবই পলাশী যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের সুদূর প্রসারী ফল”। (বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৩০-৩২)
একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্য এটি অবশ্যই রেনেসাঁ ছিল। শ্রেণী পরিচয়ে তারা সামন্ত, ব্যবহারিক পরিচয়ে জমিদার, আর আভিজাত্যের কল্যাণে কলকাতার মানসপটে এর ছিল বাবু নামে পরিচিত। রাজনীতিতে এরা ইংরেজদের বংশবদ দালাল, কিন্তু জনগণের আর্থ-সামাজিক জীবনের তারাই ছিল প্রকৃত নিয়ন্তা। পলাশীর প্রানতরে বাংলার নবাব মসনদ হারিয়েছিলেন আর এই নবোত্থিত বর্ণহিন্দুরা পেয়েছিল অনেক শ্বেতাঙ্গ নবাব। তাদরে জন্যই পলাশীর পরাজয় এনেছিল নব জাগৃতি বা রেনেসাঁ। এই জাগৃতি বাংলার জাগরণ নয়, এটি নিতান্তই ছিল কলকাতার ‘বাবু জাগরণ’।
সহায়ক গ্রন্থ
সুপ্রকাশ রায়_ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯।
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867
দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ।
আমাদের জাতিসত্ত্বার বিকাশধারা ।
যদুনাথ সরকার _ বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯।
No comments:
Post a Comment