পলাশী বিজয়ের পর বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা ও ইংরেজরা লুঠ করে মুর্শিদাবাদের রাজকোষ।
পলাশী পর মুসলমানদের বিপর্যয় এবং কলকাতায় হিন্দুদের উত্থান।
সূফি বরষণ
এক.
পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর শিবিরে দু’দিন সসৈন্যে অবস্থান করলেন ক্লাইভ। তারপর দু’শ ইংরেজ ও পাঁচশ’ দেশীয় সৈন্য নিয়ে তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা নীরবে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এই মোড় পরিবর্তনের ঘটনার সাক্ষী হলো। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেনঃ “ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদের জনতা শুধু লাঠি আর পাথর মেরে এই নতুন বিজেতাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারত। লোকেরা নাকি বলাবলিও করেছে, কোন অস্ত্র ছাড়া শুধু ইটপাটকের মেরেই মুর্শিদাবাদের লোকেরা ইংরেজদের ধরাশায়ী করতে পারত”। (ভোলানাথ চন্দ্র : দি ট্রাভেল অব এ হিন্দু, লন্ডন, ১৮৬৯, পৃষ্ঠা ৬৮)।
পলাশী যুদ্ধের প্রহসনমূলক নাটক শেষ হতে না হতেই লুণ্ঠিত হল মুর্শিদাবাদের রাজকোষ। সে সময় রাজকোষে কি পরিমাণ সম্পদ ছিল? মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনকাল থেকে দীর্ঘ ৫৫ বছরের সঞ্চয় একত্রিত হয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোষাগারে পূর্ণিয়া যুদ্ধের পর সঞ্চিত ছিল সার্জন ফোর্থের প্রদত্ত হিসেব মতে মণিমুক্তা হিরা জহরতের মূল্য বাদ দিয়ে, তৎকালীন মুদ্রায় ৬৮ কোটি টাকা [S. C. Hill. Bengal in 1757-67, P.108] যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের সাথে তুলনীয়।’ পলাশীর নাটক শেষ করে সিরাজ-উদ্দৌলারই দীওয়ান রামচাঁদ বাবু মুনশী নবকিষেণ, লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরকে নিয়ে নবাবের কোষাগারে হাজির হন বিত্ত-সম্পদ লুট করার জন্য। দীওয়ান বাবুর তালিকার সাথে মিলিয়ে প্রাপ্ত সম্পদ তারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেন। সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদে ও অন্দরমহলে রক্ষিত সম্পদ ভাগ করে নেন দীওয়ান রামচাঁদ, মুনশী নবকিষেণ, মীর জাফর আলী খান ও আমীর বেগ খান। (সিয়ারে মতাযেলি, ২য় খণ্ড (অনুবাদ) পৃ-২৩)।
পলাশী বিপর্যয় মুর্শিদাবাদের সাথে সাথেই কোন বড় রকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বলে জানা যায় না। শাসক মহলের অন্তঃপুরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আর বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষয়রোগ’ জাতির প্রতিরোধ-চেতনা পঙ্গু করে ফেলেছিল। শাসক ও জনতা ছিল আত্মিক সম্পর্কহীন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন। উদ্যমহীন এই নিস্পৃহ মানুষেরা অবাক চোখে দেখল মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের ঘটনা। ক্লাইভের নিজ তত্ত্বাবধানে মুর্শিদাবাদের রাজকোষ নিঃশেষে লুণ্ঠিত হলো। এরপর ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই পুতুল নবাব মীর জাফর আলী খাঁ রাজকীয় শন-শওকতের সাথে ইংরেজদের ‘যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের’ প্রথম কিস্তির টাকা কলকাতায় পাঠালেন সোনা-চাঁদির মাধ্যমে।
“সামরিক বাদ্য সহকারে শোভাযাত্র করিয়া প্রথম কিস্তির টাকা দুই শত নৌকায় বোঝাই করিয়া কলিকাতা অভিমুখে রওয়ানা হইল”। (রমেশচন্দ্র মজুমদার)। কলকাতার উত্থানের সূচনা এখান থেকেই। মুর্শিদাবাদের জনগণ এবারে তারেদ অন্তরে একটা অব্যক্ত জ্বালা অনুভব করল। কোথায় যেন একটা বড় রকম ছন্দপতন ঘটে গেছে!।
ইংরেজদের লুণ্ঠন সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ“নবাবের সিংহাসন নিয়ে চক্রান্ত করে, জমিদারী বন্দোবস্ত ও রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ব্যক্তিগত ও অবৈধ বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করে এবং আরও নানা উপায়ে উৎকোচ-উপঢৌকন নিয়ে চার্ণক-হেজেস-ক্লাইভ-হেষ্টিংস-কর্নওয়ালিসৈর আমলের কোম্পানির কর্মচারীরা যে কি পরিমাণ বিত্ত সঞ্চায় করেছিলেন তা কল্পনা করা যায় না। …. দেখতে দেখতে প্রচুর অর্থ ও নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কোম্পানি সাহেবরা সত্যি সত্যি নবাব বনে গেলেন। তাদের মেজাজ ও চালচলন সবই দিন দিন নবাবের মতো হয়ে উঠতে লাগল”। (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।
মুর্শিদাবাদের রাজকোষ থেকে পাওয়া গেল পনের লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বৃটিশ নৌবাহিনী এবং স্থল বাহিনীর ৬জন সদস্যকে দিতে হল ৮কোটি টাকা। সিলেক্ট কমিটির ৬ জন সদস্যকে দিতে হল ৯ লক্ষ পাউন্ড (১৮ কোটি টাকা), ক্লাইভ তার নিজের জন্য আদায় করলেন ২ লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৩ কোটি টাকা), কাউন্সিল মেম্বাররা পেলেন এক থেকে দেড় কোটি টাকা করে। এছাড়াও উৎকোচ, নিপীড়ন এবং আরো বিবিধ নীতি বহির্ভূত ঘৃণিত পন্থায় এ দেশের সম্পদ লুট করেছে বৃটিশ বেনিয়ারা। সিরাজের পতনের পর নবাবের শূন্য আসনটি কোম্পানীর অর্থোপার্জনের উৎসে পরিণত হয়। শিখণ্ডি নবাবী কেনাবেচার মধ্য দিয়ে কোম্পানীর নতুন ধরনের তেজারতি শুরু হয়।
কোম্পানী এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-ন’ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃ.-৯৫)।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ সালের মধ্যে মীর জাফরের কাছ থেকে আদায় করলো ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর বাইরে ব্যক্তিগত পারিতোষিক আর উপহার উপঢৌকনের পরিমাণ ছিল ৫৮ লাখ হাজার ৭০ হাজার টাকা। ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ‘নবাব উঠানো-বসানো’র রাজনীতি করে কোম্পানির বিভিন্ন কর্মচারী প্রচুর অর্থ-কড়ির মালিক হলো। নানা অজুহাতে কোম্পানি করল বিস্তর আয়-রোযগার। সেই অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৪৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ পাউন্ড। তখনকার হিসেবে তেরো কোটি টাকা। (ব্রিজেন কে গুপ্ত : সিরাজউদ্দৌলা এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃষ্ঠা ১২৬-২৭) মীর জাফর-মীর কাসিম-নাজমুদ্দৌলার নবাবীর মাশুলে ক্লাইভ আর ভেরেলস্টের ব্যক্তিগত বখরা ছিল ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৫ পাউন্ড। (রমেশচন্দ্র দত্ত : ইকনোমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১৭৫৭-১৮৩৭, পৃষ্ঠা ৩২) এছাড়া ক্লাইভ মীর জাফরের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন বার্ষিক তিন লাখ টাকা আদায়ের জায়গীর। এই বিরল সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে এদেশ থেকে ক্লাইভ-ভেরেলস্ট-এর দ্বারা বিতাড়িত ইংরেজ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস লিখেছেনঃ
“The plunder which the superior servants of the Company acquired in the year 1757 ……. suddenly enabled many of them to return to England with princely fortune”. (Considerations on Indian Affairs, part-II London, 1775. P-3)।
মীরজাফর ক্ষমতায় আরোহণ করে টের পেলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবাব নন, শিখণ্ডি মাত্র। বলতে গেলে তিনি বৃটিশদের অর্থোপার্জন এবং শোষণের যন্ত্র। সিরাজের প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় তিনি যে মর্যাদা এবং প্রতিপত্তির প্রতীক ছিলেন আজ নবাবীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তাকে কোম্পানীর সাধারণ কর্মচারীদের তোষামোদ করে চলতে হচ্ছে। তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য উৎকোচ উপঢৌকন হিসেবে তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে হয়েছে। কিন্তু তবু কোম্পানীর ক্ষুধা মেটান সম্ভব হয়নি। রাজকোষের সমস্ত ভাণ্ডার উজার করে দিয়েও তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। ষড়যন্ত্রের শুরুতে তিনি ভেবেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র এবং ইংরেজ বণিকদের সহযোগিতা নিয়ে তিনিই হবেন উপমহাদেশের সবেচেয়ে শক্তিশালী নবাব। নবাবীর নেশায় তিনি এত উন্মত্ত মাতাল ছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের গভীরে আর এক ষড়যন্ত্রকে আমলে আনতে পারেননি। কিন্তু নবাবের পতনের পর যখন দেখলো শক্তির সব সূত্রগুলো ছিন্ন ভিন্ন, সব অমাত্যবর্গ উগ্র লালসা নিয়ে ক্লাইভের তোষামোদে ব্যস্ত, দেখলেন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের দাপট, দেখলেন রাজকোষের নির্মম লুণ্ঠন এবং লোপাট হতে দেখলেন নগর জনপদগুলো। বাংলার নবাব হয়ে তাকে দেখতে হল সবকিছু নীরবে, নিরুপায় হয়ে। দুর্বিষহ মনে হলেও কোম্পানীর সব অপকর্মকে সমর্থন দিতে হল হাসি মুখে। ক্লাইভের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও তার অবশিষ্ট রইল না। সিরাজের পতনের সাথে সাথেই বাংলার মুসলমান হয়ে পড়ল অভিভাবকহীন। বাংলার মুসলমানদের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের সব উৎসমুখগুলোতে আগুন জ্বলে উঠল। একের পর এক ধনী গরীব নির্বিশেষে বাংলার সব মুসলমান এগিয়ে চলল ধ্বংসের কিনারে।
No comments:
Post a Comment