পলাশী বিজয়ের পর বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা ও ইংরেজরা লুঠ করে মুর্শিদাবাদের রাজকোষ।
পলাশী পর মুসলমানদের বিপর্যয় ও কলকাতায় বরং হিন্দুদের উত্থান।
সূফি বরষণ
দুই.
মুসলমানদের পলাশীর বিপর্যয়ের পর ‘হঠাৎ-নবাব’ এই ইংরেজ কর্মচারীরা এদেশে এসেছিল বার্ষিক পাঁচ, দশ, পনের কিংবা পঁচিশ পাউন্ড বেতনের ‘রাইটার’, ‘ফ্যাক্টর’, ‘জুনিয়ার মার্চেন্ট’ বা ‘সেমি-মাচেন্ট’ হিসেবে। ‘লোফার’ শ্রেণীর এই ইংরেজ কর্মচারীরাই স্বনামে-বেনামে বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন-শোষণের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে কাড়ি কাড়ি টাকা পাচার করে নিজ দেশেও ‘কিংবদন্তীর রাজপুত্তুরের’ ইমেজ অর্জন করেছিল। কোম্পানির ‘দস্তক’র অপব্যবহার করে পাঁট পাউন্ড বেতনের কর্মচারীরা এদেশে মুৎসুদ্দী-অর্থলগ্নিকারীর মূলধনে বছরে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছিল্। তার ওপর ছিল নানা প্রকার ঘুষ ও উপঢৌকন। তাদের ব্যবসায়িক লুণ্ঠনের প্রধান অবলম্বন এ দেশীয় বেনিয়ান, মুৎসুদ্দী, গোমস্তা, দালাল ও ফড়িয়ারা। তাঁতি আর কামারশ্রেণীর গরীব উৎপাদকদের কাছ থেকে টাকা লূট করেও তারা বখরা তুলে দিত এসব ইংরেজ কর্মচারীর হতে । এভাবেই কোম্পানির বার্ষিক পাঁচ পাউন্ড বেতনের কেরানী হয়ে ১৭৫০ সালে এ দেশে এসে ওয়ারেন হেস্টিংস চৌদ্দ বছর পর দেশে ফিরেছিলেন ত্রিশ হাজার পাউন্ড সাথে নিয়ে। এরপর দ্বিতীয় দফার গভর্নর জেলারেলরূপে যখন তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে, বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্য রূপান্তরের তখন তিনিই প্রকৃত প্রতিনিধি।
এভাবেই স্বল্প বেতনভূক’ বণিক নাবিক আর লোফার’ ইংরেজ কর্মচারীরা’ বেঙ্গল নেবুব’- এ পরিণত হলো। আর তাদের এ দেশীয় লুণ্ঠন-সহচর দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দীরা দালালীর মাহত্ম্যে রাতারাতি পরিণত হলো রাজা-মহারাজারয়। এই সম্মিলিত লুটেরা চক্রটি সম্পর্কেই ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেনঃ “প্রথমে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কতগুলো ভাগ্যবিতাড়িত, চরিত্রভ্রষ্ট, ধুর্ত, পলাতক, অল্প শিক্ষিত লোক বেনিয়া-মুৎসুদ্দী-গোমস্তা-কেরানী-ফড়িয়া দালালরূপে অবাধে অঢেল অজস্র কাঁচা টাকা অর্জন ও সঞ্চয়ের দেদার সুযোগ পেয়ে ইংরেজদের এ দেশে উপস্থিতিকে ভগবানের আশীর্বাদরূপে জানল ও মানল”। (বঙ্কিম বীক্ষা-অন্য নিরিখে, ভাষা-সাহিত্যপত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৮২)
মীরজাফর নিজেকে শেষ অবধি কি চিনতে পেরেছেন? পারলেও তার ফেরার পথ খোলা ছিল না। অবজ্ঞা, অপমান আর ঘাত প্রতিঘাত নির্দেশ খবরদারীর দুর্বিপাকে পড়ে স্বপ্ন আর সম্মোহনের ঘোর কাটতে খুব বেশী দেরী হয়নি তার। দেরী হয়নি তার নিজেকে চিনতে। নবাবীর মোড়কে ঢাকা বেনিয়া চক্রের শিখণ্ডী বৈতো তিনি আর কিছু নন। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্য তার ব্যক্তিসত্তা বিক্রি হয়েছে অনেক আগে।
সিরাজের শোণিত-সিক্ত বাংলার মসনদ পরিণত হল তেজারতের পণ্যে। ক্লাইভের অর্থের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে মীর জাফর অসহিষ্ণু এবং মরিয়া হয়ে উঠলেন ইংরেজদের লালসার দোহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইলেন। একারণে তিনি ওলন্দাজদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের দেশছাড়া করার এক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। আর এ কারণেই নবাবের নাটমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হল মীর জাফরকে। তাকে পদচ্যুত করে কোলকাতায় নজরবন্দী করে রাখা হল। এর পর কোম্পানীকে টাকা উৎকোচ দিয়ে গ্রীনরুম থেকে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মীর কাসিম। মীর কাসিম শুধুমাত্র মঞ্চাভিনয়ে সীমাবদ্ধ রইলেন না। সত্যিকার নবাব হবার চেষ্টা করলেন। নাটমঞ্চ থেকে রণাঙ্গনের রক্তাক্ত পথ বেছে নিলেন বাংলার ভাগ্য ফেরানোর জন্য। সাতটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে তার অতীত গুনাহর কাফফারা আদায় করেছেন তিনি। শেষ অবধি বিচ্ছিন্ন শক্তি সমূহের সব সূত্র একই গ্রন্থিতে বাধার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হলেন। সব সময় পঞ্চম বাহিনী গাদ্দারদের প্রেতাত্মা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। গিরিয়ালা, উদয়নালা এবং বক্সারের প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাকে বাংলার মাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হয়। অবশেষে অনাহারে অর্ধাহারে ধুঁকে ধুঁকে নিরাশ্রয় মীর কাশিম দিল্লীর রাজপথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন বাংলার অবস্থা কি?
অবশেষে কোম্পানীর ছোট বড় সব কর্মচারী এবং তাদের দলগত চক্র শোষণ লুণ্ঠনের দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সমগ্র বাংলাব্যাপী। আর মুসলমানদের উচ্চবিত্ত আমীর ওমরাহর দল শিখণ্ডী নবাব হবার অভিলাষে তাদের সম্পদ উজাড় করে ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে এবং বৃটিশদের অর্থতৃষ্ণা মেটাতে থাকে। মীর কাশিম একই উদ্দেশ্যে ২ লক্ষ পাউন্ড (৪ কোটি টাকা) বর্তমান মুদ্রামানে ৮ হাজার কোটি টাকা কোম্পানীর হাতে তুলে দেন। মীরজাফরের পুত্রও কোম্পানীকে দেয় ১ লক্ষ ৪৯ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ ৩ কোটি টাকা, বর্তমান মুদ্রামানে ৬ হাজার কোটি টাকা।
ওদিকে বাংলার জনপদ তার জেল্লা হারিয়ে নৈরাশ্য, হতাশা এবং বিশৃংখলার দিকে ধাপে ধাপে এগুতে থাকে। ক্লাইভের স্বীকৃতি থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করা যায়। ক্লাইভের ভাষায়- “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি।” অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, আব্দুল ওয়াদুদ, পৃ.- ৬০-৬২)। পলাশীর বিপর্যয়ের পর বাংলার প্রধান শিল্পনগরী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে দ্রুত ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। জনগণ শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। এসব শহরের জনসংখ্যা কমছিল দ্রুত, আর অন্যদিকে তখন কলকাতায় বইছিল সমৃদ্ধির জোয়ার। লুটেরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, আর তাদের লুণ্টনবৃত্তির জুনিয়র পার্টনার এদেশীয় দেওয়ান-বেনিয়ান-গোমস্তাদের উদ্যোগে তখন সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিতপুর-বিরজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলোর ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে দ্রুত বেড়ে উঠেলিল টাউন কলকাতা। কলকাতার এই উত্থান সম্পর্কে নারায়ণ দত্ত লিখেছেনঃ
“জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা”। (জন কোম্পানির বাঙ্গালি কর্মচারী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৩) বাঙালি বেনিয়ানরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ,বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাোযাগের সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠার শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও অভিন্ন পরিচয়। এভাবেই গড়ে ওঠে ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী। মুসলিম শাসনের অবসানই ছিল এই মৈত্রীজোটের উদ্দেশ্য। (এস. সি. হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’-এর ২৩, ১০২, ১১৬ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)
এই শ্রেণীর লোকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তিস্বার্থ ও সংকীর্ণ মোহাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশত এই শ্রেণীর লোকেরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিষয়টি খোলামেলা তুলে ধরে এম. এন. রায় লিখেছেনঃ
“It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English power.” (India In Transition)
আার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ
“British could winover political authority without any opposition from the Hindus.” (British Paramountcy and Indian Renaissance. Part-II, P-4)
কাদের নিয়ে জাগল এই কলকাতা ? এরা কারা এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ লিখেছেনঃ
“আঠার শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর-যতো দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লোকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২৮২)
বিনয় ঘোষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ‘নাবিক, সৈনিক ও লোফার’- এই তিন শ্রেণীর ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণী রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টাউন কলকাতার কড়টা’ বইয়ে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ
“………. ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে।…… এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে………। বেনিয়ানরা ……. ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…….. আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ত করেন, তখন দেশ ও দে শের মানুষ সম্বন্ধে তাদেঁর কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ-প্রায় সমস্ত ব্যপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তাঁরাই হলে বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন,হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে”। (টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)
ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো- সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসেব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা। (বর্তমান মুদ্রামানে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা)। ( Miller quoted by Misra. P-15.)
পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কি মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদণ্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি, হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কেবল অলিখিত বিবরণ অর্থ সাগরপারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে? (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃ-৯৫)
একটা স্বপ্নের ঘোর ছিল মীরজাফরের। তিনি নিজেকে ভেবেছিলেন সিরাজ বিরোধী চক্রের মহানায়ক। সিরাজের পতনের অর্থ তিনিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি। তিনি জানতেন, দুঃসাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে সিরাজ দাঁড়িয়েছিলেন চোরাবালির উপরে। আর এ চোরাবালি সৃষ্টির নায়কেরা তারই সহযোগী। তাদের পছন্দসই, তাদেরই মনোনীত নবাব তিনি। তিনি ভেবেছিলেন জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উঁমিচাদ, নন্দকুমার প্রমুখ অসংখ্য হিন্দু অমাত্যবর্গ এবং মীর কাসিমের পতনের পর পুনরায় মীর জাফরকে পুতুল নবাব হিসেবে ক্ষমতায় বসানো হলো। এবার কিন্তু মীর জাফরকে নির্দেশ দেয়া হল সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। কোম্পানীর নির্দেশকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা শিখণ্ডী নবাবের ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি ৮০ হাজার সৈন্যকে বরখাস্ত করলেন। এর আগে মীর কাসিমের ৪০ হাজার সৈন্য ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। মোটের উপর পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধ নাটকের পর থেকে সেনাবাহিনীর দেড়লক্ষাধিক সৈন্য এবং এ বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজার কর্মচারী চাকুরীচ্যুত হল। এদের সবাই ছিল মুসলমান। এর ফলে বাংলার অসংখ্য মুসলিম পরিবার এগিয়ে চললো বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের দুঃসহ অবস্থার দিকেও, শুরু হল সুবাহ বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
এই সম্পর্কে হান্টার (১৮৭১ সালে) বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে সেনাবাহিনী। সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হয়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারতো না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়া হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না। পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে এই দাঁওবাজ মাস্তানশ্রেণীর লোকরাই হলো এদেশের ‘ভাগ্য বিধাতা’। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনি রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানি কর্তৃত্ব লাভের ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে এই সম্মিলিত লুটেরাচক্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হলো। তাদের হাতে বাংলাদেশের হাজার বছরের শিল্পের গৌরব মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে অবিশ্বাস্য অল্পকাহিনীতে পরিণত হলো। ইংরেজদের সৃষ্ট শুল্ক-প্রতিরোধ নীতির ফলে এ দেশের বিশ্বখ্যাত সূতি বস্ত্র ও রেশম-বস্ত্র ধ্বংস হলো। কুটির শিল্প হলো বিপর্যস্ত। আগে বাংলাদেশের কাপড় বিলাতে রফতানী হতো। এখন ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্র আমাদের বাজার দখল করল।
পলাশী পর মুসলমানদের বিপর্যয় ও কলকাতায় বরং হিন্দুদের উত্থান।
সূফি বরষণ
দুই.
মুসলমানদের পলাশীর বিপর্যয়ের পর ‘হঠাৎ-নবাব’ এই ইংরেজ কর্মচারীরা এদেশে এসেছিল বার্ষিক পাঁচ, দশ, পনের কিংবা পঁচিশ পাউন্ড বেতনের ‘রাইটার’, ‘ফ্যাক্টর’, ‘জুনিয়ার মার্চেন্ট’ বা ‘সেমি-মাচেন্ট’ হিসেবে। ‘লোফার’ শ্রেণীর এই ইংরেজ কর্মচারীরাই স্বনামে-বেনামে বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন-শোষণের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে কাড়ি কাড়ি টাকা পাচার করে নিজ দেশেও ‘কিংবদন্তীর রাজপুত্তুরের’ ইমেজ অর্জন করেছিল। কোম্পানির ‘দস্তক’র অপব্যবহার করে পাঁট পাউন্ড বেতনের কর্মচারীরা এদেশে মুৎসুদ্দী-অর্থলগ্নিকারীর মূলধনে বছরে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছিল্। তার ওপর ছিল নানা প্রকার ঘুষ ও উপঢৌকন। তাদের ব্যবসায়িক লুণ্ঠনের প্রধান অবলম্বন এ দেশীয় বেনিয়ান, মুৎসুদ্দী, গোমস্তা, দালাল ও ফড়িয়ারা। তাঁতি আর কামারশ্রেণীর গরীব উৎপাদকদের কাছ থেকে টাকা লূট করেও তারা বখরা তুলে দিত এসব ইংরেজ কর্মচারীর হতে । এভাবেই কোম্পানির বার্ষিক পাঁচ পাউন্ড বেতনের কেরানী হয়ে ১৭৫০ সালে এ দেশে এসে ওয়ারেন হেস্টিংস চৌদ্দ বছর পর দেশে ফিরেছিলেন ত্রিশ হাজার পাউন্ড সাথে নিয়ে। এরপর দ্বিতীয় দফার গভর্নর জেলারেলরূপে যখন তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে, বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্য রূপান্তরের তখন তিনিই প্রকৃত প্রতিনিধি।
এভাবেই স্বল্প বেতনভূক’ বণিক নাবিক আর লোফার’ ইংরেজ কর্মচারীরা’ বেঙ্গল নেবুব’- এ পরিণত হলো। আর তাদের এ দেশীয় লুণ্ঠন-সহচর দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দীরা দালালীর মাহত্ম্যে রাতারাতি পরিণত হলো রাজা-মহারাজারয়। এই সম্মিলিত লুটেরা চক্রটি সম্পর্কেই ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেনঃ “প্রথমে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কতগুলো ভাগ্যবিতাড়িত, চরিত্রভ্রষ্ট, ধুর্ত, পলাতক, অল্প শিক্ষিত লোক বেনিয়া-মুৎসুদ্দী-গোমস্তা-কেরানী-ফড়িয়া দালালরূপে অবাধে অঢেল অজস্র কাঁচা টাকা অর্জন ও সঞ্চয়ের দেদার সুযোগ পেয়ে ইংরেজদের এ দেশে উপস্থিতিকে ভগবানের আশীর্বাদরূপে জানল ও মানল”। (বঙ্কিম বীক্ষা-অন্য নিরিখে, ভাষা-সাহিত্যপত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৮২)
মীরজাফর নিজেকে শেষ অবধি কি চিনতে পেরেছেন? পারলেও তার ফেরার পথ খোলা ছিল না। অবজ্ঞা, অপমান আর ঘাত প্রতিঘাত নির্দেশ খবরদারীর দুর্বিপাকে পড়ে স্বপ্ন আর সম্মোহনের ঘোর কাটতে খুব বেশী দেরী হয়নি তার। দেরী হয়নি তার নিজেকে চিনতে। নবাবীর মোড়কে ঢাকা বেনিয়া চক্রের শিখণ্ডী বৈতো তিনি আর কিছু নন। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্য তার ব্যক্তিসত্তা বিক্রি হয়েছে অনেক আগে।
সিরাজের শোণিত-সিক্ত বাংলার মসনদ পরিণত হল তেজারতের পণ্যে। ক্লাইভের অর্থের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে মীর জাফর অসহিষ্ণু এবং মরিয়া হয়ে উঠলেন ইংরেজদের লালসার দোহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইলেন। একারণে তিনি ওলন্দাজদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের দেশছাড়া করার এক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। আর এ কারণেই নবাবের নাটমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হল মীর জাফরকে। তাকে পদচ্যুত করে কোলকাতায় নজরবন্দী করে রাখা হল। এর পর কোম্পানীকে টাকা উৎকোচ দিয়ে গ্রীনরুম থেকে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মীর কাসিম। মীর কাসিম শুধুমাত্র মঞ্চাভিনয়ে সীমাবদ্ধ রইলেন না। সত্যিকার নবাব হবার চেষ্টা করলেন। নাটমঞ্চ থেকে রণাঙ্গনের রক্তাক্ত পথ বেছে নিলেন বাংলার ভাগ্য ফেরানোর জন্য। সাতটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে তার অতীত গুনাহর কাফফারা আদায় করেছেন তিনি। শেষ অবধি বিচ্ছিন্ন শক্তি সমূহের সব সূত্র একই গ্রন্থিতে বাধার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হলেন। সব সময় পঞ্চম বাহিনী গাদ্দারদের প্রেতাত্মা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। গিরিয়ালা, উদয়নালা এবং বক্সারের প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাকে বাংলার মাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হয়। অবশেষে অনাহারে অর্ধাহারে ধুঁকে ধুঁকে নিরাশ্রয় মীর কাশিম দিল্লীর রাজপথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন বাংলার অবস্থা কি?
অবশেষে কোম্পানীর ছোট বড় সব কর্মচারী এবং তাদের দলগত চক্র শোষণ লুণ্ঠনের দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সমগ্র বাংলাব্যাপী। আর মুসলমানদের উচ্চবিত্ত আমীর ওমরাহর দল শিখণ্ডী নবাব হবার অভিলাষে তাদের সম্পদ উজাড় করে ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে এবং বৃটিশদের অর্থতৃষ্ণা মেটাতে থাকে। মীর কাশিম একই উদ্দেশ্যে ২ লক্ষ পাউন্ড (৪ কোটি টাকা) বর্তমান মুদ্রামানে ৮ হাজার কোটি টাকা কোম্পানীর হাতে তুলে দেন। মীরজাফরের পুত্রও কোম্পানীকে দেয় ১ লক্ষ ৪৯ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ ৩ কোটি টাকা, বর্তমান মুদ্রামানে ৬ হাজার কোটি টাকা।
ওদিকে বাংলার জনপদ তার জেল্লা হারিয়ে নৈরাশ্য, হতাশা এবং বিশৃংখলার দিকে ধাপে ধাপে এগুতে থাকে। ক্লাইভের স্বীকৃতি থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করা যায়। ক্লাইভের ভাষায়- “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি।” অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, আব্দুল ওয়াদুদ, পৃ.- ৬০-৬২)। পলাশীর বিপর্যয়ের পর বাংলার প্রধান শিল্পনগরী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে দ্রুত ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। জনগণ শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। এসব শহরের জনসংখ্যা কমছিল দ্রুত, আর অন্যদিকে তখন কলকাতায় বইছিল সমৃদ্ধির জোয়ার। লুটেরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, আর তাদের লুণ্টনবৃত্তির জুনিয়র পার্টনার এদেশীয় দেওয়ান-বেনিয়ান-গোমস্তাদের উদ্যোগে তখন সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিতপুর-বিরজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলোর ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে দ্রুত বেড়ে উঠেলিল টাউন কলকাতা। কলকাতার এই উত্থান সম্পর্কে নারায়ণ দত্ত লিখেছেনঃ
“জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা”। (জন কোম্পানির বাঙ্গালি কর্মচারী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৩) বাঙালি বেনিয়ানরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ,বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাোযাগের সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠার শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও অভিন্ন পরিচয়। এভাবেই গড়ে ওঠে ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী। মুসলিম শাসনের অবসানই ছিল এই মৈত্রীজোটের উদ্দেশ্য। (এস. সি. হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’-এর ২৩, ১০২, ১১৬ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)
এই শ্রেণীর লোকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তিস্বার্থ ও সংকীর্ণ মোহাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশত এই শ্রেণীর লোকেরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিষয়টি খোলামেলা তুলে ধরে এম. এন. রায় লিখেছেনঃ
“It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English power.” (India In Transition)
আার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ
“British could winover political authority without any opposition from the Hindus.” (British Paramountcy and Indian Renaissance. Part-II, P-4)
কাদের নিয়ে জাগল এই কলকাতা ? এরা কারা এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ লিখেছেনঃ
“আঠার শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর-যতো দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লোকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২৮২)
বিনয় ঘোষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ‘নাবিক, সৈনিক ও লোফার’- এই তিন শ্রেণীর ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণী রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টাউন কলকাতার কড়টা’ বইয়ে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ
“………. ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে।…… এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে………। বেনিয়ানরা ……. ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…….. আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ত করেন, তখন দেশ ও দে শের মানুষ সম্বন্ধে তাদেঁর কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ-প্রায় সমস্ত ব্যপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তাঁরাই হলে বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন,হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে”। (টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)
ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো- সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসেব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা। (বর্তমান মুদ্রামানে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা)। ( Miller quoted by Misra. P-15.)
পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কি মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদণ্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি, হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কেবল অলিখিত বিবরণ অর্থ সাগরপারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে? (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃ-৯৫)
একটা স্বপ্নের ঘোর ছিল মীরজাফরের। তিনি নিজেকে ভেবেছিলেন সিরাজ বিরোধী চক্রের মহানায়ক। সিরাজের পতনের অর্থ তিনিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি। তিনি জানতেন, দুঃসাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে সিরাজ দাঁড়িয়েছিলেন চোরাবালির উপরে। আর এ চোরাবালি সৃষ্টির নায়কেরা তারই সহযোগী। তাদের পছন্দসই, তাদেরই মনোনীত নবাব তিনি। তিনি ভেবেছিলেন জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উঁমিচাদ, নন্দকুমার প্রমুখ অসংখ্য হিন্দু অমাত্যবর্গ এবং মীর কাসিমের পতনের পর পুনরায় মীর জাফরকে পুতুল নবাব হিসেবে ক্ষমতায় বসানো হলো। এবার কিন্তু মীর জাফরকে নির্দেশ দেয়া হল সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। কোম্পানীর নির্দেশকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা শিখণ্ডী নবাবের ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি ৮০ হাজার সৈন্যকে বরখাস্ত করলেন। এর আগে মীর কাসিমের ৪০ হাজার সৈন্য ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। মোটের উপর পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধ নাটকের পর থেকে সেনাবাহিনীর দেড়লক্ষাধিক সৈন্য এবং এ বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজার কর্মচারী চাকুরীচ্যুত হল। এদের সবাই ছিল মুসলমান। এর ফলে বাংলার অসংখ্য মুসলিম পরিবার এগিয়ে চললো বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের দুঃসহ অবস্থার দিকেও, শুরু হল সুবাহ বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
এই সম্পর্কে হান্টার (১৮৭১ সালে) বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে সেনাবাহিনী। সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হয়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারতো না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়া হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না। পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে এই দাঁওবাজ মাস্তানশ্রেণীর লোকরাই হলো এদেশের ‘ভাগ্য বিধাতা’। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনি রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানি কর্তৃত্ব লাভের ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে এই সম্মিলিত লুটেরাচক্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হলো। তাদের হাতে বাংলাদেশের হাজার বছরের শিল্পের গৌরব মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে অবিশ্বাস্য অল্পকাহিনীতে পরিণত হলো। ইংরেজদের সৃষ্ট শুল্ক-প্রতিরোধ নীতির ফলে এ দেশের বিশ্বখ্যাত সূতি বস্ত্র ও রেশম-বস্ত্র ধ্বংস হলো। কুটির শিল্প হলো বিপর্যস্ত। আগে বাংলাদেশের কাপড় বিলাতে রফতানী হতো। এখন ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্র আমাদের বাজার দখল করল।
No comments:
Post a Comment