বাংলায় কৃষকদের নীল বিদ্রোহ।
সূফি বরষণ
২১ জুন ২০১৬ গত মঙ্গলবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর বলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে।
আমাদের পূর্বপুরুষ নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে লিখেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের জের হিসেবে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের মধ্যে এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রথম ১০০ বছর পযন্ত উপ-মহাদেশের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এবং পরবর্তী ৯০ বছরকাল ইংরেজ সরকার দ্বারা সরাসরিভাবে পরিচালিত হয়েছে।
অত্যন্ত দু:খজনক হলেও এ কথা বলতে হয় যে, ১৭৬৪ সালের বকসার যুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশীয় রাজন্যবর্গ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে যে সব লড়াই করেছে তার ইতিহাস পাওয়া গেলেও ১৭৬৯-৭০ সালের মহামন্বন্তর –এর পর থেকে শ্রেণীগতভাবে যে সব রক্তাক্ত বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সবের তথ্যভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও পর্যন্ত রচিত হয়নি।
এসব বিদ্রোহের মধ্যে শুধুমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাবে অনুষ্ঠিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৩-৮৩), ত্রিপুরার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), স্বন্দীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক তন্তুবায়ের লড়াই (১৭৭০-৮০) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকলা বিদ্রোহ(১৭৭৬-৮৭) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে উপ-মহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশও নীল চাষ –এর সুত্রপাত হয়। মঁশিয়ে লুই বন্নো নামে জনৈক ফরাসি ব্যবসায়ী ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ করেন এবং পরের বছর ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যারল ব্লুম নামে জনৈকি ইংরেজ এদেশে প্রথম নীল কুঠি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ড-এ শিল্প বিপ্লবের জের হিসেবে দ্রুত বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠলে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, এ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশে যে নীল প্রতি পাউন্ড চার আনায় ক্রয় করত, ইংল্যান্ড-এ তার বিক্রয় মূল্য ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকার মতো এবং বাংলাদেশ থেকেই সমগ্র বিশ্বের নীলের চাহিদা মেটানো হতো।
এই সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ে নীলকুঠির বর্ণনা যেভাবে ফুটে উঠেছে: ''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল। 'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত।''
প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮)
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। ফলে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩)।
নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে আরও লিখেন, প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকর সাহেবরা স্থানীয় জমিদারদের সক্রিয় সহযোগিতায় তাদের প্রজাদের দিয়ে প্রজাদেরই জমিতে নীল চাষ করাতেন এবং সস্তায় ফসল ক্রয় করে নিজেদের ব্যবস্থাধীনে নীল রং নিষ্কাশন করাতেন। নীল রং নিষ্কাশন –এর এসব কেন্দ্রকেই ‘কুঠি’ বলা হতো। কিন্ত স্বল্পদিনের ব্যবধানে দেখা যায় যে, ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেরাই জমিদারি ক্রয় করে কিংবা ইজারা গ্রহণ করে প্রজাদের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের ব্যবস্থা করেছে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। অর্থ ও প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা নিজেদের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জমিদার ও জোতদারদের অধীনস্থ প্রজাদের জোর করে দাদন বা অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তিপত্রে দস্তখত করিয়ে নিতে শুরু করল। চুক্তিবদ্ধ চাষিকে কী পরিমান জমিতে নীল চাষ করতে হবে এবং উৎপন্ন ফসল কী মূল্যে কুঠিয়ালদের কাছে বিক্রি করতে হবে সবই চুক্তিপত্রে লেখা থাকত।
একবার চুক্তিপত্রে দস্তখত করলে চাষিকে আমৃত্যু নীল চাষ করতে হতো। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে চাষিদের উপর নেমে আসত “হাবিয়া দোজখ” –এর অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হারান চন্দ্র চাকলাদার তার ‘ফিফটি ইয়ার্স এগো’ (১৯০৫ জুলাই) নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন,“বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের সমসাময়িক নথিপত্রই এই অকাট্য প্রমান বহন করে যে, নীল চাষ প্রবর্তনের দিনটি থেকে শুরু করে তা একেবারে না উঠে যাওয়া পযন্ত যে সমস্ত পন্থায় রায়তদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো তার মধ্যে ছিল হত্যাকান্ড, বিচ্ছিন্নভাবে খুন, ব্যাপকভাবে খুন, দাঙ্গা, লুটতরাজ, বসতবাটি জ্বালানো এবং লোক অপহরন প্রভৃতি।”
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ (অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত) এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ (হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত) পত্রিকা দুটোতে এসব অত্যাচারের ‘ছিটেফোটা কাহিনী’ প্রকাশিত হতো। এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকেও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কিছু বিবরণ আছে। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইংরেজ আদালতে কোনও ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজ বিচারকদের আদালতে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিচারই প্রহসনে পরিনত হয়েছিল। বাস্তব অবস্থাটা ছিল খুবই করুণ। সুবিচার তো হতোই না; বরং ইংরেজ নীলকরদের আক্রোশ আরও বেড়ে যেতো আর চাষিদের হতো সর্বনাশ।
সূফি বরষণ
২১ জুন ২০১৬ গত মঙ্গলবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর বলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে।
আমাদের পূর্বপুরুষ নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে লিখেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের জের হিসেবে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের মধ্যে এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রথম ১০০ বছর পযন্ত উপ-মহাদেশের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এবং পরবর্তী ৯০ বছরকাল ইংরেজ সরকার দ্বারা সরাসরিভাবে পরিচালিত হয়েছে।
অত্যন্ত দু:খজনক হলেও এ কথা বলতে হয় যে, ১৭৬৪ সালের বকসার যুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশীয় রাজন্যবর্গ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে যে সব লড়াই করেছে তার ইতিহাস পাওয়া গেলেও ১৭৬৯-৭০ সালের মহামন্বন্তর –এর পর থেকে শ্রেণীগতভাবে যে সব রক্তাক্ত বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সবের তথ্যভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও পর্যন্ত রচিত হয়নি।
এসব বিদ্রোহের মধ্যে শুধুমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাবে অনুষ্ঠিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৩-৮৩), ত্রিপুরার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), স্বন্দীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক তন্তুবায়ের লড়াই (১৭৭০-৮০) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকলা বিদ্রোহ(১৭৭৬-৮৭) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে উপ-মহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশও নীল চাষ –এর সুত্রপাত হয়। মঁশিয়ে লুই বন্নো নামে জনৈক ফরাসি ব্যবসায়ী ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ করেন এবং পরের বছর ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যারল ব্লুম নামে জনৈকি ইংরেজ এদেশে প্রথম নীল কুঠি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ড-এ শিল্প বিপ্লবের জের হিসেবে দ্রুত বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠলে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, এ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশে যে নীল প্রতি পাউন্ড চার আনায় ক্রয় করত, ইংল্যান্ড-এ তার বিক্রয় মূল্য ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকার মতো এবং বাংলাদেশ থেকেই সমগ্র বিশ্বের নীলের চাহিদা মেটানো হতো।
এই সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ে নীলকুঠির বর্ণনা যেভাবে ফুটে উঠেছে: ''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল। 'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত।''
প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮)
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। ফলে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩)।
নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে আরও লিখেন, প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকর সাহেবরা স্থানীয় জমিদারদের সক্রিয় সহযোগিতায় তাদের প্রজাদের দিয়ে প্রজাদেরই জমিতে নীল চাষ করাতেন এবং সস্তায় ফসল ক্রয় করে নিজেদের ব্যবস্থাধীনে নীল রং নিষ্কাশন করাতেন। নীল রং নিষ্কাশন –এর এসব কেন্দ্রকেই ‘কুঠি’ বলা হতো। কিন্ত স্বল্পদিনের ব্যবধানে দেখা যায় যে, ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেরাই জমিদারি ক্রয় করে কিংবা ইজারা গ্রহণ করে প্রজাদের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের ব্যবস্থা করেছে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। অর্থ ও প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা নিজেদের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জমিদার ও জোতদারদের অধীনস্থ প্রজাদের জোর করে দাদন বা অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তিপত্রে দস্তখত করিয়ে নিতে শুরু করল। চুক্তিবদ্ধ চাষিকে কী পরিমান জমিতে নীল চাষ করতে হবে এবং উৎপন্ন ফসল কী মূল্যে কুঠিয়ালদের কাছে বিক্রি করতে হবে সবই চুক্তিপত্রে লেখা থাকত।
একবার চুক্তিপত্রে দস্তখত করলে চাষিকে আমৃত্যু নীল চাষ করতে হতো। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে চাষিদের উপর নেমে আসত “হাবিয়া দোজখ” –এর অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হারান চন্দ্র চাকলাদার তার ‘ফিফটি ইয়ার্স এগো’ (১৯০৫ জুলাই) নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন,“বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের সমসাময়িক নথিপত্রই এই অকাট্য প্রমান বহন করে যে, নীল চাষ প্রবর্তনের দিনটি থেকে শুরু করে তা একেবারে না উঠে যাওয়া পযন্ত যে সমস্ত পন্থায় রায়তদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো তার মধ্যে ছিল হত্যাকান্ড, বিচ্ছিন্নভাবে খুন, ব্যাপকভাবে খুন, দাঙ্গা, লুটতরাজ, বসতবাটি জ্বালানো এবং লোক অপহরন প্রভৃতি।”
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ (অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত) এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ (হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত) পত্রিকা দুটোতে এসব অত্যাচারের ‘ছিটেফোটা কাহিনী’ প্রকাশিত হতো। এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকেও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কিছু বিবরণ আছে। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইংরেজ আদালতে কোনও ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজ বিচারকদের আদালতে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিচারই প্রহসনে পরিনত হয়েছিল। বাস্তব অবস্থাটা ছিল খুবই করুণ। সুবিচার তো হতোই না; বরং ইংরেজ নীলকরদের আক্রোশ আরও বেড়ে যেতো আর চাষিদের হতো সর্বনাশ।
No comments:
Post a Comment