Thursday 23 June 2016

পর্ব দুই । ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

পলাশী বিজয়ের পটভূমি তৈরী করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা। 


সূফি বরষণ 

পলাশী বিপর্যয়ের মূল নায়ক মীর জাফর নয় মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ আর তাঁর সহযোগী ছিলো নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রায় দুর্লভ রাম, নন্দকুমার, উমিচাঁদ । ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের স্বৈরাচারী শোষণ, লুণ্ঠন এবং আধিপত্যের অবসান হয় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর। তাদের লুপ্ত শক্তি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ ইতিহাসে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নেপথ্যে। সম্মুখ সমরে মুসলমানদের পরাস্ত করার সর্বশেষ প্রয়াস ছিল আগ্রার অদূরে খানুয়ায় বাবুরের সাথে যুদ্ধ। উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দু রাজা ও মহারাজাদের সম্মিলিত বাহিনীর ৮০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫০০ রণ হস্তী সম্রাট বাবুরের ১০ হাজার সৈন্যের প্রতিরোধের মুখে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সম্মুখ সমর পরিহারের নীতি অবলম্বন করে।  অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তারা অতি ধৈর্য সহকারে নেপথ্য ষড়যন্ত্রের পথে এগুতে থাকে। তোষণ ও আনুগত্যের অভিনয় করে এক দিকে যেমন সংশ্লিষ্ট শাসকদের আস্থা অর্জন করে, অন্যদিকে অনুরূপ ষড়যন্ত্রের নিত্য নব নব কৌশল অবলম্বন করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

তখন বাংলার সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী। কারণ এর পিছনে কাজ করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা। তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার...। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলাদেশের মহাজনদের মাথা জগেশঠদের বাড়ির কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগেশঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলাদেশে পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।...হুগলিতে রইলেন নন্দকুমার। উমিচাঁদ ইংরেজদের হয়ে তাঁকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে রেখেছিলেন।’ জগেশঠ এবং উমিচাঁদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাঁ আর একজন ষড়যন্ত্রকারী।

সবার শীর্ষে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর এক বৈমাত্রেয় ভগ্নীর স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। নবাব হওয়ার বাসনা তার অনেক দিনের। বর্গীর হাঙ্গামার সময় আলীবর্দী খাঁকে হত্যা করিয়ে বাংলার নবাবী গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল। শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে শওকত জঙ্গের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রের আর এক গ্রন্থি রচনা করেন। তা কার্যকর হয়নি। এবারে জগেশঠ, ইয়ার লতিফ খাঁ, উমিচাঁদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামেন। সিরাজের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনানায়ক মোহন লাল এবং মীর মদন বা মীর মর্দান। ২৩ জুনের পূর্বে বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় রচিত মীর কাসিম গ্রন্থের ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় ১১ দফার এই চুক্তির বিবরণ রয়েছে। মীর জাফরের স্বাক্ষরে চুক্তিতে বলা হয় : ‘আমি আল্লাহ্র নামে ও আল্লাহ্র রসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানিয়া চলিব।’

এই কর্ম প্রয়াস শুরু হয় উপমহাদেশের সর্বত্র। যেমন মুর্শিদাবাদে শুরু হয় মুর্শিদকুলি খানের শাসনামল। আমি আগেই উল্লেখ করেছি পলাশী ট্রাজেডীর মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ। মীর জাফর ছিলেন শিখণ্ডী, পুরানের ভাষায় অধৈর্য। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী অধৈর্য ব্যক্তিত্বকে অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতায়নে প্রলুব্ধ করে এবং তাকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকে সর্বব্যাপী করে তুলে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, নবাব আলী ওয়ার্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলাহর শাসনামলে অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার ছিল হিন্দু। ‘দেওয়ান’ ‘তানদেওয়ান’ ‘সাবদেওয়ান’ ‘বখশী’ প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিতেই হিন্দুরা অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছিল মীরজাফর। অপরদিকে ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিল হিন্দু। ফলে একজন স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি হিসেবে তিনি যখন বারবার ইংরেজদের হুঁশিয়ার করে দেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে ও দেশের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা যদি ব্যবসা করে তবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। অন্যথায় তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত তো করেইনি, বরং নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে।

 এর কারণ সুস্পষ্ট তারা ভিতর থেকে ইন্ধন পাচ্ছিল। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল নবাবের সুবিধাবাদী, দেশদ্রোহী কিছু রাজকর্মচারী আর ঈর্ষাপরায়ণ কিছু নিকটাত্মীয়। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল আর বাংলার বিশ্বাসঘাতক কুচক্রী অমাত্যবর্গের মধ্যে ১ মে ১৭৫৭ সালে এক গোপন লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়। দরবারের ষড়যন্ত্রের যারা মূল হোতা তাদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি হবার কারণে ঘটনাচক্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল মীর জাফর, এর পেছনের প্রধান চক্রান্তকারীরা ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা প্রাসঙ্গিক মনে করছি তা হলো- পলাশী বিপর্যয়ের জন্য নবাবের নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে এককভাবে দায়ী করা হয়। মীরজাফর লোভী, অপদার্থ, বিশ্বাসঘাতক ছিল এবং তার চূড়ান্ত বেঈমানীর ফলেই পলাশী দিবসের প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল সবই ঠিক আছে। কিন্তু উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী শীর্ষ জমিদার আমলারা কি ধোয়া তুলসী পাতা? উর্মিচাঁদ, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, মানিকচাঁদ, দূর্লভরাম, রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্ররায়, নন্দকুমার এরা কি শুধুই পার্শ্বচরিত্র ছিল? অন্তত একশ্রেণীর ঐতিহাসিক সে রকম ধারণা দিতেই বদ্ধপরিকর। ঐতিহাসিক মোহর আলী যথার্থই বলেছেন: “মীরজাফর যদি এই চক্রান্তে যোগ নাও দিত ষড়যন্ত্রকারীরা অন্য কাউকে খুঁজে নিত।” এদের প্রচারণা এতই শক্তিশালী ছিল যে, আজকে আমজনতার একটা বিরাট অংশ সেটাকেই প্রকৃত ইতিহাস বলে গ্রহণ করে ফেলেছে। যাইহোক সেই গোপন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বিশাল সৈন্যবাহিনী থাকা সত্ত্বেও ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে যুদ্ধ যুদ্ধ নাটকের মাধ্যমে জাতীয় বেঈমানরা দেশ ও জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে গুটিকতক বিদেশী বেনিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক নবাবকে তারা গ্রেফতার ও পরে শহীদ করে।

পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলা-বিহার ইংরেজ ও তাদের দেশীয় দালাল বর্ণহিন্দুদের লুটপাটের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছিল। একজন মুসলমানও পাওয়া যায়নি যে পলাশী যুদ্ধের পর সম্পদশালী হয়েছিল। অথচ পেটের দায়ে এদেশে আসা ইংরেজ ও তাদের দেশীয় সেবাদাস জগৎশেঠ গংরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। ইংরেজরা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্নীতি আমদানী করে ব্যাপকভাবে। বৃটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশবছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এই ব্যাপক লুন্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে (বাংলা-১১৭৬) বাংলা-বিহারে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কোটি মানুষ  মৃত্যের শিকারে পরিণত হয়।  ‘‘ছিয়াত্তরের মনন্তর’’ নামে পরিচিত এই মহাদূর্ভিক্ষে ইংরেজ গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ।

বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হীরানন্দ সাহা তিনি মারোয়ারের নাগর থেকে পাটনায় এসে সুদের কারবার শুরু করেন। ১৭১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মানিক চাঁদ সুদের কারবার শুরু করেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত মুর্শিদকুলি খানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। মুর্শিদকুলি খান তার দিওয়ানী দপ্তর মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করার সাথে সাথে মানিক চাঁদও ১৭১২ সালে মুর্শিদাবাদে এসে পড়েন। একই বছর তিনি নবাব কর্তৃক নগর শেঠ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৭১৪ সালে মানিক চাঁদের মৃত্যু হলে তার ভাগিনা ফতেহ চাঁদ সাহা তার উত্তরাধিকারী হন। মুর্শিদকুলি খানের সুপারিশে ফতেহ চাঁদ দিল্লীর বাদশাহ কর্তৃক জগৎশেঠ অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংকার উপাধিতে ভূষিত হন। তুর্ক আফগান সামন্তদের বিদ্রোহের আশংকায় মুর্শিদ কুলিখান তার কৌশল পরিবর্তন করে বর্ণ হিন্দু রাজা মহারাজাদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে শুরু করেন এবং তাদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

নবাব মুসলিম মুদ্রা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ত্যাগে বাধ্য করেন। ডক্টর মোহর আলী লিখেছেন, একচেটিয়া মুদ্রা ব্যবসা ও সরকারী টাকশালে বিদেশী বণিকদের স্বর্ণতাল ও মুদ্রা তৈরীর একচ্ছত্র ক্ষমতা শুধু জগৎশেঠকে প্রদান করা হয়। মুর্শিদকুলি খানের উড়িষ্যার নায়েব সুবাদার সুজাউদ্দিন ছিলেন ভোগ বিলাসী চরিত্রহীন। অপূত্রক নবাব তার নাতি অর্থাৎ সুজাউদ্দিনের পুত্রকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং দিল্লীস্থ তার প্রতিনিধি বালকিষানকে বাদশাহর স্বীকৃতি আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। শুরু হয় ষড়যন্ত্র নাটক। নবাবের আস্থাভাজন জগৎশেঠ ফতেহ চাঁদ নবাবের ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে অতি গোপনে সুজাউদ্দিনকে প্ররোচিত করেন এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও সমর্থন দিয়ে সুজাউদ্দিনের প্রত্যাশা ও অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। এমনকি পরবর্তীতে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ব্যাপারে দিল্লীর দরবারকে প্রভাবিত করেন। নবাব মুর্শিদকুলির নিজের প্রতিনিধি বালকিষান বাবু তার উত্তরাধিকারী মনোনয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব গোপন রেখে তার প্রেরিত নজরানা উপঢৌকন ব্যবহার করেই সুজাউদ্দিনের পক্ষে দিল্লীর দরবারে তদবীর করেন এবং মুর্শিদ কুলীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুজা উদ্দিনের নামে পরবর্তী নবাবীর সনদ সংগ্রহ করেন। [তারিখে বাংলা পৃঃ ১২৪, উদ্ধৃতি মোহর আলী : হিষ্ট্রি অব দি মুসলিম অব বেঙ্গল]

মুর্শিদকুলী খানের শয্যা পাশে বসে জগৎশেঠ সুজাউদ্দিনকে মুর্শিদাবাদ আক্রমনের সংকেত পাঠান। সুজাউদ্দিনের সৈন্যরা মুর্শিদাবাদ অবরোধ করে। নবাব পত্মীও তার কন্যা সুজাউদ্দিনের স্ত্রীর হস্তক্ষেপে মনোনীত নবাব সরফরাজ খান পিতা সুজাউদ্দিনকে নবাব হিসেবে মেনে নেন। সুজাউদ্দিন জগৎ শেঠকে তার অতি বিশ্বস্ত এবং ঘনিস্টজন হিসেবে গণ্য করেন এবং ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রশাসনিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
১৭২৭ সালে বিশ্বাসঘাতকতার সাফল্য জগৎশেঠ এবং তার সহযোগীদের অতি উৎসাহী করে তুলে। মুসলিম শাসনকে দুর্বল করে তোলা এবং বৈষয়িক ফায়দা অর্জনের জন্য ব্রাহ্মণ্য চক্র আর এক নতুন খেলা শুরু করলেন মুর্শিদাবাদের নবাবী নিয়ে। জগৎশেঠ আলম চাঁদ বাবুকে নিয়ে হাজী আহমদ ও আলীবর্দী খানের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এদের লক্ষ্য ছিল আলীবর্দী খানকে মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা আলীবর্দীর প্রতি দুর্বলতার কারণে নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুসংহত মুসলিম শক্তিকে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মবিনাশের দিকে ধাবিত করানো এবং সংঘর্ষ, যড়যন্ত্র ও যুদ্ধের ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ হাতিয়ে নেয়া।

যাইহোক মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিনের যখন মৃত্যু হল সে সময় নাদির শাহ দিল্লী দখল করে নেয় এবং সুবাহ বাংলার আনুগত্য ও রাজস্ব দাবী করে। নাদির শাহ  মুর্শিদাবাদের নবাবের নিকট চিঠি লেখেন। নাদির শাহের পত্র পাওয়া মাত্র সরফরাজ খানের অনুমতি নিয়ে ব্যাঙ্কার জগৎশেঠ তাৎক্ষণিকভাবে রাজস্ব পরিশোধ করে দেন। কুচক্রী জগৎশেঠ এবং বাবু আলম চাঁদের পরামর্শে সুজাউদ্দিন অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশের জন্য নাদির শাহের নামে খুতবা পাঠ করেন এবং মুদ্রা প্রচলন করেন। এটাও ছিল জগৎশেঠ গংদের ষড়যন্ত্র। ওদিকে কয়েক মাসের মধ্যে নাদির শাহ দিল্লী ত্যাগ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে মুহাম্মদ শাহ তার সিংহাসনে পুনরারোহণ করেন। এই সুযোগে দিল্লীর আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশায় জগত শেঠ গোপনে তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করে দিল্লীর দরবারকে জানিয়ে দেন যে সরফরাজ খান বিদ্রোহী।

(তারিখে বাংলাহ পৃঃ ১৫৫-৫৬)। ব্রাহ্মণ্য চক্র এখানেই থেমে থাকল না। সরফরাজ খানের বদলে আলীবর্দী খানকে বাংলার সুবাদার করার ব্যাপারে দিল্লীর দরবারকে প্রভাবিত করলো। অবশেষে তারা আলীবর্দীর নামে সনদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন। এই বাবু গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের পরামর্শে সরফরাজ খান তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক হ্রাস করলেন। ওদিকে ব্যাংকার জগত শেঠ ২৫ লক্ষ টাকা অর্থাৎ বর্তমান মুদ্রামানে ৫ শত কোটি টাকা আলীবর্দী খানের নিকট প্রেরণ করেন সুজার বরখাস্তকৃত সৈন্যদের তার সেনা বাহিনীতে নিয়োগ দেয়ার জন্য। অন্যদিকে বিহারের হিন্দু জমিদারদের আলীবর্দী খানকে নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দানের জন্য প্ররোচিত করেন। আলীবর্দী খানের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে জগৎশেঠ তাকে মুর্শিদাবাদ আক্রমণের আহ্বান জানায়।

সামরিক গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ তেলিয়াগিরি অতিক্রম করে আলীবর্দী খানের বাহিনী মুর্শিদাবাদের ২২ মাইল দুরত্বে অবস্থান নেয়। নবাব সরফরাজ খান আকস্মিক অবরোধে কিছুটা বিচলিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। এই অবরোধে তার আমাত্যবর্গের যোগসাজশ সম্পর্কে তার ধারণা বদ্ধমূল হয়। তার সন্দেহ বহুলাংশ সঠিক হলেও পঞ্চমবাহিনীর মূল হোতাকে তিনি চিনতে ভুল করলেন। জগৎশেঠের বদলে তিনি হাজী আহমদকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কারারুদ্ধ করলেন। পঞ্চম বাহিনীর দুই হোতা বাবু আলম চাঁদ ও জগৎশেঠের সাথে সরফরাজ খানের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়ে উঠল। এই দুই কুচক্রী পরামর্শক হিসেবে সরফরাজ খানের যুদ্ধ যাত্রার সঙ্গী হলেন। প্রথম দিনের যুদ্ধে আলীবর্দী খানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে উঠল।

নিশ্চিত পরাজয় থেকে বাবু আলম চাঁদ আলীবর্দী খানকে উদ্ধার করলেন সরফরাজ খানকে যুদ্ধ মুলতবী ঘোষণার পরামর্শ দিয়ে। যুদ্ধের মোড় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাবু আলম চাঁদ এবং জগৎশেঠ বিভিন্নভাবে যোগসাজশ সলাপরামর্শ করে এবং সরফরাজ খানের সেনাপতিদেরকে মুচলেকা অর্থ বিত্তের বিনিময়ে পক্ষ ত্যাগে প্রলুব্ধ করলেন। পরদিন পূর্বাহ্নের যুদ্ধে সরফরাজ খানের বিজয় নিশ্চিত হয়ে উঠলে বাবু আলম চাঁদ তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে মনে করে আত্মহত্যা করলেন। ষড়যন্ত্রের মূলনায়ক জগৎশেঠ ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন শেষ অবধি। এমতবস্থায় জগৎশেঠ তার নেপথ্য ষড়যন্ত্র আরো জোরদার করলেন। দুপুরের পর যুদ্ধ পরিস্থিতি বদলে গেল। অবশেষে সরফরাজ খান নিহত হলেন। জগৎশেঠ সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বিজয়ী আলীবর্দী খানকে রাজধানীর অভিমুখে নিয়ে চললেন। বিশ্বাসঘাতকদের রক্তাক্ত আঙ্গিনা পেরিয়ে আলীবর্দী খান ক্ষমতাসীন হলেন। সম্ভবত সেদিনই সবার অলক্ষ্যে আর এক মর্মান্তিক বিপর্যয়ের ইতিহাস নিয়তির অদৃশ্য কাগজে লেখা হয়েছিল, লেখা হয়েছিল আলীবর্দীর বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে।

এরপর জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদের দরবারে সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। মুসলমানদের চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য জগৎশেঠ নতুন প্রেরণায় নবতর চক্রান্ত জাল বিস্তারের জন্য উন্মাতাল হয়ে উঠেন। ১৭৪০ সালে আলীবর্দী খান নবাব হলেন ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার ক্ষমতারোহনের ৩৩ বছর আগে থেকে উত্তর-মধ্য পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত ছিল অস্থির। ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলছিল সাফল্যের দিকে। হুমায়ুন ও আকবরের সময় থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের ঘাটিতে পরিণত হয়েছিল মুঘল প্রাসাদ। মুঘল হেরেমে রাজপুত বালাদের স্থান লাভের পর থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি মুঘল প্রাসাদকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়। শরাব সাকী নৃত্য গীত বিলাসিতা ও আলস্যে বিবস হয়ে পড়ে সংগ্রামী বাবরের বংশধররা। তাদের ঔদাসীন্যের কারণে ব্রাহ্মণ্য ষড়যন্ত্র পোক্ত হয়ে উঠে। সম্রাট আরঙ্গজেব চলমান ধারা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেও তার সময় থেকেই শুরু হয় ব্রাহ্মণ্য বাদীদের মুসলিম বিরোধী তৎপরতা।

 আওরঙ্গজেব তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তী মুঘল উত্তরাধিকারীরা বর্ণ হিন্দু, রাজপুত জাঠ মারাঠা এবং শিখদের সুসংবদ্ধ অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। উপমহাদেশের বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞের মত মুসলিম নিধন শুরু হয়। লুণ্ঠন ও হত্যার নৃশ্বংসতা মুসলিম জনপদগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। মুঘল ও মুঘলাই সংস্কৃতির ধারকদের নেশাগ্রস্ত অন্তরে মুসলিম জনপদগুলোর মাতম কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। তারা ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে উম্মাতাল এবং আত্মঘাতি তৎপরতায় লিপ্ত। কিন্তু তখন সুবাহ বাংলার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকম, এখানে প্রশাসন ছিল মিশ্র। নামে মুসলমানদের হাতে নবাবী থাকলেও সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য ছিল হিন্দুদের। মুঘলাই সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী বাংলার মুসলিম আমীর ওমরাহ ও উচ্চ শ্রেণী যাবতীয় নৈতিকতা ও সততা বিসর্জন দিয়ে ভ্রাতৃঘাতী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তবে বাংলার জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান থাকার কারণে এবং বাংলার কোন বিশেষ অঞ্চল বর্ণ হিন্দুদের শাসনাধীনে না থাকায় বর্ণবাদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে অথবা নেয়াতে সক্ষম হয়নি।

 এ সত্ত্বেও বাংলার বর্ণ হিন্দুরা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মুসলিম বিরোধী ভূমিকায় পিছিয়ে ছিল না। তারা প্রকাশ্য যুদ্ধ না করলেও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে মুসলমানদের চূড়ান্ত ক্ষতিসাধনে তৎপর ছিল। সমস্ত মুসলিম বিরোধী তৎপরতার মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ। একদিকে যেমন আলীবর্দী খানের উপর ছিল তার প্রভাব অন্যদিকে মুদ্রা ভাংগানী ব্যবসার সূত্রে ইংরেজদের সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা। আলীবর্দী খানের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সহযোগী হওয়ার কারণে ঘষেটি বেগমের বিশ্বস্ত প্রাদেশিক দেওয়ান রাজ বল্লভ এবং বিহারে নিযুক্ত প্রথম গভর্নর জানকী রাম ও পরবর্তী গভর্নর রামনারায়ণের সাথে নবাবের দিওয়ান চিনুরায় বাবু বীরু দত্ত, আলম চাঁদের পুত্র বারারায়ান করাত চাঁদ ও উমিচাঁদের সহযোগিতায় রাজস্বের জামিন ব্যাংকার হিসেবে সারা বাংলার জমিদারদের সাথে ছিল স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠের নিয়মিত যোগাযোগ।

সেনাবাহিনীর প্রধান প্রভাবশালী সৈন্যাধক্ষ, রায় দুর্লভ, রাম বাবু, মানিক চাঁদ, রাজা নন্দ কুমার, মোহন লাল প্রমুখও ছিলেন তার আপন জন। যেসব হিন্দু বেনিয়া মালামাল সরবরাহ করত সেই সব প্রতিষ্ঠিত বণিকদের সাথেও জগৎশেঠের ভাল সম্পর্ক ছিল। এই কারণে জগৎশেঠ মধ্যমনি হয়ে ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করতে অতি সহজে সক্ষম হন।
বর্গী হামলা প্রতিহত করার নামে বর্ধমানের মহারাজার সাথে মিলে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদের নবাবের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। অবশ্য ধরা পড়ে বর্তমান মুদ্রামানে দু হাজার কোটি টাকা নবাবকে ফেরত দিতে বাধ্য হন। পক্ষান্তরে বর্গী হামলার হাত থেকে রক্ষার নামে ইংরেজদের সাথে ব্যবসারত বর্ণ হিন্দু বণিকদের চাঁদার টাকায় কোলকাতা নগরীকে ঘিরে মারাঠা রক্ষা প্রাচীর ও পরিখা গড়ে তুলে সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার বিত্তশালী বর্ণ হিন্দু ব্যক্তিদেরকে এমনভাবে জমায়েত করা হয় যে ১৬৯০সালে প্রতিষ্ঠিত কোলকাতার জনসংখ্যা ১৭৫৭ সালের আগেই হয়ে দাঁড়ায় লক্ষাধিক এবং এই জনসংখ্যার এক শতাংশও মুসলমান ছিল না। এর ফলে কোলকাতা কুচক্রীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো।

সহায়ক গ্রন্থ
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867
দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।

No comments:

Post a Comment