Sunday 19 June 2016

পর্ব ছয় । কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।




সূফি বরষণ
উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭০  পৃষ্ঠায়  মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ১ জুলাই ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে লিখেন, আমাদের দেশের কৃষকের ন্যায় ঘোর পরিশ্রমী জাতি পৃথিবীর মধ্যে দৃষ্ট হইবে না, আবার হইা ... দৈন্যও বুঝি জগতে নাই। ....এইঘোর পরিশ্রমের ফল কি! শোচনীয় দৈন্যতা! কৃষক মাত্রই প্রায় অন্ন ও বস্ত্রহীন, গৃহহীন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। য়অধিকাংশেরই পর্ণ কুটিরে বাসসকরিতে হয়, সকলের ঘরে আবার আবশ্যকীয় খড়ও নাই। পরিধেয় বস্ত্র একখানি ভিন্ন দুখানি কাহার ভাগ্যে জুঠিয়া উঠে না। প্রায় কৃষক মাত্রের অর্দ্বশনে কি অনশনে দিন পাত করিতে হয়, অধিক কি ভোজন পাত্র ও জলপাত্র পর্যন্ত নাই। এই হৃদবিদারক অবস্থায় ১২ ঘন্টা পর্যন্ত ভুতানন্দী পরিশ্রম ! আমাদের শুনিলে আতঙ্ক হয়, কিন্তু এই হতভাগাদের প্রতিদিন এই রূপে কাটাইতে হয়। ক্যারোলিনার দাসগণের অবস্থা কি হইা অপেক্ষা মন্দ ।

এই সম্পর্কে বিনয় ঘোষ তাঁর বই বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা গ্রন্থের ২১ পৃষ্ঠা বলেন, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে যথন এই গুরুদায়িত্ব জমিদারদের দেওয়া হল, তখন বাংলাদেশের অবস্থা কি? এই বন্দোবস্তের আগেই ইংরেজদের রাজস্ব সংগ্রহের নানারকম কৌশল প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের বনেদি...... কৃষক ...চরম দুরবস্হায় পৌঁছেছিল। তার উপর ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলার গ্রাম প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বলা চলে। এই ঐতিহাসিক দুর্ভিক্ষের চিত্র জন শোর তাঁর একটি কবিতায় জীবন্তরূপে এঁকেছেন:

still fresh in memory,s eye the scene i view.
The shrivelled limbs, sunk eyes, and lifeless hue;
Still hear the mother's shrieks and infants moans.
cries of despair and agonising moans.
in wild confusion dead and dying lie;
Hark to the jackals yell and vultures cry,
the dogs fell howl, amidst the glare of day
They riot unmolested on their prey!
dire scenes of horror, which no pen can trace,
nir rolling years from memory,s page efface.
দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরে দেখা যায় যে বাংলাদেশের কৃষকদের প্রায় তিনভাগের একভাগ নিশ্চিহৃ হয়ে গিয়েছে।

উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭১ পৃষ্ঠায়  মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ১ জুলাই ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে আরও লিখেন, জমিদারের অত্যাচার । অধিকাংশ জমিদারগণই প্রজার উপর নিপীড়ণ করেন ও তাহাদের স্বর্ব্বস্ব শোষণ করিয়া লন। কি ২ উপায়ে জমিদারগণ প্রজার অর্থ দ্বারা আপনাদিগের উদর পূর্ণ করেন, তাহার কয়েকটি এখানে বলা যাইতেছে।

প্রথম নিয়মিত খাজনা । ইহার আনুসঙ্গিক কষ্ট ও অর্থব্যয় আছে। যদি প্রজার খাজনা দিতে বিলম্ব হইল, তবে পেয়াদা নিযুক্ত করা হয়। পেয়েদা হতভাগ্য প্রজাকে কাছারীর বাটিতে ধরিয়া আনিয়া যারপর নাই অপমান করে। তাহাকে রৌদ্রে দাড় করা করাইয়া রাখে, প্রহার করে ও কখন ২ জুতান্ত পর্যন্ত করিয়া থাকে । তখন এই হতভাগাদের অবস্থা দেখিলে পাষাণ হৃদয়ও বিদির্ণ হইয়া যায়। পেয়াদারা উহাদের নিকট হইতে চারি আনা কেহ বা আট আনা করিয়া লইয়া থাকে। জমিদারেরও খাজনা ছাড়া জরিমানা স্বরূপ আরও কিছু প্রাপ্য হয়।

দ্বিতীয় ভিক্ষা । পিতৃ মাতৃ শ্রাদ্ধ কি পুত্র কন্যা বিবাহ উপলক্ষে কি অন্য কোন বাবদে প্রজার নিকট হইতে প্রায়ই প্রতি বৎসর বিলক্ষণ কিছু লওয়া হইয়া থাকে ।

তৃতীয় নজর। জমিদার মাঝে ২ জমিদারিতে গমণ করেন এবং নজর স্বরূপ আচ্ছা দশটাকা হাত মারিয়া আসেন ।

চতুর্থ । জমিদারির মধ্যে স্কুল, ডিস্মেন্সরি, পুস্করণী, বাঁধ কি অন্য কোন কার্যে্যর অনুষ্ঠান দ্বারা জমিদারের বেশ লাভ আছে। হইাতে যে ব্যয় হয় তাহার অতিরিক্ত প্রজার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হয়। জমিদারের অত্যাচার এখানেই শেষ হইল না। বাকি খাজনা ও নিরিখ প্রভৃতির নালিশ আছে।

বাংলাদেশের মুসলমান কৃষকদের উপরে জুলুম অত্যাচার নির্যাতন করে যে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিল কোলকাতার বর্ণ হিন্দু জমিদারেরা তার বর্ণনা তুলেধরেন ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জয়া চ্যাটার্জী।  তিনি তাঁর বইয়ের  ৬৭_  ৬৮ পৃষ্ঠা  বলেন:  এটা বলা হলে থাকে যে বাঙালার ওপরে কোলকাতা শহর যেভাবে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব করে থাকে ভারতের অন্য কোনো শহরে তার নিজের অঞ্চলের ওপরে তেমন ভাবে করে না।

 ৬৮ পৃষ্ঠা,  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমির মালিকানা ও রায়তি স্বত্বের ক্ষেত্রে একটি জটিল অবস্থার উদ্ভব হয়। জমির এবং রাজস্ব জমাদানকারী জমিদারদের মাঝে একটি বিশাল মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণির সৃষ্টি হয়। খাজনা আদায়ের বিস্তৃত ও প্রায় অপরিবর্তনীয় কাঠামোর গুরুভার বহন করা সত্ত্বেও কৃষকদের মাঝে এক শ্রেণীর লোক উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করে। এর ফলে সাধারণ রায়তদের তুলনায় তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় আর অন্যরা বর্গাদার বা বর্গাচাষি ও কৃষি শ্রমিককে পরিণত হয়। বাঙলা ভাগ হল( হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ বিভাগ ১৯৩২- ১৯৪৭ ) জয়া চ্যাটার্জী, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৯।
 
পল্লীবাংলার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক  ডাব্লিউ হান্টার তাঁর বইয়ের ২৫ পৃষ্ঠা খাজনা আদায়ের কঠোরতার কথা উল্লেখ করে । আর সেই কথাই উঠে এসেছে তাঁর পল্লী বাংলার ইতিহাস বইয়ের ( দিব্য প্রকাশ সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০২ ) ২৫ পৃষ্ঠায়। ডাব্লিউ হান্টার লেখেন, ১৭৬৮ সালে আংশিকভাবে ফসল বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৬৯ সালের প্রথম দিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তবে এই অভাব অনটনের ফলে সরকারের আদায়কৃত খাজনার পরিমাণ তেমন হ্রাস পায়নি। স্থানীয় অফিসারদের অভিযোগ আপত্তি সত্ত্বেও সদর দফতরের কর্তৃপক্ষ জানান যে, কড়াকড়ি ভাবে খাজনা আদায় করা হয়েছে।

 উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭২পৃষ্ঠায়  মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ১ জুলাই ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে আরও লিখেন, প্রায় দুই তিন বৎসর অন্তর জমির কর বৃদ্ধি করা হয়। যদি কৃষকেরা উহা দিতে অসম্মত হয় অমনি নিরিখের নালিশ রুজু করিয়া বসেন । এই ত গেল জমিদারের অত্যাচার, এতদ্ভিন্ন তাহার কর্মচারীদের অত্যাচার আছে। ইহারা হিসাব আনা, পার্ব্বণী প্রভূতি বার করিয়া বৎসরের মধ্যে চারি পাঁচবার কিছু লইয়া থাকে । যদি প্রজারা দিতে না পারে তাহা.. নার টাকা হইতে বাটিয়া লওয়া ... এই রূপ নানা প্রকার অত্যাচারে সর্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়ে। অনেকে সহ্য করিতে না পারিয়া অন্য স্থলে উঠিয়া যায়।

তৃতীয় মহাজন। সাধারণত ঃ মহাজনেরা যেরূপ অর্থগৃধ্নু ও কঠিন হৃদয়, তা প্রসিদ্ধই আছে। কৃষক মাত্রেরই প্রায় প্রতি বৎসর মহাজনের আশ্রয় লইতে হয়, কারণ তাহাদের কাহারই মূলধন নাই। যে একবার মহাজনের নিকট ঋৃণে আবদ্ধ হইয়াছে, সে আর তাহা পুরুষ পুরুষানুক্রমেও শোধ দিতে পারেনা । সুদের সুদ, তার সুদ এইরূপে অনন্ত কাল পর্যন্ত সুদ চলিতে থাকে ।। ...... যদি খাতক (কৃষক) ধান দিতে না পারে তবে উহার মূল্য স্থির করিয়া যত টাকা হয়, তত টাকার খত লিখিয়া লন। কৃষকের মহাজনের টাকা শোধ করিবার একমাত্র উপায় শস্য বিক্রয় করিয়া। যেবার দৈবদুর্য্যোগে শস্য না জন্মে, সেবার কৃষকদিগের দুরবস্হা আর শেষ থাকে না। এদিকে জমিদারের উদর পূর্ণ করিতে হইবে, ওদিকে মহাজনকে ঠান্ডা করিতে হইবে, আবার নিজের পরিবারের ভরণ পোষণ করিতে হইবে..... এইরূপে কৃষকগণের ব্যয় আয় অপেক্ষা ঢেরবেশী হইয়া পড়ে। সাধারণতঃ কৃষকদিগের গরুই সর্ব্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তুু। মহাজন, যখন দেখিলেন, অন্য উপায়ে কর্জ্জের টাকা আদায় হইল না, তখন ঐ গরু বিক্রয় করিয়া লন, কিন্তু দুর্ভাগা কৃষকের যে কি অবস্থা হইল, তাহার প্রতি একবার দৃকপাতও করেন না।

ফল কৃষকেরা জমিদার ও মহাজনের কৃতদাস বলিলে অত্যুচিক্তি হয় না। এত পরিশ্রম করিয়া ইহারা যাহা কিছু উপার্জন করে, তাহা সমুদায় প্রায় জমিদার ও মহাজনের উদরসাৎ হয়।

উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র গ্রন্থের দশম খন্ডের ৭৩ ও ৭৫পৃষ্ঠায়  মুনতাসীর মামুন কলকাতার সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা ২৬ আগস্ট ১৮৬৯ সালের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণ হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে দুর্ভিক্ষে বাংলার তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যাওয়ার  কথা উল্লেখ করে আরও লিখেন, ১৭৭০ হইতে ৭৬ এ মন্নান্তরা বাংলায় হয়, ও কথিত আছে যে ইহা কর্তৃক বাংলায় তিনভাগের এক ভাগ লোক মরে। ইহাকে সাতাত্তরের মন্নান্তরা বলে।...... দুর্ভিক্ষের কারণ গুলো হলো, জমিদারেরা প্রজার নিকট অনেক বেশী খাজনা লাইয়া থাকেন। তাঁহারা যাহা গভর্নমেন্টকে দেন, অনেক স্থানে তাঁহারা প্রজার নিকট তাহার বিশ গুণ খাজনা লইয়া থাকেন। প্রজার যত লোকসান যায়, হইা সমুদায় বাদ দিলে, ভূমির উৎপন্ন হইতে প্রজারা যাহা পায়, জমিদারেরা তাহার অর্দ্ধেক লইয়া থাকেন।

এইসবের উপরে আরও নির্যাতন করা হত বাংলাদেশের মুসলিম কৃষকদের উপরে সেই কথাই তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত বামধারার লেখক গবেষক বদরুদ্দীন উমর তাঁর  বইয়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক বইয়ের লেখক বিখ্যাত বামধারার গবেষক বদরুদ্দীন উমর তাঁর  বইয়ের ২২ পৃষ্ঠা  বলেন, কৃষক ও প্রজা সাধারণের ওপর নির্যাতন শুধুমাত্র জমিদারি এবং ইজারাদারী প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। গ্রামাঞ্চলে প্রায় নৈরাজ্যিক অবস্থার মধ্যে সরকারি কর্মচারীরা সাধারণ কৃষক ও বিভিন্ন ধরনের গ্রাম্য কারওগরদের ওপর যে উৎপীড়ন ও শোষণ করতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক, বদরুদ্দীন উমর, মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনী, সপ্তম মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৩।

No comments:

Post a Comment