Tuesday, 28 June 2016

পর্ব সাত।। এক । কোলকাতা কেন্দ্রীক উচ্চ বর্ণের হিন্দু জমিদাররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের উপরে জুলুমের রাজ্যত্ব কায়েম করে।

বাংলায় কৃষকদের নীল বিদ্রোহ। 


সূফি বরষণ 
২১ জুন ২০১৬ গত মঙ্গলবার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর বলেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ।  ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে।

আমাদের পূর্বপুরুষ নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে লিখেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের জের হিসেবে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের মধ্যে এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রথম ১০০ বছর পযন্ত উপ-মহাদেশের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এবং পরবর্তী ৯০ বছরকাল ইংরেজ সরকার দ্বারা সরাসরিভাবে পরিচালিত হয়েছে।

অত্যন্ত দু:খজনক হলেও এ কথা বলতে হয় যে, ১৭৬৪ সালের বকসার যুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশীয় রাজন্যবর্গ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে যে সব লড়াই করেছে তার ইতিহাস পাওয়া গেলেও ১৭৬৯-৭০ সালের মহামন্বন্তর –এর পর থেকে শ্রেণীগতভাবে যে সব রক্তাক্ত বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সবের তথ্যভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও পর্যন্ত রচিত হয়নি।

এসব বিদ্রোহের মধ্যে শুধুমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাবে অনুষ্ঠিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৩-৮৩), ত্রিপুরার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), স্বন্দীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক তন্তুবায়ের লড়াই (১৭৭০-৮০) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকলা বিদ্রোহ(১৭৭৬-৮৭) ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে উপ-মহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশও  নীল চাষ –এর সুত্রপাত হয়। মঁশিয়ে লুই বন্নো নামে জনৈক ফরাসি ব্যবসায়ী ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ করেন এবং পরের বছর ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যারল ব্লুম নামে জনৈকি ইংরেজ এদেশে প্রথম নীল কুঠি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যান্ড-এ শিল্প বিপ্লবের জের হিসেবে দ্রুত বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠলে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, এ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশে যে নীল প্রতি পাউন্ড চার আনায় ক্রয় করত, ইংল্যান্ড-এ তার বিক্রয় মূল্য ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকার মতো এবং বাংলাদেশ থেকেই সমগ্র বিশ্বের নীলের চাহিদা মেটানো হতো।

এই সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' বইয়ে নীলকুঠির বর্ণনা যেভাবে ফুটে উঠেছে: ''সুচাঁদ বলে- বাবারা বলত, অ্যাই বড় বড় ঘোড়া, এই ঝালর দেওয়া সওয়ারি অর্থাৎ পালকি। এই সব বাংলা-ঘর, ফুল বাগিচা, বাঁধানো খেলার জায়গা, কাঠ-কাঠরার আসবাব; সে ঐশ্বর্যের কথা এক মুখে বলা যায় না। এক দিকে কাছারি গমগম করত, বন্দুক নিয়ে পাহারা দিত পাইক আটপৌরেরা- মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিত। জোড়হাত করে বসে থাকত চাষি সজ্জনেরা- ভয়ে মুখ চুন। দু-দশজনাকে বেঁধে রাখত। কারুর শুধু হাতে দড়ি, কারুর বা হাত-পা দুই-ই বাঁধা। সায়েব লোক, রাঙা রাঙা মুখ, কটা কটা চোখ, গিরিমাটির মত চুল, পায়ে অ্যাই বুট জুতো- খটমট করে বেড়াত, পিঠে 'প্যাটে' জুতোসুদ্ধ লাথি বসিয়ে দিত, মুখে কটমটে হিন্দি বাত- মারডালো, লাগাও চাবুক, দেখলাও শালোলোগকো সায়েব লোকের প্যাঁচ। কখনো হুকুম হত- কয়েদ কর। কখনো হুকুম হত- ভাঙ দেও শালোলোকের ধানকো জমি। লয়তো, কাটকে লেও শালোকে জমির ধান। সে তোমার বামুন নাই, কায়েত নাই, সদগোপ নাই- সব এক হাল। 'আতে' সারি সারি বাতি জ্বলত- টুং- টাং- ক্যাঁ- কোঁ- ভ্যাঁ- পো ভ্যাঁ- পো বাজনা বাজত, সায়েব মেম বিলিতি মদ খেত, হাত ধরাধরি করে নাচত, কয়েদখানায় মানুষ চেঁচালে হাঁকিড়ে উঠত বাঘের মত- মৎ চিল্লাও। বেশি 'আত' হলে সেপাইরা বন্দুকের রজ করত- দুম- দুম- দুম- দুম। হাঁক দিত- ও- হো- ই। তফাত যাও- তফাত যাও- চোর বদমাশ হুঁশিয়ার! চোরই হোক আর সাধুই হোক এতে ওদিকে হাঁটলে অক্ষে থাকত না, দুম করে গুলি করে দিত।''

প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ সালে তারা নীল চাষ করতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে অস্বীকৃতি জানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় নীল ব্যবসায়ী বা নীলকরদের বিরুদ্ধে একজোটে যে বিদ্রোহ করে। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। (মাধ্যমিক সামাজিক বিজ্ঞান (শিক্ষাবর্ষ ২০১০), পৃঃ ৪৭-৪৮)

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। ফলে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে। (মুহম্মদ ইউসুফ হোসেনঃ 'নীল বিদ্রোহের নানাকথা', পৃঃ ৯৩)।

নীল চাষীদের প্রতি বৃটিশের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কোলকাতা কেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী বইয়ে আরও লিখেন,  প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলকর সাহেবরা স্থানীয় জমিদারদের সক্রিয়  সহযোগিতায় তাদের প্রজাদের দিয়ে প্রজাদেরই জমিতে নীল চাষ করাতেন এবং সস্তায় ফসল ক্রয় করে নিজেদের ব্যবস্থাধীনে নীল রং নিষ্কাশন করাতেন। নীল রং নিষ্কাশন –এর এসব কেন্দ্রকেই ‘কুঠি’ বলা হতো। কিন্ত স্বল্পদিনের ব্যবধানে দেখা যায় যে, ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেরাই জমিদারি ক্রয় করে কিংবা ইজারা গ্রহণ করে প্রজাদের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের ব্যবস্থা করেছে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। অর্থ ও প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা নিজেদের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জমিদার ও জোতদারদের অধীনস্থ প্রজাদের জোর করে দাদন বা অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তিপত্রে দস্তখত করিয়ে নিতে শুরু করল। চুক্তিবদ্ধ চাষিকে কী পরিমান জমিতে নীল চাষ করতে হবে এবং উৎপন্ন ফসল কী মূল্যে কুঠিয়ালদের কাছে বিক্রি করতে হবে সবই চুক্তিপত্রে লেখা থাকত।

একবার চুক্তিপত্রে দস্তখত করলে চাষিকে আমৃত্যু নীল চাষ করতে হতো। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে চাষিদের উপর নেমে আসত “হাবিয়া দোজখ” –এর অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হারান চন্দ্র চাকলাদার তার ‘ফিফটি ইয়ার্স এগো’ (১৯০৫ জুলাই) নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন,“বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতের সমসাময়িক নথিপত্রই এই অকাট্য প্রমান বহন করে যে, নীল চাষ প্রবর্তনের দিনটি থেকে শুরু করে তা একেবারে না উঠে যাওয়া পযন্ত যে সমস্ত পন্থায় রায়তদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো তার মধ্যে ছিল হত্যাকান্ড, বিচ্ছিন্নভাবে খুন, ব্যাপকভাবে খুন, দাঙ্গা, লুটতরাজ, বসতবাটি জ্বালানো এবং লোক অপহরন প্রভৃতি।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ (অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত) এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ (হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত) পত্রিকা দুটোতে এসব অত্যাচারের ‘ছিটেফোটা কাহিনী’ প্রকাশিত হতো। এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকেও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কিছু বিবরণ আছে। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইংরেজ আদালতে কোনও ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজ বিচারকদের আদালতে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিচারই প্রহসনে পরিনত হয়েছিল। বাস্তব অবস্থাটা ছিল খুবই করুণ। সুবিচার তো হতোই না; বরং ইংরেজ নীলকরদের আক্রোশ আরও বেড়ে যেতো আর চাষিদের হতো সর্বনাশ।

Monday, 27 June 2016

শেষ পর্ব ।। ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

পলাশীর বিশ্বাসঘাতক  ষড়যন্ত্রকারীদের করুণ পরিণতি। 


সূফি বরষণ
আজও আন্তর্জাতিক লুটেরা চক্র নিরীহ কল্যাণকামীর ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ভূমি ও খনিজসম্পদ কিনে নিচ্ছে। এনজিও ও সুশীল সমাজের নামে-বেনামে বহু পোষ্য তারা পেলে যাচ্ছে। বিভিন্ন মতাদর্শ ও কর্মসূচির নামে জাতির মধ্যে বিভাজনের প্রাচীর নির্মাণ করছে। পলাশীর কালো ছায়া আজও আমাদের মাথার ওপর বিরাজ করছে। শাসকরূপী দানব ঝেঁকে বসেছে আমাদের ওপর। এই দানবের নৃশংস থাবায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে এদেশের বিশ্বাসদীপ্ত মানুষেরা। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আছেন এখানকার তৌহিদী জনতা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। আর এই উত্তরণে পলাশীর চেতনা হতে পারে আমাদের জন্য আলোকর্তিকা।

প্রতি বছর জুন মাস এলে পলাশীর কথা স্মরণ করে আমরা মায়াকান্না করি। কিন্তু পলাশীর আম বাগানে থেকেও আমাদের বোধোদয় নেই। পলাশীপূর্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে শাহ ওয়ালীউল্লাহ, নূর কুতবুুল আলমদের সতর্ক সাইরেন ছিল, কিন্তু আজকের পলাশীর কালো ছায়া থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নেই কোনো নকীবের হাতছানি। তাই আরেকটি পলাশীর নির্মম ভাগ্যবরণের পূর্বেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। বিদেশী প্রভুদের এবং দেশীয় প্রেতাত্মাদের গতিবিধি নজরে রেখে পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বাসী মানুষদের মহা ঐক্যই পারে পলাশীর মতো করুণ পরিণতি থেকে এই জাতিকে রক্ষা করতে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন উপমহাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় এ কথা কারো অজানা নয়। এইদিন এদেশের কিছু ক্ষমতালোভী বিশ্বাসঘাতকের কারণে বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এক প্রহসনমূলক যুদ্ধে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের চোরাগলি ধরেই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী দিল্লির মসনদ দখল করার মধ্যদিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ দখলদারিত্ব কায়েম করে। উপমহাদেশের মুসলমান ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও স্বাধীনচেতা শাসকদের দুর্দিনের সূচনা হয়।

পলাশীর দিনটিকে স্মরণ করলে কোন দেশপ্রেমিক ক্ষমতার লোভে বিদেশী শক্তির সাথে হাত মিলানোর কথা চিন্তা করতে পারেন না। ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ঐদিন যারা পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ যুদ্ধ নাটক মঞ্চস্থ করে নবাব সিরাজদ্দৌলাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজের জন্মভূমিকে বিদেশী শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল তাদের পরিণতি ভালো হয়নি। এ ঘটনা থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া যায় দেশ উম্মাহর সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করলে শুধু আদালতে আখিরাতে নয় এই দুনিয়াতেও শাস্তি পেতে হয়। কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকের পরিণতি তুলে ধরা হলো। এ যুগের বিশ্বাসঘাতকরা তাদের  পরিণতি থেকে শিক্ষা নিলে আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক সঙ্কটই কেটে যাবে।

ষড়যন্ত্রকারীদের পরিণতি:
নিউটনের তৃতীয় সূত্রে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমমুখী ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটা শুধু মাত্র বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমনটি নয়। রাজনীতি অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সমান প্রতিক্রিয়া, তা না হলে গাদ্দারদের এমন মর্মান্তিক পরিণতি হবে কেন? সিরাজ উৎখাতে পলাশী ষড়যন্ত্রে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল ইতিহাসে অমোঘ নিয়মে তাদেরও হয়েছিল মর্মান্তিক পরিণতি। কাউকে পাগল হতে হয়েছিল, কারো হয়েছিল অপঘাতে মৃত্যু। কাউকে নির্মম অপমৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল। সবার ভাগ্যে জুটেছিল কোন না কোন ভয়াবহ পরিণতি। নীচে কতিপয় মুখচেনা মুখ্য ষড়যন্ত্রকারীদের পরিণতি তুলে ধরা হল।

মিরন:
 মীর জাফরের পুত্র মীরন।মিরন ছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক। তার পুরো নাম মীর মুহাম্মদ সাদেক আলি খান। তিনি মীরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আলীবর্দী খানের ভগ্নী শাহ খানমের গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল। এই সূত্রে মিরন ছিলেন আলিবর্দীর বোনপো। অত্যন্ত দুর্বৃত্ত, নৃশংস ও হীনচেতা এবং সিরাজ হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক মিরন। আমিনা বেগম, ঘষেটি বেগম হত্যার নায়কও তিনি। লুৎফুন্নিসার লাঞ্ছনার কারণও মিরন। মীর্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি। এই মিরনকে হত্যা করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস। তবে তার এই মৃত্যু ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যে ইংরেজরা মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল। তারা বলেছে, মিরন বিহারে শাহজাদা আলি গওহারের (পরে বাদশাহ শাহ আলম) সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে পথের মধ্যে বজ্রাঘাতে নিহত হন। ইংরেজরা বলেছে, বজ্রপাতের ফলে তাঁবুতে আগুন ধরে যায় এবং তাতেই তিনি নিহত হন। ফরাসী সেনাপতি লরিস্টনের ঔবধহ-খধি ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন। বরং এই মত পোষণ করেন যে, মিরনকে আততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। তার নির্দেশেই মোহাম্মাদী  বেগ নির্মমভাবে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করে।

মুহাম্মদীবেগ:
মুহাম্মদীবেগ ৩ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল তার কাছে থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু কুখ্যাত মুহাম্মদীবেগ নবাব সিরাজকে সে সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার পরপরই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তী পর্যায়ে মুহাম্মদী বেগের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে, এমতবস্থায় সে বিনা কারণে কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। এই মুহাম্মদীবেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলীবর্দীর বেগম একটি অনাথ কুমারীর সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন।

মীরজাফর:
পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন মীরজাফর আলি খান। তিনি পবিত্র কোরআন মাথায় রেখে নবাব সিরাজের সামনে তাঁর পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করার পরও বেঈমানী করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি ছিলেন জগৎশেঠ মীর জাফর নয়। তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের শিখণ্ডি। নবাবী চলে যাওয়ার পর সে দারুণ অর্থ কষ্টে পরে। মীরজাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তিনি দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরী ১১৭৮ অব্দের ১৪ই শাবান (১৭৬৫ সালের জানুয়ারী মাসে) বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বৎসর বয়সে পরলোকগত হন। তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহার তাহাই শেষ জলপান।

এই বিশ্বাসঘাতকের স্বপ্ন ছিল সে বাংলা বিহার ঊড়িষ্যার নবাব হবে। এই ইচ্ছা পূরণ করতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় মীর জাফর। তার এ ইচ্ছা পূরণ করতেই পলাশীর প্রান্তরে সে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। লর্ড ক্লাইভের তিন হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর কাছে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পরাজিত হয় নবাব সিরাজুদ্দৌলার এ বিশাল বাহিনী। সুচতুর ক্লাইভ যুদ্ধের পর মীর জাফরকে সিংহাসনে বসায় কিন্তু ক্ষমতা রাখে নিজের হাতে। কিছুদিন পর তার ইংরেজ প্রভুরা এ বিশ্বাসঘাতককে বিশ্বাস করতে পারে না। এ বিশ্বাসঘাতককে তারা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। ইংরেজরা ভাবে  যে ব্যক্তি সামান্য ক্ষমতার লোভে তার দেশ ও জাতির সাথে  বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তারা সাতসাগর তের নদীর ওপার থেকে এসে তাকে বিশ্বাস করবে কোন ভরসায়।

জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদ এবং মহারাজা স্বরূপচাঁদ:
কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্রের প্রধানতম নায়ক এই জগৎ শেঠ। এই কুঠিরে বসেই আঁকা হয় পলাশী ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ফল তাকে হাড়ে হাড়ে ভোগ করতে হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর ষড়যন্ত্রকারীরা মেতে উঠে স্বার্থের দ্বন্দ্বে।  তিনি- আলীবর্দী খাঁর শাসনামলেই জগৎশেঠের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক গভীর ছিল। নবাব সিরাজ ক্ষমতায় এলে এই গভীরতা আরো বৃদ্ধি পেলো এবং তা ষড়যন্ত্রে রূপ নিলো। পলাশী বিপর্যয়ের পর জগৎশেঠ রাজকোষ লুণ্ঠনে অংশ নেন। নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- ইহার পর ক্রমে ইংরেজদিগের সহিত মীর কাসেমের বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, নবাব কাটোয়া গিরিয়া, উধুয়ানালা প্রভৃতি স্থানে পরাজিত হইয়া মুঙ্গেরে জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ কর হয়। মহারাজা স্বরূপচাঁদও ঐ সাথে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য হন।  মীর কাসিমের নির্দেশে বিহারের মুঙ্গের দুর্গ থেকে বস্তা বন্দী করে তাকে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। নবাবী আমলের এ ধনকুবে আরো সম্পদের লোভে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তার পাপের শাস্তি তাকে পেতে হয় পানিতে ডুবে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ার মাধ্যমে।

রবার্ট ক্লাইভ:
নবাব সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভ খুব অল্প বয়সে ভারতে আসেন। প্রথমে তিনি একটি ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রের গুদামের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। বিরক্তিকর এই কাজটিতে ক্লাইভ মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ সময় জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ও হতাশা জন্মে। তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি রিভলভার দিয়ে নিজের কপালের দিকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলী ছোঁড়েন। কিন্তু গুলী থাকা অবস্থাতেই গুলী রিভলবার থেকে বের হয়নি। পরে তিনি ভাবলেন ঈশ্বর হয়ত তাকে দিয়ে বড় কোন কাজ সম্পাদন করবেন বলেই এভাবে তিনি তাঁকে বাঁচালেন। পরবর্তীতে দ্রুত তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠতে শুরু করেন। পরিশেষে পলাশী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কোটি টাকার মালিক হন। ইংরেজেরা তাকে ‘প্লাসি হিরো’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনা কারণে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজের হাতেই ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।

বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রধান ছিলেন লর্ড ক্লাইভ। সে পলাশীর যুদ্ধের আগে একটি স্বাধীন দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশটির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হরণের প্রধান খলনায়ক। তার লুটেরা বাহিনী যুদ্ধপরবর্তী সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, সম্পদ-লুটতরাজসহ বিবিধ অপকর্মে লিপ্ত হয়। নবাব পরিবারের সাথে তার নিষ্ঠুর আচরণে আজো কেঁপে উঠে যে কেনো বিবেকবান মানুষের হৃদয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী  লুটেরার শেষ জীবন কাটে অর্থকষ্টে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ মিডিয়ায় হত্যা, ধর্ষণ, সম্পদ-লুটতরাজ ও কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ হউস-অব-কমন্স’এর সদস্যরাও তার অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন।

অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে হউস-অব-লর্ডস। দীর্ঘদিন এই তদন্ত কমিটির শুনানিতে তাকে অংশ নিতে হয় এবং আনীত অভিযোগ মোকাবেলায় আইনি খরচ মেটাতে লুটকৃত বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকার তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। শেষ জীবনে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ক্লাইভ এবং তার পরিবারের সদস্যরাও তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। ক্লাইভ হতদরিদ্র অবস্থায় চরম হতাশায় আত্মহত্যা  করে।

ইয়ার লতিফ খান:
পলাশী ষড়যন্ত্রের শুরুতে ষড়যন্ত্রকারীরা ইয়ার লতিফ খানকে ক্ষমতার মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক্ষেত্রে মীর জাফরের নাম উচ্চারিত হয়। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি এই ষড়যন্ত্রের সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এবং যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় ছবির মতো দাঁড়িয়েছিলো। তার সম্পর্কে জানা যায়, তিনি যুদ্ধের পর অকস্মাৎ নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যান। অনেকের ধারণা, তাকে কে বা কারা গোপনে হত্যা করেছিল। (মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, আসকার ইবনে শাইখ, পরিশিষ্ট)

মহারাজা নন্দকুমার :
আরেক বিশ্বাসঘাতক নন্দকুমারকেও উমিচাঁদের পরিণতি বরণ করতে হয়। মহারাজা নন্দকুমার এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে নিখিলনাথ রায় লিখেছেন- নন্দকুমার অনেক বিবেচনার পর সিরাজের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই ঘোরতর অন্ধকার দেখিয়া, ইংরেজদিগের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপনের ইচ্ছা করিলেন। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ বলিয়া থাকেন যে, ইংরেজরা সেই সময়ে উমিচাঁদকে দিয়া নন্দকুমারকে ১২ হাজার টাকা প্রদান করিয়াছিলেন। পলাশী ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীরজাফর স্বীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। মীরজাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শানুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন। তহবিল তছরূপ ও অন্যান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালত মহারাজা নন্দকুমারের প্রাণ দণ্ডের আদেশ প্রদান করে। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

রায় দুর্লভ:
রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধকালে তিনি এবং তার বাহিনী মীরজাফররের সাথে যুক্ত হন এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।

উমিচাঁদ :
কাশিমবাজার ষড়যন্ত্রের আরেক নায়ক উমিচাঁদ। দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে উমিচাঁদ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যোগ দিয়েছিল। সেই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিই তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনে। কোম্পানি উমিচাঁদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত  করে।
ক্লাইভ কর্তৃক উমিচাঁদ প্রতারিত হয়েছিলেন। ইয়ার লতিফ খান ছিলেন উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু যখন অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্ষেত্রে মীরজাফরের নাম ঘোষণা করলেন, তখন উমিচাঁদ বেঁকে বসলেন এবং বললেন, আপনাদের প্রস্তাব মানতে পারি এক শর্তে, তা হলো যুদ্ধের পর নবাবের রাজকোষের ৫ ভাগ সম্পদ আমাকে দিতে হবে। ক্লাইভ তার প্রস্তাব মানলেন বটে কিন্তু যুদ্ধের পরে তাকে তা দেয়া হয়নি। যদিও এ ব্যাপারে একটি মিথ্যা চুক্তি হয়েছিল। ওয়াটস রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তিতে তার সই করান। লাল কাগজের চুক্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য হবে। এটি ছিল নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। যাতে করে উমিচাঁদের মুখ বন্ধ থাকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ তাকে সরাসরি বলেন, আপনাকে কিছু দিতে পারবো না। এ কথা শুনে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এবং স্মৃতিভ্রংশ উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় নিঃস্ব হয়ে  ঘুরতে ঘুরতে তার মৃত্যু ঘটে।

রাজা রাজবল্লভ:
ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটেছিল। জানা যায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশ করেই পদ্মা হয় কীর্তিনাশা।

দানিশ শাহ বা দানা শাহ:
দানিশ শাহ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে বলেছেন, এই দানেশ শাহ নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, দানিশাহ ফকির মোটেই জীবিত ছিলেন না। আসকার ইবনে শাইখ তাঁর মুসলিম আমলে বাংলার শাসন কর্তা গ্রন্থে লিখেছেন’ বিষাক্ত সর্প দংশনে দানিশ শাহর মৃত্যু ঘটেছিল।

ওয়াটস:
ওয়াটস এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীরজাফরের স্বাক্ষর এনেছিল। যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাজ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিলাতেই অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন।

স্ক্রাফটন:
ষড়যন্ত্রের পিছনে স্ক্রাফটনও বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন। জানা যায়, বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে তার অকালমৃত্যু ঘটে।

ওয়াটসন:
যড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হলে কোন ওষুধেই ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন।

মীর কাশিম:
মীরজাফরের ভাই রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদের নির্দেশে মীর কাশিম নবাব সিরাজের খবর পেয়ে ভগবানগোলার ঘাট থেকে তাকে বেঁধে এনেছিলেন মুর্শিদাবাদে। পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি নবাব হন এবং এ সময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাঁধে ও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পালিয়ে যান এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।। অর্থ কষ্টে পথে পথে ঘুরতে থাকেন। তার নাবালক দুই সন্তান দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার জন্য খাবার সংগ্রহ করতো। তারা এক সন্ধ্যায় ভিক্ষা করে ফিরার সময় ইংরেজ সৈনিকদের গুলিতে নিহত হয়। নাবালক কিশোর কিশোরীকে হত্যার দায় এড়াতে ইংরেজরা প্রচার করে অন্ধকারে বাঘ ভেবে ভুল করে তাদের গুলি করেছে সিপাহিরা। মীর কাসিম অর্থ কষ্টে অনাহারে  দিল্লি জামে মসজিদের নিকট মৃত্যুবরণ করেন।  মৃতের শিয়রে পড়ে থাকা একটা পোটলায় পাওয়া যায় নবাব হিসেবে ব্যবহৃত মীর কাশেমের চাপকান। এ থেকেই জানা যায় মৃত ব্যক্তি বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাশিম আলী খান।

পলাশীর  বিশ্বাসঘাতক মীর কাসিম। ব্রিটিশদের তাঁবেদারী করে মীর জাফরের পর নবাব হতে পারলেও এক পর্যায়ে তাকেও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে ইস্ট-ইন্ডিয়া  কোম্পানি। মীর কাসিম আলী খান নবাব হওয়ার পর ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। তার সাথে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।  মীর কাসিমের সাথে ইস্ট-ইন্ডিয়া  কোম্পানির যুদ্ধ হয় যা ইতিহাসে “বক্সারের যুদ্ধ” নামে পরিচিত।

এই ভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। পলাশী ষড়যন্ত্রকারীদের ওপরে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছিল বলেই অনেকের ধারণা। আসলে এইসব ঘটনা থেকেই আমাদের অনেক কিছু শেখার বিষয় রয়েছে। (লেখাটি ডঃ মুহাম্মদ ফজলুল হক রচিত ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ’ প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে)

ঘসেটি বেগম :
ঘষেটি বেগম ছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌলার আপন খালা। তার স্বপ্ন ছিল পিতা আলীবর্দী খাঁর ইন্তিকালের পর তিনি হবেন বাংলার প্রথম মহিলা নবাব। এই ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনিও হাত মেলান ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে। প্রাসাদের সকল গোপনীয় তথ্য ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পাচার করতেন এই উচ্চভিলাষী বিশ্বাসঘাতক নবাব নন্দিনী। পলাশী’র যুদ্ধের পর মীরজাফর পুত্র মীরন বুঝতে পারে তার পিতার নবাব হবার পথে সবচেয়ে বড় বাধা ঘষেটি বেগম। তাই মীরন চক্রান্ত করে ধলেশ্বরী নদীতে নৌকা ডুবিয়ে ঘসেটি বেগম’কে হত্যা করে।


এ সময় পলাশীর ইতিহাস নিয়ে জন জেপানিয়াহ হলওয়েল নামের এক ধূর্ত ইংরেজ 'কোলকাতার অন্ধকূপ হত্যা' নামের একটি আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে নবাবকে গণহত্যাকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই গাঁজাখুরি কাহিনীতে বলা হয় যে, ১৪৬ জন ইংরেজকে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট প্রস্থের একটি গর্তে রাখায় তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। হলওয়েল নিজে ওই ঘটনায় বেঁচে যায় বলে দাবি করে।

গবেষক ও ঐতিহাসিকরা এই কাহিনীকে একটি পুরোপুরি মিথ্যা কাহিনী হিসেবে অস্বীকার করে আসছেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লেখা "An Advanced History of India" শীর্ষক বইয়ে অন্ধকূপ হত্যা বা 'ব্ল্যাক হোল স্টোরি'-কে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।

ব্রিটিশ পণ্ডিত ও গবেষক জে.এইচ লিটলও "The 'Black Hole'—The Question of Holwell's Veracity" বা 'অন্ধকূপ হত্যা- হলওয়েলের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন' শীর্ষক প্রবন্ধে হলওয়েলের বর্ণিত এই কাহিনীকে 'বড় ধরনের ধোঁকা' বলে মন্তব্য করেছেন। ভারতবর্ষে সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত তৈরি করতে ও এই লক্ষ্যে ব্রিটেনের লোকদের ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই এই কাহিনী রচনা করা হয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বাংলার ইতিহাস একটু অন্যরকম। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে সচেতন হলেও ওটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে অনেকে অভ্যস্ত। অতি অল্পসংখ্যক লোকই ভাবে যে, বিশ্বাসঘাতকতার বহু রূপ থাকতে পারে। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-তা সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা তমদ্দুনিক স্বাধীনতা হোক না কেন, যারা বিকিয়ে দিতে চায় তারাই বিশ্বাসঘাতক। দেশের প্রতি, নিজের সমাজের প্রতি তাদের আনুগত্য নেই।

এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণ নানা প্রকারের। কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের আশায় বিদেশী শক্তিকে দেশে কায়েম করে তার ছত্রচ্ছায়ায় কৃত্রিম ক্ষমতা ভোগকে সত্যিকার স্বাধীনতা মনে করে। কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশী করে মুনাফা অর্জনের লোভে দেশ ও জাতিকে পরাধীন করতে দ্বিধা করে না। আবার কেউ ভূয়া আদর্শবাদের দোহাই দিয়ে নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে এগিয়ে আসে। এসবই বিশ্বাসঘাতকতা।

বিশ্বাসঘাতকতা বিভিন্ন রকমের ছদ্মবেশ ধারণ করে হাজির হয়- বিশেষতঃ আজকালকার যুগে। কারণ, মীরজাফর বা কুইজলিং- এর বিশ্বাসঘাতকতার মত স্থূল বিশ্বাসঘাতকতা আজকালও বিরল না হলেও তার আবেদন সংকুচিত হয়ে গেছে। বর্তমান যুগের বিশ্বাসঘাতকদের তাই সূক্ষ্ণ ছদ্মবেশ ধারণ করে লোক সমক্ষে উপস্থিত হতে দেখা যায়। আদর্শবাদের ছদ্মবেশই এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্নক। কারণ আদর্শবাদের পিছনে বিশ্বাসঘাতকতা লুকিয়ে থাকতে পারে। এ সন্দেহ সহজে কোনো মনে উদিত হয় না। যাঁরা এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত তাঁরা কস্মিনকালেও দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কোন শব্দ উচ্চারণ করেন না। সমাজে তাঁরা দেশপ্রেমিক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু তাঁরা অনবরত এমন সব কর্মে সমাজকে উৎসাহিত করছেন, যার অনিবার্য পরিণতি হবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা লুপ্তি।

সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ তখনই অর্থবহ হবে যখন আমরা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যে সমস্ত সূক্ষ্ণ ষড়যন্ত্র বর্তমানে দানা বেঁধে উঠছে, সে সম্বন্ধে আমরা সতর্ক হতে পারি। অনেক তরুণ যারা ভালো করে সমাজের ইতিহাস জানে না, তারা অজ্ঞাতসারে এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। তরুণরা স্বভাবতই আদর্শবাদী। তাদের আদর্শবাদিতার সুযোগ নিয়েই তাদের মনে অনেক বিশ্বাস সঞ্চার করা হচ্ছে, যার একমাত্র অর্থ হচ্ছে যে, বাংলাদেশের আলাদা কোন শিল্পকলা নেই। যাঁরা আবহমানকাল থেকে পূর্ব বাংলার জনসমাজকে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা করে এসেছেন, সে সমস্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের জাতীর বীর হিসাবে আমাদের সামনে দাঁড় করানো হচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে শুনছি যে, এঁরাই না-কি পূর্ব বাংলার সত্যিকারের মঙ্গলাকাংখী।

এ রকমের প্রচারণা সম্ভব হচ্ছে এই কারণে যে, সমাজের তরুণদের মধ্যে ইতিহাস-চেতনা নেই, তারা অতীত সম্বন্ধে বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তি দূর না হওয়া পর্যন্ত সিরাজউদ্দৌলা দিবস উদযাপন সত্যিকার অর্থে সার্থক হবে না।

তবে অনেক দিন পর সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ করার কথা মনে হয়েছে, এটা অবশ্যই একটা সুলক্ষণ। চল্লিশের দশকে যেমন তিনি লুপ্ত স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে অভিনন্দিত হয়েছিলেন, তেমনই আজও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতীকী তাৎপর্য নিঃশেষিত হয়নি। মীরজাফরের দলও নির্মূল হয়নি। দেশের, সমাজের স্বকীয়তা রক্ষা করতে হলে ১৭৫৭ সালের সেই দুর্যোগের কারণ এবং তার ভয়াবহ পরিণতির কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে।

সহায়ক গ্রন্থ
লেখাটি ডঃ মুহাম্মদ ফজলুল হক রচিত ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ’ প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে।
সুপ্রকাশ রায়_  ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯।

শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867

দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।
 বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ।
আমাদের জাতিসত্ত্বার বিকাশধারা ।
যদুনাথ সরকার _ বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯।

পলাশী ট্রাজেডীর ২৪০তম বার্ষিকী স্মারক।

Sunday, 26 June 2016

পর্ব চার ।। ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

বসন্তকালীন দুর্গাপূজোকে বর্ণ হিন্দুরা পিছিয়ে এনে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দূর্গাপূজার প্রচলনের মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। 

দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস হিসেবে পালন করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা । 

পলাশীর পর মুসলমানদের সম্পত্তি লুন্ঠন করে ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি বর্ণ  হিন্দু ব্রাহ্মণ । 


সূফি বরষণ
মুসলমানদেরকে ষড়যন্ত্র মূলক ভাবে পরাজয়ের পর মুর্শিদাবাদ থেকে শাসনকেন্দ্র কলকাতায় স্থানান্তর হয় ১৭৬৮ সালে। ১৭৭৩ সালে দ্বৈত শাসন অবসানের সাথে সাথে কলকাতা ইংরেজদের ভারত-রাজত্বের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৭৭৪ সালে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধন করেন। এ সময়ই তিনি কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। তখনো কলকাতা ছিল গঞ্জ। তারপর কলকাতা হলো বন্দর। ইংল্যান্ডে সম্পদ পাচারের সদরঘাট ছিল এই কলকাতা বন্দর। বন্দর থেকে ক্রমে বিকশিত হলো বন্দরনগরী। এভাবেই সারা বাংলা সম্পদ শোষণ করে বেড়ে উঠল কলকাতা মহানগরী।

এই হাঠাৎ বেড়ে ওঠা কলকাতার অতীত সম্পর্কে স্বরূপচন্দ্র দাস লিখেছেনঃ “পূর্বকালে ও নগর নবদ্বীপাধীন এক ক্ষুদ্র গ্রামমাত্র ছিল। তাতে অনেক দূর পর্যন্ত ছিল বন-জঙ্গল। এই স্থানে ১০ কিংবা ১২ ঘর কৃষিজীবী গৃহস্থ বাস করত”। (দি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৯)

নিশীথরঞ্জন রায় জানাচ্ছেনঃ “জলাজঙ্গল সমাকীর্ণ অঞ্চলের আদি অধিবাসী ছিল জেলে, শিকারি, শবর প্রভৃতি তথাকথিত জাতির নর-নারী”। (ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭৭)

এই গ্রাম-কলকাতার পাশে গোবিন্দপুর গ্রামের পত্তন করেছিল চারটি বসাক ও একটি শেঠ পরিবার। তার পাশেই সূতা ও কাপড়েরন বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুতানুটি। এই গোবিন্দুপুর-ডিহি কলকাতার-সুতানুটি গ্রাম তিনটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে ১৬৯৮ সালে সাবর্ন চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল। তারপর পাঁচ বছর ধরে সেখানে উইলিয়াম দুর্গ তৈরি করেছিল। (ভারতকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২০৯)।

পলাশীর পতনে তাৎক্ষণিকভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধ-চেতনা শাণিত হয়ে উঠতে বিলম্ব হয়নি। ১৭৬৩ সালেই শাসক মীর কাসিম জাতির সর্বনাম সম্পর্কে সম্বিত ফিরে পেয়ে তলোয়া র কোষমুক্ত করেছিলেন। আর একই সময়ে জনতার কাতার থেকে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছিলেন কৃষক বিদ্রোহের অমর নায়ক ফকীর মজনু শাহ। ইংরেজরা বাংলার সাবেক শাসক জাতির ব্যাপারে একদিনের জন্যও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। লর্ড ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মুসলমানরা সব সময়ই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত। সাফল্যের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে জানলেই তারা সাথে সাথে তা সংঘটিত করবে”। (Selections from Unpublished Reords of Govt……1784-67; James Long, 1973, P-202)

কলকাতার পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদী অভ্যন্তরীন ও বহির্বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক ছিল। তার চাইতেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কলকাতার গুরুত্ব ছিল এ দেশের শাসকদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করার চমৎকার আশ্রয়কেন্দ্ররূপে। জোব চার্ণক হুগলি থেকে পালিয়ে গিয়ে এই স্যাঁতস্যাতে মাটি ও জঙ্গলাকীর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নদীপথে সাগরে পালিয়ে গিয়ে জান বাঁচানোর জন্যও এই কলকাতা ছিল তুলনাহীন। শক্তিশালী সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি তারা তাদের চার পাশে দাঁওবাজ দালালশ্রেণীর দ্বারা গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য ‘মানব বন্ধনী;। ইংরেজদেরকে অবলম্বন করে কলকাতাকে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিরূপে অবিশ্বাস্য রকম দ্রতগতিতে বাঙালি বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রণীর বিকাশ ঘটেছিল। বস্তুত দেড় শতাধিক বছর ধরে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বর্ণহিন্দুরা শোষণ-সাফল্যের একেকটি স্তর উতরিয়ে উঠে গেছে একবারে শীর্ষদেশে, আর তাদের উত্থান-আরোহণের কার্যকরণরূপে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার গরিষ্ঠ মুসলমান প্রজাসাধারণ পতনের একটি পর একটি ধাপ গড়িয়ে নেমে গেছে অধঃপাতের অতল গভীরে। একদিকে শোষক-ধনিক-জমিদার বর্ণহিন্দুদের উত্থান, অন্যদিকে বাংলার কৃষক-প্রজা মুসলমানদের পতন, এই দু’য়েরই মধ্য-বিন্দুতে কলকাতা।

কলকাতার লেখক ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ইংরেজদের সাথে সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর লড়াইকে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। প্রাচীনকালে আমাদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়গণ হানাদার আর্যদের আগ্রাসন দীর্ঘদিন পর্যন্ত রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের মুখে বারবার পর্যদস্ত হয়েই আর্যরা এ এলাকার দ্রাবিড় জনগোষ্ঠকে ‘অসুর’ নামে অভিহিত করেছিল। আর্যরা ‘দেবতা’ আর দ্রাবিড়রা ‘অসুর’। এই ‘অসুর’ পরিচয়েই আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণ দীর্ঘদিন আর্যদের কাছে পরিচিত হয়েছেন। সেই ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই প্রাচীন আর্যদের অধস্তন পুরুষ ভবানী চরণ বাংলার নতুন যুগের প্রতিরোধ সংগ্রামের বীর নায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ‘অসুর’ আখ্যায়িত করেছেন। তাদের চোখে পলাশীর ‘দেবতা’ হলো ইংরেজরা।

ভবানীচরণরা সিরাজকে ‘অসুর’ আর ইংরেজকে ‘দেবতা’ বলেই থেমে যাননি। মুখের কথার সাথে বাস্তব কাজের নমুনাও পেশ করেছেন। পলাশী যুদ্ধের ক’দিন পরই তারা পলাশীর দেবাসুর সংগ্রামের উপজীব্য করে বাংলায় শারদীয় দূর্গাপুজা প্রথম চালূ করেন। এর আগে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। শ্রীরাধারমন রায় ‘কলকাতার দুর্গোৎসব’ নামক এই প্রবন্ধে লিখেছেন, দুর্গাপূজা’ পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎস’। ‘পলাশী যুদ্ধের বিজয়োৎসব’ হিসেবেই এই পূজা ১৭৫৭ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নদিয়া ও কলকাতায়। এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘পলাশী বিজয়ী’ লর্ড ক্লাইভের সংবর্ধনা।

রাধারমণ রায় লিখেছেনঃ “১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুন ইংরেজ ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যাঁরা উল্লাসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তাঁরা হিন্দুদের জয় বলে মনে করলেন। ধুর্ত ক্লাইভও তাঁদের সেরকমই বোঝালেন। ক্লাইভের পরামর্শেই তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়োজন করলেন। বসন্তকালীন দুর্গাপূজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে- ১৭৫৭ সালেই তাঁরা বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দূর্গাপূজার মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপর ফি বছর শরৎকালে দুর্গাপূজো করে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন। …… শোনা যায়, শরৎকালীন দুর্গোপূজো যে-বছর প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দু’জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচা করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। …… আগে এদেশে বসন্তকালে চালূ ছিল দুর্গাপূজো আর শরৎকালে চালূ ছিল নবপত্রিকাপূজো।

দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মুর্তির ব্যাপার, আর পবপত্রিকা পূজোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নটি উদ্ভিদের ব্যাপার। পরে এই দু’টি ব্যাপারকে গুলিয়ে একাকার করে ফেলা হয়েছে। ১৭৫৭ সাল থেকে নবপত্রিকা হয়েছেন দুর্গা। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজার বোধনের দরকার হয়। আর আগে নবপত্রিকা পূজো করে পুরো দুর্গাপূজো করতে হয়। …… তাহলে দাঁড়ালো এই : ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করার জন্য বসন্তকালের দুর্গাপূজোকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকাপূজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাঁদের উৎসাহিত করেছিলেন ক্লাইভ। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলেন, তার প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজো অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপরিষদ উপস্থিত। ………. নবকৃষ্ণের পুরনো বাড়ির ঠাকুর দালানটি তৈরি হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। খুবই তড়িঘড়ি করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। … দুর্গাপূজোর চাইতেও ক্লাইভকে তুষ্ট করা ছিল নবকৃষ্ণের কাছে বড় কাজ। …. তিনি ভালো করেই জানতের, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রিস্টান, মনে মনে মূর্তি পূজোর ঘোর বিরোধী। অতএব স্রেফ দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে ক্লাইভের মন ভরানো যাবে না, এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভে জন্যে বাঈ নাচের, মদ-মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই একই সময়ে একই উঠানের একপ্রান্তে তৈরি করেছিলেন ঠাকুরদালান, আকে প্রান্তে তৈরি করিয়াছিলেন নাচ ঘর।…. নবকৃষ্ণর কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলেন উপলক্ষ, ক্লাইভ-ঠাকুরই ছিলেন আসল লক্ষ্য। দুর্গাপূজোর নামে তিনি ক্লাইভ পূজো করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় শরৎকালীন দুর্গোৎব প্রবর্তনের সময় নবকৃষ্ণ সাহেবপূজোর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পরে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপূজো উপলক্ষে সাহেব পূজো নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা আরস্ভ হওয়ায়”। (রাধারমণ রায় : কলকাতা বিচিত্র, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৮; দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২১ ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা)

পলাশীতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে এই উৎসব কেন? এ বিজয় কার বিজয়? তার জবান ভবানীচরণের জনানীতেই পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়, পলাশীর লড়াইয়ের ফলে উঠে এসেছে ‘হর্ষের অমৃত’ আর ‘বিষাদের হলাহল’। ‘হর্ষের অমৃত’ পান করে কলকাতা হয়েছে ‘নিরুপমা ও সর্ব্বদেশখ্যাতা’। কিন্তু ‘বিষাদের হলাহল’ কাদের ভাগ্যে জুটল, সে কথা কিছুই বলেননি ভবানীচরণ। ‘দেবাসুর’ সংগ্রামের ‘বিষাদের হলাহল’ গিলতে হয়েছিল মুর্শিদাবাদ আর ঢাকা শহরকে।

ভবানীচরণ লিখেছেনঃ “ধার্ম্মিক, ধর্ম্মাবতার, ধর্ম্ম-প্রবর্তক, দুষ্ট নিবারক, সৎ প্রজাপালক, সদ্বিবেচক ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর” এই দেশের লোকদের “অধিক ধনী হওনের অনেক পন্হা’ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। ইংরেজ তাই দেবতা। ক্লাইভ ‘মা দুর্গার প্রতীক’। এই দেবতার পূজা করেই পলাশী-উত্তর কলাকাতাকে কেন্দ্র করে রাতারাতি একটি লুটেরা শ্রেণী রাজা-মহারাজায় পরিণত হয়েছিল। ভারত সরকারের জাতীয় মহাফেজখানার ১৮৩৯ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে গবেষক বিনয় ঘোষ সেকালের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবানদের একটি তালিকা সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ তুলে দিয়েছেন ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ নামক বইতে। এই পরিবারগুলো শহর কলকাতার ‘প্রাতঃকালীন গাত্রোত্থানের’ সাথে যুক্ত। তাদের কয়েকজন হলেনঃ

১. মীর জাফরের নবাবী আমলের ক্লাইভের দেওয়ান নবকৃষ্ণের পুত্র মহারাপা রামকৃষ্ণ বাহাদুর, ২. নবকৃষ্ণের ভাতিজা বাবু গোপীমোহন দেব, ৩. কর্ণেল ক্লাইভের বেনিয়ান লক্ষীকান্ত ধরের উত্তর পুরুস রাজা রামচন্দ্র রায়, ৪. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন-বৃত্তির কুখ্যাত সহযোগী মল্লিক পরিবার, ৫. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর রাজস্ব বোর্ডের দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের নাতি বাবু শ্রীনারায়ণ সিংহ, ৬, গভর্নর ভান্সিটর্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ান রামচরণ রায়ের উত্তর পুরুষ আন্দুলের রায় বংশ, ৭. ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ান ও পরে সন্দীপের জমিদার গোকুল চন্দ্র ঘোষালের প্রতিষ্ঠিত খিদিরপুরের গোকুল পরিবার, ৮. হুইলার সাহেবের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর পরিবার, ৯, ঠাকুর পরিবারের ‘জুনিয়র ব্রাঞ্চ’ বা ‘নবীন’ শাখা নামে পরিচিত এবং কোম্পানি সরকারের এজেন্ট,পরে ২৪ পরগনার কালেক্টর ও নিমক এজেন্টের সেরেস্তাদার থেকে নিমক মহলের দেওয়ান ও স্বল্পাকালীন কাস্টমস-সল্ট-ওপিয়াম বোর্ডের দেওয়ান দ্বারকানাথ ঠাকুরের (জন্ম ১৭৯৪) পরিবার। ‘কার ট্যাগোর এন্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা দ্বারাকানাথের প্রভাব প্রতিপত্তির কোন প্রতিদ্বন্দী তাঁর সমসাময়িককালে ছিল না। দ্বারকানাথে ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই আমলের অন্যান্য অভিজাত পরিবার হলো- ১০. সুতানুটি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা শেঠ পরিবার,

১১. মেসার্স ফেয়ারলি এন্ড কোং-এর দেওয়ান রামদুলাল দে, ১২. ভুলুয়া (নোয়াখালি) ও চট্টগ্রামের নিমক মহলের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান রামহরি বিশ্বাস, ১৩. পাটনার চিফ মি. মিডলটন ও স্যার টমাস রামবোল্ড সাহেবের দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, ১৪. কোম্পানির আমলের কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরামের পরিবার, ১৫. কুমারটুলির মিত্র পরিবার, ১৬. কোম্পানির ঠিকাদার গোকুল মিত্রের পরিবার, ১৭. পামার কোম্পানির সরকার গঙ্গা নারায়ণ, ১৮. পাল চৌধুরীর পরিবার, ১৯. কুলীন ব্রাহ্মণ ব্যানার্জী পরিবার, ২০. ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সরকার রামলোচনের প্রতিষ্ঠিত পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবার, ২১. ক্লাইভের দেওয়ান কাশীনাথের পরিবার, ২২. কোম্পানির হুগলীর দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবার, ২৩. কোম্পানি সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ঠিকাদার ও কয়েকজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর বেনিয়ান এবং মেসার্স মুর হিকি এন্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীলের প্রতিষ্ঠিত কলুটোলার শীল পরিবার, ২৪. এককালের লবণের গোলার মুহুরূ বিশ্বনাথ মতিলালের পরিবার, ২৫. ঠনঠনিয়ার ঘোষ পরিবার, ২৬. মেসার্স ভেভিডসন এন্ড কোম্পানির এককালের কেরানী রসময় দত্তের প্রতিষ্ঠিত রামবাগানের দত্ত পরিবার, ২৭. পাটনার কমার্শিয়াল রেসিডেন্টের দেওয়ান বনমালি সরকারের প্রতিষ্টিত কুমারটুলীর সরকার পরিবার, ২৮. আফিমের এজেন্ট হ্যারিসনের দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত বাগবাজারের মুখার্জী পরিবার, ২৯. বেনিয়ান রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার, ৩০. বিভিন্ন বিলাতি কোম্পানির সাথে যুক্ত গঙ্গাধর মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নিমতলার মিত্র পরিবার”। (টাউন কলকাতার কড়চা, পৃষ্ঠা ৭৭-৮৮)

এই অভিজাত পরিবারগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেন,

“কেউ বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়ে, কেউ সর্দারী-পোদ্দারী করে, কেউ দাদানী বণিক ও দালাল হয়ে, কেউ বেনিয়ানী করে, কেউ বা ঠিকাদারি করে, কেউ বা ঠিকাদারি ও স্বাধীন ব্যব্সা-বাণিজ্য করে, কলকাকাতার নতুন শহুরে সমাজে নতুন বড় লোক হয়েছিলেন। সেকালের নবাবী আমলের বড়লোকরা নবযুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে একেবারে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। কোম্পানির আমলে যাঁরা নতুন বড়লোক হলেন তাঁদেরকে এক পুরুষের বড় লোক বললে ভূল হয় না”। (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১০৩)

উপরের তালিকার ‘এক পুরুষের বড় লোক’ ত্রিশটি পরিবারের সবক’টিই বাঙালি হিন্দু। তাদের অধিকাংশই উচ্চ-বর্ণজাত। মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পরের এ তালিকা! অথচ এতে একটিও মুসলিম পরিবারের নাম নেই। এখানেও ‘চিরায়ত ঐতি্যের বিব্রতকর অনুশীলন‍‍! পাল, সেন, তুর্কী, পাঠান, মোগল শাসনামলে সকল উত্থান-পতনের রাজনৈতিক বিবর্তনে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-উচ্চবর্ণ হিন্দুর এই সম্মিলিত শক্তিই শাসন-যন্ত্রের ছত্র-ছায়ায় সমাজে একটানা প্রাধান্য বজায় রেখেছে। ইংরেজ শাসনেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না।

কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার সে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীকে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরাজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলির ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্য-সৃষ্ঠ শ্রেণীটির অবাক উত্থানর কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।

সুপ্রকাশ রায় লিখেছেনঃ “বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকগণের মুৎসদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যাহারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করিয়াছিল, তাহারা এবং মার্ক্সের ভাষায় ‘শহরের চুতর ফড়িয়া ব্যবসায়ীগণ’ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে….. নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হইয়াছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল- ইংরেজ শাসকগণের প্রতি অচলা ভক্তি…. এবং কৃষির ক্ষেত্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া শহরের অবস্থিত, গ্রামাঞ্চলের ভূসম্পত্তি হইতে ইজারা মারফত অনায়াস-লব্ধ অর্থবিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং ‘বেনিয়ান’ লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সহিত ঘনিষ্ট সহযোগিতা। ইংরেজ-সৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি আবির্ভূত হয়। দ্বারাকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য।….. সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেছিল, তখন ……. (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সহিত যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করিবার জন্য কৃষকের সহিত ধনবল ও জনবল নিয়োগ করিয়াছিল”। (ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯)

এই লুটেরা শ্রেণীর হাতে পলাশী-উত্তরকালে তাদেরই রুচি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল কলকাতা। সে কারণেই স্বাধীন মেজাজে মধ্যযুগে গড়ে ওঠা সোনারগাঁও, গৌড়, ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদের সাথে কলকাতার কোন মিল ছিল না। একদিকে ইংরেজ কোম্পানির রাইটার-ফ্যাক্টর-সেমি মার্চেন্ট প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর ইংরেজ কর্মচারী, অন্যদিকে তাদের লুণ্ঠন-সহচর দালাল শ্রেণী। তাদের হাতে বেড়ে ওঠা কলকাতায় জন্ম নিল এক নতুন সংস্কৃতি, যার নাম বাবু কালচার।

কলকাতার ‘বাবু’ সম্পর্কে জে. এইচ ব্রুমফিল্ড তাঁর গ্রন্হ ‘এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ প্লুরাল সোসাইটি’-তে লিখেছেন:

“Babu : In Bengali a title of respect for an English speaking Hindu. Applied derogatorily by the British to semi educated Bhadralok and by extension to any Bhadralok”.

‘বাবু’ শব্দটি কোম্পানির শাসনের জন্ম-স্থিতি-বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করে আবুল কাশেম চৌধুরী লিখেছেনঃ

“ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে যখন স্বাধীনতা দ্রুত অপসৃয়মান, বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ কুটীর শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা ও বহির্বাণিজ্য, তখনই এই সামাজিক বিকলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এই বাবু সমাজ ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আনুকূ্ল্যে।,,,,, কালো পথে উপর্জিত বাবুদের অঢেল টাকা শেষ পর্যন্ত গাতানুগতিক ভূমিমুখীন অর্থনীতিতে আটকা পড়ে এবং তার কারণে সমাজকে বিসর্জন দিতে হয় সম্ভাব্য গতিশীলতা”। (বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নকশা, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা : ৭২)

এরূপ অনেক ‘ব্ল্যাক জেমিনদার’ বা ‘ক্যালকাটা বাবু’ দুই, চার, পাঁচ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে সে যুগের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিল। রাম দুলাল দে পাঁচ টাকা বেতনের সরকার হিসেবে জীবন শুরু করেন। ১৮২৫ সালে মৃত্যুর সময় কলকাতা শহরে তিনি রেখে গেছের উনিশটি বিশাল বাড়ি, আর সে আমলের পৌনে সাত লক্ষাধিক টাকার সম্পদ। কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটু বাবুরা ছিলেন তারই সন্তান। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল পুরাতন শিশি-বোতলের কারবার দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। আট টাকা বেতনের চাকরি শুরু করে রামকমল সেন মৃত্যুর সময় নগদ রেখে যান দশ লাখ টাকা। হেস্টিংস-এর মুৎসুদ্দীগিরি করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাসিমবাজারের রাজপরিবার, যার বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ টাকা। (সিরাজুল ইসলাম, সূর্যাস্ত আইনের সামাজিক তাৎপর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, আষাঢ়, ১৩৮৫)

এই কালো টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ‘চতুর ও বুদ্ধিমান’, শঠ ও প্রবঞ্চক’, এবং ‘হাজার রকম প্রতারণা-কৌশলের উদ্ভাবক’ রূপে। টাকা-পয়সা উপার্জনে তারা যে অভিনব ব্যবসায়িক কৌশলের অবলম্বন করত তা প্রকাশ্য দস্যুতার শামিল। অন্যদিকে সেই লুণ্ঠিত সম্পদ খরচ করার ব্যাপারেও তারা ছিল বেহিসাবী। নানা প্রকার ‘বাবু বিলাস’ তখনকার কলকাতায় চালূ হয়েছিল। বাইজী-চার্চ থেকে শুরু করে বুলবুলির লড়াই, টিকটিকির নাচ পর্যন্ত অনেক কিছুই ছিল তাদের বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের উপাদন। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ এমনকি গৃহ প্রবেমের মতো মামুলি উপলক্ষকে অবলম্বন করে তারা আভিজাত্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ তার মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে সে যুগের প্রায় কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছিল। তার নাতি লালা বাবুর ‘অন্নপ্রাশন’ উপলক্ষে সোনার পাতে দাওয়াত ছেপে বিলি করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে তার ঘরে ‘পুরাণ’ পাঠ করে গঙ্গাধর শ্রীমানী নামক জনৈক ব্রাহ্মণ পারিতোষিক পেয়েছিল হাতী, ঘোড়া ও সুসজ্জিত পাল্কি। আশুতোষ দেবের মায়ের শ্রাদ্ধ আর দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাপের শ্রাদ্ধ সেকালের কলকাতার বাবু-বিলাসের একেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সারা বাংলায় তখন চলছিল ইংরেজ ও তাদের দোসর এই কলকাতা-বাবুদের লুণ্ঠন-শোষণ। ইজারা চুক্তি, সূর্যাক্ত আইন, ব্যবসায়ের নামে লুটপাট প্রভৃতির ফলে একদা-সমৃদ্দ পল্লীবাংলায় দোজখের আগুন জ্বলছিল। উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষে পল্লী বাংলার প্রতি ষোল জনে পাঁচ জন লোক মারা গিয়েছিল। বাংলার পুরনো শহরগুলি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষের গোশত খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করছিল। দেশের শিল্প-অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্বাস নিংড়ে নিয়ে কোটি মানুষের রক্ত পান করে কলকাতায় তখন চলছিল এই প্রমত্ত বাবু-বিলাস।

এভাবেই কলকাতা বেড়ে উঠল। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণ-হিন্দুরা লুণ্ঠন-শোষণের বর্ণনাতীত নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল এবং এভাবেই উনিশ শতকের আশির দশকের মধ্যে তারা ‘সবকিছু উজাড়ভাবে আত্মসাৎ করে’ নিজেদের মধ্যে ‘নব জাগরণ’ সৃষ্টি করল।

কলকাতার এই নবশক্তির উত্থান সম্পর্কে স্বপন বসু লিখেছেনঃ ‘উনিশ শতকে বাংলায় শ্রেণীবিশেষের মধ্যে যে সব চেতনা জাগ্রত হয়েছিল তার প্রায় সবটাই সীমাবদ্ধ ছিল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলমান সমাজে এ-নব চেতনার ছোঁয়া লাগল না কেন?” (বাংলায় নব চেতনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২০৭)

স্বপন বসুর বক্তব্যেই এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ

“মুসলমান নবাবের হাত থেকে ইংরেজ যেদিন বাংলা অধিকার করে নিল, মুসলমান সমাজের অবনতির সূচনা তখন থেকেই। নবাব পরিবার এবং তাকে কেন্দ্র করে মর্শিদাবাদের যে মুসলমান অভিজাত-মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল ইংরেজ রাজত্বে তাদের প্রতিপত্তির অবসান ঘটল। সম্ভ্রম বজায় রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে তারা পাড়ি জমালেন দিল্লী বা পারস্যে। …. রাজধানীও মুর্শিদাবাদ থেকে স্থানন্তরিত হলো কলকাতায়- ফলে মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ১৫% হ্রাস পেল। নবাবী আমলে অধিকাংশ উচ্চ পদই ছিল মুসলমানের অধিকারে, ইংরেজ আসার পর শাসন-ব্যবস্থা পুরো পাল্টে গেল। মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজ রাজ্য অধিকার করেছিলেন, সেই কারণে মুসলমাদের ইংরেজরা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। এদেশে আসার অল্পদিন পরেই রবার্ট ক্লাইভ কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে বিন্দুমাত্র সম্বাবনা আছে জানলেই তারা তা করবে। … সামরিক বাহিনীতে যেসব মুসলামান উচ্চ পদে বহাল ছিলেন সহসা তারা অনুভব করলেন, তাদের দিন শেষ হয়েছে। সামরিক বিভাগের উচ্চ পদগুলো ইংরেজদের করতলগত হলো। অন্যান্য দায়িত্বশীল পদে যেসব মুসলমান ছিলেন তাদের প্রভাব দ্রুত কমতে লাগল। ১৭৮১-তে মাগল ফৌজদারদের পদগুলোতে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হলো”। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৮)

সাধারণভাবে পল্লী বাংলার মানুষ, আর বিশেষভাবে বাংলার মুসলমান জনগণ যখন লুণ্ঠন-শোষণের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তখন ‘হর্যের অমৃত’ পান করে জেগে উঠছিল কলকাতা। কলকাতার এই জাগরণ বাংলার রেনেসাঁ বা বাংলার নব জাগৃতি নয়। এটাকে বড় জোর কলকাতার বাবু জাগরণ বলা জেতে পারে। কিন্তু ভবানীচরণের মতো সাধারণ লেখক থেকে শুরু করে যদুনাথ সরকারের মতো পণ্ডিত ঐতিহাসিকরা সকলে মিলে কলকাতাকেন্দ্রিক এই বাবুজাগরণকেই বাংলার জাগরণরূপে প্রচার করেছেন। ভেদবুদ্ধি প্রসূত মোহাচ্ছন্নতায় এদের মধ্যে কোন ফারক নেই। ভবানীচরণ পলাশীর যুদ্ধকে বলেছেন. ‘দেবাসুর সংগ্রাম’, আর যদুনাথ সরকারে ভাষায়, তা ‘এক যুগান্তকারী ঘটনা’। ভবানীচরণ পলাশী যুদ্ধের ফলে মধ্যযুগের অবসান হয়ে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল’ এবং পলাশীতে ইংরেজ বিজয়ের ফলে ‘মধ্য যুগীয় ধর্মীয় স্বৈরাচারী শাসনের’ অবসান হয়েছিল। যদুনাথের মতে, ইংরেজ আমলে পশ্চিমা সভ্যতার পরশে শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতিতে জড়তা দূর হয়ে শুরু হয় নব জীবনের স্পন্দন। ‘ভগবানের দান এক যাদুকরের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায়’ যেন স্থবির প্রাচ্য সমাজে সঞ্চার হয় রেনেসাঁ বা নব জাগৃতি। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়েছিল, পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলার রেনেসাঁ তার চাইতেও ‘ব্যাপক, গভীর ও বৈপ্লবিক”। (হিস্টি অব বেঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪৯৭-৯৮)

যদুনাথ সরকার-এর এই পর্যবেক্ষণ ও মতামত সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ডক্টর সিরাজুল ইসলাম লিখেছেনঃ

………. পলাশীর পরাজয়ের মধ্যে তিনি (যদুনাথ সরকার) যে যুগান্তকারী সুফল লক্ষ্য করেছেন তা হচ্ছে নেহাতই একজন মস্তিষ্কস্নাত রাজভক্ত ঔপনিবেশিক ঐতিকাহাসিকের তথ্যশূন্য ভাবোদগার ও মনগড়া কল্পনা মাত্র। ঊনবিংশ শতকের ত্রিশের দশকে সর্বপ্রথম কোম্পানির সরকার দেশীয়দের ইংরেজি শিক্ষাদানের নামে একটি মাত্র শিক্ষানীতি গ্রহণ করে। এর পূর্বে পৌনে একশত বৎসর যাবত শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকাতার অভাবে হাজার হাজার মোগলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা বন্ধ প্রায় হয়ে যায়। ফলে দেশ নিপতিত হয় অশিক্ষা ও অজ্ঞতার মহা তিমিরে। এটা কি রেনেসাঁ? ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে এসে দেশীয়দের সর্বপ্রথম দায়িত্বশীল উচ্চপদ লাভের বাধা উত্তোলন করা হয়। এর পূর্বে শত বৎসর যাবৎ সমস্ত দায়িত্বশীল উচ্চ বেতনের সরকারি চাকরি ছিল একচেটিয়া ইউরোপীয়দের জন্য রিজার্ভ। চাকরিহারা দেশের অগণিত পেশাদার পরিবার বেকার হয়ে নিঃস্ব নিস্তেজ সামাজিক বোঝায় পরিণত হয়। উত্তরোত্তর জনবহুল শহর, বন্দর, আর লয়প্রাপ্ত হয়ে পুঁতিগন্ধময় নোংরা জঞ্জালে পরিণত হয়। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি মহামারীতে মৃত্যু ও পলায়নের ফলে নাগরিক লোকসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ইহা কি রেনেসা? বাংলার যে বস্ত্র ও রেশম-শিল্ল ছিল একদা বিশ্বনন্দিত সে শিল্পের পতন ঘটে পলাশীর যুদ্ধের পর। বাংলাদেশ পরিণত হয় গ্লাসগো-ম্যানচেস্টারের বন্দীবাজারে (captive market)। ইহা কি রেনেসাঁ? কোম্পানির ভূমি-রাজস্বনীতির ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনার্জিত আয় ভক্ষণকারী উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন একটি সুবিধাভোগী জমিদার ও মধ্যস্বত্ব শ্রেণী। রায়ত ভূমিতে চিরাচরিত অধিকার হারিয়ে পরিণত হয় জমিদারের করুণাপ্রার্থী প্রজায়। ইহা কি রেনেসাঁ? এসবই পলাশী যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের সুদূর প্রসারী ফল”। (বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৩০-৩২)

একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্য এটি অবশ্যই রেনেসাঁ ছিল। শ্রেণী পরিচয়ে তারা সামন্ত, ব্যবহারিক পরিচয়ে জমিদার, আর আভিজাত্যের কল্যাণে কলকাতার মানসপটে এর ছিল বাবু নামে পরিচিত। রাজনীতিতে এরা ইংরেজদের বংশবদ দালাল, কিন্তু জনগণের আর্থ-সামাজিক জীবনের তারাই ছিল প্রকৃত নিয়ন্তা। পলাশীর প্রানতরে বাংলার নবাব মসনদ হারিয়েছিলেন আর এই নবোত্থিত বর্ণহিন্দুরা পেয়েছিল অনেক শ্বেতাঙ্গ নবাব। তাদরে জন্যই পলাশীর পরাজয় এনেছিল নব জাগৃতি বা রেনেসাঁ। এই জাগৃতি বাংলার জাগরণ নয়, এটি নিতান্তই ছিল কলকাতার ‘বাবু জাগরণ’।

সহায়ক গ্রন্থ

সুপ্রকাশ রায়_  ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৮৬-১৮৯।

শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867

দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।
 বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ।
আমাদের জাতিসত্ত্বার বিকাশধারা ।
যদুনাথ সরকার _ বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯।

পর্ব তিন । দুই ।। ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

পলাশী বিজয়ের পর বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা ও ইংরেজরা লুঠ করে  মুর্শিদাবাদের রাজকোষ। 

পলাশী পর মুসলমানদের বিপর্যয় ও কলকাতায় বরং হিন্দুদের উত্থান। 


সূফি বরষণ
দুই.

মুসলমানদের পলাশীর বিপর্যয়ের পর ‘হঠাৎ-নবাব’ এই ইংরেজ কর্মচারীরা এদেশে এসেছিল বার্ষিক পাঁচ, দশ, পনের কিংবা পঁচিশ পাউন্ড বেতনের ‘রাইটার’, ‘ফ্যাক্টর’, ‘জুনিয়ার মার্চেন্ট’ বা ‘সেমি-মাচেন্ট’ হিসেবে। ‘লোফার’ শ্রেণীর এই ইংরেজ কর্মচারীরাই স্বনামে-বেনামে বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন-শোষণের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে কাড়ি কাড়ি টাকা পাচার করে নিজ দেশেও ‘কিংবদন্তীর রাজপুত্তুরের’ ইমেজ অর্জন করেছিল। কোম্পানির ‘দস্তক’র অপব্যবহার করে পাঁট পাউন্ড বেতনের কর্মচারীরা এদেশে মুৎসুদ্দী-অর্থলগ্নিকারীর মূলধনে বছরে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছিল্। তার ওপর ছিল নানা প্রকার ঘুষ ও উপঢৌকন। তাদের ব্যবসায়িক লুণ্ঠনের প্রধান অবলম্বন এ দেশীয় বেনিয়ান, মুৎসুদ্দী, গোমস্তা, দালাল ও ফড়িয়ারা। তাঁতি আর কামারশ্রেণীর গরীব উৎপাদকদের কাছ থেকে টাকা লূট করেও তারা বখরা তুলে দিত এসব ইংরেজ কর্মচারীর হতে । এভাবেই কোম্পানির বার্ষিক পাঁচ পাউন্ড বেতনের কেরানী হয়ে ১৭৫০ সালে এ দেশে এসে ওয়ারেন হেস্টিংস চৌদ্দ বছর পর দেশে ফিরেছিলেন ত্রিশ হাজার পাউন্ড সাথে নিয়ে। এরপর দ্বিতীয় দফার গভর্নর জেলারেলরূপে যখন তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে, বাণিজ্য থেকে সাম্রাজ্য রূপান্তরের তখন তিনিই প্রকৃত প্রতিনিধি।

এভাবেই স্বল্প বেতনভূক’ বণিক নাবিক আর লোফার’ ইংরেজ কর্মচারীরা’ বেঙ্গল নেবুব’- এ পরিণত হলো। আর তাদের এ দেশীয় লুণ্ঠন-সহচর দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দীরা দালালীর মাহত্ম্যে রাতারাতি পরিণত হলো রাজা-মহারাজারয়। এই সম্মিলিত লুটেরা চক্রটি সম্পর্কেই ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেনঃ “প্রথমে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে কতগুলো ভাগ্যবিতাড়িত, চরিত্রভ্রষ্ট, ধুর্ত, পলাতক, অল্প শিক্ষিত লোক বেনিয়া-মুৎসুদ্দী-গোমস্তা-কেরানী-ফড়িয়া দালালরূপে অবাধে অঢেল অজস্র কাঁচা টাকা অর্জন ও সঞ্চয়ের দেদার সুযোগ পেয়ে ইংরেজদের এ দেশে উপস্থিতিকে ভগবানের আশীর্বাদরূপে জানল ও মানল”। (বঙ্কিম বীক্ষা-অন্য নিরিখে, ভাষা-সাহিত্যপত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৮২)

মীরজাফর নিজেকে শেষ অবধি কি চিনতে পেরেছেন? পারলেও তার ফেরার পথ খোলা ছিল না। অবজ্ঞা, অপমান আর ঘাত প্রতিঘাত নির্দেশ খবরদারীর দুর্বিপাকে পড়ে স্বপ্ন আর সম্মোহনের ঘোর কাটতে খুব বেশী দেরী হয়নি তার। দেরী হয়নি তার নিজেকে চিনতে। নবাবীর মোড়কে ঢাকা বেনিয়া চক্রের শিখণ্ডী বৈতো তিনি আর কিছু নন। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্য তার ব্যক্তিসত্তা বিক্রি হয়েছে অনেক আগে।

সিরাজের শোণিত-সিক্ত বাংলার মসনদ পরিণত হল তেজারতের পণ্যে। ক্লাইভের অর্থের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে মীর জাফর অসহিষ্ণু এবং মরিয়া হয়ে উঠলেন ইংরেজদের লালসার দোহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইলেন। একারণে তিনি ওলন্দাজদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের দেশছাড়া করার এক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। আর এ কারণেই নবাবের নাটমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হল মীর জাফরকে। তাকে পদচ্যুত করে কোলকাতায় নজরবন্দী করে রাখা হল। এর পর কোম্পানীকে টাকা উৎকোচ দিয়ে গ্রীনরুম থেকে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মীর কাসিম। মীর কাসিম শুধুমাত্র মঞ্চাভিনয়ে সীমাবদ্ধ রইলেন না। সত্যিকার নবাব হবার চেষ্টা করলেন। নাটমঞ্চ থেকে রণাঙ্গনের রক্তাক্ত পথ বেছে নিলেন বাংলার ভাগ্য ফেরানোর জন্য। সাতটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে তার অতীত গুনাহর কাফফারা আদায় করেছেন তিনি। শেষ অবধি বিচ্ছিন্ন শক্তি সমূহের সব সূত্র একই গ্রন্থিতে বাধার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হলেন। সব সময় পঞ্চম বাহিনী গাদ্দারদের প্রেতাত্মা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে। গিরিয়ালা, উদয়নালা এবং বক্সারের প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাকে বাংলার মাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হয়। অবশেষে অনাহারে অর্ধাহারে ধুঁকে ধুঁকে নিরাশ্রয় মীর কাশিম দিল্লীর রাজপথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন বাংলার অবস্থা কি?

অবশেষে কোম্পানীর ছোট বড় সব কর্মচারী এবং তাদের দলগত চক্র শোষণ লুণ্ঠনের দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সমগ্র বাংলাব্যাপী। আর মুসলমানদের উচ্চবিত্ত আমীর ওমরাহর দল শিখণ্ডী নবাব হবার অভিলাষে তাদের সম্পদ উজাড় করে ইংরেজদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে এবং বৃটিশদের অর্থতৃষ্ণা মেটাতে থাকে। মীর কাশিম একই উদ্দেশ্যে ২ লক্ষ পাউন্ড (৪ কোটি টাকা) বর্তমান মুদ্রামানে ৮ হাজার কোটি টাকা কোম্পানীর হাতে তুলে দেন। মীরজাফরের পুত্রও কোম্পানীকে দেয় ১ লক্ষ ৪৯ হাজার পাউন্ড অর্থাৎ ৩ কোটি টাকা, বর্তমান মুদ্রামানে ৬ হাজার কোটি টাকা।

ওদিকে বাংলার জনপদ তার জেল্লা হারিয়ে নৈরাশ্য, হতাশা এবং বিশৃংখলার দিকে ধাপে ধাপে এগুতে থাকে। ক্লাইভের স্বীকৃতি থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করা যায়। ক্লাইভের ভাষায়- “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি।” অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ সংস্কৃতির রূপান্তর, আব্দুল ওয়াদুদ, পৃ.- ৬০-৬২)। পলাশীর বিপর্যয়ের পর বাংলার প্রধান শিল্পনগরী ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে দ্রুত ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। জনগণ শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল। এসব শহরের জনসংখ্যা কমছিল দ্রুত, আর অন্যদিকে তখন কলকাতায় বইছিল সমৃদ্ধির জোয়ার। লুটেরা কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, আর তাদের লুণ্টনবৃত্তির জুনিয়র পার্টনার এদেশীয় দেওয়ান-বেনিয়ান-গোমস্তাদের উদ্যোগে তখন সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিতপুর-বিরজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলোর ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভিতর থেকে দ্রুত বেড়ে উঠেলিল টাউন কলকাতা। কলকাতার এই উত্থান সম্পর্কে নারায়ণ দত্ত লিখেছেনঃ

“জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা”। (জন কোম্পানির বাঙ্গালি কর্মচারী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৩) বাঙালি বেনিয়ানরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ,বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাোযাগের সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠার শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও অভিন্ন পরিচয়। এভাবেই গড়ে ওঠে ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রমূলক মৈত্রী। মুসলিম শাসনের অবসানই ছিল এই মৈত্রীজোটের উদ্দেশ্য। (এস. সি. হিল তাঁর গ্রন্হ ‘বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’-এর ২৩, ১০২, ১১৬ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় প্রমাণপঞ্জীসহ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।)

এই শ্রেণীর লোকেরাই বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। ব্যক্তিস্বার্থ ও সংকীর্ণ মোহাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবশত এই শ্রেণীর লোকেরাই স্বাধীনতার পরিবর্তে পরাধীনতাকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিষয়টি খোলামেলা তুলে ধরে এম. এন. রায় লিখেছেনঃ

“It is historical fact that a large section of Hindu community welcomed the advent of the English power.” (India In Transition)

আার রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেনঃ

“British could winover political authority without any opposition from the Hindus.” (British Paramountcy and Indian Renaissance. Part-II, P-4)

কাদের নিয়ে জাগল এই কলকাতা ? এরা কারা এ প্রসঙ্গে আবদুল মওদুদ লিখেছেনঃ

“আঠার শতকের মধ্যভাগে কলকাতা ছিল নিঃসন্দেহে বেনিয়ানের শহর-যতো দালাল, মুৎসুদ্দী, বেনিয়ান ও দেওয়ান ইংরেজদের বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যবর্তীর দল। এই শ্রেণীর লোকেরাই কলকাতাতে সংগঠিত হয়েছিল ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট ও বশংবদ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী হিসেবে”। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২৮২)

বিনয় ঘোষ দেখিয়েছেন, কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল ‘নাবিক, সৈনিক ও লোফার’- এই তিন শ্রেণীর ইংরেজের হাতে। তাদের দেওয়ান, বেনিয়ান ও দালালরূপে এদেশীয় একটি নতুন শ্রেণী রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হয়ে ইংরেজদের জুনিয়র পার্টনাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। টাউন কলকাতার কড়টা’ বইয়ে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ

“………. ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতি ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে।…… এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে………। বেনিয়ানরা ……. ছিলেন বিদেশী ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা।…….. আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ত করেন, তখন দেশ ও দে শের মানুষ সম্বন্ধে তাদেঁর কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ-প্রায় সমস্ত ব্যপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তাঁরাই হলে বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন,হিসেব রক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে”। (টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)

ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো- সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসেব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা। (বর্তমান মুদ্রামানে ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা)। ( Miller quoted by Misra. P-15.)

পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কি মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদণ্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি, হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কেবল অলিখিত বিবরণ অর্থ সাগরপারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে? (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃ-৯৫)

একটা স্বপ্নের ঘোর ছিল মীরজাফরের। তিনি নিজেকে ভেবেছিলেন সিরাজ বিরোধী চক্রের মহানায়ক। সিরাজের পতনের অর্থ তিনিই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি। তিনি জানতেন, দুঃসাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে সিরাজ দাঁড়িয়েছিলেন চোরাবালির উপরে। আর এ চোরাবালি সৃষ্টির নায়কেরা তারই সহযোগী। তাদের পছন্দসই, তাদেরই মনোনীত নবাব তিনি। তিনি ভেবেছিলেন জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উঁমিচাদ, নন্দকুমার প্রমুখ অসংখ্য হিন্দু অমাত্যবর্গ এবং মীর কাসিমের পতনের পর পুনরায় মীর জাফরকে পুতুল নবাব হিসেবে ক্ষমতায় বসানো হলো। এবার কিন্তু মীর জাফরকে নির্দেশ দেয়া হল সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। কোম্পানীর নির্দেশকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা শিখণ্ডী নবাবের ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি ৮০ হাজার সৈন্যকে বরখাস্ত করলেন। এর আগে মীর কাসিমের ৪০ হাজার সৈন্য ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। মোটের উপর পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধ নাটকের পর থেকে সেনাবাহিনীর দেড়লক্ষাধিক সৈন্য এবং এ বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজার কর্মচারী চাকুরীচ্যুত হল। এদের সবাই ছিল মুসলমান। এর ফলে বাংলার অসংখ্য মুসলিম পরিবার এগিয়ে চললো বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের দুঃসহ অবস্থার দিকেও, শুরু হল সুবাহ বাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়।

এই সম্পর্কে হান্টার (১৮৭১ সালে) বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে সেনাবাহিনী। সেখানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হয়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারতো না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়া হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না। পলাশীর বিপর্যয়ের ফলে এই দাঁওবাজ মাস্তানশ্রেণীর লোকরাই হলো এদেশের ‘ভাগ্য বিধাতা’। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনি রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানি কর্তৃত্ব লাভের ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে এই সম্মিলিত লুটেরাচক্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্টিত হলো। তাদের হাতে বাংলাদেশের হাজার বছরের শিল্পের গৌরব মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে অবিশ্বাস্য অল্পকাহিনীতে পরিণত হলো। ইংরেজদের সৃষ্ট শুল্ক-প্রতিরোধ নীতির ফলে এ দেশের বিশ্বখ্যাত সূতি বস্ত্র ও রেশম-বস্ত্র ধ্বংস হলো। কুটির শিল্প হলো বিপর্যস্ত। আগে বাংলাদেশের কাপড় বিলাতে রফতানী হতো। এখন ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্র আমাদের বাজার দখল করল।

Friday, 24 June 2016

পর্ব তিন। এক।। ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।



পলাশী বিজয়ের পর বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা ও ইংরেজরা লুঠ করে  মুর্শিদাবাদের রাজকোষ। 

পলাশী পর মুসলমানদের বিপর্যয় এবং  কলকাতায় হিন্দুদের উত্থান। 


সূফি বরষণ 
এক.
পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর শিবিরে দু’দিন সসৈন্যে অবস্থান করলেন ক্লাইভ। তারপর দু’শ ইংরেজ ও পাঁচশ’ দেশীয় সৈন্য নিয়ে তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা নীরবে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এই মোড় পরিবর্তনের ঘটনার সাক্ষী হলো। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেনঃ “ইচ্ছা করলে মুর্শিদাবাদের জনতা শুধু লাঠি আর পাথর মেরে এই নতুন বিজেতাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারত। লোকেরা নাকি বলাবলিও করেছে, কোন অস্ত্র ছাড়া শুধু ইটপাটকের মেরেই মুর্শিদাবাদের লোকেরা ইংরেজদের ধরাশায়ী করতে পারত”। (ভোলানাথ চন্দ্র : দি ট্রাভেল অব এ হিন্দু, লন্ডন, ১৮৬৯, পৃষ্ঠা ৬৮)।

পলাশী যুদ্ধের প্রহসনমূলক নাটক শেষ হতে না হতেই লুণ্ঠিত হল মুর্শিদাবাদের রাজকোষ। সে সময় রাজকোষে কি পরিমাণ সম্পদ ছিল? মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনকাল থেকে দীর্ঘ ৫৫ বছরের সঞ্চয় একত্রিত হয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোষাগারে পূর্ণিয়া যুদ্ধের পর সঞ্চিত ছিল সার্জন ফোর্থের প্রদত্ত হিসেব মতে মণিমুক্তা হিরা জহরতের মূল্য বাদ দিয়ে, তৎকালীন মুদ্রায় ৬৮ কোটি টাকা [S. C. Hill. Bengal in 1757-67, P.108] যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের সাথে তুলনীয়।’ পলাশীর নাটক শেষ করে সিরাজ-উদ্দৌলারই দীওয়ান রামচাঁদ বাবু মুনশী নবকিষেণ, লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরকে নিয়ে নবাবের কোষাগারে হাজির হন বিত্ত-সম্পদ লুট করার জন্য। দীওয়ান বাবুর তালিকার সাথে মিলিয়ে প্রাপ্ত সম্পদ তারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেন। সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদে ও অন্দরমহলে রক্ষিত সম্পদ ভাগ করে নেন দীওয়ান রামচাঁদ, মুনশী নবকিষেণ, মীর জাফর আলী খান ও আমীর বেগ খান। (সিয়ারে মতাযেলি, ২য় খণ্ড (অনুবাদ) পৃ-২৩)।

পলাশী বিপর্যয় মুর্শিদাবাদের সাথে সাথেই কোন বড় রকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বলে জানা যায় না। শাসক মহলের অন্তঃপুরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আর বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষয়রোগ’ জাতির প্রতিরোধ-চেতনা পঙ্গু করে ফেলেছিল। শাসক ও জনতা ছিল আত্মিক সম্পর্কহীন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন। উদ্যমহীন এই নিস্পৃহ মানুষেরা অবাক চোখে দেখল মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের ঘটনা। ক্লাইভের নিজ তত্ত্বাবধানে মুর্শিদাবাদের রাজকোষ নিঃশেষে লুণ্ঠিত হলো। এরপর ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই পুতুল নবাব মীর জাফর আলী খাঁ রাজকীয় শন-শওকতের সাথে ইংরেজদের ‘যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের’ প্রথম কিস্তির টাকা কলকাতায় পাঠালেন সোনা-চাঁদির মাধ্যমে।

“সামরিক বাদ্য সহকারে শোভাযাত্র করিয়া প্রথম কিস্তির টাকা দুই শত নৌকায় বোঝাই করিয়া কলিকাতা অভিমুখে রওয়ানা হইল”। (রমেশচন্দ্র মজুমদার)। কলকাতার উত্থানের সূচনা এখান থেকেই। মুর্শিদাবাদের জনগণ এবারে তারেদ অন্তরে একটা অব্যক্ত জ্বালা অনুভব করল। কোথায় যেন একটা বড় রকম ছন্দপতন ঘটে গেছে!।

ইংরেজদের লুণ্ঠন সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেনঃ“নবাবের সিংহাসন নিয়ে চক্রান্ত করে, জমিদারী বন্দোবস্ত ও রাজস্ব আদায়ের নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ব্যক্তিগত ও অবৈধ বাণিজ্য থেকে প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করে এবং আরও নানা উপায়ে উৎকোচ-উপঢৌকন নিয়ে চার্ণক-হেজেস-ক্লাইভ-হেষ্টিংস-কর্নওয়ালিসৈর আমলের কোম্পানির কর্মচারীরা যে কি পরিমাণ বিত্ত সঞ্চায় করেছিলেন তা কল্পনা করা যায় না। …. দেখতে দেখতে প্রচুর অর্থ ও নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে কোম্পানি সাহেবরা সত্যি সত্যি নবাব বনে গেলেন। তাদের মেজাজ ও চালচলন সবই দিন দিন নবাবের মতো হয়ে উঠতে লাগল”। (কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।

মুর্শিদাবাদের রাজকোষ থেকে পাওয়া গেল পনের লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বৃটিশ নৌবাহিনী এবং স্থল বাহিনীর ৬জন সদস্যকে দিতে হল ৮কোটি টাকা। সিলেক্ট কমিটির ৬ জন সদস্যকে দিতে হল ৯ লক্ষ পাউন্ড (১৮ কোটি টাকা), ক্লাইভ তার নিজের জন্য আদায় করলেন ২ লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৩ কোটি টাকা), কাউন্সিল মেম্বাররা পেলেন এক থেকে দেড় কোটি টাকা করে। এছাড়াও উৎকোচ, নিপীড়ন এবং আরো বিবিধ নীতি বহির্ভূত ঘৃণিত পন্থায় এ দেশের সম্পদ লুট করেছে বৃটিশ বেনিয়ারা। সিরাজের পতনের পর নবাবের শূন্য আসনটি কোম্পানীর অর্থোপার্জনের উৎসে পরিণত হয়। শিখণ্ডি নবাবী কেনাবেচার মধ্য দিয়ে কোম্পানীর নতুন ধরনের তেজারতি শুরু হয়।

কোম্পানী এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-ন’ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃ.-৯৫)।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ সালের মধ্যে মীর জাফরের কাছ থেকে আদায় করলো ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর বাইরে ব্যক্তিগত পারিতোষিক আর উপহার উপঢৌকনের পরিমাণ ছিল ৫৮ লাখ হাজার ৭০ হাজার টাকা। ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ‘নবাব উঠানো-বসানো’র রাজনীতি করে কোম্পানির বিভিন্ন কর্মচারী প্রচুর অর্থ-কড়ির মালিক হলো। নানা অজুহাতে কোম্পানি করল বিস্তর আয়-রোযগার। সেই অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৪৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ পাউন্ড। তখনকার হিসেবে তেরো কোটি টাকা। (ব্রিজেন কে গুপ্ত : সিরাজউদ্দৌলা এন্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃষ্ঠা ১২৬-২৭) মীর জাফর-মীর কাসিম-নাজমুদ্দৌলার নবাবীর মাশুলে ক্লাইভ আর ভেরেলস্টের ব্যক্তিগত বখরা ছিল ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৫ পাউন্ড। (রমেশচন্দ্র দত্ত : ইকনোমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, ১৭৫৭-১৮৩৭, পৃষ্ঠা ৩২) এছাড়া ক্লাইভ মীর জাফরের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন বার্ষিক তিন লাখ টাকা আদায়ের জায়গীর। এই বিরল সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে এদেশ থেকে ক্লাইভ-ভেরেলস্ট-এর দ্বারা বিতাড়িত ইংরেজ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস লিখেছেনঃ

“The plunder which the superior servants of the Company acquired in the year 1757 ……. suddenly enabled many of them to return to England with princely fortune”. (Considerations on Indian Affairs, part-II London, 1775. P-3)।

মীরজাফর ক্ষমতায় আরোহণ করে টের পেলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবাব নন, শিখণ্ডি মাত্র। বলতে গেলে তিনি বৃটিশদের অর্থোপার্জন এবং শোষণের যন্ত্র। সিরাজের প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় তিনি যে মর্যাদা এবং প্রতিপত্তির প্রতীক ছিলেন আজ নবাবীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তাকে কোম্পানীর সাধারণ কর্মচারীদের তোষামোদ করে চলতে হচ্ছে। তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য উৎকোচ উপঢৌকন হিসেবে তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে হয়েছে। কিন্তু তবু কোম্পানীর ক্ষুধা মেটান সম্ভব হয়নি। রাজকোষের সমস্ত ভাণ্ডার উজার করে দিয়েও তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। ষড়যন্ত্রের শুরুতে তিনি ভেবেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্র এবং ইংরেজ বণিকদের সহযোগিতা নিয়ে তিনিই হবেন উপমহাদেশের সবেচেয়ে শক্তিশালী নবাব। নবাবীর নেশায় তিনি এত উন্মত্ত মাতাল ছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের গভীরে আর এক ষড়যন্ত্রকে আমলে আনতে পারেননি। কিন্তু নবাবের পতনের পর যখন দেখলো শক্তির সব সূত্রগুলো ছিন্ন ভিন্ন, সব অমাত্যবর্গ উগ্র লালসা নিয়ে ক্লাইভের তোষামোদে ব্যস্ত, দেখলেন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের দাপট, দেখলেন রাজকোষের নির্মম লুণ্ঠন এবং লোপাট হতে দেখলেন নগর জনপদগুলো। বাংলার নবাব হয়ে তাকে দেখতে হল সবকিছু নীরবে, নিরুপায় হয়ে। দুর্বিষহ মনে হলেও কোম্পানীর সব অপকর্মকে সমর্থন দিতে হল হাসি মুখে। ক্লাইভের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও তার অবশিষ্ট রইল না। সিরাজের পতনের সাথে সাথেই বাংলার মুসলমান হয়ে পড়ল অভিভাবকহীন। বাংলার মুসলমানদের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের সব উৎসমুখগুলোতে আগুন জ্বলে উঠল। একের পর এক ধনী গরীব নির্বিশেষে বাংলার সব মুসলমান এগিয়ে চলল ধ্বংসের কিনারে।

Thursday, 23 June 2016

পর্ব দুই । ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

পলাশী বিজয়ের পটভূমি তৈরী করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ জগৎশেঠরা। 


সূফি বরষণ 

পলাশী বিপর্যয়ের মূল নায়ক মীর জাফর নয় মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ আর তাঁর সহযোগী ছিলো নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রায় দুর্লভ রাম, নন্দকুমার, উমিচাঁদ । ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের স্বৈরাচারী শোষণ, লুণ্ঠন এবং আধিপত্যের অবসান হয় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর। তাদের লুপ্ত শক্তি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ ইতিহাসে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নেপথ্যে। সম্মুখ সমরে মুসলমানদের পরাস্ত করার সর্বশেষ প্রয়াস ছিল আগ্রার অদূরে খানুয়ায় বাবুরের সাথে যুদ্ধ। উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দু রাজা ও মহারাজাদের সম্মিলিত বাহিনীর ৮০ হাজার অশ্বারোহী এবং ৫০০ রণ হস্তী সম্রাট বাবুরের ১০ হাজার সৈন্যের প্রতিরোধের মুখে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সম্মুখ সমর পরিহারের নীতি অবলম্বন করে।  অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তারা অতি ধৈর্য সহকারে নেপথ্য ষড়যন্ত্রের পথে এগুতে থাকে। তোষণ ও আনুগত্যের অভিনয় করে এক দিকে যেমন সংশ্লিষ্ট শাসকদের আস্থা অর্জন করে, অন্যদিকে অনুরূপ ষড়যন্ত্রের নিত্য নব নব কৌশল অবলম্বন করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

তখন বাংলার সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী। কারণ এর পিছনে কাজ করে বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা। তপন মোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার...। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলাদেশের মহাজনদের মাথা জগেশঠদের বাড়ির কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগেশঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলাদেশে পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।...হুগলিতে রইলেন নন্দকুমার। উমিচাঁদ ইংরেজদের হয়ে তাঁকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে রেখেছিলেন।’ জগেশঠ এবং উমিচাঁদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাঁ আর একজন ষড়যন্ত্রকারী।

সবার শীর্ষে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর এক বৈমাত্রেয় ভগ্নীর স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। নবাব হওয়ার বাসনা তার অনেক দিনের। বর্গীর হাঙ্গামার সময় আলীবর্দী খাঁকে হত্যা করিয়ে বাংলার নবাবী গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল। শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে শওকত জঙ্গের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রের আর এক গ্রন্থি রচনা করেন। তা কার্যকর হয়নি। এবারে জগেশঠ, ইয়ার লতিফ খাঁ, উমিচাঁদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামেন। সিরাজের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনানায়ক মোহন লাল এবং মীর মদন বা মীর মর্দান। ২৩ জুনের পূর্বে বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় রচিত মীর কাসিম গ্রন্থের ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় ১১ দফার এই চুক্তির বিবরণ রয়েছে। মীর জাফরের স্বাক্ষরে চুক্তিতে বলা হয় : ‘আমি আল্লাহ্র নামে ও আল্লাহ্র রসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানিয়া চলিব।’

এই কর্ম প্রয়াস শুরু হয় উপমহাদেশের সর্বত্র। যেমন মুর্শিদাবাদে শুরু হয় মুর্শিদকুলি খানের শাসনামল। আমি আগেই উল্লেখ করেছি পলাশী ট্রাজেডীর মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ। মীর জাফর ছিলেন শিখণ্ডী, পুরানের ভাষায় অধৈর্য। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী অধৈর্য ব্যক্তিত্বকে অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতায়নে প্রলুব্ধ করে এবং তাকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকে সর্বব্যাপী করে তুলে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, নবাব আলী ওয়ার্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলাহর শাসনামলে অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার ছিল হিন্দু। ‘দেওয়ান’ ‘তানদেওয়ান’ ‘সাবদেওয়ান’ ‘বখশী’ প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিতেই হিন্দুরা অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম ছিল মীরজাফর। অপরদিকে ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিল হিন্দু। ফলে একজন স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি হিসেবে তিনি যখন বারবার ইংরেজদের হুঁশিয়ার করে দেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে ও দেশের আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা যদি ব্যবসা করে তবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। অন্যথায় তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা ছাড়া কোন গতি থাকবে না, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত তো করেইনি, বরং নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে।

 এর কারণ সুস্পষ্ট তারা ভিতর থেকে ইন্ধন পাচ্ছিল। এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল নবাবের সুবিধাবাদী, দেশদ্রোহী কিছু রাজকর্মচারী আর ঈর্ষাপরায়ণ কিছু নিকটাত্মীয়। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল আর বাংলার বিশ্বাসঘাতক কুচক্রী অমাত্যবর্গের মধ্যে ১ মে ১৭৫৭ সালে এক গোপন লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়। দরবারের ষড়যন্ত্রের যারা মূল হোতা তাদের মধ্যে প্রধান সেনাপতি হবার কারণে ঘটনাচক্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল মীর জাফর, এর পেছনের প্রধান চক্রান্তকারীরা ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা প্রাসঙ্গিক মনে করছি তা হলো- পলাশী বিপর্যয়ের জন্য নবাবের নিকটাত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে এককভাবে দায়ী করা হয়। মীরজাফর লোভী, অপদার্থ, বিশ্বাসঘাতক ছিল এবং তার চূড়ান্ত বেঈমানীর ফলেই পলাশী দিবসের প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল সবই ঠিক আছে। কিন্তু উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী শীর্ষ জমিদার আমলারা কি ধোয়া তুলসী পাতা? উর্মিচাঁদ, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, মানিকচাঁদ, দূর্লভরাম, রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্ররায়, নন্দকুমার এরা কি শুধুই পার্শ্বচরিত্র ছিল? অন্তত একশ্রেণীর ঐতিহাসিক সে রকম ধারণা দিতেই বদ্ধপরিকর। ঐতিহাসিক মোহর আলী যথার্থই বলেছেন: “মীরজাফর যদি এই চক্রান্তে যোগ নাও দিত ষড়যন্ত্রকারীরা অন্য কাউকে খুঁজে নিত।” এদের প্রচারণা এতই শক্তিশালী ছিল যে, আজকে আমজনতার একটা বিরাট অংশ সেটাকেই প্রকৃত ইতিহাস বলে গ্রহণ করে ফেলেছে। যাইহোক সেই গোপন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বিশাল সৈন্যবাহিনী থাকা সত্ত্বেও ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে যুদ্ধ যুদ্ধ নাটকের মাধ্যমে জাতীয় বেঈমানরা দেশ ও জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে গুটিকতক বিদেশী বেনিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক নবাবকে তারা গ্রেফতার ও পরে শহীদ করে।

পলাশী বিপর্যয়ের পর বাংলা-বিহার ইংরেজ ও তাদের দেশীয় দালাল বর্ণহিন্দুদের লুটপাটের স্বর্গভূমি হয়ে উঠেছিল। একজন মুসলমানও পাওয়া যায়নি যে পলাশী যুদ্ধের পর সম্পদশালী হয়েছিল। অথচ পেটের দায়ে এদেশে আসা ইংরেজ ও তাদের দেশীয় সেবাদাস জগৎশেঠ গংরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। ইংরেজরা এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্নীতি আমদানী করে ব্যাপকভাবে। বৃটিশ সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশবছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল। এই ব্যাপক লুন্ঠনের ফলে ১৭৭০ সালে (বাংলা-১১৭৬) বাংলা-বিহারে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কোটি মানুষ  মৃত্যের শিকারে পরিণত হয়।  ‘‘ছিয়াত্তরের মনন্তর’’ নামে পরিচিত এই মহাদূর্ভিক্ষে ইংরেজ গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল এক কোটি পঞ্চাশ লাখ।

বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হীরানন্দ সাহা তিনি মারোয়ারের নাগর থেকে পাটনায় এসে সুদের কারবার শুরু করেন। ১৭১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মানিক চাঁদ সুদের কারবার শুরু করেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত মুর্শিদকুলি খানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। মুর্শিদকুলি খান তার দিওয়ানী দপ্তর মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করার সাথে সাথে মানিক চাঁদও ১৭১২ সালে মুর্শিদাবাদে এসে পড়েন। একই বছর তিনি নবাব কর্তৃক নগর শেঠ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৭১৪ সালে মানিক চাঁদের মৃত্যু হলে তার ভাগিনা ফতেহ চাঁদ সাহা তার উত্তরাধিকারী হন। মুর্শিদকুলি খানের সুপারিশে ফতেহ চাঁদ দিল্লীর বাদশাহ কর্তৃক জগৎশেঠ অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংকার উপাধিতে ভূষিত হন। তুর্ক আফগান সামন্তদের বিদ্রোহের আশংকায় মুর্শিদ কুলিখান তার কৌশল পরিবর্তন করে বর্ণ হিন্দু রাজা মহারাজাদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে শুরু করেন এবং তাদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

নবাব মুসলিম মুদ্রা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ত্যাগে বাধ্য করেন। ডক্টর মোহর আলী লিখেছেন, একচেটিয়া মুদ্রা ব্যবসা ও সরকারী টাকশালে বিদেশী বণিকদের স্বর্ণতাল ও মুদ্রা তৈরীর একচ্ছত্র ক্ষমতা শুধু জগৎশেঠকে প্রদান করা হয়। মুর্শিদকুলি খানের উড়িষ্যার নায়েব সুবাদার সুজাউদ্দিন ছিলেন ভোগ বিলাসী চরিত্রহীন। অপূত্রক নবাব তার নাতি অর্থাৎ সুজাউদ্দিনের পুত্রকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং দিল্লীস্থ তার প্রতিনিধি বালকিষানকে বাদশাহর স্বীকৃতি আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। শুরু হয় ষড়যন্ত্র নাটক। নবাবের আস্থাভাজন জগৎশেঠ ফতেহ চাঁদ নবাবের ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে অতি গোপনে সুজাউদ্দিনকে প্ররোচিত করেন এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ ও সমর্থন দিয়ে সুজাউদ্দিনের প্রত্যাশা ও অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। এমনকি পরবর্তীতে নবাব হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ব্যাপারে দিল্লীর দরবারকে প্রভাবিত করেন। নবাব মুর্শিদকুলির নিজের প্রতিনিধি বালকিষান বাবু তার উত্তরাধিকারী মনোনয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব গোপন রেখে তার প্রেরিত নজরানা উপঢৌকন ব্যবহার করেই সুজাউদ্দিনের পক্ষে দিল্লীর দরবারে তদবীর করেন এবং মুর্শিদ কুলীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুজা উদ্দিনের নামে পরবর্তী নবাবীর সনদ সংগ্রহ করেন। [তারিখে বাংলা পৃঃ ১২৪, উদ্ধৃতি মোহর আলী : হিষ্ট্রি অব দি মুসলিম অব বেঙ্গল]

মুর্শিদকুলী খানের শয্যা পাশে বসে জগৎশেঠ সুজাউদ্দিনকে মুর্শিদাবাদ আক্রমনের সংকেত পাঠান। সুজাউদ্দিনের সৈন্যরা মুর্শিদাবাদ অবরোধ করে। নবাব পত্মীও তার কন্যা সুজাউদ্দিনের স্ত্রীর হস্তক্ষেপে মনোনীত নবাব সরফরাজ খান পিতা সুজাউদ্দিনকে নবাব হিসেবে মেনে নেন। সুজাউদ্দিন জগৎ শেঠকে তার অতি বিশ্বস্ত এবং ঘনিস্টজন হিসেবে গণ্য করেন এবং ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রশাসনিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
১৭২৭ সালে বিশ্বাসঘাতকতার সাফল্য জগৎশেঠ এবং তার সহযোগীদের অতি উৎসাহী করে তুলে। মুসলিম শাসনকে দুর্বল করে তোলা এবং বৈষয়িক ফায়দা অর্জনের জন্য ব্রাহ্মণ্য চক্র আর এক নতুন খেলা শুরু করলেন মুর্শিদাবাদের নবাবী নিয়ে। জগৎশেঠ আলম চাঁদ বাবুকে নিয়ে হাজী আহমদ ও আলীবর্দী খানের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এদের লক্ষ্য ছিল আলীবর্দী খানকে মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা আলীবর্দীর প্রতি দুর্বলতার কারণে নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুসংহত মুসলিম শক্তিকে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আত্মবিনাশের দিকে ধাবিত করানো এবং সংঘর্ষ, যড়যন্ত্র ও যুদ্ধের ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ হাতিয়ে নেয়া।

যাইহোক মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিনের যখন মৃত্যু হল সে সময় নাদির শাহ দিল্লী দখল করে নেয় এবং সুবাহ বাংলার আনুগত্য ও রাজস্ব দাবী করে। নাদির শাহ  মুর্শিদাবাদের নবাবের নিকট চিঠি লেখেন। নাদির শাহের পত্র পাওয়া মাত্র সরফরাজ খানের অনুমতি নিয়ে ব্যাঙ্কার জগৎশেঠ তাৎক্ষণিকভাবে রাজস্ব পরিশোধ করে দেন। কুচক্রী জগৎশেঠ এবং বাবু আলম চাঁদের পরামর্শে সুজাউদ্দিন অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশের জন্য নাদির শাহের নামে খুতবা পাঠ করেন এবং মুদ্রা প্রচলন করেন। এটাও ছিল জগৎশেঠ গংদের ষড়যন্ত্র। ওদিকে কয়েক মাসের মধ্যে নাদির শাহ দিল্লী ত্যাগ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে মুহাম্মদ শাহ তার সিংহাসনে পুনরারোহণ করেন। এই সুযোগে দিল্লীর আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশায় জগত শেঠ গোপনে তথ্য প্রমাণ সরবরাহ করে দিল্লীর দরবারকে জানিয়ে দেন যে সরফরাজ খান বিদ্রোহী।

(তারিখে বাংলাহ পৃঃ ১৫৫-৫৬)। ব্রাহ্মণ্য চক্র এখানেই থেমে থাকল না। সরফরাজ খানের বদলে আলীবর্দী খানকে বাংলার সুবাদার করার ব্যাপারে দিল্লীর দরবারকে প্রভাবিত করলো। অবশেষে তারা আলীবর্দীর নামে সনদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন। এই বাবু গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের পরামর্শে সরফরাজ খান তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক হ্রাস করলেন। ওদিকে ব্যাংকার জগত শেঠ ২৫ লক্ষ টাকা অর্থাৎ বর্তমান মুদ্রামানে ৫ শত কোটি টাকা আলীবর্দী খানের নিকট প্রেরণ করেন সুজার বরখাস্তকৃত সৈন্যদের তার সেনা বাহিনীতে নিয়োগ দেয়ার জন্য। অন্যদিকে বিহারের হিন্দু জমিদারদের আলীবর্দী খানকে নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দানের জন্য প্ররোচিত করেন। আলীবর্দী খানের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে জগৎশেঠ তাকে মুর্শিদাবাদ আক্রমণের আহ্বান জানায়।

সামরিক গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ তেলিয়াগিরি অতিক্রম করে আলীবর্দী খানের বাহিনী মুর্শিদাবাদের ২২ মাইল দুরত্বে অবস্থান নেয়। নবাব সরফরাজ খান আকস্মিক অবরোধে কিছুটা বিচলিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। এই অবরোধে তার আমাত্যবর্গের যোগসাজশ সম্পর্কে তার ধারণা বদ্ধমূল হয়। তার সন্দেহ বহুলাংশ সঠিক হলেও পঞ্চমবাহিনীর মূল হোতাকে তিনি চিনতে ভুল করলেন। জগৎশেঠের বদলে তিনি হাজী আহমদকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কারারুদ্ধ করলেন। পঞ্চম বাহিনীর দুই হোতা বাবু আলম চাঁদ ও জগৎশেঠের সাথে সরফরাজ খানের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়ে উঠল। এই দুই কুচক্রী পরামর্শক হিসেবে সরফরাজ খানের যুদ্ধ যাত্রার সঙ্গী হলেন। প্রথম দিনের যুদ্ধে আলীবর্দী খানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে উঠল।

নিশ্চিত পরাজয় থেকে বাবু আলম চাঁদ আলীবর্দী খানকে উদ্ধার করলেন সরফরাজ খানকে যুদ্ধ মুলতবী ঘোষণার পরামর্শ দিয়ে। যুদ্ধের মোড় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাবু আলম চাঁদ এবং জগৎশেঠ বিভিন্নভাবে যোগসাজশ সলাপরামর্শ করে এবং সরফরাজ খানের সেনাপতিদেরকে মুচলেকা অর্থ বিত্তের বিনিময়ে পক্ষ ত্যাগে প্রলুব্ধ করলেন। পরদিন পূর্বাহ্নের যুদ্ধে সরফরাজ খানের বিজয় নিশ্চিত হয়ে উঠলে বাবু আলম চাঁদ তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে মনে করে আত্মহত্যা করলেন। ষড়যন্ত্রের মূলনায়ক জগৎশেঠ ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন শেষ অবধি। এমতবস্থায় জগৎশেঠ তার নেপথ্য ষড়যন্ত্র আরো জোরদার করলেন। দুপুরের পর যুদ্ধ পরিস্থিতি বদলে গেল। অবশেষে সরফরাজ খান নিহত হলেন। জগৎশেঠ সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বিজয়ী আলীবর্দী খানকে রাজধানীর অভিমুখে নিয়ে চললেন। বিশ্বাসঘাতকদের রক্তাক্ত আঙ্গিনা পেরিয়ে আলীবর্দী খান ক্ষমতাসীন হলেন। সম্ভবত সেদিনই সবার অলক্ষ্যে আর এক মর্মান্তিক বিপর্যয়ের ইতিহাস নিয়তির অদৃশ্য কাগজে লেখা হয়েছিল, লেখা হয়েছিল আলীবর্দীর বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে।

এরপর জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদের দরবারে সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। মুসলমানদের চূড়ান্ত বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য জগৎশেঠ নতুন প্রেরণায় নবতর চক্রান্ত জাল বিস্তারের জন্য উন্মাতাল হয়ে উঠেন। ১৭৪০ সালে আলীবর্দী খান নবাব হলেন ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার ক্ষমতারোহনের ৩৩ বছর আগে থেকে উত্তর-মধ্য পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত ছিল অস্থির। ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলছিল সাফল্যের দিকে। হুমায়ুন ও আকবরের সময় থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের ঘাটিতে পরিণত হয়েছিল মুঘল প্রাসাদ। মুঘল হেরেমে রাজপুত বালাদের স্থান লাভের পর থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি মুঘল প্রাসাদকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়। শরাব সাকী নৃত্য গীত বিলাসিতা ও আলস্যে বিবস হয়ে পড়ে সংগ্রামী বাবরের বংশধররা। তাদের ঔদাসীন্যের কারণে ব্রাহ্মণ্য ষড়যন্ত্র পোক্ত হয়ে উঠে। সম্রাট আরঙ্গজেব চলমান ধারা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেও তার সময় থেকেই শুরু হয় ব্রাহ্মণ্য বাদীদের মুসলিম বিরোধী তৎপরতা।

 আওরঙ্গজেব তাদের অপতৎপরতা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তী মুঘল উত্তরাধিকারীরা বর্ণ হিন্দু, রাজপুত জাঠ মারাঠা এবং শিখদের সুসংবদ্ধ অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। উপমহাদেশের বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞের মত মুসলিম নিধন শুরু হয়। লুণ্ঠন ও হত্যার নৃশ্বংসতা মুসলিম জনপদগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। মুঘল ও মুঘলাই সংস্কৃতির ধারকদের নেশাগ্রস্ত অন্তরে মুসলিম জনপদগুলোর মাতম কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। তারা ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে উম্মাতাল এবং আত্মঘাতি তৎপরতায় লিপ্ত। কিন্তু তখন সুবাহ বাংলার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকম, এখানে প্রশাসন ছিল মিশ্র। নামে মুসলমানদের হাতে নবাবী থাকলেও সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য ছিল হিন্দুদের। মুঘলাই সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী বাংলার মুসলিম আমীর ওমরাহ ও উচ্চ শ্রেণী যাবতীয় নৈতিকতা ও সততা বিসর্জন দিয়ে ভ্রাতৃঘাতী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তবে বাংলার জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান থাকার কারণে এবং বাংলার কোন বিশেষ অঞ্চল বর্ণ হিন্দুদের শাসনাধীনে না থাকায় বর্ণবাদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে অথবা নেয়াতে সক্ষম হয়নি।

 এ সত্ত্বেও বাংলার বর্ণ হিন্দুরা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মুসলিম বিরোধী ভূমিকায় পিছিয়ে ছিল না। তারা প্রকাশ্য যুদ্ধ না করলেও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে মুসলমানদের চূড়ান্ত ক্ষতিসাধনে তৎপর ছিল। সমস্ত মুসলিম বিরোধী তৎপরতার মূল নায়ক ছিলেন জগৎশেঠ। একদিকে যেমন আলীবর্দী খানের উপর ছিল তার প্রভাব অন্যদিকে মুদ্রা ভাংগানী ব্যবসার সূত্রে ইংরেজদের সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা। আলীবর্দী খানের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সহযোগী হওয়ার কারণে ঘষেটি বেগমের বিশ্বস্ত প্রাদেশিক দেওয়ান রাজ বল্লভ এবং বিহারে নিযুক্ত প্রথম গভর্নর জানকী রাম ও পরবর্তী গভর্নর রামনারায়ণের সাথে নবাবের দিওয়ান চিনুরায় বাবু বীরু দত্ত, আলম চাঁদের পুত্র বারারায়ান করাত চাঁদ ও উমিচাঁদের সহযোগিতায় রাজস্বের জামিন ব্যাংকার হিসেবে সারা বাংলার জমিদারদের সাথে ছিল স্বরূপ চাঁদ জগৎশেঠের নিয়মিত যোগাযোগ।

সেনাবাহিনীর প্রধান প্রভাবশালী সৈন্যাধক্ষ, রায় দুর্লভ, রাম বাবু, মানিক চাঁদ, রাজা নন্দ কুমার, মোহন লাল প্রমুখও ছিলেন তার আপন জন। যেসব হিন্দু বেনিয়া মালামাল সরবরাহ করত সেই সব প্রতিষ্ঠিত বণিকদের সাথেও জগৎশেঠের ভাল সম্পর্ক ছিল। এই কারণে জগৎশেঠ মধ্যমনি হয়ে ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করতে অতি সহজে সক্ষম হন।
বর্গী হামলা প্রতিহত করার নামে বর্ধমানের মহারাজার সাথে মিলে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদের নবাবের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। অবশ্য ধরা পড়ে বর্তমান মুদ্রামানে দু হাজার কোটি টাকা নবাবকে ফেরত দিতে বাধ্য হন। পক্ষান্তরে বর্গী হামলার হাত থেকে রক্ষার নামে ইংরেজদের সাথে ব্যবসারত বর্ণ হিন্দু বণিকদের চাঁদার টাকায় কোলকাতা নগরীকে ঘিরে মারাঠা রক্ষা প্রাচীর ও পরিখা গড়ে তুলে সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার বিত্তশালী বর্ণ হিন্দু ব্যক্তিদেরকে এমনভাবে জমায়েত করা হয় যে ১৬৯০সালে প্রতিষ্ঠিত কোলকাতার জনসংখ্যা ১৭৫৭ সালের আগেই হয়ে দাঁড়ায় লক্ষাধিক এবং এই জনসংখ্যার এক শতাংশও মুসলমান ছিল না। এর ফলে কোলকাতা কুচক্রীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো।

সহায়ক গ্রন্থ
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867
দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।

Wednesday, 22 June 2016

পর্ব এক। ঐতিহাসিক পলাশীর ষড়যন্ত্র এখনও চলছে । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।

বর্তমানেও বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা ষড়যন্ত্র করছে বাংলাদেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র বানানোর জন্য


সূফি বরষণ

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য-বিপর্যয় এবং ১৭৬৪ সালে বখশারে মীর কাসিমের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। এটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। আজ থেকে ২৫৯ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এই দিনে এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে। সেই দিন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব তরুণ সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়। এমন বেদনাবহ স্মৃতিকে স্মরণ করে  মীরজাফর, ঘষেটি বেগমের প্রেতাত্মাদের রুখে দেয়ার দৃপ্ত শপথ নিতে হবে। কারণ বর্তমানেও বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণরা ষড়যন্ত্র করছে বাংলাদেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতের নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র বানানোর জন্য ।

স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতা চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক এক বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে। ফলে অতি অল্প সময়ের লুণ্ঠন-শোষণে বিপর্যস্ত হয় অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ অরাজকতা ও বিপর্যয়। বিশেষ করে ভারতের পুরাতন শাসক মুসলমানরা যাতে আর কখনো মাথা তুলতে না পারে সেজন্য সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করা হয়। তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় তাঁর পলাশীর যুদ্ধ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘পলাশীর যুদ্ধকে একটা যুদ্ধের মতন যুদ্ধ বলে কেউ স্বীকার করেন না।...কিন্তু সেই যুদ্ধের ফলেই আস্তে আস্তে একমুঠো কারবারি লোক গজকাঠির বদলে রাজদণ্ড হাতে ধরলেন। প্রথম থেকেই তাঁরা রাজত্ব করলেন না বটে, কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ালেন।’ ১৭৫৭-এর পলাশীর ষড়যন্ত্রেও এ সমাজের ইতিহাস-চেতনার দীনতা সুস্পষ্ট।

ভাগীরথী তীরে নবাবের পতন, কোম্পানি আমলের উত্থান সম্পর্কে আইরিশ-ইংরেজ গল্পকার ও ইতিহাসবিদ মার্ক বেন্স জোনস তাঁর ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া থেকে ট্রান্সক্রিয়েটেড গ্রন্থে বলেন, "মীর জাফর নবাবকে নানা কাজে ব্যতিব্যস্ত রাখার কথা বলেছিল। বিশেষ করে নবাবকে সে এমন সব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য করে, যা তখন জরুরি ছিল না। এতে করে ইংরেজ বাহিনী কতটা এগিয়ে যায়, সে ব্যাপারে অনেকটা অজ্ঞাত থেকে যান নবাব। বিশেষ করে নবাবের এই অসতর্ক অবস্থার সুযোগ নিতে চাইলেন ক্লাইভ। তিনি সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীকে নদী পার করে আমবাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে এ সময় ক্লাইভের সঙ্গে কুটের দ্বন্দ্ব ইংরেজ বাহিনীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা যায়। বর্ষীয়ান হিসেবে কুট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন,..... ইংরেজদের পক্ষ থেকে সবাই চাইছিল যেভাবেই হোক দুজনের মিলিত শক্তি তাদের কাজে লাগুক"।

আসকার ইবনে শাইখ লিখেছেন- নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে (১৭৪০-৫৬) ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভকে হিসাবপত্র নিরীক্ষণের জন্য কাগজপত্রসহ মুর্শিদাবাদ তলব করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তহবিল তসরুফের প্রামাণ্য অভিযোগ ছিল। কিন্তু হিসাব পরীক্ষার পূর্বেই তিনি কাশিম বাজারে কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের নিকট তাঁর পুত্র ও পরিজনের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণ দাস বা কৃষ্ণবল্লভ ৫৩,০০০০০ টাকা মূল্যের নগদ অর্থ ও সোনা রূপাসহ কলকাতায় আশ্রিত হন। এই কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যার্পণের জন্য নবাব দরবার হতে বার বার নির্দেশ ও তাগিদ দেয়া সত্বেও কোম্পানীর গভর্নর রজার ড্রেক তা পালন করতে অস্বীকার করেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৭৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। নবাবের নিষেধ সত্বেও ইংরেজরা তাদের ফোর্ট উইলিয়াম (কলকাতায়) দুর্গটিকে সামরিক সাজে সজ্জিত করে তুলতে শুরু করে। বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী এ দুটি ঘটনার ‘প্রতিকার করে যেতে পারেননি।

নবাবী লাভ করেই সিরাজউদ্দৌলা কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যার্পণ করতে গভর্নর ড্রেককে এবং দুর্গ দেয়াল ভেঙ্গে পরিখা বন্ধ করে দিতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণ সিংহ নামক একজন বিশ্বস্ত দূতকে ইংরেজদের মনোভাব যাচাই করার জন্য কলকাতা পাঠালেন। কিন্তু ইংরেজরা নারায়ণ সিংহকে অপমান করে কলকাতা হতে তাড়িয়ে দেয়। নবাব আবার অন্যতম ব্যাংক ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজিদকে একই উদ্দেশ্যে কলকাতা পাঠান। পরপর চার বার তিনি কলকাতা যান, কিন্তু ইংরেজরা তার সঙ্গেও সংযত আচরণ বা আপোষমূলক মনোভাব প্রদর্শন কোনটিই করেনি।

এভাবে নবাবের আন্তরিক সদিচ্ছা ব্যর্থ হবার ফলে তিনি দুর্লভরাম ও হুকুম বেগকে কাশিম বাজার কুঠি অবরোধের নির্দেশ দিলেন। মির মোহাম্মদ জো খান হুগলীতে জাহাজ নির্গমনের পথ রোধ করলেন এবং নবাবের উপস্থিতিতে কাশিম বাজারের পতন ঘটল। কুঠি প্রধান ওয়াট্স্ এবং কলেটকে সঙ্গে নিয়ে নবাব কলকাতার দিকে অগ্রসর হলেন। কাশিম বাজার অবরোধ ও পতনের মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে ইংরেজদের উপর চাপ সৃষ্টি করাই নবাবের উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তী ঘটনায় তার প্রমাণ মিলে। খাজা ওয়াজিদের মিশন ব্যর্থ হবার পর উর্মিচাঁদ ও শ্রীবাবু নামক জনৈক ব্যবসায়ী সমঝোতার প্রস্তাব দেন। মীমাংসায় আসার জন্য নবাবের নিকট একজন দূত পাঠাতে ড্রেককে অনুরোধ করে পত্র লেখেন উইলিয়াম ওয়াটস্ ও কলেট।

 এ পত্র পাঠান হয় ওলন্দাজ এজেন্ট বিসডোমের মাধ্যমে। ড্রেক তাও রক্ষা করেননি। অবশেষে ফরাসী দেশীয় ম্যাকুইস দ্যা সেন্ট জ্যাকুইস এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানো হয় কোলকাতায়। উত্তরে উদ্যত রজার ড্রেক প্রস্তাবকারীকে পক্ষ পরিবর্তনের উপদেশ দেন।
সুতরাং অনিবার্য হয়ে উঠল সংঘাত। ১৭৫৬ সালে ১৩ই জুন নবাব ফোর্ট উইলিয়মে পৌঁছান এবং যথারীতি কোলকাতা অবরুদ্ধ হয় ১৯ জুন। নাটকের উদ্ধৃত অহংকারী নায়ক রজার ড্রেক সঙ্গী মিনকিন, ম্যাকেট ও গ্রান্টসহ সগৌরবে পিছন দিকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সংগে সংগে ইংরেজ শিবিরে পলায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এক ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজদের সকল জাহাজ পলাতকদের নিয়ে ভাটির পথে পাড়ি জমায়...। ... ড্রেক ও অন্যান্যদের পলায়নের পর ফোর্ট উইলিয়ামের মাত্র আটজন যুদ্ধ পরিষদের সদস্য অবশিষ্ট রইল। তাদের মধ্যে হলওয়েল রজার ড্রেকের স্থলবর্তী গভর্নর নিয়োজিত হলেন। হলওয়েল পলায়নের কোন নৌকার অভাবেই কলকাতায় থেকে যেতে বাধ্য হন এবং তিনিই পরবর্তীকালে তথাকথিত কাল্পনিক অন্ধকুপ হত্যার গল্প কাহিনীর জন্ম দান করেন। হলওয়েল গভর্নর হয়ে এক দুপুর টিকে ছিলেন; তার পর আত্মসমর্পন ভিন্ন কিছুই আর তাঁর করবার রইল না। ২০ জুন বিকেল চারটায় কলকাতার পতন ঘটে।

১৭ জুলাই বন্দীদের নবাবের সামনে হাজির করা হয়। অন্যদিকে কাশিমবাজার ও কলকাতার পতন সংবাদ পর পর মাদ্রাজ পৌঁছে। ফলে প্রথমে মেজর কিলপেট্রিক-এর নেতৃত্বে দুটি জাহাজ এবং পরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে- প্রচুর সৈন্য, গোলাবারুদ ও সাজ-সরঞ্জামসহ বারটি জাহাজ পাঠান হয় বাংলায়। এই অভিযানের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়; ক. নবাবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কোম্পানীর ইচ্ছানুরূপ ক্ষমতা পরিবর্তন।

খ. কোম্পানীর প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসীদের চন্দন নগর হতে উৎখাত। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখিত মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের লিখিত পত্রে (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) ‘The sword should go hand in hand with the pen’ উপদেশের সঙ্গে সঙ্গে নবাবের বিরুদ্ধে যে কোন স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে এবং ফরাসীদের চন্দন নগর হতে বিতাড়নের নির্দেশও দেয়া হয়।

২৫ ডিসেম্বর ফুলতা পৌঁছেই ক্লাইভ ও ওয়াট্সন ‘কলমের সঙ্গে সঙ্গে তরবারির মহড়া শুরু করেন। ৩০ ডিসেম্বর তাঁরা বজবজ দখল করেন এবং ২ জানুয়ারী (১৭৫৭) কলকাতা পুনরুদ্ধার করে ড্রেক ও তাঁর কাউন্সিল সদস্যদের ফোর্ট উইলিয়ামে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই বিজয়ের গৌরবে ইংরেজেরা ৩ জানুযায়ী নবাব ও তাঁর দেশবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। হুগলী শহরটি ব্যাপকভাবে লুণ্ঠিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিনই নবাব তাঁর এক ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হুগলীর উত্তরে পৌঁছেন। ইংরেজরা ফিরে যায় কলকাতা। ফরাসী ও ওলন্দাজেরা নবাব ও ইংরেজদের বিবাদে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইংরেজেরা তাদের কাউকে বিশ্বাস না করে এবার খাজা ওয়াজিদের মাধ্যমে তাদের দাবীর কথা জানিয়ে দেয় ২২ জানুয়ারী। বলা হয়, কাশিমবাজার ও কলকাতা দখলের ক্ষতিপূরণ, ১৭১৭ সালের ফরমানানুযায়ী সকল সুবিধা, কলকাতায় সামরিক দুর্গ নির্মাণের অনুমতি এবং কোম্পানীর নিজস্ব মুদ্রা তৈরীর অধিকার দিতে হবে।

ডক্টর মোহর আলী লিখেছেন- দুই অপশক্তি অতি সন্তর্পণে এক অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলে। উভয় দলের উদ্দেশ্যের ভিন্নতা থাকা সত্বেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক। সেটা হলো সিরাজের পতন অনিবার্য করে তোলা। একটির উদ্দেশ্য ছিল শোষণ লুণ্ঠনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সাফল্যকে চূড়ান্ত করার জন্য ঔপনিবেশিক প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যটির উদ্দেশ্য ছিল সিরাজের পতন ঘটিয়ে মুসলমানদের বিনাশ করে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের একটা সহজ হিসেব ছিল মুসলমানরা ভারত বর্ষের যেখানেই প্রবেশ করেছে সেখানকার মাটি ও মানুষের সাথে একাকার হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের শিকড় অনেক গভীরে প্রথিত হয়ে যায়। এজন্য তাদের উৎখাত করা বর্ণ হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে তারা ভাবতে শুরু করল ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতায় মুসলমানদের পতন সম্ভব হলে কালক্রমে বৃটিশদের বিতাড়িত করা তাদের জন্য কঠিন হবে না। কেননা সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ভারতে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখা বৃটিশদের পক্ষে অসম্ভব হওয়াই স্বাভাবিক। উভয় পক্ষই তাদের আপাত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। প্রথম বর্ণবাদী হিন্দুচক্র এবং বৃটিশ বেনিয়া নিজেদের মধ্যে সখ্যতা বৃদ্ধির প্রয়াস নেয় এবং নিজেদের কৌশল সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করে। এই সাথে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে নবাবের চরিত্র হননের উদ্যোগ নেয়। সার্বিকভাবে নবাবের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে উভয় পক্ষ।

তৎকালীন বাংলার পরিস্থিতির উপর আলোচনা রাখতে গিয়ে প্রফেসর এমাজউদ্দিন লিখেছেন- তৎকালীন সামাজিক পরিবেশও ছিল ষড়যন্ত্রের উপযোগী। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড় বড় জায়গাতেই হিন্দু জমিদার ছিল প্রতিষ্ঠিত। প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়। বর্ধমানের রাজার পরই ধনে মানে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। বাংলার মহাজনদের মাথা জগৎশেঠদের বাড়ীর কর্তা মহাতাব চাঁদ। জগৎশেঠরা জৈন সম্প্রদায়ের লোক হলেও অনেকদিন ধরে বাংলায় পুরুষানুক্রমে থাকায় তাঁরা হিন্দু সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের পাণ্ডা হলেন রায় দুর্লভ রাম।... হুগলীতে রইলো নন্দকুমার।” জগৎশেঠ এবং উমিচাঁদের আশ্রিত ইয়ার লতিফ খাঁ আর একজন ষড়যন্ত্রকারী। সবার শীর্ষে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর এক বৈমাত্রেয় ভগ্নীর স্বামী মীর জাফর আলী খাঁ। নবাব হবার বাসনা তার অনেক দিনের। বর্গীয় হাঙ্গামার সময় আলীবর্দী খাঁকে হত্যা করিয়ে বাংলার নবাবী গ্রহণের আকাঙ্খা তাঁর ছিল। শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সিরাজউদ্দৌলা নবাব হলে জগৎশেঠ শওকত জঙ্গের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রের আর এক গ্রন্থি রচনা করেন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এবারে জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ খাঁ, উমিচাঁদের সহযোগী হিসেবে মাঠে নামেন। সিরাজের সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেনা নায়ক মোহন লাল এবং মীর মদন বা মীর মর্দান (২৩ জুনের পূর্বে বাংলার ‘মুক্তির চুক্তি’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে। অক্ষয় কুমার মৈত্রের রচিত মীর কাসিম গ্রন্থের ২২৩-২৪ পৃষ্ঠায় ১২ দফার এই চুক্তির বিবরণ রয়েছে। মীর জাফরের স্বাক্ষরে চুক্তিতে বলা হয় : ‘আমি আল্লাহর নামেও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তবলী মানিয়া চলিব।

আগে উল্লেখ করেছি ভারতের মারখাওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে কিভাবে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হচ্ছিল কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্যের দিকে সন্তর্পণে এগুচ্ছিল সেটা সমকালীন প্রতিষ্ঠিত শাসকরা আঁচ করতে পারেনি। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী কুচক্রীদের তোষামোদিতে সম্মোহিত হয়ে ছিল তারা। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতি সংক্রান্ত গভীর উপলব্ধি ছিল বৃটিশদের। ১৭৫৪ সালে জনৈক ইংরেজ স্কটের পত্র থেকে সেটা জানা যায়। হিন্দু জমিদারদের মনোভাব সম্পর্কে তিনি লিখেন- ‘হিন্দু রাজা ও জমিদাররা মুসলিম শাসকদের প্রতি সর্বদা হিংসাত্মক ও বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করেন। গোপনে তারা মুসলিম শাসনের হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে।’

একই সময় কোম্পানীর একজন মিলিটারী ইঞ্জিনিয়ার তার বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট একটি রিপোর্ট পেশ করেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন- ‘যদি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্যে সঠিকভাবে হিন্দুদের উৎসাহিত করতে পারে তবে হিন্দুরা অবশ্যই যোগ দিবে তাদের সাথে, উমি চাঁদ ও তাদের সহযোগী হিন্দুরাজা ও সৈন্য বাহিনীর উপর যাদের আধিপত্য কাজ করছে তাদেরও টানা যাবে এ ষড়যন্ত্রে।’ কে কে দত্তের আলীবর্দী এন্ড ‘হিজ টাইম’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- ‘১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংসহাসন চ্যুত করার ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলেছিল হিন্দু জমিদার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনী লেখক রাজীব লোচন লিখেছেন- ‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। [কে, কে. দত্ত. আলীবর্দী এন্ড হিজ টাইম, পৃঃ ১১৮]

পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ক্লাইভের সাথে বর্ধমান, দিনাজপুর ও নদীয়ার জমিদারদের পত্র যোগাযোগ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, অগ্রিম আনুগত্য প্রকাশ করে তারা ক্লাইভকে যুদ্ধযাত্রার দাওয়াত জানান [শিরীন আক্তার]। নদীয়া, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর, দিনাজপুর, বীরভূমের রাজা-মহারাজারা মুর্শিদাবাদ সমবেত হয়ে দেওয়ান-ই-সুবা মহারাজা মহেন্দ্রের কাছে অনেকগুলো দাবী পেশ করেন- তাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু দাবী মিটাতে নবাব অপারগ হলে জগৎ শেঠের পরামর্শে তারা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নেতৃত্বে-এক বৈঠকে মিলিত হয়ে সিরাজদ্দৌলাকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সভার পক্ষে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কোলকাতায় মিঃ ড্রেকের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আহবান জানান এবং সর্বমুখী সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন। (Ierrititial Aristocracy of Bangla the Naelia Raj : C.R. 1872 1.V., 107-110.) সুবে বাংলার কুলিন বর্ণহিন্দু রাজা-মহারাজারা আলাবর্দীকে দিয়ে নবাব সরফরাজকে উচ্ছেদ করে যেরূপ ফায়দা হাসিল করেন, নবাব আলীবর্দীর মৃত্যু মুহূর্তেও তেমনি দেওয়ান রাজবল্লভের নেতৃত্বে তাদের একদল সিরাজের বড় খালা ঘষেটি বেগমকে উস্কানি দিয়ে, সৈন্যে সাথে করে নিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণের জন্য নগরীর দ্বারপ্রান্তে হাজির করেন। সিরাজউদ্দৌলা তাঁর খালার মন জয় করে তার সমর্থন পেয়ে যাওয়ায় দিশেহারা দেওয়ান রাজবল্লভ নিজ পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে দিয়ে নবাবের ঢাকাস্থ যাবতীয় অর্থবৃত্ত সম্পদ-সম্ভার কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাচার করে দেন। অন্যদিকে সিরাজের খালাতো ভাই পুর্নিয়ার গভর্নর শওকত জংকেও শ্যামসুন্দর বাবুরাই উস্কানি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ করেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানিতে পারেন। তিনি মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির পদ হইতে অপসারিত করেন এবং আবদুল হাদী খানকে সে পদে নিয়োগ করেন। আবদুল হাদী ও মীর মদন মীর জাফরকে ধ্বংস করিবার জন্য নবাবকে পরামর্শ দেন। কিন্তু জগৎশেঠ ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক উপদেষ্টাগণ নবাবকে পরামর্শ দেন যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিবৃদ্ধির জন্য মীর জাফরের সহযোগিতা লাভ করা নবাবের পক্ষে সুবিবেচনার কাজ হইবে। নবাব তাহাদের উপদেশ গ্রহণ করেন। তিনি মীর জাফরের বাড়ীতে গিয়ে নবাব আলীবর্দীর নামে তাঁহার নিকট ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মর্মস্পশী আবেদন জানান। পবিত্র কুরআন হাতে লইয়া মীর জাফর এই সময় অঙ্গীকার করেন যে, তিনি নবাবের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন। (প্রফেসর আব্দুর রহিম)

সাময়িক পদচ্যুতির অপমানে মীর জাফর দারুণভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ ও ক্রোধান্ধ হয়ে উঠলেন। সিরাজের আশু পতন অনিবার্য করে তোলার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিলেন। মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার জন্য বার বার ক্লাইভের নিকট বার্তা প্রেরণ করে তাগাদা দিতে থাকেন। এমন মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতীক্ষায় ছিলেন ক্লাইভ। এই সুযোগে তিনি আরো অতিরিক্ত শর্ত যুক্ত করলেন। পরিণতির কথা না ভেবেই মীর জাফর সব দাবী অকপটে মেনে নিলেন। জগৎশেঠের প্রোথিত বিষাক্ত বীজ অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে পরিণত হল, অতঃপর মহীরুহে। ম্লেচ্ছ যবন মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে নব উত্থান সম্ভাবনায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা উদ্বেলিত হয়ে উঠল।

‘অতঃপর ষড়যন্ত্রকারীগণ জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, রাজবল্লভ এবং আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বৈঠকে যোগ দেন। ইংরাজ কোম্পানীর এজেন্ট ওয়াটস মহিলাদের মত পর্দা-ঘেরা পাল্কিতে জগৎশেঠের বাড়িতে আসেন। এই বৈঠকে সিরাজউদ্দৌলাকে সরাইয়া মীর জাফরকে বাংলার মসনদে বসাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওয়াটস এই কাজে ইংরেজদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ইহার পর কোম্পানীর প্রধানগণ চুক্তিপত্রের খসড়া প্রস্তুত করেন এবং ১৯মে ইহাতে দস্তখত করেন। মীর জাফরসহ ৪ জন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী ইংরাজদের সৈন্য সাহায্যের বিনিময়ে মীর জাফর তাহাদিগকে কয়েকটি বাণিজ্য-সুবিধা দিতে স্বীকার করেন। তাহা ছাড়া তিনি ইংরেজ সৈন্যদের ব্যয়ভার বহন করিতে এবং কোম্পানীকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দুই কোটি টাকা দিতে সম্মত হন। নবাবের কোষাগার হইতে উমিচাঁদকে ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হইবে বলিয়া বলা হয়। উমিচাঁদকে প্রতারিত করিবার জন্য ক্লাইভ চুক্তিপত্রের দুইটি খসড়া প্রস্তুত করেন। আসল খসড়ায় উমিচাঁদকে টাকা দেয়ার শর্তের উল্লেখ করা হয় নাই। নকল খসড়ায় এই শর্তটি লিখিত হয়। ইহার দস্তখতগুলি সবই ক্লাইভ জাল করিয়াছিলেন। রায়দুর্লভকেও লুটের মালের কিয়দংশ দেওয়া হইবে বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। (প্রফেসর আব্দুর রহিম)

৪ জুনের স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ :
“আমি আল্লাহর নামে ও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্রের শর্তাবলী মানিয়া চলিব।
ধারা-১     :নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে শান্তিচুক্তির যেসব ধারায় সম্মতি দান করিয়াছি, আমি সেসব ধারা মানিয়া চলিতে সম্মত হইলাম।
ধারা-২     :ইংরেজদের দুশমন আমারও দুশমন, তাহারা ভারতবাসী হোক অথবা ইউরোপীয়।
ধারা-৩     :জাতিসমূহের স্বর্গ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ফরাসীদের সকল সম্পত্তি এবং ফ্যাক্টরীগুলো ইংজেরদের দখলে থাকিবে এবং কখনো তাহাদিগকে (ফরাসীদেরকে) ওই তিনটি প্রদেশে আর কোন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করিতে দিব না।
ধারা-৪     :নবাব সিরাজ কর্তৃক কলিকাতা দখল ও লুণ্ঠনের ফলে ইংরেজ কোম্পানী যেসব ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছে তাহার বিবেচনায় এবং তন্নিমিত্ত মোতায়েনকৃত সেনাবাহিনীর জন্য ব্যয় নির্বাহ বাবদ আমি তাহাদিগকে এক ক্রোর তঙ্কা প্রদান করিব।
ধারা-৫     :কলিকাতার ইংরেজ অধিবাসীদের মালামাল লূণ্ঠনের জন্য আমি তাহাদিগকে পঞ্চাশ লক্ষ তঙ্কা প্রদান করিতে সম্মত হইলাম।
ধারা-৬     :কলিকাতার জেন্টু (হিন্দু), মূর (মুসলমান) এবং অন্যান্য অধিবাসীকে প্রদান করা হইবে বিশ লক্ষ তঙ্কা। (ইংরেজরা হিন্দুদেরকে জেন্টু’ এবং মুসলমানাদের ‘মূর’ ও ‘মেহোমেটান’ বলে চিহ্নিত করতো)
ধারা-৭     :কলিকাতার আর্মেনীয় অধিবাসীদের মালামাল লুণ্ঠনের জন্য তাহাদিগকে প্রদান করা হইবে সাত লক্ষ তঙ্কা। ইংরেজ, জেন্টু, মূর এবং কলিকাতার অন্যান্য অধিবাসীকে প্রদেয় তঙ্কার বিতরণভার ন্যস্ত রহিল এডমিরাল ওয়াটসন, কর্নেল ক্লাইভ, রজার ড্রেক, উইলিয়াম ওয়াটস, জেমস কিলপ্যাট্রিক এবং রিচার্ড বীচার মহোদয়গণের উপর। তাঁহারা নিজেদের বিবেচনায় যাহার যেমন প্রাপ্য তাহা প্রদান করিবেন।
ধারা-৮     :কলিকাতার বর্ডার বেষ্টনকারী মারাঠা ডিচের মধ্যে পড়িয়াছে কতিপয় জমিদারের কিছু জমি; ওই জমি ছাড়াও আমি মারাঠা ডিচের বাইরে ৬০০ গজ ইংরেজ কোম্পানীকে দান করিব।
ধারা-৯     :কল্পি পর্যন্ত কলিকাতার দক্ষিণস্থ সব জমি ইংরেজ কোম্পানীর জমিদারীর অধীনে থাকিবে এবং তাহাতে অবস্থিত যাবতীয় অফিসাদি কোম্পানীর আইনগত অধিকারে থাকিব।
ধারা-১০   : আমি যখনই কোম্পানীর সাহায্য দাবি করিব, তখনই তাহাদের বাহিনীর যাবতীয় খরচ বহনে বাধ্য থাকিব।
ধারা-১১   : হুগলীর সন্নিকটে গঙ্গা নদীর নিকটে আমি কোন নতুন দুর্গ নির্মাণ করিব না।
ধারা-১২   : তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হইবামাত্র আমি উপরিউক্ত সকল তঙ্কা বিশ্বস্তভাবে পরিশোধ করিব।

২৩ জুন ১৭৫৭ মীর জাফরের সাময়িক পদচ্যুতির মাত্র একমাসের ব্যবধানে সমাগত হল সিরাজের অন্তিম পর্ব। পলাশীতে সৈন্য সমাবেশ হল নবাব এবং ক্লাইভ উভয় পক্ষের। নবাবের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার, এর মধ্যে পদাতিক ৩৫ হাজার অশ্বারোহী ১৫ হাজার। ক্লাইভের পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার দেশী বিদেশী সম্মিলিত ভাবে।
২৩ জুনের পূর্বে বাংলার মুক্তি চুক্তি নামে ১২ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মীর জাফর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মধ্যে, তাতে মীরজাফরের পক্ষ থেকে বলা হয় : আমি আল্লাহর নামেও আল্লাহর রাসূলের নামে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমার জীবনকালে আমি এই চুক্তিপত্র মানিয়া চলিব।

এই মুক্তির চুক্তি মীর জাফর সত্যি আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করেছিলেন। প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে তিনি রনাঙ্গনে ছবির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়েছিল তার বাহিনী। তিনি প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাবের পতন উপভোগ করলেন প্রাণভরে। মুর্শিদাবাদের পতন হল। পুনরুদ্ধারের আশায় নবাব ছুটে চললেন বিহারে তার অনুগত বাহিনীর নিকট। তার আশা পূর্ণ হলো না। পথে গ্রেপ্তার হলেন। মীরজাফর তনয় মিরন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল। তার রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সমগ্র সুবাহ বাংলার স্বাধীনতা ১৯০ বছরের জন্য মহাকালের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সমগ্র জাতি শৃংখলিত হল ঔপনিবেশিক অক্টোপাসে। সে ইতিহাসও অতি মর্মান্তিক। ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সিরাজের পতনের মধ্যে তারা দেখতে পেল তাদের উত্থান সম্ভাবনা।

পলাশীর পরাজয় মুসলিম সমাজ-জীবনে যে সর্বমুখী বিপর্যয় ও অভিশাপ বয়ে আনে সে সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের বিশ্বস্ত মুখপাত্র ইউলিয়াম হান্টার ১৮৭২ সালে লিখেছেনঃ “তারা (মুসলমানরা) অভিযোগ করেছে যে, তাদের ধর্ম প্রচারকদের সম্মানজনক জীবন-যাপনের একটি রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ………….. আমরা এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্তার প্রবর্তন করেছি, যার ফলে তাদের গোটা সম্প্রদায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং তারা ভিক্ষাবৃত্তি ও অবমাননাকর জীবন যাপনের অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। …….. তাদের যে সমস্ত আইন অফিসার বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ধর্মীয় অনুমোদন দান করতেন এবং যারা স্মরণাতীতকাল থেকে ইসলামী পারিবারিক আইনের ব্যাখ্যা দান ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পালন করে এসেছেন, তাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে আমরা হাজার হাজার পরিবারকে শোচনীয় দুরবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছি।…… মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের উপায়গুলি থেকে বঞ্চিত করে আমরা তাদের আত্মার ওপর পীড়ন চালাচ্ছি।

অসদুদ্দেশ্যে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার করেছি এবং তাদের শিক্ষা তহবিলের বিরাট অংক আমরা আত্মসাৎ করেছি। তারা প্রচার করে থাকে যে, আমরা যারা মুসলিম সাম্রাজ্যের ভৃত্য হিসেবে বাংলার মাটিতে পা রাখবার জায়গা পেয়েছিলাম, তারাই বিজয়ের সময় কোনরূপ পরদুঃখ-কাতরতা দেখাইনি এবং গর্বোদ্ধত রূঢতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের সাবেক প্রভূদেরকে কর্দমে প্রোথিত করেছি। এক কথায়, ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারকে সহানুভূতিহীন, অনুদান ও নিকৃষ্ট তহবিল তসরূফকারী এবং দীর্ঘ এক শতাব্দিব্যাপী অন্যায়কারী হিসেবে অভিযুক্ত করে থাকে”। (ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১২৭, ১২৮)

পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলার মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ডক্টর ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন : “বস্তুত ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ে রাজক্ষমতা-চ্যুতি, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারির সংখ্যা হ্রাস, ১৮২৮ সালে বাজেয়াফত আইনে নিষ্কর ভূমির রায়তি স্বত্ব লোপ, ১৮৩৭ সালে ফারসির রাজভাষাচ্যুতি- পরপর এই চারটি বড় আঘাতে পূর্বের শাসকশ্রেণী নিঃস্ব-রিক্ত, নিরক্ষর, নিষ্ক্রিয়, নির্জীব জাতিতে পরিণত হয়। ইংরেজদের প্রশাসনিক আইন ও শিক্ষানীতির ফলেই এই রূপটি হয়েছে”। (ড. ওয়ালি আহমদ : উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার ধারা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১)

ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে শঠতা, প্রতারণা, ষড়যন্ত্রে ও বিভেদ-নীতির আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রের ভাগিদার হিন্দু শেঠ বেনিয়ারাও কখনো সে প্রতারণার শিকার হয়ে জব্দ হয়েছে। কিন্তু ইংরেজরা এই হিন্দু সম্প্রদায়কে তাদের নিরাপত্তার প্রধান সহায়ক বিবেচনা করে করে যেটুকু করুণা বর্ষণ করেছে, তার দ্বারা তাদের ঋণ শতকরা শত ভাগের বেশিই শোধ হয়েছে। বাংলার মুসলমানদের জন্য যা ছিল ইতিহাসের ভয়াবহতম বিপদ-বিপর্যয়, এই বর্ণহিন্দু শ্রেণীর জন্য তা ছিল প্রভূ পরিবর্তন এবং নব্য-প্রভুর কিঞ্চিত আশীর্বাদের জীবনের সকল দিক কানায় কানায় পূর্ণ ও পুষ্ট করার সুযোগ। সে কারণেই মুসলমানদের লাঞ্ছনার পটভূমিতে বঙ্কিম-গুরু ঈশ্বরগুপ্ত প্রমুখের কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হলো ইংরেজ-প্রভুর বিজয়-বন্দরা :

“ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়

মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়”।


সহায়ক গ্রন্থ
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮।
উইকিপিডিয়া।
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867
দুই পলাশী দুই মীর জাফর ।