Thursday 13 August 2015

পর্ব ছয় কউপমহাদের রাজনীতিতে রক্ত দেয়া নেয়ার খেলা চলছে এবং ভবিষ্যতেও কি চলবে ????জিন্নাহর যেভাবে মৃত্যু হয়॥

পর্ব ছয়    ক
উপমহাদের রাজনীতিতে রক্ত দেয়া নেয়ার খেলা চলছে এবং ভবিষ্যতেও কি চলবে ???? জিন্নাহর  যেভাবে মৃত্যু হয়॥

সূফি বরষণ
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জিন্নাহ সম্পর্কে আলোচনা শুধু করবো, কারণ সারাজীবন আমরা ভুল ইতিহাস জেনে এসেছি ॥
“অখ- ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।” ( বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃঃ ৩৬)। “এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই।  পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই শ্লোগান সকল জায়গায়।”
“২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা বোম্বে শহরে আহ্বান করলেন। অর্থের অভাবের জন্য আমি যেতে পারলাম না। জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ... কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডার কাছে তারা অর্থাৎ (মুসলিম লীগের অতিনমনীয় ফরোয়ার্ড ব্লক) টিকতে পারল না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।” ( বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পৃঃ ৬৩)। কায়দে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্পর্কে শেখ লেখেন, “এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” ( বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃঃ ৯৯)। জিন্নাহর মৃত্যুর পূর্বে বেলুচিস্তানের জিয়ারত শহরে তার ডাক্তারের নিকট দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন শুধু উর্দুর পক্ষে ঢাকাতে কথা বলা ভুল ছিল ॥
শেখ লেখেন, “১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মতো সমর্থন করছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় বরণ করতে হল কি জন্য? ... জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকেই কোটারি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছে। ... জিন্নাহকে পূর্ব বাংলার জনগণ ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত। ঘরে ঘরে জনসাধারণ তার নাম জানত। ... জিন্নাহ সাহেব শাসনতন্ত্র দিয়ে গেলে কোনো গোলমাল হওয়া বা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাব না থাকত কিনা সন্দেহ ছিল।” ( বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃঃ ১১৯)।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত বিভাগ প্রাথমিকভাবে চাননি—এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি জিন্নাহ, নেহরু তথা কংগ্রেস আর সর্দার বল্লভ প্যাটেলের নানামুখী স্বার্থচিন্তার সুযোগটাও খুব ভালোমতো নিয়েছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা জিন্নাহ সামনে এনেছিলেন যখন অন্য কংগ্রেসনেতারা মুসলমানদের সম-অধিকারের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতের কাঠামোর মধ্যে জিন্নাহর দাবিমতো স্বায়ত্তশাসন দিতে গড়িমসি করছিলেন।
নেহরু, প্যাটেল সবার মধ্যেই জিন্নাহকে অবজ্ঞা করার একটা প্রবণতা ছিল। জওহরলাল নেহরু জিন্নাহকে রাজনৈতিকভাবে ঈর্ষা করতেন। জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের একচ্ছত্র নেতা, কংগ্রেসে তখন নেহরু, মওলানা আজাদের যৌথ নেতৃত্ব। নেহরু দারুণ প্রজ্ঞাবান একজন রাজনীতিবিদ হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরোপুরি স্বাধীনতা তাঁর ছিল না। অপরদিকে জিন্নাহর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো নেতা মুসলিম লীগে ছিল না। এ ব্যাপারটি নিয়ে নেহরুর মনের গহিনে একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা কাজ করত। একবার মাউন্ট ব্যাটেনকে কথা প্রসঙ্গে জিন্নাহ সম্পর্কে নেহরু বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার বাতিকে পাওয়া মাঝারি গোছের একজন উকিল বই আর কিছু নন মি. জিন্নাহ।’ ভারতীয় রাজনীতিকদের এ রকম ব্যক্তিদ্বন্দ্ব দারুণ উপভোগ করতেন মাউন্ট ব্যাটেন। এ সময় মহাত্মা গান্ধী এই দ্বন্দ্ব নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। ভারতের দুর্ভাগ্য, গান্ধী কখনোই আপদমস্তক রাজনীতিক ছিলেন না।  ক্যাবিনেট মিশন প্লান প্রস্তাবের পর আর সেই কথা নেহেরু বলেই বসলেন জিন্নাহকে আমার সাথে প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা আমার চাপরাশিও বানাবো না???!!! এরপরই সব আলোচনা ভেসতে গিয়ে ভারত ভাগের দিকে এগিয়ে যায়॥ যার ফলে ১৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে শরণার্থী হয়॥ আর নিহত হয় ৫ মিলিয়ন মানুষ এবং ৮৩ হাজার নারী তাঁর ইজ্জত হারায় ॥

জিন্নাহর  দ্বিজাতিতত্ত্ব
এককালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন 'হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদুত', মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় কালে তিনিই হলেন সাম্প্রদায়িতক রাজনীতির প্রধান?। ইংরেজী ছাড়া যিনি কথা বলতেন না, সাহেবী পোশাক ছাড়তে চাইতেন না, খাদ্য-অখাদ্যের ব্যাপারে যার কোন বাছ-বিচার ছিল না। কোন্‌ মাসে রোজা তার খবর রাখতেন না, নিজে বিয়ে করেছিলেন পার্সী মহিলাকে, গুজরাটি শিয়া মুসলিম তিনিই হলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন তিনি মুসলমানদের অধিকার আদায়ের
করতে বদ্ধপরিকর, সেই সময়েই তিনি মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, পাণ্জাব ও বাংলার হিন্দুস্তান-পাকিস্তান তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। যুক্তি কি? যুক্তি খুব স্পষ্ট। 'আপনি বুঝতে পারছেন না কেন', মাউন্টব্যাটেনকে তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, 'পাণ্জাব হচ্ছে একটি জাতি। হিন্দু বা মুসলমান তো পরে, আগে আমরা পাণ্জাবী কিংবা বাংগালী'।
(ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক্‌ লাপিয়ের, 'মাউন্টব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশান অব ইন্ডিয়া', পৃস্ঠা ৪৩)। আজকে এটা পরিষ্কার বুঝা যায় সেই দিন যদি জিন্নাহ কৌশলে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে না রাখতেন তাহলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেতাম না ॥ বাংলাদেশের অবস্থা হায়দ্রাবাদ সিকিম আসাম কাশ্মির থেকে ভালো হওয়ার কোনো কথা ছিলনা ॥ সে আপনারা এই আলোচনার শুরুতেই পড়েছেন ॥ বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের কিছু উদ্ধৃতি থেকে ॥ জিন্নাহ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মুসলমানদের কে হিন্দুদের  হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন ॥ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পর্বে আসতেছে॥ ৪৭ এ  এসে দুইশত বছরের গোলামীর পর পূর্ব বাংলার অবস্থা কি ছিল আর ৭১ এ এসে পূর্বে পাকিস্তানের অবস্থা কি ছিল ॥ অপরদিকে জিন্নাহ
অসাম্প্রদায়িকও ছিলেন ॥
জিন্নাহ পাকিস্তান গনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই  ১৯৪৭সালের ১১ আগস্ট তিনি পাকিস্তানের গণ পরিষদে  ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানে কেউ আর আলাদা করে হিন্দু থাকবে না, মুসলমানও না, সবাই মিলে হবে এক জাতি। যে মুসলমানেরা ভারতে পড়ে রইলো তারা কোন জাতি--সে প্রশ্নেরও জবাব তিনি দেন নি।-----তিনি কর্তৃত্ত্ব ভালবাসতেন, যে জন্য তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গভর্ণর জেনারেল হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তার পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেলই হবেন সর্বে-সর্বা, প্রধানমন্ত্রী আজ্ঞাবহ (প্রাগুক্ত, পৃষঠা ৪৭)।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখলেন তার সেই ক্ষমতা থাকছে না। অসুস্থ হবার পর দেখলেন কোয়েটার এক পাহাড়ী অন্চলে তাঁকে ফেলে রাখা হয়েছে, কেউ খোঁজ নেয় না, টেলিগ্রাম পাঠালে ওষুধ আসে না। বুঝে ফেললেন, পাকিস্তান কি বস্তু!---মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। স্বাক্ষী তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে: কর্নেল ইলাহী বক্স। এখানে উল্লেখ যে জিন্নাহ পাকিস্তান ভারত থেকে আলাদা করছিলেন ঠিকই কিন্তু কংগ্রেস বা নেহেরু, গান্ধীজির মতো গণহত্যার মদত দাতা ছিলেন না তাই জিন্নাহকে যক্ষ্মা বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ক্ষয়রোগে মারা না গেলে তাঁর ভাগ্যও গান্ধীর মতো হতো। তিনি প্রাণ দিতেন মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে। কারণ, তিনি চাইছিলেন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও পাকিস্তান হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাঁর ভাষায় ‘রিলিজিয়ন শুড নট বি অ্যালাউড টু কাম ইনটু পলিটিকস’—ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত নয়।
দৈনিক সংবাদ, ২৯/১১/১৯৮৮
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

No comments:

Post a Comment