বিষাদ সিন্ধু
এক শ’ ত্রিশ বছরের পাঠ ও মূল্যায়ন
ড. আ শ রা ফ পি ন্টু
২৩ ডিসেম্বর ২০১৬,শুক্রবার, ০০:০০
‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস। শুধু কালজয়ীই নয়, বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় বা বহুলপঠিত উপন্যাসের মধ্যে এটি অগ্রগণ্য। আজ থেকে এক শত ত্রিশ বছরেরও অধিক সময় আগে উপন্যাসটি প্রকাশ হয়। তিনটি পর্বে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড (মহররম পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে, দ্বিতীয় খণ্ড (এজিদবধ পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এবং তৃতীয় খণ্ড (উদ্ধার পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশের এত বছর পরেও এখন পর্যন্ত বাঙালি পাঠকের কাছে গ্রন্থটি সাদরে গৃহীত হচ্ছে।
‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রকাশের পরপরই গ্রন্থটি নিয়ে পঠন-পাঠন, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অনেক। এখনো হচ্ছে এর মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন। গ্রন্থটি যেমন নন্দিত হয়েছে কারবালার ঐতিহাসিক ও মর্মন্তুদ ঘটনা অবতারণা এবং সৃষ্টিশীল গদ্য রচনার জন্য, তেমনি নিন্দিত হয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য অবমাননা ও অলৌকিক কাহিনীর অবতারণার দায়ে। এ দ্বিবিধ গুণ ও দোষের পরেও কেন ‘বিষাদসিন্ধু’ এখনো জনপ্রিয়Ñ সেটাই বিচার্য বিষয়।
‘বিষাদ সিন্ধু’ (প্রথম খণ্ড) প্রকাশের পরপরই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-এর ১২৯২ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় এর যে আলোচনা লেখা হয় তার কিয়দংশের উদ্ধৃতি : ‘মুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গভাষার অল্পই অনূবাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। এই সকল গ্রন্থ যে বঙ্গভাষার বিস্তৃতির আর একটি নতুন পথ এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি মুসলমানদিগের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতেছে, ইহা চিন্তাশীল পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন।’
মশাররফের যুগে কিংবা তার প্রাক্কালে মুসলমানেরা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল। তারা বাংলা ভাষা পঠন-পাঠন থেকে বিরত থাকত, কেউ কেউ বাংলাকে নিজ ভাষা (মাতৃভাষা) বলতেও নারাজ ছিলেন। এর প্রমাণ আমরা মধ্যযুগে কবি আব্দুল হাকিমের কবিতায়ও দেখতে পাই। ধর্মীয় ভাষা আরবি ও এককালের রাজভাষা ফারসির প্রতি ছিল এদের অনুরাগ। এমনকি মীর সাহেবের বাবাও বাংলা জানতেন না; তিনি ফারসিতে দস্তখত করতেন। আর এ কারণেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মীর মশাররফ হোসেনকে সাধুবাদ জানিয়েছে শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’রচনার জন্য। এরপর ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ জ্যৈষ্ঠ-এর ‘চারুবার্ত্তা’য় প্রকাশিত আলোচনাটিতেও এমন সাধুবাদ জানানো হয়েছে বিশুদ্ধ বাংলায় ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনার জন্য। এ পত্রিকা মীর মশাররফ সম্পর্কে লিখেছে : ‘ইতিপূর্বে ইহার প্রণীত আরো কয়েকখানি গ্রন্থ আমরা দেখিয়াছি, ইনি যে রূপ বিশুদ্ধ ও সুমধুর বাঙ্গালা লিখিতে পারেন, অনেক শিক্ষিত হিন্দুও তেমন লিখিতে পারে না।’
১২৯৫ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় “ভারতী’ পত্রিকায় ‘বিষাদসিন্ধু’-এর দ্বিতীয় খণ্ড (উদ্ধার পর্ব) সম্পর্কে মন্তব্য : ‘প্রথম খণ্ডের মতো দ্বিতীয় খণ্ডও উপন্যাসের মতো লিখিত, সুতরাং বড়ই সুখপাঠ্য। তবে প্রথম খণ্ডের ভাষা দ্বিতীয় খণ্ড অপেক্ষাও বিশুদ্ধ।”
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল লাইব্রেরির বার্ষিক রিপোর্টে গ্রন্থাগারিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বিষাদসিন্ধু’ (উদ্ধার পর্ব) সম্পর্কে লেখেন ÔMir Masharruf Hossain’s Bishad Sindhu, basedon the events before and after great battle of Karbala, on of the best works, in the Bengali language. The earnestness and pathos of the work, its elevated moral tone and dignified diction, raise it to high level and mark adistnct departure, both in matter and in manner, from the current examples of imaginative writing of BengaliÕ. .
মশাররফের সময়ে মুসলমান বাঙালি লেখকদের মধ্যে পুঁথিসাহিত্যে প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব পুঁথিসাহিত্যে ছিল মধ্যযুগীয় অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অলৌকিকতা। ‘বিষাদ সিন্ধু’-তে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি পুঁথিসাহিত্যের প্রভাবও লক্ষণীয়। অনেকের ধারণা, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ‘জঙ্গনামা’ ও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধু ভাষার রূপান্তর মাত্র। এ প্রসঙ্গে কাজী আব্দুল ওদুদ তাঁর ‘শাশ্বতবঙ্গ’ (১৯৫১) গ্রন্থে বলেছেন, “পুঁথিসাহিত্যের লেখকদের সঙ্গে ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখকের বড় মিল হয়তো এখানে যে, দৈব-বলের অদ্ভুত তত্ত্বে বিশ্বাস তাঁরও ভেতর প্রবল দেখা যাচ্ছে। দৈব-বলে বিশ্বাস মাত্রই সাহিত্যে বা জীবনে দোষার্হ্য নয়, কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন যোগ ঘটে অজ্ঞানের ও ভয়-বিহ্বলতার; তখন তা হয়ে ওঠে জীবনে জন্য অভিশাপ।... জীবন, ধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর ধারণা যে অগভীর তা নয়। আজরের মুখ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ধার্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক।’ মানবজীবনের জটিলতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও যথেষ্ট।’
ইতিহাসে আছে; ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে এজিদের যে বিরোধ তা মূলত সিংহাসনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মশাররফ ‘বিষাদ সিন্ধু’তে এই রাজনৈতিক বিরোধ অপেক্ষা ইমাম হাসানের স্ত্রী জয়নবের প্রতি এজিদের রূপজ মোহকেই মূল উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গতি রক্ষার চেয়ে সাহিত্যে রস পরিবেশনের তাগিদে লেখক কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কেননা ধর্মীয় ইতিহাস নয়, সাহিত্য সৃষ্টিই ছিল লেখকের মূল উদ্দেশ্য। কবি কায়কোবাদ মীরের হাতে কারবালার কাহিনীর ধর্ম-দর্শনের বিপর্যয় লক্ষ করে দুঃখিত হয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ধর্মীয় চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘মহররম শরীফ’ নামে একটি কাব্যও রচনা করেছেন। কিন্তু শিল্পগুণে তা উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরীর ‘মীরমানস’ (১৯৬৫) গ্রন্থের উক্তিটি স্মর্তব্য, “মীর মশাররফ হোসেনের মানবপ্রীতি ও শিল্পবোধ ‘বিষাদ সিন্ধু’র ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে গুরুতররূপে ব্যাহত করেছে।... মাইকেল-বঙ্কিমের জীবনোপলব্ধির উত্তরাধিকারী মীরের হাতে এমনি করেই পুরাতন নীতিধর্মের পরাভব ও শিল্পের বৈজয়ন্তী লাভ ঘটে।’’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর একটি চিঠিতে কারবালার কাহিনীর মহাকাব্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করেছিলেন। মুহম্মদ আব্দুল হাই ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৬) গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘বাংলা সাহিত্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’ অভিনব সৃষ্টিÑ একাধারে ইতিহাস আশ্রিত রোমান্টিক উপন্যাস ও গদ্য মহাকাব্য।’’ যদিও মীর সাহেব মহাকাব্য রচনা করেননি, ‘তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে ‘বিষাদ সিন্ধু’র পরিকল্পনায় দৈনন্দিন তুচ্ছতার অতীত মহাকাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়। সমকালীন মুসলিম সাহিত্য প্রয়াসের প্রবণতা ও শৈলী বিচারে মশাররফ হোসেনের এই কৃতী নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণের দাবি রাখে’’ (কথা ও কবিতা : আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ১৯৮২)।
‘মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য রচনা’ (১৯৭৫) শীর্ষক অভিসন্দর্ভের গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালও ‘বিষাদ সিন্ধু’কে গদ্য মহাকাব্য বলে অভিহিত করেছেন।
তার ভাষায়, ‘‘এতে রয়েছে মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিকা। এটি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষের কাহিনী নয়Ñ এ হচ্ছে প্রভুত্ব নিয়ে দুই নৃপতির মধ্যে সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত ছিল বহু লোকের জীবন, বহু লোকের ভাগ্য। এ গ্রন্থে প্রায় শ’খানেক পাত্র-পাত্রী আছে; এর মধ্যে রয়েছে অনেক কাহিনী শাখা-প্রশাখার বিস্তৃত। হিংসাবিদ্বেষ জর্জরিত মানুষের কামনা-বাসনা, প্রভুত্বের জন্য ষড়যন্ত্র, নিষ্ঠুরতা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামÑ এসব কিছুই ঘটেছিল একটি নারীকে কেন্দ্র করে। ঠিক এমন ঘটনা গ্রিক সাহিত্যের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যে ঘটেছিল একটি নারীকে কেন্দ্র করে।’’
শুধু কাহিনী বিন্যাসে নয়, ‘বিষাদ সিন্ধু’র বিস্ময়কর রচনাগুণও এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তার মূল কারণ। মধ্যযুগের ধারাপ্রবাহে বিশ শতক পর্যন্ত কারবালার কাহিনীর করুণধারা এ দেশের মানুষের মনে করুণ রস সঞ্চার করেছিল। এই করুণ রস পাঠকের মনে কী বিপুল পরিমাণে আবেগমথিত করতে সক্ষম আজ ১৩০ বছর পরেও ‘বিষাদসিন্ধু’র অক্ষুণœ আবেদন তা প্রমাণ করে।
http://m.dailynayadiganta.com/?/detail/news/181014
এক শ’ ত্রিশ বছরের পাঠ ও মূল্যায়ন
ড. আ শ রা ফ পি ন্টু
২৩ ডিসেম্বর ২০১৬,শুক্রবার, ০০:০০
‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস। শুধু কালজয়ীই নয়, বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় বা বহুলপঠিত উপন্যাসের মধ্যে এটি অগ্রগণ্য। আজ থেকে এক শত ত্রিশ বছরেরও অধিক সময় আগে উপন্যাসটি প্রকাশ হয়। তিনটি পর্বে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড (মহররম পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে, দ্বিতীয় খণ্ড (এজিদবধ পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এবং তৃতীয় খণ্ড (উদ্ধার পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশের এত বছর পরেও এখন পর্যন্ত বাঙালি পাঠকের কাছে গ্রন্থটি সাদরে গৃহীত হচ্ছে।
‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রকাশের পরপরই গ্রন্থটি নিয়ে পঠন-পাঠন, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অনেক। এখনো হচ্ছে এর মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন। গ্রন্থটি যেমন নন্দিত হয়েছে কারবালার ঐতিহাসিক ও মর্মন্তুদ ঘটনা অবতারণা এবং সৃষ্টিশীল গদ্য রচনার জন্য, তেমনি নিন্দিত হয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য অবমাননা ও অলৌকিক কাহিনীর অবতারণার দায়ে। এ দ্বিবিধ গুণ ও দোষের পরেও কেন ‘বিষাদসিন্ধু’ এখনো জনপ্রিয়Ñ সেটাই বিচার্য বিষয়।
‘বিষাদ সিন্ধু’ (প্রথম খণ্ড) প্রকাশের পরপরই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-এর ১২৯২ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় এর যে আলোচনা লেখা হয় তার কিয়দংশের উদ্ধৃতি : ‘মুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গভাষার অল্পই অনূবাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। এই সকল গ্রন্থ যে বঙ্গভাষার বিস্তৃতির আর একটি নতুন পথ এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি মুসলমানদিগের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতেছে, ইহা চিন্তাশীল পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন।’
মশাররফের যুগে কিংবা তার প্রাক্কালে মুসলমানেরা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল। তারা বাংলা ভাষা পঠন-পাঠন থেকে বিরত থাকত, কেউ কেউ বাংলাকে নিজ ভাষা (মাতৃভাষা) বলতেও নারাজ ছিলেন। এর প্রমাণ আমরা মধ্যযুগে কবি আব্দুল হাকিমের কবিতায়ও দেখতে পাই। ধর্মীয় ভাষা আরবি ও এককালের রাজভাষা ফারসির প্রতি ছিল এদের অনুরাগ। এমনকি মীর সাহেবের বাবাও বাংলা জানতেন না; তিনি ফারসিতে দস্তখত করতেন। আর এ কারণেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মীর মশাররফ হোসেনকে সাধুবাদ জানিয়েছে শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’রচনার জন্য। এরপর ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ জ্যৈষ্ঠ-এর ‘চারুবার্ত্তা’য় প্রকাশিত আলোচনাটিতেও এমন সাধুবাদ জানানো হয়েছে বিশুদ্ধ বাংলায় ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনার জন্য। এ পত্রিকা মীর মশাররফ সম্পর্কে লিখেছে : ‘ইতিপূর্বে ইহার প্রণীত আরো কয়েকখানি গ্রন্থ আমরা দেখিয়াছি, ইনি যে রূপ বিশুদ্ধ ও সুমধুর বাঙ্গালা লিখিতে পারেন, অনেক শিক্ষিত হিন্দুও তেমন লিখিতে পারে না।’
১২৯৫ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় “ভারতী’ পত্রিকায় ‘বিষাদসিন্ধু’-এর দ্বিতীয় খণ্ড (উদ্ধার পর্ব) সম্পর্কে মন্তব্য : ‘প্রথম খণ্ডের মতো দ্বিতীয় খণ্ডও উপন্যাসের মতো লিখিত, সুতরাং বড়ই সুখপাঠ্য। তবে প্রথম খণ্ডের ভাষা দ্বিতীয় খণ্ড অপেক্ষাও বিশুদ্ধ।”
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল লাইব্রেরির বার্ষিক রিপোর্টে গ্রন্থাগারিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বিষাদসিন্ধু’ (উদ্ধার পর্ব) সম্পর্কে লেখেন ÔMir Masharruf Hossain’s Bishad Sindhu, basedon the events before and after great battle of Karbala, on of the best works, in the Bengali language. The earnestness and pathos of the work, its elevated moral tone and dignified diction, raise it to high level and mark adistnct departure, both in matter and in manner, from the current examples of imaginative writing of BengaliÕ. .
মশাররফের সময়ে মুসলমান বাঙালি লেখকদের মধ্যে পুঁথিসাহিত্যে প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব পুঁথিসাহিত্যে ছিল মধ্যযুগীয় অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অলৌকিকতা। ‘বিষাদ সিন্ধু’-তে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি পুঁথিসাহিত্যের প্রভাবও লক্ষণীয়। অনেকের ধারণা, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ ‘জঙ্গনামা’ ও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধু ভাষার রূপান্তর মাত্র। এ প্রসঙ্গে কাজী আব্দুল ওদুদ তাঁর ‘শাশ্বতবঙ্গ’ (১৯৫১) গ্রন্থে বলেছেন, “পুঁথিসাহিত্যের লেখকদের সঙ্গে ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখকের বড় মিল হয়তো এখানে যে, দৈব-বলের অদ্ভুত তত্ত্বে বিশ্বাস তাঁরও ভেতর প্রবল দেখা যাচ্ছে। দৈব-বলে বিশ্বাস মাত্রই সাহিত্যে বা জীবনে দোষার্হ্য নয়, কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে যখন যোগ ঘটে অজ্ঞানের ও ভয়-বিহ্বলতার; তখন তা হয়ে ওঠে জীবনে জন্য অভিশাপ।... জীবন, ধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর ধারণা যে অগভীর তা নয়। আজরের মুখ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ধার্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক।’ মানবজীবনের জটিলতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও যথেষ্ট।’
ইতিহাসে আছে; ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের সঙ্গে এজিদের যে বিরোধ তা মূলত সিংহাসনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মশাররফ ‘বিষাদ সিন্ধু’তে এই রাজনৈতিক বিরোধ অপেক্ষা ইমাম হাসানের স্ত্রী জয়নবের প্রতি এজিদের রূপজ মোহকেই মূল উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গতি রক্ষার চেয়ে সাহিত্যে রস পরিবেশনের তাগিদে লেখক কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কেননা ধর্মীয় ইতিহাস নয়, সাহিত্য সৃষ্টিই ছিল লেখকের মূল উদ্দেশ্য। কবি কায়কোবাদ মীরের হাতে কারবালার কাহিনীর ধর্ম-দর্শনের বিপর্যয় লক্ষ করে দুঃখিত হয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ধর্মীয় চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘মহররম শরীফ’ নামে একটি কাব্যও রচনা করেছেন। কিন্তু শিল্পগুণে তা উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরীর ‘মীরমানস’ (১৯৬৫) গ্রন্থের উক্তিটি স্মর্তব্য, “মীর মশাররফ হোসেনের মানবপ্রীতি ও শিল্পবোধ ‘বিষাদ সিন্ধু’র ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে গুরুতররূপে ব্যাহত করেছে।... মাইকেল-বঙ্কিমের জীবনোপলব্ধির উত্তরাধিকারী মীরের হাতে এমনি করেই পুরাতন নীতিধর্মের পরাভব ও শিল্পের বৈজয়ন্তী লাভ ঘটে।’’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর একটি চিঠিতে কারবালার কাহিনীর মহাকাব্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করেছিলেন। মুহম্মদ আব্দুল হাই ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৬) গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘বাংলা সাহিত্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’ অভিনব সৃষ্টিÑ একাধারে ইতিহাস আশ্রিত রোমান্টিক উপন্যাস ও গদ্য মহাকাব্য।’’ যদিও মীর সাহেব মহাকাব্য রচনা করেননি, ‘তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে ‘বিষাদ সিন্ধু’র পরিকল্পনায় দৈনন্দিন তুচ্ছতার অতীত মহাকাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়। সমকালীন মুসলিম সাহিত্য প্রয়াসের প্রবণতা ও শৈলী বিচারে মশাররফ হোসেনের এই কৃতী নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণের দাবি রাখে’’ (কথা ও কবিতা : আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ১৯৮২)।
‘মীর মশাররফ হোসেনের গদ্য রচনা’ (১৯৭৫) শীর্ষক অভিসন্দর্ভের গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালও ‘বিষাদ সিন্ধু’কে গদ্য মহাকাব্য বলে অভিহিত করেছেন।
তার ভাষায়, ‘‘এতে রয়েছে মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিকা। এটি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষের কাহিনী নয়Ñ এ হচ্ছে প্রভুত্ব নিয়ে দুই নৃপতির মধ্যে সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত ছিল বহু লোকের জীবন, বহু লোকের ভাগ্য। এ গ্রন্থে প্রায় শ’খানেক পাত্র-পাত্রী আছে; এর মধ্যে রয়েছে অনেক কাহিনী শাখা-প্রশাখার বিস্তৃত। হিংসাবিদ্বেষ জর্জরিত মানুষের কামনা-বাসনা, প্রভুত্বের জন্য ষড়যন্ত্র, নিষ্ঠুরতা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামÑ এসব কিছুই ঘটেছিল একটি নারীকে কেন্দ্র করে। ঠিক এমন ঘটনা গ্রিক সাহিত্যের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যে ঘটেছিল একটি নারীকে কেন্দ্র করে।’’
শুধু কাহিনী বিন্যাসে নয়, ‘বিষাদ সিন্ধু’র বিস্ময়কর রচনাগুণও এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তার মূল কারণ। মধ্যযুগের ধারাপ্রবাহে বিশ শতক পর্যন্ত কারবালার কাহিনীর করুণধারা এ দেশের মানুষের মনে করুণ রস সঞ্চার করেছিল। এই করুণ রস পাঠকের মনে কী বিপুল পরিমাণে আবেগমথিত করতে সক্ষম আজ ১৩০ বছর পরেও ‘বিষাদসিন্ধু’র অক্ষুণœ আবেদন তা প্রমাণ করে।
http://m.dailynayadiganta.com/?/detail/news/181014
No comments:
Post a Comment