![images](https://sufiborshan.files.wordpress.com/2017/10/images.jpg)
বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসটি তিন পর্বে বা খণ্ডে বিন্যস্ত। এর প্রথম খণ্ডের নাম ‘মহরম পর্ব’ ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ড ‘উদ্ধার পর্ব’ ও তৃতীয় খণ্ড ‘এজিদ-বধ পর্ব’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৮৭ ও ১৮৯০ সালে। বিষাদ-সিন্ধুর মূল উপজীব্য হলো: ১. কারবালার যুদ্ধ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হাসান ও হোসেনের শহীদ হওয়ার কাহিনি; ২. মোহাম্মদ হানিফার হাতে দামেস্কে এজিদের সেনাদের হাতে বন্দী জয়নাল আবেদীন ও নারীদের মুক্ত হওয়ার ঘটনা; এবং ৩. এজিদের পরাজয় (এই পর্বের নাম ‘এজিদ-বধ’ হলেও, তাঁকে আসলে বধ বা হত্যা করা হয়নি)।
পরাজিত হওয়ার পর এজিদ একটি কুয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, রোজ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে আগুনে পুড়তে থাকবেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যু হবে না। তৃতীয় পর্বের শেষে বিষাদ-সিন্ধু রূপকের মধ্য দিয়ে যায়। অন্যদিকে জয়নাল আবেদীন তাঁর পূর্বপুরুষদের সিংহাসনে আরোহণ করে দামেস্ক ও মদিনা শাসনভার নেন। উপন্যাসটির প্রথম পর্বের উপশিরোনাম, মুসলমান চান্দ্র মাসের প্রথম মাসের নামে, রাখা হয়েছে ‘মহরম’। এর বিশেষ কারণ হলো, হোসেন এই মাসেরই ১০ তারিখে কারবালায় শহীদ হয়েছিলেন। দিনটি তাই মুসলিমদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশেষ করে বাঙালি সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের কাছে দিনটি খুবই গুরুত্ববহ। তবে সংখ্যাগুরু সুন্নিদের কাছেও এর গুরুত্ব কম নয়। এটি তাঁদের ঐতিহ্যের অংশ।
বিষাদ-সিন্ধুর মূল বিষয়বস্তু ইসলাম। তবে এখানে এ-ও উল্লেখ করা জরুরি যে উপন্যাসটিতে বাঙালি মুসলমান বা হিন্দু কোনো সম্প্রদায়ের প্রতিই জবরদস্তি বা জঙ্গিপনার কোনো নজির নেই। মনে রাখতে হবে, ঊনবিংশ শতকে বাংলায় বেশ কয়েকটি সংস্কারপন্থী ইসলামি আন্দোলন হয়েছে; ওয়াহাবি ও ফরায়েজি আন্দোলন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আন্দোলন দুটির লক্ষ্য ছিল মুসলমান সমাজ, তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মশুদ্ধি বা সহি ইসলামচর্চা। আনিসুজ্জামান তাঁর মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বইয়ে বলেছেন, বিষাদ-সিন্ধুতে এসব সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রভাব দেখা যায় না:
পরবর্তী কালের সাহিত্যেও তরীকা-ই-মুহম্মদীয়া বা ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব বিশেষ দেখতে পাই নে। পণ্ডিত রেয়াজ-আল-দীন আহমদ মশহাদীর মতো দু-একজন লেখক নিঃসঙ্গ লেখক হয়তো ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, কিন্তু এই মনোভাব সামগ্রিকভাবে পরিব্যাপ্ত হয়নি।
তা যদি হতো, তবে তিতুমীরের বিদ্রোহ নিয়ে কেউ না কেউ কিছু লিখতেন। শুধু তা-ই নয়, মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু বা মৌলুদ শরীফ বিংবা হামিদ আলীর কাসেম-বধ কাব্য প্রভৃতি রচনা প্রমাণ করে যে ধর্মসংস্কারের পিউরিট্যানিক একালের লেখকদের গভীরভাবে নাড়া দিতে পারেনি।
মীর মশাররফ হোসেন যে শুধু মুসলিম ‘শুদ্ধতাবাদী’ সংস্কারক ছিলেন না তা-ই নয়, বরং তিনি হিন্দুদের দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রকৃত বোঝাপড়া করেছেন—অন্তত তাঁর জীবনের শুরুর অর্ধাংশ সময় তো তা-ই। ১৮৮৮ সালে, বিষাদ-সিন্ধু ত্রয়ী পর্ব রচনা ও প্রকাশনার দশকটিতে, তিনি ‘গো-জীবন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। লেখাটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান আছে। এ জন্য তিনি মুসলমানদের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করারও আহ্বান জানান।
কিন্তু রেয়াজ-আল-দীন আহমদ মশহাদীর মতো রক্ষণশীল মুসলমানরা এর প্রতি কর্কশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। মাশহাদী লিখেছিলেন, ‘হিন্দুদিগের প্ররোচনায় দুই একজন আত্মতত্ত্ববিহীন ধর্ম্মশাস্ত্রানভিজ্ঞ মোসলমানও আজকাল গরু কোরবানী ও গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে প্রতিকূলতাচরণ করিতেছেন।’
একটি সাময়িকপত্রে লেখা হয়, মীর মশাররফ হোসেন ‘একজন অমুসলমান’। একজন মুসলিম সাব-ডেপুটি হাকিমের বাসভবনে এক সভায় তাঁকে কাফের বলে সাব্যস্ত করা হয় এবং তাঁর স্ত্রীকে আবশ্যিকভাবে তালাক দেওয়ার দাবি তোলা হয়। নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্য থেকে এমন বিরোধিতা ও আক্রমণের মুখেও মশাররফ হোসেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রতি গভীর আস্থা রেখেছেন। নিজের বিশ্বাসের কথা বলিষ্ঠতার সঙ্গে লিখে জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু তাঁর শেষ বয়সে, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, মশাররফ হোসেনের এই চিন্তা-চেতনায় আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। বাঙালি হিন্দুদের প্রতি তিনি তখন তাঁর আগের আস্থা রাখতে পারেননি, বজায় রাখতে পারেননি তাঁর সহানুভূতিশীলতা। তাঁর মনোজগতের এই পরিবর্তনকে আনিসুজ্জামান সে সময়ের অনুদার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে খাটো করে দেখতে নারাজ। সে সময়ে সংঘটিত হিন্দু রেনেসাঁ (অনেক পণ্ডিত যাকে বাংলার রেনেসাঁ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন) বা পুনর্জাগরণ সাহিত্যে ও সমাজে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল আলোড়ন তোলে। একপর্যায়ে তা হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দে্যর পরিবর্তে বৈরিতায় পর্যবসিত হয়।
আনিসুজ্জামান যদিও কারও নাম উল্লেখ করেননি, তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) কথা নিশ্চয়ই তিনি মনে করেছেন, বিশেষ করে তাঁর আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাস ও কৃষ্ণচরিত্র-এর কথা। কৃষ্ণচরিত্র ১৮৮৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৮৯২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হয়ে বেরোয়। বঙ্কিমের কৃষ্ণ ভগবদ্গীতার কৃষ্ণ, আনন্দমঠ উপন্যাসের যোদ্ধা হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতোই একজন যোদ্ধা হিন্দু দেবতা। মীর মশাররফ হোসেনের রচনায় এমন পরিবর্তন এবং এর কারণ দেখে পরিতাপ করতে পারেন; কিন্তু মশাররফের প্রথম দিকের রচনায় যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র চিহ্ন নেই, তার শতমুখ প্রশংসাও তিনি করতে পারেন।
মশাররফের প্রথম দিকের রচনাগুলোকে আনিসুজ্জামান সত্যিকার অর্থে ‘সাহিত্য’ বলে মনে করেছেন। আর ন্যারেটিভ ইন নভেল ফর্ম বা উপন্যাসরীতির বয়ান-কৌশলের নমুনা হিসেবে পেশ করেছেন বিষাদ-সিন্ধুর নজির। তিনি বলেছেন, ‘মশাররফ হোসেনের মনোভাবের পরিবর্তনের পেছনে এই অনুদার পরিবেশের দান যে অনেকখানি, সেটা স্বীকার না করে উপায় নেই।’ শুধু মশাররফই নন, দুর্ভাগ্যক্রমে ওই বিশেষ পরিস্থিতি সেকালের সব লেখককেই প্রভাবিত করেছে। তবে মশাররফ হোসেনের কৃতিত্ব হলো, তাঁর রচনার সমগ্রতা, যাকে আমরা সাহিত্য বলেই অভিহিত করতে পারি, ছিল সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব থেকে মুক্ত।
অনুবাদ: মিজান মল্লিক
ক্লিনটন বি সিলি: ইমেরিটাস অধ্যাপক, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র; জীবনানন্দ দাশ–গবেষক; অনন্য জীবনানন্দ (প্রথমা প্রকাশন) বইয়ের লেখক।
https://www.google.co.uk/amp/www.prothom-alo.com/amp/special-supplement/article/503155/আধুনিক-সাহিত্যে-মুসলিম-কণ্ঠ
No comments:
Post a Comment