Sunday 1 October 2017

সেকুলার নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের চৌর্যবৃত্তি

সেকুলার নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের চৌর্যবৃত্তি ।
taslima-3
এখন দেখা যাচ্ছে সব সেকুলার নাস্তিকরা চুরি করে বিখ্যাত হয়েছে । আসলে এরা নৈতিক ভাবেও অসৎ বর্বর ।
তসলিমার আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তির নেপথ্য কাহিনী
Byফরিদ আহমেদ

তসলিমা নাসরিনের গদ্যগ্রন্থ ‘নির্বাচিত কলাম’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর প্রকাশক ছিলো বিদ্যাপ্রকাশ নামের একটা প্রকাশনী। ‘নির্বাচিত কলাম’ অত্যন্ত পাতলা একটা বই। শ’খানেক পৃষ্ঠা হবে কিনা, সেটা নিয়েই সন্দেহ আছে আমার। এখন যে বইটা পাওয়া যায়, সেটার প্রকাশক জ্ঞানকোষ প্রকাশনী। এদের ‘নির্বাচিত কলামে’ তসলিমার ‘যাবো না কেন? যাবো’ নামের সংকলন থেকে কিছু রচনা সংযুক্ত করা হয়েছে।
পাতলা এই গ্রন্থটার জন্য আচমকাই তিনি পরের বছর আনন্দ পুরস্কার পেয়ে যান। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আনন্দ পুরস্কারকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণত বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যিক এই পুরস্কার পেয়ে থাকেন। বেলাল চৌধুরীর মতে, “আনন্দ পুরস্কার হচ্ছে বাংলার সাহিত্যিকদের জন্য স্বপ্নের বিষয়। এ হচ্ছে গিয়ে বাংলার নোবেল প্রাইজ।” তসলিমা তখন তরুণী, নবাগত একজন লেখক। দেশের ভিতরে তাঁর পরিচিতি থাকলেও, দেশের বাইরে তাঁর লেখালেখি সেভাবে বিস্তৃত হয়নি তখনও। এরকম অবস্থায় তসলিমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়াটা দুই বাংলাতেই বিস্ময় হিসাবে দেখা দেয়।
আনন্দ পুরস্কারটা দেওয়া হয় আনন্দ বাজার গোষ্ঠীর তরফ থেকে। আনন্দ বাজার প্রকাশনীর জন্ম ১৯২২ সালে। পশ্চিম বঙ্গের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশনা হাউজ এটি। এখান থেকে বের হয় আনন্দ বাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা, দেশ পত্রিকা, একটা ইংরেজি সাপ্তাহিকী এবং আরো বেশ কয়েকটা ফিল্ম ম্যাগাজিন, বাচ্চাদের পত্রিকা, খেলার পত্রিকা। এর বাইরে খুব উঁচু মানের বই প্রকাশনাতেও এর নাম ডাক রয়েছে। খুব সহজ ভাষায় বললে প্রকাশনা জগতের এক দানব হচ্ছে আনন্দ বাজার প্রকাশনী। এদের বাজার শুধু পশ্চিম বঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়, এর বিস্তৃতি বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়ানো। ব্যবসা কীভাবে করতে হয়, সেটা তারা খুব ভালো করে জানে এবং বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই সেটা জানে।
তসলিমা নাসরিনের মধ্যে আনন্দ বাজার ব্যবসায়ের বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলো। তসলিমা একজন বিতর্কিত বাংলাদেশি লেখক, মুসলিম পরিবার থেকে আসা নাস্তিক, বাংলায় লেখালেখি করেন, এবং এমন সব বিষয় নিয়ে লেখেন যা মুসলিম পাঠকদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। এই পণ্যকে বাজারজাত করার জন্য আনন্দ বাজার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে নামে। তাঁকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়াটা এই মার্কেটিং ক্যাম্পেইনেরই অংশ ছিলো।
তসলিমা হচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশি, যিনি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। গর্বে বাংলাদেশিদের যেখানে বুক ফুলে ওঠার কথা, সেখানে বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া হয় বিপরীত ধরনের। পশ্চিম বঙ্গের স্বীকৃতির জন্য লালায়িত বাংলাদেশি সাহিত্যিকেরা কেউ-ই তসলিমার এই পুরস্কারপ্রাপ্তিকে সহজভাবে নিতে পারেন নাই। কোলকাতা যতো ভালবেসে তসলিমাকে কাছে টেনে নিতে থাকে, ঢাকা তাঁকে ঠিক ততোটাই দূরে ঠেলে দিতে থাকে। ঢাকার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এবং কোলকাতার কাছ থেকে ভালবাসা পেয়ে তসলিমার ভালবাসাও সরে যেতে থাকে কোলকাতার দিকে। তিনি তাঁর এক কবিতায় ঢাকার তুলনায় কোলকাতা যে স্বর্গ, এটা বলতেও দ্বিধা করেন নাই।
আনন্দ পুরস্কারের বিচারকেরা অবশ্য শুরুতে তসলিমাকে নয়, পুরস্কারটা দিতে চেয়েছিলো বাংলা একাডেমিকে। বাংলা একাডেমির কাউন্সিল এটাকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়। বাংলা একাডেমি একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে এর অস্তিত্ব জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। এরকম একটা মর্যাদাবান জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একটা বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর পুরস্কার নেওয়াটা মর্যাদা হানিকর, এই বিবেচনা থেকেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো। প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো বিনয়ের সাথে, তবে অত্যন্ত শক্তভাবে। কেউ কেউ অবশ্য বলে যে, এগুলো কিছু নয়। পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আনন্দ বাজার গোষ্ঠীর দহরম মহরম ছিলো। বাংলা একাডেমি সে কারণেই এই পুরস্কার গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলো না।
বাংলা একাডেমিকে আনন্দ পুরস্কার দেবার পিছনে আনন্দ বাজার গোষ্ঠীর একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, এরকম একটা ধারণাও তখন প্রচার পেয়ে গিয়েছিলো। তারা বাংলাদেশ থেকে একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চায়, এবং তাদের এই প্রচেষ্টাতে বাংলা একাডেমি বাধা দিতে পারে, এই বিষয়কে মাথায় রেখেই বাংলা একাডেমিকে পুরস্কার দিয়ে ঠাণ্ডা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে আনন্দ বাজার গোষ্ঠী।
ঢাকার অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বাংলা একাডেমিকে বিশেষ করে এর মহাপরিচালক প্রতিষ্ঠিত কবি এবং সাহিত্যিক শামসুর রাহমানকে একটা উচিত শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে আনন্দ বাজার আনন্দ পুরস্কার তসলিমাকে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
আনন্দ বাজারের বিচারক প্যানেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। তিনি তসলিমাকে এই পুরস্কার দেবার বিপক্ষে ছিলেন। এর বদলে তাঁর পছন্দ ছিলো কবি শামসুর রাহমান। তসলিমাকে এই পুরস্কার দিলে, চারিদিকে যে ঝড় উঠবে, সেটা তিনি জানতেন। কারণ, কোলকাতার কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে সুনীলেরই সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিলো বাংলাদেশের সাথে। আনন্দ হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় কর্ণপাত করেননি। পুরস্কার চলে যায় তসলিমা নাসরিনের কাছে।
তসলিমা নাসরিনের আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তি ঢাকার সাহিত্যিকদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। দুইদিনের পুচকে মেয়ে কিনা সব বাঘা বাঘা সাহিত্যিকদের ডিঙ্গিয়ে ভারতের সেরা সাহিত্য পুরস্কারটা ছিনিয়ে নিচ্ছে। একথা ঠিক যে তসলিমা তখন বেশ জনপ্রিয়। লেখালেখিকে পেশা হিসাবে নিতে চাইলে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে মাত্র দুজন লোক ছিলেন, হুমায়ুন আহমেদ আর তসলিমা নাসরিন। কিন্তু, জনপ্রিয়তা বাদ দিলে, তখন তাঁর এমন কোনো অবদান সাহিত্যে ছিলো না যা তাঁকে আনন্দ পুরস্কার পাওয়াতে পারে। এর বাইরে, যে বইটা পুরস্কার পাচ্ছে, সেই ‘নির্বাচিত কলাম’ নিয়েও একটা গুরুতর অভিযোগ ছিলো। অভিযোগটা হচ্ছে এর অংশ বিশেষ সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা ‘প্রাচীন ভারত ও বৈদিক সমাজ’ বই থেকে নকল করা।
তসলিমার এই চৌর্যবৃত্তির কথা, এবং তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির যৌক্তিকতা নিয়ে নামে এবং বেনামে অসংখ্য চিঠি বাংলাদেশ থেকে আসতে থাকে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর কাছে। তসলিমার বইয়ের একটা রিভিউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখতে দিয়েছিলেন সাংবাদিক মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জিকে। তিনি বইটা থেকে বাইশ পৃষ্ঠা আলাদা করেন, যেখানে তসলিমা সুকুমারী ভট্টাচার্যের বই থেকে নিয়েছেন, কিন্তু তথ্যসূত্র স্বীকার করেন নাই। এরকম একটা মর্যাদাবান পুরস্কার পাওয়া বইয়ে কীভাবে এমন হতে পারে, কীভাবে কেউ এটাকে খেয়াল করলো না, সেটা ভেবে অবাক হন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার গ্রন্থ সেকশনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি সুনীলকে জানান যে, তাঁর রিভিউতে তিনি এটা উল্লেখ করেছেন। এখন এটা লেখাতে যাবে, কী যাবে না, সেটা সুনীলের ব্যাপার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৈত্রেয়ীর রিভিউ এর তসলিমার এই তথ্যসূত্র না দেবার অংশটাকে না কেটে অবিকৃত অবস্থায় রেখে দেন।
মৈত্রেয়ীর এই অপরাধকে ক্ষমার চোখে দেখেনি আনন্দ বাজার। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নিখিল সরকার তাঁর উপরে প্রচণ্ড রকমের ক্ষিপ্ত হন। তাঁর লেখা একটা প্রবন্ধ ছাপানো হয় না এবং পরবর্তী ছয় মাস আনন্দ বাজার থেকে তাঁকে কোনো কাজও দেওয়া হয়নি।
তসলিমার চৌর্যবৃত্তি নিয়ে অন্য পত্রিকাতেও লেখালেখি হতে থাকে। এর কাউন্টার দিতে আনন্দ বাজার পুরো একটা সাপ্লিমেন্টই উৎসর্গ করে তসলিমাকে। তসলিমা যে তাঁদের আদরের সন্তান এটা জানিয়ে দিতে কোনো কুণ্ঠাবোধ তাঁরা করে না।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সুকুমারী ভট্টাচার্য সব জানার পরেও কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেন না তসলিমার বিরুদ্ধে। এর কারণ হিসাবে অনেকেই বলে থাকেন যে, তিনি নিজেও আনন্দ বাজার গোষ্ঠীর লেখক। সে কারণে তাঁর পক্ষে প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিলো না। এই একই পুরস্কার তিনি নিজেও কয়েক বছর আগে পেয়েছেন।
[এডিটরস নোটঃ নাগরিক কথা সেকশনে প্রকাশিত এই লেখাটিতে লেখক তার নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করেছেন। নিয়ন আলোয় শুধুমাত্র লেখকের মতপ্রকাশের একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফরমের ভূমিকা পালন করেছে। কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির সম্মানহানি এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আপনার আশেপাশে ঘটে চলা কোন অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতে চান সবার কাছে? আমাদের ইমেইল করুন neonaloymag@gmail.com অ্যাড্রেসে।]
http://www.neonaloy.com/2017/09/28/তসলিমার-আনন্দ-পুরস্কার-প/

No comments:

Post a Comment