নজরুল সাহিত্যে মহররম
শেখ দরবার আলম
॥ এক ॥
নজরুল সাহিত্যে মহররমের বিষয়ে লিখতে হলে এটা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, নজরুল সব ধর্মীয় সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু মুসলমানদের প্রতেবেশী বড় সমাজের বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা কেবল তাদের ধর্মীয় সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতি-সত্তা নিয়ে লিখেছেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। কিন্তু হাম্দ, নাত কিংবা মুসলমান সমাজের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বা ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট কোন কিছু চর্চার বিষয়ে লেখেননি। সেদিক দিয়ে নজরুল কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, তামাম বিশ্বের সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনায় অনন্য সাধারণ ও অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন যথার্থই অনন্য সাধারণ মানুষ।
কিন্তু সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের আগে ১৯৪২-এর ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তার সুস্থাবস্থায় বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সহাবস্থানের প্রয়োজনে যে অবদান তিনি রেখেছিলেন তা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের কাছে কোন গুরুত্ব পায়নি।
ভারতীয় উপমহাদেশের অশিক্ষিত ও হতদরিদ্রপ্রধান সমাজহীন মুসলমান সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানকামী একজন কবির অবদানকে গুরুত্ব দেয়ার মানসিকতা তাদের ছিল না। তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে তারা এবং তাদের জাতীয়তাবাদ এবং একজাতিত্ব কায়েমের লক্ষ্যে ব্রিটেনের সঙ্গে লেনদেনের ভিত্তিতে মুসলিমপ্রধান অখ- পাঞ্জাব এবং মুসলিমপ্রধান অখ- বাঙলা ও আসাম ভাগ করে সাময়িকভাবে বিশ শতাংশ জায়গা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে একটা মুসলিমপ্রধান দেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তারা জানতেন, যেভাবে এই মুসলিমপ্রধান দেশটি সৃষ্টি করে দেয়া হচ্ছে এভাবে দিলে অশিক্ষিত ও হতদরিদ্রপ্রধান সমাজহীন মুসলমান সমাজের লোকেরা এটা ধরে রাখতে পারবেন না।
সেটাই হয়েছে। তাদের সেই আকাক্সক্ষাই কার্যকর হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের এক একটি ভাষাভাষীপ্রধান মুসলিমপ্রধান প্রদেশকে অন্য আর এক একটি ভাষাভাষীপ্রধান মুসলিমপ্রধান প্রদেশের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশের এক একটি ভাষাভাষী প্রধান, মুসলিমপ্রধান প্রদেশের মুসলমানরা যখন প্রতিপক্ষ ও শত্রু খুঁজে পেল তাদের নিজেদের অশিক্ষিত, অসচেতন ও হতদরিদ্রপ্রধান সমাজহীন সমাজের মধ্যেই এবং ভারতীয় উপ-মহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশের এক একটা ভাষাভাষী প্রধান মুসলিম প্রধান প্রদেশ তাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু জ্ঞান করলো খোদ মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তাকেও, তখন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের সমাজের জাতীয়তাবাদ ও এক জাতিতত্ত্ব কায়েমের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন।
ভারতীয় উপ-মহাদেশের মুসলমানদের জন্য সাতচল্লিশের মধ্যআগস্টে একটা কারবালা সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং পরবর্তীকালে আরো অনেক কারবালা সৃষ্টির দ্বারও উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু এই একই সঙ্গে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে এক এক জায়গায় এক একেকভাবে অনেক কারবালা সৃষ্টির দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই একই সঙ্গে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশে এক এক জায়গায় এক একভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের জাতীয়তাবাদ ও এক জাতিতত্ত্ব কায়েমের পথও প্রশস্ত হয়ে গেছে। সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টের আগে তাদের যে আশঙ্কা ছিল মুসলমানরা এবং শত্রুরা মিলে তামাম ভারতের রাজধানী দিল্লির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সে সম্ভাবনাও আপাতত বহুলাংশে দূর হয়ে গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের প-িত জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো নেতারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, তাদের সমাজের লোকেরা যেন উন্নত জীবন যাপন করার মতো সুযোগ-সুবিধা পান ভারত ভাগের মাধ্যমে। তাদের সচেতন ও সুসংহত সমাজের চেষ্টায় সে লক্ষ্যও অর্জিত হয়েছে।
॥ দুই ॥
মহররম মাসের কারবালার ইতিহাস মুসলমান সমাজের একটা মর্মান্তিক করুণ ইতিহাস। মুসলমান সমাজের এরকম কারবালার আরো অনেক করুণ ঘটনা পরেও সংঘটিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নজরুল যখন মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনে ছিলেন তখন তুর্কীভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সে সময় ইহুদি-খ্রিস্টানদের মদদপুষ্ট ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সংঘাতের মাধ্যমে খলিফা হওয়ার আশঙ্কা চরিতার্থ করার যুদ্ধে ফিলিস্তিন এলাকায় কারবালা সংঘটিত হতে দেখেছেন।
নিষ্ফল আক্রোশে যে সব আরবীভাষী তরুণরা এখন ইসরায়েলের ইহুদী সৈনিকদের দিকে পাথর ছোঁড়েন এবং পাথর ছুঁড়ে গুলি খেয়ে মরেন তাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সে সময়ে ইহুদী-খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিলে তুর্কীভাষী মুসলমানদের খুঁজে খুঁজে একটা একটা করে খুন করেছিল। পূর্ব পুরুষদের সেই ভূলের মাশুল পরবর্তী বংশধরদের এক সময়ে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
॥ তিন ॥
নজরুল সেনাবাহিনী থেকে ফিরে কলকাতায় এসে ছিলেন ১৯২০-এর মার্চে। এর মাস চারেক পর তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতা। সে সময় পহেলা মহররম ছিল ১৩৩৯ হিজরীর। এর করেসপন্ডিং ইংরেজি ও বাংলা তারিখ ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২০ [৩০ ভাদ্র ১৩২৭] তারিখ বুধবার। মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এর জন্য নজরুল সম্ভবত পূর্বাহ্নেই ‘মহররম’ কবিতাটি লিখেছিলেন ৮ আশ্বিন ১৩২৭ [১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২০] মোতাবেক ১৩৩৯ হিজরীর ১০ মোহররম শুক্রবার আশুরা উপলক্ষে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের নামে এই বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বর্ষ : প্রথম খ- : ষষ্ঠ সংখ্যা ‘মোসলেম ভারত’-এ ৩৬১ থেকে ৩৬৪ পৃষ্ঠায়।
এই ‘মার্হরম’ কবিতাটির সঙ্গে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনের সমাধির একটা ছবিও ছাপা হয়েছিল। নিচে লেখা ছিল নজরুলের ‘মহররম’ কবিতার দুটো পঙক্তি।
“মহররম! কারবালা! কাঁদো হায় হোসেনা!
দেখো ‘মরু-সূর্য্য’ে এ খুন যেন শোষে না!”
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ কবিতাটি যখন ‘মোসলেম ভারত’-এ প্রকাশিত হয় তখন তিনি ছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক নবযুগের অন্যতম সহযোগী সম্পাদক। থাকতেন তার সুহৃদ মুজফফর আহমদের সঙ্গে কলকাতার ৮/এ টার্নার স্ট্রীটে।
॥ চার ॥
প্রতিবেশী সমাজ শাসিত স্বাধীন ভারতে আমি যখন আমার কৈশোরে চব্বিশ পরগনায় আমাদের পারুলিয়ার বাড়িতে থেকে জাড়োয়া পীর গোরচাঁদ হাই স্কুলে এবং বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজে পড়তাম তখন প্রতিটি হিজরী সালের ১০ মর্হরম তারিখে আশুরার দিন সকাল থেকে দুপুর এবং বিকালে কতবার যে এই কবিতাটি পড়তাম তার ইয়ত্তা নেই! আমি পড়তাম এবং আমার চোখ দুটো ভিজে যেত এবং আমার দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তো। এভাবেই আমি আমার ইতহিাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার আশ্রয়ে থাকতাম।
এই আশ্রয় আমি কোন মূল্যেই কোনো দিনই ত্যাগ করতে চাইনি। ত্যাগ করতে রাজি হইনি। আমার সবসময়ই মন হয় আমি বাংলাভাষী ঠিকই; কিন্তু যখন যে দেশেরই নাগরিক হই না কেন আমি মুসলমান। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় এই যে, আমি মুসলমান।
‘মহররম’ কবিতা পড়তে গিয়ে শুরু থেকেই আমার চোখ দুটো ভিজে যেত।
আমি পড়তাম :
“নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া
আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।”
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া-দামেসকে
“জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?”
‘হায় হায় হোসেনা’, ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়।’
উন্মাদ দুলদুল ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলিজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।
মা ফাতিমা আসমান কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেত বাস!
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা;
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা।
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও সখিনা
‘কঙ্কন পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান খান খুন হয়ে করে বুক-ফাটা নীর।
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা ও ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি, মা!”
নিয়া তৃষা সাহারার দুনিয়ার হাহাকার
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার।”
কবিতাটির প্রথম দিককার কিংয়দংশের উদ্ধৃতি
অবিস্মরণীয় কবিতা! নজরুল এই কবিতাটি যখন লিখেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র একুশ বছর তিন মাস। কারবালার সমস্ত ইতিহাসটাই যেন এই দীর্ঘ কবিতাটির মধ্যে তিনি এনেছেন। অনন্য সাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল তার। অনন্য সাধারণ ছিল তার প্রতিভা। তার ভাষার কথা মনে পড়লে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের ভাষার কথা মনে পড়বে। মুসলমান সমাজের যন্ত্রণার ইতিহাসটাও মনে পড়বে এই কবিতায়।
শেষের দিকে নজরুল লিখেছেন :
‘কত মহররম এলো, গেল চলে বহু কাল
ভুলি নি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুসলিম! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন’
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন।
ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণীষ কোরানের হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা,
শমশের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তূর্য,
হুশিয়ার মুসলিম ডুবে তব সূর্য।
জাগো, ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দরী হাঁক,
শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন!
হাসানের মতো পিব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের,
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোরবান
জালিমের দাদ নেবো, দেব আজ গোর জান!
সকীনার শ্বেত বাস দবো মাতা-কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়।
মহররম! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসানা’!
দেখো মরু-সূর্য এ খুন যেন শোষে না!”
কবিতাটির প্রথম দিকে আছে কারবালা কেন্দ্রিক সমস্ত ইতিহাস এবং শেষের দিকে আছে মুসলমান জাতির সতর্ক হওয়ার বিষয়ে শিক্ষনীয় কিছু কথা।
তৎসময়ে [অর্থাৎ সংস্কৃত] অদ্ধতৎসম, তদ্ভব শব্দের চারপাশে আরবী-ফার্সি শব্দের ব্যবহার যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা মহররমের আশুরার কারবালার সে সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে এই কবিতায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। মহররম নিয়ে এবং ইসলামের ইতিহাসের অন্যান্য স্মরণীয় দিন নিয়ে নজরুলের যে সব কবিতা, গান, নিবন্ধ এবং অভিভাষণ আছে সে সবেরও বৈশিষ্ট্য এই একই রকম।
নজরুল সাহিত্যে মহররমের বিষয়ে যখন লেখার দাওয়াত দেয়া হয়েছে তখন এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে খ্রিস্টান পাদ্রিদের তত্ত্বাবধানে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে আমাদের প্রতিবেশী সমাজের উচ্চবর্ণের লোকেরা আরবী-ফার্সী বর্জিত এবং সংস্কৃতি শব্দবহুল যে বাংলাভাষা সৃষ্টি করেছিলেন, এর অর্ধশতাব্দীকালেরও পরে মুসলমান ঘরের যে সব সন্তান বাংলাভাষায় নিজেদের কথা লিখতে এসেছিলেন, এমনকি ইসলামের ইতিহাসের কথা, এই মহররমের কারবালার ঘটনার কথাও লিখেছিলেন, তাঁরা লিখেছিলেন তৎসম শব্দবহুল অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দবহুল বাংলা ভাষায়। বালাই বাহুল্য যে, নজরুল এদের তুলনায় অনেক বেশি কেবল নয়, পরিপূর্ণরূপে আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। সম্পূর্ণ হীনমন্যতাবোধমুক্ত ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি তার ছিল নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ আনুগত্য। ইসলামের প্রতি ছিল অপরিসীম মমত্ববোধ।
ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি পর মুসলমান ঘরের যে সব সন্তান বাংলা ভাষায় নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম শাসনামলের অভিজাত পরিবারের সন্তান।
তাদের অনেকেরই পূর্ব পুরুষদের এক সময়কার ভাষা ছিল আরবী। মুসলমান শাসনামলের রাষ্ট্রভাষা ফার্সী এসব অনক পরিবারের এক সময়কার পরিবারিক ভাষা হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে অনেক পরিবারের পারিবারিক ভাষা হয়েছিল উর্দু। তবে এই সব পরিবারে আরবী-ফার্সীর চর্চাও সমান গুরুত্বের সাথে হতো। নজরুল ছিলেন এ রকমই এক সময়কার অভিজাত পরিবারের সন্তান। ইসলামের প্রতি গভীর মমত্ববোধের কারণে আরবি, ফার্সী, উর্দু ভাষার উত্তরাধিকার তিনি সমান গুরুত্বে সঙ্গে বহন করার চেষ্টা করেছেন। ফলে যথাযথ ইসলামী সাহিত্য ও সঙ্গীত আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি।
সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টে পর থেকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একটা তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই উত্তরাধিকার থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির সাধারণ শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং গণমাধ্যমে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে আমরা মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক প্রতিবেশী মুসলিম জাতিসত্তা ত্যাগ করে আমাদের প্রতিবেশী সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রতিবেশী সমাজের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক প্রতিবেশী সমাজের জাতিসত্তা নিজেদের বলে গ্রহণ করে অসম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী হচ্ছি। এ রকম হওয়াটা আমাদের শিখিয়ে গেছেন অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, অনুশীলন সমিতির সভ্য ডাক্তার কেশব রাও হেডগেত্তয়ার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বিজয়া দশমীর দিন যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্গ (আরএসএস) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্গের অঙ্গ সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, ভারতীয় জনতা পার্টি [বিজিপি], দুর্গা বাহিনী, বিদ্যার্থী পরিষদ, মজদুর সঙ্গ, প্রভৃতি সংগঠন, সেই আরএসএস উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড শীর্ষক গ্রন্থে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, ভারতের মুসলমানদের (ধর্মীয়) সংস্কতি ত্যাগ করতে হবে।
অনুশীলন সমিতির সভ্য ডাক্তার কেশব রাও হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে যে কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন এবং স্বাধীন ভারতে যে কথা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, সেই একই কথা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে শিখিয়েছেন অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ চৈতলোকনাথ চক্রবতীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা। ইতোমধ্যে এখন তাদের সেই দায়িত্ব বাস্তবায়নের সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিষ্য-সাগরেদদের অনেকেই। এঁদের অনেকেই মুসলমান ঘরের সন্তান। অনেকেই স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ করা দরকার যে, অনুশীলন সমিতির ও যুগান্তর দলের সভ্যরা ১৯২০-এর দশকে দলে দলে কংগ্রেসে ঢুকে কংগ্রেস দখল করেছেন, ১৯৩০-এর দশকে দলে দলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢুকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দখল করেছিলেন এবং ১৯৪০-এর দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে মুসলিম প্রধান অখ- পাঞ্জাব ভাগ, মুসলিম প্রধান অখ- বাংলা ভাগ ও আসাম ভাগের মাধ্যমে মাত্র বিশ শতাংশ জায়গা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত সাময়িকভাবে একটা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টি করার ব্যাপারে তাদের সমাজকে প্রভাবিত করেছিলেন। আমাদের সাংস্কৃতকি সমস্যা উপলব্ধি করতে হলে এসব ইতিহাস জানার অপরিহার্য প্রয়োজন আছে। জ্ঞান চর্চার পথ অবাধ ও উন্মুক্ত করার প্রয়োজন আছে।
No comments:
Post a Comment