ইবনে খালদুন
মুসলিম দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাতা ইবনে খালদুন ১৪০৬ সালের ১৯ মার্চ (৮০৮ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন। ‘আল মুকাদ্দিমা’ তার রচিত বিখ্যাত বই। সপ্তদশ শতকের উসমানীয় খলিফাদের ওপর তার এই বইয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃত বলা হয় তাকে।
খালদুনের পুরো নাম ওয়ালি উদ্দিন আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ। তিনি তিউনিসে আরব বংশোদ্ভূত আন্দালুসিয়ান এক অভিজাত পরিবারে ১৩৩২ সালের ২৭ মে (৭৩২ হিজরির ১ রমজান) জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠা সেখানেই। প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন বাবার কাছ। প্রভাবশালী বংশের সন্তান হওয়ায় মাগরেবের প্রথিতযথা শিক্ষকদের সান্নিধ্য পান। তিনি গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকাহ নিয়ে পড়েন। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তার পড়ালেখা চলে। এ সময় মিসর থেকে মৌরিতানিয়া পর্যন্ত সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় প্লেগের মহামারী (ব্ল্যাক ডেথ) দেখা দেয়। এতে তার বাবা-মা মারা যান। ১৩৫২ সালে ইবনে তাফ্রাকিনের দরবারে কিতাব আল উলামার কাজে ডাক পান। ১৩৫৫ সাল নাগাদ তিনি হয়ে ওঠেন ফেজের উলামা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে ফেজ, আন্দালুসিয়া, গ্রানাডা ও কায়রোসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সব অঞ্চলে তিনি অনেক রাজার উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেন। যা একই সঙ্গে রাজনীতিতে তার উত্থান-পতনের ইতিহাস। বলা যায়, স্পেনকে বাদ দিলে পুরো উত্তর আফ্রিকা চষে বেড়িয়েছেন। তিনি এ সব রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নানান ধরনের ট্রাজেডিতে পূর্ণ ছিল তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন। নিঃসঙ্গ এই ব্যক্তি শেষ জীবনে ঠাঁই পান কায়রোতে। ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা তাকে জ্ঞানচর্চা থেকে থামাতে পারেনি।
ইবনে খালদুনের সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চল ক্ষমতার দিক থেকে পতনের দিকে যাচ্ছিল। তিনি সে সব রাজ-রাজাদের ইতিহাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তার লেখা বিখ্যাত বই 'আল মুকাদ্দিমা' তাকে দিয়েছে কালজয়ী দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীর সম্মান। ১৩৭৭ সালে পাঁচ মাস সময়ে বইটি রচনা করেন। এর মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ইতিহাসের ভেতর দর্শনকে খুঁজে বের করেন। আবার ইতিহাস ও সমাজের বিশ্লেষণ করেছেন যুগপৎভাবে। ফলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক সূচিত হয়। যা পরবর্তীতে নৃতত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি সমাজকে যাযাবর অবস্থা থেকে নগর ও রাষ্ট্রের পত্তনের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের অবস্থা পর্যন্ত ভাগ করেন। শহুরে সমাজ ও যাযাবর সমাজের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখেন। সাম্রাজ্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন- ভূ-খণ্ড বিজয়, সাম্রাজ্য গঠন, সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ, শক্তি হ্রাস এবং পতন। এতে মানব সমাজের দৃঢ়তা ও দুর্বলতা, নতুন ও পুরাতন যুগ, উত্থান ও পতনের দিকে নজর দেন।
বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিলে বুঝা যায় তার আলোচনা শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামোর বাহিরের দিকে ব্যপ্ত নয়। বরং এর চেয়ে আরো গভীরে ডুব দেন। তা হলো মানুষের মনস্তত্ত্ব। এ ছাড়া অনুমাননির্ভর ধারণাকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষণভিত্তিক অভিজ্ঞতাকে তিনি গুরুত্ব দেন। তার মতে, ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণই উপযুক্ত পদ্ধতি। ১৮ শতকের শেষ দিকে তিনি পাশ্চাত্যে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮০৬ সালে ফ্রান্সের প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ভেল্টার দ্য সাকি মুকাদ্দিমার কয়েকটি পরিচ্ছেদ অনুবাদসহ তার জীবনী ছাপেন। এর পর অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ ভন হ্যামার পার্গস্টল তার একটি বইয়ে তাকে 'আরবীয় মন্টেস্কু' বলে অভিহিত করেছেন। এর পর উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ তিনি ইউরোপে ব্যাপক পরিচিত পান। অগাস্ট ক্যোঁৎ ‘সোশিওলজি’ শব্দটি পাশ্চাত্যের অভিধানে সংযোজন করেন। তা আসলে পাঁচ শতাব্দী আগে প্রাচ্যের অভিধানে স্থান পাওয়া 'আল উমরান' এর পরিভাষা। এ ছাড়া ম্যাকিয়াভেলি’র ‘প্রিন্স’র ধারণা পাওয়া যায় ইবনে খালদুনের বর্ণনায়।
‘আল মুকাদ্দিমা’ বাংলায় অনুদিত হয়েছে অনেক আগে। দুই খণ্ডে অনুবাদ করেছেন গোলাম সামদানি কোরাইয়ী। এ ছাড়া এর ভূমিকা অংশটি অনুবাদ করেছেন ড. মুঈন-উদ-দীন আহমদ খান। এ ছাড়া তার বিখ্যাত আত্মজীবনীর শিরোনাম তা’রিফ বি-ইবনে খালদুন ওয়া-রিলাতুহু গারবান ওয়া-সারকার।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিুউএস/এমডি/এএল/মার্চ ১৯, ২০১৪)
No comments:
Post a Comment