Sunday 1 October 2017

বাংলা মর্সিয়া সাহিত্য ও মহররম

বাংলা মর্সিয়া সাহিত্য ও মহররম
তৈয়্যেবা খাতুন

বাংলা মর্সিয়া সাহিত্য ও মহররমতৈয়্যেবা খাতুন
এটা জ্ঞাত সকলে- কোনো ট্র্যাজিক বা শোকময় ঘটনা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক গান, গাথা অথবা কাব্য রচনা করার রেওয়াজ পৃথিবীর সকল দেশ ও জাতির মধ্যে রয়েছে। আর এটা আসলে পারিভাষিকতায় মর্সিয়া হিসেবে পরিগণিত।

সংজ্ঞায়ন

মর্সিয়া শব্দটি আরবি, যার অর্থ শোক করা, মাতম করা, ক্রন্দন করা, বিলাপ করা প্রভৃতি। এক কথায় শোকগাথা বা শোকগীতি। ইংরেজিতে যাকে বলে এলিজি, যেখানে ফুটে ওঠে বিষাদময় কাহিনীর করুণ অভিব্যক্তি। কারবালার যুদ্ধ মুসলমানদের জীবনে এক ভয়াবহ ট্র্যাজিক ঘটনা। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেন এবং অন্যান্য বীর শহীদের উদ্দেশে লিখিত প্রসংশাসূচক কবিতাকেই সাধারণত মর্সিয়া নামে অভিহিত করা হয়।

 তবে কারবালার যুদ্ধের আগে সাধারণত কোনো মৃত ব্যক্তির গৌরবময় জীবনের মহিমা কীর্তন করে পনেরো-বিশটি স্লোক লেখা হতো তাই মর্সিয়া নামে পরিচিত ছিল। যেমন হজরত উসমান (রা.)-এর মৃত্যুতে কবি কাব ইবনে মালিক মর্সিয়া কবিতা লিখেছিলেন। আসলে তামসিক যুগের আরব দেশে মর্সিয়া সাহিত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। সে সময়ে অনেকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মর্সিয়া কবিতা লিখতেন। এদের মধ্যে দু’জন বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন, এর একজন মহিলা কবি খানসা এবং মোতাম্মিম ইবন নুবয়রা।

বাদায়ুন নিবাসী কবি নিজামী বলেন, কোনো মৃত ব্যক্তির জীবনের গুণ বর্ণনার ক্ষেত্রে ছন্দে রচিত বিলাপ অথবা দুঃখ প্রকাশক বিষয়ের নাম মর্সিয়া; কিন্তু বর্তমানে কারবালার বিষাদময় ঘটনা কাব্যাকারে লিখা হলে তাকে মর্সিয়া নামে অভিহিত করা হয়।

বিকাশ পর্ব

এ সাহিত্যধারা আরবে প্রচলনের পর পারস্যে প্রচলিত হয়। মহাকবি ফেরদৌসী তার শাহনামায় সোহরাবের মৃত্যুর পর তার মাতার জবানিতে মর্মস্পর্শী ভাষায় শোকগাথা লিখেছিলেন। কবি ফররুখী সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর করুণ ভাষায় একটি শোকগাথা লিখেছিলেন। কবি শেখ সাদী এবং ভারতের কবি আমির খসরু ফারসি ভাষায় অনেক মর্সিয়া কবিতা লিখেছেন।

ইরানের সাফারি বংশের বাদশাহদের উৎসাহে কবি মুহতাশ্ম কাশানী ফারসি ভাষায় সর্বপ্রথম হফত বন্দ নামে একটি মর্সিয়া কাব্য লিখেছিলেন। কবি কাশানী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে তরজিবন্দ বা তরকির বন্দ নামে মর্সিয়া কবিতা লিখেছিলেন। সাফারি বংশের বাদশাহরা ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তাদের উৎসাহেই মহররম নামের ‘তাজিয়া’ বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাজিয়ার সাথে আবৃত্তির জন্য কারবালার কাহিনী নিয়ে মর্সিয়া কাব্য রচিত হয়। কবি কাশানীর পর কবি মুকবিল মর্সিয়া কাব্যকে উন্নতপর্যায়ে নিয়ে যান।

ইরান থেকে অনেক কবি-সাহিত্যিকের ভারত আগমনের ফলে ভারতে মর্সিয়া সাহিত্যের সূত্রপাত হয়। ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ফারসি রাষ্ট্রভাষারূপে পরিগণিত হয়। ফারসি দরবারি ভাষা হওয়ায় এ ভাষায় ব্যাপক সাহিত্য চর্চা হয়।

উর্দু সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল ভারতের দাক্ষিণাত্যে। দাক্ষিণাত্যের উর্দু কবিরা অনেক মর্সিয়া কাব্য লিখেছিলেন। বর্তমান হায়দরাবাদ অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যে অল্পশিক্ষিত জনসাধারণের কথ্যভাষা ছিল উর্দু। দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ১৩৬৪ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বাহমনী রাজার বিদ্রোহ সফল হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো ‘প্রাচীন উর্দু’ বা ‘দাকিনী’কে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করেছিল। বিদ্রোহের বিশ বছর আগে মুহম্মদ তুঘলকের সেনাবাহিনী দাক্ষিণাত্যে উর্দুর প্রবর্তন করেছিল।

দাক্ষিণাত্যের কবি ওয়ালী (১৬৬৮-১৭৪৪) থেকেই উর্দু সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে কবি ওয়ালী মসনবী রচনা করেছিলেন, মর্সিয়া লিখেননি। ভারতে মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি কিংবা প্রথম কবি কে ছিলেন তা সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন। মীর্জা সওদা (১৭১৩-১৭৮০) ও মীর দার্দের (১১৩৩-১১৯৯ হিঃ) আগেই চার পঙক্তিবিশিষ্ট মর্সিয়া রচিত হয়েছিল। মীর্জা সওদাই প্রথম ছয় পঙক্তিবিশিষ্ট মর্সিয়া রচনা করেন। পরে মীর আনিস ও মীর্জা দবিরের যুগে মর্সিয়া সাহিত্য প্রভূত উন্নতি লাভ করে।

 উর্দু কবিদের জীবনচরিত সংগ্রহকারী মীর তকী (১৭১২-১৮১০) ও মীর হাসান সে যুগের মর্সিয়া কবিদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে মীর আমানী, মীর আল আলী দরখশান, সিকন্দর, কাদির, গোমান, আশেমী, নদীম, স্ববর প্রমুখ অন্যতম। আধুনিক গবেষণায় জানা যায় যে, দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডা রাজ্যের শাসক মুহম্মদ কুলী কুতুব শাহ (১৫৮০-১৬১১) উর্দু ভাষার প্রথম বিশিষ্ট কবি যিনি প্রচুর মর্সিয়া কবিতা লিখেছেন।

 গোলকুণ্ডা ও বীজাপুর রাজ্যের শাসকেরা মর্সিয়া কাব্য সাহিত্যের কবিদের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি নিজেরা মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছিলেন। তারা ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং এ ধরনের সাহিত্য রচনা করাকে পুণ্যকর্ম বলে মনে করতেন। বীজাপুরের আদিলশাহী শাসকদের সময় মহররমের মজলিস অনুষ্ঠানের নিয়ম চালু হয় এবং কুতুবশাহী ও নিজামশাহী শাসকদের কালে মর্সিয়া কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মহররমের মজলিস অনুষ্ঠানে প্রথম দিকে ইরানি কবি কাশামির ফারসি মর্সিয়া পাঠ করা হতো, পরে তা দাকিনী উর্দু ভাষায় রচিত হয়। পরে বহু মর্সিয়া কাব্য রচিত হয় এবং মর্সিয়া কবিতা আবৃত্তির জন্য একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এ কথা ঠিক যে, লক্ষ্ণৌতে এ সাহিত্যের বিকাশ হয়েছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে।

সে সময়ে মর্সিয়া সাহিত্যের দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি মীর আনীস ও মীর্জা দবীরের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের পূর্ববর্তী দুইজন মর্সিয়া অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন মীর জমীর ও মীর খলীক (১৭৭৪-২৮০৪)। তাদের সময়কে বলা হয় ‘জমীর ও খলীকের যুগ।’ মূলত মর্সিয়া সাহিত্য আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার মাধ্যমে বিকশিত হয়। ফারসি ও উর্দুর পথ ধরেই বাংলাতেও এ সাহিত্যধারা বিকশিত হয়।

১০ মহররম তারিখে কারবালার প্রান্তরে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) তাঁর শিষ্য সঙ্গী-সাথী ও পরিবারের ওপর এজিদ বাহিনী যে অমানুষিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল সেই ট্র্যাজিক কাহিনী প্রায় সমগ্র মুসলিম জাহানে কবি সাহিত্যিকদের লেখনীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ দিনটি মুসলিম জাহানের একটি স্মরণীয় দিন। যাকে বলা হয় পবিত্র আশুরা। এই দিনে ইমাম হোসেন (রা.) এজিদের জঘন্য সেনাপতি সীমারের হাতে নিষ্ঠুরভাবে শাহাদত বরণ করেন। কারবালার বিষাদময় কাহিনীকে কবি-সাহিত্যিকেরা করুণ রসে সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের প্রভাবে কারবালার করুণ কাহিনীভিত্তিক মর্সিয়া সাহিত্য বাংলা ভাষাতেও ভিন্ন আমেজ নিয়ে পরিবেশিত হয়েছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা ভাষায় মর্সিয়া সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কবিরা সম্ভবত চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি প্রভৃতি অঞ্চলের শিয়া সুবেদার অথবা শাসকদের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক কারণেই শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ভেতর ১০ মহররমের মর্মান্তিক ঘটনা গভীর শোকের সৃষ্টি করেছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে এই দিন ক্রন্দন কিংবা মাতম করাকে ধর্মীয় কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়।

 কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকেন্দ্রিক সাহিত্য হিসেবে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম যে গ্রন্থটির নাম উল্লেখ করতে হয় তা হলো ষোড়শ শতাব্দীর কবি ফয়জুল্লাহ রচিত যয়নবের চৌতিশা। বাংলায় মহররম ভিত্তিক সাহিত্য বা মর্সিয়া সাহিত্যের এখন পর্যন্ত এটিই প্রাচীনতম নিদর্শন। চট্টগ্রামের কবি মুহম্মদ খানের মোক্তাল হোসেন (১৬৪৫) বাংলা মর্সিয়া কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে একটি জনপ্রিয় কাব্য হিসেবে পরিচিত। সিলেটের কবি হামিদের সংগ্রাম হুসন কারবালাকেন্দ্রিক অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাব্য। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্যের অনুলিপি হয়। কবি মূল কাব্যের অনেক আগেই লিখেছেন বলে ধারণা করা যায়। ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের কবি হায়াৎ মাহমুদ জঙ্গনামা রচনা করেন, যেখানে কারবালার শোকাবহ যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

প্রকৃত প্রস্তাবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় বিষয়বস্তু ব্যাপকভাবে স্থান লাভ করেছিল। মর্সিয়া কাব্যের উপাদান বিবেচনা করলে এগুলোকেও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

আর এরই পথ ধরে মোগল আমলে বাংলায় মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করে আলোক বর্তিকা সত্যিকার অর্থে প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন উল্লিখিত কবিগণ। অর্থাৎ দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, জাফর, হামিদ প্রমুখ। দৌলত উজির বাহরাম খান ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচনা করেছিলেন। মুহম্মদ খান ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্য রচনা করে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ইসলামী বিষয় অবলম্বনে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির যে সব নিদর্শন মধ্য যুগে লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে সুফি সাহিত্য বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বাংলা সুফি সাহিত্যের ধারায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি সৈয়দ সুলতান।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিম বঙ্গে মুসলমানি বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। এই ধারায় মহররমের শোকাবহ ঘটনা নিয়ে অনেক কাব্য রচিত হয়। এই ধারার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি ফকির শাহ গরীবুল্লাহ। তিনি মহররমের প্রেক্ষাপটে ইমাম হোসেনের (রা.) বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও শহীদ হওয়ার কাহিনী তার কাব্যে তুলে ধরেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের ভুরশুট কানপুর পরগনা থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুনশী আলীর শহীদে কারবালা, শায়খ মুহম্মদ মুনশীর শহীদে কারবালা প্রভৃতি গ্রন্থে কারবালার হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গরীবুল্লাহ যে ভাষায় মর্সিয়া কাব্য শুরু করেছিলেন সে ধারাই অনেক দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই ধারার আধুনিককালে কবিদের ভেতর রংপুরের মুহম্মদ ইসহাক উদ্দীন ও চট্টগ্রামের কাজী আমীনুল হকের নাম উল্লেখ করা যায়। মুহম্মদ ইসহাক উদ্দীনের দাস্তান শহীদে কারবালা ও আমীনুল হকের জঙ্গে কারবালা গ্রন্থে মহররমের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সিলেটে নাগরী লিপিতে বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল। সিলেটি নাগরী লিপিতে নানান ধরনের কাব্য রচিত হয়েছে। এই লিপিতে মর্সিয়া সাহিত্যও রচিত হয়েছে। নাগরী লিপিতে লেখা কবি ওয়াহিদ আলীর ৫০০ পৃষ্ঠার বৃহৎ জঙ্গনামা কাব্যটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহররমের হৃদয়স্পর্শী ট্র্যাজিক ঘটনা নিয়ে শুধু মধ্য যুগেই সাহিত্য রচিত হয়নি আধুনিক যুগেও হয়েছে।

 ব্রিটিশ আমলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য শিল্পী মীর মোশাররফ হোসেন হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে হৃদয়স্পর্শী ভাষায় লেখেন বিশাল গ্রন্থ বিষাদ-সিন্ধু। এই গ্রন্থটি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে এক সময় তা ঘরে ঘরে পঠিত হতো। বিষাদ-সিন্ধুর একটি পর্বের নাম মহররম পর্ব, যাতে মহররমের কাহিনী প্রাধান্য পেয়েছে। আধুনিককালের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে মুহম্মদ হামেদ আলী, মতীয়ুর রহমান খান, কায়কোবাদ, আবদুল বারী, আবদুল মোনায়েম, ইসমাইল হোসেন শিরাজী, আজীজুল হাকিম, মুহম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ মহররমের ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মহররম ও কারবালার কাহিনী নিয়ে কবিতা ও গান লিখেছেন।

বাংলা মর্সিয়া কাব্যগুলো প্রধানত অনুবাদ সাহিত্য হিসেবেও গড়ে উঠে। বাঙালী কবিরা মূলত ফারসী ও উর্দু কাব্যের ভাব কল্পনা ও ছায়া আশ্রয় করে তাদের কাব্য রচনা করেছিলেন তথাপি এর মধ্যেও তাদের মৌলিকতার যথেষ্ট পরিচয় বিদ্যমান। ফলে এই কাব্যগুলো এক প্রকার অভিনব সৃষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ফাকে একটা কথা বলা অতীব প্রয়োজন- মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু' মর্সিয়া সাহিত্যের ধারায় উপন্যাস জাতীয় গ্রন্থ। আধুনিক উপন্যাসের সুবিন্যস্ত বন্ধন রীতি আলোচ্য গ্রন্থে অনুসরণ করা হয়নি।

 গ্রন্থটি ইতিহাস, উপন্যাস, সৃষ্টিধর্মী রচনা এবং নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বিবিধ সংমিশ্রণে রোমান্টিক আবেগ মাখানো এক সংকর সৃষ্টি। মীর মোশাররফ হোসেন অতীতের জঙ্গনামা, মক্তুল হোসেন, শহীদে কারবালা প্রভৃতি কাব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সে সব গ্রন্থের কল্পনা বহুল কাহিনী দ্বারা তিনি ছিলেন প্রভাবিত। তার এই উপন্যাস রূপায়নে ও চরিত্র চিত্রনে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এর কিছু প্রধান চরিত্র ছাড়া অপরাপর চরিত্র ইতিহাস বহির্ভূত ও কল্পনাশ্রয়ী।

ঘটনা বিন্যাসে প্রথমদিকে সামান্য ঐক্য পরিলক্ষিত হলেও পরের দিকে ব্যাপকভাবে কল্পনানির্ভর। অন্যদিকে মর্সিয়া সাহিত্যের ধারায় হামিদ আলী ঊনিশ শতকীয় মহাকাব্যের রীতিতে কাশেম বধ কাব্য রচনা করেন। চরিত্র সৃষ্টি, ঘটনা বিন্যাস এ কাব্য মহাশ্মশান তো বটেই এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বৃত্রসংহারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই কাব্যে কবির দুর্লভ সংযম, প্রদীপ্ত বুদ্ধি ও চমৎকার কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কবির পরবর্তী রচনা ‘জয়নালোঘারে কাব্য'। কাশেম বধ কাব্যে যা বর্ণিত হয়েছে তার পরবর্তী ঘটনাবলীই এ কাব্যের বর্ণিতব্য বিষয়। মাইকেলের ব্যাপক প্রভাব এতে লক্ষ্যণীয়। এই ধারার সর্বশেষ সংযোজন হলো কায়কোবাদের ‘মহরম শরীফ' কাব্য। এই কাব্যে কবি তার সহজাত ইতিহাসপ্রীতি, স্বজাত্যবোধ ও নীতিজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কাব্যকলার উৎকর্ষ সাধন তিনি করতে পারেননি। মর্সিয়া সাহিত্যের আলোচনায় যার কথা সবার শেষে আসে তা হচ্ছে লোকসাহিত্যের অন্তর্গত মর্সিয়া কাব্য। জারি গান এই সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। অন্যান্য লোকসাহিত্যের মতো এর জন্ম ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে। বিষয়ের বৈচিত্র্য, সুরের মাধুর্যে এবং শোকের গভীরতায় এই মর্সিয়া গীতি প্রচলিত কাব্যের চেয়ে উৎকৃষ্টতর দাবি রাখে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক ও স্কুল শিক্ষক

http://bm.thereport24.com/article/67271/index.html

No comments:

Post a Comment