নজরুল সাহিত্যে মহররম
শেখ দরবার আলম
নজরুল সাহিত্যে মহররম, এই বিষয়টার ওপর যদি লিখতে হয় তা হলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, ইসলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ছিল একটা আশ্রয়। মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতি-সত্তা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। তামাম বিশ্বের মুসলিম সভ্যতা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। কোরআন এবং সুন্নাভিত্তিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় আদর্শ মানুষ ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের আর্থ-সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক মহাবস্থানের কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় যে সব জায়গায় উল্লেখ করেছেন সেই সব জায়গায় তিনি যে মুসলমান ঘরের সন্তান, এই কথাটুকু বলে ক্ষান্ত হতে চাননি। তিনি বারংবার বলেছেন এবং লিখেছেন, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং নবীর উম্মত! কিন্তু তিনি কবি সবার। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সবার। এদিক দিয়েও বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ভূমিকা অনন্য।
দুই
বাংলা সাহিত্যে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের বাংলাভাষীদের মধ্যে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা বৈদিক, ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রুতী মনুসংহিতার সমাজের কবি-সাহিত্যিক হিসেবে লেখালেখি করেছেন এবং সেইভাবেই মূলত কাজ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বোধ হয় অনুশীলন সমিতির সভ্য মণিসিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের মতো ও যুগান্তর দলের সভ্যদের মতো এবং অনুশীলন সমিতিরি সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের মতো ও যুগান্তর দলের সভ্যদের মতো বলতে চাইতেন যে তিনি নাস্তিক। এ কথা বললে যথার্থ অহিন্দুদের কাছে এবং নাস্তিকদের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী, শিখ- এরকম কোনো ধর্মাবলম্বীর শুধু নাস্তিক হলে তাতে ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বিশ্বে মজলুম মুসলমানদের কারো কোনো উপকার হয় না। তারা নিজ নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সাথে পালন করলে তাতে মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ, তাদের কোনো ধর্ম গ্রন্থেই মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে বা কল্পনা করে জাতীয়তাবাদী হয়ে মজলুম মুসলমানদের অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হওয়ার এবং এর চূড়ান্ত রূপে পৌঁছে ফ্যাসীবাদী হওয়ার কোনো সংস্থান নেই।
ধর্মের ভিত্তিতে হোক, বর্ণের বা গায়ের রঙের ভিত্তিতে হোক, ভাষার ভিত্তিতে হোক কিংবা কোনো অঞ্চল বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে হোক, কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে তাদের অধিকার বঞ্চিত করার কোনো সংস্থান তৌহীদবাদ কেন্দ্রিক, আল্লাহর একত্ববাদ কেন্দ্রিক বা আল্লাহর ওয়ানলেনকেন্দ্রিক ইসলামের নেই। সাহিত্য ও ধর্ম শাস্ত্র যে এক জিনিস নয়, সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নজরুল যে সাম্য ও সহাবস্থানের কবি হতে চেয়েছিলেনি এবং সব ধর্মীয় সমাজের মানুষের কবি হতে প্রতিবেশী সমাজের জন্য আলাদা করেও অনেক কিছু লিখেছিলেন সে সবের মূল ভিত্তিটাও ঠিক এখানেই। এসব জানার এবং বোঝার চেষ্টা না করে বাংলাভাষী ইসলামপন্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিতজনদের কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অযথা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। এদের অনেকেরই ঘরে নজরুল রচনাবলী নেই। নজরুল সম্পর্কে পড়াশোনা করে ধারণা পোষণ করার প্রয়োজন আছে বলে এরা মনে করেন না। এরা নজরুল সম্পর্কে ধারণা পোষণ করেন নজরুল সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেন না, এমন লোকদের কাছ থেকে গুজব শুনে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল চর্চা উপেক্ষিত হওয়ায় এমনটা হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ তাদের একজাতিতত্ত্ব আরোপের দৃষ্টিভঙ্গিতে চান যে, তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ও এই জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত বিস্মৃত হয়ে হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা মুসলমানদের নিজেদের বলে মুসলমানরা গ্রহণ করুন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের এই আকাক্সক্ষার কারণে প্রতিবেশী বড় সমাজপ্রধান ভারতীয় উপমহাদেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে যেমন, অনুরূপভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসেও খোদ পাকিস্তান আমলেও ১৯৪৮-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নজরুল সাহিত্যও অবশ্য পাঠ্য ছিল না। এই যখন বাস্তবতা তখন একটি দৈনিকে একজন এ বিষয়ে লিখলে কী জনরুল চর্চা হবে! সবার জানা উচিত এবং চিন্তা-ভাবনা করে দেখা উচিত যে, মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এ পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতি সত্তার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়ে দেয়ার ফলে আমাদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে নজরুল সাহিত্যে মহররম, এ রকম মুসলিম জাতিসত্ত্বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী অচ্ছ্যুৎ হয়ে আছে। এভাবে বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মুসলিম জাতিসত্তা হারাচ্ছে।
তিন
এই বাস্তবতাটা, এই সত্যটা আমাদের সবারই স্মরণ রাখা উচিত যে, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব বাংলাভাষীর বাংলা ভাষা অনেকাংশে এক হলেও তৌহিদবাদী মুসলমানদের বাংলা ভাষা এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের বাংলা ভাষা সর্বাংশে এক নয়। অনুরূপভাবে তৌহিদবাদী মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতি এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি, সাংস্কৃতি সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা উচিত। আমি এসব কথাগুলো অপরিহার্য প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই লিখছি। কেননা, এই কথাগুলো সবারই চিন্তা করে দেখা উচিত।
দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আবদুল গফুর সাহেব নজরুল সাহিত্যে কোরবানীর ঈদ, নজরুল সাহিত্যে ঈদুল ফিতর, নজরুল সাহিত্যে মহররম, এ রকম মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট এমন কোনো কোনো বিষয়ের ওপর লিখতে বলেন যে বিষয়গুলোর ওপর লিখতে বলার মানুষ এবং লেখার মানুষ তৈরি হওয়ার পথ এই মুসলিম প্রধান দেশেও ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টেই বন্ধ হয়ে গেছে।
বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর পঠন-পাঠনের সংস্থান সেখানকার স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় নেই। সে সুযোগে এই মুসলিম প্রধান দেশেও এখানকার স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় নেই। মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করানোর ফলে খোদ পাকিস্তান আমল থেকেই এরকম একটা অবস্থা সৃষ্টি হতে পেরেছে। এ দেশে যারা ইসলামী আন্দোলন করেন তারাও এ বিষয়টির দিকে কখনো নজর দেননি।
চার
তামাম ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুসলিম সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ও এই মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত মুছে ফেলার অংশ হিসেবে এ ক্ষেত্রে নজরুল চর্চার পথও রুদ্ধ করার বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু নিজ নিজ সমাজের মানুষ হলে হিন্দুর ভাষা এবং সাহিত্য হবে এরকম এবং মুসলমানের ভাষা ও সাহিত্য হবে অন্যরকম।
বাংলায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট পূর্বপুরুষরা বৈদিক, ব্রাহ্মণ পূর্বপুরুষরা যেমন এসেছিলেন বাইরে থেকে, তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরব পূর্বপুরুষরাও এসেছিলেন বাইরে থেকে। ভারতে আসার পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরা বাংলায় এসেছিলেন কনৌজ বা কান্যকুঞ্জ থেকে। আর আরবের বাগদাদ থেকে ভারতে আসার পর কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুরুষরা বাংলায় এসেছিলেন বিহারের পাটনা থেকে।
হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তার প্রতি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন ছিল প্রচ- আবেগ এবং আকর্ষণ, অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সম্পর্কেও এই মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত, শিল্প, স্থাপত্য সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর মমত্ববোধ ও আকর্ষণ।
পাঁচ
অন্যতম রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত রবি জীবনীতে লিখেছেন যে, আধুনিক বাঙালি বলতে যাদের বোঝায় তারা এসেছেন বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। ঠিক অনুরূপভাবে আমরা যদি অষ্টম শতাব্দী থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার দিকে চোখ রাখি তা হলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো, সাহিত্যিক-সাংবাদিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতো এবং মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আব্দুল কাসেম ফজলুল হকের মতো, মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের মতো, মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো আধুনিক বাংলাভাষী মুসলমানরাও এসেছেন ভারতের বাইরের সাধারণত আরব বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্য এশিয়া থেকে। এভাবে আমরা দেখছি যে, আধুনিক বাঙালি হিন্দুদের যেমন রয়েছে বৈদিক ব্রাহ্মণশাসিত বর্ণ এ অধিকার ভেদাস্ত্রয়ী মনুসংহিতার সমাজের হিন্দু জাতিসত্ত্বার উত্তরাধিকার; অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি আধুনিক বাংলাভাষী মুসলমানদেরও রয়েছে মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার উত্তরাধিকার।
ছয়
আরবী ভাষাভাষী এলাকা ইরাকের বাগদাদে থাকতে নজরুলের পূর্ব পূরুষরা ছিলেন আরবীভাষী। হিন্দুস্থানে অর্থাৎ ভারতে এসে তার পূর্বপুরুষরা এক সময়ে হয়েছিলেন ফার্সীভাষী। পরে উর্দুভাষী।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু পূর্ববর্তী সভাপতি এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের পূর্বপুরুষরাও আরব থেকে এসেছিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদের জীবদ্দশায়ও তাঁদের পরিবারের মহিলারা গৃহপরিবেশে কথাবার্তা বলতেন ¯্রফে কেবল আরবী ভাষায়। মওলানা আবুল কালাম আজাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের মানুষজনদের সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুভাষায়।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে [১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ] কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাদের পরিবারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষার চর্চা ছিল। তাঁর আব্বা কাজী ফকীর আহমদ বাংলাভাষাও খুব ভালো মতো শিখেছিলেন। নজরুল তাঁর শৈশবে এবং বাল্যেই শিখেছিলেন আরবী, ফার্সী, উর্দু এবং বাংলা। কাজী নজরুল ইসলামের যখন জন্ম হয় তখন তাদের পরিবারের লোকেরা গৃহপরিবেশে কথাবার্তা বলতেন উর্দু ভাষায়।
সাত
১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের আগে কথ্য বাঙলা এবং দলিল দস্তাবেজ এবং চিঠিপত্রের বাংলা ছিল আরবী-ফার্সী শব্দবহুল বাঙলা। তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরাও পারিবারিক পর্যায়েও ফার্সী ভাষা চর্চা করতেন। রাজ ভাষা হিসেবেও ব্যবহারিক জীবনে ফার্সী ভাষার চর্চা তো করতেনই।
পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের বেয়াল্লিশ বছর সাত মাস পর ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজিভাষী স্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান সমাজের পাদ্রি উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর মিশনে। সংস্কৃতিক পণ্ডিত রামরাম বড়ুয়ার তালিমে আরবী-ফার্সী শব্দ রঞ্জিত এবং সংস্কৃত শব্দ বহুল খ্রিস্টান ধর্মীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সাবেক পাদুকা নির্মাতা পাদ্রী উইলিয়াম কেরী এর এক বছর দু’মাস পর ১৮০১-এর মে মাসে ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে অধীনস্থ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সহযোগিতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বাঙলাভাষা শেখানের জন্য আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত কেবল নয়, তামাম মুসলিম সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা বর্জিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেন। কালক্রমে এই ধরনের বাঙলা পাঠ্যপুস্তকই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ হলো।
শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠার এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ বছর পর মীর মশাররফ হোসেন [১৮৪৭-১৯১২]-এর জন্ম। পাঠশালায় এবং স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে এবং সে সময়কার হিন্দুদের লেখা সাহিত্যে আরবী-ফার্সী বর্জিত সংস্কৃত শব্দবহুল যে ধরনের বাঙলা ভাষার প্রচলন মীর মশাররফ হোসেন দেখেছিলেন ঠিক সে ভাষাতেই তিনি ইসলামের ইতিহাসের কারবালার ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন ‘বিষাদসিন্ধু’ [১৮৮৫-১৮৯১]।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম মীর মশাররফ হোসেনের জন্মের বাহান্ন বছর পর। তিনিও কেবল পাঠশালায় নয়, মক্তবে এবং স্কুলেও আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত সংস্কৃত শব্দবহুল বাঙলাই শিখেছিলেন। হিন্দুদের লেখা অন্যান্য কাজ এবং সাহিত্যে ও শিখেছিলেন এই একই ভাষা। কিন্তু মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে তিনি যখন কাব্য ও সাহিত্য সৃষ্টি করলেন এবং গান লিখলেন তখন এই বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে তিনি সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ যথাসম্ভব বর্জন করে ব্যবহার করলেন প্রচুর আরবী-ফার্সী শব্দ।
প্রথমে শ্রীরামপুর মিশনে এবং পরে আরো ব্যাপকভাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে খ্রিস্টান পাদ্রী এবং সংস্কৃতজ্ঞ হিন্দু প-িতরা মিলে একশ’ বিশ বছর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই যেমন দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, লিখিত বাংলাভাষা হবে সম্পূর্ণরূপে আরবী-ফার্সী শব্দবর্জিত সংস্কৃত শব্দ বহুল ভাষা এবং বাঙলা সাহিত্য-সঙ্গীত হবে কেবল কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তাসংশ্লিষ্ট সাহিত্য ও সঙ্গীত, ঠিক তেমনি এই ধারার বিপরীতে এর একশ’ বিশ বছর পর সেনাবাহিনী থেকে মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাঙলা মুল্লুকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর কবি কাজী নজরুল ইসলামও দেখিয়ে দিলেন মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত বহুলাংশে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বাংশে তৎসম শব্দ অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ বর্জন করেও লেখা যায়।
আট
নজরুল সেনাবাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরেছিলেন উনিশশ’ বিশ সালের মার্চ মাসে। এর চার মাস পর ১৩৩৯ হিজরীর পহেলা মহররম ছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ৩০ ভাদ্র মোতাবেক ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর। নজরুল তখন শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক নবযুগের অন্যতম সহযোগী সম্পাদক। থাকেন কলকাতার ৮/৬ টার্নার স্ট্রিটে তার সহকর্মী ও সুহৃদ মুজফফ্র আহমদের সঙ্গে। সামনে ১০ মহররম ১৩৩৯ হিজরী [৮ আর্শ্বিন ১৩২৭ মোতাবেক ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২০] তারিখ শুক্রবার আশুরা। মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এর প্রথম বর্ষ : প্রথম খ- ষষ্ঠ সংখ্যার জন্য তিনি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত ইসলামী কবিতা ‘মোহররম’। প্রথম দুটো পঙক্তি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, সেখানে কোনো তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ নেই। নজরুল শুরুতেই অত্যন্ত আবেগ ও দরদ দিয়ে এবং গভীর মমত্ববোধ মিশিয়ে লিখেছেন :
“নীল সিয়া আস্মান, লালে লাল দুনিয়া-
আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।”
আরবী-ফার্সী শব্দবহুল এই বাঙলা পড়ে কারো বলার সাধ্য নেই যে, বাঙলা সংস্কৃতের দুহিতা। সংস্কৃত শব্দ স্বদেশী শব্দ এবং আরবী-ফার্সী শব্দ বিদেশী শব্দ! নত্ববিধান এবং ষত্ববিধান কেবল সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের জন্য প্রযোজ্য! ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ইন্তেকালের এবং ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরলোক গমনের এত দিন পর এবং ধ্বনিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবদুল হাই সাহেবের ইন্তেকালের এতদিন পর আমাদের কোনো বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে যখন ভাষাতত্ত্ববিদ নেই, ধ্বনিতত্ত্ববিদ নেই তখন কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুকরণে আমাদের মুসুল্লী প্রুফ রিডাররাও আমাদের শেখাচ্ছেন যে, ‘ইরান’ বানানের মূর্ধন্য ‘ন’ মূর্ধা বা মস্তক থেকে অর্থাৎ জিহ্বাগ্র তালুতে স্পৃষ্ট করে উচ্চার্য নয়; কেননা, এটা সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ নয়। সবই এখন চলছে।
নজরুলের জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় বাঙলাভাষী মুসলমানরাও যে বাঙলাভাষী মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে সচেতন ছিলেন সেটা সাতচল্লিশের মধ্য আগস্ট পূর্ববর্তীকালের মুসলিম মালিকানাধীন এবং মুসলিম সম্পাদিত সাময়িক পত্রগুলো লক্ষ্য করলেই উপলব্ধি করা যায়। বাঙলা সাহিত্যে নজরুল একমাত্র বড় কবি যিনি প্রতিবেশী সমাজের জন্য কীর্তন ভজন এবং শ্যামাসঙ্গীত পর্যন্ত লিখেছিলেন। সেখানে নজরুল আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যবহার করেননি। নজরুল বিশ্বাস করতেন যে, বাঙলাভাষী মুসলমানদের ভাষারও আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বাঙলাভাষী মুসলমানদের সংস্কৃতি ও বাঙলাভাষী হিন্দুর সংস্কৃতি এক নয়। বাঙলাভাষী মুসলমানদের ভাষা এবং সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটে গেছে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর।
http://old.dhakatimes24.com/2015/10/24/88048
শেখ দরবার আলম
নজরুল সাহিত্যে মহররম, এই বিষয়টার ওপর যদি লিখতে হয় তা হলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, ইসলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ছিল একটা আশ্রয়। মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতি-সত্তা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। তামাম বিশ্বের মুসলিম সভ্যতা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। কোরআন এবং সুন্নাভিত্তিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের আশ্রয়। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় আদর্শ মানুষ ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের আর্থ-সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক মহাবস্থানের কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় যে সব জায়গায় উল্লেখ করেছেন সেই সব জায়গায় তিনি যে মুসলমান ঘরের সন্তান, এই কথাটুকু বলে ক্ষান্ত হতে চাননি। তিনি বারংবার বলেছেন এবং লিখেছেন, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং নবীর উম্মত! কিন্তু তিনি কবি সবার। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সবার। এদিক দিয়েও বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ভূমিকা অনন্য।
দুই
বাংলা সাহিত্যে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের বাংলাভাষীদের মধ্যে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা বৈদিক, ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রুতী মনুসংহিতার সমাজের কবি-সাহিত্যিক হিসেবে লেখালেখি করেছেন এবং সেইভাবেই মূলত কাজ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বোধ হয় অনুশীলন সমিতির সভ্য মণিসিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের মতো ও যুগান্তর দলের সভ্যদের মতো এবং অনুশীলন সমিতিরি সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের মতো ও যুগান্তর দলের সভ্যদের মতো বলতে চাইতেন যে তিনি নাস্তিক। এ কথা বললে যথার্থ অহিন্দুদের কাছে এবং নাস্তিকদের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী, শিখ- এরকম কোনো ধর্মাবলম্বীর শুধু নাস্তিক হলে তাতে ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বিশ্বে মজলুম মুসলমানদের কারো কোনো উপকার হয় না। তারা নিজ নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সাথে পালন করলে তাতে মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ, তাদের কোনো ধর্ম গ্রন্থেই মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে বা কল্পনা করে জাতীয়তাবাদী হয়ে মজলুম মুসলমানদের অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হওয়ার এবং এর চূড়ান্ত রূপে পৌঁছে ফ্যাসীবাদী হওয়ার কোনো সংস্থান নেই।
ধর্মের ভিত্তিতে হোক, বর্ণের বা গায়ের রঙের ভিত্তিতে হোক, ভাষার ভিত্তিতে হোক কিংবা কোনো অঞ্চল বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে হোক, কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে তাদের অধিকার বঞ্চিত করার কোনো সংস্থান তৌহীদবাদ কেন্দ্রিক, আল্লাহর একত্ববাদ কেন্দ্রিক বা আল্লাহর ওয়ানলেনকেন্দ্রিক ইসলামের নেই। সাহিত্য ও ধর্ম শাস্ত্র যে এক জিনিস নয়, সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নজরুল যে সাম্য ও সহাবস্থানের কবি হতে চেয়েছিলেনি এবং সব ধর্মীয় সমাজের মানুষের কবি হতে প্রতিবেশী সমাজের জন্য আলাদা করেও অনেক কিছু লিখেছিলেন সে সবের মূল ভিত্তিটাও ঠিক এখানেই। এসব জানার এবং বোঝার চেষ্টা না করে বাংলাভাষী ইসলামপন্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিতজনদের কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অযথা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। এদের অনেকেরই ঘরে নজরুল রচনাবলী নেই। নজরুল সম্পর্কে পড়াশোনা করে ধারণা পোষণ করার প্রয়োজন আছে বলে এরা মনে করেন না। এরা নজরুল সম্পর্কে ধারণা পোষণ করেন নজরুল সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেন না, এমন লোকদের কাছ থেকে গুজব শুনে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল চর্চা উপেক্ষিত হওয়ায় এমনটা হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ তাদের একজাতিতত্ত্ব আরোপের দৃষ্টিভঙ্গিতে চান যে, তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ও এই জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত বিস্মৃত হয়ে হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা মুসলমানদের নিজেদের বলে মুসলমানরা গ্রহণ করুন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের এই আকাক্সক্ষার কারণে প্রতিবেশী বড় সমাজপ্রধান ভারতীয় উপমহাদেশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে যেমন, অনুরূপভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসেও খোদ পাকিস্তান আমলেও ১৯৪৮-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নজরুল সাহিত্যও অবশ্য পাঠ্য ছিল না। এই যখন বাস্তবতা তখন একটি দৈনিকে একজন এ বিষয়ে লিখলে কী জনরুল চর্চা হবে! সবার জানা উচিত এবং চিন্তা-ভাবনা করে দেখা উচিত যে, মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এ পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতি সত্তার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়ে দেয়ার ফলে আমাদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে নজরুল সাহিত্যে মহররম, এ রকম মুসলিম জাতিসত্ত্বা সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী অচ্ছ্যুৎ হয়ে আছে। এভাবে বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মুসলিম জাতিসত্তা হারাচ্ছে।
তিন
এই বাস্তবতাটা, এই সত্যটা আমাদের সবারই স্মরণ রাখা উচিত যে, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব বাংলাভাষীর বাংলা ভাষা অনেকাংশে এক হলেও তৌহিদবাদী মুসলমানদের বাংলা ভাষা এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের বাংলা ভাষা সর্বাংশে এক নয়। অনুরূপভাবে তৌহিদবাদী মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতি এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি, সাংস্কৃতি সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা উচিত। আমি এসব কথাগুলো অপরিহার্য প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই লিখছি। কেননা, এই কথাগুলো সবারই চিন্তা করে দেখা উচিত।
দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আবদুল গফুর সাহেব নজরুল সাহিত্যে কোরবানীর ঈদ, নজরুল সাহিত্যে ঈদুল ফিতর, নজরুল সাহিত্যে মহররম, এ রকম মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট এমন কোনো কোনো বিষয়ের ওপর লিখতে বলেন যে বিষয়গুলোর ওপর লিখতে বলার মানুষ এবং লেখার মানুষ তৈরি হওয়ার পথ এই মুসলিম প্রধান দেশেও ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টেই বন্ধ হয়ে গেছে।
বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ প্রধান স্বাধীন ভারতে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর পঠন-পাঠনের সংস্থান সেখানকার স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় নেই। সে সুযোগে এই মুসলিম প্রধান দেশেও এখানকার স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় নেই। মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করানোর ফলে খোদ পাকিস্তান আমল থেকেই এরকম একটা অবস্থা সৃষ্টি হতে পেরেছে। এ দেশে যারা ইসলামী আন্দোলন করেন তারাও এ বিষয়টির দিকে কখনো নজর দেননি।
চার
তামাম ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুসলিম সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ও এই মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত মুছে ফেলার অংশ হিসেবে এ ক্ষেত্রে নজরুল চর্চার পথও রুদ্ধ করার বন্দোবস্ত হয়েছে। কিন্তু নিজ নিজ সমাজের মানুষ হলে হিন্দুর ভাষা এবং সাহিত্য হবে এরকম এবং মুসলমানের ভাষা ও সাহিত্য হবে অন্যরকম।
বাংলায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট পূর্বপুরুষরা বৈদিক, ব্রাহ্মণ পূর্বপুরুষরা যেমন এসেছিলেন বাইরে থেকে, তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরব পূর্বপুরুষরাও এসেছিলেন বাইরে থেকে। ভারতে আসার পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরা বাংলায় এসেছিলেন কনৌজ বা কান্যকুঞ্জ থেকে। আর আরবের বাগদাদ থেকে ভারতে আসার পর কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুরুষরা বাংলায় এসেছিলেন বিহারের পাটনা থেকে।
হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তার প্রতি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেমন ছিল প্রচ- আবেগ এবং আকর্ষণ, অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সম্পর্কেও এই মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত, শিল্প, স্থাপত্য সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর মমত্ববোধ ও আকর্ষণ।
পাঁচ
অন্যতম রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত রবি জীবনীতে লিখেছেন যে, আধুনিক বাঙালি বলতে যাদের বোঝায় তারা এসেছেন বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। ঠিক অনুরূপভাবে আমরা যদি অষ্টম শতাব্দী থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার দিকে চোখ রাখি তা হলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো, সাহিত্যিক-সাংবাদিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের মতো এবং মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আব্দুল কাসেম ফজলুল হকের মতো, মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের মতো, মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো আধুনিক বাংলাভাষী মুসলমানরাও এসেছেন ভারতের বাইরের সাধারণত আরব বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্য এশিয়া থেকে। এভাবে আমরা দেখছি যে, আধুনিক বাঙালি হিন্দুদের যেমন রয়েছে বৈদিক ব্রাহ্মণশাসিত বর্ণ এ অধিকার ভেদাস্ত্রয়ী মনুসংহিতার সমাজের হিন্দু জাতিসত্ত্বার উত্তরাধিকার; অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি আধুনিক বাংলাভাষী মুসলমানদেরও রয়েছে মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার উত্তরাধিকার।
ছয়
আরবী ভাষাভাষী এলাকা ইরাকের বাগদাদে থাকতে নজরুলের পূর্ব পূরুষরা ছিলেন আরবীভাষী। হিন্দুস্থানে অর্থাৎ ভারতে এসে তার পূর্বপুরুষরা এক সময়ে হয়েছিলেন ফার্সীভাষী। পরে উর্দুভাষী।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু পূর্ববর্তী সভাপতি এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের পূর্বপুরুষরাও আরব থেকে এসেছিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদের জীবদ্দশায়ও তাঁদের পরিবারের মহিলারা গৃহপরিবেশে কথাবার্তা বলতেন ¯্রফে কেবল আরবী ভাষায়। মওলানা আবুল কালাম আজাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের মানুষজনদের সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুভাষায়।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে [১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ] কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাদের পরিবারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষার চর্চা ছিল। তাঁর আব্বা কাজী ফকীর আহমদ বাংলাভাষাও খুব ভালো মতো শিখেছিলেন। নজরুল তাঁর শৈশবে এবং বাল্যেই শিখেছিলেন আরবী, ফার্সী, উর্দু এবং বাংলা। কাজী নজরুল ইসলামের যখন জন্ম হয় তখন তাদের পরিবারের লোকেরা গৃহপরিবেশে কথাবার্তা বলতেন উর্দু ভাষায়।
সাত
১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের আগে কথ্য বাঙলা এবং দলিল দস্তাবেজ এবং চিঠিপত্রের বাংলা ছিল আরবী-ফার্সী শব্দবহুল বাঙলা। তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরাও পারিবারিক পর্যায়েও ফার্সী ভাষা চর্চা করতেন। রাজ ভাষা হিসেবেও ব্যবহারিক জীবনে ফার্সী ভাষার চর্চা তো করতেনই।
পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের বেয়াল্লিশ বছর সাত মাস পর ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজিভাষী স্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান সমাজের পাদ্রি উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর মিশনে। সংস্কৃতিক পণ্ডিত রামরাম বড়ুয়ার তালিমে আরবী-ফার্সী শব্দ রঞ্জিত এবং সংস্কৃত শব্দ বহুল খ্রিস্টান ধর্মীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সাবেক পাদুকা নির্মাতা পাদ্রী উইলিয়াম কেরী এর এক বছর দু’মাস পর ১৮০১-এর মে মাসে ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে অধীনস্থ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সহযোগিতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বাঙলাভাষা শেখানের জন্য আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত কেবল নয়, তামাম মুসলিম সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা বর্জিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেন। কালক্রমে এই ধরনের বাঙলা পাঠ্যপুস্তকই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ হলো।
শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠার এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ বছর পর মীর মশাররফ হোসেন [১৮৪৭-১৯১২]-এর জন্ম। পাঠশালায় এবং স্কুলের পাঠ্য পুস্তকে এবং সে সময়কার হিন্দুদের লেখা সাহিত্যে আরবী-ফার্সী বর্জিত সংস্কৃত শব্দবহুল যে ধরনের বাঙলা ভাষার প্রচলন মীর মশাররফ হোসেন দেখেছিলেন ঠিক সে ভাষাতেই তিনি ইসলামের ইতিহাসের কারবালার ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন ‘বিষাদসিন্ধু’ [১৮৮৫-১৮৯১]।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম মীর মশাররফ হোসেনের জন্মের বাহান্ন বছর পর। তিনিও কেবল পাঠশালায় নয়, মক্তবে এবং স্কুলেও আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত সংস্কৃত শব্দবহুল বাঙলাই শিখেছিলেন। হিন্দুদের লেখা অন্যান্য কাজ এবং সাহিত্যে ও শিখেছিলেন এই একই ভাষা। কিন্তু মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে তিনি যখন কাব্য ও সাহিত্য সৃষ্টি করলেন এবং গান লিখলেন তখন এই বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে তিনি সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ যথাসম্ভব বর্জন করে ব্যবহার করলেন প্রচুর আরবী-ফার্সী শব্দ।
প্রথমে শ্রীরামপুর মিশনে এবং পরে আরো ব্যাপকভাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে খ্রিস্টান পাদ্রী এবং সংস্কৃতজ্ঞ হিন্দু প-িতরা মিলে একশ’ বিশ বছর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই যেমন দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, লিখিত বাংলাভাষা হবে সম্পূর্ণরূপে আরবী-ফার্সী শব্দবর্জিত সংস্কৃত শব্দ বহুল ভাষা এবং বাঙলা সাহিত্য-সঙ্গীত হবে কেবল কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তাসংশ্লিষ্ট সাহিত্য ও সঙ্গীত, ঠিক তেমনি এই ধারার বিপরীতে এর একশ’ বিশ বছর পর সেনাবাহিনী থেকে মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাঙলা মুল্লুকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর কবি কাজী নজরুল ইসলামও দেখিয়ে দিলেন মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরস্পরা এবং এই পরস্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত বহুলাংশে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বাংশে তৎসম শব্দ অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ বর্জন করেও লেখা যায়।
আট
নজরুল সেনাবাহিনী থেকে কলকাতায় ফিরেছিলেন উনিশশ’ বিশ সালের মার্চ মাসে। এর চার মাস পর ১৩৩৯ হিজরীর পহেলা মহররম ছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ৩০ ভাদ্র মোতাবেক ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর। নজরুল তখন শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক নবযুগের অন্যতম সহযোগী সম্পাদক। থাকেন কলকাতার ৮/৬ টার্নার স্ট্রিটে তার সহকর্মী ও সুহৃদ মুজফফ্র আহমদের সঙ্গে। সামনে ১০ মহররম ১৩৩৯ হিজরী [৮ আর্শ্বিন ১৩২৭ মোতাবেক ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২০] তারিখ শুক্রবার আশুরা। মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এর প্রথম বর্ষ : প্রথম খ- ষষ্ঠ সংখ্যার জন্য তিনি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত ইসলামী কবিতা ‘মোহররম’। প্রথম দুটো পঙক্তি লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, সেখানে কোনো তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ নেই। নজরুল শুরুতেই অত্যন্ত আবেগ ও দরদ দিয়ে এবং গভীর মমত্ববোধ মিশিয়ে লিখেছেন :
“নীল সিয়া আস্মান, লালে লাল দুনিয়া-
আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।”
আরবী-ফার্সী শব্দবহুল এই বাঙলা পড়ে কারো বলার সাধ্য নেই যে, বাঙলা সংস্কৃতের দুহিতা। সংস্কৃত শব্দ স্বদেশী শব্দ এবং আরবী-ফার্সী শব্দ বিদেশী শব্দ! নত্ববিধান এবং ষত্ববিধান কেবল সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের জন্য প্রযোজ্য! ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ইন্তেকালের এবং ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরলোক গমনের এত দিন পর এবং ধ্বনিতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবদুল হাই সাহেবের ইন্তেকালের এতদিন পর আমাদের কোনো বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে যখন ভাষাতত্ত্ববিদ নেই, ধ্বনিতত্ত্ববিদ নেই তখন কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুকরণে আমাদের মুসুল্লী প্রুফ রিডাররাও আমাদের শেখাচ্ছেন যে, ‘ইরান’ বানানের মূর্ধন্য ‘ন’ মূর্ধা বা মস্তক থেকে অর্থাৎ জিহ্বাগ্র তালুতে স্পৃষ্ট করে উচ্চার্য নয়; কেননা, এটা সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ নয়। সবই এখন চলছে।
নজরুলের জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় বাঙলাভাষী মুসলমানরাও যে বাঙলাভাষী মুসলমান সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে সচেতন ছিলেন সেটা সাতচল্লিশের মধ্য আগস্ট পূর্ববর্তীকালের মুসলিম মালিকানাধীন এবং মুসলিম সম্পাদিত সাময়িক পত্রগুলো লক্ষ্য করলেই উপলব্ধি করা যায়। বাঙলা সাহিত্যে নজরুল একমাত্র বড় কবি যিনি প্রতিবেশী সমাজের জন্য কীর্তন ভজন এবং শ্যামাসঙ্গীত পর্যন্ত লিখেছিলেন। সেখানে নজরুল আরবী, ফার্সী শব্দ ব্যবহার করেননি। নজরুল বিশ্বাস করতেন যে, বাঙলাভাষী মুসলমানদের ভাষারও আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বাঙলাভাষী মুসলমানদের সংস্কৃতি ও বাঙলাভাষী হিন্দুর সংস্কৃতি এক নয়। বাঙলাভাষী মুসলমানদের ভাষা এবং সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটে গেছে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর।
http://old.dhakatimes24.com/2015/10/24/88048
No comments:
Post a Comment