শেখ মুজিব হত্যা ও বাংলাদেশ ঘিরে ভারতীয় রাজনীতির ষড়যন্ত্রের নানান দিক ।
একশত বছরের রাজনীতি বইয়ের আলোকে ।
উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলির ভূমিকাঃ বঙ্গভূমির আন্দোলনে চারটি গ্রুপের প্রত্যেকেই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। অন্যরা আরএসএস ও আনন্দমার্গের আজ্ঞাবাহী। তাছাড়া ভারত সেবাশ্রম সংঘ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষধ নানাভাবেই বঙ্গভূমি আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। আছে সন্তান দলও। কালিদাস বাবু বলেন, তিনি প্রত্যেকের কাছেই গিয়েছিলেন তবে কেউই বিশেষ সাহায্য করেনি। তবে ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী বিজয়ানন্দ মহারাজ বিভিন্ন সভায় এসে তাঁদের আশীর্বাদ করেছেন। আনন্দমার্গ আমরা বাঙালীর মাধ্যমে কাজ করছে বঙ্গভূমির পক্ষে। কালিদাস বৈদ্য জানান, চিত্ত ছুতোরের মাধ্যমে আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাংলাদেশে ‘বঙ্গভূমি’ সংগঠকদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংগঠক ডাঃ সুরঞ্জিত ধর এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সুব্রত চট্টেপাধ্যয় জানান, বাংলাদেশে ‘হিন্দু লীগ’ গড়া হয়েছে তাদেঁরই পরামর্শে। বিশ্বহিন্দু পরিষদের সাথে যোগাযোগ আছে। তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। ডাঃ ধরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাধারণভাবে আর এস এস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বঙ্গভূমির দৃঢ় সমর্থক বলে বঙ্গভূমি আন্দোলনের কর্মী ও সমর্থকদের বিশ্বাস। বিএলও নেতা সুব্রত চট্টোপাধ্যয় জনসংঘের পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি। বিভিন্ন জায়গায় তিনি হিন্দু সম্মেলন করে থাকেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিজেপি এবং জনসংঘ অনুপ্রবেশ নিয়ে কিছুদিন ধরে যে হল্লা শুরু করেছে সেটাও বঙ্গভূমিওয়ালাদের হাতকেই শক্ত করছে।
ঐক্য প্রচেষ্টাঃ বঙ্গভূমির দাবীদার বিভিন্ন গ্রুপগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য, আন্দোলনকে জোরদার করা। এ ব্যাপারে কয়েকটা সভাও হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরই নাকি বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে চিত্তবাবুর বাড়িতে বসেই তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ অনুগামী জানান, এসবের মধ্যে চিত্ত বাবু নেই। টেলিফোনে একই কথা বলেন চিত্ত বাবুর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দেবী। কালিদাস বাবু এবং সুব্রত বাবু কিছু না বললেও, বিএলটি নেতারা জানিয়েছেন, চিত্ত বাবুর মধ্যস্থতায় অন্তত একটি ‘সমন্বয় কমিটি’ করার জন্য তাঁরা বিশেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে, বাঙালীকে আরেকবার ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা”।–[দৈনিক আজকাল, কোলকাতা, ২২, ২৩ এবং ২৪শে এপ্রিল, ১৯৮৯]
কোলকাতার দৈনি আজকালের এই রিপোর্ট এতই সুস্পষ্ট যে, ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এই রিপোর্ট থেকে কয়েকটা বিষয় পারিস্কারভাবে জানা গেলঃ (১) বাংলাদেশ বিরোধী এক সক্রিয় ষড়যন্ত্র সীমান্তের ওপারে দানা বেঁধে উঠছে, যার সাথে জড়িত আছে ভারতের নামকরা রাজনীতিক ও পলিটিশিয়ান, (২) এই ষড়যন্ত্রকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে আর এস, এস, বিশ্ব-হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, আনন্দমার্গ ও ভারত সেবা সংঘ এবং পরোক্ষভাবে এর পেছনে রয়েছে ভারতের ক্ষমহাসীন দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, (৩) এই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, আনন্দমার্গ এবং চাকমাদের শান্তিবাহিনী, (৪) এই ষড়যন্ত্রের আশু লক্ষ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করা, আর দূরবর্তী লক্ষ্য হলো অসন্তোষ ও সাস্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি করে ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনা, এবং (৫) বাংলাদেশের কিছু দল ও ব্যক্তির সাথে এই ষড়যন্ত্র অথবা ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ ঘিরে ভারতীয় রাজনীতির এই হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করা।–[ষড়যন্ত্রের তৃতীয় আরেকটা ফ্রন্টও খোলা হয়েছে। সেটা হলো ‘যুক্তবাংলা’র ষড়যন্ত্র। দিল্লী থেকে পশ্চিম বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে এই ‘যুক্তবাংলা’র কথা কোলকাতায় নয়, বাংলাদেশকে ছড়ানো হচ্ছে। এরও গোপন লক্ষ্য বাংলাদেশ ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করা।] ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর অবাধ বাক-স্বাধীনতা এবং অঢেল পত্র-পত্রিকার প্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই ক্ষেত্রেও ভারত কেন্দ্রীক ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত যে কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা ও লিখা অসম্ভব ছিল, তা এই সময় বলা শুরু হয়েছে। মনে পড়ে ’৯১ সালের সম্ভবত নভেম্বরের দিকে একটা পুস্তিকা আমার হাতে আসে। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা (যিনি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা ছিলেন এবং মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজনের একজন ছিলেন) পরিচালিত একটি সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক বলে পরিচয়দানকারী জনৈক ব্যক্তি আরেকজন সহ এসে ঐ পুস্তিকাটি আমাদের দিয়েছিলেন। পুস্তিকাটির নাম ‘A Heretic’, যার অর্থ ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ বা ‘বিদ্রোহী’। প্রকাশক হিসেবে নাম আছে জনৈক সৈয়দ ফয়জুর রহমানের আর প্রকাশের স্থান ৪ নং নিউ সার্কুরার রোড। পুস্তিকাটিতে অখণ্ড ভারতের পক্ষে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেক কথার সাথে বলা হয়েছে, “এই উপমহাদেশই আমাদের দেশ এবং আমরা এই উপমহাদেশের নাগরিক হিসেবেই বাঁচতে চাই। কেটে বিচ্ছিন্ন করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ পুনঃসংযোজিত করার সক্রিয় আন্দোলনই আমাদের প্রত্যাশা পূরণের পথ রচনা করতে পারে”। এই ঘটনার কিছুদিন পর ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকার কাকরাইল এলাকার একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট একটা অভূতপূর্ব সাংবাদিক সম্মেলন হলো। এ ধরনের কোন সাংবাদিক সম্মেলন ’৪৭-উত্তর কালে বাংলাদেশে হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলনকারী সংগঠনকির নাম হলো ‘Continent Resurrection Movement’ বা ‘উপমহাদেশ পুনর্জীবন আন্দোলন’। তারা আহুত সাংবাদিকদের মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে জানারেন, তাদের লক্ষ্য উপমহাদেশের অখণ্ডতা। তাঁরা ’৪৭ এবং ’৭১-এর বিভক্তি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষন করেন’।–[দৈনিক বাংলা’, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৯১।] এই সাংবাদিক সম্মেলনের মাত্র একদিন পর ৩১শে ডিসেম্বর ’৯১ তারিখে ঢাকা পিজি হাসপাতাল মিলনায়তনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।–[দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯১।] সেমিনারের বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদসহ আরও অনেকে। ভারত থেকে কংগ্রেস সমর্থক মওলানা আসাদ মাদানী এ সেমিনারে যোগদান করেন। সেমিনারে মূল বক্তব্য ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করা এবং মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযমের উপর ভারত-বিভাগের দায় চাপানো। যেমন মওলানা আসাদ মাদানি বলেন, “মুসলিম লীগের পাশ্চাত্যায়ন ও বৃটিশ আনুগত্য অনুসারে নেতৃবর্গ লাহোর সম্মেলনে ‘পাকিস্তান’ নামে মুসলমানদের জন্যে পৃথক ভূ-খণ্ডের দাবী তোলেন। —এভাবেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে”।–[কংগ্রেসী নেতা মওলানা আসাদ মাদানী এদেশবাদীসে উল্টো কথা শুনিয়েছেন। কংগ্রেসের অপরাধ আড়াল করা এবং অখণ্ড ভারত গড়ার আন্দোলনকে ভারতের জন্যে যৌক্তিক করার জন্যেই তিনি মিথ্যাচার করেছেন। এ মিথ্যাচারের জবাব সে সময়ের ইতিহাস। এখানে শুধু মহাত্মা গান্ধীর বন্ধু পণ্ডিত সুন্দর লাল-এর একটা বক্তব্য মাত্র তুলে ধরছি। তিনি তাঁর ‘Who was responsible for the partition of India’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভারত বিভাগের চিন্তা সর্বপ্রথম করেন লালা লাজপাত রায়। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে এ দাবীর পক্ষে কথা বলতে পারেননি উচ্চ বর্ণের নেতারা। তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে এমন কৌশল অবলম্বন করেন যাতে ভারত ভাগও হয় এবং তার দোষটা গিয়ে মুসলমানদের উপর পড়ে। বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা তাদের কাজের দ্বারা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে মুসলমানরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হন যে, ভারত বিভাগের মধ্যেই তাদের মঙ্গল নিহিত (The congress encouraged the Muslim League ….by action that league feel that in a free (united) India Muslim interest would not protected.)” হিন্দু কংগ্রেস এবং ভারতের বর্ণবাদী নেতারা একাজটি কোন লক্ষ্যে কোন যুক্তিতে করেছিলেন তাও পণ্ডিত সুন্দরজী প্রকাশ করেছেন। মিঃ সুন্দরজীর ভাষায় সেই যুক্তিগুলি ছিলঃ “দেখ এই সুযোগ হারিও না। আর না আসতে পারে সহজে এই সুযোগ। দু’টো অংশকে কেটে ফেল- একটি পূর্বে একটি পশ্চিমে। অবশিষ্ট বড় ও মূল অংশটি আমাদের হাতে থাকবে। কোন অহিন্দু আমাদের অংশে থাকতে সাহস করবে না, থাকলেও আমাদের মত হয়ে থাকবে। ভারতের যে দু’অংশ দু’পাশে থাকল, আমরা শক্তি অর্জন করার পর ঐ দু’টোকে পরে আমরা দেখে নেব”। (Reiance, Delhi, August 13, 1967).] আর জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমদ বলেন, “বাংলাদেশের জনগণকেও দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বাদ দিয়ে নতুন আদর্শে চিন্তা ভাবনা করতে হবে”।–[‘দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯২।] পিজি সেমিনারেরর ৩০ দিন পর সাপ্তাহিক বিচিন্তা ‘উপমহাদেশের মানচিত্রের আসন্ন পরিবর্তন’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে।–[৩১শে জানুয়ারী, ১৯৯২ তারিখে ‘বিচিন্তা’র এ সংখ্যা প্রকাশিত হয়।] এ কাহিনীতে রয়েছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর উপর একটি রিপোর্ট এবং এ আন্দোলনের নেতার একটি সাক্ষাতকার। রিপোর্ট এবং সাক্ষাৎকার দু’টিতেই দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে কথা বলা হয়েছে। ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়ঃ “অযৌক্তিক এবং অন্যান্য বিভক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সক্রিয় ছিলেন উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু রাজনীতিক। ….এসব জ্যৈষ্ঠ প্রজন্মের রাজনীতিকরা আবার নতুন করে তাদের রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চাইছেন। …..এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’। এই পটভূমি বর্ণনা করার পর বাংলাদেশে এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন,তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। এঁরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ ও জাসদ করতেন। এছাড়াও বলা হয়েছে, “…..তাঁদের পেছনে জাতীয় পর্যায়ের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিকও রয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাসদ-এর সর্বোচ্চ দু’জন নেতা এই প্রক্রিয়ার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত”। এছাড়া উক্ত প্রচ্ছদ কাহিনীতে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর নেতার যে সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছেতাতে উক্ত নেতা বলেছেন, “ঠিক ’৪৭-এর আগস্টের পূর্বে ভেঙ্গে যাবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। …..আমরা পুরো উপমহাদেশকে ভাষাভিত্তিক একটি ফেডারেশনে বাঁধতে চাই। দু’পাঞ্জাব আর দিল্লী নিয়ে একটি, আরাকান-কাচীন নিয়ে একটি, শ্রীলংকার তামিল আর মাদ্রাজ নিয়ে একটি, আসাম-মেঘালয় বাংলাদেশ নিয়ে একটি, বেলুচদের নিয়ে একটি। ….ভারতের আগ্রহেই এটা হচ্ছে”।
দ্বি-জাতিতত্ত্ব মুছে ফেলা এবং অখণ্ড ভারত গঠনের লক্ষ্যে সাহিত্য-সিনেমা ক্ষেত্রেও ভারতে কাজ হচ্ছে। এ লক্ষ্যে অনেক উপন্যাস-কাহিনী গড়ে উঠেছে। তার ভিত্তিতে চলচ্চিত্রও তৈরীর চেষ্টা চলছে। একটা দৃষ্টান্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিভক্ত দুই পারের মর্ম-যাতনা দেখানো হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে অখণ্ডত্বের একটা আবেদন বিমূর্ত হয়ে উঠে। এ উপন্যাসের ভিত্তিতে সীমান্তের দুই পারের যৌথ উদ্যেঅগে চলচ্চিত্র নির্মানের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সুনীল বাবুরা ঢাকায় এসে এ লক্ষ্যে একটা উদ্বোধনী সাংবাদিক সম্মেলনও করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সম্ভবত উদ্যোগটাকে স্থগিত রাখা হয়েছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী কাজ বাংলাদেশ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও হচ্ছে। একশ্রেণীর নবজাত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও ম্যাগাজিন প্রকাশ্যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের পক্ষের এই তৎপরতাগুলো, আগেই বলা হয়েছে, ভারত যে রাজনীতি চর্চা করছে তারই একটা রূপ। এ বিষয়টা প্রকাশও পেয়েছে ঐ সব তৎপরতার মধ্য দিয়ে। এই প্রকাশের মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ সেই ’৪৭ থেকে ভারত যা চাচ্ছিল তাই সে করছে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এখানে দুইটি। একটি হলো, হঠাৎ করে ’৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতমুখী তৎপরতা মাথা তুলে দাঁড়ানো। দ্বিথীয়টি এই তৎপরতার সাথে আওয়ামী লীগ ও জাসদের একটা অংশ সংশ্লিষ্ট হওয়া। অবশ্য গভীরভাবে একটু চিন্তা করলে এ বিস্ময় আর থঅকে না কারণ বাংলাদেশে প্রথম ধারার যে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, তার কাছে দ্বি-জাতিতত্ত্ব একটি অসার বস্তু এবং সেই হেতু মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ কারণেই এই ধারার রাজনীতির পক্ষ থেকে উপরোক্ত রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ উত্থিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ’৯১ থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও ভারতের অখণ্ডতামুখী তৎপরতা মাথা তুলেছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে অবাধ বাক-স্বাধীনতা ও বিপুল সংখ্যায় পত্র-পত্রিকা প্রকাশের সুযোগে।
একানব্বই থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের অখণ্ডতামুখী রাজনীতি বাংলাদেশে মাথা তোলার পর থেকে এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হলো, বাংলাদেশে নবোত্থিত এই রাজনীতি সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এসবের পাহারাদার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলোৎপাটন না করলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের মূলোচ্ছেদ করা যায় না বলেই এই অভিযান। এই অভিযান শুরু করলে প্রথম ধারার রাজনীতির সাথে স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত বেধেছে দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির। দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা আগেই বলেছি, জামায়াতে ইসলামী এবং ঘটনাক্রমে এই জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধকে মুসলমানদের স্বাধীনতা বিরোধী ভারতের একটি তৎপরতা বলে অভিহিত করে। এ বিষয়টা প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্যে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এই অস্ত্র দিয়ে জামায়াতে ইসলামী তথা দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মুণ্ডুপাত করার মোক্ষম সুযোগ করে নিয়েছে। এই লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারলে, তারা মনে করছে, শুধু জামায়াতে ইসলামীর মুণ্ডুপাত হবে না, মূলোচ্ছেদ হবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির, মূলোৎপাট ঘটবে দ্বি-জাতিতত্ত্বের এবং সেই সাথে স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশেরও। এর অর্থ বাংলাদেশ দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং এ ধারার রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামী শুধু ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, শুধু দ্বি-জাতিতত্ত্ব নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও একটা গ্যারান্টি।
বাংলাদেশে প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যেকার এই সংঘাতকেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। ১৯৯৩ সালের ২২শে জুন নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বয় কমিটির ৮ম বিশেষ সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে রাজনৈতিক মূল্যায়নে বলা হয়, “বাংলাদেশে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সম্ভবত এটাই শেষ যুদ্ধ। একদল চাইছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অপর দল চাইছে বাংলাদেশে স্বাধীনতার অধ্যায় মুছে ফেলতে এবং প্যান ইসলামিক স্রোতের সাথে মিশে যেতে। অশুভ মৌলবাদী শক্তিগুলো সুপরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ….একটি আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির পতাকা সমুন্নত রাখতে ভারতের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে”।–[বাংলা বাজার পত্রিকা ২৩শে আগস্ট ১৯৯৩।]
ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মূল্যায়ন রিপোর্টকে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ৪৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী রিপোর্ট দিল্লীতে পাঠানো হয়েছে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি বলতে বাংলাদেশের প্রথম ধারার রাজনীতি অর্থাৎ ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ধারা বলতে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টেও জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, ঠিক যেমন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক ধারাটি জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করে থাকে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশে উল্লেখিত দুই ধারা বা পক্ষের সংঘাতকে ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা এবং এই শেষ যুদ্ধে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারার পক্ষ নেয়াকে ভারতের জন্যে নৈতিক দায়িত্ব বলা। কংগ্রেস তার এই বক্তব্য দ্বারা নতুন করে জানিয়ে দিল, বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির সাথে শুধু আরএসএস বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, শিবসেনানয় কংগ্রেসসহ গোটা ভারতই শ্যামল রয়েছে। তবে এ কথা না বললেও চলতো। কারণ কারো অজানা নয় যে, কংগ্রেসীরা এ যুদ্ধে আগে থেকে শামিল রয়েছে। বরং উপরের গোটা আলোচনায় এ বিষয়টা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে, বাংলাদেশের এ যুদ্ধটা ভারতেরই যুদ্ধ।
তবে কংগ্রেস ঐভাবে কথা বলে একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির মর্যাদাকে যেমন ভুলুণ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দ্বিতীয় ধারাটির আদর্শিক নেতা জামায়াতের মর্যাদাকে আকাশচুম্বী করে দিয়েছে। কংগ্রেসের রিপোর্ট বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি যথেষ্ট নয়, তাদের সহযোগিতার জন্যে ভারতকেও যুদ্ধে নামতে হচ্ছে। এর দ্বারা কংগ্রেস না চাইলেও এবং বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ধারাটি না চাইলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাটি। বাংলাদেশী মুসলিম জনগণের ত্রাতায় পরিণত হয়েছে এবং তার স্বাধীনতার সংরক্ষণকারীর স্থান লাভ করেছে। দ্বিতীয় এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থীরা এবং এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থিরা এবং এই ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলো বিএনপি। বিএনপির স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক। বিএনপির এই বৈশিষ্ট্যই দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দল ও বিএনপি’র জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এই রাজণৈতিক মেরুকরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে যেমন শক্তিশালী করেছে, তেমনি দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের করেছে দিশেহারা। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা রাজনীতির এই জোটগত মেরুকরণ ভাঙার জন্যে করিয়া।
একটা বিষয় কিন্তু অস্পষ্ট থাকছে, বাংলাদেশের উপরোক্ত রাজণৈতিক সংঘাতকে ভারতের কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেস যুদ্ধ’ বলছে কেন? তাহলে কি কংগ্রেস বাংলাদেশের আয়ু জেনে ফেলেছে? জেনে ফেলেছে যে, এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থাকছে না? এর অর্থ কি এই যে, কংগ্রেস ধরে নিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা জয়লাভ করবে এবং তার ফলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের কবর রচিত হবে এবং বাংলাদেশ নামক কোন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে না? বাংলাদেশ না থাকলে বাংলাদেশে আর কোন যুদ্ধেরও প্রশ্ন উঠবে না। সুতরাং এটাই হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ। সন্দেহ নেই কংগ্রেস হয়তো এভাবেই চিন্তা করেছে।
কংগ্রেসের এই চিন্তা ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার চিন্তার অনুরূপ। ফ্যান্সিস ফকুয়ামা পৃথিবীর শেষ যুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন এবং এর মাধ্যমে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছেন।–[‘The end of History’, Fransis Fukuyama, The National Interest, Summer, 1989.] ফুকুয়ামার মতে সেই যুদ্ধটা সংঘটিত হবে ধর্মীয় আদর্শবাদের সাথে পশ্চিমী ‘উদার নৈতিক গণতন্ত্রের’, যা ভৌগলিক জাতীয়তার সীমা অতিক্রম করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে এবং ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করবে। অনেক ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই ফকুয়ামার প্রতিবাদ করেছেন।–[‘The Return of History’ নিবন্ধে Flora Lewis (Sais Review-summer 1990), Responses to Fukuyama’ প্রবন্ধে Allan Bloom (The National Interest, Summer 1989), More Resposes to Fukiyama’ প্রবন্ধে Timothey Fuller The National Interest, Summer, 1989)’, ‘The errors of Endisim’ প্রবন্ধে Samuel p. Huntington (The National Interest, 1989) এবং ‘Huntington’s fault lines’ and Fukuyama’s end of History’: An appraisal’ প্রবন্ধে Tujul Islam Hashmi (Holiday, Dec. 31, 1993) এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত ও আকর্ষণীয় আলোচনা করেছেন।] বলেছেন সমাজ ও সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিষয় ও উপাদানগুলোকে ফুকুয়ামা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ফুকুয়ামার সমাজ-সভ্যতার সরলীকরণ তত্ত্বটা একেবারেই অবাস্তব। ফুকুয়ামা যা চেয়েছেন তেমন শেষ যুদ্ধও যেমন সামনে নেই, তেমনি ইতিহাসের গতিও রুদ্ধ হচ্ছে না। ভারতীয় কংগ্রেসের ‘শেষ যুদ্ধ’ সম্পর্কেও এই একই কথা। বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যত বড় আশাই করুক, একশ্রেণীর ভারতীয়দের বিশেষ রাজনীতি এর প্রতি যতই সাহায্যের হাত বাড়াক, বাংলাদেশের জনগণ এবং জনগণের আদর্শের শক্তির চাইতে তা বড় হবে না। ’৯৬ সালে এই রাজনীতির বিজয় হয়েছিল, কিন্তু ২০০১ সালে এসেই সে রাজনীতির পরাজয় ঘটেছে। জনগণ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ধর্মবিরোধী, সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির চেহারা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সুতরাং কোন যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ নয় এবং বাংলাদেশে কোন শেষ যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশাগত উপাদান বাদ দিলে এখানে বৈপরীত্যের চেয়ে সমন্বয়ের এই উপাদানগুলিই মৌল প্রকৃতির। বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি প্রকৃতপক্ষে বিদেশাগত বিজাতীয় অনুপ্রবেশের ফল। কিন্তু এ ধারাটির যারা ধারক তাদের হৃদয় ধর্মীয় আদর্শবাদমুক্ত নয়, মুক্ত করাও সম্ভব নয়। তাইতো আমরা দেখি, ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেন তাদের অনেকেই এমনকি তাহাজ্জুদগোজারও।–[আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলেন, তাদের অনেকে তাহাজ্জুদ নামাজও পড়েন। এমনকি কম্যুনিষ্ট বলে পরিচিত লোকরাও আজান হলে অনেকে মসজিদে দৌড়ান। তাদের হৃদয় যে ঈমান দৃপ্তি এটা তারই প্রমাণ। আমি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ড্রইং রূপে যেদিন কোরআন দেখলাম, যায়নামাজ দেখলাম, সেদিন সত্যিই আমার বুকটা এক অনাস্বাদিত গৌরবে ভরে গিয়েছিল। এই ঈমান তাদের রাজনীতির চেয়ে বড়, সময় এলেই তার প্রমাণ তারা দেবে। এমনও হতে পারে দ্বিতীয় ধারার যে রাজনীতি, সে রাজনীতির প্রধান শক্তি তারাই হয়ে দাঁড়াবে।] এছাড়া রয়েছে জনগণের চাপ। ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেছেন, তারা কিন্তু তাদের পরিচয় জনগণকে বলতে সাহস পান না। বরং তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ স্লোগান নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হন। সুতরাং দেশের শিক্ষার হার আরও বাড়লে, জনগণ আরও সচেতন হলে এবং দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে দেশে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি আর থাকবে না এবং দেশের রাজনীতিতে আদর্শিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ সুদিনের আগমন কতদূরে তা নির্ভর করছে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দ্বিতীয় রাজনৈতিক ধারাটির ইতিবাচক ও স্বাধীন রাজনীতির সংহতি ও শক্তিবৃদ্ধি এবং সার্বিক সচেতনতা ও গণজাগরণের উপর।
একশত বছরের রাজনীতি বইয়ের আলোকে ।
উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলির ভূমিকাঃ বঙ্গভূমির আন্দোলনে চারটি গ্রুপের প্রত্যেকেই একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। অন্যরা আরএসএস ও আনন্দমার্গের আজ্ঞাবাহী। তাছাড়া ভারত সেবাশ্রম সংঘ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষধ নানাভাবেই বঙ্গভূমি আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। আছে সন্তান দলও। কালিদাস বাবু বলেন, তিনি প্রত্যেকের কাছেই গিয়েছিলেন তবে কেউই বিশেষ সাহায্য করেনি। তবে ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী বিজয়ানন্দ মহারাজ বিভিন্ন সভায় এসে তাঁদের আশীর্বাদ করেছেন। আনন্দমার্গ আমরা বাঙালীর মাধ্যমে কাজ করছে বঙ্গভূমির পক্ষে। কালিদাস বৈদ্য জানান, চিত্ত ছুতোরের মাধ্যমে আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাংলাদেশে ‘বঙ্গভূমি’ সংগঠকদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংগঠক ডাঃ সুরঞ্জিত ধর এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সুব্রত চট্টেপাধ্যয় জানান, বাংলাদেশে ‘হিন্দু লীগ’ গড়া হয়েছে তাদেঁরই পরামর্শে। বিশ্বহিন্দু পরিষদের সাথে যোগাযোগ আছে। তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। ডাঃ ধরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাধারণভাবে আর এস এস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বঙ্গভূমির দৃঢ় সমর্থক বলে বঙ্গভূমি আন্দোলনের কর্মী ও সমর্থকদের বিশ্বাস। বিএলও নেতা সুব্রত চট্টোপাধ্যয় জনসংঘের পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের সভাপতি। বিভিন্ন জায়গায় তিনি হিন্দু সম্মেলন করে থাকেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিজেপি এবং জনসংঘ অনুপ্রবেশ নিয়ে কিছুদিন ধরে যে হল্লা শুরু করেছে সেটাও বঙ্গভূমিওয়ালাদের হাতকেই শক্ত করছে।
ঐক্য প্রচেষ্টাঃ বঙ্গভূমির দাবীদার বিভিন্ন গ্রুপগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য, আন্দোলনকে জোরদার করা। এ ব্যাপারে কয়েকটা সভাও হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে চিত্ত ছুতোরই নাকি বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে চিত্তবাবুর বাড়িতে বসেই তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ অনুগামী জানান, এসবের মধ্যে চিত্ত বাবু নেই। টেলিফোনে একই কথা বলেন চিত্ত বাবুর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দেবী। কালিদাস বাবু এবং সুব্রত বাবু কিছু না বললেও, বিএলটি নেতারা জানিয়েছেন, চিত্ত বাবুর মধ্যস্থতায় অন্তত একটি ‘সমন্বয় কমিটি’ করার জন্য তাঁরা বিশেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে, বাঙালীকে আরেকবার ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা”।–[দৈনিক আজকাল, কোলকাতা, ২২, ২৩ এবং ২৪শে এপ্রিল, ১৯৮৯]
কোলকাতার দৈনি আজকালের এই রিপোর্ট এতই সুস্পষ্ট যে, ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এই রিপোর্ট থেকে কয়েকটা বিষয় পারিস্কারভাবে জানা গেলঃ (১) বাংলাদেশ বিরোধী এক সক্রিয় ষড়যন্ত্র সীমান্তের ওপারে দানা বেঁধে উঠছে, যার সাথে জড়িত আছে ভারতের নামকরা রাজনীতিক ও পলিটিশিয়ান, (২) এই ষড়যন্ত্রকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে আর এস, এস, বিশ্ব-হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, আনন্দমার্গ ও ভারত সেবা সংঘ এবং পরোক্ষভাবে এর পেছনে রয়েছে ভারতের ক্ষমহাসীন দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, (৩) এই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, আনন্দমার্গ এবং চাকমাদের শান্তিবাহিনী, (৪) এই ষড়যন্ত্রের আশু লক্ষ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করা, আর দূরবর্তী লক্ষ্য হলো অসন্তোষ ও সাস্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি করে ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনা, এবং (৫) বাংলাদেশের কিছু দল ও ব্যক্তির সাথে এই ষড়যন্ত্র অথবা ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ ঘিরে ভারতীয় রাজনীতির এই হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করা।–[ষড়যন্ত্রের তৃতীয় আরেকটা ফ্রন্টও খোলা হয়েছে। সেটা হলো ‘যুক্তবাংলা’র ষড়যন্ত্র। দিল্লী থেকে পশ্চিম বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে এই ‘যুক্তবাংলা’র কথা কোলকাতায় নয়, বাংলাদেশকে ছড়ানো হচ্ছে। এরও গোপন লক্ষ্য বাংলাদেশ ভারতীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করা।] ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর অবাধ বাক-স্বাধীনতা এবং অঢেল পত্র-পত্রিকার প্রকাশের সুযোগ নিয়ে এই ক্ষেত্রেও ভারত কেন্দ্রীক ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত যে কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা ও লিখা অসম্ভব ছিল, তা এই সময় বলা শুরু হয়েছে। মনে পড়ে ’৯১ সালের সম্ভবত নভেম্বরের দিকে একটা পুস্তিকা আমার হাতে আসে। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা (যিনি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা ছিলেন এবং মুজিব বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজনের একজন ছিলেন) পরিচালিত একটি সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক বলে পরিচয়দানকারী জনৈক ব্যক্তি আরেকজন সহ এসে ঐ পুস্তিকাটি আমাদের দিয়েছিলেন। পুস্তিকাটির নাম ‘A Heretic’, যার অর্থ ‘ভিন্নমতাবলম্বী’ বা ‘বিদ্রোহী’। প্রকাশক হিসেবে নাম আছে জনৈক সৈয়দ ফয়জুর রহমানের আর প্রকাশের স্থান ৪ নং নিউ সার্কুরার রোড। পুস্তিকাটিতে অখণ্ড ভারতের পক্ষে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেক কথার সাথে বলা হয়েছে, “এই উপমহাদেশই আমাদের দেশ এবং আমরা এই উপমহাদেশের নাগরিক হিসেবেই বাঁচতে চাই। কেটে বিচ্ছিন্ন করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ পুনঃসংযোজিত করার সক্রিয় আন্দোলনই আমাদের প্রত্যাশা পূরণের পথ রচনা করতে পারে”। এই ঘটনার কিছুদিন পর ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকার কাকরাইল এলাকার একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট একটা অভূতপূর্ব সাংবাদিক সম্মেলন হলো। এ ধরনের কোন সাংবাদিক সম্মেলন ’৪৭-উত্তর কালে বাংলাদেশে হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলনকারী সংগঠনকির নাম হলো ‘Continent Resurrection Movement’ বা ‘উপমহাদেশ পুনর্জীবন আন্দোলন’। তারা আহুত সাংবাদিকদের মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে জানারেন, তাদের লক্ষ্য উপমহাদেশের অখণ্ডতা। তাঁরা ’৪৭ এবং ’৭১-এর বিভক্তি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষন করেন’।–[দৈনিক বাংলা’, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৯১।] এই সাংবাদিক সম্মেলনের মাত্র একদিন পর ৩১শে ডিসেম্বর ’৯১ তারিখে ঢাকা পিজি হাসপাতাল মিলনায়তনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।–[দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯১।] সেমিনারের বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদসহ আরও অনেকে। ভারত থেকে কংগ্রেস সমর্থক মওলানা আসাদ মাদানী এ সেমিনারে যোগদান করেন। সেমিনারে মূল বক্তব্য ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করা এবং মুসলিম লীগ ও কায়েদে আযমের উপর ভারত-বিভাগের দায় চাপানো। যেমন মওলানা আসাদ মাদানি বলেন, “মুসলিম লীগের পাশ্চাত্যায়ন ও বৃটিশ আনুগত্য অনুসারে নেতৃবর্গ লাহোর সম্মেলনে ‘পাকিস্তান’ নামে মুসলমানদের জন্যে পৃথক ভূ-খণ্ডের দাবী তোলেন। —এভাবেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে”।–[কংগ্রেসী নেতা মওলানা আসাদ মাদানী এদেশবাদীসে উল্টো কথা শুনিয়েছেন। কংগ্রেসের অপরাধ আড়াল করা এবং অখণ্ড ভারত গড়ার আন্দোলনকে ভারতের জন্যে যৌক্তিক করার জন্যেই তিনি মিথ্যাচার করেছেন। এ মিথ্যাচারের জবাব সে সময়ের ইতিহাস। এখানে শুধু মহাত্মা গান্ধীর বন্ধু পণ্ডিত সুন্দর লাল-এর একটা বক্তব্য মাত্র তুলে ধরছি। তিনি তাঁর ‘Who was responsible for the partition of India’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভারত বিভাগের চিন্তা সর্বপ্রথম করেন লালা লাজপাত রায়। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে এ দাবীর পক্ষে কথা বলতে পারেননি উচ্চ বর্ণের নেতারা। তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে এমন কৌশল অবলম্বন করেন যাতে ভারত ভাগও হয় এবং তার দোষটা গিয়ে মুসলমানদের উপর পড়ে। বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা তাদের কাজের দ্বারা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে মুসলমানরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হন যে, ভারত বিভাগের মধ্যেই তাদের মঙ্গল নিহিত (The congress encouraged the Muslim League ….by action that league feel that in a free (united) India Muslim interest would not protected.)” হিন্দু কংগ্রেস এবং ভারতের বর্ণবাদী নেতারা একাজটি কোন লক্ষ্যে কোন যুক্তিতে করেছিলেন তাও পণ্ডিত সুন্দরজী প্রকাশ করেছেন। মিঃ সুন্দরজীর ভাষায় সেই যুক্তিগুলি ছিলঃ “দেখ এই সুযোগ হারিও না। আর না আসতে পারে সহজে এই সুযোগ। দু’টো অংশকে কেটে ফেল- একটি পূর্বে একটি পশ্চিমে। অবশিষ্ট বড় ও মূল অংশটি আমাদের হাতে থাকবে। কোন অহিন্দু আমাদের অংশে থাকতে সাহস করবে না, থাকলেও আমাদের মত হয়ে থাকবে। ভারতের যে দু’অংশ দু’পাশে থাকল, আমরা শক্তি অর্জন করার পর ঐ দু’টোকে পরে আমরা দেখে নেব”। (Reiance, Delhi, August 13, 1967).] আর জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমদ বলেন, “বাংলাদেশের জনগণকেও দ্বি-জাতিতত্ত্বকে বাদ দিয়ে নতুন আদর্শে চিন্তা ভাবনা করতে হবে”।–[‘দৈনিক বাংলা’, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯২।] পিজি সেমিনারেরর ৩০ দিন পর সাপ্তাহিক বিচিন্তা ‘উপমহাদেশের মানচিত্রের আসন্ন পরিবর্তন’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে।–[৩১শে জানুয়ারী, ১৯৯২ তারিখে ‘বিচিন্তা’র এ সংখ্যা প্রকাশিত হয়।] এ কাহিনীতে রয়েছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর উপর একটি রিপোর্ট এবং এ আন্দোলনের নেতার একটি সাক্ষাতকার। রিপোর্ট এবং সাক্ষাৎকার দু’টিতেই দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা এবং অখণ্ড ভারতের পক্ষে কথা বলা হয়েছে। ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে রিপোর্টে বলা হয়ঃ “অযৌক্তিক এবং অন্যান্য বিভক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং সক্রিয় ছিলেন উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু রাজনীতিক। ….এসব জ্যৈষ্ঠ প্রজন্মের রাজনীতিকরা আবার নতুন করে তাদের রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চাইছেন। …..এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’। এই পটভূমি বর্ণনা করার পর বাংলাদেশে এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন,তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে। এঁরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ ও জাসদ করতেন। এছাড়াও বলা হয়েছে, “…..তাঁদের পেছনে জাতীয় পর্যায়ের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিকও রয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাসদ-এর সর্বোচ্চ দু’জন নেতা এই প্রক্রিয়ার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত”। এছাড়া উক্ত প্রচ্ছদ কাহিনীতে ‘উপমহাদেশ পুনরুজ্জীবন আন্দোলন’-এর নেতার যে সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছেতাতে উক্ত নেতা বলেছেন, “ঠিক ’৪৭-এর আগস্টের পূর্বে ভেঙ্গে যাবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। …..আমরা পুরো উপমহাদেশকে ভাষাভিত্তিক একটি ফেডারেশনে বাঁধতে চাই। দু’পাঞ্জাব আর দিল্লী নিয়ে একটি, আরাকান-কাচীন নিয়ে একটি, শ্রীলংকার তামিল আর মাদ্রাজ নিয়ে একটি, আসাম-মেঘালয় বাংলাদেশ নিয়ে একটি, বেলুচদের নিয়ে একটি। ….ভারতের আগ্রহেই এটা হচ্ছে”।
দ্বি-জাতিতত্ত্ব মুছে ফেলা এবং অখণ্ড ভারত গঠনের লক্ষ্যে সাহিত্য-সিনেমা ক্ষেত্রেও ভারতে কাজ হচ্ছে। এ লক্ষ্যে অনেক উপন্যাস-কাহিনী গড়ে উঠেছে। তার ভিত্তিতে চলচ্চিত্রও তৈরীর চেষ্টা চলছে। একটা দৃষ্টান্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাস। এই উপন্যাসে বিভক্ত দুই পারের মর্ম-যাতনা দেখানো হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে অখণ্ডত্বের একটা আবেদন বিমূর্ত হয়ে উঠে। এ উপন্যাসের ভিত্তিতে সীমান্তের দুই পারের যৌথ উদ্যেঅগে চলচ্চিত্র নির্মানের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সুনীল বাবুরা ঢাকায় এসে এ লক্ষ্যে একটা উদ্বোধনী সাংবাদিক সম্মেলনও করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সম্ভবত উদ্যোগটাকে স্থগিত রাখা হয়েছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী কাজ বাংলাদেশ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেও হচ্ছে। একশ্রেণীর নবজাত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও ম্যাগাজিন প্রকাশ্যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের পক্ষের এই তৎপরতাগুলো, আগেই বলা হয়েছে, ভারত যে রাজনীতি চর্চা করছে তারই একটা রূপ। এ বিষয়টা প্রকাশও পেয়েছে ঐ সব তৎপরতার মধ্য দিয়ে। এই প্রকাশের মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ সেই ’৪৭ থেকে ভারত যা চাচ্ছিল তাই সে করছে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এখানে দুইটি। একটি হলো, হঠাৎ করে ’৯১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও অখণ্ডভারতমুখী তৎপরতা মাথা তুলে দাঁড়ানো। দ্বিথীয়টি এই তৎপরতার সাথে আওয়ামী লীগ ও জাসদের একটা অংশ সংশ্লিষ্ট হওয়া। অবশ্য গভীরভাবে একটু চিন্তা করলে এ বিস্ময় আর থঅকে না কারণ বাংলাদেশে প্রথম ধারার যে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, তার কাছে দ্বি-জাতিতত্ত্ব একটি অসার বস্তু এবং সেই হেতু মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ কারণেই এই ধারার রাজনীতির পক্ষ থেকে উপরোক্ত রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ উত্থিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ’৯১ থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী ও ভারতের অখণ্ডতামুখী তৎপরতা মাথা তুলেছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে অবাধ বাক-স্বাধীনতা ও বিপুল সংখ্যায় পত্র-পত্রিকা প্রকাশের সুযোগে।
একানব্বই থেকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বিরোধী এবং ভারতের অখণ্ডতামুখী রাজনীতি বাংলাদেশে মাথা তোলার পর থেকে এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হলো, বাংলাদেশে নবোত্থিত এই রাজনীতি সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এসবের পাহারাদার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলোৎপাটন না করলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের মূলোচ্ছেদ করা যায় না বলেই এই অভিযান। এই অভিযান শুরু করলে প্রথম ধারার রাজনীতির সাথে স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত বেধেছে দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির। দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা আগেই বলেছি, জামায়াতে ইসলামী এবং ঘটনাক্রমে এই জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধকে মুসলমানদের স্বাধীনতা বিরোধী ভারতের একটি তৎপরতা বলে অভিহিত করে। এ বিষয়টা প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্যে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এই অস্ত্র দিয়ে জামায়াতে ইসলামী তথা দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মুণ্ডুপাত করার মোক্ষম সুযোগ করে নিয়েছে। এই লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারলে, তারা মনে করছে, শুধু জামায়াতে ইসলামীর মুণ্ডুপাত হবে না, মূলোচ্ছেদ হবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির, মূলোৎপাট ঘটবে দ্বি-জাতিতত্ত্বের এবং সেই সাথে স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশেরও। এর অর্থ বাংলাদেশ দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং এ ধারার রাজনীতির আদর্শিক নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামী শুধু ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, শুধু দ্বি-জাতিতত্ত্ব নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও একটা গ্যারান্টি।
বাংলাদেশে প্রথম ধারার ধর্ম বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং দ্বিতীয় ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যেকার এই সংঘাতকেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। ১৯৯৩ সালের ২২শে জুন নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বয় কমিটির ৮ম বিশেষ সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে রাজনৈতিক মূল্যায়নে বলা হয়, “বাংলাদেশে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সম্ভবত এটাই শেষ যুদ্ধ। একদল চাইছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অপর দল চাইছে বাংলাদেশে স্বাধীনতার অধ্যায় মুছে ফেলতে এবং প্যান ইসলামিক স্রোতের সাথে মিশে যেতে। অশুভ মৌলবাদী শক্তিগুলো সুপরিকল্পিত লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ….একটি আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তির পতাকা সমুন্নত রাখতে ভারতের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে”।–[বাংলা বাজার পত্রিকা ২৩শে আগস্ট ১৯৯৩।]
ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখার মূল্যায়ন রিপোর্টকে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ৪৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী রিপোর্ট দিল্লীতে পাঠানো হয়েছে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টে বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি বলতে বাংলাদেশের প্রথম ধারার রাজনীতি অর্থাৎ ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ধারা বলতে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে বুঝানো হয়েছে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টেও জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, ঠিক যেমন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক ধারাটি জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করে থাকে। কংগ্রেসের এই রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশে উল্লেখিত দুই ধারা বা পক্ষের সংঘাতকে ‘বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা এবং এই শেষ যুদ্ধে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারার পক্ষ নেয়াকে ভারতের জন্যে নৈতিক দায়িত্ব বলা। কংগ্রেস তার এই বক্তব্য দ্বারা নতুন করে জানিয়ে দিল, বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির সাথে শুধু আরএসএস বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, শিবসেনানয় কংগ্রেসসহ গোটা ভারতই শ্যামল রয়েছে। তবে এ কথা না বললেও চলতো। কারণ কারো অজানা নয় যে, কংগ্রেসীরা এ যুদ্ধে আগে থেকে শামিল রয়েছে। বরং উপরের গোটা আলোচনায় এ বিষয়টা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে, বাংলাদেশের এ যুদ্ধটা ভারতেরই যুদ্ধ।
তবে কংগ্রেস ঐভাবে কথা বলে একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটির মর্যাদাকে যেমন ভুলুণ্ঠিত করেছে। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দ্বিতীয় ধারাটির আদর্শিক নেতা জামায়াতের মর্যাদাকে আকাশচুম্বী করে দিয়েছে। কংগ্রেসের রিপোর্ট বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি যথেষ্ট নয়, তাদের সহযোগিতার জন্যে ভারতকেও যুদ্ধে নামতে হচ্ছে। এর দ্বারা কংগ্রেস না চাইলেও এবং বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ধারাটি না চাইলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাটি। বাংলাদেশী মুসলিম জনগণের ত্রাতায় পরিণত হয়েছে এবং তার স্বাধীনতার সংরক্ষণকারীর স্থান লাভ করেছে। দ্বিতীয় এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থীরা এবং এই ধারার আদর্শিক নেতৃত্বে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামী সহ ইসলাম পন্থিরা এবং এই ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলো বিএনপি। বিএনপির স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক। বিএনপির এই বৈশিষ্ট্যই দ্বিতীয় ধারার রাজনীতিতে ইসলামপন্থী দল ও বিএনপি’র জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এই রাজণৈতিক মেরুকরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে যেমন শক্তিশালী করেছে, তেমনি দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের করেছে দিশেহারা। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা রাজনীতির এই জোটগত মেরুকরণ ভাঙার জন্যে করিয়া।
একটা বিষয় কিন্তু অস্পষ্ট থাকছে, বাংলাদেশের উপরোক্ত রাজণৈতিক সংঘাতকে ভারতের কংগ্রেস ‘বাংলাদেশের শেস যুদ্ধ’ বলছে কেন? তাহলে কি কংগ্রেস বাংলাদেশের আয়ু জেনে ফেলেছে? জেনে ফেলেছে যে, এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশ থাকছে না? এর অর্থ কি এই যে, কংগ্রেস ধরে নিয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা জয়লাভ করবে এবং তার ফলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের কবর রচিত হবে এবং বাংলাদেশ নামক কোন স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে না? বাংলাদেশ না থাকলে বাংলাদেশে আর কোন যুদ্ধেরও প্রশ্ন উঠবে না। সুতরাং এটাই হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধ। সন্দেহ নেই কংগ্রেস হয়তো এভাবেই চিন্তা করেছে।
কংগ্রেসের এই চিন্তা ঐতিহাসিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার চিন্তার অনুরূপ। ফ্যান্সিস ফকুয়ামা পৃথিবীর শেষ যুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন এবং এর মাধ্যমে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে ভবিষ্যতবাণী করেছেন।–[‘The end of History’, Fransis Fukuyama, The National Interest, Summer, 1989.] ফুকুয়ামার মতে সেই যুদ্ধটা সংঘটিত হবে ধর্মীয় আদর্শবাদের সাথে পশ্চিমী ‘উদার নৈতিক গণতন্ত্রের’, যা ভৌগলিক জাতীয়তার সীমা অতিক্রম করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে এবং ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করবে। অনেক ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই ফকুয়ামার প্রতিবাদ করেছেন।–[‘The Return of History’ নিবন্ধে Flora Lewis (Sais Review-summer 1990), Responses to Fukuyama’ প্রবন্ধে Allan Bloom (The National Interest, Summer 1989), More Resposes to Fukiyama’ প্রবন্ধে Timothey Fuller The National Interest, Summer, 1989)’, ‘The errors of Endisim’ প্রবন্ধে Samuel p. Huntington (The National Interest, 1989) এবং ‘Huntington’s fault lines’ and Fukuyama’s end of History’: An appraisal’ প্রবন্ধে Tujul Islam Hashmi (Holiday, Dec. 31, 1993) এ বিষয়ের উপর বিস্তারিত ও আকর্ষণীয় আলোচনা করেছেন।] বলেছেন সমাজ ও সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিষয় ও উপাদানগুলোকে ফুকুয়ামা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ফুকুয়ামার সমাজ-সভ্যতার সরলীকরণ তত্ত্বটা একেবারেই অবাস্তব। ফুকুয়ামা যা চেয়েছেন তেমন শেষ যুদ্ধও যেমন সামনে নেই, তেমনি ইতিহাসের গতিও রুদ্ধ হচ্ছে না। ভারতীয় কংগ্রেসের ‘শেষ যুদ্ধ’ সম্পর্কেও এই একই কথা। বাংলাদেশে ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যত বড় আশাই করুক, একশ্রেণীর ভারতীয়দের বিশেষ রাজনীতি এর প্রতি যতই সাহায্যের হাত বাড়াক, বাংলাদেশের জনগণ এবং জনগণের আদর্শের শক্তির চাইতে তা বড় হবে না। ’৯৬ সালে এই রাজনীতির বিজয় হয়েছিল, কিন্তু ২০০১ সালে এসেই সে রাজনীতির পরাজয় ঘটেছে। জনগণ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হলেও ধর্মবিরোধী, সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির চেহারা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সুতরাং কোন যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ নয় এবং বাংলাদেশে কোন শেষ যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশাগত উপাদান বাদ দিলে এখানে বৈপরীত্যের চেয়ে সমন্বয়ের এই উপাদানগুলিই মৌল প্রকৃতির। বাংলাদেশের ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ধারাটি প্রকৃতপক্ষে বিদেশাগত বিজাতীয় অনুপ্রবেশের ফল। কিন্তু এ ধারাটির যারা ধারক তাদের হৃদয় ধর্মীয় আদর্শবাদমুক্ত নয়, মুক্ত করাও সম্ভব নয়। তাইতো আমরা দেখি, ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেন তাদের অনেকেই এমনকি তাহাজ্জুদগোজারও।–[আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলেন, তাদের অনেকে তাহাজ্জুদ নামাজও পড়েন। এমনকি কম্যুনিষ্ট বলে পরিচিত লোকরাও আজান হলে অনেকে মসজিদে দৌড়ান। তাদের হৃদয় যে ঈমান দৃপ্তি এটা তারই প্রমাণ। আমি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ড্রইং রূপে যেদিন কোরআন দেখলাম, যায়নামাজ দেখলাম, সেদিন সত্যিই আমার বুকটা এক অনাস্বাদিত গৌরবে ভরে গিয়েছিল। এই ঈমান তাদের রাজনীতির চেয়ে বড়, সময় এলেই তার প্রমাণ তারা দেবে। এমনও হতে পারে দ্বিতীয় ধারার যে রাজনীতি, সে রাজনীতির প্রধান শক্তি তারাই হয়ে দাঁড়াবে।] এছাড়া রয়েছে জনগণের চাপ। ধর্মবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যারা করেছেন, তারা কিন্তু তাদের পরিচয় জনগণকে বলতে সাহস পান না। বরং তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ স্লোগান নিয়ে জনগণের কাছে হাজির হন। সুতরাং দেশের শিক্ষার হার আরও বাড়লে, জনগণ আরও সচেতন হলে এবং দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে দেশে ধর্মবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি আর থাকবে না এবং দেশের রাজনীতিতে আদর্শিক প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ সুদিনের আগমন কতদূরে তা নির্ভর করছে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দ্বিতীয় রাজনৈতিক ধারাটির ইতিবাচক ও স্বাধীন রাজনীতির সংহতি ও শক্তিবৃদ্ধি এবং সার্বিক সচেতনতা ও গণজাগরণের উপর।
No comments:
Post a Comment