বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দুটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করে নএবং বঙ্গ-ভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে তিনি ‘রাখি বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুদের উৎকট ন্যাশনালিজম বা জাতীয়তার প্রকাশ ঘটেছিল। স্বদেশ-জাতীয়তাকে আরাধ্য দেবীতে পরিণত করা হয়েছিল এবং এই আরাধ্য দেবীর জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার সব পণ করা হয়েছিল। যুগান্তর পত্রিকায় বলা হলো, “হে বাঙ্গালী, তুমি কি নর-কীট হতে জন্মেছিলে? –যখন বাঙ্গালাদেশ দু’ভাগ হল দেখে সাত কোটি বাঙ্গালী মর্মাহত হয়ে পড়লো, সেদিনকার কথা আজ একবার ভাব। সেদিন স্বদেশের জন্য কোটি কোটি হৃদয়ের ব্যাথা যেমনি এক হল, অমনি মাতৃরূপিনী স্বদেশ শক্তি পলকের মধ্যে বাঙ্গালা দেশের সর্বত্র আপনাকে প্রকাশ করিলেন, বাঙ্গালীও সর্বত্র আচম্বিত ‘বন্দেমাতরম’ বলিয়া উচ্চঃস্বরে মাকে আহবান করিল। –সেদিন যেন এক নিমিষের জন্যে বাঙ্গালীর কাছে মা আমার প্রকাশিত হয়েছিলেন, সেদিন যে বাঙ্গালী বড়ই ব্যথা পেয়েছিল, ভেবেছিল মা বুঝি দ্বিখণ্ড হয়েছে, তাই মা আত্মপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি দ্বিখণ্ড হই নাই, তোদের একত্র রেখে সহজেই শক্তিদান কর্তুম, আজ সেই বাঁধা ঘর শত্রুরা ভেঙ্গে দিলে মাত্র; যেদিন আমার জন্যে স্বার্থ ও সংসারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রাণ দিতে অগ্রসর হবি, সেদিন আবার সেই শক্তি তরংগ মাঝে আমার দেখা পাবি, আমি মরি নাই। –এস বাঙ্গালী আজ মার সন্ধানে বেরুতে হবে। সে বার মা আপনি এসে দেখা দিয়েছিলেন, এবার মার জন্য লক্ষ রুধিরাক্ত হৃদয়ের মহাপীঠ প্রস্তুত করে রেখে মাকে খুঁজে খুঁজে কারামুক্ত করে নিয়ে আসব। একবার সকলে বুকে হাত দিয়ে হৃদয়কে জিজ্ঞাসা কর দেখি, প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার, সমস্ত পণ করে আজ মার সন্ধানে বেরুতে পারবে কিনা? —বাঙ্গালীকে ‘বন্দেমাতরম’ মাতৃমন্ত্র শিখাইতে হইবে। ….সর্বাগ্রে মাকে সাক্ষাৎ বন্দনা কর, মাকে তাঁর উপযুক্ত আসনে অধিষ্ঠিত করিলে বিদ্যা, অর্থ, মোক্ষ, ইত্যাদি সবই ক্রমশ আসিয়া পড়িবে”।–[‘স্বাধীণতা আন্দোলনে যুগান্তর’ পত্রিকার দান বা শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার বিপ্লববাদ’, পৃষ্ঠা ১৪২, ১৪৬ (যুগান্তর পত্রিকার ‘যোগ ক্ষ্যাপার চিঠি’ নামক এই নিবন্ধের রচয়তা ছিলেন, দেবব্রত বসু, ঐ পৃষ্ঠা ১৬)।]
এই হিন্দু-জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সাথে রবীন্দ্রনাথও পুরাপুরি একাত্ম হয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দুটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করে নএবং বঙ্গ-ভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে তিনি ‘রাখি বন্ধন’ দিবস ঘোষণা করেন। ‘রাখি বন্ধন’ এর দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছলের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটা প্রার্থনা সংগীত গাইলেন। সে প্রার্থনা সংগীতে তিনি বললেন—
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার হাওয়া বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক।
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর বাংলার হাট
বাংলার বন বাংলার মাঠ
পূণ্য হউক পূণ্য হউক
পূণ্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর পণ বাংগালীর আশা
বাংগালীর কাজ বাংগালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান।
বাংগালীর প্রাণ বাংগালীর মন
বাংগালীর ঘর যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান।
এক সংগীত শেষে বীডন উদ্যানে ও অন্যান্য জায়গায় রাখবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক ভাবে ‘ফেডারেশন হলের’ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অভিভাষণ পাঠ করেন। বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে উল্লেখ করেন, “যেহেতু বাঙ্গালী জাতির সার্বজনীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ করিয়াছেন সেহেতু আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালী জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব”। (অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন’, আহসানুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮২, ৮৩) রবীন্দ্রনাথের এ কথা মিথ্যা হয়নি। ‘বন্দেমাতরম’ এর খন্ডিত মা’কে অখন্ড করার জন্যে ‘প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসার’কে পণ করে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল। “১৯০২ সালে তিনি (শ্রী অরবিন্দ) মারাঠী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে তার ছোট ভাই শ্রী যতীন মুখার্জীকে কলকাতায় পাঠান। এ সময়ে যোগেন্দ্র বিদ্যাভুষণ, জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত হন”।–[‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ পুর্নেন্দু দস্তিদার।] রবীন্দ্রনাথ নিজেও একথা বলেছেন, “আমাদের দেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল, তখন আমি তার মধ্যে ছিলাম। মুসলমানরা তখন তাতেযোগ দেয়নি, বিরুদ্ধে ছিল”। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩) গুপ্তবিপ্লবী বা স্বদেশী বা সন্ত্রাসবাদী এই দল কতকটা বাম ঘেষা ছিল।–[‘বিপ্লবী দলের কাজকর্ম ইতালীর কার্বোনারী ও রাশিয়ার গুপ্ত সমিতি গুলোর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়েছিল’। (‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার দান’, পৃষ্ঠা ১১)।] তাই বলে ভাববার কোন কারণ নেই যে, এদের শরীরে কোনরূপ অসাম্প্রদায়িকতার নামগন্ধ ছিল। এদের লক্ষ্য যেমন ছিল ধর্মরাজ্য, তেমনি এরা কট্টর ধর্মনীতি অনুসরণ করতো। শ্রী নলিনী কিশোর গুহ তার ‘বাংলার বিপ্লববাদ’ (চতুর্থ সংস্করণ, ১৩৭৬ বাংলা, প্রকাক এক, মুখার্জি কোম্পানী প্রাঃ লিমিটেড, ২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলিকাতা-২) বইয়ে বিপ্লবী দলের নতুন রিক্রুটদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের যে রীতি-নীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে প্রমাণ হয় বিপ্লবী-স্বদেশীরা পুরোপুরি হিন্দু রীতি-আদর্শের দ্বারা পরিচালিত ছিল। শ্রী গুহ’র বর্ণনা: “বঙ্কিমচন্ত্র আনন্দ মঠে যে জমকালো প্রতিজ্ঞার নমুনা দেখাইয়াছেন, বিপ্লববাদীরাও সে প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে তাহারই অনুকরণ করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নেই। এখানে অনুশীলনের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের নমুনা দিতেছি। এখানে পুলিন বাবু স্বীয় দীক্ষা বা প্রতিজ্ঞা গ্রহণের বর্ণনা করিতেছেন, “পি. মিত্রের আদেশ মতে একদিন (কলিকাতায়) একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া সংযমী থাকিয়া পরের দিন গঙ্গাস্নান করিয়া পি, মিত্রের বাড়ীতে তাহার নিকট হইতে দীক্ষা লইলাম। ধূপ দীপ নৈবেদ্য পুষ্প চন্দনাদি সাজাইয়া ছান্দোগ্যোপনিষদ হইতে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিয়া পি. মিত্র যজ্ঞ করিলেন, পরে আমি আলীঢ়াসনে বসিলাম, আমার মস্তকে গীতা স্থাপিত হইল তদুপরি অসি রাখিয়া উহা ধরিয়া পি মিত্র আমার দক্ষিনে দণ্ডায়মান হইলেন, উভয় হস্তে ধারণ করিয়া যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে কাগজে লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম। পরে যজ্ঞাগ্নির নমস্কার করিলাম।
—–পি. মিত্র যে পদ্ধতিতে আমাকে দীক্ষা দিয়াছেন গুপ্তচক্রের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে আমিও অনুরূপ পদ্ধতিতে আমার বাসায় দীক্ষা দিতাম। এক সঙ্গে দীক্ষা দিতে হইলে ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে পুরাতন ও নির্জন ‘সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে’ যাইয়া একটু জাঁক-জমক করিয়াই দীক্ষা দিতাম। অর্থাৎ সংযম হবিষ্যাণ্ন গ্রহণ করিয়া প্রতিজ্ঞা করাইতাম’ —-পুলিন বাবু দীক্ষান্তে প্রত্যেক সভ্যকে পর্যাপ্তরূপে বিশুদ্ধ ঘৃত ও চিনিযুক্ত কাঁচা দুগ্ধসেবন করিতে দিতেন। এই সকল প্রতিজ্ঞা বা দীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে বঙ্কিমের আনন্দমঠের অনুকরণ লক্ষ্য করিবার’।–[‘বাংলার বিপ্লববাদ’, শ্রী নলিনী কিশোর গুহ, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮।]
স্বদেশী বা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধর্মমত সম্পর্কে সুন্দর কথা বলেছেন, সাহিত্যিক গিরিজাশংকর রায় চৌধুরী। তিনি লিখছেন, “আমরা দেখিয়াছি, দেখিতেছি অরবিন্দ বঙ্কিম প্রদর্শিত জাতীয়তাকেই সজ্ঞানে ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দ হইতেই অনুসরণ করিতেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের বা মুসলমানদের ধার তিনি ধারেন না। তিনি একপায়ে দাঁড়াইয়া বগলামন্ত্র জপ ও বগল মূর্তি পূজা শেষ করিয়া আসিয়াছেন। —গুপ্ত সমিতিতে মা কালীও আছেন এবং শ্রী গীতাও আছে। এতে মুসলমান ভ্রাতাগণ যদি বলেন যে, ‘এ ব্যবস্থায় দেশ উদ্ধারের জন্য আমরা যা-ই বা কি করিয়া, আর থাকিই বা কোন মুখে?”-[‘শ্রী অরবিন্দ ও বাংলার স্বদেশী যুগ’, গীরিজা শংকর রায় চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৪৫২, ৪৫৩।] সূত্র বিস্তারিত পড়ুন : একশো বছরের রাজনীতি = লেখক : আবুল আসাদ
No comments:
Post a Comment