Wednesday 16 August 2017

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাসদ_ সিপিবি ও দৈনিক ইত্তেফারের ভূমিকা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাসদ_ সিপিবি ও দৈনিক ইত্তেফারের ভূমিকা045f6-fb_img_1498273065688
অতীত খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে চায়!
মহিউদ্দিন আহমদ।
পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে ঘটেছিল রক্তাক্ত পালাবদল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট বিদ্রোহ করে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা যেতে-না-যেতেই দেখা গেল পুরো সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর এবং অসামরিক আমলারা অভ্যুত্থানকে হয় স্বাগত জানাল, নয়তো ​তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল। পুরো দৃশ্যপট যেন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল। ওই সময় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল এম এ হামিদ। এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন ছিল: ফারুক-রশিদের অভ্যুত্থান স্রেফ দুটি ইউনিটের একক দুঃসাহসিক অভিযান মনে করা হলেও তাঁদের পেছনে বড় র‍্যাঙ্কের কিছু অফিসার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ জুগিয়েছিলেন। ৪৬ ব্রিগেডের নিষ্ক্রিয়তাই এর একটি দৃষ্টান্ত। ফারুক-রশিদ এ রকম কিছু একটা ঘটাতে পারেন, এ ধরনের অস্পষ্ট তথ্য আলাদাভাবে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও আবদুর রউফ (ডিজিএফআইয়ের প্রধান) কমবেশি জানতেন। তাঁরা খুব সম্ভব চেপে যান এই মতলবে যে পাগলদের প্ল্যান যদি সত্যিই সফল হয়, তাহলে ক্ষমতার মসনদে বসার সহজ সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে তাঁরা যেন অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে না থাকেন। কর্নেল হামিদের মনে জিজ্ঞাসা ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন জনপ্রিয় নেতার এমন পরিণতি কেন হলো? তাঁর করুণ মৃত্যুতে কোথাও ‘টুঁ’ শব্দটি উচ্চারিত হলো না কেন? কোথায় ছিল তাঁর ব্যর্থতা? ইতিহাসের প্রয়োজনে এগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
এটা সবারই মোটামুটি জানা, আমাদের দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বস্তুগত নির্মোহ বিশ্লেষণ খুব কমই হয়েছে। ৪১ বছর ধরে চলছে সমর্থন–বন্দনা কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত সমালোচনা। এর মধ্যেই ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে বারবার। মুশকিল হলো, ইতিহাস তো লেখাই হয়নি! এ জন্য আরও অনুসন্ধান দরকার। দরকার আরও সময়ের।
স্বাধীনতার আগে ও পরে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষ-বিপক্ষ ছিল। মুজিব-শাসনের শেষ দিনগুলোতে মুজিববিরোধীদের সামনের কাতারে ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং পরীক্ষিত মিত্র ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। আগস্ট-অভ্যুত্থান নিয়ে এই দুটি দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আমলে নেওয়া যেতে পারে।
জাসদ জন্মমুহূর্তেই সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত দলের অন্যতম মুখপত্র সাম্যবাদ-এর চতুর্থ সংখ্যায় শেখ মুজিবের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ (পরবর্তীকালে বাকশাল)-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল সংশোধনবাদের বাংলাদেশস্থ এজেন্ট গণধিক্কৃত মণি-মুজাফফর চক্র। কিন্তু চরম ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ শেখ মুজিবকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না।...বুর্জোয়াবাদের মধ্যে দেখা দিল অস্থিরতা ও অন্তঃকোন্দল। দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিদেশি মুরব্বিরাও দিশেহারা হয়ে উঠল; কোন নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ প্রতিপত্তি কায়েম থাকবে—এ প্রশ্নে তারা দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল। এই ডামাডোলের একপর্যায়ে এল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এদিন শেখ মুজিব ও তাঁর কতিপয় সহযোগী নিহত হলো। সামরিক বাহিনীর একাংশের সহযোগিতায় শেখ মুজিবেরই অন্যতম সহচর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসল।’
জাসদের বিপরীত মেরুর দল ছিল সিপিবি। সিপিবির মূল্যায়নটিও অনুরূপ, যদিও তা করা হয়েছিল জাসদের মূল্যায়নের তিন বছর পর। ১৯৭৯ সালে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আমাদের পার্টির ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামে একটি দলিল গৃহীত হয়। ওই দলিলে মন্তব্য করা হয়, দেশে একটি প্রগতির ধারা সূচিত হলেও দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি এবং দলের কর্মীদের একাংশ ব্যাপক দুর্নীতি, লাইসেন্স-পারমিট, ব্যাংকঋণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে ওঠে। এমনকি জাতীয়করণকেও তারা নিজেদের বিত্ত সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহার করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ৩৪০ কোটি ৩৮ লাখ ডলার বৈদেশিক সাহায্য বাংলাদেশে আসে।
‘বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এই টাকার শতকরা ৩০ ভাগ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের লোকজনও ছিল। এভাবে দলের মধ্যে বুর্জোয়া ও নব্য-ধনিকদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বস্তুতপক্ষে ১৯৭৪ সালে দেশের প্রগতির ধারাকে অগ্রসর করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।...শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল অংশ জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সঙ্গে শরিক হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগের একাংশ খুনি মোশতাকের সহযোগী হয়।’
রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উত্থান ছিল নানা নাটকীয়তায় ভরা। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, একজন সুবক্তা এবং অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির। তাঁর সাহসের জুড়ি ছিল না। তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী মিজানুর রহমান চৌধুরী ওই সময়ের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘এ সময় আমরা দেখেছি, যারা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপণ করতে প্রস্তুত—এ ধরনের অনেককেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে বা নিজ প্রচেষ্টায় দেখা করে বাকশাল প্রবর্তনের জন্য তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করছেন। সব মানুষই নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে।...কিন্তু এটা যে প্রশংসাকারীকে চাটুকারে পরিণত করে তা-ই নয়, প্রশংসিত ব্যক্তির যে কী সর্বনাশ করা হলো, তা তিনি উপলব্ধিও করতে পারেন না। নিজের অজান্তেই তিনি নিজের সৃষ্ট একটা বলয়ের মধ্যে একাকী হয়ে যান।...এ কথা ভুলে যান যে চাটুকার কেবল তার আপন স্বার্থেরই বন্ধু।’
এ কথা সত্য যে, একটা পর্যায়ে এসে শেখ মুজিব বড্ড একা হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর আশপাশে যাঁরা ঘিরে ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন অনুগত কিংবা সুযোগসন্ধানী। তাঁর চারপাশে ভিড় করে এত লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অনিশ্চিত পথের যাত্রী।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর সঙ্গে শেখ মুজিবের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাবেক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন শেখ মুজিবের বড় ভাইয়ের মতো। নানা বিষয়ে তিনি শেখ মুজিবকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। এ দেশের রাজনীতিতে এবং স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্বে মানিক মিয়ার অবদান অনেকটাই অজানা। মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে মইনুল হোসেন হিরু ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্তেফাক-এর হাল ধরেছিলেন। মইনুল হোসেন প্রথম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের টিকিটে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকশালের বিরোধিতা করে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
আনোয়ার হোসেন ছিলেন অনেকটা বিপরীত মেরুর। তিনি বাকশালের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ইত্তেফাক ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিল। ১৬ আগস্ট ইত্তেফাক-এর প্রথম পাতায় ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শিরোনামে একটা সম্পাদকীয় ছাপা হয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয়:
‘দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে ১৫ আগস্ট শুক্রবার প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছে। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছে এবং এক ভাবগম্ভীর অথচ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। ...বিগত সাড়ে তিন বছরের ঊর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তব ক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়​েণ খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিতে আগাইয়া আসিতে হইয়াছে। তারও কারণ ছিল। পূর্ববর্তী শাসকচক্র সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়া সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসের গতিকে কোনো দিন ক্ষমতালিপ্সার বাঁধ দিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায় না। আজকের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমাদের দায়িত্ব অনেক। বাংলাদেশের এক মহাক্রান্তিলগ্নে জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে তাহাকে সুসংহত করিতে হইলে জনগণের প্রতি অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সকলকে আজ ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ নেই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও চালকের আসনে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার চালাচ্ছেন। তাঁর চারপাশে অনেক লোক। এখানে জাসদ-সিপিবি-ইত্তেফাক একাকার। একসময় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর প্রচণ্ড বিরোধিতা করতেন বা তঁার পতন দাবি করতেন, এখন তঁারা অনেকেই শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য। জীবনানন্দ থেকে কয়েকটা শব্দ ধার করে বলতে চাই—অতীত খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে চায়!
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক: মতিউর রহমান
সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভেনিউ,
কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫
ফোন: ৮১৮০০৭৮-৮১, ফ্যাক্স: ৯১৩০৪৯৬,
ইমেইল: info@prothom-alo.info
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/954469/অতীত-খুঁড়ে-কে-হায়-বেদনা-জাগাতে-চায়

No comments:

Post a Comment