Wednesday 16 August 2017

১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় মুসলমানদের উপরে হিন্দুদের চালানো হত্যাযজ্ঞ দিবস

১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় মুসলমানদের উপরে হিন্দুদের চালানো হত্যাযজ্ঞ দিবস HINDU/MUSLIM RIOTS - INDIA '46
''মুসলমান শাসনের থেকে দেশ-বিভাগ অধিকতর পছন্দনীয়, এই ধারণা পশ্চিম বাঙলার অন্তত কিছু হিন্দুর মনে উদিত হয়।...১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালে দিল্লীতে কেবিনেট মিশন ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনার সময় জল্পনা-কল্পনা উত্তেজনার তুঙ্গে ওঠে। তখন কোলকাতা ও পশ্চিম বাঙলার প্রাণকেন্দ্রের হিন্দুরা প্রদেশ বিভাগের পরিকল্পনাকে অনুকূল বলে মনে করে এবং এভাবে পশ্চিম বাঙলাকে একটা নতুন হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা চিন্তা করে।''
[কংগ্রেস কর্তৃক ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ব্যার্থ হবার পর] ''কেন্দ্রে সম্পূর্ণ কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রতিক্রিয়ায় সোহরাওয়ার্দী এই বলে সর্তক করে দেন: লীগকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসানোর সম্ভাব্য পরিণতি হবে বাঙলার পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ও সমান্তরাল একটা সরকার প্রতিষ্ঠা… এ রকম কেন্দ্রীয় সরকার বাঙলা থেকে কোনো রাজস্ব সংগ্রহ করতে না পারে তা আমরা নিশ্চিত করব, আর আমরা নিজেদের পৃথক রাষ্ট্র মনে করব যার সাথে কেন্দ্রের কোনো সম্পর্ক নেই।''
তার আগেই মুসলিম লীগ কর্তৃক ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে
১৬ই আগস্ট ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে' ঘোষণা করে। ভারতের সর্বত্র হরতাল পালনের লক্ষ্যে এই কর্মসূচী ঘোষিত হয়। বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর সরকার ঐ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে।
সোহরাওয়ার্দীর উপরোক্ত বিবৃতিতে হিন্দু সংবাদপত্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, তারা এর ব্যাখ্যা করে সমগ্র বাংলাকে তখনই ‘পাকিস্তান বানাবার’ হুমকি হিসেবে। হিন্দু বাঙালিদের কাছে ‘পাকিস্তান’ আসার অর্থ হল চিরকালের জন্য রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারানো এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ইচ্ছার অধীনে থাকা।
এই প্রেক্ষাপটে কুখ্যাত কোলকাতা হত্যাযজ্ঞ (Great Calcutta Killing) সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার লোক নিহত হয়-এ দাঙ্গা স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিচিত উন্মত্ত জনতার আক্রমণের ব্যাখ্যাতিরিক্ত হঠাৎ বহিঃপ্রকাশ ছিল না।....পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার পর দেখা যায় উভয় পক্ষের হাজার হাজার লোক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। হত্যা শুরু হওয়ায় দশ দিন পর এই ভয়ঙ্কর রাতের শহর (city of dreadful night) ফুটপাতে তিন হাজারের বেশি মৃতদেহ পড়ে থাকে।
এটি সোহরাওয়ার্দীর নিন্দনীয় কাজ, এখন পর্যন্ত তা একটা সুপ্রতিষ্ঠিত কাহিনী হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু হিন্দু নেতারাও যে এই ঘটনায় গভীরভাবে জড়িত ছিল, এ সত্যটা তেমন সুবিদিত নয়। ঐ লড়াইয়ে হিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান নিহত হয়। অভ্যাস মতো নিরুদ্বিগ্ন প্যাটেল ঐ বীভৎস বিষয়টিকে এভাবে মূল্যায়ন করেন: ‘হিন্দুরা এতে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে।’
শক্তির এই বীভৎস প্রতিযোগিতায় ১৯৪৬ সালে হিন্দুদের প্রস্তুতি একেবারে বিস্ময়কর ছিল না।কারণ এ কথা মনে রাখা দরকার যে, ত্রিশ দশকের শেষে এবং চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে কোলকাতা ও মফস্বল শহরগুলোতে হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সংগঠন প্রতিষ্ঠার আধিক্য দেখা যায়- এসব গ্রুপের বিঘোষিত নীতি ছিল হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা; কিন্তু তারা ভদ্রলোক যুবকদেরকে দৈহিক যোগ্যতা অর্জন করতে ও আধা-সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উৎসাহ দিতে অধিকতর শক্তি ব্যয় করত।
এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছিল চল্লিশের দশকে ভদ্রলোক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। মুসলমান দাঙ্গাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল পল্লি এলাকা থেকে শহরে আসা ভাসমান শ্রেণীর লোক। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বহু সংখ্যক ভদ্রলোক হিন্দুকে দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।...বাঙালি হিন্দু ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবী বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক… সক্রিয় ছিল। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী সওদাগর, শিল্পী, দোকানদার… দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। মধ্য কোলকাতায় মুসলমানদের একটি সভা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য অন্যদের সাথে ভদ্রলোকেরাও অংশগ্রহণ করে- ঐ সভায় মুখ্যমন্ত্রী নিজে ভাষণ দেন। বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ড. জামাল মোহাম্মদকে হত্যাকারী জনতার মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল ‘শিক্ষিত যুবক’।
হিন্দুদের পক্ষে যোগ দেয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সৈনিক ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। ছাত্র, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ও পাড়ার ভাড়াটে গুণ্ডা মার্কা ছেলেদের অভাবিত ঐক্যের ফলে হিন্দু জনতার রক্তক্ষয়ী বিজয় হয় কোলকাতার রাস্তায়, ১৯৪৬ সালে। এটাই বাঙলা বিভাগ এবং একটা পৃথক হিন্দু আবাসভূমি গঠনের জন্য হিন্দু আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছে।
কিন্তু হিন্দুদের এই জঘন্য কাজকে কখনও স্বীকার করা হয়নি। হিন্দু সংবাদপত্র এই আক্রমণের জন্য দোষারোপ করে সোহরাওয়ার্দী সরকার ও মুসলিম লীগকে; আর এই হত্যাযজ্ঞকে গণ্য করা হয় ভবিষ্যতে ‘মুসলমান শাসনে’র অধীন বাঙালি হিন্দুদের ভাগ্যের ভয়াবহ অশুভ লক্ষণ হিসেবে।(প্রফেসর জয়া চ্যাটার্জী, বাংলা ভাগ হল)

No comments:

Post a Comment