ভারতীয় সেক্যুলারিজম হলো ‘সিন্ডিকেটেড হিন্দুইজম’ : রমিলা থাপার’র সাক্ষাৎকার
written by অজিত দাশ
ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনার শেষ বই ‘দ্যা পাস্ট অ্যাজ প্রেজেন্ট’ পড়ে আমার কাছে মনে হলো আপনি আমাদের ইতিহাস পাঠের বিষয়টি নিয়ে অনেকটা আশাহত হয়েছেন। যদিও আপনি নিরাশাবাদী নন এটা স্পষ্ট করে লিখেছেনও। এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
রমিলা থাপারঃ আসলে শেষ কয়েকটি দশক ভারতের ইতিহাস রচনার অবস্থাটি লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে। আমি ইতিহাসের দুটো ধাপ এর কথা বলবো যেভাবে ইতিহাস রচনা এবং অধ্যয়ন হয়ে থাকে। একটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ ইতিহাসবিদ রচিত ইতিহাস। তারা সকলেই ভাল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। যদি পঞ্চাশ বছর আগের ইতিহাসশিক্ষা পদ্ধতির কথা বিবেচনা করি তাহলে বলবো তখনকার চেয়ে এখন কিছুটা হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। যদিও সেই পরিবর্তনকে আমি সার্বজনীন বলব না। এখনো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে ইতিহাস শিক্ষা দিতে পারছেন না। তবে বর্তমানে অনেক ইতিহাসবিদই আছেন যারা ইতিহাসকে সমাজ বিজ্ঞানের চেয়ে একধাপ এগিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভিত্তি বলে মনে করেন। আর এ কারনে যে কারো প্রত্যাশা আরো বৃদ্ধি পাবে।
আর অন্যদিকটি হলো ঠিক বিপরীত। সাধারণ মানুষের নিকট যে ইতিহাসগুলো জনপ্রিয়। যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। শতবছর আগেও যে ইতিহাসগুলোর নির্ভরযোগ্য কোনো সময় কিংবা ঘটনার বাস্তবতা পাওয়া যায়নি। কিংবা যেগুলো শুধু অতীত কোনো ইতিহাসই নয়। এক্ষেত্রে ইতিহাস জ্ঞান না থাকার কারনে অনেক অর্থহীন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এরকম ইতিহাসগুলোই মূলত লোকজনের মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে যাদের ইতিহাস বিষয়ে কোনো পেশাগত অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের এখনো ইতিহাস এবং ইতিহাস শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সেকেলে বোঝাপড়া রয়েছে। আমরা কেবলমাত্র কিছু তারিখ, ঘটনার আলোকে ইতিহাসকে মনে রাখার চেষ্টা করি। যেমন একজন শিক্ষক কোনো ছাত্রকে পড়া দিয়ে থাকেন। অনেকটা কারো মোবাইল নাম্বারের তালিকার একটি ডায়রির মত ।
মানুষ এখনো মনে করে ইতিহাস হচ্ছে অতীতের তথ্য মাত্র। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন তারপরও তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়। আমি মনে করি তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কেবলমাত্র পরিচিত উৎস থেকে অনুসন্ধানের পাশাপাশি নতুন নতুন উৎস সংযোজন করা জরুরী। এবং সেগুলোর কতটা প্রমাণ আছে সতর্কতার সহিত পর্যালোচনার করাও জরুরী। আর এই পদ্ধতিটিকেই আমি বলছি ‘ঐতিহাসিক পদ্ধতি’।
দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে এভাবে ইতিহাস শিক্ষায় কেউ জোড় দেন না। স্কুল কিংবা কলেজ মাধ্যমে তো নয়ই। প্রথমত প্রমাণ এবং তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত সেটি কতটুকু সত্য তা যাচাই করে নিতে হবে। তৃতীয়ত হলো ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিলো সেটই নিশ্চিত করতে হবে। ক ঘটনাটি কি খ ঘটনাটির ফলাফল? ক এবং খ এই দুটো ঘটোনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না? অর্থাৎ দুটো গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার কারণ আছে কিনা সেটির যৌক্তিক বিশ্লেষন করতে হবে। এখনো অনেক পেশাগত ইতিহাসবিদ আছেন যারা শুধুমাত্র প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করেন। দ্বিতীয় ধাপটিতে যান না। ইতিহাস রচনার প্রতিটি বিশ্লেষন খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে করা চাই। প্রতিটি তথ্যের পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে। জনপ্রিয় ইতিহাসগুলোতে যৌক্তিক বিশ্লেষনের চেয়ে কল্পনা অনেক বেশি দৃশ্যত হয়।
যদি কেউ এই ধাপগুলোর ভিতর দিয়ে যায় কেবল তখনি সেটিকে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলা যায়। ইতিহাসকে এইভাবে ঘটনার পরম্পরা হিসেবে দেখার জন্য একটি যৌক্তিক বিশ্লেষন এবং বিবেচনাবর্তমানে বেশী জরুরী যেটি গেল কয়েকটি দশকে হয়নি। এটা পূর্বেও ছিলো তবে ভাল ইতিহাসবিদরা সেটি করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাসের সব ছাত্রদের মধ্যে সেটি থাকা চাই। যদিও এটা কঠিন সব ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
রণবীর চক্রবর্তীঃ যেহেতু আপনি বলেছেন তথ্য সংগ্রহ এবং সেটিকে বিচার বিশ্লেষনের কাজটি সহজ নয় তার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। এবং এক্ষেত্রে পেশাদারী আগ্রহটা অনেক বেশি জরুরী তাই নয় কি?
রমিলা থাপারঃ ঠিক বলেছ। মূল বিষয় হলো ইতিহাসগুলোর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসে নির্ভযোগ্য কোনো সূত্রে খোঁজে পাওয়া খুব জটিল। সেগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা করতে হবে। প্রাচীণ ভারতীয় ইতিহাসের বেশ কিছু বই পড়েই সেটি সম্ভব নয়। সেগুলো কাউকে বিশেষজ্ঞ বানাবে না। তোমাকে ধীরে ধীরে মূল উৎসের দিকে যেতে হবে। এরপর সেগুলোকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবে? তোমাকে সেই সময়ে ভাষার উৎস সম্পর্কেও জানতে হবে। সংস্কৃতে লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। বর্তমানে ইতিহাস জানার জন্য পুরাতত্ত্বের উপর নির্ভর করা যেতে পারে। কেননা সেটি বিজ্ঞানভিত্তিক। কখনো সেই সময়কার পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করলেও তুমি সেই সময়টিকে ভাল করে বুঝতে পারবে। তারপর ভাষাবিদ্যা সম্পর্কে জানতে হবে। শুধুমাত্র ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়। ভাষাগত নিয়মও জানতে হবে। ভাষার ধ্বনিগত পার্থক্য, ব্যাকরণ ইত্যাদি জানতে হবে। তাহলে বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে একটি যোগাযোগ তৈরি করা যাবে।
আমরা যখন ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম তখন আমরা বলেছি ঋগবেদের ভাষা হচ্ছে কেবল ‘ইন্দো-আর্য’ ভাষা। বেদ বিশেষজ্ঞরা তাতে একমত হলেও দেখা যাবে সেখানে দ্রাবিড়ীয় ভাষার কিছু কিছু উপাদান আছে। যদিও শেষমেষ মূল ভাষা হিসেবে ‘ইন্দো-আর্য’ থেকে যাবে।
ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধান অনুযায়ী তাহলে কি এটি কারো মনে কোনো সংশয়ের জন্ম দিবে না? অবশ্যই। কেননা কেউ এটা জোড় দিয়ে বলতে পারবে না যে সেই সময় শুধুমাত্র একটি ভাষাই প্রচলিত ছিলো শুধুমাত্র। যে ভাষায় মানুষ কথা বলতেন, লেখালেখি করতেন। যদি সে সময়ে আরেকটি ভাষা প্রচলিত থাকে এবং সেটি আর্যদের চেয়ে আলাদা, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই ভাষা দুটোর মধ্যে একটি সামঞ্জস্য ছিলো। তুমি হয়ত জিজ্ঞেস করতে পার তারা হয়ত দো-ভাষী ছিলো অথবা এর কোনো যথাযথ প্রমাণ আছে কি? কিংবা ভিন্ন ভাষার দুটো গোষ্ঠীর অধিকরণ এর প্রভাব আছে কি? আর এগুলোই ঋগবেদকে একটি আকর্ষনীয় ঐতিহাসিক গ্রন্থে রূপ দিয়েছে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্য নয় একই সঙ্গে অনেকগুলো সংস্কৃতির সহ অবস্থানের ফলে তা সম্ভব হয়েছে। তাহলে ইতিহাসবিদদের সেই সংস্কৃতিগুলোকেও জানতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে স্বরস্বতী নদী নিয়ে একধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেটির ইতিহাস সম্পর্কে এখনো কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। নানারকম প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। আর এরকম প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ অথবা না দিয়ে শেষ হয়ে যায় না। ইতিহাসে এরকম হ্যাঁ অথবা না দিয়ে প্রশ্ন উত্তর কোনো মানে রাখে না। ইতিহাসবিদকে তাদের বিশ্লেষনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। এটা এমনও হতে পারে প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। উনিশ শতকের একটি পর্যালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ যেরকম হয়েছে একুশ শতকে এসে সেটি আগের মত নাও থাকতে পারে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলো কিছু নির্দিষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সময়ে উন্মোচিত হয়ে থাকে।
ইতিহাসবিদকে তাদের বিশ্লেষনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। এটা এমনও হতে পারে প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। উনিশ শতকের একটি পর্যালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ যেরকম হয়েছে একুশ শতকে এসে সেটি আগের মত নাও থাকতে পারে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলো কিছু নির্দিষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সময়ে উন্মোচিত হয়ে থাকে।
সাধারণ মানুষজন ইতিহাসবিদের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। তাদের অতীত নিয়ে তেমন কোনো জ্ঞান কিংবা খুঁটিয়ে দেখবার ইচ্ছা থাকবে না। কিংবা তারা একটি নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা গোষ্ঠীর আলোকে সেটিকে বিবেচনা করবে। আমরা জানি অতীতের যেকোনো ঘটনা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জাতির নয়। যেরকম তুমি বলেছ ঋগবেদ শুধুমাত্র ইন্দো-আর্যদের গ্রন্থ নয়। এটি একটি নির্দিষ্ট ভাষায় লেখা হয়নি। কয়েক ধরনের ভাষার সংমিশ্রণ আছে সেখানে।
যাইহোক সাধারণ মানুষের বিচার বিশ্লেষণের দিকে আমি যাচ্ছি না। আমি বলছি জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইতিহাসবিদদের কথা। অনেকেই গবেষণা করে বলেছে, আর্যরা ইরান হয়ে মধ্য এশিয়ায় এসেছে। কিন্তু অনেকেই এখন এই ধারণা পোষণ করছেন আর্যরা ভারতে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী ছিলো। অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক করছেন যে, হরপ্পা সভ্যতা আর্যদেরই সৃষ্ট ছিলো। ভারতীয় সভ্যতায় অনার্য কোনো উপকরণ ছিলোই না। নানা কারনে এখন এই বিষয়গুলো আসছে এবং এগুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।
নির্দিষ্ট কিছু উৎস থেকে তথ্য নিয়ে নতুন এই পরিচ্ছন্ন আর্যবাদকে একটি খুব সহজভাবে সরলীকরণ করা হয়েছে। নানা রকম সম্ভাবনা এবং সমস্যাগুলোকে এখানে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রমাণ এবং মতবাদ এই দুটো দৃষ্টিকোণের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের অনেকেই ভাষাগত কিংবা স্থাপত্যগত দিক থেকে একমত হতে পারছিনা। আমরা বিতর্ক করেছি যে ঋগবেদের সময়কাল হরপ্পা সভ্যতার পরপরই। তাই তা প্রকৃতপক্ষে প্রাচীণ ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। হরপ্পা সভ্যতার স্থান হলো বর্তমান ওমান যেটির সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সংযোগ ছিলো।
এর কোনো প্রতিফলনই ঋগবেদে পাওয়া যায়নি। তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষে এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে সমসাময়িক অন্যান্য সংস্কৃতির মিশ্রন ঘটেছিলো। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্য থেকে শেষভাগের দিকে, যীশুর জন্মের পূর্বে, ঋগবেদের সময়কাল ধরা হয়ে থাকে। সে সময়ে আরো কিছু সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় যেমন বিভিন্ন ধূসর মৃৎপাত্র, কালো এবং লাল মৃৎপাত্রের ব্যবহার। একধরনের বৈচিত্র ছিলো। এর মধ্য দিয়ে আর্য ভাষা গোষ্ঠীরা তাদের বসতি স্থাপন করেছিলো। এবং এটা ভুলে গেলে চলবে না হরপ্পান এবং আর্য ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য ছিলো। যেখানে হরপ্পার অধিবাসীরা ছিলো অত্যাধুনিক শহুরে সংস্কৃতি পরিমণ্ডিত সেখানে আর্যরা ছিলো অশিক্ষিত এবং পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। যাদের শহুরে সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিলোনা।
রণবীর চক্রবর্তীঃ বিশেষ করে দক্ষিণ উপদ্বীপের ম্যাগাথিয়েটিক সংস্কৃতিতে কি ঘটছে তা পাঠের মধ্যে কমই প্রতিফলিত হয়।
রমিলা থাপারঃ বইগুলিতে প্রকৃত সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ করা হয় না। তবে এইসব গ্রন্থে বিভিন্ন দল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেদিকে আরো বাস্তবভাবে তাকানো জরুরী। ঋগবেদে দুটি বর্ণের উল্লেখ আছে আর্য ও দাস। দাসরা কে ছিলেন? ঋগবেদে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করে এবং বিভিন্ন দেবতাদের পূজা করে তারাই হলো দাস। এবং বৈদিক সময়ের লেখা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য ছিলো। তারা ধনী এবং তাদের গবাদিপশু সম্পদ-এর জন্য তারা বড়াই করতেন এবং তারা পৃথক বসতি গড়েছিলেন। তাই কিছু পণ্ডিত মনে করেন তারা ভিন্ন সংস্কৃতির ছিলেন। তাহলে আমরা প্রশ্ন করতে পারি ‘তারা কে?’
এবং কেন তারা পৌরানিকছিলো? তারপর দেখা যায় দাসী-পুত্র। যারা প্রথম দিকে সমাজে নিম্নশ্রেনীর বলে নিগৃহীত হত তারা যখন ক্ষমতায় আসল তাদেরকে আবার লোকজন ব্রাক্ষ্মন বলে স্বীকৃতিও দিল। একদিকে থেকে বিষয়টি পরস্পরবিরোধী (স্বভাবতই সমাজে দাসদের ছেলে-মেয়েদের নিম্ন চোখেই দেখা হয়)। দাসী-পুত্র কিভাবে ব্রাক্ষ্মন হতে পারে! বৈদিক পুরাণ বলছে দেবতা এবং অশুরদের মধ্যে সবসময়ই বিরোধ ছিলো। এক দিক থেকে এটি পুরাণ বটে কিন্তু পৌরানিক ঘটনাগুলো পুরোপুরি সত্য না হলেও তা প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থা বা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তারা তাদের নিজস্ব ধারণাগুলোকে নিজেদের তৈরি পৌরাণিক ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। তাই যদি ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’ এই দুটো শব্দের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে একের অধিক সংস্কৃতির অবস্থান বোঝা যায়। আর একারনেই ইতিহাসবিদরা বৈদিক সময়কাল খ্রীস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে হরপ্পা নগর সভ্যতা পর্যন্ত বলে বাদানুবাদ করছেন। এটা স্পষ্টতই সেখানে নানারকম সংস্কৃতির একটি সংযোগ ছিলো। যদি বিভিন্ন সংস্কৃতির একটি মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয় তাহলে নিঃসন্দেহে নানা সম্ভাবনার সূচনা করে। কিন্তু বৈদিক গ্রন্থগুলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। অথচ আজও পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ সত্ত্বেও নানারকম সংস্কৃতির বৈচিত্র বিদ্যমান।
রণবীর চক্রবর্তীঃ এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় একের অধিক সংস্কৃতির সমন্বয় ছিলো। যেহেতু আপনি প্রত্নতাত্তিক প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন সেহেতু আমি একটি প্রয়োজনীয় আবিষ্কারের কথা বলতে চাই। বছর পাঁচেক আগে আমার সঙ্গে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকারী ডেভিড এন্থনির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো এবং তিনি খুঁজে পেয়েছেন যে এটি ব্রোঞ্জ যোগের সময়কাল ছিলো। আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ২৫০০ বছর হবে। সে সময়ের অধিবাসীরা ব্রোঞ্জ দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতেন। কিন্তু তারা পুরোপুরি দক্ষ ছিলেন না। আকর্ষনীয় বিষয় এই যেধর্মীয় সংস্কার হিসেবে মৃত মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরার হাড় সমাহিত করার রীতি ছিলো। ঘোড়ার হার সমাহিত করার বিষয়টি শারীরীক স্পষ্টতার প্রমানের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের বিকৃতির চিহ্ন বহন করে। আর এই রীতিটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে মধ্য এশিয়াতে চালু ছিলো। ভারত থেকে অনেক দূরে ঘোড়া বলি দেওয়ার রীতি ছিলো। আমি বলছিনা সেটি অশ্বমেধ কিন্তু অনেকটা সেরকমই দেখা গিয়েছে। হয়ত পরবর্তিতে সেটিকেই বৈদিক গ্রন্থগুলোতে অন্তভূর্ক্ত করা হয়েছে। এগুলো যে শুধুমাত্র বৈদিক সংস্কৃতির অন্তভূর্ক নয় কেউ এই দাবি থেকে বেরিয়ে এসে বলতে পারেনা।
রমিলা থাপারঃ আসলে মূল বিষয় হলো আমরা সব সভ্যতার সেরা এই বিষয়টিকে সকলের নিকট উপস্থাপন করার চেষ্টা করা। এটা অনেক জনপ্রিয় আলোচনা যে আর্যরা এ অঞ্চলের আদিবাসী ছিলো। ভারতবর্ষ থেকে পরবর্তিতে পৃথিবীর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এবং ইউরোপে সভ্যতার বিস্তার ঘটিয়েছিলো। এই তত্ত্বটি উনিশ শতকের দিকে গড়ে উঠেছে এবং ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এটি প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন মার্কিন ধর্মতাত্ত্বিক কলোনেল হেনরি স্টিল ওলকট এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের নিকট সেটি গৃহীত হয়েছিলো। এই প্রথম অল্পের জন্য হলেও ধর্মতাত্ত্বিকরা আর্য সমাজের নিকটবর্তী হয়েছিলেন। তাছাড়া দয়ানন্দ স্বরস্বতী যিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি বিশ্বাস করেন যে আর্যরা তিব্বত থেকে ভারতে এসেছিলো।
এই ঐতিহাসিক তত্ত্বে জড়িয়ে থাকা বিতর্কগুলো ভারতের অতীতের সাক্ষ্য বহন করে।এবং তাদেরকে সেই জায়গা থেকে সরানো কঠিন হবে। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে তখন ইউরোপীয় আধিপত্যের সময়কাল ছিলো এবং আর্যদের উৎস অনুসন্ধান বিষয়টি ‘রেইস সায়েন্স’ এর একটি অংশ হিসেবে আলোচনা করা হতো। এই তত্ত্বগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্রোহী দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় যেমন আর্যবাদ বিংশ শতকের দিকে ইউরোপে এসেছে। ঐতিহাসিক তও্বগুলোর সঙ্গে চরম জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সমান্তরালে চলে আসে যা এই তত্ত্ব বিতর্কের জন্য আবশ্যক।
ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত প্রশ্নগুলো চর্চা করার জন্য পন্ডিতদের নানারকম মতামতের গুরত্ব দেওয়া উচিৎ কিন্তু দুঃখজনকভাবে ভারতে ‘আর্য’ প্রসঙ্গ এতটাই রাজনীতিগত হয়ে উঠেছে যে, কেউ যদি ভারতীয়দের আদি উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা আর্যদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদেরকে নানারকম কূট মন্তব্য শুনতে হয় এতে করে ঐতিহাসিক বিতর্কগুলোর সম্ভাবনা ক্রমেই হ্রাস পেয়ে যায়।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি কি উপলব্ধি করেন যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এমন কিছু আছে যা মানবজাতির আদর্শ থেকে আলাদা বলে কিছু মনে হয়?
রমিলা থাপারঃ আমি মনে করি অতীতকে ভিন্নভাবে দেখার একটি ভয়,একটি সরলীকৃত একক প্রভাবশালী সংস্কৃতির পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির জটিল মিথস্ক্রিয়া হিসাবে সেটিকে দেখার একটি ভয়। তার মানে হলো বিশ্বব্যাপী অন্য সব সংস্কৃতির মত আমাদের সংস্কৃতিরএকাধিক উৎস আছে এবং অনেক শতাব্দী ধরে সেটি বিকশিত হয়েছে এই সত্যটিকে স্বীকার করে নেওয়ার আস্থা আমাদের নেই।
রণবীর চক্রবর্তীঃ এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, এটি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয় কি ?
রমিলা থাপারঃ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে মূলত প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ে সংস্কৃতির যেরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো তার উপর ভিত্তি করে। মৌর্যরা কিভাবে তাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি্লো? কিভাবে গুপ্ত, চোল, এবং মোঘল সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছিলো? এটি এমন কিছু বিষয় যা আমরা চিন্তা করি না, কারণ এর পুনর্গঠন সহজ নয়। কিন্তু এই সবকিছুকে বিবেচনা করার জন্য আমাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে বিবেচনা করা উচিত। কেবলমাত্র উপনিবেশিক ধারনাগুলো থেকে বের হলেই বোঝা যাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিগুলোকতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । এটি ইন্দোনেশিয়ার মতো ভারতের জন্যও সত্য এবং পেরু এবং মেক্সিকোরদিকে তাকালে আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে।
ঐতিহ্যগুলো মূলত আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রীতিনীতির ভিতর দিয়ে। তাই বিবর্তিত হওয়া বর্তমান রীতিনীতিগুলো দিয়ে হাজার বছর পূর্বের সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হবে। কেননা এই দীর্ঘ বিবর্তনের ভিতর দিয়ে রীতিনীতিগুলোকে অনেকভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে। আমি ১৯৭৫ এর দিকে কেরালায় একটি বৈদিক আচারে (‘অগ্নিছায়া’) উপস্থিত ছিলাম যা মূলত নাম্বুদিরি ব্রাক্ষ্মণ দ্বারা পরিচালিত হত। তারা বৈদিক গ্রন্থগুলো থেকে মন্ত্র পাঠ করছিলেন এবং ঘোষনা দিচ্ছিলেন যেন সবকিছু গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে।
কেউ যদি ‘আর্য’ শব্দটির উৎস সন্ধান করতে যায় সংস্কৃত, প্রকৃত কিংবা পালি ভাষায় তাহলে দেখা যাবে তিনটি ভাষায় কিভাবে তা বদলে যাচ্ছে আর এই তথ্য উনিশ শতকের ধারনা কিংবা ব্যাখ্যাকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করবে কে কাকে আর্য বলে ডাকত? এবং কেন ডাকত? কিভাবেই এই প্রথম শব্দটি ব্যবহার হয়েছে? পালি গ্রন্থে ‘আর্য’ শব্দটি দিয়ে একরকম সামাজিক অবস্থানকে বোঝাতো। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা পেশাগত দিক থেকে যারা উচ্চ শ্রেনীর ছিলেন। আবার এই একই শ্রেনীকে বিষ্ণু পুরাণে নাস্তিক বলে শ্রেনীভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান যেসব ধারণা টিকে রয়েছে সেগুলো সব উপনিবেশিক ধারণা হতে জন্ম নিয়েছে এবং ধারনা করা হচ্ছে এগুলোই আদি ধারণা।
ঐতিহ্যগুলো মূলত আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রীতিনীতির ভিতর দিয়ে। তাই বিবর্তিত হওয়া বর্তমান রীতিনীতিগুলো দিয়ে হাজার বছর পূর্বের সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হবে। কেননা এই দীর্ঘ বিবর্তনের ভিতর দিয়ে রীতিনীতিগুলোকে অনেকভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে।
আদি আর্যবাদ অর্থাৎ আর্যদের আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি এসেছে মূলত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ থেকে- হিন্দু সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধানের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। এই একক সংস্কৃতির প্রভাব খুব সহজে চলে যায়নি। গুপ্তযুগ পরবর্তি পাওয়া খুদাই লিপিতে তাদের পূর্বপুরুষ এবং রাজবংশের ইতিহাস পাওয়া যায় যা তাদের সময়কালকে গৌরবান্বিত করে রচনা করা হয়েছে। গুপ্তদের পূর্বপুরুষ এবং বংশধরদেরইতিহাস বৈচিত্রপূর্ণ ছিলো। এবং সেটিকে বৈধতা দেওয়ার বিভিন্ন উৎসের রয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বহু সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যায়। এটি সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি করে। যদিও সেটি উপনিবেশিক, ধর্মীয়, ভাষাগত বা জাতিগত জাতীয়তাবাদের বিরোধী। জাতীয় আন্দোলনগুলি সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করার মাধ্যমে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষাকে একচেটিয়া ভাবে ধারণ করে। আর এতে করেরাজনৈতিক সমর্থন খুব সহজে পাওয়া যায় বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী হলে। পন্ডিতদের মতে হিন্দুবাদ এবং হিন্দুত্ব একই জিনিস। হিন্দুবাদ হলো ধর্মীয় মতবাদ এবং হিন্দুত্ব হলো রাজনৈতিক পরিচয়। হিন্দুত্ব খুব আধুনিক একটি মতাদর্শ যা হিন্দুধর্মের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু কিছুটা পরিমার্জিত। এই ধারণাটি মূলত বিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। ধর্মীয় আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলার জন্য হিন্দু ধর্মকে কিছুটা প্রয়োজন অনুযায়ী পুণরায় তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। আর এই পুনর্গঠন মূলত অভিজাত এবং রক্ষণশীল শ্রেনীর দ্বারা করা হয়েছে। হিন্দুত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, গোত্র এবং ভাষাকে উপস্থাপন করে। হিন্দুদের অবশ্যই একটি পিতৃভূমি এবং পূন্যভূমি, পূর্বপুরুষ এবং ধর্ম থাকতে হবে। তাদের বাইরেঅন্য গোত্রীয়রা হবে এখানে বিদেশি। এটাও সেই সেমিটিক ধর্মগুলোর মত একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস, ধর্ম, পবিত্র গ্রন্থের কথা বলা যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠির জীবন-যাপন এবং রাজনীতিকে সহজ করে দেয়। আমি বলি ‘সিন্ডিকেটেড হিন্দুবাদ’।
হিন্দু জাতীয় সংস্কৃতিতে তাদের মহাকাব্য গুলো সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সেগুলোর একের অধিক সংস্করণ রয়েছে। আর সমস্যা হলো সেখানে, বলা হয়ে থাকে একটি সংস্করণ সঠিক বাকি গুলো ভুল। আর রামায়ণ নিয়ে তাই হয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একটিকে বৈধতা দেয় যা ইতিহাসবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভুলে গেলে চলবেনা দক্ষিন-পশ্চিম এশিয়াতে রামায়ণের অনেকগুলো সংস্করণ রয়েছে। যেগুলো একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে যা বাল্মিকীর রামায়ণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলবে না। তার কারণ হলো এই মহাকাব্য একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর লোকজন সেটিকে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের মত করে পরিবর্তন করে নিয়েছে।
কখনো কখনো দেখা যায় ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে ধরে নিয়ে সেটিকে ধ্রুপদী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অথবা একটি একক সংস্কৃতির প্রভাবকে অতিরঞ্জিতভাবে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এবং সেটিই জাতীয় আন্দোলনের মূল হয়ে উঠে। আর সমস্য তৈরি হয় একারনেই যে, এই একক সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ফলেসেটি আর পূর্বের মত তার অবস্থানে থাকে না।
অন্যান্য ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকে সমমর্যাদা দিতে চাইলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে হবে। তাহলে দেখা যাবে কেউ যখন রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির কথা বলবে তখন শুধুমাত্র একটি একক ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকে বোঝাবে না। সেখানে অবশ্যই একের অধিক সংস্কৃতিকে বোঝাবে। ভারতে নানারকম সংস্কৃতি রয়েছে- আদিবাসী, দলিত, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, ফার্সী এবং আরো অন্যান্য সম্প্রদায় যাদেরকে রাষ্ট্র তেমন গুরুত্ব দেয়না। কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইলে বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে প্রাধাণ্য দিয়ে ইতিহাস তৈরি করতে হবে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ অনেক ক্ষেত্রে, আমরা দেখতে পাই যারা ক্ষমতালোভী বা একটি বিশেষ দল যেটি ক্ষমতাশীল হতে চায় একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এটা স্পষ্টভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কোনো সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য নয়। আর এটা ইতিহাস পাঠের জন্য ক্ষতিকর।
রমিলা থাপারঃ হ্যাঁ অবশ্যই সেটি ইতিহাস পাঠের জন্য ক্ষতিকর। এটা বলা যায় না যে ইতিহাসের প্রতিটি সময় বিদ্যমান সব সম্প্রদায়েকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মানে কি এই যে ঐতিহাসিকরা অবহেলিত অন্যান্য সম্প্রদায়ের দিকে নজর দিবেনা। অবশ্যই দিতে হবে, বহুসংস্কৃতিগুলোর সহ অবস্থানের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে । উনিশ শতকের সামাজ সংস্কার আন্দোলনে দেখা যায় লেখকগণ একই সামাজিক পটভূমি থেকে এসেছেন এবং হিন্দু ধর্মের প্রকৃতিতে তারা যে পরিবর্তনগুলি করেছেন তা অঞ্চলভেদে খুব একটা আলাদা ছিল না, তবে নির্বাচন এবং গঠনগুলি আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত ছিল।
এটি ঐতিহাসিক ছবিতেই স্পষ্ট হয়ে আছে। উনিশ শতকের এই ধর্মীয় সংস্করণ ভারতীয় ধর্মগুলোকে কিছুটা হলেও একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে যখন পন্ডিতগণ সেই সংস্কার গুলোকে চিহ্নিত করেছেন এবং লোকজন সেটিকে সমর্থন দিয়েছেন সেটির একটি ভাল ফল হয়েছে। তাদের মনোযোগ মূলত ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচালিত হয়েছিল, কারণ এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি মূলত উচ্চ শ্রেণীর উপর প্রভাব ফেলেছিল। এটা সমাজের শ্রেণী বিভাগকে আরো স্পষ্ট করে যা ছিল, এক অর্থে, আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দখল করা। এটি জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে সচেতন ছিল এবং পরে উপনিবেশিক মনিবরা যখন চলে গিয়েছিল তখন তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। কিছু ঐতিহাসিকরাও সমাজতান্ত্রিক সমাজের নীচের দিক থেকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তদন্ত শুরু করে। এটি ‘সাবল্টার্ন স্টাডির’ মাধ্যমে শুরু হয় এবং জনসাধারণের মনোযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু তা খুব শীঘ্রই স্বীকৃত হয় যে অনেকগুলি সামাজিক পর্যায় যেমন দলিত ও আদিবাসী হিসাবেও অনেকগুলি জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন উপায়ে অংশগ্রহণকারী ছিলেন। আরেকট প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোন দলটি জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে পরিণত করেছে বর্তমান রাজনীতির ধারাবাহিকতায়?
কিন্তু দেখা যায় এই প্রশ্নগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়না কারণ জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণমূলক ও সমালোচনামূলক গবেষণাগুলি রাজনীতিবিদদের দ্বারা হয়ে থাকে এবং এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হলে জনগণকে দেশপ্রেমনেই বলে গণ্য করা হয়। যদি ‘ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ’ এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করা যায় তাহলেই বিষয়টি আরো পরিস্কার বোঝা যাবে।
ঐতিহাসিক গবেষণাগুলো এইক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়ছে। যদি ইতিহাস জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদের একটি উপাদান হয়ে থাকে (যেরকম এরিক হবসম পপি এবং হিরোইন এর মধ্যে তুলনা করেছিলেন) তাহলে এই বিচিত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষা এবং গোত্র অবশ্যই বিচিত্র ইতিহাস দাবি করে। এবং ব্যাক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সেরকম হতে হবে। আর এই দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উত্তর উপননিবেশিক ভারতে বহুবিচিত্র সংস্কৃতির স্বীকৃতি দাবি করে এবং একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রকাশকে হ্রাস করে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টিই আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি মূলত বিদ্যমান ধর্মগুলোর সহবস্থানকে নির্দেশ করে। যা আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলা হয় যে ভারতীয় সভ্যতা এমন একটি সভ্যতা যেখানে বহু ধর্মকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে সন্মান দেওয়া মানেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে বোঝায় না যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মকে গুরত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত করা না হয়। যদি আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ধর্মগুলিকে যুক্ত করি, যেমন আমরা অবিলম্বে করছি, তাহলে এই পার্থক্যগুলি থেকে একটি ধর্মীয় সমধিকার রাষ্ট্রের অভাব স্পষ্ট অনুমান করা যায়।
আরকেটি গোলমাল তৈরি হয় ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ নিয়ে। ইউরোপী অনেক দেশগুলোতে ক্যাথলিক গীর্জাগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ক্যাথলিক গীর্জাগুলো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমরা নিঃসন্দে সেক্যুলারিজম বলতে আমাদের সমাজকে সেরকম অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইনা। পন্ডিতরা ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটিকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে রাখতে চান যার অর্থ দাঁড়ায় ধর্মকে পাশ কাটিয়েসমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলা সম্ভব নয়।
ঐতিহাসিক গবেষণাগুলো এইক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়ছে। যদি ইতিহাস জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদের একটি উপাদান হয়ে থাকে (যেরকম এরিক হবসম পপি এবং হিরোইন এর মধ্যে তুলনা করেছিলেন) তাহলে এই বিচিত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষা এবং গোত্র অবশ্যই বিচিত্র ইতিহাস দাবি করে। এবং ব্যাক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সেরকম হতে হবে। আর এই দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উত্তর উপননিবেশিক ভারতে বহুবিচিত্র সংস্কৃতির স্বীকৃতি দাবি করে এবং একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রকাশকে হ্রাস করে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি একের অধিক পরিচয়ের কথা বলছেন?
রমিলা থাপারঃ আমি একটি ‘মুক্ত পরিচিত’ ব্যবহার করতে চাই। যদি `প্রকৃত-গণতন্ত্র’ বলে কিছু থাকে তাহলে সেখানে একটি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আধিপত্য থাকতে পারেনা। তাহলে বেশিরভাগ পরিবর্তনগুলো নিয়ে কারা আলোচনা করবে এবং সেটির সমাধান করবে। যদি ভূমি-সংস্কারের কথাই বলি তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়টিই গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ দিবে। যদি শিক্ষা-সংস্কারের কথা বলি তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সেখানে সব নির্ধারন করবে।
অন্যদিকে আমি মনে করি স্কুল শিক্ষার সময় থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারনাটি এমন হতে হবে যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আগত সবাইকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়টির ধারনা তৈরি হবে এবং গণতন্ত্রে তাদের ভূমিকা থাকবে। কারো সংখ্যা একটু বেশি হতে পারে। তাহলে দেখা যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারনাটি পূর্ব নির্ধারিত একটি ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীই হবে না। যখনি কেউ গণতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবে তখন এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝাবে যেখানে নানারকম পরিচয়গুলোর অবস্থান থাকবে এবং তাদের মতামতের গুরুত্ব থাকবে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ কিন্তু দুঃখজনক হলো বর্তমানে ব্যক্তি পরিচয় বলতে কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়টিকেই বোঝায়। উনিশশতকের পূর্বে আদমশুমারি নিবন্ধন গুলোতে নির্দিষ্ট ধর্ম এবং সম্প্রদায়ভুক্ত পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যেত যা এখন আর নেই। সেটি অব্যাহত থাকা প্রয়োজন।
রমিলা থাপারঃ তুমি যদি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বল তাহলে অবশ্যই তোমাকে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের গণতন্ত্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে এই বিষয়গুলো জোড়ালোভাবেই অভ্যেস করতে হবে। কিন্ত তারপরও সেখানে উগ্রজাতীয়তাবাদের একটা প্রবণতা থাকবে। কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম বিষয়টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুরুত্ব পেয়ে যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তির পরিচয় তৈরি হয়।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি বিশেষ করে দেখিয়েছেন যে প্রকৃতভাবে প্রাচীন ভারতকে জানার জন্য নির্ভরযোগ্য আদর্শিক কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। অন্যান্য অনেক ইতিহাসবিদরাও সেরকম ধারণা করেন। আপনি স্পষ্টভাবে আদর্শগত এবং বর্ণনামূলক তথ্যসূত্রগুলির মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। এবং সেটির জন্য ইতিহাসবিদদের একটি পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়। পেশাদারী ঐতিহাসিক গবেষণা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রয়োজনও রয়েছে। সাধারণ প্রচলিত ইতিহাস এবং পেশাদারী ইতিহাসবিদদের রচিত ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য বোঝাও জরুরী বলে মনে করেন।
রমিলা থাপারঃ ইতিহাসবিদরা আদর্শিক গ্রন্থগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছেন এবং কেন সেখানে বিভিন্ন নিয়মগুলি তৈরি করা হয়েছে সেগুলো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মনু, আটটি স্বতন্ত্র ও বিচিত্র বিয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কন্যাদান বা কণ্যাকে রাক্ষসের কাছে উপহার দেওয়া কিংবা নারীদের অপহরণ করা এই বিষয়গুলো অনেকটা ভৌতিক।একটা সমাজ সমান্তরালভাবে আট রকমের বিবাহের চর্চা করবে ব্যাপারটি অসম্ভব। আমরা সবাই জানি যে প্রতিটি বর্ণ এবং সংস্কৃতি তাদের সম্পর্কগুলোর বিষয়ে কেমন সচেতন থাকে। যদি আট রকম বিবাহের নিয়ম থেকেই থাকে তাহলে সেগুলোর কারণ কি?
নাকি সেগুলো একপ্রকার কল্পনা? আর এই বিবাহগুলোর সঙ্গে কারা সম্পর্কযুক্ত? নিঃসন্দেহে সেখানে বিভিন্নরকম সংস্কৃতির উপস্থিতি ছিলো এবং তারা সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র পান্ডবদের পরিবারেই তিন প্রজন্ম ধরে তিনরকমের বিবাহ রীতি প্রচলিত ছিলো- বধু ক্রয় করা, একের অধিক ভাই কতৃক একই নারীকে বিবাহ করা এবং ভাইদের কণ্যা-পুত্রদের মধ্যে বিবাহ করা। ইতিহাসবিদদের এইসব প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যে এই নিয়মগুলো কি সত্যি কোনো আদর্শিক বিষয় ছিলো নাকি সেই সময়ের বাস্তবতা ছিলো। নাকি পান্ডবরা ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদদের বিভ্রান্ত করার জন্য তা করেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কৃত গ্রন্থগুলোতে ‘চ’ অথবা ‘আদি’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে সেটিকে আরো কঠিন করার প্রয়োজনে।
এটা বহুত্বকে প্রকাশ করার একটি নির্দেশনা বলা যায়। কিন্তু সেটির অন্যান্য নির্দেশনাও রয়েছে যা খ্রীস্ট পরবর্তি প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিক হতে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিক এর শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। আমি চম্বা শিলালিপি পড়েছিলাম। হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে উঠা একটি প্রদেশ হলো চম্বা। এবং সেটিকে চম্বা বংশাবলীর উপাখ্যানের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু প্রাচীন শিলালিপিতে ব্রাক্ষ্মনদের শর্মা নামে অভিহিত করা হত। অর্থাৎ এই পদবীদ্বারা এটা স্পষ্ট করে বোঝানো হতো যে তারা ব্রাক্ষণ। এর কয়েক শতাব্দী পর পাওয়া কিছু শিলালিপিতে নিন্মমানের সংস্কৃত শব্দে চম্বালি ভাষার কিছু শব্দকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্রাক্ষ্মনদের ‘বাবু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। চম্বালীতে স্থানীয় ব্রাক্ষ্মনদের বাবু বলেই ডাকা হতো। এতে বোঝা যায় যখন এই সম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো সেখানে কিছু ব্রাক্ষ্মনদের বাইরে থেকে বিশেষ কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্নের কাজে নিয়ে আসা হয়েছিলো। যারা গৌড় এবং কৌনজ ব্রাক্ষ্মন ছিলেন। ধীরে ধীরে তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় নামকরণ করা হয়েছিলো।
(সংক্ষেপিত)
লেখাটি FRONTLINE-এ প্রকাশিত Linking The Past and The Present থেকে নেয়া হয়েছে এবং শুধুমাত্র ইতিহাস বিষয়ক প্রশ্নগুলোতে রমিলা থাপার-এর আলাপ নিয়ে মূল সাক্ষাৎকার থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করা হয়েছে।
https://www.ongkar.net/2017/07/29/ভারতীয়-সেক্যুলারিজম-হলো-2/
http://www.frontline.in/cover-story/linking-the-past-and-the-present/article7599425.ece
written by অজিত দাশ
ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনার শেষ বই ‘দ্যা পাস্ট অ্যাজ প্রেজেন্ট’ পড়ে আমার কাছে মনে হলো আপনি আমাদের ইতিহাস পাঠের বিষয়টি নিয়ে অনেকটা আশাহত হয়েছেন। যদিও আপনি নিরাশাবাদী নন এটা স্পষ্ট করে লিখেছেনও। এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
রমিলা থাপারঃ আসলে শেষ কয়েকটি দশক ভারতের ইতিহাস রচনার অবস্থাটি লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে। আমি ইতিহাসের দুটো ধাপ এর কথা বলবো যেভাবে ইতিহাস রচনা এবং অধ্যয়ন হয়ে থাকে। একটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ ইতিহাসবিদ রচিত ইতিহাস। তারা সকলেই ভাল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। যদি পঞ্চাশ বছর আগের ইতিহাসশিক্ষা পদ্ধতির কথা বিবেচনা করি তাহলে বলবো তখনকার চেয়ে এখন কিছুটা হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। যদিও সেই পরিবর্তনকে আমি সার্বজনীন বলব না। এখনো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে ইতিহাস শিক্ষা দিতে পারছেন না। তবে বর্তমানে অনেক ইতিহাসবিদই আছেন যারা ইতিহাসকে সমাজ বিজ্ঞানের চেয়ে একধাপ এগিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভিত্তি বলে মনে করেন। আর এ কারনে যে কারো প্রত্যাশা আরো বৃদ্ধি পাবে।
আর অন্যদিকটি হলো ঠিক বিপরীত। সাধারণ মানুষের নিকট যে ইতিহাসগুলো জনপ্রিয়। যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। শতবছর আগেও যে ইতিহাসগুলোর নির্ভরযোগ্য কোনো সময় কিংবা ঘটনার বাস্তবতা পাওয়া যায়নি। কিংবা যেগুলো শুধু অতীত কোনো ইতিহাসই নয়। এক্ষেত্রে ইতিহাস জ্ঞান না থাকার কারনে অনেক অর্থহীন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এরকম ইতিহাসগুলোই মূলত লোকজনের মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে যাদের ইতিহাস বিষয়ে কোনো পেশাগত অভিজ্ঞতা নেই। আমাদের এখনো ইতিহাস এবং ইতিহাস শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সেকেলে বোঝাপড়া রয়েছে। আমরা কেবলমাত্র কিছু তারিখ, ঘটনার আলোকে ইতিহাসকে মনে রাখার চেষ্টা করি। যেমন একজন শিক্ষক কোনো ছাত্রকে পড়া দিয়ে থাকেন। অনেকটা কারো মোবাইল নাম্বারের তালিকার একটি ডায়রির মত ।
মানুষ এখনো মনে করে ইতিহাস হচ্ছে অতীতের তথ্য মাত্র। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন তারপরও তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়। আমি মনে করি তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কেবলমাত্র পরিচিত উৎস থেকে অনুসন্ধানের পাশাপাশি নতুন নতুন উৎস সংযোজন করা জরুরী। এবং সেগুলোর কতটা প্রমাণ আছে সতর্কতার সহিত পর্যালোচনার করাও জরুরী। আর এই পদ্ধতিটিকেই আমি বলছি ‘ঐতিহাসিক পদ্ধতি’।
দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে এভাবে ইতিহাস শিক্ষায় কেউ জোড় দেন না। স্কুল কিংবা কলেজ মাধ্যমে তো নয়ই। প্রথমত প্রমাণ এবং তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত সেটি কতটুকু সত্য তা যাচাই করে নিতে হবে। তৃতীয়ত হলো ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিলো সেটই নিশ্চিত করতে হবে। ক ঘটনাটি কি খ ঘটনাটির ফলাফল? ক এবং খ এই দুটো ঘটোনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না? অর্থাৎ দুটো গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার কারণ আছে কিনা সেটির যৌক্তিক বিশ্লেষন করতে হবে। এখনো অনেক পেশাগত ইতিহাসবিদ আছেন যারা শুধুমাত্র প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করেন। দ্বিতীয় ধাপটিতে যান না। ইতিহাস রচনার প্রতিটি বিশ্লেষন খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে করা চাই। প্রতিটি তথ্যের পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে। জনপ্রিয় ইতিহাসগুলোতে যৌক্তিক বিশ্লেষনের চেয়ে কল্পনা অনেক বেশি দৃশ্যত হয়।
যদি কেউ এই ধাপগুলোর ভিতর দিয়ে যায় কেবল তখনি সেটিকে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলা যায়। ইতিহাসকে এইভাবে ঘটনার পরম্পরা হিসেবে দেখার জন্য একটি যৌক্তিক বিশ্লেষন এবং বিবেচনাবর্তমানে বেশী জরুরী যেটি গেল কয়েকটি দশকে হয়নি। এটা পূর্বেও ছিলো তবে ভাল ইতিহাসবিদরা সেটি করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাসের সব ছাত্রদের মধ্যে সেটি থাকা চাই। যদিও এটা কঠিন সব ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
রণবীর চক্রবর্তীঃ যেহেতু আপনি বলেছেন তথ্য সংগ্রহ এবং সেটিকে বিচার বিশ্লেষনের কাজটি সহজ নয় তার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। এবং এক্ষেত্রে পেশাদারী আগ্রহটা অনেক বেশি জরুরী তাই নয় কি?
রমিলা থাপারঃ ঠিক বলেছ। মূল বিষয় হলো ইতিহাসগুলোর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসে নির্ভযোগ্য কোনো সূত্রে খোঁজে পাওয়া খুব জটিল। সেগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা করতে হবে। প্রাচীণ ভারতীয় ইতিহাসের বেশ কিছু বই পড়েই সেটি সম্ভব নয়। সেগুলো কাউকে বিশেষজ্ঞ বানাবে না। তোমাকে ধীরে ধীরে মূল উৎসের দিকে যেতে হবে। এরপর সেগুলোকে কিভাবে বিশ্লেষণ করবে? তোমাকে সেই সময়ে ভাষার উৎস সম্পর্কেও জানতে হবে। সংস্কৃতে লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। বর্তমানে ইতিহাস জানার জন্য পুরাতত্ত্বের উপর নির্ভর করা যেতে পারে। কেননা সেটি বিজ্ঞানভিত্তিক। কখনো সেই সময়কার পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করলেও তুমি সেই সময়টিকে ভাল করে বুঝতে পারবে। তারপর ভাষাবিদ্যা সম্পর্কে জানতে হবে। শুধুমাত্র ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়। ভাষাগত নিয়মও জানতে হবে। ভাষার ধ্বনিগত পার্থক্য, ব্যাকরণ ইত্যাদি জানতে হবে। তাহলে বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে একটি যোগাযোগ তৈরি করা যাবে।
আমরা যখন ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম তখন আমরা বলেছি ঋগবেদের ভাষা হচ্ছে কেবল ‘ইন্দো-আর্য’ ভাষা। বেদ বিশেষজ্ঞরা তাতে একমত হলেও দেখা যাবে সেখানে দ্রাবিড়ীয় ভাষার কিছু কিছু উপাদান আছে। যদিও শেষমেষ মূল ভাষা হিসেবে ‘ইন্দো-আর্য’ থেকে যাবে।
ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধান অনুযায়ী তাহলে কি এটি কারো মনে কোনো সংশয়ের জন্ম দিবে না? অবশ্যই। কেননা কেউ এটা জোড় দিয়ে বলতে পারবে না যে সেই সময় শুধুমাত্র একটি ভাষাই প্রচলিত ছিলো শুধুমাত্র। যে ভাষায় মানুষ কথা বলতেন, লেখালেখি করতেন। যদি সে সময়ে আরেকটি ভাষা প্রচলিত থাকে এবং সেটি আর্যদের চেয়ে আলাদা, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই ভাষা দুটোর মধ্যে একটি সামঞ্জস্য ছিলো। তুমি হয়ত জিজ্ঞেস করতে পার তারা হয়ত দো-ভাষী ছিলো অথবা এর কোনো যথাযথ প্রমাণ আছে কি? কিংবা ভিন্ন ভাষার দুটো গোষ্ঠীর অধিকরণ এর প্রভাব আছে কি? আর এগুলোই ঋগবেদকে একটি আকর্ষনীয় ঐতিহাসিক গ্রন্থে রূপ দিয়েছে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্য নয় একই সঙ্গে অনেকগুলো সংস্কৃতির সহ অবস্থানের ফলে তা সম্ভব হয়েছে। তাহলে ইতিহাসবিদদের সেই সংস্কৃতিগুলোকেও জানতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে স্বরস্বতী নদী নিয়ে একধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেটির ইতিহাস সম্পর্কে এখনো কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। নানারকম প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। আর এরকম প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ অথবা না দিয়ে শেষ হয়ে যায় না। ইতিহাসে এরকম হ্যাঁ অথবা না দিয়ে প্রশ্ন উত্তর কোনো মানে রাখে না। ইতিহাসবিদকে তাদের বিশ্লেষনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। এটা এমনও হতে পারে প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। উনিশ শতকের একটি পর্যালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ যেরকম হয়েছে একুশ শতকে এসে সেটি আগের মত নাও থাকতে পারে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলো কিছু নির্দিষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সময়ে উন্মোচিত হয়ে থাকে।
ইতিহাসবিদকে তাদের বিশ্লেষনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। এটা এমনও হতে পারে প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে। উনিশ শতকের একটি পর্যালোচনা কিংবা বিশ্লেষণ যেরকম হয়েছে একুশ শতকে এসে সেটি আগের মত নাও থাকতে পারে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলো কিছু নির্দিষ্ট জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সময়ে উন্মোচিত হয়ে থাকে।
সাধারণ মানুষজন ইতিহাসবিদের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। তাদের অতীত নিয়ে তেমন কোনো জ্ঞান কিংবা খুঁটিয়ে দেখবার ইচ্ছা থাকবে না। কিংবা তারা একটি নির্দিষ্ট ধর্ম কিংবা গোষ্ঠীর আলোকে সেটিকে বিবেচনা করবে। আমরা জানি অতীতের যেকোনো ঘটনা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জাতির নয়। যেরকম তুমি বলেছ ঋগবেদ শুধুমাত্র ইন্দো-আর্যদের গ্রন্থ নয়। এটি একটি নির্দিষ্ট ভাষায় লেখা হয়নি। কয়েক ধরনের ভাষার সংমিশ্রণ আছে সেখানে।
যাইহোক সাধারণ মানুষের বিচার বিশ্লেষণের দিকে আমি যাচ্ছি না। আমি বলছি জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইতিহাসবিদদের কথা। অনেকেই গবেষণা করে বলেছে, আর্যরা ইরান হয়ে মধ্য এশিয়ায় এসেছে। কিন্তু অনেকেই এখন এই ধারণা পোষণ করছেন আর্যরা ভারতে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী ছিলো। অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক করছেন যে, হরপ্পা সভ্যতা আর্যদেরই সৃষ্ট ছিলো। ভারতীয় সভ্যতায় অনার্য কোনো উপকরণ ছিলোই না। নানা কারনে এখন এই বিষয়গুলো আসছে এবং এগুলো নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।
নির্দিষ্ট কিছু উৎস থেকে তথ্য নিয়ে নতুন এই পরিচ্ছন্ন আর্যবাদকে একটি খুব সহজভাবে সরলীকরণ করা হয়েছে। নানা রকম সম্ভাবনা এবং সমস্যাগুলোকে এখানে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রমাণ এবং মতবাদ এই দুটো দৃষ্টিকোণের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের অনেকেই ভাষাগত কিংবা স্থাপত্যগত দিক থেকে একমত হতে পারছিনা। আমরা বিতর্ক করেছি যে ঋগবেদের সময়কাল হরপ্পা সভ্যতার পরপরই। তাই তা প্রকৃতপক্ষে প্রাচীণ ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। হরপ্পা সভ্যতার স্থান হলো বর্তমান ওমান যেটির সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সংযোগ ছিলো।
এর কোনো প্রতিফলনই ঋগবেদে পাওয়া যায়নি। তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষে এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে সমসাময়িক অন্যান্য সংস্কৃতির মিশ্রন ঘটেছিলো। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্য থেকে শেষভাগের দিকে, যীশুর জন্মের পূর্বে, ঋগবেদের সময়কাল ধরা হয়ে থাকে। সে সময়ে আরো কিছু সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় যেমন বিভিন্ন ধূসর মৃৎপাত্র, কালো এবং লাল মৃৎপাত্রের ব্যবহার। একধরনের বৈচিত্র ছিলো। এর মধ্য দিয়ে আর্য ভাষা গোষ্ঠীরা তাদের বসতি স্থাপন করেছিলো। এবং এটা ভুলে গেলে চলবে না হরপ্পান এবং আর্য ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য ছিলো। যেখানে হরপ্পার অধিবাসীরা ছিলো অত্যাধুনিক শহুরে সংস্কৃতি পরিমণ্ডিত সেখানে আর্যরা ছিলো অশিক্ষিত এবং পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। যাদের শহুরে সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিলোনা।
রণবীর চক্রবর্তীঃ বিশেষ করে দক্ষিণ উপদ্বীপের ম্যাগাথিয়েটিক সংস্কৃতিতে কি ঘটছে তা পাঠের মধ্যে কমই প্রতিফলিত হয়।
রমিলা থাপারঃ বইগুলিতে প্রকৃত সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ করা হয় না। তবে এইসব গ্রন্থে বিভিন্ন দল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেদিকে আরো বাস্তবভাবে তাকানো জরুরী। ঋগবেদে দুটি বর্ণের উল্লেখ আছে আর্য ও দাস। দাসরা কে ছিলেন? ঋগবেদে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করে এবং বিভিন্ন দেবতাদের পূজা করে তারাই হলো দাস। এবং বৈদিক সময়ের লেখা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য ছিলো। তারা ধনী এবং তাদের গবাদিপশু সম্পদ-এর জন্য তারা বড়াই করতেন এবং তারা পৃথক বসতি গড়েছিলেন। তাই কিছু পণ্ডিত মনে করেন তারা ভিন্ন সংস্কৃতির ছিলেন। তাহলে আমরা প্রশ্ন করতে পারি ‘তারা কে?’
এবং কেন তারা পৌরানিকছিলো? তারপর দেখা যায় দাসী-পুত্র। যারা প্রথম দিকে সমাজে নিম্নশ্রেনীর বলে নিগৃহীত হত তারা যখন ক্ষমতায় আসল তাদেরকে আবার লোকজন ব্রাক্ষ্মন বলে স্বীকৃতিও দিল। একদিকে থেকে বিষয়টি পরস্পরবিরোধী (স্বভাবতই সমাজে দাসদের ছেলে-মেয়েদের নিম্ন চোখেই দেখা হয়)। দাসী-পুত্র কিভাবে ব্রাক্ষ্মন হতে পারে! বৈদিক পুরাণ বলছে দেবতা এবং অশুরদের মধ্যে সবসময়ই বিরোধ ছিলো। এক দিক থেকে এটি পুরাণ বটে কিন্তু পৌরানিক ঘটনাগুলো পুরোপুরি সত্য না হলেও তা প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থা বা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তারা তাদের নিজস্ব ধারণাগুলোকে নিজেদের তৈরি পৌরাণিক ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। তাই যদি ‘আমাদের’ এবং ‘তাদের’ এই দুটো শব্দের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে একের অধিক সংস্কৃতির অবস্থান বোঝা যায়। আর একারনেই ইতিহাসবিদরা বৈদিক সময়কাল খ্রীস্ট পূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে হরপ্পা নগর সভ্যতা পর্যন্ত বলে বাদানুবাদ করছেন। এটা স্পষ্টতই সেখানে নানারকম সংস্কৃতির একটি সংযোগ ছিলো। যদি বিভিন্ন সংস্কৃতির একটি মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয় তাহলে নিঃসন্দেহে নানা সম্ভাবনার সূচনা করে। কিন্তু বৈদিক গ্রন্থগুলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। অথচ আজও পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ সত্ত্বেও নানারকম সংস্কৃতির বৈচিত্র বিদ্যমান।
রণবীর চক্রবর্তীঃ এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় একের অধিক সংস্কৃতির সমন্বয় ছিলো। যেহেতু আপনি প্রত্নতাত্তিক প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন সেহেতু আমি একটি প্রয়োজনীয় আবিষ্কারের কথা বলতে চাই। বছর পাঁচেক আগে আমার সঙ্গে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকারী ডেভিড এন্থনির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো এবং তিনি খুঁজে পেয়েছেন যে এটি ব্রোঞ্জ যোগের সময়কাল ছিলো। আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ২৫০০ বছর হবে। সে সময়ের অধিবাসীরা ব্রোঞ্জ দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করতেন। কিন্তু তারা পুরোপুরি দক্ষ ছিলেন না। আকর্ষনীয় বিষয় এই যেধর্মীয় সংস্কার হিসেবে মৃত মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরার হাড় সমাহিত করার রীতি ছিলো। ঘোড়ার হার সমাহিত করার বিষয়টি শারীরীক স্পষ্টতার প্রমানের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের বিকৃতির চিহ্ন বহন করে। আর এই রীতিটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে মধ্য এশিয়াতে চালু ছিলো। ভারত থেকে অনেক দূরে ঘোড়া বলি দেওয়ার রীতি ছিলো। আমি বলছিনা সেটি অশ্বমেধ কিন্তু অনেকটা সেরকমই দেখা গিয়েছে। হয়ত পরবর্তিতে সেটিকেই বৈদিক গ্রন্থগুলোতে অন্তভূর্ক্ত করা হয়েছে। এগুলো যে শুধুমাত্র বৈদিক সংস্কৃতির অন্তভূর্ক নয় কেউ এই দাবি থেকে বেরিয়ে এসে বলতে পারেনা।
রমিলা থাপারঃ আসলে মূল বিষয় হলো আমরা সব সভ্যতার সেরা এই বিষয়টিকে সকলের নিকট উপস্থাপন করার চেষ্টা করা। এটা অনেক জনপ্রিয় আলোচনা যে আর্যরা এ অঞ্চলের আদিবাসী ছিলো। ভারতবর্ষ থেকে পরবর্তিতে পৃথিবীর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এবং ইউরোপে সভ্যতার বিস্তার ঘটিয়েছিলো। এই তত্ত্বটি উনিশ শতকের দিকে গড়ে উঠেছে এবং ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এটি প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন মার্কিন ধর্মতাত্ত্বিক কলোনেল হেনরি স্টিল ওলকট এবং ধর্মতাত্ত্বিকদের নিকট সেটি গৃহীত হয়েছিলো। এই প্রথম অল্পের জন্য হলেও ধর্মতাত্ত্বিকরা আর্য সমাজের নিকটবর্তী হয়েছিলেন। তাছাড়া দয়ানন্দ স্বরস্বতী যিনি আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি বিশ্বাস করেন যে আর্যরা তিব্বত থেকে ভারতে এসেছিলো।
এই ঐতিহাসিক তত্ত্বে জড়িয়ে থাকা বিতর্কগুলো ভারতের অতীতের সাক্ষ্য বহন করে।এবং তাদেরকে সেই জায়গা থেকে সরানো কঠিন হবে। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে তখন ইউরোপীয় আধিপত্যের সময়কাল ছিলো এবং আর্যদের উৎস অনুসন্ধান বিষয়টি ‘রেইস সায়েন্স’ এর একটি অংশ হিসেবে আলোচনা করা হতো। এই তত্ত্বগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্রোহী দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় যেমন আর্যবাদ বিংশ শতকের দিকে ইউরোপে এসেছে। ঐতিহাসিক তও্বগুলোর সঙ্গে চরম জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সমান্তরালে চলে আসে যা এই তত্ত্ব বিতর্কের জন্য আবশ্যক।
ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত প্রশ্নগুলো চর্চা করার জন্য পন্ডিতদের নানারকম মতামতের গুরত্ব দেওয়া উচিৎ কিন্তু দুঃখজনকভাবে ভারতে ‘আর্য’ প্রসঙ্গ এতটাই রাজনীতিগত হয়ে উঠেছে যে, কেউ যদি ভারতীয়দের আদি উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা আর্যদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদেরকে নানারকম কূট মন্তব্য শুনতে হয় এতে করে ঐতিহাসিক বিতর্কগুলোর সম্ভাবনা ক্রমেই হ্রাস পেয়ে যায়।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি কি উপলব্ধি করেন যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এমন কিছু আছে যা মানবজাতির আদর্শ থেকে আলাদা বলে কিছু মনে হয়?
রমিলা থাপারঃ আমি মনে করি অতীতকে ভিন্নভাবে দেখার একটি ভয়,একটি সরলীকৃত একক প্রভাবশালী সংস্কৃতির পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির জটিল মিথস্ক্রিয়া হিসাবে সেটিকে দেখার একটি ভয়। তার মানে হলো বিশ্বব্যাপী অন্য সব সংস্কৃতির মত আমাদের সংস্কৃতিরএকাধিক উৎস আছে এবং অনেক শতাব্দী ধরে সেটি বিকশিত হয়েছে এই সত্যটিকে স্বীকার করে নেওয়ার আস্থা আমাদের নেই।
রণবীর চক্রবর্তীঃ এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, এটি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয় কি ?
রমিলা থাপারঃ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে মূলত প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ে সংস্কৃতির যেরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো তার উপর ভিত্তি করে। মৌর্যরা কিভাবে তাদের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি্লো? কিভাবে গুপ্ত, চোল, এবং মোঘল সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছিলো? এটি এমন কিছু বিষয় যা আমরা চিন্তা করি না, কারণ এর পুনর্গঠন সহজ নয়। কিন্তু এই সবকিছুকে বিবেচনা করার জন্য আমাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে বিবেচনা করা উচিত। কেবলমাত্র উপনিবেশিক ধারনাগুলো থেকে বের হলেই বোঝা যাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিগুলোকতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । এটি ইন্দোনেশিয়ার মতো ভারতের জন্যও সত্য এবং পেরু এবং মেক্সিকোরদিকে তাকালে আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে।
ঐতিহ্যগুলো মূলত আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রীতিনীতির ভিতর দিয়ে। তাই বিবর্তিত হওয়া বর্তমান রীতিনীতিগুলো দিয়ে হাজার বছর পূর্বের সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হবে। কেননা এই দীর্ঘ বিবর্তনের ভিতর দিয়ে রীতিনীতিগুলোকে অনেকভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে। আমি ১৯৭৫ এর দিকে কেরালায় একটি বৈদিক আচারে (‘অগ্নিছায়া’) উপস্থিত ছিলাম যা মূলত নাম্বুদিরি ব্রাক্ষ্মণ দ্বারা পরিচালিত হত। তারা বৈদিক গ্রন্থগুলো থেকে মন্ত্র পাঠ করছিলেন এবং ঘোষনা দিচ্ছিলেন যেন সবকিছু গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে।
কেউ যদি ‘আর্য’ শব্দটির উৎস সন্ধান করতে যায় সংস্কৃত, প্রকৃত কিংবা পালি ভাষায় তাহলে দেখা যাবে তিনটি ভাষায় কিভাবে তা বদলে যাচ্ছে আর এই তথ্য উনিশ শতকের ধারনা কিংবা ব্যাখ্যাকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করবে কে কাকে আর্য বলে ডাকত? এবং কেন ডাকত? কিভাবেই এই প্রথম শব্দটি ব্যবহার হয়েছে? পালি গ্রন্থে ‘আর্য’ শব্দটি দিয়ে একরকম সামাজিক অবস্থানকে বোঝাতো। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা পেশাগত দিক থেকে যারা উচ্চ শ্রেনীর ছিলেন। আবার এই একই শ্রেনীকে বিষ্ণু পুরাণে নাস্তিক বলে শ্রেনীভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান যেসব ধারণা টিকে রয়েছে সেগুলো সব উপনিবেশিক ধারণা হতে জন্ম নিয়েছে এবং ধারনা করা হচ্ছে এগুলোই আদি ধারণা।
ঐতিহ্যগুলো মূলত আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রীতিনীতির ভিতর দিয়ে। তাই বিবর্তিত হওয়া বর্তমান রীতিনীতিগুলো দিয়ে হাজার বছর পূর্বের সংস্কৃতিকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হবে। কেননা এই দীর্ঘ বিবর্তনের ভিতর দিয়ে রীতিনীতিগুলোকে অনেকভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে।
আদি আর্যবাদ অর্থাৎ আর্যদের আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি এসেছে মূলত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ থেকে- হিন্দু সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধানের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। এই একক সংস্কৃতির প্রভাব খুব সহজে চলে যায়নি। গুপ্তযুগ পরবর্তি পাওয়া খুদাই লিপিতে তাদের পূর্বপুরুষ এবং রাজবংশের ইতিহাস পাওয়া যায় যা তাদের সময়কালকে গৌরবান্বিত করে রচনা করা হয়েছে। গুপ্তদের পূর্বপুরুষ এবং বংশধরদেরইতিহাস বৈচিত্রপূর্ণ ছিলো। এবং সেটিকে বৈধতা দেওয়ার বিভিন্ন উৎসের রয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বহু সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যায়। এটি সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি করে। যদিও সেটি উপনিবেশিক, ধর্মীয়, ভাষাগত বা জাতিগত জাতীয়তাবাদের বিরোধী। জাতীয় আন্দোলনগুলি সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করার মাধ্যমে ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একটি নির্দিষ্ট ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষাকে একচেটিয়া ভাবে ধারণ করে। আর এতে করেরাজনৈতিক সমর্থন খুব সহজে পাওয়া যায় বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী হলে। পন্ডিতদের মতে হিন্দুবাদ এবং হিন্দুত্ব একই জিনিস। হিন্দুবাদ হলো ধর্মীয় মতবাদ এবং হিন্দুত্ব হলো রাজনৈতিক পরিচয়। হিন্দুত্ব খুব আধুনিক একটি মতাদর্শ যা হিন্দুধর্মের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু কিছুটা পরিমার্জিত। এই ধারণাটি মূলত বিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। ধর্মীয় আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলার জন্য হিন্দু ধর্মকে কিছুটা প্রয়োজন অনুযায়ী পুণরায় তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। আর এই পুনর্গঠন মূলত অভিজাত এবং রক্ষণশীল শ্রেনীর দ্বারা করা হয়েছে। হিন্দুত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, গোত্র এবং ভাষাকে উপস্থাপন করে। হিন্দুদের অবশ্যই একটি পিতৃভূমি এবং পূন্যভূমি, পূর্বপুরুষ এবং ধর্ম থাকতে হবে। তাদের বাইরেঅন্য গোত্রীয়রা হবে এখানে বিদেশি। এটাও সেই সেমিটিক ধর্মগুলোর মত একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস, ধর্ম, পবিত্র গ্রন্থের কথা বলা যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠির জীবন-যাপন এবং রাজনীতিকে সহজ করে দেয়। আমি বলি ‘সিন্ডিকেটেড হিন্দুবাদ’।
হিন্দু জাতীয় সংস্কৃতিতে তাদের মহাকাব্য গুলো সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সেগুলোর একের অধিক সংস্করণ রয়েছে। আর সমস্যা হলো সেখানে, বলা হয়ে থাকে একটি সংস্করণ সঠিক বাকি গুলো ভুল। আর রামায়ণ নিয়ে তাই হয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একটিকে বৈধতা দেয় যা ইতিহাসবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভুলে গেলে চলবেনা দক্ষিন-পশ্চিম এশিয়াতে রামায়ণের অনেকগুলো সংস্করণ রয়েছে। যেগুলো একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে যা বাল্মিকীর রামায়ণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলবে না। তার কারণ হলো এই মহাকাব্য একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর লোকজন সেটিকে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেদের মত করে পরিবর্তন করে নিয়েছে।
কখনো কখনো দেখা যায় ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে ধরে নিয়ে সেটিকে ধ্রুপদী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অথবা একটি একক সংস্কৃতির প্রভাবকে অতিরঞ্জিতভাবে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এবং সেটিই জাতীয় আন্দোলনের মূল হয়ে উঠে। আর সমস্য তৈরি হয় একারনেই যে, এই একক সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ফলেসেটি আর পূর্বের মত তার অবস্থানে থাকে না।
অন্যান্য ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকে সমমর্যাদা দিতে চাইলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে হবে। তাহলে দেখা যাবে কেউ যখন রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির কথা বলবে তখন শুধুমাত্র একটি একক ধর্ম কিংবা সংস্কৃতিকে বোঝাবে না। সেখানে অবশ্যই একের অধিক সংস্কৃতিকে বোঝাবে। ভারতে নানারকম সংস্কৃতি রয়েছে- আদিবাসী, দলিত, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, ফার্সী এবং আরো অন্যান্য সম্প্রদায় যাদেরকে রাষ্ট্র তেমন গুরুত্ব দেয়না। কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইলে বহু সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে প্রাধাণ্য দিয়ে ইতিহাস তৈরি করতে হবে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ অনেক ক্ষেত্রে, আমরা দেখতে পাই যারা ক্ষমতালোভী বা একটি বিশেষ দল যেটি ক্ষমতাশীল হতে চায় একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এটা স্পষ্টভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কোনো সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য নয়। আর এটা ইতিহাস পাঠের জন্য ক্ষতিকর।
রমিলা থাপারঃ হ্যাঁ অবশ্যই সেটি ইতিহাস পাঠের জন্য ক্ষতিকর। এটা বলা যায় না যে ইতিহাসের প্রতিটি সময় বিদ্যমান সব সম্প্রদায়েকে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মানে কি এই যে ঐতিহাসিকরা অবহেলিত অন্যান্য সম্প্রদায়ের দিকে নজর দিবেনা। অবশ্যই দিতে হবে, বহুসংস্কৃতিগুলোর সহ অবস্থানের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে । উনিশ শতকের সামাজ সংস্কার আন্দোলনে দেখা যায় লেখকগণ একই সামাজিক পটভূমি থেকে এসেছেন এবং হিন্দু ধর্মের প্রকৃতিতে তারা যে পরিবর্তনগুলি করেছেন তা অঞ্চলভেদে খুব একটা আলাদা ছিল না, তবে নির্বাচন এবং গঠনগুলি আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত ছিল।
এটি ঐতিহাসিক ছবিতেই স্পষ্ট হয়ে আছে। উনিশ শতকের এই ধর্মীয় সংস্করণ ভারতীয় ধর্মগুলোকে কিছুটা হলেও একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে যখন পন্ডিতগণ সেই সংস্কার গুলোকে চিহ্নিত করেছেন এবং লোকজন সেটিকে সমর্থন দিয়েছেন সেটির একটি ভাল ফল হয়েছে। তাদের মনোযোগ মূলত ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচালিত হয়েছিল, কারণ এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি মূলত উচ্চ শ্রেণীর উপর প্রভাব ফেলেছিল। এটা সমাজের শ্রেণী বিভাগকে আরো স্পষ্ট করে যা ছিল, এক অর্থে, আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দখল করা। এটি জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে সচেতন ছিল এবং পরে উপনিবেশিক মনিবরা যখন চলে গিয়েছিল তখন তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। কিছু ঐতিহাসিকরাও সমাজতান্ত্রিক সমাজের নীচের দিক থেকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তদন্ত শুরু করে। এটি ‘সাবল্টার্ন স্টাডির’ মাধ্যমে শুরু হয় এবং জনসাধারণের মনোযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু তা খুব শীঘ্রই স্বীকৃত হয় যে অনেকগুলি সামাজিক পর্যায় যেমন দলিত ও আদিবাসী হিসাবেও অনেকগুলি জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন উপায়ে অংশগ্রহণকারী ছিলেন। আরেকট প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোন দলটি জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে পরিণত করেছে বর্তমান রাজনীতির ধারাবাহিকতায়?
কিন্তু দেখা যায় এই প্রশ্নগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়না কারণ জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণমূলক ও সমালোচনামূলক গবেষণাগুলি রাজনীতিবিদদের দ্বারা হয়ে থাকে এবং এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হলে জনগণকে দেশপ্রেমনেই বলে গণ্য করা হয়। যদি ‘ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ’ এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করা যায় তাহলেই বিষয়টি আরো পরিস্কার বোঝা যাবে।
ঐতিহাসিক গবেষণাগুলো এইক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়ছে। যদি ইতিহাস জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদের একটি উপাদান হয়ে থাকে (যেরকম এরিক হবসম পপি এবং হিরোইন এর মধ্যে তুলনা করেছিলেন) তাহলে এই বিচিত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষা এবং গোত্র অবশ্যই বিচিত্র ইতিহাস দাবি করে। এবং ব্যাক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সেরকম হতে হবে। আর এই দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উত্তর উপননিবেশিক ভারতে বহুবিচিত্র সংস্কৃতির স্বীকৃতি দাবি করে এবং একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রকাশকে হ্রাস করে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টিই আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি মূলত বিদ্যমান ধর্মগুলোর সহবস্থানকে নির্দেশ করে। যা আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলা হয় যে ভারতীয় সভ্যতা এমন একটি সভ্যতা যেখানে বহু ধর্মকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে সন্মান দেওয়া মানেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে বোঝায় না যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মকে গুরত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত করা না হয়। যদি আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ধর্মগুলিকে যুক্ত করি, যেমন আমরা অবিলম্বে করছি, তাহলে এই পার্থক্যগুলি থেকে একটি ধর্মীয় সমধিকার রাষ্ট্রের অভাব স্পষ্ট অনুমান করা যায়।
আরকেটি গোলমাল তৈরি হয় ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ নিয়ে। ইউরোপী অনেক দেশগুলোতে ক্যাথলিক গীর্জাগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ক্যাথলিক গীর্জাগুলো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমরা নিঃসন্দে সেক্যুলারিজম বলতে আমাদের সমাজকে সেরকম অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইনা। পন্ডিতরা ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটিকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে রাখতে চান যার অর্থ দাঁড়ায় ধর্মকে পাশ কাটিয়েসমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলা সম্ভব নয়।
ঐতিহাসিক গবেষণাগুলো এইক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়ছে। যদি ইতিহাস জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদের একটি উপাদান হয়ে থাকে (যেরকম এরিক হবসম পপি এবং হিরোইন এর মধ্যে তুলনা করেছিলেন) তাহলে এই বিচিত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষা এবং গোত্র অবশ্যই বিচিত্র ইতিহাস দাবি করে। এবং ব্যাক্তি পরিচয়ের রাজনীতিও সেরকম হতে হবে। আর এই দৃষ্টিভংগি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উত্তর উপননিবেশিক ভারতে বহুবিচিত্র সংস্কৃতির স্বীকৃতি দাবি করে এবং একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রকাশকে হ্রাস করে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি একের অধিক পরিচয়ের কথা বলছেন?
রমিলা থাপারঃ আমি একটি ‘মুক্ত পরিচিত’ ব্যবহার করতে চাই। যদি `প্রকৃত-গণতন্ত্র’ বলে কিছু থাকে তাহলে সেখানে একটি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আধিপত্য থাকতে পারেনা। তাহলে বেশিরভাগ পরিবর্তনগুলো নিয়ে কারা আলোচনা করবে এবং সেটির সমাধান করবে। যদি ভূমি-সংস্কারের কথাই বলি তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়টিই গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ দিবে। যদি শিক্ষা-সংস্কারের কথা বলি তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সেখানে সব নির্ধারন করবে।
অন্যদিকে আমি মনে করি স্কুল শিক্ষার সময় থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারনাটি এমন হতে হবে যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আগত সবাইকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়টির ধারনা তৈরি হবে এবং গণতন্ত্রে তাদের ভূমিকা থাকবে। কারো সংখ্যা একটু বেশি হতে পারে। তাহলে দেখা যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারনাটি পূর্ব নির্ধারিত একটি ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীই হবে না। যখনি কেউ গণতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবে তখন এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝাবে যেখানে নানারকম পরিচয়গুলোর অবস্থান থাকবে এবং তাদের মতামতের গুরুত্ব থাকবে।
রণবীর চক্রবর্তীঃ কিন্তু দুঃখজনক হলো বর্তমানে ব্যক্তি পরিচয় বলতে কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়টিকেই বোঝায়। উনিশশতকের পূর্বে আদমশুমারি নিবন্ধন গুলোতে নির্দিষ্ট ধর্ম এবং সম্প্রদায়ভুক্ত পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যেত যা এখন আর নেই। সেটি অব্যাহত থাকা প্রয়োজন।
রমিলা থাপারঃ তুমি যদি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বল তাহলে অবশ্যই তোমাকে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের গণতন্ত্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে এই বিষয়গুলো জোড়ালোভাবেই অভ্যেস করতে হবে। কিন্ত তারপরও সেখানে উগ্রজাতীয়তাবাদের একটা প্রবণতা থাকবে। কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম বিষয়টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুরুত্ব পেয়ে যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তির পরিচয় তৈরি হয়।
রণবীর চক্রবর্তীঃ আপনি বিশেষ করে দেখিয়েছেন যে প্রকৃতভাবে প্রাচীন ভারতকে জানার জন্য নির্ভরযোগ্য আদর্শিক কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। অন্যান্য অনেক ইতিহাসবিদরাও সেরকম ধারণা করেন। আপনি স্পষ্টভাবে আদর্শগত এবং বর্ণনামূলক তথ্যসূত্রগুলির মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। এবং সেটির জন্য ইতিহাসবিদদের একটি পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়। পেশাদারী ঐতিহাসিক গবেষণা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার প্রয়োজনও রয়েছে। সাধারণ প্রচলিত ইতিহাস এবং পেশাদারী ইতিহাসবিদদের রচিত ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য বোঝাও জরুরী বলে মনে করেন।
রমিলা থাপারঃ ইতিহাসবিদরা আদর্শিক গ্রন্থগুলো নিয়ে প্রশ্ন করছেন এবং কেন সেখানে বিভিন্ন নিয়মগুলি তৈরি করা হয়েছে সেগুলো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মনু, আটটি স্বতন্ত্র ও বিচিত্র বিয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কন্যাদান বা কণ্যাকে রাক্ষসের কাছে উপহার দেওয়া কিংবা নারীদের অপহরণ করা এই বিষয়গুলো অনেকটা ভৌতিক।একটা সমাজ সমান্তরালভাবে আট রকমের বিবাহের চর্চা করবে ব্যাপারটি অসম্ভব। আমরা সবাই জানি যে প্রতিটি বর্ণ এবং সংস্কৃতি তাদের সম্পর্কগুলোর বিষয়ে কেমন সচেতন থাকে। যদি আট রকম বিবাহের নিয়ম থেকেই থাকে তাহলে সেগুলোর কারণ কি?
নাকি সেগুলো একপ্রকার কল্পনা? আর এই বিবাহগুলোর সঙ্গে কারা সম্পর্কযুক্ত? নিঃসন্দেহে সেখানে বিভিন্নরকম সংস্কৃতির উপস্থিতি ছিলো এবং তারা সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র পান্ডবদের পরিবারেই তিন প্রজন্ম ধরে তিনরকমের বিবাহ রীতি প্রচলিত ছিলো- বধু ক্রয় করা, একের অধিক ভাই কতৃক একই নারীকে বিবাহ করা এবং ভাইদের কণ্যা-পুত্রদের মধ্যে বিবাহ করা। ইতিহাসবিদদের এইসব প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যে এই নিয়মগুলো কি সত্যি কোনো আদর্শিক বিষয় ছিলো নাকি সেই সময়ের বাস্তবতা ছিলো। নাকি পান্ডবরা ভবিষ্যতে ইতিহাসবিদদের বিভ্রান্ত করার জন্য তা করেছে। স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কৃত গ্রন্থগুলোতে ‘চ’ অথবা ‘আদি’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে সেটিকে আরো কঠিন করার প্রয়োজনে।
এটা বহুত্বকে প্রকাশ করার একটি নির্দেশনা বলা যায়। কিন্তু সেটির অন্যান্য নির্দেশনাও রয়েছে যা খ্রীস্ট পরবর্তি প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিক হতে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিক এর শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। আমি চম্বা শিলালিপি পড়েছিলাম। হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে উঠা একটি প্রদেশ হলো চম্বা। এবং সেটিকে চম্বা বংশাবলীর উপাখ্যানের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু প্রাচীন শিলালিপিতে ব্রাক্ষ্মনদের শর্মা নামে অভিহিত করা হত। অর্থাৎ এই পদবীদ্বারা এটা স্পষ্ট করে বোঝানো হতো যে তারা ব্রাক্ষণ। এর কয়েক শতাব্দী পর পাওয়া কিছু শিলালিপিতে নিন্মমানের সংস্কৃত শব্দে চম্বালি ভাষার কিছু শব্দকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্রাক্ষ্মনদের ‘বাবু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। চম্বালীতে স্থানীয় ব্রাক্ষ্মনদের বাবু বলেই ডাকা হতো। এতে বোঝা যায় যখন এই সম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো সেখানে কিছু ব্রাক্ষ্মনদের বাইরে থেকে বিশেষ কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্নের কাজে নিয়ে আসা হয়েছিলো। যারা গৌড় এবং কৌনজ ব্রাক্ষ্মন ছিলেন। ধীরে ধীরে তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় নামকরণ করা হয়েছিলো।
(সংক্ষেপিত)
লেখাটি FRONTLINE-এ প্রকাশিত Linking The Past and The Present থেকে নেয়া হয়েছে এবং শুধুমাত্র ইতিহাস বিষয়ক প্রশ্নগুলোতে রমিলা থাপার-এর আলাপ নিয়ে মূল সাক্ষাৎকার থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করা হয়েছে।
https://www.ongkar.net/2017/07/29/ভারতীয়-সেক্যুলারিজম-হলো-2/
http://www.frontline.in/cover-story/linking-the-past-and-the-present/article7599425.ece
No comments:
Post a Comment