Friday 11 August 2017

রাখিবন্ধন উৎসব ও ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় একজন কবি জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাখিবন্ধন উৎসব ও ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় একজন কবি জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরimages (22)
সাংস্কৃতিক উৎসবের ধর্মীয় রঙ হয় কিন্তু কোন কোন সময়ে তা ধর্মীয় রঙ ছাড়িয়ে রাজনৈতিক রুপও ধারন করে। তেমনি একটি উদাহরন হল রাখীবন্ধন উৎসব, যা সমগ্র উপমহাদেশে এখনো প্রাসঙ্গিক।
রাখিবন্ধনকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। বস্তত এই ব্যাবহারের উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার উচু শ্রেনীর হিন্দু জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রাখি বন্ধন কর্মসূচি
১৭ সেপ্টেম্বর কোলকাতার সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির ভাষণে প্রস্তাব রাখেন –১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব। দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজনীতিকরা ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করে।
রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রাখি-সঙ্গীত
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল—পূণ্য হউক, পূণ্য হউক’ রচনা করেন।
৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন– বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলো মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও দূরে সরাবে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন।তিনি লিখেছেন–হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।
কিন্তু তার এহেন প্রস্তাব বা বক্তৃতায় ফল হয়েছিল নিতান্তই সামান্য। বঙ্গভঙ্গ যদিও ব্রিটশদের “ডিভাইড এন্ড রুল” পলিসির ফল ছিল, তথাপিও এর ফলে লাভবান হয়েছিল পূর্ব বাংলার কৃষক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়। এই ধর্মীয় পরিচয়টিই কলকাতার দাদা জমিদারদের পছন্দনীয় ছিল না।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোলকাতার দাদা জমিদারদের সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ হয়তো প্রশমন হয়েছিল পূর্ব বাংলার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে , কিন্তু তাদের মূল লক্ষ বঙ্গের ঐক্য রক্ষা আদৌ সম্ভব হয়নি। ৪৭ ভারত ভাগের সাথে সাথেই বাংলাও ভেঙ্গেছে, এমনকি সোহরাওয়ার্দি-সুভাস বসুর ঐক্যবদ্ধ বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাবেও কলকাতার জমিদার ও সাম্প্রদায়িক শ্রেনীর কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্তত এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের আসল চেহারা।
শ্রাবণের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রাখীবন্ধনের অনুষ্ঠান । এই রাখী বন্ধনের প্রথম সূচনা কবে,তা’ আজ আর জানার উপায় নেই । এ নিয়ে নানা ধরনের মত বিদ্যমান । তবে পৌরানিক এক কাহিনী থেকে জানা য়ায়, দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে দেবতারা পরাজিত হলে, দেবরাজ ইন্দ্র জয়লাভের পথ খুঁজতে দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে যখন যাচ্ছিলেন, সেইসময় ইন্দ্রের পত্নী ইন্দ্রানী দেবরাজকে বললেন, তিনি জানেন কি উপায়ে অসুরদের পরাজিত করা য়ায় ।
আর সেই উপায় হিসাবে পরদিন শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমাতে ইন্দ্রানী স্বামীর হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন ‘রক্ষাকবচ ‘। এবার ইন্দ্র অসুরদের পরাজিত করতে সমর্থ হলেন । এই রক্ষাকবচটি ছিল একটি ‘রাখী ‘। পৌরানিক কাহিনীতে স্ত্রী স্বামীর হাতে রাখী বেঁধে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালে রীতির পরিবর্তন হয়, এবং সাধারণতঃ বোনেরা ভাইদের হাতে রাখী বেঁধে দেয়, বা প্রিয়জন ।
এটা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব । কেউ কেউ বলেন, আর্যদের প্রভাবেই এই বাংলায় রক্ষাবন্ধন প্রচলিত হতে শুরু করে এবং পরবর্তীকালে । অবাঙালী ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের আগমন ও বঙ্গভূমিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের ফলে তাদের দেখাদেখি রাখীবন্ধন এই বাংলায় জনপ্রিয় হতে থাকে । এমন একটা সময় ছিল, যখন আমাদের দেশের পুরোহিত প্রধানরা তাঁদের শত শত শিষ্যের হাতে রাখী পরিয়ে দিতেন । পুরাণ কাহিনী থেকে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণের কল্যান-কামনায় মা যশোদা, রাখীপূর্ণিমার দিন পুত্রের হাতে রাখী পরিয়ে দিতেন । প্রাচীনকাল থেকেই নারীরাই পুরুষের হাতে রাখী পরিয়ে দিয়ে আসছেন । বোন ভাইকে রাখী পরায় অথবা ভাই ভেবে বরণ করে নিতে চায়,এমন কাউকেই রাখীর বন্ধনে জড়িয়ে নেয় ।
https://www.google.co.uk/amp/s/somikkhon.wordpress.com/2014/12/18/রাখিবন্ধন-উৎসব-ও-বঙ্গভঙ্/amp/

No comments:

Post a Comment