Friday 11 August 2017

মুমিনের গুণাবলী

FB_IMG_1502048636840

মুমিনের গুণাবলী
ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : সূরা হুযুরাতের ১৫নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, প্রকৃত মুমিন তারাই, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর আর কোনো সন্দেহে পড়ে না। এবং নিজেদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। আর এরাই তাদের ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী। সূরা আনফালের ২-৪ আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, তাদের সামনে আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা আল্লাহর ওপর আস্থাশীল ও নির্ভরশীল হয়ে থাকে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক থেকে ব্যয় করে। বস্তুত এরাই হচ্ছে সত্যিকারের মুমিন। তাদের জন্য আল্লাহর নিকট খুবই উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। আরো রয়েছে অপরাধের ক্ষমা ও অতি উত্তম রিযিক। সূরা নূরের ৫১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, মুমিনের বৈশিষ্ট্য এই যে, যখন তাদের মাঝে ফয়সালার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানের প্রতি ডাকা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরূপ লোকেরাই প্রকৃত সফলকাম। সূরা রাদের ২৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। সূরা আল ইমরানের ২৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, মুমিনরা যেন মুমিনদের ছাড়া কাফিরদের বন্ধু না বানায়। আর যে কেউ এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে যদি তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের কোনো ভয়ের আশঙ্কা থাকে। আর আল্লাহ তোমাদের তার নিজের ব্যাপারে সতর্ক করছেন এবং আল্লাহর নিকটই প্রত্যাবর্তন।
‘মুমিনের নিকট ঈমানের অপরিহার্য দাবি শাহাদাত। সৃষ্টির আদি হতে এযাবতকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীন ধারাবাহিকতা, সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন সংঘাত, কল্যাণ ও অকল্যাণের রশি টানাটানি, আলো-আঁধারের বৈপরিত্য সুন্দরের আরোহী কাঠিন্যতার প্রাচীর মাড়িয়ে ফুলের উৎসব অসুন্দরের আস্ফালন ও হীনতার অতলগহ্বরে পতন ঠেকাতে একজন মুমিনের সমগ্র জীবনের প্রকাশ জীবনাচার হবে শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত। তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় বিষয়; হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, সামাজিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক লেনদেন, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও মননশীলতা, অবসর ও বিনোদন, শয়ন ও জাগরণ সবকিছুই বিপ্লবী ঘোষণা দেবে শাহাদাতের চূড়ান্ত প্রত্যাশা, মুমিনের জীবন চলার প্রতিটি কদম, তাদের প্রতিটি স্পর্শ, চাহনির প্রতিটি পলক, জিহ্বার প্রতিটি বুলি, লেখনীর প্রতিটি আঁচড়, ব্যয়ের প্রতিটি কপর্দক, সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এবং হৃদয়ের সব অনুভূতি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার জন্য থাকে সতত নিবেদিত।
শাহাদাত বা শাহাদাহ শব্দটি অতি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি আরবি শব্দ। ‘শাহাদাত’ অর্থ হলো- সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি। ‘শহীদের’ ভাবার্থ হলো- ‘শহীদ ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সফলতায় তার জীবন কোরবানীর মাধ্যমে তার ঈমানের দাবি পূরণের সত্যতার সাক্ষ্য, সনদ, সার্টিফিকেট বা প্রত্যয়ন প্রদান করলো।’ (সূত্র : মুমিনের বাসনা শাহাদাতের মৃত্যু)
দোয়া কবুলের শর্ত
সাহল ইবনে আব্দুল্লাহ দসতোরী দোয়া কবুলের জন্য সাতটি শর্তারোপ করেন। তা হলো-
১. বিনীত হওয়া।
২. ভয় করা।
৩. আশা করা।
৪. নিয়মিত দোয়া করা।
৫. দোয়ায় একাগ্রতা থাকা।
৬. হালাল রুজি ভক্ষণ করা।
৭. সাধারণভাবে সব মুসলিমকে দোয়ায় শরীক করা।
ইবনে আতা বলেন : দোয়া কবুলের জন্য নির্ধারিত রুকন, বিশেষ সময়, আনুষঙ্গিক শর্ত ও উপায় আছে :
১. রুকনসমূহ হলো- একাগ্রতা, প্রশান্তি, স্থিরতা এবং বিনয়।
২. আনুষঙ্গিক শর্ত হচ্ছে, সত্যবাদিতা।
৩. সময় হচ্ছে, রাতের শেষ ভাগ।
৪. উপায় হচ্ছে, নবী করিম (সা.) এর প্রতি দরুদ পাঠ করা।
নিম্নবর্ণিত স্থান, সময় ও অবস্থায় আল্লাহ চাহে তো দোয়া কবুল হবে।
১. রাতের শেষ প্রহরে।
২. রোজাদারের ইফতারের সময়।
৩. নিরূপায় ব্যক্তি ও মুসাফিরের দোয়া।
৪. আযান ও ইকামতের মাঝ খানে।
৫. রুগ্ন ব্যক্তির দোয়া।
৬. জিহাদের মাঠে কাতারবন্দী মুজাহিদের দোয়া।
৭. জুমার দিনের শেষ প্রহরের দোয়া।
৮. আরাফার দিনের দোয়া।
৯. ফরজ নামাজান্তে দোয়া।
১০. যমযমের পানি পান করার সময় দোয়া।
১১. পুত্রের জন্য পিতার দোয়া।
১২. কোনো মুসলিমের জন্য তার অগোচরে দোয়া।
১৩. মোরগের ডাক শ্রবণকালে দোয়া।
১৪. সাফা মারওয়া পাহাড়ের দোয়া।
১৫. সিজদারত অবস্থায় দোয়া।
হাদীসের চিত্র বিচিত্র
সব কল্যাণ অকল্যাণ আল্লাহর হাতে : হযরত আবু আব্বাস আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, “একদিন আমি রাসূল (স.) এর পিছনে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে যুবক, আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখাবো, আল্লাহকে স্মরণ করবে তো তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহকে স্মরণ করলে তাঁকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে তো আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে তো আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, সমস্ত মানুষ যদি তোমার কোন উপকার করতে চায় তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা ব্যতিত আর কোন উপকার করতে পারবে না। আর যদি সমস্ত মানুষ তোমার কোন অনিষ্ট করতে চায় তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তা ব্যতিত আর কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গিয়াছে।
অহংকার কি?
মুসলিম শরীফের বর্ণনা। ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনাকারী। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- যার অন্তরে কণা পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে বেহেস্তে যেতে পারবে না, এক ব্যক্তি বললো: মানুষতো চায় তার কাপড় ভালো হোক, জুতো ভাল হোক। এটাও কি অহংকার বলে গণ্য হবে? এ ধরনের রুচিবান লোক কি জান্নাতে যেতে পারবে না? রাসূল (স.) বললেন- না এটা অহংকার নয়। আল্লাহ সুন্দর ও পবিত্র। তিনি সৌন্দর্য ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। অহংকার হলো- আল্লাহর ইবাদত যথাযথভাবে না করা এবং তার বান্দাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।
গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ : মেশকাত শরিফ বর্ণিত। আবু সাঈদ ও জাবের (রা.) থেকে উল্লেখিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: হে রাসুল! গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ কিভাবে? রাসুল (স.) বললেন: মানুষ ব্যভিচার করার পর তওবা করলে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। কিন্তু গীবতকারীকে আল্লাহ ততক্ষণ মাফ করবেন না যতক্ষণ যার গীবত করা হয়েছে সে মাফ না করে। মেশকাতের আরেক বর্ণনায় আছে আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন: তোমরা জান গীবত কী? লোকেরা বললো: আল্লাহ ও তার রাসুল (স.) ভাল জানেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন: গীবত হলো নিজের ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে পছন্দ করে না। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হল: হে রাসুল আমি যা বলি তা যদি আমার ভাই এর ভেতরে সত্যিই থেকে থাকে তাহলেও কি তা গীবত? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন: হ্যাঁ, তুমি যা বল তা যদি তার ভিতরে থেকে থাকে তা হলে তা গীবত? আর যা বলছো তা তার ভেতরে যদি না থাকে, তা হলে তুমি তার উপর অপবাদ আরোপ করেছ।
উট কথা কয় : রিয়াদুস সালেহিন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার জনৈক আনসারীর বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটা উট বাঁধা ছিল। উটটি রাসুল (সা.) কে দেখে করুণ সুরে ডেকে উঠলো। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাসুল (স.) সস্নেহে তার ঘাড় ও চুটের উপর হাত বুলালে সে শান্ত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এই উটের মালিক কে? এই উট কার? জনৈক আনসারী যুবক এসে বললো: হে রাসুল (স.) উটটি আমার।
তিনি বললেন: এই বাকশক্তিহীন প্রাণীটিকে আল্লাহ তোমার দায়িত্বে ন্যস্ত করে রেখেছেন। এর ব্যাপারে কি তুমি আল্লাহকে ভয় কর না? এই উট চোখের পানি ও করুণার আওয়াজ দ্বারা আমার কাছে অভিযোগ করছিল যে, তুমি তাকে অভূক্ত রাখ এবং ক্রমাগত কাজে খাটাও।
কুকুরের সেবায় যে ক্ষমা পেল : বুখারী ও মুসলীম শরীফের বর্ণনামতে আবু হোরায়রা (রা.) বলেন: এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার ভীষণ পিপাসা লাগলো। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে সে একটি কুয়া দেখতে পেল। সে ঐ কুয়ায় নেমে পড়লো। সেখান থেকে পানি পান করে পিপাসা মিটালো, সে কুয়া থেকে উপরে উঠে এলো, সে দেখতে পেল একটা কুকুর পিপাসার জ্বালায় জিভ বের করে ভিজে মাটি চেটে খাচ্ছে। লোকটি মনে মনে বললো: আমার যেমন প্রচন্ড পিপাসা লেগেছিল, এই কুকুরটারও তেমনি প্রবল পিপাসা লেগেছে।
সে তৎক্ষণাৎ আবার কুয়ার ভেতর নামলো। নিজের চামড়ার মোজায় ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে ধরে বাইরে এলো। সে কুকুরকে পানি পান করালো। আল্লাহ তার এই কাজের জন্য প্রচুর প্রতিদান দিলেন। তাকে ক্ষমা করে দিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো: চতুষ্পদ জন্তুর সেবা করলেও কি সওয়াব হয়? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন: যে কোন প্রাণীর প্রতি দয়া করলে সওয়াব পাওয়া যায়।
কেয়ামতের দিন সবাইকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে : তিরমিযি শরীফে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন যে- কেয়ামতের দিন প্রত্যেক আদম সন্তানের পা এক বিন্দু সামনে বাড়তে দেওয়া হবে না যতক্ষন পর্যন্ত না তাদের থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর নেয়া হবে। তা হল:
(১) তোমার জীবন কাল কিভাবে কাটিয়েছ ?
(২) তোমার যৌবন কাল কীভাবে কাটিয়েছ ?
(৩) তোমার আয় কোথা থেকে করেছ ?
(৪) উহার ব্যয় কোথায় করেছ ?
(৫) অর্জিত জ্ঞান অনুপাতে কতটুকু আমল করেছ ?
রবিবার ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ দৈনিক সংগ্রাম। http://www.dailysangram.com/post/215951-মুমিনের-গুণাবলী

No comments:

Post a Comment